#প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
৩৪.
চারু যখন চোখ পিটপিট করে তাকালো দেখল একটা অপরিচিত মহিলা ওর দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে। চারু কোথায় আছে বুঝতে চেষ্টা করছে। হঠাৎ চারু লাফ দিয়ে উঠে বসল। চারু কে উঠতে দেখেই মহিলা দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
মহিলার সাথে মজনু কে এগিয়ে আসতে দেখে চমকাল চারু। চারু মলিন মুখে তাকিয়ে আছে।
মজনু রেগেমেগে বললেন,’ মাইয়াটার মায়ায় পরে আমি এতো কষ্ট করে ওকে ভেতরে পাঠালাম। সে নাকি কোনদিন বড়ো লোকের বিয়ে এনগেজমেন্ট দেখে নি। আমি ওকে পাঠালাম কিন্তু ও কি করল! আমাকে হবার সামনে বেইজ্জতি করতে অচেতন হয়ে গেল। বলি তুই কি আর অজ্ঞান হবার জায়গা পেলি না? আমাকে বিপদে ফেলতে ভেতরে গিয়েই অজ্ঞান হলি?’
চারু কথা বলছে না মাথা নিচু করে একনাগাড়ে চোখের জল ফেলছে। মজনু যা নয় তাই বলে চারু কে অপমান করে যাচ্ছে। মজনুর স্ত্রী চারু কে বেসামাল হয়ে কাঁদতে দেখে স্বামী কে রুমের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। এখানে থাকলে এই লোক থামবে না। চারু কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে উঠেছে। ফর্সা মুখটা লাল টকটকে হয়ে উঠছে কান্নার ফলে।
মজনুর স্ত্রী মাহমুদা চারুর কাঁধ চেপে ধরে বললেন,’ কি ব্যাপার এতো কাঁদছো কেন? কি হয়েছে তোমার?’
চারু দুহাতে বারবার চোখের জল মুছে নিজেকে সামলাতে চাইছে কিন্তু পারছে না। হেঁচকি উঠে যাচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে।
মাহমুদা গ্লাসে পানি এনে বললেন,’ পানি খাও। নিজেকে সামলাও। তোমার বাসা কোথায় কোথা থেকে এসেছো?’
চারু একটা কথাও বলতে পারল না। বেসামাল হয়ে শুধু কাঁদছে। মাহমুদা কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ একটু আগেই তার স্বামী এই অচেনা মেয়েকে দুটো মেয়ের দ্বারা এখানে নিয়ে এসেছে। বাসার বাইরে তাদের থাকার ঘর। সেখানে চারু আছে। চারু আধা ঘন্টা ধরে শুধুই কাঁদল। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নিজের নাম পরিচয় কান্নার কোন কারণ ই মাহমুদা জানতে পারল না। অবাক হয়ে চারুর নির্লিপ্ততা দেখলেন মাহমুদা।
মাহমুদা অনেক বলে এক ফোঁটা পানি ও খাওয়াতে পারল না চারু কে।
চারু মুখ ঢেকে গেইটের বাইরে এসে হাঁটা ধরল উদ্দেশ্যহীন পায়ে। চোখে জলে ওড়না ভিজে উঠছে। বুকের ভেতর কালবৈশাখী ঝড় উঠেছে। ধ্রুব ওকে ঠকাতে পারল? এতো মিথ্যা কই ধ্রুবর চোখে তো একবার ও ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পায়নি। কত বড়ো খেলোয়াড় ধ্রুব কি দারুণ ভাবেই না ওকে ঠকিয়ে দিল আর ও টের অব্দি পেল না। দু’হাতে মুখ ঢেকে রাস্তার পাশেই চারু বসে পড়ল এক পা ও এগুতে ইচ্ছে করছে না। সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে ওর। এতো কষ্ট ও কোথায় রাখবে। মায়ের এতো অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছে কত কষ্ট মুখ বুজে সয়ে নিয়েছে কখনো তো এতো যন্ত্রণা হয়নি এই অন্তরে আজ এতো কষ্ট কেন হচ্ছে! কেন ও নিজেকে সামলাতে পারছে না। রাস্তায় পাগলের মতো বসে বেহুঁশের মতো কাঁদতে দেখে চারু কে হয়ত সবাই পাগল ভাবছে। সবাই ঘুরে ঘুরে ওকে দেখছে অদ্ভুত চোখে চারু উঠে দাঁড়াল অবশ পা জোড়া টেনে সামনে এগুতে লাগল কোথায় যাবে ও বাসায় গেলে মা ওকে মেরেই ফেলবে। চারু হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা করে ফেললো কিন্তু যাওয়ার জায়গা পেল না। এদিকে মনের দিক থেকে এতো অসহায় লাগছিল নিজেকে মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। চারুর চোখ জ্বলছে চারু স্থির দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ একজন পরিচিত মানুষ ছুটে এলো ওর দিকে। শিখা আন্টি মানুষটাকে অনেকদিন পর দেখল। ছুটে এসেই একগাল হাসি উপহার দিল চারু কে। তারপর দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,’ হেই চারু কেমন আছো কতদিন পর তোমায় দেখলাম।’
চারু নিস্তেজ কন্ঠে বলল,’ ভালো আছি আন্টি। আপনি ভালো আছেন?’
‘ দৌড়াদৌড়ি করছি চাকরি পাচ্ছি না। বুড়ি টা মরে কি যে বিপদে আছি চারু এখন তো পেট বাঁচানোর উপায় পাচ্ছি না। খুব কষ্টের দিন কাটছে আমার।’ বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আন্টি।
চারুর দিকে ভালো করে চেয়ে বললেন,’ তোমার এই হাল কেন? মুখটা একটুখানি হয়ে আছে। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় এখন খুব সুখে আছো। ধ্রুব স্যার তো তোমার খুব ভালোবাসে।’
চারু বুক চিরে এক দলা কষ্ট উতলে উঠল। ঠুকরে কেঁদে উঠল চারু।
শিখা ওকে কাঁদতে দেখে বিস্মিত কন্ঠে বললেন,’ একি কাঁদছো কেন?’
‘ ধ্রুব আমায় ঠকিয়েছে আন্টি। আমার সব শেষ।’ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল চারু।
চারু কে কাঁদতে দেখে চমকে উঠলেন শিখা। বিস্মিত চোখে চারুর দিকে তাকিয়ে বললেন,’ কি বলছো তুমি?’
‘ আমি ঠিক বলছি আন্টি!’
‘ তাহলে ধ্রুব তোমায় বিয়ে করেনি?’
চারু কথা বলছে না শুধু কাঁদছে। শিখা ওকে নিয়ে চায়ের দোকানে বসে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। মেয়েটা উনার সামনে কাঁদছে দেখতে একদমই ওর কাছে ভালো লাগছে না। উনি অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে চারুর দিকে। চারু উনার সামনে নাকের জল চোখের জল এক করে কাঁদছে। চারু নিজেই নিজেকে সামলে নিল। তখনো ফুপানো কমেনি। ঠুকরে উঠছে থেকে থেকে।
শিখা ওকে ভরসা দিয়ে বললেন,’ কি হয়েছে বলো তো।’
চারু আস্তে আস্তে সব খোলে বলল। সব শুনে শিখা স্তব্ধ হয়ে গেল। রাগে উনার চেয়াল শক্ত হয়ে এলো। রাগী কন্ঠে বললেন,’ ধনী মানুষের রক্তে রক্তে বে ঈ মা নি। সবকটা বে ঈ মা নের দল।’
তারপর আবার বললেন,’ কিন্তু ধ্রুব কে আমার মনে হয়েছিল সে তোমায় ভালোবাসে আমি তার চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখছিলাম। কিন্তু তোমার কথা শোনার পর আমি সব কিছুই গুলিয়ে ফেলছি।’
চারু কে ধরে বললেন,’ তার মানে এখন তোমার যাওয়ার জায়গা নেই?’
‘ কোথায় যাব আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। বাসায় গেলে মা আমাকে মেরেই ফেলবে। আর ধ্রুব তো আমায় ছেড়েই দিয়েছে। আমাকে ভালোবাসলে ও কখনোই আরেকজনের সাথে এনগেজমেন্ট করতে পারতো না। ও আমার প্রতি রাগী ছিল আমার উপর তার অনেক রাগ এজন্য ও আমায় এভাবে ঠকিয়েছে এমন বিচ্ছিরি ভাবে। ও কখনোই আমায় ভালোবাসে নি গো আন্টি। বুকের ভেতর জ্বলছে আমার ভালোবাসার প্রতি খুব লোভ হয়ে গেছে। আমি ধ্রুব কে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। কিভাবে আমি ওকে ছাড়া থাকব আমি বুঝতে পারছি না। সব কিছু আমার কাছে শূন্য লাগছে।’
‘ তুমি ধ্রুবর স্ত্রী আমার মতে উচিত তোমার এখন থানায় যাওয়া।’
চারু বলল,’ যে আমায় ভালোবাসে না তার উপর আইনের চাপ দিয়ে কি হবে আন্টি? ওকি আমায় ভালোবাসবে? আমি তো ভালোবাসা চাই অধিকার না।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিখা আন্টি চারু কে নিজের বাসায় নিয়ে এলো। চারু আসতে চাইছিল না কিন্তু শিখা জোর করেই নিয়ে গেল। বাসায় তার অসুস্থ স্বামী যে হাঁটতে পারে না। শিখা আন্টির স্বামী বাইক এক্সিডেন্ট এ পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়েছে তারপর থেকে অসুস্থ স্বামীর সেবা করছে শিখা আন্টি নিজে খাটাখাটুনি করে।
তিনি অনেক পরিশ্রমী। বাসায় এসে আমার থাকার জায়গা করে দিল। রুম গুছিয়ে দিল আন্টি। আমি শুয়ে আছি। শিখা আন্টির বাসায় আমি এক রাতের উপর কাটাতে পারব না। সে নিজের সংসার চালাতে হিমশিম খায় এখানে থেকে তাকে আমি পেরেশানিতে ফেলতে চাই না। তার বাসায় তাদের ধর্মালম্বী দেবদেবীর ছবি দিয়ে ঘরের দেয়াল ভর্তি। শিখা আন্টি দেখলাম এসে সব সরিয়ে দিচ্ছে। আমার সুবিধার কথা ভাবছে ব্যাপারটা আমার আরো ভালো লাগলো। শিখা আন্টি আমায় কত ভালোবাসে কখনোই মনে হয়নি আজ দেখা না হলে হয়ত তার এই ভালোবাসা আমি দেখতে পেতাম না। এর এক বিন্দু ভালোবাসা ধ্রুবর মধ্যে থাকলে আমি সুখি হতাম। একটু ভালোবাসলে কি হতো?
#চলবে.?
#প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
৩৫.
সিঁথি ও ময়না বেগম মাঝরাতে ধুপধাপ দরজা ধাক্কাধাক্কির শব্দে সিটকে উঠল। সিঁথি লাফ দিয়ে উঠে ভয় ভয় কন্ঠে বলল,’ মা কি হয়েছে এমন করে দরজা ধাক্কাধাক্কি করছে কে? ডাকাত পড়ল নাকি?’
ময়না বেগম ও ভয়ে সিটকে উঠেছেন। এমন ভাবে দরজা ধাক্কাধাক্কি করছে যে মনে হচ্ছে দরজা ভেঙ্গে ফেলবে। মা মেয়ে দুজনের হাত ধরে কাঁপছে ভয়ে। দরজার কাছে এগিয়ে আসতে পারছে না। সিঁথি মিনমিন করে বলল,’ মা দরজা খোল যাও।’
‘ পাগল হয়েছিস? দরজা খুলব। পুলিশে ফোন দে।’
‘ মা চারু ও তো হতে পারে।’ আচমকাই সিঁথির মনে হতে লাগল চারু হয়ত ধ্রুবর কাছে প্রত্যাখ্যান হয়ে ফিরে এসেছে। ওরা তো চারুর মুখটা দেখার জন্য বসে ছিল কিন্তু চারু না আসায় অবাক হয়েছে ধ্রুব কি তাহলে ওকে মেনে নিলো?
সিঁথি ময়না বেগম কে ধাক্কা দিচ্ছে বেরিয়ে দরজা খুলতে। ময়না বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,’ তোর এতো শখ তুই যা। আমি যাব না। এতো জলদি আমার মরার শখ নাই।’
সিঁথি মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,’ মা এতো জলদি কি বলছো তোমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আমার কি বয়স হয়েছে বলোতো। তুমি নিজের মেয়েকে জমের দুয়ারে পাঠাতে চাইছ?’
ময়না বেগম আর সিঁথি ঝগড়া করছে এদিকে দরজার মধ্যে ঘুর্ণিঝড় চলছে। দুই মা মেয়ে উঠে এলো কিচেনে থেকে বটি নিল ময়না বেগম আর সিঁথি চাকু নিল। তারপর দুজনে ভয়ে ভয়ে দরজার ছিটকিনি খুলতেই সামনে উদ্বিগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ধ্রুব কে। ধ্রুব কে দেখে সিঁথি আর ময়না বেগমের মুখটা হা হয়ে গেল। সাথে চোখদুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। সিঁথি মায়ের দিকে তাকাল হতভম্ব হয়ে। তারপর শুকনো ঢোক গিলল।
ময়না বেগমের কানে কানে সিঁথি বলল,’ মা এই সাইকো এখানে কি করছে?’
ময়না বেগম মুখে মেকি হাসি এনে বললেন,’ এসব কেমন আচরণ ধ্রুব শ্বশুর বাড়ি এসে কেউ এমন করে। মাঝরাতে দু’জন মেয়ে মানুষের বাসায় এসে কেউ এমন হাঙ্গামা করে? ভয়ে তো মা মেয়ে আরেকটু হলে হার্টফেল করতাম।’
ধ্রুব কপাল কুঁচকে বলল,’ দুইজন মানে? চারু কোথায়?’
ময়না বেগম সিঁথির দিকে চেয়ে নিচু কন্ঠে বিড়বিড় করলেন,’ কিরে এই পোলায় কি কয়! চারু কোথায় জিজ্ঞেস করছে তারমানে কি চারু ওর কাছে যায় নাই?’
সিঁথি বিস্মিত হয়ে বলল,’ তাই হবে হয়তো।’
সিঁথির মুখে তো হাসি ও চট করেই বলে উঠল,’ একি দুলাভাই আপনি এসব কি বলছেন? চারু কোথায় আমরা কি করে জানব? চারু তো আপনার সাথেই গেল? বিয়ে করেই তো বউ নিয়ে চলে গেলেন একদিন শালি কে তো ফোন ও করলেন না। বউ পেয়ে শাশুড়ি শালী সবাইকেই তো ভুলে গেছেন আপনি।’
অভিমান ঝড়ে পড়ল সিঁথির কন্ঠ জুড়ে।
সিঁথির কথায় ধ্রুব যেন ভরকে গেল। ময়না বেগম মেয়ের এতো দারুণ বুদ্ধি দেখে কাশি দিল। তার মেয়ে তো তাকেও পাস করে যাবে। ধ্রুবর মুখে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে সে সিঁথির কথা বিশ্বাস করেছে। ভালোই হয়েছে চারু বাসায় এসেছিল এই কথা এই ছোকরা কে বলার কি দরকার? ভালো হয়েছে চারু সময় মতো আজকেই পালিয়েছে কে জানে জামাই জামাই করে কোথায় চলে গেছে হারিয়ে যাক মরে যাক হারামজাদি। আর এই বেচারা ওকে খোঁজে মরুক।
সিঁথি মায়ের দিকে চেয়ে কুটিল হাঁসি দিয়ে আবার বলল,’ কি হলো দুলাভাই আপনি নিরব হয়ে গেলেন কেন? কিছু তো বলেন। চারু কোথায়। আর আপনি এতো রাতে কোথায় থেকে এলেন? চারু কি আপনার সাথে নেই?’
চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে বলল সিঁথি।
ময়না বেগম কে খোঁচা দিল কিছু বলার জন্য।
ময়না বেগম মেয়ের ইঙ্গিত বুঝে ন্যাকা কান্না জুড়ে বললেন,’ হায়হায় চারু কে এতো রাতে খুঁজতে এসেছো তাহলে কি চারু বাসা থেকে রাগ করে চলে গিয়েছে? আহারে মেয়েটা কত অভাগী এতো কষ্ট করে একটা বড়োলোক বাড়ির ছেলেকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করল সেখানে গিয়েও শান্তি পেল না। নিশ্চয়ই তোমার বাড়ির লোকজন ওকে মেনে নেয়নি নিশ্চিত সবাই ওকে অবজ্ঞা অবহেলা অপমানে জর্জরিত করেছে। মেয়েটা এতো কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বেরিয়ে এসেছে বাসা থেকে।’
রাগে অপমানে ধ্রুবর চেয়াল শক্ত হয়ে এলো। ফর্সা মুখটা রক্তিম হয়ে উঠল। রাগী স্বরে বলল ধ্রুব,’ দেখুন আমার সামনে ড্রামা করবেন না। চারু কে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে আপনারা যে কতটা হ্যাপি হয়েছেন আমার থেকে কেউ ভালো জানে না।’
থতমত খেয়ে গেলেন ময়না বেগম।
ধ্রুব বলল,’ চারু এখানে ছাড়া আর কোথায় যাবে না। আমি জানি চারু এখানে এসেছে সরুন সামনে থেকে।’
চিৎকার করে উঠল ধ্রুব। ধ্রুব চিৎকার দেখে ময়না বেগম দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। ধ্রুব গটগট পায়ে হেঁটে ভেতরে চলে গেল। চারুর রুমের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সিঁথি চাকু রেখে চমকে উঠল। এবং দৌড়ে সামনে গিয়ে পথ আগলে দাড়াল।
কারণ রুমে গেলেই সত্য ফাঁস হয়ে যাবে কারণ চারু সব জামাকাপড় বাসায় এখন। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে বলল,’ সামনে থেকে সরে যাও সিঁথি।’
‘ না আমি সরে যাব না। তুমি আগে বলো আমার বোন চারু কোথায়? কি করেছো তোমরা ওর সাথে। বউ নিয়ে গেলে এখন একা এসে বলছো চারু কোথায় ওর কি করেছো সত্যি করে বলো।’
ধ্রুব কপট রাগী গলায় বলল,’ এতো ওভার এ্যাক্টিং আমার সহ্য হচ্ছে না। চারুর জন্য এতোটা চিন্তা করার মেয়ে নও তুমি এবং তোমরা।’
নিভে গেল সিঁথি কিন্তু থামছে না কোনভাবেই এই রুমে ওকে ঢুকতে দেবে না সিঁথি।
ধ্রুব সিঁথি কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুমে গিয়ে মৃদু চিৎকার করে উঠল। ময়না বেগম আর সিঁথি ভয়ে কাঁপছে।
চারুর বিয়ের শাড়ি যেটা পরে চারু ওর সাথে গিয়েছিল সেটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো লাল চোখে।
সিঁথি আর ময়না বেগম মাথা নিচু করে কাঁপছে।
ধ্রুব চিৎকার করে উঠল,’ চারু এখানেই ছিল এই যে তার প্রমাণ এবার ভদ্র ভাবে বলছি কোথায় চারু বলেন।’
ময়না বেগম বললেন,’ এতো যে টেনশন বউ কে আজ মাঝরাতে খুঁজতে চলে এসেছো এতো দিন কই ছিলা। এক রাত কাটিয়ে বন্ধুর বাসায় বউ ফেলে এতো দিন কোথায় লাপাত্তা ছিলে হ্যাঁ? এখন এসেছে চারু চারু করতে। আমরা জানি নাকি ওই হারামজাদি কোথায়। হারামজাদি সকালে পালিয়েছে আমরা কেউ জানি না ও কোথায় গিয়েছে আমরা তো ভেবেছিলাম ওই তোমার কাছে গিয়েছে কিন্তু তুমি আসায় বুঝতে পারছি ও তোমার ওখানে যায়নি।’
‘ আপনাদের কথা আমি বিলিভ করছি না। চারু কোথায় সঠিক করে বলুন।’
‘ পারব না বাপু। আর জানলেও বলতাম না। টাকার কথা বলে কি পাঁচ হাজার দিয়ে পালিয়ে গেলে ভালোই হয়েছে দুজনে আলাদা হয়েছো।’
ধ্রুব সোফায় জোরে লাথি মারল ময়না বেগমের কথা শুনে। ময়না বেগম আর সিঁথি দুজনেই কেঁপে উঠল। সিঁথি ভয়ে ভয়ে বলল,’ আমরা সত্যিই জানি না চারু কোথায়! তোমার সাথে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর এলো বিধ্বস্ত হয়ে এসে খুব কাঁদল তুমি নাকি ওকে একা ফেলে কোথায় চলে গেছো। তোমার বান্ধবীর বাসা থেকেও চারু কে তাড়িয়ে দিয়েছে। খুব কাঁদল তোমার বাসার ঠিকানা চাইল। আমরা দেইনি কারণ আমরা তোমাদের আলাদা দেখে খুব এনজয় করেছিলাম। চারু কে বন্দি করে রাখলাম চারু তোমার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করায়। তারপর আজ আমার বেরিয়েছিলাম চারু এই সুযোগ এ বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে কোথায় গেছে আমরা জানি না।’
ধ্রুব দেয়ালে একেরপর এক ঘুসি মেরে হাত রক্তাক্ত করে ফেলল সিঁথি আর ময়না বেগম চোখ বড়ো বড়ো করে দেখল ধ্রুবর পাগলামি। ধ্রুব নিজে থেকেই এরপর চলে গেল।
ময়না বেগম আর সিঁথি দুজনে উঠান পর্যন্ত এসে ওর যাওয়া দেখল। তারপর দরজা আটকে দিল।
‘
#চলবে…?
#প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
৩৬.(১)
ধ্রুবর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মণিকা। ধ্রুবর চোখে চোখ মিলাতে পারছে না মণিকা। ধ্রুব রাগ দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে মণিকা। ধ্রুব ওর সামনে নিজের গাড়িতে লাথি মারছে।
মণিকা চমকিত সুরে বলল,’ সামান্য একটা মেয়ের জন্য তুই আমার সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করছিস? আমার থেকে এখন ওই দুই টাকার চারু তোর কাছে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে গেল? ওর জন্য তুই আমার সাথে রাগারাগী করছিস আমি তোকে চিনতে পারছি না ধ্রুব।’
মণিকা বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠল। ধ্রুব লাল চোখে মণিকার দিকে তাকাতেই মণিকা ঢোক গিলল। ধ্রুবর রাগ দেখে ওর মুখে কথা আটকে এলো। ধ্রুব রাগী স্বরে বলল,’ শি ইজ মাই ওয়াইফ। তুই হয়ত এই সত্যি টা ভুলে গেছিস মণিকা। আমি তোকে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড ভেবে তোর কাছে চারু কে রেখে গিয়েছিলাম আর তুই ওকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলি বাসা থেকে। আবার দাড়োয়ান কে দিয়ে মিথ্যা কথা বলিয়েছিস এতো স্পর্ধা তোর?’
মণিকা এগিয়ে এসে ধ্রুবর হাত আকড়ে ধরে বলল,’ তুই এতো রাগ করছিস কেন? তুই কি ওই মেয়েকে ভালোবাসিস তুই তো ওর সাথে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এসব করেছিস তাই না আমি জানি। এজন্য তো আমি এসব করেছি। তোর হেল্প করেছি তুই আঙ্কেলের সাথে দেশের বাইরে যেতেই আমি বাসা ছেড়ে দিয়েছি। তোকে এই কথা জানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুই নাকি ফোন ভুলে বাসায় ফেলে গিয়েছিলি এজন্য তোর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।’
ঝামটা দিয়ে ছাড়িয়ে নিল নিজের হাত ধ্রুব। মণিকা ছিটকে সরে গেল। ধ্রুব ওর গাল চেপে ধরে বলল,’ এজন্য আমি তোদের আগে এসব জানাই নি। নিজের একটা বেকুব ভাবনা আন্দাজ করে তুই এসব করে দিলি আমাকে দেশে আসার সময় দিলি না? চারু এখন কি আর আমার মুখ দেখবে? কতটা কষ্ট পেয়েছে ও? তুই যেভাবে ওকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলি এরপর আমিও ওর খোঁজ নিতে পারিনি জানি না আমি এখন কি করব সব কিছু আমার এলোমেলো লাগছে।’
বলতে বলতে ধ্রুব দূর্বল হয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে রাস্তায় বসে পড়ল। মণিকা বিস্মিত হয়ে এগিয়ে এসে বসল নিজেও ধ্রুবর পাশে।
‘ তারমানে তুই সত্যি চারু কে ভালোবাসিস?’
মিনমিনে স্বরে বলল মণিকা।
ধ্রুব টকটকে লাল চোখে মণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,’ ভালো না বাসলে কি আমি এতো কষ্ট পেতাম? তুই আমার অবস্থা দেখে বুঝতে পারছিস না আমি কতটা ভালোবাসি চারু কে।’
‘ তাহলে গতকাল যুথির সাথে এনগেজমেন্ট করলি কেন? ওসব কি ছিল?’ প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করল মণিকা।
ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ মাকে নিয়ে হুট করেই দেশের বাইরে যেতে হলো আমি আর আব্বু গেলাম। দেশে এসেই মায়ের এক কথা আমি হয়ত আর বাঁচব না আগামীকার কেই আমার ছেলের বউ নির্বাচন করব। আমি ভাবলাম সকালে গিয়েই চারু কে বাসায় নিয়ে আসব। কিন্তু সকালে আমার জন্য সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল যুথির সাথে এনগেজমেন্ট ঠিক করেছে। মায়ের অসুস্থতার জন্য আমি মুখের উপর কিছু বলতে পারলাম না। এদিকে বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য আমি ছটফট করছিলাম। বের হবার সুযোগ হলো না। এক রাতেই আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। যা দেখে বুঝলাম এই কাজে আগ বাড়িয়ে দিয়েছে আগে চাচা চাচি চারু কে বাসায় আনার পর তারা আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন। এজন্য এই প্লান করেছে। আমি ক্লান্ত বিধায় এক ঘুমে রাত পার করেছি সকালে এসব দেখে স্তব্ধ।
রাত এগারোটায় আমি তোর ফ্ল্যাটে গিয়েছি দাড়োয়ানের সাথে কথা বলে সব জানতে পেরে আমার মন চাচ্ছিল তোকে খুন করে ফেলি। এক সপ্তাহ চারু এখানেই ছিল আমার আশায় আমি আসতে পারি নিজেকে এতোটা অসহায় লাগছিল।
চারু আমার ভালোবাসা এখন আমার দায়িত্ব কিন্তু আমি বিয়ের পর এক মুহুর্ত ওর সাথে কাটাতে পারলাম না। উল্টো কত বড়ো আঘাত দিয়ে বসলাম।
সেই রাতেই গাড়ি নিয়ে আমি অস্থির হয়ে ওদের বাসায় যায়। ওর সৎ মা ও বোনের সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করে আসি। সেখানেও চারু নেই হতাশ হই আমি। চারু নাকি আমার খোঁজে বেরিয়েছে তাদের আন্দাজ এখন কোথায় আছে জানে না। চারু যদি গতকাল আমার বাসায় গিয়ে থাকে তাহলে ওকে বাসায় গেলেই আমি সি সি ক্যামেরা ফোটেজ এ দেখতে পাব কিন্তু আমি বাসায় গেলে বের হতে পারব না। এজন্য আমি বাসায় যাওয়ার রিস্ক নিতে পারছি না। কোথায় পাব চারু কে বল?’
ফরসা মুখটা লাল হয়ে গেছে ধ্রুবর। ধ্রুবর অবস্থা দেখে মণিকার বুঝতে বাকি নেই চারুর প্রতি ধ্রুব কতটা দূর্বল।
মণিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,’ আই এ্যাম সরি দোস্ত তুই চারুকে নিয়ে এতোটা সিরিয়াস জানলে আমি কখনোই এমন করতাম না। আমাকে ক্ষমা করে দে।’
ধ্রুব উত্তর দিল না সিগারেট বের করে সিগারেট টানছে আর কিছু ভাবছে।
মণিকা বলল,’ তোকে খুব বিধ্বস্ত লাগছে। এখন ঘড়িতে দুইটা বাজে রাতে বের হয়েছিস। ঘুমাসনি, খাসনি চোখ দুটো তো ফুলে বেলুন হয়ে আছে যা বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট কর খাওয়া দাওয়া কর।’
‘ তুই আমার চোখের সামনে থেকে যা মণিকা তোর কথা আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না। তোর মুখটাও আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না।’
মণিকা অপরাধী চোখে তাকিয়ে আছে। ধ্রুব বলল,’ কি হলো যা।’
মণিকা বলল,’ তুই কি করবি এভাবে না খেয়ে না ঘুমিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে ঘুরবি নাকি?’
‘ দরকার পরলে তাই করব।’ কঠোর স্বরে বলল ধ্রুব।
মণিকা স্থির তাকিয়ে আছে ধ্রুবর দিকে। ধ্রুবর ফের ধমকে চমকে উঠল আচমকা। সিটকে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল মণিকা। ঢোক গিলে সরে এলো এবং নিজের ফ্রেন্ডদের জানাল ব্যাপারটা। মণিকা সবার আসার জন্য অপেক্ষা করছে। সবাই এলে ও চলে যাবে ওকে এখন ধ্রুব দেখতেই পারছে না ওর সামনে যাওয়া উচিত হবে না। মণিকা দূর থেকে ওকে নজরে রাখছে বন্ধুর এই অবস্থা দেখে ওর খুব খারাপ লাগছে। ধ্রুব দুইটা সিগারেট টেনে উঠে দাঁড়াল পিচ ঢালা রাস্তা থেকে। তারপর গাড়িতে উঠে শো করে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। মণিকা হা হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
শিশির ছাড়া আর কেউ আসলো না কারণ সবাই বিজি আছে। শিশির এসেই বলল,’ কই রে ধ্রুব কই?’
‘ চলে গেছে। ওর কষ্ট দেখে আমার নিজের ই কাঁদতে ইচ্ছে করছে রে।’
‘ তুই এমন একটা কাজ করছিস শুনে তো আমার ই রাগ হয়েছে।’
‘ আমি সত্যি ভাবিনি ওই মেয়েটার প্রতি এতো উইক হবে ধ্রুব।’
‘ দেখ তোর ভাবনায় তো কিছু হবে না। কাজটা তুই ভালো করিস নি। তোকে বিলিভ করে চারু কে তোর কাছে রেখেছিল ধ্রুব আর তুই কি করলি?’
‘ আর কত বকবি সবাই মিলে আমাকে। আমার জন্য ওরা আলাদা হয়েছে আমি নিজেই ওদের মিল করিয়ে দেব দেখিস!’
ধ্রুবর বাসা থেকে কল এসেছে কল দিয়েছে ধ্রুবর চাচি।
ধ্রুব কল কেটে দিল এবার দিল ধ্রুবর বাবা।
ধ্রুব কল রিসিভ করে বলল,’ কি সমস্যা আব্বু সবাই মিলে আমাকে এতো জ্বালাতন করছো কেন বলোতো?’
‘ তুমি কোথায় আছো? রাতে বাসায় ফিরে আসোনি কেন? সবাই তোমার চিন্তায় অস্থির! বিশেষ করে যুথি।’ বলেই তিনি হাসলেন।
গা জ্বলে উঠল ধ্রুবর,’ কেন এতো টেনশন করার কি আছে? আমি কি ছোটো বাচ্চা যে হারিয়ে যাব। দেখো আমার এসব ভালো লাগছে না কেউ আমাকে কল করবে না।’
বলেই ধ্রুব মুখের কল কেটে দিল। ধ্রুবর বাবার দিকে লাজুক মুখে চেয়ে ছিল যুথি। চাচাকে ফোন নামিয়ে রাখতে দেখে হতচকিত গেলো কারণ ও চেয়েছিল কথা বলতে কিন্তু ওর নাম্বার থেকে খালি বিজি দেখাচ্ছে নাম্বার। যুথির নাম্বার ধ্রুব ব্লক করে রেখেছে যেটা যুথি জানে না।
চাচাকে কল রেখে দিতে দেখে একটু মন খারাপ হলো যুথির।
ও সামনে থেকে চলে গেল। পিনাক বোনের কাছে এসে বলল,’ আপু কি হয়েছে তোমার? তোমার কি মন খারাপ?’
যুথি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,’ কই কি হবে আমার?’
পিনাক উচ্ছাস নিয়ে বলল,’ আমার কি যে আনন্দ লাগছে আপু তোমার আর ধ্রুব ভাইয়ার বিয়ে হবে কি মজা।’
পিনাক বোনের মুখে মলিনতা দেখে চুপ করে গেল। তারপর বলল,’ ভাইয়া বাসায় নেই বলে কি তোমার মন খারাপ আপু?’
যুথি বলল,’ এনগেজমেন্টের পর ধ্রুবর সাথে কথা হলো না তাই ভালো লাগছে না। কাল বারবার বলছিল আমাকে কিছু জরুরী কথা বলতে চায়। কিন্তু আজ তার পাত্তা নেই।’
‘ কাল কথা শুনলে না কেন?’
‘ সুযোগ পেলাম কোথায়? একজনের পর একজন আমার গা ঘেঁষেই ছিল এজন্য হলো না। আচ্ছা এজন্য কি ধ্রুব আমার উপর রাগ করে বাসায় আসছে না?’
‘ আরে না হয়ত ভাইয়া বিজি।’ বোনকে শান্ত করতে বলল পিনাক।
পিনাক চারুর কথা যুথি কে জানাতে চেয়েছিল কিন্তু মায়ের ধমকে চেপে গেছে আচ্ছা ভাইয়া কি ওই চারু চাকরানির কাছে গেছে?
পিনাক চিন্তিত মুখে মায়ের কাছে গেল।
#চলবে…?
#প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
৩৬.(২)
‘ আন্টি আমি জেনেছি আপনার বাসায় এক রাত ছিল চারু। আপনি নিশ্চয়ই জানেন চারু এখন কোথায়?’ গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করল ধ্রুব।
শিখা বললেন,’ তুমি হয়ত আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমি সত্যি জানি না চারু কোথায়। ওকে আমি নিজেই ছাড়তে চায়নি। ব্রেকফাস্ট করেই ও বলল বাসায় যেতে চায় আমি ওর বাসায় যাওয়ার দ্বিমত করতে পারিনি। তুমি ওর বাসায় গিয়ে দেখতে পারো।’
ধ্রুবর মুখমন্ডল চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল কারণ একটু আগেও চারু বাসায় গিয়েছিল সেখানে চারু নেই। এখানে থেকে বাড়ি যাবার কথা বলে চারু কোথায় যেতে পারে?
চিন্তায় ধ্রুবর হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো।
শিখা আন্টির থেকে বিদায় নিয়ে ধ্রুব উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায় কার থামিয়ে।
এখন ঘড়িতে সন্ধ্যা ছয়টা বাজে।
মায়ের নাম্বার থেকে কল এসেছে ধ্রুব রিসিভ করে হ্যালো বলল।
ওপাশে থেকে ধ্রুবর মা বললেন,’ তুমি কোথায় আছো?’
‘ এইতো আম্মু আমি তো ফ্রেন্ডদের সাথে কোন সমস্যা?’
‘ তুমি এখনি বাসায় আসো।’ গম্ভীর স্বরে বলেই কল কেটে দিলেন। ধ্রুব গাড়ি ঘুরিয়ে বাসার দিকে ছুটতে লাগল। বাড়িতে যাওয়ার কোন প্রকার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু অসুস্থ মায়ের কথা ফেলতে পারবে না ধ্রুব তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়িতে আসতে হলো।
বাসায় এসে দেখল মা আর যুথি সোফায় বসে আছে। যুথি মাকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে। ওর উপস্থিতি পেতেই যুথির ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল। যুথি আড়চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে লাজুক হাসলো। ধ্রুবর দৃষ্টিতে পুরোটাই পড়ল। রাগে ওর গা জ্বলে উঠল। এইসব দেখার জন্য বাসায় আসতে ইচ্ছে করছিল না ধ্রুবর। যুথি লজ্জা কাচুমাচু করছে মনে হচ্ছে ও এখন বাসর ঘরে বসে আছে।
‘ আম্মু..’
ধ্রুবর মা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,’ মুখটা এমন শুকিয়ে আছে কেন? সারাদিন কোথায় ছিলে? বাসায় আসো নি কেন?’
ধ্রুব বলল,’ ফ্রেন্ডদের সাথেই ছিলাম আম্মু।’
‘ তাই বলে সারাদিন কারো কল রিসিভ করবে না কেন?
ধ্রুব একপলক যুথির দিকে তাকিয়ে ভাবছে তাকে ব্লক করার কথা বলে দিয়েছে নাকি। কিন্তু মায়ের থেকে তেমন কোন অভিযোগ আসলো না। মা কাজের বুয়ার সাহায্য রুমে চলে গেল। যুথি স্যুপের বাটি টি টেবিলের উপর রেখে বসে ছিল। সবাই জায়গা ফাঁকা করে চলে যেতেই যুথি মাথা তুলে তাকাল ধ্রুবর দিকে।
ধ্রুবর ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে আছে। দুজনের দৃষ্টি জোড়া মিলিত হতেই গমগমে সুরে ধ্রুব বলল,’আমাকে দেখে এতো লজ্জা পাচ্ছিস কেন?’
ধ্রুবর গম্ভীর মুখের কথা শুনে যুথি থতমত খেয়ে গেল। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে বিরক্তিকর চাহনি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
যুথি মিনমিন করে বলল,’ কই আমি তোমাকে দেখে লজ্জা পাব কেন? আমি তো লজ্জা পাচ্ছি না।’
বলেই যুথি সোজা হয়ে বসল।
ধ্রুব উঠে দাঁড়াল চলে যাওয়ার জন্য। যুথি ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখেই নিজেও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তারপর বলল,’ তুমি আমার নাম্বার ব্লক করেছো কেন?’
ধ্রুব পিছু না ফিরেই বলল,’ কেন ব্লক করেছি এখন আর বলার ইচ্ছে নেই। যখন বলতে চাইছিলাম তখন তোর শোনার সময় ছিল না। এখন আর তোকে আমার কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না।’
চমকে উঠল যুথি। ধ্রুব কি কালকের জন্য এখনো আমার উপর রাগ করে আছে?
যুথি ধ্রুবর সামনে এসে দাঁড়াল অপরাধী চোখে।
ধ্রুব বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,’ সামনে দেখে সর।’
‘ কালকের জন্য কি তুমি আমার উপর রাগ করে আছো? আই এ্যাম সরি। এখন বলো না কি বলতে চাও।’
ধ্রুব যুথি কে সামনে থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে গটগট করে নিজের রুমে চলে গেল। যুথি ছলছল চোখে ধ্রুবর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
ধ্রুব রুমে এসে ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ধ্রুব চোখ বন্ধ করে ভাবছে চারু কোথায় যেতে পারে। আচ্ছা সিঁথি আর ময়না বেগম ওর থেকে কিছু লুকাতে চাইছে না তো?
ধ্রুব ময়না বেগমের ফোনে কল দিল। ময়না বেগম কল ধরছে না। এবার সিঁথির সিমে কল দিল। সিঁথি বলল,’ হেই ধ্রুব কেমন আছো?’
‘ চারু কি বাসায় এসেছে?’
‘ কই না তো’
ধ্রুব বলল,’ মিথ্যে বলবে না আমি যদি জানতে পারি চারুর মিসিং হওয়ার পেছনে তোমাদের মা মেয়ের হাত আছে বিষয় টা ভালো হবে না।’
সিঁথি কে ধমকে ধ্রুব কল কাটতেই কারো শব্দ পেল।
ধ্রুব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল যুথি কফি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ও তাকাতেই এগিয়ে এলো যুথি বিছানার সাথে লেগে দাঁড়াল।
কফি হাতে নিয়ে এগিয়ে দিল ধ্রুবর দিকে,’তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ঠিক নেই। কফি খাও ভালো লাগবে।’
যুথির ঠোঁটের মিষ্টি হাসি। ধ্রুবর মেজাজ বিগড়ে গেল। ধ্রুব চিৎকার করে উঠল,: তোকে আমি বলেছি আমার জন্য কফি নিয়ে আয়? বের হও আমার রুম থেকে। বিনা পারমিশনে কেন এসেছিস? ভদ্রতা শিখিসনি কারো রুমে ঢোকার আগে অনুমতি নিতে হয়।’
যুথি ধমকে কেঁপে উঠল। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে ধ্রুবর দিকে। ধ্রুবর লাল চোখে তাকিয়ে ধমক শুনে যুথি স্তম্ভিত হয়ে গেল। যে পায়ে রুমে এসেছিল সে পায়েই ঘুরে দাঁড়াল। লজ্জায় অপমানে ওর হাত-পা কাঁপছে। ধ্রুবর এমন বিহেভিয়ার এ যুথি থমকে গেছে এমন ভাবে ধমক দিয়ে ধ্রুব কখনোই কথা বলেনি আজকে ধ্রুবর কথায় চমকে উঠেছে ও।
যুথি দরজার কাছে এসে আবার পিছন ফিরে তাকাল দেখল ধ্রুব ফোনে কিছু করছে। ওর চোখ জোড়া টলমল করে উঠল। ধ্রুব কেন এমন করছে ওর সাথে? কাল ওদের এনগেজমন্ট হলো কত হ্যাপি যুথি। ধ্রুব কে ছোটো বেলা থেকে ভালোবেসে এসেছে লজ্জায় কখনোই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেনি।
যুথি রুমে এসে বিছানায় শুয়ে কাঁদছে ফুঁপিয়ে। হাতের আংটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাল ধ্রুব এটা ওকে পড়িয়ে দিয়েছে। যুথি আংটির উপর চুমু খেলো। আজকের দিনটা তো এমন হবার কথা ছিল না। কত কিছু ভেবে রেখেছিল। ধ্রুবর সাথে প্রেমালাপ করবে ঘুরতে যাবে। সুন্দর সুন্দর মুহুর্তে তৈরি করবে কিন্তু এসব কি হচ্ছে ধ্রুব ওর সাথে এতো খারাপ এতো রুড বিহেভ কেন করছে?
যুথি নিজের ছোটো বোন এর উপস্থিতি টের পেতেই দুহাতে চোখ মুছে উঠে বসল। পিনাক বোনের পাশে বসে বলল,’ আপু রুমে কি করছো চলো ভাইয়া এসেছে বাসায় তুমি সারাদিন ভাইয়ার অপেক্ষায় ছিলে ঘুরতে যাবে বললে চলো না এখন যাই। ভাইয়া তো বাসায় এসেছে। তুমি না কফি করার সময় বললে ভাইয়াকে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলবে।’
যুথি উঠে বলল,’ আজকে যাব না অন্যদিন যাব।’
‘ কেন আপু?’
‘ আমার মাথা ব্যথা করছে।’
পিনাক মুখ কালো করে চলে গেল আপুর হঠাৎ কি হলো। আপু তো ঘুরতে যাওয়ার জন্য ভাইয়াকে রাজি করাতে গিয়েছিল তাহলে এখন কি হলো আপু রুমে এসে বসে আছে কেন?
পিনাক দেখল আপুর রুমে দেখল ভাইয়ার জন্য করে নিয়ে যাওয়া কফির মগ এখানে। কপাল কুঁচকে পিনাক বেরিয়ে গেল।
যুথি বোন কে বেরিয়ে যেতে দেখেই ফুঁপিয়ে উঠল। ধ্রুব কথা না শোনায় এতোটা রেগে যাবে জানলে সব কিছু ফেলে যুথি ধ্রুবর কথা শুনতে চলে যেতো। এখন আফসোস এ নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
যুথি নিজের মায়ের ডাকে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
যুথি মায়ের কাছে গিয়ে দাড়াতেই তিনি বললেন,’ কি হয়েছে শুনলাম তুমি রুমে গিয়ে কাঁদছো!’
যুথি থতমত খেয়ে গেল। মা জানলো কীভাবে?
পিনাক কে দেখতে পেল।
‘ কই না তো।’
‘ এখনো চোখের কোনায় জল চিকচিক করছে তুমি বলছো না?’ যুথির চোখের কোনা থেকে পানি আঙুলে নিয়ে বললেন।
যুথি বলল,’ তেমন কিছুই না।’
‘ ধ্রুব তোমার সাথে কি রাগারাগী করেছে?’
যুথি বলল,’ কি যে বলো না। ধ্রুব আমার সাথে রাগারাগী করবে কেন?’
‘ আমাকে মিথ্যা বলো না।’
‘ আমি মিথ্যে বলছি না আম্মু। ধ্রুব আমাকে কখনোই ধমক দেয়না।’
যুথি দেখল মা তার কথা বিলিভ করছে না কেমন জানি সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে যুথি কোনভাবেই কথা কাটিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
#চলবে….?