প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
৫৫.
সিঁথির প্রেগন্যান্সির মিথ্যা রিপোর্ট নিয়ে এসেছে। ও মিথ্যা কথা বলে বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছিল। আর যে টাকার কথা বলেছিল ময়না বেগম সবটাই ছিল মিথ্যা বানোয়াট কথা। আর ময়না বেগমের সেই কথায় প্রথম থেকেই বিলিভ করেনি চারু। না করে বেঁচে গিয়েছে নয়ত তাদের নোংরা কাজে সামিল হয়ে যেতো চারু।
ধ্রুব আর চারুর সাথে দেখা করতে এসেছিল সেই ছেলে যাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিল সিঁথি। প্রথম থেকেই চারু ওদের কথায় মাথা ঘামায়নি তাই কখনোই ছেলের সম্পর্কে কিছুই জানতে চায়নি। কিন্তু সেই ছেলে ধ্রুবর শুধু পরিচিত নয় যুথির মামাতো ভাই।
এই ঘটনা ফাঁস হবার পর চারুর এই বাসায় মুখ দেখানো লজ্জা জনক হয়ে উঠল। চারুর লজ্জায় ঘৃণায় মন চাচ্ছে মা আর সিঁথির সাথে বোঝাপড়া করতে। কিন্তু ময়না বেগম আর সিঁথি লাপাত্তা। এই লাপাত্তা হওয়ার কারণ ও চারু জানতে পেরেছে। ময়না বেগম যুথির মামাতো ভাই ইমরান কে ব্লাকমেইল করে দশ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ইমরানের সবচেয়ে বড়ো ভুল সে সিঁথির মিষ্টি কথায় ফেঁসে গিয়েছিল। পরে যখন প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট দেখায় তখন থেকে ও ভয়ে ভীত হয়ে যায়। ইমরান বিয়ের কথা বললে সিঁথি জানায় ওর মা নাকি রাজি না এই বিয়েতে। বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণ যে ছেলে বিয়ের আগেই এসব ঘটায় তার কাছে ময়না বেগম নাকি মেয়ে দিবে না।
এসব জানায়। ইমরান বাড়িতে গিয়েও কথা বলে। সেইদিন ময়না বেগম চারু কে বাড়িতে ডাকে। আর বলে পাত্রপক্ষ এসেছে কিন্তু এটা ছিল মিথ্যা কারণ ময়না বেগম জানতেন চারু কখনোই আসবে না। ময়না বেগম চারুর কাছে মিথ্যা সিনপ্যাতি তৈরি করেছিল টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য কিন্তু যখন দেখল চারুর মনে কোন আঁচড় পড়ছে না। ইমরানের কাছে মোটা অংকের টাকা চেয়ে বসে তিনি ইমরান টাকা না দিলে ওর বদনাম করে দিবে জানায়। ইমরান বাধ্য হয়েই টাকা দেয়। টাকা নিয়ে মা মেয়ে উধাও।
চারু মুখে হাত দিয়ে সব কথা শুনছে। মা আর সিঁথি খারাপ জানে চারু কিন্তু এতোটা খারাপ ও কখনোই ভাবেনি। সিঁথিকে বড়ো ঘরে বিয়ে দিতে চায় ময়না বেগম কিন্তু ভুল ছেলের পাল্লায় পরে গিয়েছিল দুজনে। ইমরানের আর্থিক অবস্থা দেখে হয়ত তারা এই নোংরা প্লান করেছে। চারু এই মানুষ গুলোর সাথে এতো দিন থেকেছে ভাবতেই লজ্জা লাগছে। ইমরানকে নিয়ে সিঁথি সে ডক্টরের সাথে কথা বলেছিল ভুল রিপোর্ট দেখিয়েছিল ইমরান জেনেছে আসলে সে কোন ডক্টর ই না এজন্য সিঁথি কখনোই ওর সাথে হসপিটালে যায়নি। একটা মেয়েকে ডক্টর সাজিয়ে ওর কাছে নিয়ে এসেছিল।
ইমরান সব জানিয়ে চলে যাওয়ার পর যুথির মা বললেন,’ বরবাদ করে দিয়েছে আমার ভাইকে আমার ভাইপো কে। ধ্রুব এবার তো দেখো কোন বাড়ির মেয়েকে বউ করে এনেছো। এই মেয়ের জন্য তুমি আমাদের সাথে লড়াই করো দিনরাত তাইনা।’
চারু মাথা নিচু করে বসে আছে। এসব তো ওকে শুনতেই হবে যা সব করেছে মা তারপর এসব হওয়াটা তো স্বাভাবিক।
চারু কে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল যুথি তারপর বলল,’ তোমার ওই প্রতারক মা বোন কোথায় লুকিয়েছে সত্যি করে বলো চারু।’
ধ্রুব উঠে দাঁড়াল তারপর যুথির হাতের তলায় থেকে চারুর হাত ছাড়িয়ে বলল,’ যুথি তোর এতো সাহস তুই চারুর সাথে এভাবে কথা বলিস?’
‘ ধ্রুব এখন অন্তত গলার জোর নামিয়ে রাখো। চারুর পরিবারের লোক যা করেছে তারপর দয়া করে ওকে সাপোর্ট করা অফ করো।’ রেগে বলল যুথি।
ধ্রুব বলল,’ তোরা সবাই চারু কে দোষারোপ করছিস কেন? এখানে ওর কি দোষ? ও কি করেছে এসব? এসব করেছে ময়না বেগম ও সিঁথি এসবের কোথাও চারু নেই।’
‘ তুমি বললেই তো নাই হয়ে যাবে না। চারুর
মা বোন ই তো এসব করেছে। তারা এসব একা একা করেনি আমি নিশ্চিত চারু এই প্লান এর মাথা। ওকে চেপে ধরলেই ওদের খোঁজে পাওয়া যাবে।’
ধ্রুব কটমট চোখে তাকিয়ে আছে যুথির দিকে। যুথি ও একই ভাবেই তাকিয়ে আছে। এই সুবর্ণ সুযোগ ও তো হাতছাড়া করবে না। এই চারু কে ও ছাড়বে না।
যুথির মা ধ্রুবর মায়ের দিকে চেয়ে বললেন,’ এই মেয়ে এই বাড়িতে থাকলে আমরা এই বাড়ি থাকব না আপা। এই মেয়েকে স্বীকার করতে বলো সব। কোথায় লুকিয়ে রেখেছে নিজের জালিয়াত পরিবারকে।’
চারু একটা কথাও বের করতে পারছে না মুখ দিয়ে। ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ধ্রুব চারুর বাহু জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চারু কে ফুপাতে দেখে ধ্রুব ওকে নিয়ে উপরে আসতে চাইল। ধ্রুব চারু কে নিয়ে চলে ভেতরে যেতে গেলে ধ্রুবর মা ওদের থামিয়ে দিল।
ধ্রুব বিস্মিত চোখে নিজের মায়ের দিকে তাকাল।
ধ্রুবর মা বললেন,’ আম্মু তুমি চারু কে সন্দেহ করছো?’
ধ্রুব বাবা ও বলে উঠলেন,’ ধ্রুব চারু কে সত্যি কথা বলতে বলো।’
‘ আব্বু আপনিও? আপনারা সবাই চারু কে কেন সন্দেহ করছেন? এখানে চারুর কোন হাত নেই বিলিভ করেন।’
ধ্রুবর কথায় কেউর উপর কোন আঁচড় পড়ল না। তারা সবাই চারু কে সন্দেহ করছে। চারু ছলছল চোখে একটু পর পর মাথা তুলে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। এমনিতেই এই বাসার কেউ ওকে পছন্দ করে না। তার উপর আজ যে দোষ ওর উপর এলো এরপর সবার চোখে প্রতারক হয়ে গেল ও। এতো কিছুর পর ও ধ্রুব ওকে একবিন্দু সন্দেহ করেনি এখনো ওর হয়েই পরিবারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছে ওর পাশে। চারু কি ধ্রুব কে নিজের পাশে পেয়ে খুশি হবে নাকি পরিবারের সবাইকে আপন করে পাবার বদলে আরো দূরে যেতেই দেখে কষ্ট পাবে বুজে উঠতে পারছে না। কিন্তু ওর চোখের অশ্রু তখন থামতেই চাইছে না। চারু কে নিয়ে কেউ ধ্রুব কে রুমে যেতে দিবে না এবং কি বাসার বাইরেও যেতে দিবে না সবাই চারু কে চেপে ধরেছে সত্যি জানার জন্য। অথচ চারু কি সত্যি বলবে সেটাই তো জানে না।
এতো অসহায় তখন লাগছিল চারুর নিজেকে বড্ড দূর্বল লাগছিল। চারুর দিকে তাকিয়ে ধ্রুব ওর গাল ছুঁয়ে বলল,’ চারু আই এ্যাম সরি আমি থাকতেও তোমায় এতো অপমান সহ্য করতে হচ্ছে।’
চারু উত্তর দিল না। শুধু মৃদু হাসলো।
ধ্রুব মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’ আম্মু তুমি এমন করছো! চারুর কন্ডিশন তো তোমরা সবাই জানো? এমন করে কেন ওকে কষ্ট দিচ্ছ তোমার কি একটুও মনে হচ্ছে না তোমরা ভুল দোষারোপ করছো চারু কে।’
ধ্রুবর কথায় যুথি বলল,’ এসব ড্রামা করছে। অসুস্থ হবার ড্রামা। ধরা পরে এখন ইনোসেন্ট সাজতে চাইছে।’
ধ্রুব ক্রোধে উঠল,’ তুই আর একটা কথা বললে আমার হাত উঠে যাবে যুথি।’
যুথি মুখ ভেংচি দিয়ে সরে গেল। ধ্রুবর মা ধ্রুবকে বললেন,’ চারু কে নিয়ে রুমে যাও।’
ধ্রুব রুমে এসে চারু কে বলল,’ এইজন্য সেইদিন আমি বাড়ি ছাড়ার কথা বলেছিলাম। এই মানুষগুলোকে আপন করতে চেয়েছিলে তাই না এরা সুযোগ পেলেই তোমার দিকে আঙুল তুলতে দ্বিধাবোধ করবে না।’
চারু ফুঁপিয়ে কাঁদছে রুমে এসে।
‘ এখন কাঁদছো কেন?’ রেগে বলল।
‘ আমি কাঁদছে নিজের ভাগ্য দেখে। মা আর সিঁথি এসব ইচ্ছে করে করেছে যাতে আমাকে সবার সামনে ফাঁসাতে পারে। আপনার কি একটু সন্দেহ হচ্ছে না আমাকে?’
ধ্রুব রেগে উঠল,’ আমি কি নিজেকে সন্দেহ করব?’
চারু বলল,’ মানে?’
‘ তুমি আর আমি কি আলাদা? আমি জানি তুমি ওই নোংরা কাজে নেই। তোমার মতো মাথামোটা আর যাইহোক টাকার লোভী না।’
চারু ধ্রুব কে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
‘ কিন্তু বাসার কেউ আমায় বিশ্বাস করছে না।’
‘ না করুক তাদের বিশ্বাস না বিশ্বাস এ কি এমন আসে যায়?’
চারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সন্ধ্যার দিকে পুলিশ এলো বাসায়। পুলিশ এসে চারু কে জেরা করা শুরু করে দিয়েছে। চারুর নিজেকে আসামি মনে হচ্ছে।
বাসায় পুলিশ আসায় তো আরো রেগে বোম হয়ে গেছে সবাই চারুর উপর। কেউ সামনে এসে কিছু বলছে না।
ধ্রুব পুলিশদের বুঝানোর চেষ্টা করছে চারুর সাথে ওর পরিবারের কারো সাথেই সম্পর্ক ভালো ছিল না। তাদের এসব কুটনৈতিক কাজে চারুর কোন হাত নেই। এসবের কিছুই ও জানে না।
পুলিশ ধ্রুবর কথা কানেই নিচ্ছে না বারবার চারু কে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে। অবশেষে পুলিশ চলে যাবে ভাবল চারু প্রেগন্যান্ট না থাকলে হয়ত ওকে থানায় ও নিয়ে যেতো এমন হুমকি দিয়ে গেল। চারু কে ওয়ার্নিং দিল।
কেউ সামনে না এলেও যুথির মা হনহনিয়ে এসে দাঁড়াল পুলিশের সামনে তারপর রেগে বললেন,’ এই মেয়েকে থানায় নিয়ে যান অফিসার তাহলে একাই সব কথা গড়গড় করে বলতে থাকবে। এই মেয়েই নাটের গুরু আমি নিশ্চিত।’
ধ্রুব চিৎকার করে উঠল,’ চাচি…!’
যুথির মা বললেন,’ এই মেয়ে আর এর পরিবারের জন্য আমার ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। আমার সহজ সরল ভাইপোকে ব্লাকমেইল করে সর্বশান্ত করেছে।’
চারু বলল,’ আমি কিছু করিনি চাচি আপনি বিশ্বাস করেন। আমার কোন হাত নেই। আমাকে দয়া করে দোষারোপ করবেন না।’
ধ্রুব বলল,’ চাচি তুমি আর একটাও বাজে কথা বলবে না চারুর নামে।’
পুলিশ চলে গেল ঝামেলা দেখে। আর যাওয়ার আগে চারু কে সাবধান করে গেল।
ধ্রুব নিজের মাকে ডেকে বলল,’ মা তুমি দেখলে চাচি কি করল?’
‘ দেখেই আর কি হবে? তোর বউ এর জন্য বাসায় পুলিশ আসল আমাদের কি আর কোন মানসম্মত রইল? এই মেয়েকে বিয়ে করে আর কত কিছু দেখাবি তুই?’
ধ্রুব রেগে সোফায় লাথি মেরে চারু কে টেনে রুমে নিয়ে এলো।
#চলবে….