প্রেমপ্রবাহে বিষবৃষ্টি পর্ব-০৮

0
24

#প্রেমপ্রবাহে_বিষবৃষ্টি (৮ম পর্ব)
#মাইশা_জান্নাত_নূরা (লেখিকা)

শিউলির বাড়িটা ঠিক মধ্যবিত্ত একটা আলাদা পাড়ার ভিতর। গলির সরু রাস্তা গুলো ধরে মিতা মেহেরুন্নিসাকে নিয়ে শিউলির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। মেহের এপাশ ওপাশ চোখ বুলালো। ঘন বসতি। রাস্তাটা চিকন হলেও দু’ধার দিয়ে সরকারী ড্রেন দেওয়া রয়েছে। নোংরা পানি ও ময়লায় ড্রেনটার জায়গায় জায়গায় পানি চলাচলের রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে মশা-মাছি উড়াচ্ছে আর অদ্ভুত বা*জে গ*ন্ধও ছড়াচ্ছে বাতাসে। শিউলির বাড়ির মূল দরজাটা টিনের হওয়ায় জং লেগে গিয়েছে অনেক জায়গায়। মনে হচ্ছে জং গুলোতে হাত ছোঁয়ালেই তা গুড়ো গুড়ো হয়ে নিচে পড়বে। মিতা দরজায় কড়া নাড়লো। ডাকলো শিউলির নাম ধরে। ভিতর থেকে গম্ভীর পুরুষালি একটা কন্ঠে ‘কে? আসছি’ শব্দ দু’খানা ভেসে এলো। মিতা মেহেরের দিকে তাকিয়ে বললো….

—“আঙ্কেল আছে বাসায়। আঙ্কেল পুরোনো দিনের মানুষ। মান-সম্মান জিনিসটাকে গুরুত্ব দেন বেশি। আঙ্কেলের সামনে এসব বিষয়ে শিউলির সাথে কথা বলা যাবে বলে তো মনে হয় না।”

মিতার কথা শেষ হতে না হতেই শিউলির বাড়ির দরজাটা খুলে গেলো। দরজা খুলতেই মিতা আর মেহেরের নজরে পড়লো সাদা লুঙ্গি ও ক্রিম কালারের একটা ফতুয়া পরিহিত মাঝারি বয়সের পুরুষের সাথে। মুখভর্তি দাঁড়িগুলোতে পাঁক ধরেছে। মাথায় সামনের দিকে অর্ধ অংশে চুল নেই বললেই চলে। পিছনের দিকে যা আছে তাতেও পাঁক ধরেছে। তার চেহারায় গম্ভীরতার ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। চোখের আকৃতি ছোট রেখেই বললেন……

—“কে তোমরা? কাকে চাই?”

মিতার সাথেও তার প্রথম সাক্ষাৎ। মিতা কেবল শিউলির মুখেই ওর বাবার ব্যবহার, চলন, রাগ সম্পর্কে শুনেছে। মিতা জোরপূর্বক হেসে বললো….

—“আপনি কি শিউলির বাবা জামাল আঙ্কেল?”

জামাল গম্ভীর কন্ঠেই বললেন….
—“হুম।”

—“আমার নাম মিতা। আর ওর নাম মেহেরুন্নিসা।আমরা শিউলির বান্ধবী হই আঙ্কেল। আমরা ওর সাথে দেখা করতে এসেছি।”

—“ওও আচ্ছা। ভেতরে এসো তোমরা।”

জামাল দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। মিতা আর মেহের বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। মেহের চারপাশে চোখ বুলালো। খুব ছোট পরিসরে টিনের ছাদ বিশিষ্ট এক তলা বাড়িটি। আঙিনাটা কাঁচা মাটির। আঙিনার উপর একটা দড়ির ও বাঁশের তৈরি সিংগেল খাট রাখা আছে। একপার্শে মাটির চুলোর রান্নাঘর। অন্যপার্শে গ্রিল দেওয়া বারান্দা। গ্রিলের ফাঁকে ফাঁকে লতা-পাতা উঠে গিয়েছে। ফুলগাছের শখ রয়েছে যে এ বাড়ির কোনো সদস্যের তা এই দৃশ্য দেখে যে কেউ-ই বুঝতে সক্ষম হবে। বারান্দার ওপাশেই হয়তো হাতে গোণা কয়েকটা রুম রয়েছে। জামাল দড়ির বাঁধনে বাঁধা খাটটাতে বসতে বসতে হাতের ইশারায় একটা রুম দেখিয়ে বললেন….

—“ঐ তো ঐ পার্শের রুমটাই শিউলির। যাও তোমরা। শিউলি ওর রুমেই আছে।”

মিতা আর মেহের ধীরপায়ে বারান্দা ধরে সেই কক্ষের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজাটা হালকা ভিড়ানো রয়েছে দেখে মিতা নক করলো। ভিতর থেকে সাড়া ভেসে এলে মিতা আর মেহের একসাথে ভিতরে প্রবেশ করলো। শিউলি বিছানার উপর দু’হাটু ভাঁজ করে হাঁটুর উপর থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে। শিউলির পরনে ছাইরঙা একটা থ্রিপিচ রয়েছে। মাথার অনেকটাই উঁচুতে হাতখোপা বেঁধে রেখেছে। শিউলির রুমটা অনেক ছোট। একপার্শে কেবল একটা সিংগেল চৌকি টাইপ খাট রয়েছে। একটা ছোট কাঠের টেবিল যার উপর ২ সারি করে একহাত সমান উচু হবে কতোকগুলো বই রাখা রয়েছে। একটা কাঠের তৈরিই চেয়ার আছে। অন্য কর্ণারে আলনা রাখা আছে। যেখানে তাকে তাকে শিউলির কাপড় ভাঁজ করে রাখা দেখা যাচ্ছে। দেওয়ালের উপর এক হাত পরিমাণও দৈর্ঘ-প্রস্থ হবে না একটা আয়নাও রাখা আছে। এই তো। এই শেষ। মিতা আর মেহেরের দিকে না তাকিয়েই শিউলি বললো….

—“কেনো এসেছো তুমি মিতা? আমার এখানে তোমার আসা-যাওয়ার বিষয়টা ঐ নোং*রা লোকটা জানতে পারলে তোমাকেও ছিঁ*ড়ে খা*বে। যেভাবে আমাকে ছিঁ*ড়ে খে*য়ে*ছে।”

শিউলির এরূপ কথা শুনে মেহেরের বুকের ভিতরটা ধ*ক করে উঠলো। ঐ নোং*রা লোকটা যে ওর-ই মায়ের পেটের আপন ভাই। মিতা শিউলির কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বললো….

—“সেদিন তোমার কথাগুলো শুনে আমি ভ*য় পেয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই৷ একটা বারের জন্য ভেবেওছিলাম এসব ঝা*মে*লা*র ভিতর আমার না জড়ানোই ভালো। কিন্তু মেহেরুন্নিসা আপু আমার সমস্ত ভু*ল ধারণা ভে*ঙে দিয়েছেন। আমার মনষ্যত্ব বোধকে জাগিয়ে তুলেছেন। আমিও বুঝতে পেরেছি শিউলি সেদিন যদি আমি তোমায় না বলতাম যে আমাকে বাড়ি যেতে হবে আমার হয়ে ওভারটাইম তুমি করে দাও, আর তুমি যদি আমার কথা না মানতে তাহলে আজ তুমি যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছো সেই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমাকে যেতে হতো। তাই এখন আর আমি পরোয়া করি না তোমার কাছে আসার জন্য আমার কি হবে না হবে তা নিয়ে।”

শিউলি চোখ তুলে তাকালো। তখুনি মেহেরকে দেখতে পেলো সে। শিউলি মিতার দিকে তাকালো। মিতা বললো….

—“মেহের আপুর সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। কে উনি? কেনো এসব বিষয়ে নিজেকে জড়াচ্ছেন? কিছুই না।”

মেহের এগিয়ে এসে বিছানার কাছে দাঁড়ালো। শিউলি মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে প্রশ্নমিশ্রিত চোখে। মেহের কোনো দ্বিধা না করে বললো….

—“তোমার সাথে যে এতো বড় অ*ন্যায় করেছে দূর্ভাগ্যবশত আমি তারই ছোট বোন হই।”

মেহেরের পরিচয় পাওয়া মাত্র শিউলি আর মিতা দু’জনেই অবাক হয়ে গেলো। মিতা বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো….

—“আমি তোমার পরিচয় জানতাম না বাট তুমি ঐ ধ্ব*র্ষ*কে*র রিলেটিভ হও এটা ভাবতেও পারি নি।”

—“শান্ত হও মিতা। আমার পরিচয় আগেই পেয়ে গেলে হয়তো তুমি আমাকে শিউলির কাছে নিয়ে আসতে না।”

—“আসলেই আনতাম না। আপনি আমাকে এতো এতো বড় বড় কথা শুনালেন যে আমি মুগ্ধ হয়ে আপনাকে নিয়ে এসেছিলাম শিউলির কাছে। কিন্তু…!”

শিউলি রাগী স্বরে বললো….
—“কেনো এসেছেন আপনি এখানে? নিজের ভাইয়ের করা কৃত*কর্মের জন্য সাফাই গাইতে এসেছেন? নাকি আমার পরিবারকে টাকা দিয়ে কিনে নিতে এসেছেন? কি ভাবছেন লাখ লাখ টাকা আমার পরিবারের মুখের উপর ছুঁ*ড়ে মা*র*লে*ই ওরা আমাকে বুঝাবে যে ঐ ধ্ব*র্ষ*কে*র বিরুদ্ধে করা কেসটা আমার তুলে নেওয়া উচিত! আর আমি চুপচাপ তা তুলে নিবো? আমার তো ইজ্জত বলতে আর কিছু এমনিও অবশিষ্ট নেই। এবার কি আমার শিক্ষক বাবার বেঁচে থাকা বাকি সম্মানটুকুও নিলামে তুলে দিবো?”

শিউলির দু’চোখ কেবল ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে মূহূর্তেই। হালকা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। মুখে, গলায় থাকা ক্ষ*ত গুলো এখনও চোখে ধরার মতো চিকচিক করছে। মেহের বললো….

—“২দিন হলো জানতে পেরেছি আমার ভাই একজন ধ্ব*র্ষ*ক। আমার বাবাও নিজের বংশের সম্মানের কথা চিন্তা করে আমার ভাইয়ের সব দো*ষ থাকা সত্ত্বেও ওকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য যেই ক্রি*মি*না*ল লয়্যারের শরণাপন্ন হয়েছেন তারই সাথে চতুরতার সাথে আমার থেকে সত্য লুকিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। আমার শরীরের প্রতিটি জায়গায় সেই লোকের ছোঁয়া রয়েছে। নিজের কাছেই নিজেকে কেমন অ*পবিত্র, অ*পবিত্র লাগে। নিজের বাবার বাড়ির সবার সাথেই সম্পর্ক শেষ করেছি। স্বামী নামক ঐ অ*মা*নুষটাকে বুঝানোর বৃ*থা চেষ্টাও করেছি যে সে যেনো ঐ ধ্ব*র্ষ*কে*র হয়ে কেসটা না ল*ড়ে। কিন্তু আমি ব্য*র্থ হয়েছি। এরপর নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম তোমাকে খুঁজে বের করবো। তোমাকে ন্যায় পাইয়ে দিতে যা যা করা প্রয়োজন আমার সেই সবকিছুই করবো আমি। আমার সামনে আমার বাবা-ভাই-স্বামী যেই দাঁড়াক না কেনো আমি কারোর পরোয়া করবো না। ন্যায়ের পথে চলবো যখন মনঃস্থির করেছি তখন আমাকে এই পথ থেকে কেউ হটাতে পারবে না শিউলি। আমাকে একটাবার বিশ্বাস করে দেখো। কথা দিচ্ছি ঠ*কা*বো না।”

শিউলি আর মিতা নিরব হয়ে রইলো। পিছন থেকে জামালের কন্ঠস্বর ভেসে এলো।

💥

অনেকক্ষণ হলো বাসায় ফিরেছে রক্তিম। রূপার থেকে জানতে পেরেছে মেহের বাসায় নেই। বেড়িয়েছে রক্তিম বেড়িয়ে যাওয়ার পরপরই। এখন বাজে বিকেল ৫টা। এর মাঝে রক্তিম মেহেরকে ফোনও দিয়েছিলো বেশ কয়েকবার কিন্তু ফোন বাজতে বাজতে আপনা-আপনিই কেটে গিয়েছে। চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে রক্তিমের মুখশ্রী জুড়ে। ড্রয়িংরুমে সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে রক্তিম। কপালের উপর ডান হাতটা ভাঁজ করা রয়েছে। সেইসময় মেহের মূল দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। রক্তিমকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে রক্তিম মেহেরের উপস্থিতি বুঝতে পেরে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো….

—“দাঁড়াও সুইটহার্ট।”

মেহের দাঁড়িয়ে গেলো। ওর মুখশ্রী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক-ই রয়েছে। রক্তিম মেহেরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওকে উপর থেকে নিচ একবার দেখে নিয়ে বললো….

—“কোথায় গিয়েছিলে?”

মেহের স্ট্রেইট জবাব দিলো…
—“আপনাকে বলার প্রয়োজন মনে করি না।”

—“কতোবার বলবো তোমায় তুমি মানো বা নামানো তুমি আমার বিয়ে করা বউ হও। তুমি কোথায় কখন কি কারণে যাচ্ছো সেই সবকিছু জানার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে।”

মেহের রক্তিমের চোখের দিকে তাকালো। অতঃপর বললো….

—“বিয়ে মানে আসলে কি, বিয়ের বাঁধনে আবব্ধ হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই উভয়ের প্রতি কি কি অধিকার খাটানো উচিত এবং কিভাবে তা খাটানো উচিত সেই সব সম্পর্কে আপনার ভিতর সঠিক কোনো ধারনা আছে বলে আমার মনে হয়। কেবল একটা কথাই জানেন বিয়ে করেছেন মানে বউয়ের সাথে জোর করে স*হ*বা*স করতে পারবেন আর বউ কখন কোথায় যাচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন এবং যোগ্য উত্তরও আমার আপনাকে দিতে হবে।”

রক্তিম দাঁতে দাঁত চেপে বললো….
—“আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না সুইটহার্ট। তাহলে ফল ভালো হবে না।”

—“আপনাকে তো আমি মানুষ-ই মনে করি না। তাহলে ভালো ফলের আশা রাখবো তাও আপনার উপর ভাবলেন কি করে?”

এই বলে মেহের রক্তিমের পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে রক্তিম মেহেরের হাতের উপরি অংশের মাংসপেশি শক্ত ভাবে চেপে ধরে ওকে নিজের অনেক কাছে টেনে নিলো। মেহের রাগে-ঘৃ*ণা*য় নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় ছটফট করছে কেবল৷ রক্তিম বললো….

—“নিজের বাপ-ভাইয়ের করা অ*ন্যা*য়*কে ধা*মা*চা*পা না দেওয়া থেকে আমাকে বিরত করতে সক্ষম না হওয়ায় আমার বিরুদ্ধে গোপন পরিকল্পনা সাজাচ্ছো তাই না!”

মেহের রাগে হিসহিসিয়ে বললো….
—“হ্যা সেটাই করছি। আপনাদের কাউকে আমি ছেড়ে দিবো না। শান্তিতে বাঁচতেও দিবো না।”

—“ঠিক আছে চালিয়ে যাও তুমি তোমার চেষ্টাটা। আমি তো দেখতে চাই আমার ঘরের মালকিন আমার সাথে থেকেই আমাকে টে*ক্কা দিতে কতোদূর পর্যন্ত যেতে পারে!”

এই বলে রক্তিম মেহেরকে ছেড়ে দিলো। মেহের রক্তিমের পাশ কাটিয়ে দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। রক্তিম বাঁকা হাসির রেখা নিজের ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তুলে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ…….