#প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
৩১.
রাত পৌনে ৯ টা
চারু গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। একটু দূরেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে ধ্রুব। কাউকে কল দিচ্ছে কিন্তু অগত্যা মানুষটি হয়তো কল রিসিভ করতে পারছে না। চারু একটু পর পর উঁকি মারছে ভয়ে কারণ ধ্রুব আবার ওকে এখানে একা ফেলে পালিয়ে না যায়। ধ্রুব ওকে ভালোবাসে কিন্তু বিয়েটা বিপদে পড়ে করেছে তাই চারুর মনে ভয়ের দানা বেড়েছে।
চারু জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে শীতকাল না এখন কিন্তু বাইরের বাতাস ওর কাছে ভালো লাগছে না। শীতল করে দিচ্ছে শরীর গায়ের জর্জেট শাড়ি পেঁচিয়ে বসে আছে কিছু হচ্ছে না উল্টো আরো শীত করছে। চারু নিজেও ধ্রুবর সাথে নামতে চেয়েছিল ধ্রুব তখন ওকে ধমক দিয়ে বলেছে,বের হবে না একদম।
চারু ধমক খেয়ে মিনমিন করে বলেছে,’ বিয়ে করেই ভালোবাসা শেষ হয়ে গেল? এখনি ধমক দিচ্ছেন?
ধ্রুব কটমট করে তাকায় শুধু মুখে কিছু বলে না। চারু মুখ বেঁকিয়ে চুপ করে থাকে। ধ্রুব দশ মিনিট যাবত চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। চারু দুইবার ডেকেছে সাড়া দেয় নাই।
চারু জানালার কাঁচ তুলে বসে আছে এখন ভালো লাগছে। চোখ বন্ধ করে বসে ছিল ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে যায়। হঠাৎ একটা গাড়ির জোরে হর্ন বাজতেই চমকে উঠে। ধরফরিয়ে উঠে চোখ মেলেই চমকে যায়। গাড়িতে এখনো চারু একাই বসে আছে। ধ্রুব নেই পিল চমকে উঠে চারুর। তাড়াতাড়ি কাঁচ নামিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই ঢোক গিলে উঠে। বাইরে ধ্রুব কে দেখা যাচ্ছে না। ধ্রুব কোথায় গেল? চারু মাথা বের করে উঁচু হয়ে ধ্রুব কে খুঁজতে লাগল এলোমেলো দৃষ্টি জোড়া মেলে। না পেয়ে ওর মাথা ভনভন করতে লাগল। চারু শঙ্কিত কন্ঠে ডেকে উঠল। কিন্তু ধ্রুবর সাড়াশব্দ নেই।চারু দরজা খুলে তাড়াতাড়ি গাড়িতে থেকে বেরিয়ে এলো। ওকে একা গাড়িতে ফেলে কোথায় গেল? রাগে ভয়ে কাঁপতে লাগল চারু।
চারু সামনে হেঁটে খুঁজতে শুরু করে দিল। কিছুটা সামনে যেতেই একটা চায়ের দোকান দেখা গেল সেখানে ধ্রুব পায়ের উপর পা তুলে ধোয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ওর পাশে বসে আছে ওর এক ফ্রেন্ড সে কি জানি বলছে। তার চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ। চারু ধ্রুব কে দেখেই নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারল না। কোন সাহস ওকে রাস্তায় গাড়িতে একা ফেলে এসেছে। রাগে ওর মাথা দপদপ করছিল এখন তা ফুস করে বেরিয়ে আসতে চাইল। চারু কোন দিকে ধ্যান না দিয়ে এগিয়ে এসে ছো মেরে ধ্রুবর হাত থেকে চায়ের ওয়ান টাইম কাপ ছিনিয়ে নিল। আচমকা হাত থেকে চা টেনে নিতে ভরকে যায় ধ্রুব মাথা তুলে কিছু বলার আগেই চারু চায়ের কাপ রাস্তায় ছুঁড়ে মারে।
ধ্রুবর বন্ধু চোখ কপালে তুলে চারুর দিকে তাকায়। ঢোক গিলে ধ্রুব কে বলতে লাগে,’ দোস্ত দেশে কি মেয়ের অভাব ছিল? বারুদ বিয়ে করলি। এই মেয়ের যা রাগ প্রথম দিনই দেখেছিলাম এখন তুই সারাজীবন এই হিটলার বউয়ের সাথে সংসার করবি কীভাবে?’
চারু অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাতেই ধ্রুবর ফ্রেন্ড কথা গিলে নিল। শিশির দাঁতের পাটি বের করে হাসির অভিনয় করতে চাইল।
চারু সেসব পাত্তা না দিয়ে রাগে গমগমে সুরে বলে উঠল,’ এই মেয়ে এই মেয়ে করছেন কেন? আপনার বন্ধুর বিয়ে করা বউ আমি আমাকে ভাবি সম্বোধন করবেন। সম্মান দিয়ে কথা বলবেন।’
ধ্রুব বিল মিটিয়ে চারুর হাত ধরে টেনে ওকে দোকান থেকে টেনে এনে বলল,’ তুমি এখানে কি করছো? তোমাকে গাড়ি থেকে নামতে নিষেধ করেছিলাম না?’
চারু ঝামটা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,’ আপনি কোন সাহসে আমাকে গাড়িতে একা শুনশান রাস্তায় অনিরাপদ অবস্থায় ফেলে এসেছিলেন বলুন?’
চারুর চোখে যেন আগুন জ্বলছে।
‘ আপনি আমায় ভালোবেসে বিয়ে করেন নি। বাধ্য হয়ে করেছেন এজন্য এখন এতো অবহেলা করছেন।’ বলতে বলতে চারুর কন্ঠ নরম হয়ে এলো।
ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ চারু তুমি আমার ব্যাপারটা বুঝতে পারছো না। বিয়ের বিষয়টা বাসায় কীভাবে জানাব সেই নিয়েই আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আছি। আম্মুর এই অবস্থা আব্বুর মাথা গরম থাকে। আমি এখন তোমাকে বাসায় নিয়ে কীভাবে সবটা সামলাবো সেটা বুঝতে পারছি না। সবাই কীভাবে রিয়েক্ট করবে আল্লাহ জানেন।’
চারু ধ্রুবর কথা শুনে ঠান্ডা হলো।
চারু দোকানের দিকে তাকিয়ে বলল,’ আমার খিদে লেগেছে। বিয়ের চিন্তায় আমি সকাল থেকে না খাওয়া।’
‘ আসার সময় যে বললাম খেয়ে নাও। তখন তো ভাব নিয়ে বললে খাবে না খিদে নেই।’
‘ ভেবেছিলাম শ্বশুর বাড়ি গিয়ে পেট পুরে খাবো কে জানতো কপালে শ্বশুর বাড়ির খাবার নেই।’
ধ্রুব বলল,’ এখানে খাবার কোথায় পাব?’
‘ ওইযে দোকানে পাউরুটি কলা আছে ওগুলোতেই হবে।’
ধ্রুবর ফ্রেন্ড দোকানেই দাঁড়িয়ে ছিল ভয়ে কাছে আসেনি। চারু কে নিয়ে ধ্রুব আবার দোকানে গিয়ে বসতেই ফিসফিস করে ধ্রুব কে জিজ্ঞেস করল,’ তোর কপাল পুড়ল ধ্রুব। এই মেয়ে তোকে শান্তিতে থাকতে দিবে না।’
ধ্রুব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ ভাবি বল।’
‘ তুই ও?’ মুখ কালো করে ফেলল শিশির।
ধ্রুব সব ফ্রেন্ড এসে জড়ো হলো দোকানে। এসে চারু কে বিয়ের লাল শাড়ি পরে বসে খেতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
ধ্রুব কে ফিসফিস করে মণিকা জিজ্ঞাসা করল,’ দোস্ত এতো জরুরি তলব করে ডাকলি এখন তো তুই পার্টি করার টাইম ও পাস না সারাক্ষণ বিজি থাকিস। এই সময় এই মেয়েকে বিয়ের ড্রেস পরিয়ে বসিয়ে রেখেছিস কেন? বাই এনি চান্স এই মেয়ে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে তোকে ঝামেলায় ফেলতে চাচ্ছে নাকি।’
ধ্রুব কিছু বলার আগেই আরেকজন বলল,’ দোস্ত চিন্তা করিস না এই মেয়ের তোর কোন প্রব্লেম করতে পারবে না।’
ধ্রুব যে চারু কে ভালোবাসে রাহুল আর শিশির ছাড়া কেউ জানে না। মেয়েরা এমনিতেই কথা পেটে রাখতে পারে না। তাই ওদের বলা ইম্পসিবল। এখন যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে তাই ওদের জানাতেই ডেকেছে ধ্রুব। ওদের রিয়েকশন কেমন হবে সেটা ই ভাবছে ধ্রুব।
চারু খাওয়া শেষ করে উঠল গম্ভীর মুখে। অনেকক্ষণ ধরেই দেখছে ধ্রুবর দুই পাশে দুইটা মেয়ে ওর বাহু ধরে কি জানি বলছে ওর দিকে তাকিয়ে। চারু খাওয়া শেষ করার অপেক্ষায় ছিল শুধু। চারু চোখ মুখ কঠিন করে এগিয়ে এলো। তারপর ধ্রুব কে দুজনের মাঝখানে থেকে টেনে বের করিয়ে নিল। দুজনেই ছিটকে উঠে বলল,’ এই মেয়ে এই তোমার সাহস তো কম না তুমি ধ্রুব কে…’
চারু আঙুল তুলে বলল,’ বুঝি না দুজনে আসার পর থেকেই আমার জামাইয়ের গায়ের সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? দাঁড়ানোর কি আর জায়গা নেই? ধরার জন্য আমার বরের হাত দুটোই দুজনের পছন্দ হলো?’
দুজনের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। চারুর কথা শুনে দুজনেই আকাশ থেকে পড়ল যেন দপ করে মাটিতে। চারুর দিকে কিংকিতৃব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল।
চমকানো কন্ঠে ধ্রুব কে জিজ্ঞেস করল,’ ধ্রুব এসব কি বলছে এই মেয়ে?’
ধ্রুব বলল,’ উফ তোদের এক কথায় বিবরণ দিতে দিতেই রাত পার হয়ে যাবে। আমাকে হেল্প করবি কখন আর?’
‘ কি হেল্প?’ বিস্মিত কন্ঠে বলল।
‘ চারু কে বাসায় নিয়ে যাব কীভাবে?’ জিজ্ঞেস করল ধ্রুব।
‘ ওকে তুই কেন বাসায় নিয়ে যাবি?’
ধ্রুব বলল,’ বউ কি বাইরে রেখে যাব?’
‘ তার মানে সত্যি তোরা বিয়ে করেছিস?’
‘ হুম।’
দুজনেই চিৎকার করে উঠল। ধ্রুব চারু কে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসেছে। বাকিরা ও এসে বসলো।
সবাই এখন ভাবছে কি করবে। সবাই বলছে চারু কে বাসায় নিয়ে যাওয়া ভুল হবে। ঝামেলা হতে পারে। আগে সবাইকে ভালো করে ম্যানেজ করে এরপর নিয়ে যাওয়া উচিত।
চারু চুপ করে বসে আছে। ধ্রুব বলল,’ নিয়ে না গেলে ওকে কোথায় রাখবো?’
চারু আঁতকে উঠে বলল,’ আমি অন্য কোথাও যাব না আগেই বলে দিচ্ছি।’
শিশির বলল,’ তোর বাপ যা রাগী রেগে যদি দুজনকে বাসা থেকে বের করে দেয় তখন কি করবি?’
ধ্রুব শিশিরের দিকে রাগী চোখে চেয়ে বলল,’ শিশির সলিউশন দে।’
চারু ধ্রুবর হাত স্পর্শ করে বলল,’ আপনার যদি অনেক বেশি সমস্যা হয় আমাকে বাসায় নিয়ে যেতে তাহলে আমাকে আমার বাসায় রেখে আসুন।’
ধ্রুব বলল,’ তোমার কি মনে হয় তোমার মা ওখানে তোমায় ঢুকতে দিবে? আসার সময় এতো করে বলার পর ও তিনি জোর করেই তোমাকে আমার সাথে পাঠিয়ে দিল।’
চারু বলল,’ দাদু যে বাসায় থাকতো আমাকে কি সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?’
‘ সেখানে কিভাবে দেব চাবি তো আব্বুর কাছে।চাবি আমার কাছে থাকলে তো সমস্যা ছিলই না।’
চারু বুঝতে পারছে ধ্রুবর পক্ষে এখন বাসায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। ওকে আলাদাভাবে থাকতেই হবে সবসময় জোরজবরদস্তি করা উচিত নয়। চারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তা করতে লাগল কি করা যায়।
ধ্রুব হঠাৎ মণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,’ দোস্ত তুই নিজের বাসায় তো ওকে নিয়ে যেতে পারিস। মাত্র এক সপ্তাহ রাখলেই হবে প্লিজ দোস্ত না করিস না।’
মণিকা চমকে উঠল। ওর বাসায় ও কীভাবে নিবে ওর বয়ফ্রেন্ড আসে সেখানে। একা বাসায় থাকে ঠিকাছে কিন্তু সেখানে চারু কে রাখবে। মুখটা ভোঁতা করে তাকাল চারুর দিকে। চারুর কে আগে একটুও পছন্দ করতো না এখন যে খুব করে তাও না কিন্তু ধ্রুব পছন্দের মানুষ তাই দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হয়। সবাই মিলে মণিকা কে চেপে ধরল কয়েকদিন বাসায় চারু কে রাখতে।
ধ্রুব বলল,’ এক সপ্তাহ টাইম দে। আম্মু একটু সুস্থ হলেই আমি আব্বুকে সব জানিয়ে চারু কে বাসায় নিয়ে যাব। প্লিজ দোস্ত।’
হাতজোড় করে বলল ধ্রুব।
চারু মণিকার হাত ধরল ধ্রুবর এতো অনুরোধ অনুনয় দেখে।
‘ আপু প্লিজ আমাকে আপনার সাথে নিয়ে চলুন। আমি খুব ভালো মেয়ে আপনার কোন অসুবিধা হবে না।’
মণিকা সবাইকে হাত উঁচিয়ে বলল,’ থাম তোরা এতো অনুরোধ করার দরকার নেই। আমি আমার বন্ধু কে এইটুকু হেল্প করতেই পারি।’
সবাই মিলে মণিকার ছোটো বাসায় চলে এলো। দুইটা বেড রুম কিন্তু একটা এখন আপাতত স্টোর রুমে পরিণত হয়েছে।
মণিকা কারো সাথে বেড শেয়ার করে না বলল। ধ্রুব বলল,’ একটা তো স্টোর রুম বানিয়ে ফেলেছিস। যাই হোক তুই এখন থেকে ড্রয়িংরুম এ থাকবি।’
মণিকা কপাল কুঁচকে বলল,’ কেন এতো বড়ো বিছানায় তোর বউ কি একা ঘুমাবে?’
ধ্রুব মণিকার মাথায় গাট্টা দিয়ে বলল,’ বলদি নতুন বউ কোনদিন বর ছাড়া একা ঘুমায়? ওই বিছানা এক সপ্তাহের জন্য আমাদের দোস্ত তুই হয় ওই স্টোর রুমে যা নয়ত ড্রয়িংরুম এ থাকা স্টার্ট করে দে।’
মণিকা চিৎকার করে উঠল,’ আমার রুম থেকে আমাকেই বের করে দিলি?’
ধ্রুব চারু কে নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। মণিকা চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগল। শিশির আর রাহুল বলল,’ দোস্ত কুল ডাউন। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে এখন ওরা আলাদা থাকবে কেমন দেখা যায় বল। একটু এডজাস্ট করে নে প্লিজ।’
‘ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে তোরা আমায় ঘর ছাড়া করলি হারামির দল।’
সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেল। মণিকা দরজা আটকে সোফায় মুখ কালো করে বসে নিজের বয়ফ্রেন্ড কে কল দিল।
#চলবে….
Nondini Nila
#প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
৩২.
আজ এক সপ্তাহ পার হলো ধ্রুবর সাথে চারুর কন্টাক্ট নেই। সেই যে এক সপ্তাহ আগে চারু কে নিয়ে মণিকার বাসায় এসেছিল ধ্রুব রাতটা ধ্রুব ওর সাথেই ছিল সকালে চলে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায়, রাতে আসবে।
চারু সারাদিন ধ্রুবর অপেক্ষায় থাকে। রাতে ধ্রুব আসবে এদিকে সন্ধ্যায় ব্যাগ প্যাক করে মণিকা বলে,’ আমার বাসা থেকে কল দিয়েছিল সবাই গ্রামে যাবে। আমি যাই কেমন? আমি ধ্রুব কে জানিয়ে দিয়েছে ও একটু পরই চলে আসবে তুমি থাকো কেমন।’
চারু হ্যাঁ না কিছুই বলে না শুধু স্তব্ধ হয়ে যায়। সারাদিন তো মণিকা ওর আশেপাশে ছিল বাসা থেকে কল দিল কখন? আর আলমারির সব জামাকাপড় নিয়ে চলে যাচ্ছে কেন সেটাই ভাবছে চারু। সেই যে মণিকা গেল আর মণিকার খবর পায়নি চারু। রাতে আর ধ্রুব আসেনি বাসায়। হঠাৎ যেন উধাও হয়ে গেল নাম্বারে কল দিলেও সংযোগ হচ্ছে না বলে। গলা শুকিয়ে যায় চারুর। রাতটা একাকী কাটিয়ে সকালে বাসা থেকে বের হয় চারু। ধ্রুব বাড়িতে তো চারু গিয়েছিল কিন্তু এখন সেই ঠিকানা একটু মনে নেই চারুর। দিশেহারা লাগছে চারুর। মাথা এলোমেলো হয়ে আসছে কি হচ্ছে ওর সাথে কিছুই ওর মাথায় আসছে না। বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারে তারা বিদেশে থাকে। বাড়ির দেখাশোনা করে দাড়োয়ান তার সাথে কথা বলে জানতে পারে ওই রুম নাকি এক সপ্তাহের জন্য ভাড়া নিয়েছিল মণিকা। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে চারুর। মণিকা তো ওখানে থাকে এমনটাই বলল তাহলে এক সপ্তাহের জন্য ভাড়া নিয়েছে বলছে কেন উনি। চারু নিজের বাসায় যাওয়ার কথা ভাবে কিন্তু সেখানে গিয়ে কি করবে? ও ধ্রুবর দাদুর বাসায় গিয়ে ঘুরে আসে। হাতে বেশি টাকা ও নেই। ধ্রুব যাওয়ার আগে এক হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছিল সেগুলো দিয়েই চলছে।
কিন্তু ওর মাথায় কিছুই ঢুকছে না ধ্রুব হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল? ধ্রুবর মা যে হসপিটালে ভর্তি ছিল চারু সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। কোথায় যাবে সেই চিন্তা শক্ত হয়ে চারু বিছানায় বসে আছে। আজকে বাসা ছেড়ে দিতে হবে।
চোখ ফেটে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে চারুর। যার হাত ধরে বের হলো বাসা থেকে সেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেল? ওর সাথে এসব কি হচ্ছে এখন ও কোথায় যাবে বিয়ের এক রাত তারপর ধ্রুব নিখোঁজ হদিশ মিলছে না ওর। এখন ওর কি হবে? কোথায় যাবে ও? বাসায় গেলে কম অত্যাচারিত ওকে হতে হবে না সবাই ওর উপর ভীষণ খ্যাপা।
শূন্য হাতেই বাসা ছেড়ে বেরিয়ে এলো চারু এখন নিজের বাড়ি যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
ধ্রুব কি কোন বিপদে পরেছে? ওর মা ঠিক আছে তো? চারু চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে বাসস্ট্যান্ডে। খা খা করা রোদে পুড়ে যাচ্ছে ওর শরীর। চঞ্চল চোখ জোড়া ধ্রুব কে খোঁজে চলেছে। চারু বাসে উঠে বসে আছে মন মরা হয়ে। এতো দিন ধ্রুবর আসেপাশে থেকে হঠাৎ ধ্রুব কে নিখোঁজ হয়ে যেতে দেখে ও স্তম্ভিত হয়ে গেছে। ধ্রুব কি হারিয়ে গেল?
বাসার সামনে এসে দাড়িয়ে আছে চারু। কাঁপা পায়ে চারু গেইট খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দরজায় টোকা দিল। ভেতরে থেকে ময়না বেগম এসে দরজা খুলে দিলেন। চারু কে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ময়না বেগম কপাল কুঁচকে বললেন,’ আবার কি চাই? আমাদের তো নিঃস্ব করে দিয়ে চলে গেলি। তোর জামাই বলল টাকা দিবে কই পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছিল। এখন এক সপ্তাহ ধরে ফোন বন্ধ করে রেখেছে। কত বড়ো শেয়ানা ছেলে। বউ হাতে পেয়ে এখন আমাদের ভুলে গেছে।’
চারু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ময়না বেগম দরজা খুলে বাইরে এলো চারু ভেতরে ঢুকে গিয়েছে।
ময়না বেগম ধ্রুব কে উঁকিঝুঁকি মেরে খোঁজে ভেতরে এসে বললেন,’ কই ধ্রুব কোথায়? একাই এসেছিস নাকি?’
চারু বলল,’ আমি একাই এসেছি মা।’
ময়না বেগম কপাল কুঁচকে নিলেন।
‘ কেন একা কেন? আর এসব কি পরে এসেছিস? এতো বড়োলোক বাড়ির ছেলের হাত ধরে গেলি স্বর্ণের কোন গহনা ও তো কানে গলায় দেখছি না। কিছুই দেয় নাই নাকি।’
ভেতরে থেকে সিঁথি এগিয়ে এসে ফোড়ন কাটল,’কি সব বলছো মা। ওকে ওই বাড়ির কেউ মেনেছে নাকি। মুখটা কেমন মরা মরা লাগছে না দেখতে আমার তো মনে হয় ওকে ঘাড় ধরে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।’
চারু ছলছল চোখে তাকাল সিঁথির দিকে।
সিঁথির ঠোঁটে কুটিল হাসি। চারু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কোন প্রত্যুত্তর করছে না দেখে ময়না বেগম জিজ্ঞেস করলেন,’ সত্যি করে বলতো কি হয়েছে তোকে ওরা বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে নাকি?’
চারুর চোখ ফেটে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল। ভেতরে জমে থাকা চাপা কষ্ট উপচে পড়ল। আচমকাই চারু ময়না বেগম কে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ফুপানো কন্ঠে সবটা খুলে বলল।
সব শুনে সিঁথি বলল,’ বেশ হয়েছে। ধ্রুব তোকে ভালোবাসে এটাই তো বিলিভ যোগ্য না। ও নিশ্চিত তোকে ভালোবাসার বিয়ে করার নাটক করেছে। হাহাহা
সিঁথির কথায় চারু কথা বলল,’ ধ্রুব নিশ্চিত কোন বিপদে পড়েছে। মা তুমি ধ্রুবর বাসার ঠিকানা যোগাড় করে দিতে পারবে?’
ময়না বেগম তো আনন্দে আটখানা হয়ে গেছেন। বেশ হয়েছে বাড়াবাড়ি করে উনার বিরুদ্ধে গিয়ে খুব তো বিয়ে করেছিস এখন জামাই হাতে হারিকেন ধরিয়ে পালিয়েছে উচিত হয়েছে।
ময়না বেগম মুখ গম্ভীর করে বললেন,’ আমি ওই পোলার ঠিকানা কোথায় পাব?’
‘ মিথ্যা বলো না মা। তুমি তো আমাকে খোঁজে খোঁজে চলে গিয়েছিলে মনে নেই? আমাকে তো রাতে নিয়ে গিয়েছিল বাসায় আর যখন এসেছি তখন অনেক বেশি শকে ছিলাম তাই আমি আশপাশ টা তেমন খেয়াল করিনি এজন্য সঠিক করে খোঁজে নিতে পারছি না।’
চারু আচমকাই ময়না বেগমের পা চেপে বসে পড়ল,’ মা প্লিজ আমাকে ঠিকানা টা দাও। আমি ধ্রুবর খবর নিতে যাব।’
ময়না বেগম আমতা আমতা করতে লাগলেন। সিঁথি ইশারায় শাসিয়ে দিচ্ছে কোন ভাবেই যেন ঠিকানা না দেয় চারু কে।
সিঁথি এগিয়ে এসে টেনে চারুকে ফ্লোর থেকে তুলে বলল,’ দেখ চারু আমাদের কাছে ঠিকানা নেই। আর থাকলেও তোকে দেব না। ভুলে যাস না আমার ধ্রুব কে তুই কেড়ে নিয়েছিস। ধ্রুব একবার তোর হাত ছেড়ে বেরিয়ে গেছে মানে ও চায়না তোর সাথে থাকতে। তুই কি ওর যোগ্য বলতো? ধ্রুব কি দেখে তোকে বিয়ে করতে পাগলামি করলো আমি জানি না। কিন্তু ও তোকে ছেড়ে দিয়ে উচিত কাজ করেছে। এখন চুপচাপ নিজের ঘরে যা খুব তো বড়োলোক বাড়ির বউ হতে চাইছিলি হতে পারলি না এতো সুখ তোর কপালে সইবে না বুঝছিস। তোকে আমাদের পায়ের তলায় থাকতে হবে কথাটা মাথায় ভালো করে ঢুকিয়ে নে। মায়ের কথায় বিয়েটা করে নিলে বুড়ো জামাই পেলেও সুখ পেতি বেশি লোভ করে এখন কিছুই পেলি না।’
চারু কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে চলে এলো।
সিঁথি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’ মা আমার যে কি খুশি লাগছে। খুব উড়ছিল ধ্রুব ওর সাপোর্ট নেওয়ার জন্য এখন বুঝবে ঠ্যালা।’
‘ কিন্তু যে ছেলে এতো যুদ্ধ করে ওকে বিয়ে করে নিয়ে গেল এমন ভাবে ওকে ছেড়ে দিল কেন? সেটাই তো আমার মাথায় ঢুকছে না। তাহলে কি সব নাটক ছিল?’ বিস্মিত কন্ঠে বললেন ময়না বেগম।
সিঁথি বলল,’ অফকোর্স এসব নিশ্চিত ওই ধ্রুবর কোন প্লান ছিল। ও চারু কে ভালোবাসে আমার কখনোই বিলিভ হয়নি কিন্তু এমন ভাবে বিয়ে করে কি করল আমিও বুঝিনি কিন্তু চারুর শিক্ষা হয়েছে। ও আর তোমার আমার কথার বিরুদ্ধে যেতে পারবে না। ভালো শিক্ষা পেয়েছে বেচারা।’
চারু রুমে থেকে সব কথাই শুনছে। ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ধ্রুব কি তাহলে ভালোবাসা নিয়ে মিথ্যাচার করল?
ও কী নিজের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এতো বড়ো গেইম খেললো ওর সাথে?
চারু মাথা ভনভন করছে। বুকের ভেতর টা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।
ঢাকা শহর কি ছোট্ট? ওকে যেভাবেই হোক ধ্রুবর বাসায় যেতেই হবে। চারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল,’ আমি উলটো পাল্টা ভাববো না ধ্রুব তো বিপদেও থাকতে পারে। আন্টি হসপিটালে ছিল। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল তিনি কেমন আছে মায়ের জন্য হয়ত ধ্রুব ওর খোঁজ নিতে পারছে না। মণিকা হয়তো ধ্রুব কে মিথ্যা বলেছিল বাসা নিয়ে।’
চারু নিজের মনকে নিজেই সামলে নিচ্ছে।
#চলবে….?
#প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
৩৩.
চারু দুরুদুরু বুকে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় এতো মানুষ এতো সাজানো গোছানো কেন? গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে চারু ভাবছে কি হচ্ছে এই বাসায়? আচ্ছা ধ্রুবর মা ঠিক আছেন তো? ধ্রুবর মায়ের কিছু হয়ে যায়নি তো?
চারু গেইটের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সামনে দিয়ে অনেকেই বাসার ভেতরে প্রবেশ করছে অনেকে বাইরে বের হচ্ছে। চারু ঢোক গিলে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢুকতে গেলে ওকে যদি দাড়োয়ান আটকে দেয়? নিজের পোশাকের দিকে তাকিয়ে আরো হতাশ হলো আজ কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে এই বাসায় সবাই দামী পোশাক পরে যাচ্ছে আমি এমন একটা ড্রেস এ বেরিয়েছি খুব নগন্য লাগছে নিজেকে।
চারু অনেক কষ্টে ধ্রুবর বাসায় ঠিকানা পেয়েছে। তারপর আর এক সেকেন্ড বিলম্ব করেনি ছুটে এসেছে বাসায় যে ড্রেসে ছিল সেই ড্রেসেই। যতই হোক এই বাড়ির বউ চারু এভাবে বাসায় ঢুকতে খুব লজ্জা ও সংকোচ বোধ হচ্ছিল চারুর। কাঁপা পায়ে চারু এগিয়ে এসে বাসায় ঢুকতে চেষ্টা করে।
দাড়োয়ান আটকে দিতে গিয়েও আটকালো না চারু কে। চারু একবার ভাবলো দাড়োয়ান চাচাকে জিজ্ঞেস করবে বাসায় কিসের অনুষ্ঠান হচ্ছে।
চারু জিজ্ঞেস করতে পারল না। কারণ তীক্ষ্ণ চোখে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে যাচ্ছে ও তাই গেইটে সময় পাস না করে তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল।
ভেতরে গিয়ে এখন সবাইকে নিজের দিকে অবহেলার চোখে তাকাতে দেখে চারু নিজের ওড়না বারবার টেনে নিচ্ছিল। সদর দরজার সামনে গিয়ে দাড়াতেই একজন ভদ্রলোক ওকে দেখে বিরক্তিকর ভাবে এনে বলে উঠলেন,’ এইদিকে কি কাজ? ফকির মিসকিন ওইদিকে যা ওইদিকে যা।’
চারু থতমত খেয়ে গেল। ভদ্রলোকটা হাত দিয়ে বাগানের দিকে দেখিয়ে দিচ্ছে। চারু আমতা আমতা করতে লাগল। ও বারবার বলতে চাইল আমি ফকির মিসকিন না। আমি এই বাড়ির বউ আমাকে ঢুকতে দিন। চারু ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে দেখে ভদ্রলোক আগের থেকে ও বেশি বিরক্তি নিয়ে বললেন,’ কি হলো এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন দেখছিস না গেস্ট আসছে সর সামনে থেকে।’
চারু চমকে উঠল। ধমকে কেঁপে উঠেছে ওর বুকখানি। ধ্রুব কোথায় নিরাশ চোখে ভেতরে উঁকি মারলো কিছুই দেখতে পারছে না ভেতরে গিজগিজ মানুষ।
চারু ধমক খেয়ে ভদ্রলোকের দেখিয়ে দেওয়া বাগানে এসে থামতে হলো। দেখল সেখানে গরিবের খাবার দেওয়া হয়েছে। সবাই পেট পুড়ে খাচ্ছে। কি উপলক্ষে এই খাবারের আয়োজন জানার জন্য চারুর মনটা আনচান করছে। ভয় করছিল অনেক। ও এসে দাড়াতেই খাবার পরিবেশন করা ছেলেটা বলে উঠল,’ তাড়াতাড়ি বসে পড়ো। খাবার কিন্তু শেষ হয়ে গেলে আর পাবে না।’
চারু কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল অনেক সাহস সঞ্চয় করে,’ ভাইয়া এইখানে কিসের আয়োজন হয়েছে?’
লোকটা খুব ব্যস্ত কথা বলতে পারছে না। ব্যস্ত হয়ে একটা ওয়ান টাইম প্লেট এনে চারুর হাতে দিল। তারপর বলল,’ বসো।’
চারুর পাশেই একটা মহিলা বসে খাচ্ছিল তৃপ্তি করে মহিলাটা চারুর হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিয়ে বলল,’ কি লো ছেড়ি খাস না ক্যান। বয় জলদি খাওন শেষ হইলে খাবি কি?’
চারু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহিলা টার দিকে। নিজের শ্বশুর বাড়ি এসে এমন ভাবে ওকে খেতে বসতে হবে কল্পনাতেও ভাবেনি।
ততক্ষণে পরিবেশন করা ছেলেটা চারুর প্লেট ভর্তি করে এনেছে। চারুর সামনে প্লেট রাখতেই চারু লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল ছেলেটাকে,’ প্লিজ বলুন না এখানে কিসের আয়োজন চলছে।’
বলতে বলতে চারু হাত জোর করে ফেলল। ছেলেটা বিস্মিত হয়ে তাকাল চারুর দিকে। ছেলেটার নাম সামি। ছেলেটা এই বাসায় কাজ করে। চারুর খাওয়ার থেকে জানার আগ্রহ দেখে বিস্মিত হয়ে বলল,’ তুমি কি খেতে আসো নাই?’
চারু বলল,’ না আমি খেতে আসিনি।’
‘ তাহলে কেন এসেছো?’ চমকিত কন্ঠে বলল সামি।
‘ আমি একজন কে খুঁজতে এসেছি?’
কাঁপা কন্ঠে বলল চারু।
ছেলেটি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে বলল,’ কাকে?’
‘ আছে একজন আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন।’
সামি বলল,’ বড়ো সাহেবের ছেলের এনগেজমেন্ট হচ্ছে ভেতরে। আমার অনেক কাজ আছে তোমার সাথে কথা বলতে পারছি না। তুমি খেতে না আসলেও খেতে পারো খাবার রইল।’
চারু স্থির দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় এনগেজমেন্ট হচ্ছে? কার এনগেজমেন্ট? এই বাসায় বড়ো সাহেবটা কে? ধ্রুবর বাবা কি? ধ্রুবর তো আর ভাই বোন নেই। ধ্রুব তো এনগেজমেন্ট করবে না আমি থাকতে আরেক মেয়েকে ধ্রুব কীভাবে আংটি পরাবে?
চারু ভেতরে যাওয়ার জন্য ছুটলো। এদিকে সেই মহিলাটা চারুকে পেছনে থেকে খাওয়ায় জন্য ডাকল চারু না শোনায় বিড়বিড় করে বকল। তারপর নিজের লুকিয়ে রাখা পলি বের করে প্লেটের খাবার পলিতে ভরে নিল।
খাওয়া শেষে এটা সাথে করে নিয়ে যাবে।
চারুকে আবার গেইটে সামনে এসে দাড়াতে দেখে মজনু এবার রেগে গেলেন। একটু আগেই এই মেয়েকে তিনি যেতে বললেন আবার এখানে কি করছে?
‘ এই তোরে বললাম না এইখানে থেকে যেতে।’
চারু বলল,’ আঙ্কেল প্লিজ আমাকে ভেতরে যেতে দিন আমার ভেতরে যাওয়াটা খুব জরুরী।’
মজনু বলল,’ কিসের জরুরী হ্যাঁ? চুপচাপ বের হও। ফকির মিসকিন ভেতরে যাওয়া নিষেধ।’
চারু বলল,’ আমি ফকির মিসকিন না। আমাকে ভেতরে যেতে দিন।’
‘ বের হবি নাকি তোকে চুলের মুঠি ধরে বের করতে হবে বল আমায়।’
চারুর রাগ মাথায় উঠে গেল।
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল,’ আপনার এতো বড়ো সাহস আপনি আমায় চুল ধরে বের করার হুমকি দেন। ধ্রুবর সাথে একবার দেখা হোক তারপর দেখব আপনি এখানে দাঁড়িয়ে হুকুমগিড়ি কিভাবে করেন।’
পরক্ষনেই মনে হলো,’ আচ্ছা ধ্রুবর সাথে দেখা হবে তো?’
চট করেই চারু নিচু হয়ে মজনুর পা চেপে ধরল,’ আঙ্কেল প্লিজ একবার যেতে দিন। আমি আপনার পায়ে পড়ছি।’
মজনু পড়ল বিপাকে এই মেয়ে তো প্রচুর জেদি এই মেয়ে বাসায় ঢুকতে এতো নাছোড়বান্দা হচ্ছে কেন?
কি সমস্যা এই মেয়ের?
মজনু চারু কে বলল,’ দাঁড়া।’
চারু উঠে দাঁড়াল।
‘ তোর মতলবটা কি বলতো? তুই বাসায় ঢোকার জন্য এতো হাতে পায়ে ধরছিস কেন?’
চারু টলমল চোখে চেয়ে আছে। সত্যি টা না বলতে পারার যন্ত্রণায় ওর বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।
চারু শুকনো ঢোক গিলে বলল,’ আসলে কখনো বড়োলোক বাড়ির বিয়ে এনগেজমেন্ট পার্টি দেখিনি তো তাই খুব দেখার সাধ জেগেছে। পাঁচ মিনিটের জন্য আমাকে ঢুকতে দিন আমি দূর থেকে একঝলক দেখেই চলে আসবো কারো কোন সমস্যা হবে না। প্রমিজ।’
মজনু সন্দেহের চোখে চারুর দিকে তাকিয়ে আছে। চারু ভয়ার্ত ঢোক গিলল। মিথ্যে বলার কোন ইচ্ছা চারুর ছিল না কিন্তু মিথ্যা বলা ছাড়া আর কোন উপায় পেল না। তাই বাধ্য হয়েই বলতে হলো।
মজনু কেমন জানি অবিশ্বাস্য চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
চারু আবার বলল,’ আপনি আমায় কি সন্দেহ করছেন?’
‘ তুই আমায় মিথ্যে বলে বাসায় ঢোকার চেষ্টা করছিস না তো? এমন যদি হয় তোর কপালে শনি আছে মনে রাখিস।’
গমগমে কন্ঠে বললেন মজনু।
চারু ঢোক গিলে বলল,’ আমি সত্যি বলছি আপনি বিশ্বাস করুন।’
মজনু বলল,’ আচ্ছা যা। কেউ যেন তোকে না দেখে বেশি ভেতরে যাবি না। এইদিক দিয়ে গিয়ে ওই কোনায় দাঁড়িয়ে দেখবি। তারপর সবার আড়ালে চলে আসবি সময় মাত্র পাঁচ মিনিট। যাবি আর আসবি।’
‘ ওকে আমি যাব আর আসবো।’
বলেই একটা মিষ্টি হাসি দিল চারু। মজনু ভাবছে মেয়েটার মিষ্টি কথায় গলে গিয়ে ভুল করলাম না তো?
তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। পাঁচ মিনিট হবার অপেক্ষায়। মজনু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সামি এসে বলল,’ কাকা কি হয়েছে? তুমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছো কেন?’
‘ আর বলিস না এক মেয়ে আইসা বলল তার নাকি খুব বড়ো লোকের বিয়ে দেখার সাধ আমার সাথে জোরাজুরি করে ভেতরে গেল।’
‘ তোমার সাথে একটা মেয়ে জোরাজুরি করে ভেতরে চলে গেল? কাকা তোমার শরীরের জোর এতো কম?’ চোখ বড়ো বড়ো করে বলল সামি।
মজনু রাগী কন্ঠে বললেন,’ আমার শরীরে জোর কম আয় তোকে দুইটা ঘুসি মেরে দেখিয়ে দেই কার শরীরে কেমন শক্তি।’
‘ তাহলে মেয়েটাকে ভেতরে যেতে দিলে কেন? একটা মেয়ে বলল আর তুমি তাকে যেতে দিলে?’
‘ কি জানি মাইয়ার উপর হঠাৎ মায়া হলো। এখন তো আসছে না পাঁচ মিনিট তো শেষ তুই একটু ভেতরে গিয়ে দেখ না।’
সামি বলল,’ আমার কাজ আছে কাকা আমার এসব দেখার টাইম নাই। কাজে ভুল হলে তখন বড়ো সাহেবের কাছে বকুনি খেতে হবে। তুমি তোমার ঝামেলা মেটাও আমি যাই।’
বলেই সামি চলে গেল। মজনু বিড়বিড় করে বকলো সামি কে দরজা ছেড়ে তো যাওয়া ও যাবে না। দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মজনু ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ভয়ে তার কপাল ঘামছে। মেয়েটা ওকে নরম সুরে কথা বলে বোকা বানালো নাকি? শার্টের হাতা দিয়ে কপাল মুছে হাঁসফাঁস করতে লাগল। একবার মেয়েটা বেরিয়ে আসুক মেয়েটার সরল মুখ দেখিয়ে আমাকে গাধা বানানোর শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব।
ময়না বেগম ঘরে ঢুকে দেখে চারু নেই। আবার পালিয়েছে। এবার কোথায় গেল? ময়না বেগম চারু কে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে সিঁথি কে নিয়ে বেরিয়েছিল।
সিঁথি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’ আবার পালিয়েছে। ওকে আটকে রাখা যাচ্ছে না মা। ও এতো শয়তান হয়েছে এবার বাড়ি আসলে ওকে কোনভাবেই ঢুকতে দিবে না।’
ময়না বেগম রাগে গজগজ করে বললেন,’ ও বাড়ি আসুক। এইবার বাড়ি আসলে ওকে আমি মেরেই ফেলবো সিঁথি দেখিস। হা রা ম জা দি দুই দিন পর পর বাড়ি থেকে পালাবে আর আমি ওকে বাসায় আয়েশ করে খাওয়াবো তাই না।’
সিঁথি ভয়ে ভয়ে বলল,’ মা চারু ধ্রুবর বাসার ঠিকানা পেয়ে গেল নাকি?’
‘ কীভাবে পাবে তুই বলেছিস?’
‘ কি বলছো আমি ওকে কেন বলতে যাব। আমার কি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারব। আমার কি মাথা খারাপ নাকি?’
‘ তুই বলিস নাই আমিও বলি নাই তাহলে ও কিভাবে বাসার ঠিকানা জোগাড় করবে?’
‘ বুঝতে পারছি না কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে চারু যেভাবেই হোক ঠিকানা পেয়েছে তাই তো এমন জানালা দিয়ে পালিয়েছে।’
‘ পেলেও কি ওই পোলা কি ওরে বাড়ির বউ করার জন্য ছেড়ে গেছে। নিশ্চিত ছেলেটা বদের হাড্ডি ইচ্ছে করে কোন ছক কষে এই কাজ করেছে।’
‘ সেটাই আমিও ভেবেছি মা। কিন্তু আমার তো ভয় হয়। ধ্রুব কে পেলাম না তাতে আমার আফসোস নেই কিন্তু ধ্রুবর সাথে চারু সুখে শান্তিতে কাটাবে এসব দেখলে আমি সহ্য করতে পারব না। ধ্রুব যেন আর না আসে চারুর জীবনে তুমি শুধু এই দোয়া করো মা।’
‘ আমিও কি আর চাই রে আমার পোষা বিড়াল আমার হাতের নাগালের বাইরে চলে যাক। ধ্রুব যেভাবে আমাকে নাস্তানাবুদ করে চারু কে বিয়ে করেছে আমি তো প্রতি মিনিটে এক কথাই জপী ওই শয়তানের উচিত শিক্ষা হোক দুটোতে সারাজীবনের জন্য আলাদা হয়ে যাক।’
মা মেয়ে শয়তানি হাসি হাসছে আর ইচ্ছে মতো নিজেদের মতো করে বরদোয়া দিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে মা মেয়ের দোয়া কে হয়ত কবুল করে দিচ্ছিল আল্লাহ পাক। চারু ভেতরে এসে কাঁপছে। এতো অপরিচিত মানুষের সামনে খুব সংকোচ লাগছিল। চারু দুটো চোখ শুধু ধ্রুব কে খুঁজছিল। এলোমেলো দূর্বল পা জোড়া ফেলে চারু হাঁটছে। মজনু আঙ্কেল ওকে যেখানে দাঁড়াতে বলছিল ও সেখানে দাঁড়ায় নি। ড্রয়িংরুম ঘুরছে চরকির মতো। কেউ ওকে সেভাবে খেয়াল করছে না। কারণ এখন আংটি পরানোর টাইম সবাই সামনে তাকিয়ে আছে। সেখানে একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে ভীড় ঠেলে চারু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার মাথা ছাড়া কিছুই দেখতে পারছে না ও কি এতোটাই বেঁটে? সবাই তো দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু ও মেয়েটার মুখ ছাড়া কিছুই দেখতে পারছে না মেয়েটা এইদিক করে আছে তাই তার মুখটা দেখল সুন্দর হাস্যোজ্জ্বল মুখ। দূর থেকে রাজকন্যা লাগছে মেয়েটাকে। ঠোঁটের কোনে কি সুন্দর মিষ্টি হাসি। মুগ্ধ হয়ে গেল চারু। সামনে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ওদের দিকে পিঠ দিয়ে। চারু উঁকিঝুঁকি মারছে তার মুখ দেখার জন্য। কিন্তু ছেলেটা ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে নড়ছে না নড়লেও এই দিক ফিরছে না। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে চারু নিজের উত্তেজনাকে সামালে নিতে পারছে না। গা ছমছম করছে মানুষ কে জানার জন্য। কার এনগেজমেন্ট হচ্ছে ও পা উঁচু করে ঘাড় কাত করে সামনে দেখছে হঠাৎ কেউ ওকে সজোরে ধাক্কা দিল। ভীড়ের মধ্যে থেকে ওকে টেনে বের করিয়ে আনলো। পিল চমকে উঠল চারুর। চারু দেখল মজনু আঙ্কেল আগুন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
তিনি ওর হাত ধরে ভীড় থেকে টেনে এনেছে।
চারু মিনমিনে সুরে বলল,’ আঙ্কেল আপনি আমায় এভাবে টেনে আনলেন কেন?’
‘ এই মেয়ে তুই আমায় বলেছিলি না পাঁচ মিনিটের জন্য আসছিস। তুই আমায় মিথ্যা বলিস এতো সাহস তোর?’
চারু ঢোক গিলে বলল,’ ক্ষমা করে দিন আঙ্কেল আসলে এখনো তো আংটি পরানো হয়নি তাই একটু দেরি করেছি একটু দেখতে দিন না আঙ্কেল আমি তো কারো কোন সমস্যা করছি না। কেউ আমায় সেভাবে খেয়াল ও করেনি। একটু যেতে দিন না।’
বলতে বলতে চোখের পানি ছেড়ে দিল চারু।
মজনু বললেন,’ তুই তো খুব চালাক মেয়ে কিছুই বললেই সরল মুখ করে আমার মনটা নরম করে দিস। তখন তো তোর কথা না শুনেই পারি না। যা তো তাড়াতাড়ি দেখে চলে আসবি আমার আর যেন আসতে না হয়।’
‘ আর আসতে হবে না।’
চারু এসে দেখল ছেলেকে আংটি পরানো শেষ। এবার ছেলে মেয়েকে পড়িয়ে দিবে। চারু এবার আরেকপাশে চলে এসেছে। এবার সরাসরি পাত্রের মুখ দেখা যাচ্ছে। পাত্র মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভীড়ের মধ্যে চারু মুখটা চিনতে পারছে না কিন্তু কপাল দেখেই ওর বুক ধুকপুক বেড়ে গেছে। পাত্র মুখ তুলতেই চারুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। নিঃশ্বাস আটকে এলো যেন। চারু নিজের শরীরের শক্তি ছেড়ে দিয়ে দপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল। ভীড়ের মধ্যে চারু পা ছড়িয়ে বসতেই আশেপাশের সবাই চমকে উঠল। চারুর চোখে থেকে এক দলা নিস্তেজ জল চিকচিক করে গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। চারু বিড়বিড় করে বলল,’ তারমানে ধ্রুব আমায় ভালোবাসেনি! ধ্রুব প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার সাথে বিয়ের অভিনয় করেছে আ মি আ মি কত বোকা আমি ওর ড্রামা কে ভালোবাসা ভেবে ওকে বিশ্বাস করে নিজের সব দিয়ে দিলাম আর ও আমার উপর প্রতিশোধ নিলো।’
চারু ওখানেই অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়ল। ফ্লোরে চারুর মাথাটা ঠাস করে পড়ল। আশেপাশের সবাই বিস্মিত হয়ে ওর পড়ে যাওয়া মাথাটার দিকে তাকিয়ে আছে।
#চলবে…..?