#প্রেমপ্রবাহে_বিষবৃষ্টি (শেষ পর্ব)
#মাইশা_জান্নাত_নূরা (লেখিকা)
রক্তিম শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে দরজার দিকে তাকালো একবার৷ রক্তিমের দৃষ্টিতে মেহেরুন্নিসা ও তার অনাগত সন্তানকে হা*রা*নোর ভ*য় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওর বুকের ভিতরটাতে অস্থিরতারা ঢেউ তুলেছে। রক্তিমের মন যেনো চিৎকার করে বলছে…..
—“হারতে ঘৃ*ণা করো তুমি! কোনোভাবেই হা*র*কে মেনে নিতে পারো না। এই চিঠিটা পাওয়ার আগে পর্যন্তও তো মেহেরুন্নিসাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার মস্তিষ্ক আমার সাথে ল*ড়া*ই*য়ে নেমেছিলো। এখন তোমার মস্তিষ্ক শীতল হয়ে গিয়েছে দেখো একটাবার! তোমার বউয়ের এতো মিষ্টি আবেদন এর পরিপ্রেক্ষিতে সে জেদ দেখানোর শক্তি হা*রি*য়ে কেমন মিইয়ে গিয়েছে! আমি তোমার মন, তোমায় জানান দিচ্ছি। থেকো না আর বসে। করো না আর সময়ের অ*প*চয়। নিজের বাবাকে হারিয়ে সমাজের উপর জমে থাকা রাগকে উপরে তুলে যেই অ*মানবিকতার পেশাকে বেছে নিয়েছিলে আজ সময় এসেছে সেই পেশাকে ও মাটিতে পরে থাকা ডি*ভো*র্সে*র কাগজগুলোকে তুলে একত্রে আ*স্তা*কুঁড়ে ছুঁ*ড়ে ফেলে দেওয়ার। ফেলে দাও নিজের মস্তিষ্কে জমে থাকা নোংরাগুলোকে। তোমার জন্য সুন্দর একটা জীবন অপেক্ষা করছে। তোমার ভালোবাসার মানুষ প্রিয়তমা স্ত্রী যে সে ও তোমার অনাগত সন্তান তোমার অপেক্ষায় আছে। এই মিছে হার-জিতের খেলায় এমন সুন্দর সম্পর্কটাকে শেষ করো না।”
রক্তিম পরপরই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চোখের পানিটুকু মুছে মেঝের উপর পরে থাকা ডি*ভোর্সে*র কাজগগুলো তুলে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। অতঃপর বাসা থেকে বেড়িয়ে কাগজগুলো কয়েকশত টুকরো করে আ*স্তা*কুঁ*ড়ে ছুঁ*ড়ে ফেললো। পার্কিং সাইড থেকে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো মেহেরের দেওয়া ঠিকানাটার উদ্দেশ্যে। দক্ষ হাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে রক্তিম। মেহেরের কাছে পৌঁছাতে যে সময় টুকুর প্রয়োজন এখন ততো টুকুও অনেক ভাড়ি লাগছে মনের উপর রক্তিমের কাছে। ঠোঁটে ফুটে আছে হালকা হাসির রেখা।
💥
বিকেলের শেষ আলোয় নদীর পানি চিকচিক করছে। চোখে ধরার মতো। হালকা হাওয়া বইছে। নদীর একেবারে সন্নিকটেই বলা চলে একটা ছোট্ট কাঠের ঘর খানিকটা জায়গা দখল করে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের বারান্দায় ঝুলানো দোলনায় চুপচাপ বসে আছে মেহের। দৃষ্টি সেই চিকচিক করা নদীর পানির উপর স্থির। পাশেই একটা ছোট্ট এক পা-য়ার কাঠের টেবিলের উপর দু’টো চায়ের কাপ! একটা ওর নিজের জন্য আরেকটা রক্তিমের জন্য। রয়েছে একটা ফাঁকা ফুলদানি আর একটা সাধারণ ক্যমেরাও। যদিও চায়ের কাপ দু’টোর দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যাচ্ছে অনেক আগেই তা জুড়িয়ে গিয়েছে। কোনো ধোঁয়া ভাব উঠার চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
মেহেরের কোলের উপর একটা ডায়েরি রাখা রয়েছে। ডায়েরিটার পাতা গুলোও হালকা বাতাসে এপাশ-ওপাশ হচ্ছে। পুরো ডায়েরিটাই ফাঁকা। একটা শব্দও জায়গা করে নিতে পারে নি এখনও।
মেহের জানে না তার এই আয়োজন আজ রঙে রঙে ভরে জীবন্ত হয়ে যাবে নাকি এমন সাদাকালোয় মূর্ছা অবস্থাতেই রয়ে যাবে। রক্তিম যদি সত্যিই আসে তবে এই ফাঁকা ফুলদানি রঙিন ফুলেরা ঘর হবে। এই দু’কাপে জুড়িয়ে যাওয়া চা টুকু ফেলে দিয়ে নতুন করে রোজ ধোঁয়া উড়া চা পান করা হবে। পাশাপাশি বসে গল্প করা হবে। আর নিজেদের সুন্দর মুহূর্ত গুলোর স্মৃতি ক্যমেরাতে বন্দী করার পাশাপাশি এই ফাঁকা ডায়েরির প্রতিটি বাসায় লিখে লিখে শব্দের ভান্ডার বানানো হবে।
তখনই রুমের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো রক্তিম। চিরচেনা পারফিউম এর গন্ধ এসে মেহেরের নাকে ধা*ক্কা লাগলো। ঠোঁটে ফুটে উঠলো তৃপ্তির এক চিলতে হাসি। মেহের চোখ তুলে তাকালো। রক্তিম মেহেরের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো ঠিক ওর পায়ের পাশে মেঝের উপর। নিজের মাথাটা রাখলো ঠিক মেহেরের কোলের উপর। মেহেরের সর্ব শরীর শিরশির করে উঠলো। আজ সে যেই রক্তিমকে নিজের পা জড়িয়ে বসে থাকলে দেখছে একেবারে ইগোহীন, রাগহীন ভিষণ শান্ত অবস্থায় তার সাথে পূর্বের রক্তিমের এক আকাশ পরিমাণ ফাঁরাক রয়েছে। মেহের ঢো*ক গি*ল*লো। একদম শুকনো সেই ঢো*ক। যা শুকিয়ে আসা গলাকে ভিজাতে সক্ষম নয়।
মেহেরের মনে হচ্ছে আজকের এই রক্তিম, এই মানুষটা হলো তার জীবনের আসল পুরুষ। তার ব্যক্তিগত পুরুষ। আর এতোদিন ওর সামনে যে থাকতো! দিনের পর দিন ওকে যে স্পর্শ করেছিলো গভীর ভাবে! যার স্পর্শে মেহের স্বামীর ভালোবাসা অনুভব করতে পারে নি সে ছিলো মু*খো*শ*ধা*রী অন্য কেউ। আজকের এই মানুষটাই ওর স্বামী হওয়ার যোগ্য। এই মানুষটাই ওদের অনাগত সন্তানের যোগ্য পিতা হতে পারবে। এই মানুষটাকে মেহের খুব করে ভালোবাসতে পারবে। যেই ভালোবাসার কোনো সীমা-রেখা থাকবে না। যেই ভালোবাসার সম্পর্কে কোনো রাগ, জেদ, অভিমান, ঘৃ*ণা*রা ফাঁক ফোকড় খুঁজে পাবে না নিজেদের জন্য একটু জায়গা করে নিতে। থাকবে না কোনো হার-জিতের নোং*রা খেলা! একটা সুন্দর, গোছালো, পরিপাটি সংসার জীবন পার করা সম্ভব এই মানুষটার সাথে।
মেহের রক্তিমের মাথায় হাত রাখলো। নিঃশ্বাস ভাড়ি হয়ে এসেছে মেহেরের। রক্তিমের দু’চোখ বেয়ে উষ্ণ গরম নোনাজল মেহেরের উরুতে পড়তেই ওর বুকের ভিতরটা ধ*ক করে উঠলো। রক্তিম কাঁদছে! এমন শক্ত, কঠিন হৃদয়ের মানুষটার দু’চোখ নোনাজলে ভিজে গিয়েছে! রক্তিম বললো….
—“আমায় ক্ষমা করে দাও আমার প্রিয়তমা স্ত্রী ও আমাদের অনাগত সন্তানের মা! আজ সব ছেড়ে-ছুড়ে এই অ*মানুষটা এসেছে তোমার কাছে। একটু ঠাই দাও তাকে। আপন করে নাও। কসম মানুষ হয়ে যাবো। মনের সব আবর্জনাও আ*স্তা*কুঁড়ে ছুঁ*ড়ে ফেলে দিয়ে এসেছি ডি*ভো*র্স পেপার গুলোর সাথে। তোমাদের ছাড়া বেঁচে থাকা বড্ড দায় হয়ে দাঁড়াবে এই পা*গ*ল*টার। আমার এই শরীরে আর কখনও কোর্টের কালো পোশাক উঠবে না। তোমাদের ভালোবাসার চাদরে নিজের মনকে ঢাকতে চাই এবার। আমার সন্তানের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে বলতে চাই, ‘তার বাবা একজন প্রকৃত মানুষ, একটা পরিষ্কার হৃদয় তার আছে, যেই হৃদয়ে তার ও তার মাম্মামের নাম লেখা রয়েছে ও থেকে যাবে জীবন ভর।’ থাকতে দিবে না আমায় তোমাদের পাশে জীবনভর? বলো না বউ! দিবে না!”
মেহেরের দু’চোখ ভিজে উঠেছে। রক্তিম মেহেরের কোলের উপর থেকে মাথা তুলে ওর চোখের দিকে তাকালো। মেহেরের হাত জোড়া নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে তাতে ছোট ছোট চুমু এঁকে দিতে দিতে বললো…..
—“এই রাস্তা ধরে তোমাদের কাছে আসতে আসতে আমি দু’টো নাম ঠিক করেছি জানো! আমাদের মেয়ে হলে তার নাম রাখবো ‘মেহরিম’ আর ছেলে হলে রাখবো ‘মাহতীম’। সুন্দর না নাম দু’টো! বলো! আর হ্যা ব্যবসা হিসেবে একটা রেস্টুরেন্ট খুলবো ভেবেছি। সেখানে সব রকম খাবার এর ব্যবস্থা থাকবে। দেশী, বিদেশী সব। যারা গরীব, অসহায় মানুষ আছেন! সবসময় বড় বড় রেস্টুরেন্ট থেকে কয়েক হাত দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে তার বাহ্যিক সৌন্দর্য উপভোগ করেন কেবল তাদের সম্মানের সহিত সপ্তাহে ২দিন আমাদের রেস্টুরেন্টে এনে বসিয়ে তাদের পছন্দনুযায়ী খাবার খাওয়াবো। যেনো কোনোরকম অভিযোগ, অভিমান তাদের মনে জমে না থাকে।”
রক্তিমের কথাগুলো আজ ভিষণ শান্তি দিচ্ছে মেহেরকে। মানুষটা কতো সহজে বদলে গিয়েছে! রক্তিম থেমেছে এবার। মেহেরের মুখ থেকে স্বস্তি দেওয়ার মতো শব্দ শোনার জন্য রক্তিমের মনটা ব্যকুল হয়ে উঠেছে। মেহের বললো….
—“জড়ায় ধরবেন না আমাদের! বুকে আগলে নিবেন না!”
মেহেরের এরূপ কথা শোনা মাত্র রক্তিম উঠে মেহেরকে উঠিয়ে ওকে জড়ায় ধরলো শক্ত করে৷ মেহেরের পা বারান্দা স্পর্শ করছে না। মেহেরও রক্তিমের গলা জড়িয়ে ধরেছে। মেহের বললো….
—“নতুন জীবনে সু স্বাগতম জানাই আপনাকে স্বামী। আপনার ভালোবাসায় আপনার বিবি ও সন্তান সিক্ত হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো বহুক্ষণ ধরে। আমরা দু’জনেই আপনাকে ভিষণ ভালোবাসি। কামনা করছি এই ভালোবাসা অক্ষয় থাকুক জীবন ভর।”
রক্তিম ও মেহের দু’জনের ঠোঁটেই ফুঁটে রয়েছে পরিতৃপ্তির হাসি৷
এই প্রকৃতি, এই সুন্দর সময়কে সাক্ষী রেখে রক্তিম-মেহেরুন্নিসার নতুন জীবনের সূচনা হলো এবং এই উপন্যাসেরও সমাপ্তি ঘটলো…..🎀
সমাপ্ত……….