প্রেমপ্রবাহে বিষবৃষ্টি পর্ব-১৪

0
11

#প্রেমপ্রবাহে_বিষবৃষ্টি (১৪ তম পর্ব)
#মাইশা_জান্নাত_নূরা (লেখিকা)

মেহেরুন্নিসা বিচারকের দিকে তাকিয়ে বললো…..

—“ইউর ও’নার! আমার বিপরীত পক্ষ সম্মানীয় ডিফেন্স লয়্যার হয়তো আজ সকালে ঘর থেকে বেরোনোর সময় তাঁর বুদ্ধির থলেটা ড্রয়ারে তালাবদ্ধ করে রেখে এসেছেন। তা না হলে সাক্ষীর জবানির পুরো অংশ না শুনেই উ*ত্তে*জিত হয়ে তাকে ব্য*ক্তি*গত আ*ক্র*ম*ণের চেষ্টা করতেন না। তাঁকে আমার পক্ষ থেকে বিনীত অনুরোধ তিনি যেনো নিজ আসনে গিয়ে স্থির হয়ে বসেন এবং সম্ভব হলে ঠান্ডা পানি পান করে নিজের ভেতরটাকেও ঠান্ডা করেন। এটা আদালত কোনো নাটক মন্ঞ্চ নয় ইউর ও’নার যেখানে প্রতিপক্ষকে ক*টা*ক্ষ করে ১০ জনের থেকে সুনাম অর্জন করা সম্ভব হবে।”

পেছনের সারিতে বসে থাকা জনতাদের মাঝে অনেকেই ঠোঁট চেপে হাসি নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে তো অনেকেই হেসেই ফেলেছেন।
বিচারক কড়া গলায় বললেন…..

—“Order! Order! Order!”

সকলের হাসি থেমে গেলো। রক্তিমের মুখশ্রী রাগে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। ঘাড়ের ও কপালের র*গ গুলো হালকা ফুলে উঠেছে। রক্তিম নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে করতে বললো….

—“আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট না করে সরাসরি আদালতের কাছে প্রমাণগুলো তুলে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ বলে আমিও মনে করি ইউর ও’নার। যে বুদ্ধি এখনও পর্যন্ত আমার জুনিয়র আইন বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীর মতিষ্কে কাজ না করাটাই স্বাভাবিক৷”

বিচারক বললেন…..
—“ডিফেন্স আপনি বারংবার নিজ সীমা লঙ্ঘন করছেন ও প্রসিকিউশন এবং তার আনা সাক্ষীকে পারসোনালি অ্যাটাক করে বসছেন। এই শেষ আদালত আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছে। যদি এরপরও আপনি আপনার সীমা লঙ্ঘন করেন তাহলে আদালত আপনার বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে বাধ্য হবে।”

রক্তিম শান্ত কন্ঠে বললো….
—“সরি ইউর ও’নার।”

এই বলে সে নিজ আসনে গিয়ে বসলো। মেহের সাক্ষী রফিকুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো….

—“আপনি নি*র্ভ*য়ে আপনার বাকি রয়ে যাওয়া কথাগুলো শেষ করুন মি.রফিকুল ইসলাম।”

রফিকুল একবার মেহেরের দিক তাকিয়ে পরপরই বিচারকের উপর দৃষ্টি স্থির করে বললেন….

—“ইউর ও’নার আমি কৌতুহল বশত সেই রাতে ৩২২ নাম্বার রুমে ঢোকার পর মিস.শিউলির ওমন সাং*ঘা*তি*ক অবস্থা দেখে তৎক্ষনাৎ রুম থেকে বেড়িয়ে হোটেলের ম্যনেজারের কাছে যাই। ম্যনেজারের কক্ষের বাহিরে এসে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে ২জন ব্যক্তির কথপোকথন এর আওয়াজ ভেসে আসায় আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে যাই। যতোটা বুঝি তাদের কথপোকথন থেকে তারা মিস.শিউলিকে নিয়েই কথা বলছিলেন। আমার বুঝতে বাকি রয় না শিউলির ওমন ক*রু*ণ অবস্থার জন্য দা*য়ী ঐ কা*পুরুষটা (আঙুল তুলে জেভিয়ানকে দেখিয়ে) ভিতরে ম্যনেজারের সাথেই আছে। ম্যনেজারের কক্ষের দরজাটা হালকা ফাঁকা ছিলো। আমি আমার মোবাইল বের করে তাদের কথপোকথন এর পুরো অংশটা ভিডিও রেকর্ড করেছিলাম।”

এই বলে রফিকুল থামলেন। মেহের নিজের ফোন থেকে সেই ভিডিও রেকর্ডটা বের করে বিচারকের কাছে নিবেদন করলো। বিচারক এর সহকারী ভিডিওটা বড় পর্দায় চালু করলেন। উপস্থিত সকলেই ভিডিওটা দেখতে সক্ষম হচ্ছে এখন। ভিডিওতে জেভিয়ান আর ম্যনেজারকে একটি কক্ষের ভিতর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। দু’জনের চোখে-মুখেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। ম্যনেজারটি জেভিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“স্যার, মেয়েটা ম*রে-ট*রে যায় নি তো আবার!”

জেভিয়ান বললো….
—“না ম*রে নি এখনও মনে হয়। র‍্য*প করার সময় যে চি*ল্লা*তে নিয়েছিলো হাতের কাছে কস্টেপ ছিলো একদম মুখটা মাথার পিছন দিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বেঁ*ধে দিয়েছিলাম পর আর শোনা যায় নি। মুখটা যদি বন্ধ না করতাম তাহলে কাজ সারার সময় নিশ্চিত আমার হাতে খু*ন হতো শালী। আমার আবার সে* এর সময় মেয়ে মানুষের এতো চি*ল্লা-পা*ল্লা সহ্য হয় না। নাটক মনে হয়। কারণ মজা তো পুরুষ জাতি একা পায় না। জোর করে করলেও কি নারী জাতি ফিলিংস লেস হয় নাকি!”

—“মে*রে না ফেলে একদিক থেকে ভালোই করেছেন স্যার। নয়তো আরো বড় ঝা*মে*লা পাঁকতে পারতো। কারণ সে তো আমারই হোটেলের একজন লেডি কর্মী। তাই তার নিরাপত্তার দায়িত্বও আমার উপর বর্তানো থাকে।”

—“এতো দায়-দায়িত্বের হিসাব আমি শুনতে চাই নি তো আপনার কাছে। এতো সময় আমার হাতে নেই। মেয়েটাকে চুপেচাপে হোটেল থেকে বাহিরে নিয়ে যান। এরপর তার চিকিৎসা করাবেন না রাস্তায় ফা*লা*য় রে*খে শি*য়া*ল-কু*কু*রে*র রাতের খাবার বানাবেন আপনাদের বিষয়। আমায় যাস্ট আপনার ব্যংক একাউন্ট নাম্বারটা পাঠিয়ে দিন। আমি আপনার মুখ বন্ধ রাখতে যা অর্থ দেওয়া দরকার তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর হ্যা সিসিটিভি ফুটেজ একদম ক্লিয়ার থাকে যেনো। আমায় পরবর্তীতে কোনো ঝা*মে*লা*শ জড়ানো হলে আর সাক্ষী বা প্রমাণ হিসেবে আপনার হোটেল থেকে কোনো কার্যকলাপ করা হলে এই হোটেল ও আপনার অ*স্তি*ত্ব পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিবো যাস্ট একটা চু*ট*কি বাজানোর মাধ্যমে।”

—“না না স্যার। এমন কিছু করতে হবে না আপনাকে। আমি এক্ষুণি ব্যবস্থা করছি সব বিষয় ক্লিয়ার করে ফেলার।”

পরপরই ভিডিওটা থেমে গেলো। রক্তিম কপালের উপর ডান হাতের দু’টো আঙুল ঠেকিয়ে দু’চোখ বুঁজে নিয়েছে। রক্তিম জানে এই মুহূর্তেই তার হার নিশ্চিত। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটা ওকে পো*ড়া*চ্ছে সেটা হলো, সে হেরেছে মেহেরুন্নিসার কাছে। তার স্ত্রী যে কিনা একজন আইন বিভাগের ২য় বর্ষের সাধারণ শিক্ষার্থী! পুরো কেসটাই যেখানে রক্তিম ভেবে নিয়েছিলো ওর হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। গত কয়েকদিনের মাঝে মেহেরুন্নিসার জোগার করা যাবতীয় প্রমাণগুলো যা প্রথম প্রসিকিউশন হিসেবে কাজ করা আকবরের কাছে থেকে নিয়ে নিয়েছিলো রক্তিম তা বাদেও মেহের এতো বড় ধ্বং*সা*ত্ম*ক প্রমাণ নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতে পারে তা ভাবনাও বাহিরে ছিলো। রক্তিমের ভিতরটা পরাজয়ের আ*গু*নে দা*উ-দা*উ করে জ্বলছে।

জেভিয়ান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জহিরের চেহারাও মলিন রূপ ধারণ করেছে। নিজের একমাত্র ছেলে তার চৌধুরী বংশের একমাত্র বংশধর জেভিয়ান যার করা ঘৃ*ণ্য অ*প*রা*ধ*কে ধা*মা চাপা দেওয়ার জন্য নিজের আদরের মেয়ে মেহেরুন্নিসার কাছেও খা*রা*প হয়ে গেলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো কই? ভাই-বোনের মাঝে তৈরি হওয়া এই দূরত্ব আজ এমন মোড়ে এনে দাঁড় করালো পুরো চৌধুরী বংশকে যার শেষ জেভিয়ানের প্রাপ্ত শা*স্তি*র মাধ্যমেই হয়ে যাবে আজ। মেহেরের দু’চোখ এতোক্ষণে ছলছল করে উঠেছে। সে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। মেহেরের চোখের সামনে ভাসছে পুরোনো এমন অনেক স্মৃতি যা ওর ভিতরটাকে পো*ড়া*চ্ছে। জেভিয়ান ওর একনাত্র বড় ভাই। যাকে পিতৃতুল্য ভাবে সম্মান ও ভালোবাসা দিয়ে এসেছিলো মেহের। এক ঝটকায় ওর পুরো জীবনটা, পুরো পরিবারটা এলোমেলো হয়ে গেলো। বিচারক এর প্রদানকৃত শা*স্তি কি হতে পারে তা সম্পর্কে মেহের খুব ভালো ভাবেই জানে। জেভিয়ানের হয় ফাঁ*সি হবে নয়তো জাবজ্জীবন কা*রা*দ*ন্ড হবে। মেহের নিজের বুকের বা’পাশে হাত রাখলো। দু’চোখ বুঁজলো আলতো করে।

বিচারক গম্ভীর কন্ঠে বললেন………
—“এই ভিডিও ফুটেজটিকে নি*র্ভু*ল প্রমাণ হিসেবে আদালত গ্রহণ করছে। আসামি জেভিয়ান চৌধুরীর অ*প*রা*ধ সরাসরি প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে আদালতের সামনে। তাই এই আদালত সাক্ষ্যপ্রমাণ ও উপস্থাপিত ভিডিও ফুটেজের ভিত্তিতে আসামি জেভিয়ানের করা ভি*ক্টি*ম শিউলির সাথে নি*ষ্ঠু*র, পা*শ*বি*ক ও অ*মা*নবিক অপরাধ সংঘটনের জন্য তাকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ধারা (***) অনুযায়ী যাবজ্জীবন স*শ্র*ম কা*রা*দণ্ড প্রদান করছে এবং পাঁচ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করছে। যা ভিক্টিমের পুনর্বাসন খাতে ব্যয় হবে। এই কেসের সমাপ্তি এখানেই হলো। আদালত আজকের মতো মুলতবি ঘোষনা করছে।”

জেভিয়ান ক্ষি*প্ত চোখে মেহেরুন্নিসা, শিউলি আর ওর বাবার দিকে তাকালেন। পুলিশ জেভিয়ানের কাছে এসে ওকে হা*ত*ক*ড়া পড়ানো অবস্থাতেই আদালত থেকে বহিরাগত পথের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করলেন। শিউলি মিতাকে জড়িয়ে ধরেছে। হাসছে ও। প্রাণ খুলে হাসা যাকে বলে। ওর অ*ন্যা*য় কারী উপ*যুক্ত সা*জা পেয়েছে আজ। জহির ও রক্তিম দু’জনেই নীরবে স্থান ত্যগ করলেন।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ……..