প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব-৩৪+৩৫

0
482

#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা

৩৪.

-আই লাভ ইউ মিস্টার গ্যাংস্টার! আই লাভ ইউ!

-এজন্যই বুঝি খইয়ের ক্ষতি করতে চাইছিলে তুমি ইচ্ছে? টু শো ইউর ক্রেজিনেস?

ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবাসি বলার পর, ঠোটের কোনে ফোটা উচ্ছ্বাসের হাসিটা পরের দু সেকেন্ডেই মিইয়ে গেলো ইচ্ছের। প্রাপ্তর বুক থেকে আস্তেধীরে মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে। ওর কাতর চেহারার দিকে অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো কিয়দক্ষন। হাত আলগা হয়ে এসেছে ইচ্ছের। প্রাপ্ত পিছিয়ে সরে দাড়ালো ওর বাহুডোর থেকে। ইচ্ছের বধুবেশকে দু চোখে ভরে নিলো যেনো। কপাল থেকে উল্টে পরা ঠিকলি, নাক থেকে খুলে পরা নথ, এলোমেলো চুল, মাথা থেকে‌ সরে যাওয়া ঘোমটা। ওকে ভালোবাসি বলার একরাশ পাগলামি ইচ্ছের সর্বাঙ্গে। অথচ এই পাগলামি তো ওরই করা উচিত ছিলো। কিন্তু সুযোগটাই বা পেলো কোথায়? যে মুহুর্তে বাবাকে বলতে গিয়েছে খইয়ের সাথে আংটিবদল করবে না, সে মুহুর্ত থেকেই খই নিখোজ। আর এখন সাফোয়ানের কাছে শুনতে পেলো, সে মেয়েটা আইসিইউতে। মৃত্যুমুখে। আর তার কারন, ইচ্ছে। ওর ভালোবাসা। আস্তেধীরে ইচ্ছের কপালের টিকলিটা ঠিক করে দিয়ে, ছোট চুলগুলো কানে গুজে দিলো প্রাপ্ত। ওর কপালে ঠোট ছুইয়ে মৃদ্যুস্বরে‌ বললো,

-আমিও ভালোবাসি। তোমাকেই ভালোবাসি মিস রকস্টার। তোমাকেই।

ইচ্ছে বিমুঢ়। প্রাপ্তর কোন কথাকে ধরবে, কোন কথাকে ধরবে না, বুঝে উঠতে পারছে না ও। প্রাপ্ত ইচ্ছের এক গালে হাত রাখলো আলতোভাবে। অসহায়ের মতো করে‌ বললো,

-আমরা দুজন একে অপরকে ভালোবাসি। কিন্তু এরমাঝে খই কেনো শাস্তি পেলো ইচ্ছে? ও কি দোষ করেছে?

ইচ্ছের মাথা ফাকা লাগছে এবার। এসব কি বলছে প্রাপ্ত, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কোনোমতে মুখ দিয়ে বের করলো,

-এ্ এসব তুমি কি বলছো?

-আজকে আংটিবদল ছিলো আমার আর ওর। কিন্তু যখন রাকা জানালো, তুমি বিয়ের আসর ছেড়েছো আমার জন্য, তখন আমিও এনগেইজমেন্ট ক্যান্সেল করতে‌ গিয়েছিলাম ইচ্ছে। তারপরও খইকে কেনো শাস্তি দিলে তুমি? ও তো কোনো দোষ করেনি।

“খইয়ের সাথে প্রাপ্তর আংটিবদল” এই কথাটা শুনেই শব্দহীন ঝড় বইতে লাগলো যেনো ইচ্ছের চারপাশে। ঘাড় খানিকটা কাত করে অপলক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইলো ও প্রাপ্তর দিকে। যে মানুষটার জন্য সব ছেড়ে আসলো, সে মানুষটা অন্য কাউকে জীবনসঙ্গীনি করতে চলেছিলো। অথচ প্রাপ্তর এই জীবনসঙ্গীনির জায়গাটা ওর নিজের জন্য বরাদ্দ বলে ভেবে রেখেছিলো। কেনো ভেবে রেখেছিলো? কোনোদিন কি তার কোনো কারন দেখিয়েছে প্রাপ্ত? তবে ও কেনো ভেবে রেখেছিলো? এতোবড় ভুল কি করে করে ফেললো ও? নিজের কাছে নিজেকেই অচেনা মনে হতো লাগলো ইচ্ছের। ওকে চুপ দেখে প্রাপ্ত এবার ইচ্ছের দুগাল ধরে বললো,

-কেনো করলে এমন ইচ্ছে? কেনো? শুধুমাত্র তোমার হবু বর রাকীন শাফায়াতের অনৈতিক নোটিশ খইয়ের কাছে ছিলো বলে? তাই বলে ওর ক্ষতি করতে চেয়েছিলে তুমি? হুম?

-এজন্য নয়? তবে কেনো ইচ্ছে? প্রথমদিন যখন তোমার গিটার ভেঙেছিলাম, কি বলেছিলে তুমি? তোমার আবেগকে আঘাত করার প্রতিত্তর তুমি দেবে। তা না করার আগ পর্যন্ত নাকি আমার উপর থেকে রাগ মিটবে না তোমার। তাহলে এজন্যই কি আজ…আজ খইকে বিপদে ফেলতে চাইছিলে তুমি ইচ্ছে? এজন্যই?

-আচ্ছা? তুমি কি বলেছিলে সেদিন রাকাকে? ইউ উইল নেভার ফল ইন লাভ। ইউ উইল রাইজ ইন লাভ! ভালোবেসে উত্তল হবে তুমি তাইনা ইচ্ছে? ভালোবাসার পাগলামো দেখাবে তুমি। আজ তোমার মনে হলো, ভালোবাসো তুমি আমায়। আর আজই আমার আর খইয়ের আংটিবদল হওয়ার কথা। তবে কি তার জন্যই খইয়ের ক্ষতি করতে চেয়েছিলে তুমি ইচ্ছে? তোমার আমার মাঝ থেকে ওকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য? এভাবে ভালোবাসার পাগলামো দেখাতে চেয়েছিলে তুমি ইচ্ছে? এভাবে?

চোখ বন্ধ করে দাতে দাত চেপে রইলো ইচ্ছে। ধীরস্থির গলায় যে অপবাদে প্রাপ্ত ওকে অপমান করতে শুরু করেছে যে,‌ নিজেকে সামলানো দায় হয়ে গেছে ওর। তবুও একবর্নও বললো না ও। যে ইচ্ছে নিজের আত্মসম্মানের জন্য নিজের বাবাকেও ছাড় দেয়নি, প্রাপ্তর সমস্ত অপবাদ সয়ে নিলো চুপচাপ। আজ কেনো যেনো ওর প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করছে না। কেনো যেনো নিজেকে জাহির করতে ইচ্ছে করছে না। কেনো করবে? প্রাপ্ত ওকে যদি ভালোই বাসে, তবে অবিশ্বাস কেনো করবে ওকে? কেনো ভুল বুঝবে? শুধু ভাবতে লাগলো, ভালোবাসি বলে কেউ কাউকে কি করে এতোটা ভুল কি করে বুঝতে পারে? হয়তো পরিস্থিতির জন্য। ইচ্ছে প্রাপ্তকে এতোটুকোও দোষ দিলো না। সবরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করতে লাগলো নিজেকে। এরমাঝে ডক্টর এসে বললো,

-পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।

প্রাপ্ত একধ্যানে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইচ্ছে চোখ মেলে তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,

-খই ভালো আছে। গিয়ে দেখে আসো ওকে।

-ইচ্ছে…

-দেখা করে এসো।

প্রাপ্ত হাতের পিঠে নাক ডলা মেরে পা বাড়াচ্ছিলো ভেতরে যাবে বলে। ডক্টর ওকে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন,

-সরি? আপনি কোথায় যাচ্ছেন? পেশেন্ট তো ইচ্ছের সাথে দেখা করতে চায়।

অবাকচোখে ডক্টরের দিকে তাকালো প্রাপ্ত। ইচ্ছে ভাবলো, হয়তো হসপিটালে আনার জন্য খই ধন্যবাদ দেবে ওকে। ডক্টরের দিকে নিমীলীতদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,

-ইটস্ ওকে ডক্টর। আগে ওই যাক।

-সরি। পেশেন্টকে এই মুহুর্তে উত্তেজিত করা যাবে না। গেলে আপনাকেই এলাউ করবো আমরা। ওনাকে না।

ইচ্ছে প্রাপ্তর দিকে তাকালো। ততোক্ষনে সাফোয়ান এসেছে। ডক্টর আবারো বললো,

-মিস ইনায়াত? ভেতরে যাবেন আপনি?

সাফোয়ান এগিয়ে এসে বললো,

-অবশ্যই উনি যাবেন। ইনফ্যাক্ট উনিই আগে যাবেন। আজকে উনি যদি ব্লাড ডোনেট না করতো, খইকে বাচানো যেতো না। তাই ওনার সাথেই‌ আগে খই দেখা করুক।

বিস্ফোরিত চোখে সাফোয়ানের দিকে তাকালো প্রাপ্ত। কি বলছে সাফোয়ান? তবে ওকে যে বললো, এক্সিডেন্টটা ইচ্ছের গাড়িতে হয়েছে। পুরোটা আবারো ভাবতে লাগলো প্রাপ্ত। কেয়ারটেকার বলেছিলো, খই স্বেচ্ছায় বেরিয়েছে মিষ্টিঘর থেকে। যদি খইয়ের এক্সিডেন্ট ইচ্ছে জেনেবুঝে করাতো তাহলে ওকে হসপিটালে নিয়ে আসলো কে? ইচ্ছেই বা এখানে কি করছে? আর ব্লাড দেওয়ার কথাই বা সাফোয়ান কেনো বলবে? দিশেহারার মতো প্রাপ্ত মাথার চুল উল্টে ধরলো নিজের। খইকে অসুস্থ্য দেখে, ইচ্ছের গাড়িতে এক্সিডেন্ট করেছে শুনে, কিসব বলে দিলো ও? ডক্টর বললেন,

-চলুন মিস ইনায়াত। পেশেন্ট ওয়েট করছে আপনার জন্য। বেশ অনেকবার নাম নিয়েছে আপনার।

ইচ্ছে ডক্টরের সাথে পা বাড়ালো চুপচাপ। প্রাপ্তর মাথা ঠান্ডা হলে হয়তো সবটা বুঝতে পারবে ও, এটা ও জানে। কিন্তু ততোক্ষন অবদি সবটা ঠিক থাকবে তো? ভেতরে ভেতরে বারবার মনে হচ্ছে, শেষবারের মতো একটু শান্তি চাই ওর। কোনো ভুল বোঝাবুঝি চাইনা। কোনো লাভক্ষতির পসরা চাই না। কোনো জবাবদিহিতা চাই না। শুধু শান্তি চাই! একটু শান্তি। কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো ইচ্ছে। খই আধশোয়া হয়ে বেডে বসে। ওর মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ, ক্যানোলা, স্যালাইন চলছে। ওকে দেখেই খই উৎফুল্লভাবে বলে উঠলো,

-ইচ্ছে!

মৃদ্যু হাসি নিয়ে এগোলো ইচ্ছে। আলতোভাবে খইয়ের গালে হাত রেখে বললো,

-এখন কেমন আছো খই?

খই ইচ্ছের হাতের উপর হাত রাখলো নিজের। চোখ বন্ধ করে কাদতে লাগলো তারপরই। ইনিশা থেকে‌ বেরোনোর কিছুক্ষন পরই ওর সিএনজিটার সামনে গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে যায় নিজাম। ওর সাথে আরো‌ দুজন ছিলো। ঝামেলা এড়াতে মাঝরাস্তায় ওকে রেখেই সিএনজিচালক পালিয়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে ছুট লাগিয়েছিলো খই। আর তখনই‌ ইচ্ছের গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয় ওর। জ্ঞান ফেরার পর একঘন্টা আগের স্মৃতির সাথে যুক্ত হয় ওর একযুগ আগের স্মৃতিও। যে স্মৃতিতে রয়ে গেছে ওর নাম, খেয়া, ওর মা নাফিজা বেগম, বাবা নওশাদ সাহেব, নিজের প্রানের চেয়েও‌ প্রিয় বোন ইচ্ছে, আর ভালোবাসা বোঝার আগে থেকেই ভালোবাসার জায়গা জুড়ে নেওয়া, রাকীন। নিজের ছোটবেলার যে স্মৃতির জন্য সাহেরা মাকে প্রশ্ন করে করে কষ্ট দিতো, সে স্মৃতি যখন আজ ওর ফিরে এসেছে, সেই মা-ই ওর কাছে নেই। আজ ও ওর নিজের নাম, পরিচয় জানে। ও অনাথ না। ও তো ইচ্ছেরই বোন, খেয়া! ওকে কাদতে দেখে ইচ্ছে বললো,

-কাদছো কেনো তুমি?

খেয়া চোখ মেললো। বললো,

-কি অদ্ভুত জীবন। তাইনা রে ইচ্ছে? যখন আমি নিজেকে চিনি নি, তখন হয়তো তোরা আমাকে খুজেছিস। আজ আমি নিজেকে চিনলাম, তোদেরকে চিনলাম, অথচ দেখ! এখন তুই আমাকে চিনতে পারছিস না! আমার সাথেই কেনো এমন হবে ইচ্ছে? কেনো?

ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো ইচ্ছে। খেয়া বললো,

-বড়মা ঠিকই বলতো, ইচ্ছেনদীতে যদি খেয়াতরী না থাকে, তবে সে খেয়ার অস্তিত্ব থাকবে না। তোর থেকে দুরে সরে সত্যিই খেয়ার অস্তিত্ব ছিলো না ইচ্ছে! সে তো ভাদুলগাঁয়ে সাহেরা মায়ের মেয়ে হয়ে বেচে ছিলো। খই! দেখনা! আজ আবার নিয়তি আচমকাই তাকে মনে করিয়ে দিলো, তোর সাথে জরিয়ে তার আরো একটা পরিচয় আছে। খইই খেয়া! তোর হারিয়ে যাওয়া বোন!

কথা শেষ করে শব্দ করে কাদতে লাগলো খেয়া। শ্বাস আটকে খেয়ার কথাগুলো শুনলো ইচ্ছে। বুঝে উঠতেই নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো ও খেয়াকে। গায়েমাথায় হাত বুলিয়ে ওর চোখেমুখে অজস্র চুমোয় ভরিয়ে দিলো। সুখের অশ্রুজল বাধ মানলো না ইচ্ছের। বাকিসব কিছু ভুলে গেছে ও। কাদতে লাগলো খেয়াকে জরিয়ে। কিছু হারিয়েছে বা হারাতে চলেছে কিনা, জানে না ও। শুধু মনে হলো, হারানোর মাঝেও প্রাপ্তির এ কান্না স্বস্তির, এ কান্না প্রশান্তির…

#চলবে…

#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা

৩৫.

-যতোদুর মনে পরে, সেদিন পার্ক থেকে ইচ্ছে রাকীন চলে যাওয়ার পর আমি নিজেনিজেই উল্টোদিকে হাটা শুরু করেছিলাম। আমার গায়ের রঙ নিয়ে বলা ইচ্ছের কথায় অভিমান হয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু বাসায় ফিরতাম আমি। অভিমান নিয়ে হাটতে হাটতেই পার্ক থেকে বেশ অনেকটা দুরে চলে আসি। কোনো এক মুলসড়কে। অন্যমনস্ক হয়ে হাটার সময় প্রাইভেট কার ধাক্কা দিয়ে চলে‌ গেলে, জ্ঞান হারাই। সাথে স্মৃতিও। হসপিটালে সাহেরা মা আমাকে মেয়ের পরিচয় দেয় আর ওখান থেকেই ভাদুলগায়ে নিয়ে আসে। কখনো বলেনি আমি তার মেয়ে নই। বরং শুরুর দিক থেকেই আমাকে গ্রামের ভাষায় কথা বলতে জোর করতো, স্কুলে যেতে দিতো না ঠিকমতো, জামাকাপড়েও কখনো আধুনিকতা দেয়নি আমাকে। এমনকি শহর থেকে কেউ গ্রামে গেলেও তাদের ছায়াটা অবদি দেখতে পেতাম না আমি। সর্বোস্ব দিয়ে ভালোবাসলেও, সাহেরা মা সবসময় আড়াল করে রাখতো আমাকে। সবসময়!

নাফিজা বেগমের বুকে মুখ গুজে সবটা বললো খেয়া। ইচ্ছে কল করে জানানোর পরেই হসপিটালে চলে এসেছেন নওশাদ সাহেব আর নাফিজা বেগম। মেয়েকে দেখে অঝোরে কেদেছেন দুজনে। কেদেছে খেয়াও। তবে তাদের আগে আরো একজনের আগমন ঘটেছে কেবিনে। রাকীনের। এককোনে দাড়িয়ে দাতে দাত চেপে এতোগুলো বছরের সমস্ত কষ্ট, রাগ, অভিমান সহ্য করার চেষ্টা করে চলেছে সে এতোক্ষন হলো। যাকে এতোগুলো বছর খুজে চলেছে ও, এতোটা কাছে পেয়েও চিনতে পারে নি তাকে। নিজের ওপর, খেয়ার উপর শুধু রাগই হচ্ছে ওর। খেয়া মায়ের বুকে মুখ গুজে রাকীনের ওই চাওনি পরখ করে চলেছে। নাফিজা বেগম মেয়েকে আদর করে দিয়ে কাতরভাবে বললেন,

-খুব কষ্ট হয়েছে তোর মা? খুব কষ্ট হয়েছে?

-না মা। সাহেরা মা এতোটুকোও কষ্ট পেতে দেয়নি আমাকে। সবসময় আগলে রাখতো।

-কেনো রাখবে না খেয়া? তুমিই তো তার বেচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিলে। তোমাকে আগলে না রাখলে, কি নিয়ে বাচতো সাহেরা?

রাকীন বাদে দরজায় তাকালো সবাই। ওর দৃষ্টি খেয়ার দিকেই স্থির। সাদিক সাহেব এসেছেন। উনি ভেতরে ঢুকতেই খেয়া বললো,

-সাদিক কাকা, আমি…

-শান্ত হও‌ খেয়া। আজ আমি বলি?

খেয়া থামলো। সাদিক সাহেব বললেন,

-অনেক আগেই এগুলো বলা উচিত ছিলো আমার। কথাগুলো আমার আগে তোমারই‌ জানা উচিত ছিলো। কিন্তু সাহেরা চায়নি বলে হয়নি। মারা যাওয়ার আগে সাহেরা বলেছিলো, মরনরোগে আক্রান্ত ছিলো বলে স্বামীরঘর ছাড়তে হয়েছিলো ওকে। বাচার জন্য কোনো অবলম্বন অবশিষ্ট নেই‌ দেখে যখন ঠিক করলো আত্মহত্যা করবে, ঠিক তখনই তোমাকে স্মৃতিহারা মেয়ে হিসেবে পেয়ে যায় সাহেরা। মাতৃত্বের লোভ সামলাতে পারেনি ও। তেমনি না কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলো তোমাকে হারানোর ভয়। তাইই তোমাকে ঘিরে ওর এতো আড়াল ছিলো খেয়া। সাহেরার ইচ্ছে ছিলো, ওর মৃত্যুর পর যেনো আমি তোমাকে তোমার আসল ফ্যামিলি খুজে দেই। নিজের মতো করে চেষ্টা চালাবো বলেছিলাম। কিন্তু ছেলের কথা ভেবে স্বার্থপর হয়ে পরি একসময়। না তোমার স্মৃতি ফেরানোর চেষ্টা করেছি, না তোমার পরিবারকে খোজার। আমার‌ সেই স্বার্থপরতার জন্যই আজ তোমাদের এই পরিস্থিতি ফেইস করতে হচ্ছে। চার চারটে সাজানো জীবনে তান্ডব শুরু হয়েছে। সবটার জন্য আমিই দায়ী।

এতোক্ষন হলো এককোনে দাড়িয়ে খেয়া, নাফিজা বেগম আর নওশাদ সাহেবের খুশি দেখছিলো ইচ্ছে। সাদিক সাহেবের কথা এবার এগিয়ে আসলো ও। বললো,

-দায় কেনো নিচ্ছেন? আপনাকে তো আমাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত আঙ্কেল।

-ধন্যবাদ মানে?

-ধন্যবাদই বটে। আজ আপনি যদি ভাদুলগায়ে না যেতেন, খেয়াকে কি করে শহরে ফিরে পেতাম আমরা বলুন তো? এইযে ওকে‌ আমরা ফিরে পেলাম, এর সব ক্রেডিট তো আপনারই! তাই গিল্টিফিল করে আমাদের ছোট করে‌ দেবেন না প্লিজ! রিকুয়েস্ট করছি!

মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থেকে, ইচ্ছের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন সাদিক সাহেব। নাফিজা বেগম খেয়াকে ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। ইচ্ছের সামনে দাড়িয়ে বললেন,

-তোর সাহেরা মাকে হারিয়ে যে যন্ত্রনা তুই এই ক দিনে পেয়েছিস, একই যন্ত্রনা সয়ে, তোর বড়মাকে হারানোর পর, ইচ্ছে কিভাবে বেচে আছে খেয়া?

টলোমলো চোখ তুলে নাফিজা বেগমের দিকে তাকালো ইচ্ছে। বুঝেই উঠতে পারলো না কি বলবে। নাফিজা বেগম একহাত ইচ্ছের গালে রেখে বললেন,

-যে মেয়ে আমার কথার অগ্নিবর্ষনের প্রতিত্তর যুক্তির জালে দমন করে, আজ তার চোখে জল? এ বর্ষনে আমায় শুচি করতে পারবি মা?

-আমি সত্যিই তোর মা হওয়ার যোগ্য নই ইচ্ছে। কোনোদিনও, এতোটুকোও বুঝতে চাইনি তোকে। তোর মতো মেয়ের মা হওয়ার সৌভাগ্য, যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই। সে সৌভাগ্য শুধু বড় আপাকেই মানাতো। তাইতো সে তোর মা। আর আমি তোর এস এম। সৎ মা।

-কেনো যেনো আজ খেয়াকে ছেড়ে তোকে আদর করতে ইচ্ছে করছে মা। তোকে একটু আদর করতে দিবি আমাকে? অল্প একটু?

টুপটাপ জল গরালো ইচ্ছের চোখ থেকে। যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না ওর সবটা। আস্তেধীরে ও কপাল এগিয়ে দিলো নিজের। নাফিজা বেগম ওর দুগাল ধরে কপালে চুমো দিলেন। বাস্তবতা টের পেতেই নাফিজা বেগমকে শক্তকরে জরিয়ে ধরলো ইচ্ছে। উপরওয়ালা আজ যেনো দুহাত ভরে ভরিয়ে দিচ্ছে ওকে। নাফিজা বেগম আজ প্রানভরে আদর করলেন ইচ্ছেকে। এতে সবচেয়ে বেশি খুশির হাসি খেয়ার ঠোটে। ওকে হাসতে দেখে এতোটা সময় পর রাকীন বলে উঠলো,

-আজ তোর এনগেইজমেন্ট হওয়ার কথা ছিলো খেয়া?

রাকীনের মুখে নিজের নাম শুনে, চমকে উঠলো খেয়া। ছোটবেলার খেলার সাথী হলেও, বরাবর রাকীনকে ভয় পেতো ও। আজ যদি খই পরিচয়ে ও এখানে থাকতো, হয়তো এই ভয়টা একবিন্দুও কাজ করতো না ওর। হয়তো খই বলতো, তুমিও তো বিয়ে করে নিচ্ছো নকশাদার। এমনটা ভেবে, রাকীনের দিকে একপলক তাকিয়ে, তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে নিলো খেয়া। বলতে পারলো না কিছুই। রাকীন এগোলো ওর দিকে। নাফিজা বেগম তখনও ইচ্ছেকে জরিয়ে। ইচ্ছে বুঝলো, দুজনের মধ্যে জমা অভিমানগুলো বেরিয়ে আসবে এবার। বললো,

-এখান থেকে চলো মা। ওরা কথা বলুক।

চলে আসবে বলে পা বাড়াচ্ছিলো সবাই। রাকীন ততোক্ষনে খেয়ার বেডে গিয়ে বসেছে। কেবিন থেকে একজনও বেরোনোর আগে, আঙুলে থাকা আংটিটা খুলে খেয়ার আঙুলে পরিয়ে দিলো রাকীন। ওর কাজে বিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো সবাই। খেয়ার বিস্মিত চাওনি দেখে রাকীন স্বাভাবিক গলায় বললো,

-নে! হয়ে গেছে তোর এনগেইজমেন্ট!

-রাকীন!

-আমি ছাড়া তুই অন্যকারো না খেয়া। তুই শুধুই আমার। খেয়া, রাকীনের! মাথায় বসিয়ে নে! এমনভাবে বসিয়ে নে, যেনো অভিমানের আগে রাকীনের পাগলামোর কথা মনে পরে তোর। এই বারোবছরের শাস্তির কথা মনে পরে তোর! আমার কষ্টগুলোর কথা মনে পরে তোর!

চোখ ফেটে আবারো জল গরালো খইয়ের। আস্তে করে মাথা ঠেকালো ও রাকীনের বুকে। দুহাতে জরিয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো রাকীন। কতোদিন হলো এই বুকে হাহাকার, শুন্যতা। আজ তা সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষেই স্বস্তিতে ভরে উঠেছে। ওদের দুজনকে একসাথে দেখে মুচকি হেসে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলো সবাই। খেয়াকে নিয়ে রাকীনের পাগলামোর সীমা জানে তারা। ইচ্ছে করিডরে আসতেই দেখে প্রাপ্ত দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে। উপস্থিতি জানান পেতেই, ইচ্ছের দিকে চেয়ে চেয়ে নিরবে অশ্রুবিসর্জন দিতে শুরু করেছে প্রাপ্ত। অপরাধবোধে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে ওর। ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো সবাই। শুধু ইচ্ছে দাড়ালো। এগিয়ে এসে, একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো,

-আমি জানতাম, পুরো পৃথিবী একদিকে থাকলেও, যে আমার ঠোটে হাসির কারন, যাকে আমি ভালোবেসেছি, যার কাছে আমার প্রেমনোঙর ঠায়, শুধুমাত্র সেই আমাকে, আমার ভালোবাসাকে ডেফাইন করতে পারবে। অন্য কেউ না। ভুল ছিলাম আমি প্রাপ্ত। আমার বোঝা উচিত‌ ছিলো, আমি ভালোবেসেছি তো কি? তুমি তো না আমায় ভালোবেসেছো, না আমার ভালোবাসাকে বুঝেছো। তোমার প্রেমনোঙর তো অন্য তরীর মালিকানাধীন। না বুঝেই বিয়ের আসর ছেড়েছিলাম, আমার একপাক্ষিক ভালোবাসার পাগলামো দেখাবো বলে। সত্যিই অনেকবড় ভুল করে ফেলেছি। তাইনা প্রাপ্ত?

প্রতিটা কথা তীরের মতো বিধলো প্রাপ্তর কাছে। এবার আর ও সামলাতে পারলো না নিজেকে। জাপটে জরিয়ে ধরলো ইচ্ছেকে। ওর চুলে মুখ গুজে দিয়ে কাদতে কাদতে বললো,

-ভুল তো আমি করেছি ইচ্ছে! ভুল তো আমার! যার দায়িত্ব নেবো বলে তোমার প্রতি ভালোবাসাকে অস্বীকার করেছিলাম, তাকেই মৃত্যুমুখে দেখে মাথা ঠিক ছিলো না আমার। সাফোয়ানের কাছে যখন শুনলাম খেয়া তোমার গাড়িতেই এক্সিডেন্ট করেছে, আমি নিজেকে বুঝাতে পারিনি, ইচ্ছে এমনটা করতে পারে না। ভুল আমার ইচ্ছে! সব ভুল আমার! সীমাহীন ভালোবেসেও বলিনি ভালোবাসি। তাইতো আজ এই দিনটা দেখতে হলো তোমাকে। কথা দিচ্ছি এমন ভুল আর কোনোদিনও হবে না। আর কখনো তোমার কান্নার কারন হবো না মিস রকস্টার। ভালোবাসি তোমাকে। খুব ভালোবাসি!

প্রাপ্তর কাছে এইবার ভালোবাসি শুনে বুকভরে শ্বাস নিলো ইচ্ছে। ও জানতো, প্রাপ্ত ঠিক বুঝবে সবটা। প্রাপ্ত বলে চলেছে নিজের মতো করে। আর ইচ্ছের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমশ। প্রাপ্তর বলা কথাগুলো মাথায় ঢুকছে না আর কিছুই। ইচ্ছে টলোমলো শরীরটা কিঞ্চিত সামনে এনে একহাত প্রাপ্তর গালে রাখলো। তারপর মিহিস্বরে বললো,

-আমিও ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। বয়ে চলা স্রোতস্বীনীর মতো হয়েও, বরাবর, আমি শুধু তোমাতেই আটকেছি মিস্টার গ্যাংস্টার। প্রেমনোঙর ফেলে।

কথা শেষ করেই মুখে হাসি ফোটালো ইচ্ছে। প্রাপ্তও হাসিমুখ করে ওর দিকে হাত বাড়াচ্ছিলো। ইচ্ছে কি বুঝলো, প্রাপ্তর দিকে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,

-আমার হাজারো প্রাপ্তি আর পুর্নতার খাতায়, তুমি সর্বোচ্চ অপুর্নতা প্রাপ্ত। এতো বেশি ভালোবেসেছি যে, সেখানেই বোধহয় আমার ইতি আঁকা। তবুও! তোমাকে ভালোবাসি মিস্টার গ্যাংস্টার। ভালোবাসি।

প্রাপ্তর হাত থেমে গেলো। কথাদুটো বলে হঠাৎই দুবার জোরে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে‌ ওর হাতে ঢলে পরলো ইচ্ছে। বড়বড় চোখে স্তব্ধতা নিয়ে হাতে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলো প্রাপ্ত। ওর পুরো পৃথিবী যেনো থমকে গেছে। কাপাকাপা হাতে ইচ্ছের গলায় আলতোভাবে স্পর্শ করলো প্রাপ্ত। ফিসফিসিয়ে ডাকলো বারদুয়েক। ইচ্ছে সাড়া দিলো না। হাতে তরলের উপস্থিতি টের পেয়ে ইচ্ছের গলা থেকে কাপতে থাকা হাত উপরে তুলে ধরলো প্রাপ্ত। কান দিয়ে রক্তক্ষরন হয়েছে ইচ্ছের। কানের পাশ বেয়ে গলার দিকটা র’ক্তে ভিজে উঠেছে। অবিশ্বাসে সেকেন্ডদুই তাকিয়ে থেকে, দুহাতে শক্ত করে ইচ্ছেকে জরিয়ে ধরলো প্রাপ্ত। গগনবিদারক চিৎকার করে বলে উঠলো,

-এটা কি করলে তুমি? কি করলে এটা? যেটুকো বলে তোমার ভালোবাসাকে অপমান করেছি, তার জন্য শাস্তি প্রাপ্য আমার! কিন্তু তাই বলে এমন শাস্তি দিও না আমাকে ইচ্ছে! এমন শাস্তি দিও‌ না! এখনো তো ইচ্ছেনদীর ভালোবাসার স্রোতে গা ভাসানো বাকি! এখনো তো তোমার নামের প্রেমযমুনায় প্রেমনোঙর ফেলা বাকি! চোখ খোলো ইচ্ছে! প্লিজ চোখ খোলো! ভালোবাসার উত্তল ঢেউ হয়ে এসে, এভাবে‌ আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে, নিজেকে দুরে সরিয়ে নিতে পারো না তুমি ইচ্ছে! পারো না!

#চলবে…