#প্রেমপ্রবাহে_বিষবৃষ্টি (১৫ তম পর্ব)
#মাইশা_জান্নাত_নূরা (লেখিকা)
রক্তিম ড্রয়িংরুমের সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। কোর্ট থেকে ফিরেছে প্রায় তিন ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে। এখনও শরীর থেকে আইনজীবীর কালো কোর্টটা খোলে নি সে। রক্তিমের চোখদু’টো বুঁজে রাখা। মুখশ্রীজুড়ে লজ্জা, অ*প*মান, চাপা ক্ষোভের ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। আজকের এই দিনটা রক্তিমের এই আইনি পেশার জীবনে প্রথম হার। যে হার যে বড় বড় পেশাদার উকিলদের সাথে কেস লড়ে হারে নি। সেই হার হারতে হয়েছে ওরই স্ত্রী যে কিনা মাত্র আইন বিভাগের ২য় বর্ষের সাধারণ শিক্ষার্থী। রক্তিম কখনো কল্পনাও করে নি যেই নারীকে কেস লড়ার বিনিময়ে পুরষ্কার হিসেবে নিজের হিসেবে গ্রহন করেছিলো সেই নারীই ওর অ*হং*কারে ভরা সাম্রাজ্যকে ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁ*পি*য়ে তুলবে। ছি*ন্ন-ভি*ন্ন করে দিবে ওর কখনও না হারার গর্ববোধকে।
কোর্ট রুমের ভিতর প্রতিবার যেখানে রক্তিম দাঁড়িয়েছিলো জয়ের গর্ব নিয়ে আজ সেখানেই ওকে দাঁড়াতে হয়েছিলো মাথা নত করে। প্রতিবার ওর প্রতিপক্ষের মুখে আফসোসের বানী, ন্যায় না পাওয়ার বেদনার সুর শোনার যে অভ্যাসটা তৈরি হয়েছিলো তা ভ*ঙ্গ হয়ে গিয়েছে। প্রতিপক্ষের হাসির রোল, ন্যায়ের উল্লাসে মেতে উঠেছিলো আজ পুরো কোর্টরুম। সেই সুর এখনও পর্যন্ত রক্তিমের কানে অভি*শা*পে*র মতো বাজছে। রক্তিম এই হারের প্র*তি*শো*ধ না নেওয়া পর্যন্ত শান্তি পাবে না, ঘুমোতে পর্যন্ত পারবে না। তাই সে নিজেকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য অনেক আগেই মনঃস্থির করে নিয়েছে যে খুব তাড়াতাড়ি এমন কিছু ওকে করতে হবে যার মাধ্যমে ওর প্রতিপক্ষ হাসতে ভুলে যাবে।
ঠিক তখনই মেহেরুন্নিসা খান ভিলার মূল দরজা অতিক্রম করে ভিতরে প্রবেশ করলো। মেহের দৃঢ় ভঙ্গিমায় হেঁটে এলো ড্রয়িংরুম অবধি। রক্তিমকে সোফায় বসে থাকতে দেখে মেহেরের ঠোঁটে ফুটে উঠলো বাঁকা হাসির সূক্ষ্ণ রেখা। মেহের রক্তিমের থেকে দুই হাত দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো। মেহেরের দু’চোখে আত্মবিশ্বাস আর বিজয়ের দীপ্তি জ্বল জ্বল করছে। মেহের শীতল কন্ঠে বললো……
—“হারের স্বাদ কেমন লাগছে, উকিল সাহেব?”
রক্তিম মাথা তুললো। রক্তিমের চোখে তীব্র ক্রোধের ছাপ ফুটে আছে। ঠিক যেনো আহত সিংহের ন্যায় লাগছে ওর এই দৃষ্টি মেহেরের কাছে। কিন্তু মেহেরুন্নিসা সেই দৃষ্টিকে তু*চ্ছ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রক্তিম এবার সোজা হয়ে বসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো…
—“এই রক্তিম রেজওয়ান খান না কখনও হা*র*তে শিখেছে আর মা হার মানতে। কারণ রক্তিম রেজওয়ান খানের ডিকশনারিতে ‘হার’ বলে কোনো শব্দের অস্তিত্ব নেই সুইটহার্ট।”
রক্তিম সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেহেরের দিকে এগিয়ে এলো। মেহের পিছোতে নিলে ড্রয়িংরুমে উপরনিচ অংশ খেয়াল না করায় সে পরে যেতে নিলে রক্তিম মেহেরের হাত ধরে ওকে বাঁচিয়ে নিলো। মেহের কিছুটা বেঁকে দাঁড়িয়ে আছে আর রক্তিম মেহেরের দিকে কিছুটা ঝুঁকে। রক্তিম বাঁকা হেসে বললো…..
—“তুমি যেটাকে বিজয় ভেবে এখন এতো হাসছো খুব শিঘ্রই সেটা পরিণত হবে তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে।”
এই বলে রক্তিম হ্য*চ*কা টান দিয়ে মেহেরের নিজের বুকের উপর এনে ফেললো। মেহের এই আকস্মিকতায় কিছুটা চমকালেও খুব বেশি সময় ওর লাগলো না নিজেকে সামলে নিতে নিজের অবস্থান বুঝে নিতে। মেহের নিজেকে ছাড়াতে নিলে রক্তিমের মেহেরের কমোরের উপর হাত রেখে মেহেরকে নিজের কাছে ধরে রাখার এই বাঁধন আরো মজবুত করলো। মেহের নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে রা*গে হি*স*হি*সি*য়ে বললো…..
—“ছাড়ুন আমায়। আপনার মতো ল*জ্জা হীন এর মুখে এসব কথা শুনে আমার সর্ব শরীর ঘৃ*ণা*য় রি রি করছে। আপনাদের মতো অ*মা*নু*ষদের অ*মানু*ষি*ক*তা দেখানোর এই এনার্জিগুলো টেকসই হবে না খুব বেশি দিনের জন্য। আজ আপনাকে কেসে হারিয়েছি একদিন আপনার এই এনার্জিও ধ্বং*স করে দিবো।”
রক্তিম হো হো করে হেসে উঠলো। পরপরই নিজের হাসি থামিয়ে মেহেরের কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো…..
—“এই হারের বদলা আমি নেবো, মেহেরুন্নিসা। এমনভাবে নেবো যা তোমার কল্পনার সীমারেখাও ল*ঙ্ঘ*ণ করে ফেলবে। তাই বেশি খুশি হইয়ো না সুইটহার্ট। খেলা এখনও শেষ হয় নি। খেলা তো মাত্র শুরু হয়েছে।”
এই বলে রক্তিম মেহেরের কানের লতিতে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে ওকে ছেড়ে দিলো। মেহের তৎক্ষণাৎ ছিঁ*ট*কে অনেকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। রীতিমত রাগে, ঘৃ*ণা*য় কাঁপ*ছে সে। অতঃপর বললো…..
—“আপনার এই বুকটা গু*লি*র পর গু*লি দিয়ে ঝাঁ*ঝ*ড়া করে দিতে আমার একটুও বুক কাঁপবে না উকিল সাহেব। একটুও না।”
রক্তিম শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। আলতো হেসে বললো…..
—“হয়তো বুকটা তখন কাঁপবে না, হাতটা স্থির থাকবে, চোখ দু’টো দিয়ে আ*গু*ন ঝড়বে কিন্তু তোমার সামনে যখন শব্দ করে আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস ফেলবো তখন তুমি নিজেকে সামলাতে পারবে না সুইটহার্ট। বৃষ্টির ন্যয় তোমার এই দু’চোখ থেকে অশ্রুরা ঝরে পড়বে। কাঁপবে তোমার স্থির ঠোঁটজোড়া। হা*হা*কা*রে বুকের ভিতরটা ছি*ন্ন-ভি*ন্ন হয়ে যাবে। চিৎ*কা*র করে বলবে আমায় আর একটিবার ফিরে আসার জন্য। তোমার মতো করে তোমায় ভালোবাসার জন্য………!”
মেহের শরীরটা ঝাঁ*কি দিয়ে উঠলো যেনো রক্তিমের কথাগুলো শুনে। হৃদপিণ্ডের গতিও বেড়েছে স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেকটা। মেহের নিজের ঘৃ*ণা*কে উচ্চে উঠিয়ে হাতের ডান পাশে মেঝের উপর থু*থু ফেলে বললো…..
—“জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে মি.রক্তিম রেজওয়ান খান। নয়তো আপনি যখন আমার সামনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যগ করবেন তখন আপনাকে আবার নিজের করে পাওয়ার জন্য আমার এই মন কাঁদবে, হা*হা*কা*র করবে এতো বড় হাস্যকর বিষয়টা ভাবতে পারতেন না।”
রক্তিম প্রতিত্তুর করলো না কোনো। মেহের তৎক্ষনাৎ সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজ রুমে চলে গেলো। রক্তিম পুনরায় সোফায় বসে পড়লো। কেমন যেনো বি*দ্ধ*স্ত দেখাচ্ছে এই মূহূর্তে রক্তিমকে। এই তো একটু আগেও যেই জোস, যেই অ*হং*কা*রী ভাব ফুটে উঠেছিলো ওর চেহারায় ও কন্ঠে তা হুট করেই উধাও হলো কেনো!
সন্ধ্যে বেলা……
মেহের বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে। শরীরটা কেমন যেনো লাগছে বিকাল থেকেই। বমিও হয়েছে কয়েকবার। মাথাটা ভার লাগছে। একবার তো মাথা ঘুরে পরেও যেতে নিয়েছিলো তবুও কোনো রকমে দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়েছিলো। দুপুরের পর সেইযে রক্তিমের সাথে কথা কা*টা-কা*টি হলো রুমে চলে এলো মেহের এরপর আর রক্তিম রুমে আসে নি। তাই ওরা আর একে-অপরের সম্মুখীন ও হয় নি।
সেইসময় মেহেরের ননদ রূপা দু’কাপ চা নিয়ে ওর রুমে প্রবেশ করলো। মেহের কপালের উপর একহাত ভাঁজ করে চোখ দুটো বুঁজে রেখেছে। রূপা একবার ‘এহেম’ শব্দটি উচ্চারণ করতেই মেহের কপালের উপর থেকে হাত সরিয়ে চোখ মেলে তাকালো। রূপা নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মলিন হাসলো। রূপার চোখে মেহেরের মুখশ্রীর ক্লান্ত ভাব পড়তেই সে দ্রুত চায়ের কাপ দু’টো বেডসাইড টেবিলের উপর রেখে মেহেরের পাশে বসে ওর কপালে গালে হাত বুলিয়ে চিন্তিত স্বরে বললো…..
—“ভাবী তোমায় এমন ক্লান্ত লাগছে কেনো দেখতে! শরীর খারাপ লাগছে নাকি? কই জ্বর তো নেই মনে হচ্ছে। শরীর স্বাভাবিক গরম-ই আছে।”
মেহের বললো….
—“শান্ত হও তুমি রূপা। আমার শরীর ঠিকি আছে। একটু মাথা ঘুরছে আর ২-৪বার বমি হয়েছিলো। তেমন সিরিয়াস কিছু না।”
রূপা চোখ রাঙিয়ে বললো….
—“মাথা ঘুরছে, এতো বার বমিও হয়েছে আর বলছো সিরিয়াস কিছু না! বলি ফা*জ*লা*মো পেয়েছো? চোখ-মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কেমন বসা বসা হয়ে গিয়েছে এক বেলাতেই।”
—“আরে, চিন্তার কিছু নেই। সিজন চেইঞ্জ হচ্ছে শরীরে এমন একটু-আধটু পরিবর্তন হতেই পারে।”
রূপা উঠে দাঁড়িয়ে বললো….
—“তোমার এসব তাল-বাহানা শোনার সময় আমার নেই। আমি ডাক্তার আন্টিকে কল করছি আর বাসায় আসতে বলছি এক্ষুনি।”
—“ডাক্তার কেনো?”
—“চুপ। আর একটা কথা না।”
এই বলে রূপা দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। পিছন থেকে মেহের কয়েকবার ওকে ডাকলেও আর সারা পেলো না সে।
আধঘন্টা পর ডাক্তারনিকে নিয়ে আবারও মেহেরের রুমে প্রবেশ করলো রূপা। মেহের তখনও আগের ন্যয় বিছানার সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। ডাক্তার মেহেরের সম্মুখে বসে ওর পালস, প্রেসার চেক করলো। আরো কিছু বিষয় চেক করে হাসিমুখে বললেন….
—“রক্তিম বাবা কোথায়? মিষ্টি নিয়ে আসতে বলো এক্ষুণি। সুখবর আছে।”
ডাক্তারের এমন কথার মানে রূপা বা মেহের কেউ-ই বুঝে উঠতে পারলো না। দু’জনে একে-অপরকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দেখলো। রূপা বললো….
—“ভাবীর শরীর খারাপ করেছে। মাথা ঘুরছে। এতোবার বমিও হয়েছে। কারোর শরীর খারাপ হলে বুঝি মিষ্টি মুখ করতে হয়? সুখবর থাকে?”
মেহের মনে মনে বললো….
—“আমি যেটা আন্দাজ করছি কোথাও সেটাই মিন করছেন না তো ডাক্তার!”
ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে রূপার মাথায় আলতো বা*রি দিয়ে হেসে বললেন…..
—“পাগলী মেয়ে কবে তোমার মাথায় একটু বুদ্ধির উদয় হবে বলো তো! একজন বিবাহিতা নারীর শরীর খারাপ কখন হলে সবাইকে মিষ্টি মুখ করানো হয় তা এখনও বুঝে উঠতে পারো নি তুমি হুম!”
রূপা নিজের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে কিয়ৎক্ষণ ভাবুক রূপ নিয়ে থাকলো। পরক্ষণেই বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরে হেসে বললো….
—“তবে কি.. তবে কি.. আমি ফুপি হতে চলেছি ডাক্তার আন্টি! ভাবী মা হয়ে চলেছে? আর ভাইয়া বাবা?”
ডাক্তারনী মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। রূপার খুশি আর দেখে কে আজ! মেহের নিজের পেটের উপর হাত রাখলো। মেহেরের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে নেই। নেই কোনো খুশির ছাপ পর মুখশ্রী জুড়ে। মনে মনে বললো…..
—“আমার ভিতর একজন নি*কৃ*ষ্ট মানসিকতার, পা*পী ও অ*মানুষের অংশ সৃষ্টি হয়েছে! যে নিষ্পাপ ছোট্ট শরীরটা আমার ভিতর আস্তে আস্তে তৈরি হবে সে ঐ লোকটার চিহ্ন! ঐ অ*মানুষটার!”
#চলবে_ইনশাআল্লাহ…….