প্রেমনেশা পর্ব-৫৬ এবং শেষ পর্ব

0
2

#প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
৫৬.

আমার উপর দোষারোপ কাটানোর জন্য সিঁথি আর ময়না বেগম কে হন্যে হয়ে ধ্রুব ও খুঁজতে লেগে পড়ল। ও চায়না তাদের পাপের শাস্তি আমাকে পেতে হয়।
চারু ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না সব সময় দুশ্চিন্তা নিয়ে‌ থাকে। এজন্য চারু খুব দূর্বল হয়ে পড়ল ডক্টরের কাছে গেলে ডক্টর জানালো এই সময় দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে হবে চারু কে আর খাওয়া-দাওয়ায় গাফেলতি একদম করা যাবেনা। চারু কে নিয়ে হসপিটালে থেকে বেরিয়ে ধ্রুব কঠিন স্বরে বলল,’ চারু প্লিজ দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকো আমাদের বেবির কথা ভাবো। এই বেবি পৃথিবীতে আনার জন্য তুমি কত যুদ্ধ করেছো। আমার সাথেও করেছো আমিও তোমার পাশে ছিলাম না। এখন শেষ মুহূর্তে এসে তুমি এমন হেলাফেলা করে নিজের এবং আমাদের অনাগত সন্তানের ক্ষতি করো না চারু। আমি শুধু তোমার জন্য ময়না বেগম ও সিঁথি কে হন্যে হয়ে খুঁজছি তোমার উপর করা সমস্ত আরোপ আমি মিথ্যে প্রমাণিত করব ইনশাআল্লাহ। তুমি শুধু নিজেকে সুস্থ রাখো। তোমার কিছু হলে আমি কিভাবে বাঁচব বলো?’
ধ্রুবর কথায় চারু ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,’ আই অ্যাম সরি আসলে এতো কিছু হচ্ছে আমার উপর দিয়ে আমি নিজের অজান্তে নিজের ক্ষতি করে দিচ্ছিলাম।’
বাসায় এসে ধ্রুব নিজের বাসার সবাইকে ডেকে শাসালো চারু কে দোষারোপ করে কেউ খারাপ কথা বললে ফলাফল খারাপ হবে। চারু আর ধ্রুব কে বাসায় রাখার পর থেকে বাসার হাঁড়ি আলাদা হয়ে গিয়েছে। যুথির মা ঝগড়া করে বলেছে একসাথে তিনি আর থাকবেন না।
চারু কে থানায় ও পাঠানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু ধ্রুবর বাবা মা তখন দ্বিমত করেছে। এসব দেখে যুথির বাবা মা অসন্তুষ্ট হয়েছে।
এক‌ই বাসায় থেকেও কেউ কারো সাথে বাক্যবিনিময় করে না।
ধ্রুবর কথায় মুখ ভেংচে চলে গেলেন তিনি। ধ্রুব নিজের মাকে চারুর কন্ডিশন বলল।‌

ধ্রুব নিজের ফ্রেন্ড নিয়ে ময়না বেগম কে খুঁজছে ও একটা ইঙ্গিত পেল। টাকা হাতে পেয়ে তিনি নিজের বাসা ছেড়েছে এর উত্তর আশেপাশের মানুষ দিতে পারবে। আশেপাশের মানুষের কাছে গিয়ে কোন লাভ হলো না তারা জানালো পুলিশ এসেছিল কিন্তু তারা কিছুই জানে না এজন্য খবর দিতে পারে নাই। এরপর ওরা সিঁথির নানাবাড়িতে খোঁজ নিল তারা জানে নাকি ধ্রুব বুঝল না কারণ তারা উল্টো পাল্টা উত্তর দিল। ধ্রুব ভাবল পুলিশ নিয়ে আসলে হয়তো আসল কথা জানাবে তাই করতে চাইল কিন্তু পুলিশ জানাল তারা আগেই সেখানে গিয়েছিল। ময়না বেগমের নাম্বার ট্যাগ করে একটা ঠিকানা পেল। পুলিশ সেখানেই যাবে জানালো। ধ্রুব তাদের সাথে সামিল হলো এবার ভাগ্য ধ্রুব দের সহায় ছিল এজন্য তো ময়না বেগম ও সিঁথি কে হাতে নাতে ধরতে পারল। পুলিশ সমেত ধ্রুব কে দেখে তিনি বললেন,’ জামাই বাবা কি হয়েছে পুলিশ নিয়ে এসেছো কেন?’
ধ্রুব বলল,’ আপনি এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? পুলিশ তো আমি আপনাদের খোঁজার জন্য নিয়ে এসেছি‌। হঠাৎ আমার শ্বাশুড়ি শালি উধাও হয়ে গেল । তারা কোন বিপদে পড়ল নাকি জানতে হবে না। এজন্য তো তন্নতন্ন করে আপনাদের খোঁজার কাজে লেগে পড়লাম ফাইনালি আপনাদের পেলাম। আপনাদের পেয়ে দেহ আমার জান ফিরে এলো যেন এমন লাগছে।’
ময়না বেগম বললেন,’ কিন্তু…’
ধ্রুব বলল,’ তা আমার শালি কোথায়?’
ময়না বেগম তোতলাতে তোতলাতে বললেন,’ আছে আশেপাশেই ওকে দিয়ে কি হবে?’
মহিলা পুলিশ ময়না বেগম এর হাত ধরে বললেন,’ আপনাদের দুজনকে থানায় যেতে হবে।’
ময়না বেগম বললেন,’ কেন আমরা কি করেছি?’
ভয়ে ময়না বেগম এর মুখটা সাদা হয়ে উঠেছে। তিনি থেকে থেকে ঢোক গিলছে। সিঁথি বাসায় এসে পুলিশ দেখে চমকে উঠল। মা মেয়েকে পুলিশ থানায় নিয়ে এলো। ময়না বেগম আর সিঁথিকে জিজ্ঞেস করা হলো তাদের অপকর্মের সাথে কি চারু সামিল ছিল নাকি।
ময়না বেগম বললেন,’ হ্যাঁ ছিল তো।’
ধ্রুব রেগে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। সিঁথি বলল,’ না ছিল না। আমি আর মা করেছি যা করার‌’
ময়না বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,’ আমরা জেলের ভাত খাব আর ওই চারু সুখে থাকবে এ তো হতে পারে না।’
সিঁথি বলল,’ মা এবার তো থামো। চারু প্রেগন্যান্ট। ওকে এসব জড়ানো ঠিক হবে না। আমাদের পাপের শাস্তি ও কেন ভোগ করবে।’
দুই তা মেয়ের তর্কবিতর্ক দেখে অফিসার ধমক দিলেন। দুজনেই কেঁপে উঠল।
ময়না বেগমের দিকে তাকিয়ে অফিসার বললেন,’ সব সত্যি কথা বলুন। মিথ্যা বললে শাস্তির পরিমাণ আরো বাড়বে মনে রাখবেন।’
ময়না বেগম শাস্তির কথা শুনে হাত জোড় করে সব সত্যি কথা বলল। চারু তাদের এসব ব্যাপারে কিছু জানত না‌। তাদের যেন ছেড়ে দেওয়া হয় এই অনুরোধ করল‌‌। ধ্রুব চলে আসতে নিচ্ছিল ময়না বেগম ডেকে বললেন,’ আমাদের বাঁচাও।’
ধ্রুব তাদের কথায় উত্তর দিল না আর না দাঁড়াল।

দুই মাস পরের কথা,
চারুর এখন নয় মাসের প্রেগন্যান্সি চলছে। দেখতে দেখতে দুই মাস পার হয়ে গেছে। চারু নির্দোষ জানার পর ধ্রুব মা বাবা চারুর প্রতি নরম হয়েছে। ধ্রুব এখন বেশিরভাগ সময় ভয়ে থাকে চারুর হাঁটাচলা দেখে। এজন্য নিজের অফিসে যাওয়া আবার অফ করে দিয়েছে‌ যতদিন চারুর ডেলিভারি না হচ্ছে ও অফিসে যাবে না। দিনরাত সমানে ধ্রুব নিজের যতটুকু করা সম্ভব সেবাযত্ন করে চারুর। প্রতিদিন রাতে উঠে চারুর পা টিপে দিতে হয়‌। চারু ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে।
ধ্রুব তখন বলে,’ হাসো কেন?’
‘ মনে আছে একসময় এই প্রেগন্যান্সির খবর পেয়ে আপনি আমায় কি বলেছিলেন?’
‘ চারু আমি তো তোমার কথা ভেবে বলেছিলাম। প্রেগন্যান্সির সময় কত কষ্ট করতে হয় তুমি কষ্ট পাবে এটা আমি চাচ্ছিলাম না কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি কিছু কিছু কষ্ট সুখ বয়ে আনে। এখন আমি চাই আমাদের একটা ফুটফুটে সন্তান হোক যার ছোটো ছোটো হাত পা ধরে আমি চুমু খাব। তার ডাগর ডাগর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে।
আমাকে পাপা বলবে ইশ চারু আমার এতো আনন্দ হচ্ছে।’
চারু ধ্রুবকে নিজের দিকে ডাকল। ধ্রুব ওর দিকে এগিয়ে এলে চারু ওর গাল স্পর্শ করে বলল,’ আপনার এই আনন্দ দেখে আমার খুব শান্তি লাগে।’
চারু উঠে বসার চেষ্টা করল ধ্রুব ওকে ধরে বসিয়ে দিল। ধ্রুবর লাল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’ আপনাকে খুব যন্ত্রণা করছি ইদানিং তাই না? রাতে ঘুমাতে দেই না বসিয়ে রাখি।’
ধ্রুব বলল,’ তোমার কষ্টের সামনে তো এটা কিছুই না চারু।’
চারু হাসলো। হঠাৎ হাসতে হাসতে ওর পেটে ব্যথা শুরু হলো। চারু আহ্ বলে হাসি থামিয়ে দিল। ধ্রুব আঁতকে উঠে বলল,’ কি হলো?’
‘হাসার জন্য হয়ত টান লেগেছে পেট ব্যথা করছে।’
ধ্রুব ওকে শুইয়ে দিয়ে বলল,’ শুয়ে পরো তুমি।’
চারু ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখ বন্ধ করল। ব্যথা কমায় বদলে বাড়ছে। চারু ভাবছে হয়ত একাই কমে যাবে তাই ব্যথা কমার অপেক্ষা করছে শোয়ে। ধ্রুব চারুর পাশে শুয়ে ওকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে ওর গালে একটা চুমু খেলো।
ধ্রুব চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল হঠাৎ চারু চিৎকার করে উঠল। চিৎকার করেই ও কেঁদে উঠেছে। ধ্রুব আচমকা চারু কে চেঁচিয়ে উঠতে দেখে ভয়ে ধরফরিয়ে উঠে বসে টেবিল লাইট জ্বালায়। চারু পেট ধরে চিৎকার করছে। ধ্রুব বলল,’ চারু কি হয়েছে?’
‘ জানি না আমার খুব ব্যথা করছে আপনি কিছু করেন। মাকে ডাকুন।’
ধ্রুবর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ধ্রুব দৌড়ে গিয়ে মাকে ডেকে আনলেন।
তিনি এসে বললেন,’ চারুর হয়ত লেবার পেইন উঠেছে ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে গাড়ি বের করতে বলো ড্রাইভার কে।’
চারু চিৎকার করেই যাচ্ছে। ধ্রুব ওর হাত শক্ত করে ধরে বলল,’ চারু আমরা এখনি হসপিটালে যাব তুমি একেবারে ভয় পাবে না‌ কেমন?’
‘ধ্রুব আমার খুব ভয় লাগছে। আমি যদি মরে যাই।’
চারুর কথায় ধ্রুবর বুক ধক করে উঠল।
ধ্রুব মৃদু ধমক দিয়ে বলল,’ একদম বাজে কথা বলবে না। তোমার কিছু হবে না।’
চারু গাড়িতে খালি এক ভয়ে কাঁদতে লাগল ও মরে যাবে না তো? ধ্রুব ওকে ধমকে ভালোবেসে বুঝাতে লাগল ওর কিছুই হবে না।
চারু সিজার রুমে নেওয়া হয়েছে বাইরে টেনশনে পায়চারী করছে ধ্রুব আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ধ্রুবর মা বাবা।
ধ্রুব মায়ের হাত ধরে একটু পর পর জিজ্ঞেস করছে,’ আম্মু চারুর কিছু হবে না তো?’
ধ্রুবর ছটফটানি দেখে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,’ যার এমন অফুরন্ত স্বামীর ভালোবাসা আছে তার কীভাবে কিছু হতে পারে?’
‘ আর আমার বেবি?’
‘ তুমি ভয় পেয়ো না ধ্রুব তোমার বেবি ও চারুর কিছুই হবে না ইনশাআল্লাহ। আমার ছেলের সুখ যাদের মাঝে বিরাজ করছে তারা আমার ছেলের সুখ হয়েই ফিরে আসবে।’
ধ্রুব কে সাহস দিতে অনেক কিছুই বলেছে ধ্রুবর মা কিন্তু ছেলের মন তো তখনি শান্ত হবে যখন সে তাদের দেখতে পারবে। নার্স যখন ধ্রুবর ফুটফুটে কন্যা সন্তান কে কোলে নিয়ে বাইরে এলো ধ্রুবর দিকে তখন বিস্মিত হয়ে ধ্রুবর মা তাকিয়ে ছিল। ধ্রুব নিজের কন্যাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,’ আম্মু দেখো আমার বেবি।’
ধ্রুবর মুখে তখন এতো আনন্দ ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। ধ্রুবর হাত তখন কাঁপছিল নিজের সন্তান কে দেখে ওর চোখের অশ্রু থামতেই চাইছিল না। ধ্রুব চারু কে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেল ডক্টর জানালো চারু ঠিক আছে তাকে একটু পর কেবিনে দেওয়া হবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করতে বলা হয় কিন্তু ধ্রুবর যেন তর সইছে না ধ্রুব তখনি চারুর সাথে দেখা করার জন্য পাগলামি শুরু করে। নার্স বাধ্য হয়েই ওকে অনুমতি দেয়। চারু এখন অজ্ঞান ছিল ধ্রুব গিয়ে চারুর হাত ধরে চুমু খায় আর ওর কানে কানে বলতে লাগে,’চারু উঠো দেখো আমাদের মেয়ে হয়েছে।’
কিন্তু চারু উঠল না। নার্স ওকে ফের করে দিল।
চারু কে কেবিনে দেওয়ার পর ধ্রুব চারুর পাশেই বসা ছিল। চারুর জ্ঞান ফেরার পর ধ্রুব নিজের মায়ের কাছে থেকে বেবিকে কোলে নিয়ে চারুর কাছে আসে। চারু নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
চারু নিজের সন্তানের দিকে তাকিয়ে বলে,’ আমার মেয়ে।’
ধ্রুব বলে,’ শুধু তোমার না বলো আমাদের মেয়ে।’
চারু মুচকি হেসে বলে,’ হ্যাঁ আমাদের মেয়ে।’

সমাপ্তি