#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
অন্তিম পর্ব.
সময়ের অতিবাহন এক চিরন্তন সত্য। আর সে অতিবাহনে জীবনের প্রবাহ বয়ে চলে, এটাও জীবনের আরেক অনবদ্য নিয়ম। ভালোবাসা, মান-অভিমান, উত্থান-পতন, কাছে আসা-দুরে যাওয়া, সন্ধি-বিচ্ছেদ সব সমার্থক বিপরীতার্থক মিলিয়ে তৈরী হয় সে জীবনের ছন্দ। ব্যতিক্রম হয়নি খেয়া-রাকীনের জীবনেও। ওরাও এগিয়েছে। জীবনের সকল ঝড়ঝঞ্চা পেরিয়ে এগিয়েছে। পুর্নতা দিয়েছে নিজেদের ভালোবাসাকে। প্রেমময় প্রহরের তেমনি এক পুর্নিমায় শুকমরার ঘাটে পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে খেয়া। পরনে গাঢ় নীল শাড়ি। কোমড়ের নিচ অবদি খোলা চুল, ছুইছুই করছে পানিতে। মাঝরাতের চাঁদটা কখনো মেঘের আড়াল হচ্ছে, তো কখনো বেরিয়ে এসে উজ্জ্বল আলো বিলাচ্ছে। শুকমরার পরিষ্কার পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে চাঁদের আলো। খানিকটা পেছনে তালগাছের সাথে হেলান দিয়ে, বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে আছে রাকীন। ওর চাওনি খেয়ার দিকে স্থির। বেশ কিছুটা সময় পর খেয়া পেছন ফিরে রাকীনকে ইশারা করলো ওর পাশে বসার জন্য। তারপর নিজের মতো করে ব্যস্ত হয়ে গেলো পানিতে হাত নাড়াতে। একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে রাকীন এগোলো। দাড়িয়ে থেকে প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
-মানুষ হানিমুনে ফরেইন যায়, নয়তো দেশের মধ্যেই দর্শনীয় জায়গাগুলোতে যায়। সাজেক ভ্যালি, কক্সবাজার আরো কতো জায়গা! আর আমাকে কিনা আসতে হলো এই ভাদুলগাঁয়ে। শুকমরার তীরে। একেই বলে, কপাল!
খেয়া চোখ তুলে তাকালো রাকীনের দিকে। মোটেও আফসোস ছিলো না ওর কথায়। বরং উপেক্ষিত হওয়ার অভিমান ছিলো। এই অভিমান বরাবরই মানায় রাকীনকে। হসপিটালে আংটিবদল থেকে শুরু করে, তার দু মাস পর বিয়ে, আর আজ বিয়ের চারমাস পর ঢাকার বাইরে বেরোনো, সেটাও আবার ভাদুলগাঁয়ে। সে মানুষটা অভিমান করবে না তো কে করবে? বিষয়টা বুঝে মুচকি হেসে উঠে দাড়ালো খেয়া। ঘাড় কাত করে রাকীনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-শুকমরার তীরে আসতে হয়েছে বলে আফসোস হচ্ছে?
-হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু? নেহাত তুই বললি সাহেরা মায়ের এখানে আসবি বলেই আসা। নইলে কোন নিউলি ম্যারেড বিয়ের পর ঘুরতে গ্রামে আসে? এখানে রোমান্স হয়?
-তো রোমান্স আসছে না বুঝি তোর?
-একদমই না!
খেয়া হাত ধরে বসালো রাকীনকে। নিজে হাতে ওর প্যান্ট ভাজ দিতে যাচ্ছিলো। রাকীন তৎক্ষনাৎ পা সরিয়ে নিয়ে কপালে ভাজ ফেলে নিজে নিজেই প্যান্ট ভাজ দিলো। তারপর পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো খেয়ার মতোন করেই। হেসে দিয়ে ওর হাত জরিয়ে ওর কাধে মাথা রাখলো খেয়া। বললো,
-মনে পরে রাকীন? কয়েকমাস আগে এমনই এক রাতে এই ভাদুলগায়ে দেখা হয়েছিলো তোর সাথে খইয়ের।
-মনে পরবে না আবার? যা তান্ডব ঘটিয়েছিলেন আপনি! আমাকে জ্বী’নটিন ভেবে তো জ্ঞানই হারিয়েছিলেন। কি যে বিপদে পরেছিলাম ওই রাতে, আমিই জানি! কনফিউশনে পরে গিয়েছিলাম তোকে জ্ঞান হারাতে দেখে সত্যিই ঘাড়টার মটকে দিলাম নাকি?
খেয়া ফিক করে হেসে দিলো। তারপর হঠাৎই মন খারাপ করে বললো,
-তান্ডব তো তার পরে শুরু হয়েছিলো রাকীন। সাহেরা মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। সাদিক কাকা আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলো। তোর কথা বারবার মনে পরতো। তার পরেও প্রাপ্তর সাথে আংটিবদল আর ইচ্ছের…
রাকীন এতোক্ষনে খেয়ার দিকে ফিরলো। একহাতে ওর হাত শক্তকরে ধরে আরেকহাত ওর গালে রেখে বললো,
-হুশ! তুই আমার এতোগুলো বছরের অপেক্ষার ফল খেয়া। যদি আমি জানতাম আমার সেই ঝাসির রানী খইই আমার খেয়া, প্রাপ্তর সাথে তোর বিয়েটা হতে দিতাম না আমি। কোনোদিনও না! আগে হোক বা পরে, তোকে তো আমারই হতে হতো। এর জন্য যেকোনো সীমা পার করতে পারতাম আমি। যেকোনো!
রাকীনের কথায় শুধুই জেদ আর অধিকারবোধ। চাঁদের আলোতে মানুষটাকে দেখতে দেখতে বাকিসব ভুলে বসলো খেয়া। মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থেকে বললো,
-নিজামকে পুলিশের হাতে দেওয়ার আগে খুব মেরেছিলি না তুই?
রাকীন হেসে দিয়ে বললো,
-ও নেশায় পরে তোর দিকে হাত বাড়িয়েছিলো। খালি হাতটাই ভেছে দিয়েছি।
-নিজাম তোর চাচাতো ভাই হয় রাকীন।
-অন্যায় কাউকে ছাড়ে না। ওকে কি করে ছাড় দিতো? পাপের ফল ভোগ করতে এখনো পুলিশ কাস্টাডিতে আছে। সবদিক ঠিকই আছে খেয়া। হাউজিং, মিষ্টিঘরের স্কুলবিল্ডিং দুটোই বাবা সামলে নিয়েছে। তোকে ফিরে পেয়ে আমার মতো তারাও অনেক খুশি। আসলে তুই মানুষটাই এমন। মায়ায় ফেলে দিস সবাইকে।
খেয়া কিছুক্ষন নিরবে চেয়ে রইলো শুধু। তারপ নিরবতা ভেঙে বললো,
-একটা কথা বলতো রাকীন? কাকে ভালোবাসিস তুই? খইকে? নাকি খেয়াকে?
রাকীন আবারো হেসে দিলো। হুট করেই খেয়ার কোমড় জরিয়ে অনেকটা কাছে টেনে নিলো ও। কিঞ্চিত চমকে উঠলো খেয়া। রাকীন ওর নাকে নাক ঘষে দিয়ে বললো,
-তোকে ভালোবাসি।
-কেনো?
-তোকে ভালোবাসার কারন লাগবে না আমার খেয়া। অথবা বলতে পারিস, কারনগুলো এতো বেশি যে তাদেরকে ভাষায় সঙ্গায়িত করতে পারি না। আমার কাছে ভালোবাসার মানুষটা মানে তুই। সে তুই খই রুপেই থাক, বা খেয়া হয়ে। এই শ্যামসুন্দরীর মায়াবী মুখের দিকে তাকালে আর কিছুই লাগে না আমার। আজীবন শুধু একটাই চাওয়া! এভাবেই থেমে রই, তোর প্রেমনোঙরে। এভাবেই খেয়া থাকুক, আমার হৃদসাগরের সম্রাজ্ঞী হয়ে। প্রেমনোঙর ফেলে…
কথা শেষ করে খেয়ার কপালে আলতো করে ঠোট ছোয়ালো রাকীন। লাজুক হাসিতে খেয়া মুখ লুকালো রাকীনের বুকে। আর চাঁদ লুকালো মেঘের আড়ালে। লজ্জাঘেরা এই রজনীর সাক্ষ্য দেওয়ার মতো নির্লজ্জ নাইবা হলো সে!
•
ডোরবেল বাজতেই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো পিয়ালী। দরজায় হাসিমুখ করে ইচ্ছে দাড়িয়ে। সেই আগের ইচ্ছে। কোমড়ের উপরে ছাড়া সোজা চুল, জিনস টপস, কাধে গিটারের ব্যাগ আর ঠোটের সেই উজ্জল হাসি। এক্সিডেন্টের ছ মাস পর আজ প্রথম কনসার্টে গিয়েছিলো ইচ্ছে। অলৌকিকভাবে সেদিন ওর অপারেশনটা মিটেছিলো ভালোভাবে। প্রাপ্তর ভালোবাসার কাছে হার মেনেছিলো ওর মৃত্যুসম্ভবনা। অপারেশনের সময় এ বিষয়ে জানতে পেরে নওশাদ সাহেব অনেকবেশি রিয়্যাক্ট করেছিলেন। পরে অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পারেন তিনি। হসপিটাল থেকে প্রাপ্ত ওকে সরাসরি ওদের বাসায়ই নিয়ে এসেছিলো। প্রেস মিডিয়া সবাইকে ওদের বিয়ের বিষয়ে জানিয়ে। এ বাসায় প্রাপ্ত, পিয়ালী আর সাদিক সাহেব মিলে আদরযত্মের কোনো কমতি রাখেনি ইচ্ছের। বরং যে ভালোবাসা থেকে এতোদিন বঞ্চিত ছিলো, সে ভালোবাসার পুরোটাই যেনো উশুল করে নিয়েছে ইচ্ছে।
এভাবেই দেখতে দেখতেই পার হয়ে গেছে ছ মাস। ইচ্ছে ভেতরে ঢোকার আগে টমি বাসার ভেতরে ঢুকলো। পিয়ালীকে ইশারা করে রুমে চলে গেলো ইচ্ছে। প্রাপ্তকে খুজলো পুরো ঘরে। কিন্তু প্রাপ্ত নেই সেখানে। ফ্রেশ হয়ে ধুতি আর শর্টকামিজ পরে ডাইনিংয়ে বসে গেলো ইচ্ছে। উকিঝুকি দিয়ে তখনো প্রাপ্তকে খুজছে ও। কোনো কথা ছাড়াই ইচ্ছেকে খাইয়ে দিতে লাগলেন সাদিক সাহেব। পিয়ালী পাশে বসে নিজে হাত দিয়ে খেতে শুরু করলো। ইচ্ছে এ বাসায় আসার পর থেকে কখনো নিজ হাতে খেয়েছি কিনা সন্দেহ। সাদিক সাহেবের যেনো ইচ্ছেকে নিজ হাতে না খাইয়ে তৃপ্তি মেলে না। তাই মানা করলো না ইচ্ছে। উনি ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন,
-এতোদিন পর কনসার্টে গিয়েছিলি। সবকিছু কেমন ছিলো রে মা?
ইচ্ছে হাসিমুখে বললো,
-ভালোই ছিলো। ইনফ্যাক্ট খুব বেশি ভালো ছিলো বাবা। ছ মাসের এবসেন্সে অডিয়েন্সে যেনো নতুন করে আমার প্রতি ভালোবাসাটা বেড়েছে।
-তোর প্রতি ভালোবাসা তো আগে থেকেই ছিলো সবার। আছে আর থাকবেও। নতুন করে বাড়ার কিছু নেই।
মৃদ্যু হাসলো ইচ্ছে। সাদিক সাহেব বললেন,
-ভালো কথা! সাফোয়ান কল করেছিলো। বললো কাল পরশুর মধ্যে মিষ্টিকে নিয়ে যেতে চায় ও ওর ওখানে। বিয়ের প্রায় দু মাস হতে চললো। বলছে এখন নাকি মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছে ওখানকার সবদিক। তোর কনসার্ট বা নেক্সট রেকর্ডিং কবে? সে অনুযায়ী টাইম বলে দেই ওকে? কি বলিস?
মিষ্টি চলে যাবে শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো ইচ্ছের। এতোগুলো দিনে ওউ কম যত্ম নেয়নি ওর। সাফোয়ানের সেটলমেন্টের জন্য মেয়েটাকে একাকী থাকতে হয়েছে এতোগুলো দিন। তবে মিষ্টি, পিয়ালী, অরিত্রা, রাকা, মাহীম সবার সাথে সময়গুলো বেশ ভালো কেটেছে ইচ্ছের। খেয়া, রাকীনও এসে দেখা করে যেতো প্রায়ই। ইচ্ছে বললো,
-মিউজিক ডিরেক্টর বলছিলো কল করে জানাবে। মেবি পরশু আছে রেকর্ডিং। তবে আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো।
-পরশু আমার আইটেলে জয়েনিং ডেইট।
প্রাপ্ত বেখেয়ালিভাবে চেয়ারে বসতে বসতে বললো। বড়বড় চোখে ওর দিকে তাকালো উপস্থিত সবাই। প্রাপ্ত ওর নিজের হাতে বানানো কন্টিনেন্টাল আলাদা আলাদা বাটিতে বাড়তে মনোযোগী। ইচ্ছে বুঝলো, কিচেনে ছিলো প্রাপ্ত। ওর হাতের রান্না খেতে ভালোবাসে বলে বেশিরভাগ সময়ইপ্রাপ্ত রান্না করে। অবশ্য এ ছ মাসে ওউ সাথেসাথে থেকে শিখেছে টুকটাক। পুরোটা না করলেও, কিচেনে হেল্প করে প্রাপ্তকে, সাদিক সাহেবকে। প্রাপ্তর কথা শুনে পিয়ালী বিস্ময়ে বললো,
-ভাইয়া? তুই আইটেলে জয়েন করছিস?
-কেনো? আমার এজুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন কি খুব খারাপ? ওই ফার্স্টক্লাস ফার্স্টের সার্টিফিকেটসগুলো দিয়ে আইটেলে জয়েন করা পসিবল না?
পিয়ালী থামলো। ইচ্ছে খাবার চিবানো বাদ দিয়ে প্রাপ্তর দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে। সাদিক সাহেব ওর মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলেন। ইচ্ছের বিস্ময় কাটছেই না। ওকে খাবার খেতে বললেন ইশারায়। ইচ্ছে মুখে তুললো খাবার। সাদিক সাহেব আবারো খাবার মাখাতে মাখাতে বললেন,
-তোমার কোয়ালিফিকেশনের কথা বলে নি ও। হুট করে জবে ঢুকতে চাইছো, তাই বলেছে। তা হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত?
-দুদিন পর এক ডজন নাতি নাতনির দাদুভাই হবে, তখন বুঝবে কেনো জবে ঢুকতে চাইছি।
প্রাপ্তর কথা শুনে কাশি উঠে গেলো ইচ্ছের। তরিঘরি করে ওকে পানি এগিয়ে দিলো প্রাপ্ত। পানি খেয়ে ইচ্ছের কাশি কমে এলে প্রাপ্ত কন্টিনেন্টাল ওর মুখের সামনে তুলে ধরে বললো,
-এই লোকের বয়স হয়েছে। কিভাবে খাইয়ে দিতে হয়, ভুলে গেছে। তুমি আমার হাতেই খাও!
ড্যাবড্যাব করে বাবা ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো ইচ্ছে। সাদিক সাহেব মুচকি হেসে ইচ্ছের জন্য মাখানো প্লেটেই খাবার খেতে লাগলেন। খেতে খেতে বললেন,
-আজ অনেকদিন পর অনেক ধকল গেছে মেয়েটার উপর দিয়ে। আর অনেক রাতও হয়েছে। খাওয়া শেষ করে ঘুমোও গিয়ে।
প্রাপ্ত খাবার তুলে ধরলো ইচ্ছের মুখের সামনে। ইচ্ছে কিছুটা মুখে নিয়ে বললো,
-শুনলাম মাহীমের প্রমোশন হয়েছে? রাকার বাসায় বিয়ের প্রোপোজাল পাঠাচ্ছে না কেনো?
-ওই ব্যাটা আমার জন্যই আটকে আছে। তোমার বান্ধবীর আম্মু আবার আমার হাতে মানুষ কিনা!
-মানে? তার বাসায়ও গুন্ডামো করে এসেছিলে নাকি?
-ওরকমই বটে। তাও তোমার জন্য!
বড়বড় চোখে তাকালো ইচ্ছে। প্রাপ্ত ভাবলেশহীন। আর কথা বাড়ানোটা উচিত বলে মনে হলো না ইচ্ছের। বললো,
-আর খাবো না। বাবা অনেক খাইয়ে দিয়েছে।
প্রাপ্ত শীতল চোখে চেয়ে বুঝালো, আমি এতো কষ্টে রান্না করেছি, পুরোটা না খেলে তোমাকেই খেয়ে নেবো রকস্টার ম্যাডাম। বিষয়টা বুঝে ভয়ের বদলে মজা পেলো ইচ্ছে। গলা ঝেড়ে ভাব নিয়ে বললো,
-সত্যিই খিদে নেই মিস্টার গ্যাংস্টার। আজ বরং…
ইচ্ছেকে শেষ করতে না দিয়ে উঠে দাড়ালো প্রাপ্ত। হুট করেই সবার সামনে ও কোলে তুলে নিলো ও ইচ্ছেকে। ইচ্ছের বিস্ফোরিত চাওনি। পাশে তাকিয়ে দেখে, পিয়ালী কপালে হাত রেখে চোখ আড়াল করেছে নিজের। সাদিক সাহেব যেনো জীবনে প্রথমবার থেসিস ছেড়ে খাবার খেতে এতো মনোযোগী। কিছু বলে ওঠার আগেই প্রাপ্ত বললো,
-হ্যাঁ। আজ বরং নাইবা খেলে আমার বানানো খাবার। তোমাকে পানিশ করার অজুহাতের দরকার ছিলো আমার। আসছি বাবা। গুড নাইট।
প্রাপ্ত ওকে কোলে নিয়েই হাটা লাগালো। ওর গলা জরিয়ে রেখে চোখ খিচে বন্ধ করে রইলো ইচ্ছে। ও এ বাসায় আসার পর থেকে এই ছেলে একটু বেশিই নির্লজ্জ হয়ে গেছে। নাকি বাবা-ছেলের সম্পর্ক এমনও হয়? সম্ভব? প্রাপ্ত রুমে এনে বিছানায় বসিয়ে দিলো ইচ্ছেকে। ইচ্ছে বললো,
-এটা কি হলো?
-পানিশমেন্টের ট্রেইলর। এবার পুরো পিকচার দেখাবো! আর ইউ রেডি?
-আর ইউ ম্যাড? এভাবে বাবার সামনে…
-বাবাও এমনই ছিলো। তারও প্রেমের বিয়ে ছিলো!
-কিন্তু…
ইচ্ছে কিছু বলার আগেই আঙুল ছুইয়ের ওর ঠোট আটকে দিলো। ঘোর লাগা চাওনি স্থির রেখে বললো,
-সারাদিন পর দেখছি তোমাকে রকস্টার ম্যাডাম। কোনো কথা হবে না!
ইচ্ছে বড়বড় চোখে তাকালো। প্রাপ্ত ওর সামনে বসেই মুখ এগোচ্ছিলো ওর দিকে। হঠাৎই টমির আওয়াজ শুনে থেমে গেলো। চোখ বন্ধ করে প্রচন্ড বিরক্তিতে বললো,
-বর-বউ রুমে থাকলে দরজায় নক করে আসতে হয়। তোমার সো কলড্ এজুকেটেড পেটকে শেখাও নি এই আদব?
ইচ্ছে হেসে দিলো। পাশে তাকিয়ে দেখে দরজায় সত্যিসত্যিই টমি দাড়িয়ে। প্রাপ্তর গলা জড়িয়ে ধরে মজা নিয়ে বললো,
-বউকে আদর করার সময় রুমের দরজা লক করতে হয়। এই রুল আপনি শেখেন নি মিস্টার গ্যাংস্টার?
প্রাপ্ত চোখ মেললো। রাজ্যের বিরক্তি ওর চেহারায়। বিছানা ছেড়ে ও এগোতে যাচ্ছিলো দরজা লক করবে বলে। মনেমনে তার আগে টমিকেও গোটাকয়েক কথা শোনাবে বলেও প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। কিন্তু ওকে বাহুডোর থেকে সরতে দিলো না ইচ্ছে। প্রাপ্তর কলার একহাতে চেপে ধরে রাখলো। আরেকহাতে পাশের দেয়ালে ঠেকানো গিটারটা উপরে তুলে ধরলো। কিঞ্চিত বিস্ময়ে প্রাপ্ত দেখতে লাগলো ওর কর্মকান্ড। গিটারটা একহাতে একদম দরজা বরাবর ধরে, নিজেদের টমির আড়াল করে নিলো ইচ্ছে। আরেকহাতে প্রাপ্তর চুল মুঠো করে নিয়ে, ঠোটে ছুইয়ে দিলো প্রাপ্তর ঠোট। বড়বড় দৃষ্টিতে সেকেন্ডদুই তাকিয়ে থেকে বাকা হাসলো প্রাপ্ত। ইচ্ছে সরে যেতেই গিটারের আড়াল থেকে উকি দিয়ে টমির দিকে তাকালো সরু চোখে। আঙুল ঘুরিয়ে ইশারায় বোঝালো, “ইউ টার্ন নাও টমি মিয়া। এখানে তোমার উপস্থিতি নট এলাউড!”
টমি আর দাড়ালো না। অলসের মতো পা ছুড়ে পেছনে ঘুরে হাটা লাগালো। ওর প্রস্থানে যেনো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে, “জাগ সুনা সুনা লাগে” দুজনের কান্ড দেখে শব্দ করে হেসে দিলো ইচ্ছে। প্রাপ্ত মুগ্ধচোখে তাকিয়ে রইলো ওর হাসির দিকে। ওর দিকে তাকিয়েই ঠোট কামড়ে হাত থেকে গিটারটা নামালো ইচ্ছে। মাথা নামিয়ে নিলো লাজুক চাওনিতে। জানে প্রাপ্ত ওর হাসিটাতে বরাবর দুর্বল। অঘটন ঘটতে খুব বেশি দেরি নেই এখন আর। ওর হাত ধরে ওকে জানালার সামনে এনে দাড় করালো প্রাপ্ত। জরিয়ে ধরলো পেছন থেকে। ঘাড়ের সবগুলো চুল সামনে দিয়ে ঠোট ছোয়ালো ইচ্ছের উন্মুক্ত কাধে। মৃদ্যু কেপে উঠলো ইচ্ছে। প্রাপ্ত ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-আমার একান্ত ইচ্ছেনদী আজীবন এমন চঞ্চল থাকুক। আজীবন এমন উত্তল থাকুক তার প্রেমজোয়ার নিয়ে। আমি আজীবন এভাবে তোমার ভালোবাসার গহীনে বাধা পরে থাকতে চাই ইচ্ছে। প্রেমনোঙর ফেলে! ভালোবাসি তোমাকে।
স্বস্তিতে প্রাপ্তর বুকে মাথা ঠেকালো ইচ্ছে। নিজেকে বড্ড সৌভাগ্যবতী মনে হয় ওর। সেদিনের পর একবারও ওর জীবনমৃত্যুর সন্ধির সে ভয়ানক মুহুর্ত মনে করতে দেয়নি প্রাপ্ত। শুধুই ভালোবেসেছে। ওই বুকজুড়ে ওর নামে স্বস্তি লেখা, শান্তি আঁকা। এতোগুলো দিন সে অনুভবেই তৃপ্ত ইচ্ছে। প্রতিবারের মতো নিজেকে আজও উজার করে দেবে ও প্রাপ্তর ভালোবাসায়। লুফে নেবে ওর সমস্ত শিহরনী ভালোবাসা। এমন প্রতিটা মাঝরাতের চাঁদ সাক্ষী থাকুক ওদের ভালোবাসার। রাতজাগা ডাহুক সাক্ষ্য দিক ওদের খুনশুটির। বাগানের প্রতিটা ফুল গল্প লিখুক, ওদের কাছে আসার। ভালোবাসা এমনই সুন্দরতম হোক। আর প্রেমজোয়ারে বাধা পরুক প্রতিটা উত্তল হৃদয়, প্রেমনোঙর ফেলে…
~সমাপ্ত🌸