প্রেমপ্রবাহে বিষবৃষ্টি পর্ব-০৫

0
14

#প্রেমপ্রবাহে_বিষবৃষ্টি (৫ম পর্ব)
#মাইশা_জান্নাত_নূরা (লেখিকা)

চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িং রুমজুড়ে একপ্রকার থমথমে ভাব বিরাজ করছে। জহির রায়হান চৌধুরী মেহেরুন্নিসাকে উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“কি হয়েছে মা তোমার? মুখশ্রীতে এমন গম্ভীরতার ছাপ ফুটে আছে কেনো।?”

মাহফুজা চৌধুরী এক গ্লাস পানি নিয়ে মেহেরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর দিকে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন….

—“পানিটুকু পান কর মা।”

জহির মেয়ের আরালে মাহফুজার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে বললেন….

—“গ্লাসটা এখানেই রাখো। আর যাও আমার মেয়ের পছন্দের খাবারগুলো রান্না করো।”

মাহফুজা নিঃশব্দে জহিরের কথা মেনে নিলেন। পানি গ্লাসটা টি-টেবিলের উপর রেখে স্থান ত্যগ করতে নিলেই মেহের বললো….

—“দাঁড়াও মা। কোথাও যেতে হবে না তোমায়। আমি এখানে প্রকারে প্রকারে খাবার খাওয়ার জন্য আসি নি।”

মাহফুজা থামলেন। জহির বললেন….
—“এভাবে বলছিস কেনো মা? কি হয়েছে তোর সেটা তো বল!”

মেহের চাপা রাগ নিয়ে জহিরের দিকে তাকিয়ে বললো….

—“বাবা! ঐ লোকটার সাথে বিয়ে দেওয়ার পিছনে তোমার ঠিক কি স্বার্থ সিদ্ধি হয়েছে বলো তো..?

জহির কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেন আকস্মিক মেহেরের এমন প্রশ্নে। পরপরই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন….

—“এ কেমন প্রশ্ন তোমার মা! কোনো বাবা কি নিজের মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পিছনে নিজেদের কোনো স্বার্থ সিদ্ধি হওয়ার কথা চিন্তা করতে পারেন..?”

—“যদি কোনো স্বার্থ সিদ্ধি করার-ই না থাকে তাহলে কেনো তুমি আমায় একজন মানুষ রূপী অ*মানুষের সাথে বিয়ে দিলে? তুমি আমার স্বপ্ন সম্পর্কে অবগত ছিলে না বাবা? আমার ঠিক বিপরীত স্বভাবের মানুষ আজ আমার স্বামী হলো কেনো? আমার-ই কি তবে ভু*ল ছিলো তোমাদের উপর ভরসা করা! নিজের মনকে ঐ পর্যন্ত স্থির করা যেখানে দাঁড়িয়ে একজন মেয়ে নিজের জীবনের সবথেকে বড় সিদ্ধান্ত নিজে না নিয়ে নিজের বাবা-মায়ের উপর ছেড়ে দিতে পারে এটা কি তবে আমার নেওয়া সবথেকে বড় ভুল কাজ ছিলো?”

—“রক্তিম বাবা যথেষ্ট ভালো মা। আর তাই তো..!”

—“ভালো? অ*ন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে যে লোক অ*ন্যায়কারীদের সঙ্গ দেয়। নিরাপরাধীদের অ*প*রাধী বানিয়ে অ*প*রাধীদের নিরাপরাধী বানায় সে ভালো? ক্রি*মি*না*লী কাজ যার পেশা সে ভালো?”

—“সবার-ই নিজ নিজ পছন্দ থাকে। নিজ নিজ ইচ্ছে থাকে। তোমার যেমন জীবনে একজন ভালো লয়্যার হওয়ার ইচ্ছে আছে তেমনই রক্তিম বাবারও হয়তো ক্রি*মি*না*ল লয়্যার হওয়ার ইচ্ছে ছিলো। আর সবথেকে বড় কথা পেশা পেশার জায়গায় আর ঘর ঘরের জায়গায়। একটা জিনিস অপরটার উপর তো দখলদারী দেখাতে যাবে না। তাহলে সমস্যা কোথায়?”

নিজের বাবার এরূপ কথাগুলো শুনে মেহেরের মন আরো বেশি হতাশায় ভরে উঠলো। মেহের শব্দ করে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সেইসময় মূল দরজা ভেদ করে রক্তিমের সহায়তায় ভিতরে প্রবেশ করলো জেভিয়ান। অতিরিক্ত নেশা করে বাড়ি ফিরেছে আজ সে তাই নিজ পায়ে হাঁটতে পর্যন্ত পারছে না সে। মেহের জেভিয়ানের এমন অবস্থা দেখে অনেক অবাক হলো। রাগে জহিরের মুখশ্রী হালকা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। কারণ মেহের জানে না তার ভাইয়ের এমন রূপ সম্পর্কে। মেহের সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো….

—“ভাইয়া! তুমি নেশা করেছো?”

জেভিয়ান নিজেকে রক্তিমের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। অতঃপর ঢুলতে ঢুলতে মেহেরের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বললো….

—“হ্যা করেছি নেশা আমি। আজ ১ম করছি না। আমার জীবনের ৩ভাগ সময়-ই তো কেটেছে নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করতে করতে। অবশ্য তুই আমায় আজ ১ম এই অবস্থায় দেখছিস কারণ হোস্টেল থেকে বাড়িতে এসে যে সময়টুকু তুই থাকতি সে সময়ের ভিতর আমি নেশা করতাম না বাবা নিষেধ করতো জন্য। আজ তো পূর্ব থেকে অবগত ছিলাম না আমি যে তুই আসবি। তাহলে হয়তো আজও নেশা করে বাড়ি ফিরতাম না।”

এই বলে জেভিয়ান হাসতে শুরু করলো। জহির রাগী স্বরে বললেন….

—“জেভিয়ান! ঘরে যাও তোমার। এখানে এভাবে বিশৃঙ্খলা করো না।”

জেভিয়ান হাসি থামিয়ে নিজের দু’চোখ দু’হাতের উপরপিঠ দিয়ে একবার ঘষে নিয়ে বললো…

—“আমার তো মাত্র একটা পোল খুলে গেলো তোমার আদরের মেয়ের সামনে বাবা। এখনও আরো অনেক বড় সত্য ওর জানার বাকি। সেগুলো না বলেই ঘরে চলে যাবো আমি?”

মেহের বললো….
—“এসব তুমি কি বলছো ভাইয়া? আরো কোন সত্য আমার জানার বাকি আছে?”

জহির বললেন…
—“ওর কথা ধরো না তুমি মা। নেশা করে এসেছে। তাই উল্টো-পাল্টা কথা বলছে। জেভিয়ান, তোমায় আমি ঘরে যেতে বললাম তো!”

—“মাতাল অবস্থায় আর রাগের মাথায় মানুষ যা বলে তা সত্য হয় বাবা । তাই আমি শুনবো ভাইয়া কোন সত্যের কথা বলছে।”

এই বলে মেহের কয়েক কদম এগিয়ে এসে দাঁড়ালো জেভিয়ানের সামনে। জহিরের কপালে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠলো। জহির মাহফুজাকে চোখের ইশারা করলেন তিনি যেনো জেভিয়ানকে এখান থেকে নিয়ে যায়। মাহফুজা ইশারা বুঝতে পেরে জেভিয়ানের কাছে এসে ওর হাত ধরে বললেন….

—“মেহের মা, এখন তোমায় ওর সাথে কোনো কথা বলতে হবে না। জেভিয়ান বাবা, তুমি আমার সাথে চলো। আমি তোমায় রুম পর্যন্ত দিয়ে আসছি।”

মাহফুজার এরূপ কথায় জেভিয়ানের রাগ জাগ্রত হলো। ঝটকা মেরে মাহফুজার হাত নিজের থেকে ছাড়ালো সে। ফলস্বরূপ মাহফুজা পরে যেতে নিলে মেহের তাকে ধরে নিয়ে রাগী স্বরে বললো….

—“ভাই! এ কেমন আচারণ তোমার? এক্ষুণি তো পরে যেতো আম্মা। আম্মা, তোমার লাগে নি তো!”

মাহফুজা নিরবে বুঝালেন তার লাগে নি। জেভিয়ান রাগী স্বরে বললো….

—“কিসের আম্মা! উনি আমাদের কেবল জন্মই দিয়েছেন। কিন্তু এই চৌধুরী বংশের না বউ হওয়ার যোগ্য উনি আর না আমাদের মা হওয়ার যোগ্য।”

মাহফুজা ঠোঁট কাঁমড়ে ধরলেন। আজ তবে কিছুই অজানা রইবে না মেহেরের। মেহের মাহফুজাকে ছেড়ে আবারও জেভিয়ানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো….

—“ভাই, মুখ সামলে কথা বলো তুমি। মা হন উনি আমাদের। তোমার কোনো রাইট নেই তার সাথে এহেনু আচারণ করার।”

—“বললাম না এই মহিলা আমাদের মা হওয়ার যোগ্য নন! বললাম তো! শুনিস নি তুই? এই মহিলাকে আজ থেকে ৩৫ বছর আগে আমাদের দাদু দাসী রূপে মাত্র কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে কিনে এনেছিলেন এ বাড়িতে। এরপর বাবা এই মহিলার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তাই দয়া করে তাকে বিয়ে করেছিলেন। তাই আজ পর্যন্ত না বাবা তাকে নিজের বউয়ের মর্যাদা দিয়েছেন আর না আমি তাকে মা হিসেবে মেনে নিয়েছি। শুধুমাত্র বাবার তোর প্রতি না জানি কি এতো দূর্বলতা রয়েছে যার জন্য সব সত্য তোর থেকে লুকিয়ে রেখেছে আর মি*থ্যে নাটক নিজেও করেছে আমাকেও করতে বাধ্য করেছে।”

রক্তিম নিজেও এতো গভীর ভাবে এ বাড়ির সব কথা জানতো না। আজ একটু একটু করে জানছে আর অবাক হচ্ছে সে নিজেও। মেহের একবার ঢোক গি*লে নিলো। এসব সে কি শুনছে আজ! নিজের কানকে যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না সে। মাহফুজা মাথা নুইয়ে নিরবে চোখের পানি ফেলছেন কেবল। জহির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কি বলবেন, জেভিয়ানকে কিভাবে আটকাবেন সেসব নিয়ে যেনো কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখানোর এনার্জি নেই তার ভিতর। জেভিয়ান আবারও বললো….

—“তুই তো জানতি জবা স্বাভাবিক ভাবেই মৃ*ত্যু বরণ করেছিলো। কিন্তু আসলে জবার মৃ*ত্যু স্বাভাবিক ছিলো না মেহের। জবা আ*ত্ম*হ*ত্যা করেছিলো। আর জবার মৃ*ত্যু*র জন্য কেবল বাবা দায়ী৷ বাবা নিজের করা অ*ন্যায়কে ধা*মা চাপা দিতে নিজের মতোই এক অ*মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন জবাকে। কারণ জবার প্রতি বাবার কোনো দূর্বলতা ছিলো না। জবা তো আমাদের সাথেই এ বাড়িতে থেকেই বড় হয়েছিলো। তাই ও আমাদের প্রত্যেকজনের আসল রূপ সম্পর্কে অবগত ছিলো। স্বামীর থেকে পাওয়া শারীরিক ও মানসিক অ*ত্যা*চা*র গুলো সহ্য করতে না পেরেই জবা সেদিন আ*ত্ম*হ*ত্যা করেছিলো। এই চৌধুরী বংশের সম্মানের কথা চিন্তা করে জবার মৃ*ত্যু*কে স্বাভাবিক মৃ*ত্যু হিসেবে তুই সহ বাকি সকলের সামনে তুলে ধরেছিলো বাবা। বুঝেছিস!”

মেহেরের নিজের চোখের সামনেটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। টুপটাপ কয়েক ফোঁটা নোনাজল ওর চোখে পেরিয়ে দু’গাল বেয়ে নেমে গেলো। মেহের পিছিয়ে যেতে নিলে টি-টেবিলের সাথে ধাক্কা খেলো। পরে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলো সে। বুকের ভিতরে কেমন চাপা য*ন্ত্র*ণা অনুভব করছে মেহের। জেভিয়ান মেহেরের দিকে ঢুলু ঢুলু পায়ে এগিয়ে এসে বললো….

—“তোর সাথে রক্তিমের বিয়েটাও কিন্তু নরমাল বিয়ে ছিলো না মেহের।”

জেভিয়ানের ঠোঁটে ফুটে আছে পৈ*শা*চি*ক হাসির রেখে। মেহের নোনাজলে টইটম্বুর চোখজোড়া নিয়েই তাকালো জেভিয়ানের দিকে। জেভিয়ান বললো….

—“অবশ্য এবার বাবার করা অ*ন্যায়ের জন্য ব*লি*র শিকার হতে হয় নি তোকে। হতে হয়েছে আমার করা অ*ন্যায়ের জন্য ব*লি*র শিকার। শুনবি কি অ*ন্যায় করেছি আমি!”

মেহের পলক হীন চোখে তাকিয়ে আছে জেভিয়ানের দিকে। আরো কি শুনতে হবে ওকে আজ! আর কতোটা য*ন্ত্র*ণা পাওয়া-ই বা বাকি ওর! এবার যেই ধা*ক্কা*টা পেতে চলেছে মেহের তা কি সামলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি সে পাবে! জেভিয়ান হাসতে হাসতে বললো…..

—“ধ্ব*র্ষ*ণ করেছি আমি। একটা ফাইভ স্টার হোটেলের সাদাসিধে লেডি কর্মীকে ধ্ব*র্ষ*ণ করেছি। চৌধুরী বংশের ছেলের গাঁয়ে ধ্ব*র্ষ*ণে*র দা*গ লাগলে সেই দা*গ তো চৌধুরী বংশের উপরেও পড়বে। তাই বাবা আমাকে নির্দোষ বানাতে ক্রি*মি*না*ল লয়্যার রক্তিম রেজওয়ান খানের কাছে গিয়েছিলো যেনো সে আমার হয়ে কেস টা ল*ড়ে। আর শা*লা তোর স্বামীও এই সুযোগ টাকেই কাজে লাগালো। অফার করে বসলো যদি বাবা তোর সাথে রক্তিমের বিয়ে দেয় তারপরেই আমার হয়ে কেসটা লড়বে এবং আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করে দিবে। কিন্তু আমি জানি না রক্তিম তোকে চিনলো কেমনে! পূর্ব থেকে না চিনলে তো কেউ হুট করেই কাউকে বিয়ে করার কথা বলতে পারে না তাই না! এরপর বাবাও রাজি হলেন। তোকে সাত-পাঁচ ভুজুং-ভাজুং বুঝালেন। তোর সাথে রক্তিমের বিয়েটাও হয়ে গেলো।”

মেহের ধ*প করে টি-টেবিলের উপরেই বসে পড়লো। দু’হাতে চেপে ধরলো নিজের কান দু’টো। আর শুনতে পারছে না সে বি*ষে ভরপুর একেকটা কথা৷

#চলবে_ইনশাআল্লাহ……..