#প্রেমপ্রবাহে_বিষবৃষ্টি (৪র্থ পর্ব)
#মাইশা_জান্নাত_নূরা (লেখিকা)
বাস স্ট্যন্ডে এসে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে মেহের। অনেক সময় পেরিয়ে গিয়েছে। বাস আসার কোনো নাম-গন্ধ নেই। সেইসময় মেহেরের সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করালো রক্তিম৷ মেহের রক্তিমকে দেখেও না দেখার ভান ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। রক্তিম গাড়ির জানালা খুলে মেহেরকে বললো….
—“গাড়িতে এসে বসো। যেখানে যাবে আমি ছেড়ে দিবো তোমায়।”
মেহের ভ্রু কুঁচকে বললো….
—“কে আপনি? আমাকে আপনার গাড়িতে উঠতে বলছেন কেনো? রাস্তাঘাটে একলা একা কম বয়সী সুন্দরী মেয়ে দেখে ফ্লা*টিং করতে এসেছেন!”
রক্তিম দাঁতে দাঁত চেপে বললো….
—“আশেপাশে অনেক মানুষ আছে সুইটহার্ট। বেশি কথা না বলে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসো।”
—“আজব তো। আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্র পরিবারের সন্তান আপনি। তাহলে রাস্তাঘাটে এমন অ*ভ*দ্র*তা*মো করার মানে কি?”
—“আমি যদি গাড়ি থেকে নামি একবার তাহলে কিন্তু ফল ভালো হবে না তোমার জন্য।”
তখুনি মেহেরের থেকে কিছুটা দূরে বেন্ঞ্চে বসা ২জন প্রাপ্ত বয়সের যুবক এসে মেহেরের পাশে দাঁড়িয়ে বললো….
—“কি সমস্যা এখানে? আপু উনি কি আপনাকে বিরক্ত করছেন? আমাদের বলুন আমরা দেখছি তারপর বিষয়টা।”
রক্তিম ক্ষি*প্ত নজরে একবার মেহেরকে দেখে পরপরই যুবক দু’জনের উপর দৃষ্টি স্থির করলো। মেহের নিজের আশপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে বললো…..
—“এই লোকটাকে আমি চিনি না। অথচ কোথায় না কোথায় থেকে এসে বলছে তার গাড়িতে উঠার জন্য। আমাকে নাকি আমার গন্তব্য পর্যন্ত ছেড়ে দিবেন উনি! আপনারাই বলুন তো একজন অপরিচিত লোকের সাথে আমার বয়সী কোনো মেয়ের এভাবে যাওয়াটা কি ঠিক?”
যুবক দু’জন কিছুটা দাদাগিরি ভাব নিলো। একজন বললো….
—“একদম ঠিক না আপু। আজকালকার যে যুগ-জামানা হয়েছে তাতে অনেক বেশি সতর্ক থাকা উচিত সকল নারীদের।”
অপরজন বললো….
—“আর এই যে আপনি! যদি গন*পি*টু*নি খেতে না চান তাহলে মানে মানে কেটে পরুন এখান থেকে। নয়তো মিঠুন চক্রবর্তীর ডায়লগটা স্মরণ করিয়ে দিবো যে ‘পাবলিক এর মা*র কেওরাতলা পার’।”
মেহের মনে মনে বললো….
—“ঠিক হয়েছে। এবার যদি উচিত শিক্ষা হয়।”
রক্তিম নিজের সিটবেল্টটা খুলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে ওর আর মেহেরের বিয়ের ছবি পাশাপাশি রেজিস্ট্রি পেপারে সাইনের ভিডিও যুবক দু’জনকে দেখিয়ে বললো…..
—“বউ আমার অনেক অভিমানী স্বভাবের বুঝলেন ভাই সাবরা! সকালে একটু আদর যত্নের ডোজ কম পরে গিয়েছিলো তাই রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যাবে বলে বেড়িয়েছে। এখন রাগ ভাঙাতে এসেছি আর বলেছি গাড়িতে উঠতে ছেড়ে দিবো বাপের বাড়ি। অভিমানের মাত্রা এতো বেড়ে গিয়েছে যে সবার সামনে নিজের স্বামীকেই চিনেও না চেনার ভান ধরেছে। এবার বলুন আপনাদের কি করা উচিত!”
রক্তিম যে এই মূহূর্তে দাঁড়িয়ে এমন কিছু করে বসবে তা কল্পনাও করে নি মেহের। মেহেরের চোখের আকৃতি এতোটাই বড় হয়ে গিয়েছে যে মনে হচ্ছে এইমূহূর্তে মনিজোড়া ওর চোখের কোটর থেকে বেড়িয়ে আসবে। যুবক দু’জন মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“কি আপামনি! আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে হওয়া মনোমালিন্যের বিষয় এভাবে পাব্লিক প্লেসে প্রেজেন্ট করার কোনো দরকার ছিলো না তো। এসব ঘরোয়া বিষয় ঘরের ভিতরে থাকাকালীন-ই সলভড করে নিতে হয়। এসব অভিমানের পাট চুকিয়ে এখন যান আপনার স্বামীর সাথে যেখানে যাওয়ার।”
এই বলে ওনারা দু’জন পুনরায় নিজের জায়গায় বসে পড়লেন। মেহের বের লজ্জা বোধ করেছে তাদের কথায়। রক্তিম মেহেরকে একবার চোখ টিপ দিয়ে বললো….
—“বাংলায় বহুল প্রচলিত দু’টো প্রবাদ বাক্য পড়েছিলাম, যেমন বুনো ওল তেমন বাঘা তেঁতুল আর যেমন কু*কু*র তেমন মুগুর। এই ২টাই তোমার আর আমার সাথে ভিষণ ভাবে যাচ্ছে কি বলো!”
মেহের রাগে কেবল ফোঁস ফোঁস করছে। রক্তিম বাঁকা হেসে মেহেরের দিকে কিছুটা ঝুঁকে বললো….
—“এইযে রাগে তোমার নাকের ডগা ও কানের লতি জোড়া হালকা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে তা কিন্তু আমাকে চুম্বকের ন্যয় আকর্ষণ করছে তোমার কাছে যাওয়ার জন্য। এভাবে পাব্লিক প্লেসে কন্ট্রোল হারিয়ে কোনো অ*ঘ*ট*ন ঘটিয়ে ফেললে তার সম্পূর্ণ দায়ভার ও তোমার উপরেই বর্তাবে মনে রেখো সুইটহার্ট। তাই এখনও সময় আছে গাড়িতে উঠে বসো।”
মেহের রাগে, বিরক্তিতে গজগজ করতে করতে গাড়ির পিছন পার্শে গিয়ে দরজা খুলতে নিলে রক্তিম ভাবলেশহীন কন্ঠে বললো…..
—“কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে BMW xm গাড়িটা কিনলাম কি বউয়ের ড্রাইভারি করার জন্য?”
—“পিছনের দরজা খুলুন নয়তো আমি এই গাড়িতে যাবো না।”
—“তাহলে প্রস্তুত হও।”
—“কিসের জন্য প্রস্তুত হবো?”
—“Rmtk Ottcar সহ্য করার জন্য।”
—“মানে?”
—“মানেটা প্রাক্টিকেলিই বুঝিয়ে দেই তাহলে!”
এই বলে রক্তিম মেহেরের দিকে অগ্রসর হতে নিলে মেহের পুরো বিষয়টা বুঝে উঠতে সক্ষম হলো। তৎক্ষনাৎ সে সামনের দরজা খুলে সেখানের সিটে বসে ঠাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। মেহেরের এমন কাজে রক্তিম ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। গাড়ির দু’পাশের গ্লাস দু’টো তুলে দিলো রক্তিম। এই গাড়ির জানালার রং বাহির থেকে এতোটাই কালো কুচকুচে যে ভিতরে কে বা কারা আছে তা বুঝতে সক্ষম হয় না। রক্তিম গাড়ির দরজা লক করে মেহেরের দিকে ঝুঁকে এলো। মেহেরও কিছুটা ঝুঁকে নিজের দু’হাত রক্তিমের বুকের উপর রেখে ওকে বাধা প্রয়োগ করে বললো……
—“কি হচ্ছে এসব? যাচ্ছি তো আপনার সাথে আপনার গাড়ি করেই তারপরেও এমন গা ঘেঁষা ঘেঁষি নোংরা চাল-চলন গুলো করতে চেষ্টা করার মানে কি?
রক্তিম মেহেরের সিটবেল্টট লাগিয়ে দিয়ে নিজের সিটে ভালো ভাবে বসে বললো….
—“সিটবেল্ট লাগাও নি সেটাই লাগিয়ে দিতে গিয়েছিলাম শুধু ৷ দেখো আমার নিয়ত কতো পরিষ্কার আর তোমার চিন্তা-ভাবনা কেমন!”
রক্তিমের এরূপ কথায় মেহের কিছুটা লজ্জা পেলো। পরপরই মেহের নিজের লাগানো সিটবেল্টটা খুলে পুনরায় তা লাগাতে লাগাতে বললো….
—“আমি কোনো ছোট বাচ্চা নই যে আমাকে সিটবেল্ট লাগিয়ে দিতে হবে। আর তাছাড়া আমার চিন্তা-ভাবনা অন্তত আপনার লাগামবিহীন মুখের থেকে অনেক পরিষ্কার।”
এই বলে মেহের নিজের দৃষ্টি বাহিরের দিকে স্থির করলো। রক্তিম শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট করে স্টিয়ারিং এ নিজের দক্ষ হাতখানা ঘুরাতে ঘুরাতে বললো…..
—“নারী তুমি সেরা
দোষ করিয়া যখুনি দেখিলা খুলে গেলো তোমার পোল, ওমনি পুরুষের অন্য দোষ তুলিয়া ধরিয়া নিজেকে ঠিকই দোষ মুক্ত করিয়া নিলা, সত্যিই নারী তুমি অভিনয়ে একদম সেরা।”
রক্তিমের এমন খাপছাড়া কবিতা নামক ‘বিষবাক্য’ শুনে বি*র*ক্তি*তে মেহের নিজের নাক ছিটকালো। কপালের এক পার্শে হাত রেখে বিরবিরিয়ে বললো…..
—“নাটক*বা*জ লোক কোথাকার।”
রক্তিম হেসে বললো….
—“বউ..ও বউ.. তোমার স্বামীর এমন প্রতিভা দেখে নিশ্চয়ই অনেক অবাক হয়েছো তাই না! আমিও অবাক হয়েছি। যদি আমার এই কবিতা কোনো প্রকৃত সাহিত্যিক শুনতো তাহলে এতোটাই মুগ্ধ হয়ে যেতো যে, প্রকাশনাকে দিয়ে বইয়ের পাতায় ছাপানোর জন্য আমার পিছন পিছন ঘুরতো।”
মেহেরের বিরক্তির মাত্রা ধাপে ধাপে বেড়েই চলেছে যেনো। রক্তিম আবারও বললো….
—“আরে ঈশ্বরচন্দ্র থুক্কু রবীন্দ্রনাথের হারিয়ে যাওয়া বংশের উজ্জ্বল বাতি এমন তাল মিলিয়ে কবিতাও যে বলতে পারো তুমি এই ট্যলেন্টটা এতোকাল কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলা বৎস! সঠিক সময়ে কাজে-টাজে লাগাতে পারলে এতোদিনে নোবেল তোমার কাছে দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া চলে আসতো আর বলতো, রক্তিম ভাইজান আপনার চরনে আমাকে একটু ঠাই দেন।”
রক্তিমের এরূপ কথা শুনে মেহের চোখের আকৃতি ছোট করে আড় দৃষ্টিতে একবার ওকে দেখে পরপরই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
প্রায় আধঘণ্টা পর চৌধুরী বাড়ির মেইন গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলো রক্তিমের গাড়ি। পার্কিং স্পটে গাড়িটা থামাতেই মেহের যেনো রকেটের স্পিডে দরজা খুলে গটগটিয়ে ভিতরের দিকে হেঁটে গেলো। রক্তিম ধীরে সুস্থে সিটবেল্ট খুলে সিটে হেলান দিয়ে গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো….
—“আহ্! জীবনটা মনে হচ্ছে বদনার মতো কাটবে শেষমেশ! বিয়ের পর প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি আসলাম। আর আমার একমাত্র বউ তার একমাত্র স্বামীকে রেখেই উধাও হলো? কী কপাল আমার! অবশ্য শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখতে তো গেলো না। গেলো তো নিজের জীবনের প্রথম কেস লড়তে। যেই কেসের শিরোনাম হলো, স্বামী যখন আসামী।”
রক্তিম গাড়ি থেকে নেমে বললো…..
—“যাই গিয়ে দেখি আমার হবু উকিল বউ, আমার বিরুদ্ধে কেস জিততে কতদূর পর্যন্ত এগোলো। আমিও তো ছাড়ার পাত্র না। বিশিষ্ট ক্রি*মি*না*ল লয়্যার রক্তিম রেজওয়ান খান এবার তোমাকে তোমার হয়েই উকালতি করতে হবে। আর কোর্টরুম হবে তোমার শ্বশুরবাড়ি চৌধুরী ভিলার ড্রয়িংরুম!”
রক্তিম সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললো….
—“লড়বো এবং জিতবো তবুও আদরের বউকে ছাড়বো না!”
#চলবে_ইনশাআল্লাহ…….