#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
২৯.
-আমি বিয়েটাতে রাজী রাকীন। সত্যিই হয়তো তোর চেয়ে বেশি আন্ডারস্ট্যান্ডিং কাউকে পাবো না। তাই জীবনসঙ্গী হিসেবে তোকেই মেনে নেবো। আমি রাজী বিয়েতে।
ফোনে ইচ্ছের বলা কথাটা শুনে কান থেকে ফোন নামিয়ে কলটা কেটে দিলো রাকীন। ও জানতো, ইচ্ছে মানা করবে না এই বিয়েতে। ইচ্ছের মনে এখনো অবদি যদি কোনো দুর্বলতা থেকে থাকে, সেটা শুধু ওকে নিয়েই। যদিও তা ভালোবাসার না। বন্ধুত্বের। তবুও! ওর সারা রুমের অবস্থা দেখার মতো না। ড্রেসিংটেবিলের আয়না চুর্নবিচুর্ন হয়ে মেঝেতে পরে আছে। সাথে পরে আছে রাকীনের শিক্ষাজীবনের গোটাবিশেক ক্রেস্ট, মেডেল আর অনেকগুলো স্কেচের কাগজ। তাতে এক বাচ্চা মেয়ের মুখশ্রী। মোবাইলটা ছুড়ে মেরে, চিৎকার করে মাথার চুলগুলো উল্টে ধরলো রাকীন। দেয়ালে ঘুষি ছুড়লো কয়েকবার। ওর আওয়াজ শুনে ছুটে এলেন রাজীব মাহমুদ আর তার মিসেস। ভেতরে ঢুকে চারপাশ দেখে শব্দ করে কেদে দিলেন মিসেস মাহমুদ। ছুটে এসে বিছানায় বসা রাকীনের কাটা হাত আচলে চেপে ধরলেন। এতোগুলো বছরের সংসারে, স্বামীর দিকে প্রথমবারের মতো ঘৃনাদৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে বললেন,
-এটা কেমন বিয়ে বলতে পারো? তুমি না আমাদের ছেলের ভালোর জন্য ওকে বিয়ে দিতে চাইছো? আমার ছেলেটা তো…
-আমি ঠিক আছি মা।
শান্তস্বরে বললো রাকীন। মিসেস মাহমুদ আরো জোরে কেদে দিয়ে বলতে যাচ্ছিলেন কিছু। রাকীন নিজেকে ছাড়িয়ে বাবার মুখোমুখি এসে দাড়ালো। শক্ত গলায় বললো,
-ইচ্ছে রাজী হয়ে গেছে বাবা। ও রাজি এই বিয়েতে।
-এ মাসের পনেরো তারিখ তোমাদের বিয়ে রাকীন।
রাকীন চোখ সরিয়ে তাচ্ছিল্যে হাসলো। বললো,
-আর খেয়া হাউজিং?
-আমি কথা বলেছি লয়ারের সাথে। ঝামেলা মিটে গেলে আমিই ইনস্টলমেন্টের ব্যবস্থা করে দেবো। ওটা নিয়ে আর ভাবতে হবে না তোমাকে। নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নাও রাকীন। আমার বিশ্বাস, ইচ্ছেকে কোনোদিনও কষ্ট দেবে না তুমি। আর সে দায়িত্ববোধ থেকেই তোমাদের সম্পর্কটা আরো গাঢ়তর হবে দেখো। তাইতো এই বিয়ে…
আবারো রাকীন তাচ্ছিল্যে হাসলো। বললো,
-ইচ্ছেকে যেমন কোনোদিনও কষ্ট দিতে পারবো না, তেমন খেয়াকেও কোনোদিনও ভুলতে পারবো না আমি বাবা। তাই বলে তুমি ভুলেও ভেবো না, হাউজিং নিয়ে তোমার শর্তের জন্য এই বিয়েতে রাজি হয়েছি আমি। মোটেও তা নয়। ইচ্ছের বন্ধুত্বের জন্য ওকে খুশি রাখার দায়িত্বটা আমি নিচ্ছি। মাঝখান থেকে এই শর্ত জুড়ে দিয়ে নিজেকে ছোট না করলেও পারতে।
ছেলের সামনে দাড়িয়ে থাকার আর সাহস হলো না রাজীব মাহমুদের। চলেআসলেন রাকীনের সামনে থেকে। জীবনে এই প্রথমবার এতোটা নিচকাজ করেছেন তিনি। ছেলেকে ভালো দেখবেন বলে তার ভালোলাগার, ভালোবাসার সাথেই বেআইনি সংশ্লিষ্টতা প্রমান করে তাতে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন রাজীব মাহমুৃদ। উপায় ছিলো না তার। অবশ্য তাতে যদি ভবিষ্যতে রাকীন, ইচ্ছে দুজনেই ভালো থাকে, এ কাজ নিয়ে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই তার। একটুও না।
•
সন্ধ্যে নেমেছে শহরে। বাইকের চাবিটা নিয়ে বেরোচ্ছিলো প্রাপ্ত। পরনে সাদা টিশার্টের উপর ডার্কচেইক শার্ট। শার্টের হাতা কনুই অবদি গুটানো। ইচ্ছের দেখা সেই প্রথমদিনের প্রাপ্তর মতো। ভালোবাসি বলবে বলে, চেনাপরিচয়ের সেই শুরুর বেশেই বাসা থেকে বেরোনের প্রস্তুতি নিয়েছে প্রাপ্ত। দরজা দিয়ে বেরোনের সময় সাদিক সাহেব ডাক লাগালেন ওকে। প্রাপ্ত দাড়ালো। সাদিক সাহেব বললেন,
-ইমারজেন্সি?
মুচকি হেসে মাথা নেড়ে না বুঝালো প্রাপ্ত। মুখে বললো,
-কিছু বলবে বাবা?
ছেলের কাধে হাত রাখলেন সাদিক সাহেব। মুখে হাসি রেখে করিডোর দিয়ে হাটতে হাটতে বললেন,
-তোমার মা মারা যাওয়ার পর থেকে এখনো অবদি, আমি সবসময়, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি তোমাকে আর পিয়ালীকে সবরকম অভাব থেকে আগলে রাখার। বাবা হিসেবে কতোটুকো পেরেছি, তা তোমরাই জানো প্রাপ্ত। কিন্তু আমি সবসময় চেয়েছি তোমাদের বন্ধু হতে। আর হয়েও উঠেছি বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই হয়তো কোনো আড়াল সেভাবে ছিলোই না আমাদের মাঝে। আজও আমি তার ব্যতিক্রম চাইনা প্রাপ্ত। তাই সরাসরিই বলতে চাইছি তোমাকে।
প্রাপ্ত দাড়িয়ে গেলো। স্বতন্ত্রস্বরে বললো,
-এভাবে কেনো বলছো? কি হয়েছে বাবা? কোনো সমস্যা?
-সমস্যা না প্রাপ্ত। সমাধান। আমার হাজারো ব্যাকুলতার সমাধান তুমি।
-মানে? কি হয়েছে বলোতো বাবা!
সাদিক সাহেব আবারো মুচকি হাসে বলতে লাগলেন,
-আমি জানি, তুমি খইকে পছন্দ করো। আর খইও এ কয়দিনে যথেষ্ট সাচ্ছন্দ্য হতে শুরু করেছে তোমার সাথে। তাই তোমাদের দুজনের বিয়েটা এবার সেরে ফেলতে চাইছি আমি প্রাপ্ত। এ বিষয়ে তুমি কি বলো?
বাবার কথা শুনে খুব বেশি চকিত হলো না প্রাপ্ত। এমন ভাবনা যে সাদিক সাহেবের আগে থেকেই ছিলো, তা ও জানতো। কিন্তু কথাটা আজ বলছে বলেই যা। ও ভেবেছিলো ইচ্ছেকে বলার পরই বাবাকে বলবে, ও ইচ্ছেকেই ভালোবাসে। কিন্তু সাদিক সাহেব আগেই বলে বসলেন কথাটা। প্রাপ্ত এটা খুব ভালোমতোই জানে, ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনোই ওকে জোর করবে না ওর বাবা। আজ যখন কথাটা উঠেছেই, ও ঠিক করলো, পরিস্কারভাবে বলবে বাবাকে, ইচ্ছেকে ভালোবাসে ও। খইকে নয়। এটা জানলেই মিটে যাবে সবটা। মুচকি হেসে প্রাপ্ত বললো,
-আসলে বাবা, তুমি যেমনটা ভাবছো, তেমনটা নয়। কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে তোমার।
সাদিক সাহেব একটু থেমে বললেন,
-ভুল বোঝাবুঝি মানে?
-সত্যি বলতে, আমিও ধারনা করেছিলাম, তুমি যা ভেবেছিলে সেভাবেই হওয়ার কথা ছিলো সবটা। কিন্তু হয়নি। বরং তার বিপরীতে ঘটে গেছে সবকিছু। বিশ্বাস করো বাবা, আমার অগোচরেই হয়েছে এসবের রদবদল। তোমাকে, আমাকে ভুল প্রমানিত করে আমার মন আজ বিপরীতে আটকেছে। আসলে আমি খইকে ভ্…
-প্রাপ্ত?
ভালোবাসি না বাবা- বলার আগেই মাহীমের গলা শুনে প্রাপ্ত থামলো। দরজায় ঝুকে দাড়িয়ে হাটুতে দুহাত রেখে সমানে হাপাচ্ছে ও। ও যে ছুটতে ছুটতে এ বাসা অবদি পৌছেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাপ্ত বললো,
-কি হয়েছে? এভাবে হাপাচ্ছিস কেনো?
মাহীম সোজা হয়ে দাড়িয়ে, জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে ভেতরে ঢুকলো। কিছুক্ষন সাদিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে থেকে কি ঘটেছে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো হয়তো। আগের মতোই হাপিয়ে ওঠা কন্ঠে বললো,
-তোর সাথে জরুরি কিছু কথা আছে।
প্রাপ্ত ওর কথাকে উপেক্ষার স্বরে বললো,
-পরে। বাবার সাথে কথা আছে আমার।
-কিন্তু প্রাপ্ত এটা তারচেয়েও বেশি জরুরি। তোর…
-তোকে বললাম না? এখন বাবার সাথে কথা বলছি আমি। পরে দেখছি তোর বিষয়টা। সোফায় গিয়ে বস কিছুক্ষন।
কড়া গলায় মাহীমকে থামিয়ে দিয়ে বাবার দিকে ফিরলো প্রাপ্ত। মাহীম অস্থিরভাবে কপাল চেপে ধরে এদিকওদিক পায়চারী করতে লাগলো। সাদিক সাহেব মৃদ্যু হেসে বললেন,
-আগে মাহীম কি বলে, সেটা শুনে এসো প্রাপ্ত। আমরা নিজেদের কথা একটু পরে আলোচনা করলেও কোনো সমস্যা নেই তো।
-কিন্তু বাবা…
-কোনো কিন্তু নেই। শুনে এসো তুমি। মনে হচ্ছে খুব জরুরি কিছু বলবে ও। ছুটে এসেছে ওভাবে।
শীতল দৃষ্টিতে মাহীমের দিকে তাকালো প্রাপ্ত। মাহীম অসহায়ভাবে ইশারায় বুঝালো, আমার কথাটা শোন ভাই। বাবার সামনেই দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে ওর শার্ট ধরে টেনে নিজের সামনে নিয়ে পিঠে ধাক্কা লাগালো প্রাপ্ত। এক ধাক্কাতেই দরজা ঠেলে ভেতরের রুমে ঢুকেছে মাহীম। প্রাপ্ত শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে, ওর দিকে এগোতে এগোতে বললো,
-সমস্যা কি তোর? তোর জন্য কি বাবার সাথে নিজের বিয়ের আলাপও করতে পারবো না ঠিকমতো? বল তোর জরুরি আলাপ। আমি তো শুনি। তবে যদি তোর আলাপে জরুরি কিছু না থাকে, আমি নিজ দায়িত্বে তোকে জরুরি খাতিরের মাধ্যমে হসপিটালের জরুরি বিভাগে পাঠিয়ে দেবো। বল এবার।
-বিয়ের আলাপ মানে? কার সাথে? খই?
মাহীমের বিস্ময়ের সুর। প্রাপ্ত বললো,
-না। যাকে ভালোবাসি তার সাথে। তুই বল কি বলবি।
-তুই কি সাদিক আঙ্কলেকে রকস্টার ইচ্ছের বিষয়ে বলতে যাচ্ছিলি?
প্রাপ্ত থামলো। মাহীমের সাথে ওর ওঠাবসা বেশি। ইচ্ছেকে নিয়ে ওর অনুভূতিগুলোও ও টের পেয়ে যাবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু না। শান্তভাবে বললো,
-হেয়ালী না করে আগে বল কি বলতে এসেছিলি। তাড়া আছে আমার।
-তুই রকস্টার ইচ্ছেকে ভালোবাসিস।
চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছাড়লো প্রাপ্ত। অস্বীকার করার উপায় নেই। অস্বীকার করতে ইচ্ছে করছে না ওর। শুধু মাহীম কেনো, চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে বলতে ইচ্ছে করছে ওর, ও ইচ্ছেকে ভালোবাসে। ঠোটে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে একধ্যানে কিছুক্ষন মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। তারপর মাথা তুলে মাহীমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-হ্যাঁ ভালোবাসি। ভালোবেসে ফেলেছি ওই রকস্টারকে। প্রচন্ড! ওকে ছাড়া থাকা দায় হয়ে গেছে আমার মাহীম। খুব বেশি ভালোবাসা আর তার থেকে দুরুত্ব, এতো বেশি ভয়ানক হয় বুঝি? পাগল করে দিয়েছে আমাকে সে। লিটরেলি পাগল করে দিয়েছে। তাকে ছাড়া মনমস্তিষ্কে আর কোনো কিছুই আসছে না। কি করি বলতো?
ওর কথা শুনে মাহীম নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো। প্রাপ্ত হেসে বললো,
-থাক। তোকে বলতে হবে না। বাবার সাথে ওকে নিয়েই কথা আছে আমার। বাবাকে বলে, তারপর ওকে প্রোপোজ করতে যাবো ভাবছি। সময় নষ্ট করিস না আমার। কিছু বলার থাকলে বল, নইলে আমি আসছি।
নিরবে ওর দিকে চেয়ে রইলো মাহীম। রাগ নিয়ে তেড়ে এগোতে গিয়েও নিজেকে সামলালো প্রাপ্ত। ওকে জ্বালাতেই মাহীম এসময় এসেছে এমনটা ভেবে পেছন ফিরলো বেরিয়ে আসবে বলে। মাহীম ডাক লাগিয়ে বললো,
-যাস না প্রাপ্ত।
-শা’লা! কুসংস্কার বলেও একটা কথা আছে! এই কাজেও পিছনডাক দিলি? ফিরবো না আমি।
চোখ বন্ধ করে নিজেকে সংবরন করতে গিয়ে বিরক্তি বাড়লো। মাহীমের দিকে ফিরে না ফিরে হাটতে হাটতেই বললো ও কথাটা। মাহীম ধরা গলায় বললো,
-ইচ্ছের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে প্রাপ্ত। সামনের পনেরো তারিখ ওর বিয়ে।
#চলবে…
#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
৩০.
-রকস্টার ইচ্ছের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে প্রাপ্ত।
প্রাপ্তর পা থেমে গেলো তৎক্ষনাৎ। রোবটের মতো পেছন ফিরলো ও। ওর অবিশ্বাসী চাওনি। মাহীম জলভরা চোখে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর এগিয়ে এসে মোবাইলটা বের করে এগিয়ে দিলো প্রাপ্তর হাতে। আস্তেধীরে মোবাইলে থাকা নিউজটায় চোখ বুলিয়ে নিলো প্রাপ্ত। রকস্টার ইনায়াত নিক্কন ইচ্ছে আর ইনিশা বিল্ডার্সের উত্তরসুরী রাকীন শাফায়াতের বিয়ের খবর। একটু চুপ থেকে হঠাৎই হেসে উঠলো প্রাপ্ত। শব্দ করে হাসতে হাসতে বিছানায় গিয়ে বসলো ও। মাহীম নির্বাক। ও বুঝে উঠতে পারছে না, ঠিক কি বলে প্রাপ্তকে সামলাবে। প্রাপ্ত হাসি থামালো। হাটুতে কনুই ঠেকিয়ে বসে আবারো কিছুক্ষন একধ্যানে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,
-এমনটাই তো হওয়ার ছিলো। তাইনা রে মাহীম?
-নিজেকে সামলা প্রাপ্ত।
-সামলানোর কি আছে এখানে মাহীম? কিছুই নেই তো সামলানোর। এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিলো। দোষটা তো আমারই। যে মনটাকে সযত্মে গুছিয়ে রেখেছিলাম, তাকে দেখার পর, সে মনটাকে আমি আর সামলাতে পারি নি। যেখানে দুজনার মিল কোনোদিনও হবার নয়, সেটা ভুলেও ভালোবেসে ফেলেছি তাকে। অনুভব হয়, বারবার, প্রতিবারের দেখায় প্রেমে পরেছি তার। আর তার চেয়েও বড় কথা, যাকে আমি ভালোবাসলাম, সে যে অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে এ কথাটা অবদিও ভুলে গিয়েছিলাম আমি। একবারও ভাবি নি, ইচ্ছে নিজে থেকে কখনো আমাকে অনুভব করায় নি, ও ভালোবাসে আমায়। বারবার দেখা হওয়াটা তো শুধু কো-ইন্সিডেন্স ছিলো মাত্র! আর প্রতিবার সেই দেখা হওয়ায় ওর হাসিটা দেখার বদৌলতে ভুলে গেলাম, ওর মতো সেলিব্রিটির লাইফে আমার মতো অহরহ মানুষের আনাগোনা। অনেকেই আমার মতো এভাবে ভালোবেসে ফেলেছে ওকে। আর ওউ হয়তো সেই ভালোবাসাগুলোর একটাকে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই।
মাহীম এগিয়ে এসে প্রাপ্তর কাধে হাত রাখলো। কথাগুলো বলে মাথা নিচু করেছিলো প্রাপ্ত। কাধে মাহীমের হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ তুলে তাকালো ও। ওর চোখ দেখে এতোক্ষনে আঁতকে উঠলো মাহীম। ছলছল করছে প্রাপ্তর চোখ। যখন তখন অস্রুবর্ষন হবে তুমুলভাবে। ওকে অবাক করে দিয়ে ঠোটে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে প্রাপ্ত বললো,
-এতোটাই বেশি ভালোবেসেছি যে, শুধু ওকে ভেবে বাকিসব ভুলে গিয়েছি মাহীম। এমনকি আমার সে কল্পকন্যাকেও। ও আমাকে নিজেরসত্ত্বাতেই আটকে নিয়েছে রে। প্রেমনোঙরে। আমি কি করবো বল? ওর ভালোবাসার জোয়ারে ভাসতে চাওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। দোষটা আমারই।
মাহীম কিছু বলতে যাচ্ছিলো। ওকে সুযোগ না দিয়ে উঠে দাড়ালো প্রাপ্ত। একফোটা চোখের জলও পরতে দেয়নি নিজের চোখ থেকে। ঠিকঠাকমতো দাড়িয়ে গলা ঝেরে বললো,
-এখানে যা যা কথা হলো, ভুলে যা। কেউ জানবে না এসব কিছু। মাথায় রাখিস কথাটা।
-প্রাপ্ত?
-আমি বলেছি কেউ কিছু জানবে না মানে জানবে না।
মাহীম থামলো। প্রাপ্ত কি করে নিজেকে সামলাবে সেটা ও জানে না। তবে এই কথাগুলো কাউকে জানিয়েও যে কোনো লাভ নেই, তা ও বেশ ভালোমতোই জানে। যেখানে ইচ্ছেরই বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সেটা অবশ্যই ওর সম্মতিতেই হচ্ছে। প্রাপ্তকেই ওর একপাক্ষীক ভালোবাসা ভুলতে হবে। আর কথা বাড়ালো না মাহীম। রুম থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে আসলো প্রাপ্ত। ড্রয়িংরুমে ততক্ষনে খই আর মিষ্টি এসে বসেছে সাদিক সাহেব আর পিয়ালীর সাথে। প্রাপ্তকে দেখে দাড়িয়ে গেলো খই। একপলক ওর দিকে তাকিয়ে, প্রাপ্ত সুস্পষ্ট গলায় বলে দিলো,
-এ মাসের পনেরো তারিখে আমার আর খইয়ের এনগেইজমেন্টের ব্যবস্থা করো বাবা। পরের এক সপ্তাহের মধ্যেই চাকরি কনফার্ম করে ফেলবো আমি। বিয়েটা আমার এপয়েন্টমেন্ট লেটার পাবার পরেই হবে। আমি খই-কেই বিয়ে করতে চাই।
পাথরের মতো দাড়িয়ে রইলো খই। ঠিক কি শুনেছে, তা বুঝে উঠতেই পারলো না যেনো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সাদিক সাহেবের দিকে। তার চেহারার হাসিটা বলে দিলো, প্রাপ্তর সাথে ওর বিয়ে হোক, এমনটাই চান তিনিও। শ্বাস আটকে একপা দুপা করে পেছোতে লাগলো ও। সাদিক সাহেব ইশারা করতেই পিয়ালী আর মিষ্টি উঠে দাড়িয়ে গেলো। মিষ্টি খইয়ের কাধে হাত রেখে বললো,
-তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি আমি। চলো।
জলভরা চোখে মিষ্টির দিকে তাকালো খই। যন্ত্রমানবীর মতো চলে আসলো পিয়ালীর ঘরে। মিষ্টি মৃদ্যু হেসে বললো,
-আসলে পিয়ালীর মা ছিলেন গ্রামের মেয়ে। সাদিক আঙ্কেলের কোনো এক থেসিস চলাকালে তার সাথে দেখা হয়। প্রেমের বিয়ে ছিলো দুজনের। হয়তো এ কারনেই প্রাপ্তর বরাবরের ইচ্ছে ছিলো, গ্রামের প্রানবন্ত কোনো মেয়েকেই বিয়ে করার। ওর লাইফে তেমন করেই কেউ আসুক, যেমনটা ওর বাবা মায়ের সাথে হয়েছিলো। তোমাকে দেখার পর আমাদের সবারই মনে হয়েছে, প্রাপ্তর মনে সে জায়গাটা তুমিই করে নিতে পারবে। এমনকি তুমি করেও নিয়েছো। এখন তুমি নিজের মতো করে এ শহরে মানিয়ে নিতে শিখেছো খই। তোমার চেষ্টায় পড়াশোনাতেও তুমি অনেকদুর এগিয়েছো। সাদিক আঙ্কেল তো সবসময়ই তোমার পাশে ছিলেন। আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। তবুও যেহেতু প্রাপ্তর তোমাকে পছন্দ, তাই উনি চান তোমাদের দুজনের বিয়েটা সেরে ফেলে তোমাকে এ বাসায় নিয়ে আসতে।
খই নির্বাক। সাদিক সাহেবের দায়িত্ববোধটা এতো বেশি হবে যে, নিজের ছেলে বউ করে ওকে নিজের কাছে রাখবেন উনি, এমনটা ধারনাতেও ছিলো না ওর। তবে যদি প্রাপ্ত ওকে ভালোবেসে ফেলে, সেদিকটাও ভাববেন উনি। এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু তা বলে ওর মতো অনাথকে? অবশ্য ও যে অনাথ সেটা বিবেচনার মন মানসিকতা সাদিক সাহেবের নয়, ও এটাও জানে। প্রাপ্ত কি করে ওকে ভালোবাসে? কেউ আগে থেকেই কেমন মানুষকে ভালোবাসবে সেটা নিশ্চিত করে রাখতে পারে বুঝি? এই ভালোবাসার প্রতিত্তর কি হওয়া উচিত ওর? ও তো ভালোবাসে না প্রাপ্তকে। তাহলে কাকে? যার কথা ভেবে ভেবে ও নিজেকে সাজাচ্ছে, তাকে নয় তো? ওর নকশাদার! ওর? মাথার চুলগুলো উল্টে ধরলো খই। ওর দিশেহারা অবস্থা দেখে পিয়ালী আর মিষ্টি একে অপরের দিকে তাকালো। পিয়ালী এগিয়ে এসে বললো,
-তুমি কি চাও খই? তুমি চাওনা এই বিয়েটা হোক?
ওর জিজ্ঞাসুদৃষ্টির জবাব খুজে পেলো না খই। কিন্তু ওকে তো জবাব দিতেই হবে। মিষ্টি আবারো বললো,
-বলো খই? তোমার মতামত ছাড়া তো আর বিয়েটা সম্ভব না। তোমার মত নেই এই বিয়েতে?
মত নেই! কথাটা বলার কারন খুজতে লাগলো খই। কিন্তু খুজে পেলো না। যতোটা ভালোবাসা এখানে ও পেয়েছে, তার সীমা জানা নেই ওর। অমক করবে কার জন্য? যে মানুষটার সাথে কিছুটা সময়ের সাক্ষাৎ ওকে নতুন করে বাচতে শিখিয়েছে, তার জন্য? কিন্তু সে তো আপনজন হওয়ার কোনো আশ্বাস দেয়নি ওকে। সেদিনের পর আর দেখা পর্যন্ত করতে আসেনি সে মানুষটা। তবে তার জন্য কেনো ও ভাবছে? কেনো তার জন্য এই পরিবারটাকে অস্বীকার করবে ও? তা কি করে হয়? একটা শ্বাস ছেড়ে খই চোখ বন্ধ করে বললো,
-আমি রাজি।
পিয়ালী জড়িয়ে ধরলো খইকে। মিষ্টি কি বুঝে কিছুক্ষন অনুভবের চেষ্টা করলো ওর কথাটা। বললো,
-সত্যিই কি তুমি রাজী খই?
-হ্যাঁ। অমতের তো কোনো কারন নেই আমার মিষ্টি আপু। আমি রাজি।
-কিন্তু খই…
-আজ মা থাকলে…
কথা শেষ না করে তাচ্ছিল্যে হাসলো খই। মুলত মিষ্টির সন্দিহান কথাগুলো থামাতে মায়ের কথাটাকেই মনে করিয়ে দিলো ও। মিষ্টি মৃদ্যু হেসে ওর কাধে হাত রেখে বললো,
-উনি যেখানেই আছেন, ভালো আছেন খই। তোমার সিদ্ধান্তে খুশিই হয়েছেন। প্রাপ্ত অনেক ভালো রাখবে তোমাকে। অনেক ভালোবাসবে।
খই নিমীলিত দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। ও তো ভালোবেসে ভালোবাসার আশা করেছিলো। সে সৌভাগ্য হলো না। এবার ভালোবাসাকেই ভালোবাসার চেষ্টা করবে না হয়!
•
মায়ের পুরোনো একটা গয়না খুজতে খুজতে নিজের পুরো রুমটা তছনছ করে দিয়েছে ইচ্ছে। যেখানে আর কিছু হোক বা না হোক, মায়ের জিনিসগুলো সবসময় নখদর্পনে থাকে ওর। মাথার চুলগুলো উল্টে চেপে ধরে ধপ করে বিছানায় বসে পরলো ও। বিয়েতে রাজী কথাটা রাকীনকে বলার পর থেকেই মাথা কাজ করছে না ওর। টমি মুখ দিয়ে মেঝেতে পরে থাকা দুটো ফাইল খানিকটা সাইডে রেখে দিলো। কিছু জামাকাপড়ও একপাশে টেনে রাখলো। ঘর গোছানোর চেষ্টা হয়তোবা। অতঃপর ইচ্ছের কাছে এগোলো। ওর পায়ে প্যাঁচ লেগে গেছে কিছু একটা। ইচ্ছের অস্থিরতা বুঝে ওকে নিজের দিকে মনিযোগী করার চেষ্টা শুরু করলো টমি। ওর গা ঘেষা, পা মুড়িয়ে থাকা। ইচ্ছেও বুঝলো, টমি ওর পা মুড়িয়ে থাকা জিনিসটা ছাড়িয়ে দিতে বলছে ও। কিছুক্ষন পাত্তা না দিয়ে মাথা ধরে বসে রইলো নিজের মতো। টমি হার মানতে নারাজ। যেনো ইচ্ছের মনোযোগ এখন ওর চাইই চাই! পেরে না উঠে ইচ্ছে একসময় চেচিয়ে বলে উঠলো,
-ওটা প্রাপ্তর ছেড়া স্কার্ফ না টমি! সো প্লিজ স্টপ এনোয়িং মি!
বলে দিয়ে নিজেই আটকে গেলো ইচ্ছে। টমি ওর ধমক শুনে নুইয়ে বসে গেলো মেঝেতে। ঠোট কামড়ে ধরে আশেপাশে তাকালো ইচ্ছে। আজ বাদে কাল রাকীনের সাথে ওর বিয়ে। বাকিসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোর মতো, আজ এই মুহুর্তেও প্রাপ্তর নামটাই ওর মাথায় ঘুরছে। নিজের ওপর প্রচন্ডরকমের বিরক্ত হলো ও। একটা অচেনা মানুষকে নিয়ে কখনো এতোটা ভেবেছে কিনা মনে পরলো না ওর। মাথা থেকে এসব ভাবনা সরানো জরুরি ভেবে বাটন ফোনটা হাতে নিলো ইচ্ছে। ডাবল ট্যাপে লাস্ট ডায়ালড্ নম্বরে না দেখেই কল লাগালো ও। ওপাশ থেকে শান্তশিষ্ট এক আওয়াজ,
-হ্যালো কে বলছেন?
গলার স্বর শুনেই চমকে উঠলো ইচ্ছে। কান থেকে ফোন নামিয়ে নম্বরটার দিকে তাকালো। আননোন নম্বর। অথচ ওই ফোনে ওর বাবা আর রাকীনের ছাড়া অন্যকারো নম্বর থাকার কথা না। আর রাকীনকেই কল করতে চেয়েছিলো ও। কিন্তু এই অচেনা নম্বরধারীর স্বর চেনা ওর। এটা প্রাপ্ত। মনে পরলো, এই ফোন থেকে লাস্ট কল ও প্রাপ্তকেই করেছিলো। হুট করেই চোখ ভরে উঠতে লাগলো ইচ্ছের। ওপাশ থেকে আবারো প্রাপ্ত বলে উঠলো,
-হ্যালো?
চোখের পানিকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দিলো না ইচ্ছে। কল কেটে দিয়ে মোবাইলটা ঢিল ছুড়লো বিছানায়। তারপর সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার অন করে দিলো ও। বসেবসে ওর অবস্থাটা দেখলো টমি। উঠে গিয়ে বিছানায় থাকা বাটন ফোনটা মুখে নিয়ে কামড়াতে লাগলো। তবে নষ্ট করার মতো করে না। ওটা ইচ্ছের কাজের জিনিস। তবে এর জন্য রাগ উঠেছে ইচ্ছের। তাই ওকে শাস্তি দেওয়াই চলে। টমির কামড়ে আবারো কল চলে গেছে। ওপাশ থেকে হ্যালো শব্দটা শুনতেই টমি আরো জোরে শব্দ করে উঠলো এবার। ও বুঝে গেছে। ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটা অন্য কেউ না, ওর সেই চরম অপছন্দের মানুষ। প্রাপ্ত!
#চলবে…