#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_১
#লেখিকা_তাসফিয়াহ_আনজুম
পাত্র হিসেবে নিজের ভার্সিটির প্রফেসরের ছেলেকে দেখে আঁতকে উঠলো ঝুমুর।যদিও এর আগে কখনো স্যারের ছেলেকে সে দেখেনি।তবে চেহারা দেখেই যে কেউ বলে দিবে এটা যে স্যারের ছেলে। একদম স্যারের কার্বন কপি, কিন্তু লম্বায় কিছুটা বেশি হবে হয়তো।ঝুমুরের মাথা রীতিমতো ঘুরপাক খাচ্ছে।শাকিল স্যারের ছেলে! কিন্তু কেন?সামনে বসা মানুষগুলো যখন তাকে নিয়ে নানান কথা বলায় ব্যস্ত। কিন্তু এদিকে তার বিন্দুমাত্র ও আগ্রহ নেই।
ঝুমুর শিকদার। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। ছোট ভাই জাবির শিকদার। এবার চতুর্থ শ্রেণীতে উঠলো।একমাত্র মেয়ে বলেই সে একটু বেশি আদরের, কিন্তু আদরের পাশাপাশি বাবার শাসন ও মাত্রাতিরিক্ত। ঝুমুর এবার ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে। পড়ালেখার প্রতি তার তেমন একটা আগ্রহ নেই,নাহ! নেই বললেই চলে। না হলে কি এসময় বিয়ে দেওয়ার জন্য কোন পরিবার উঠে পড়ে লাগতো? তার শুধু ভালো লাগে বন্ধু বান্ধবের সাথে ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা দেয়া।
“যাও ঝুমুর ওয়াহিদকে নিয়ে একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসো।”
বাবার এমন কথা কানে প্রবেশ করতেই চমকে উঠলো ঝুমুর। কি আশ্চর্য! চেনা নেই জানা নেই একটা মানুষের সাথে সে কি কথা বলবে? আর কেনই বা বলবো! ঝুমুর ছাদে যাব না ভেবে সটান হয়ে জায়গায় বসে রইলো।
“কি হলো শুনতে পাচ্ছো না আমি কি বলছি? যাও!”গম্ভীর কণ্ঠে ঝুমুরের বাবা বলে উঠলেন কথাটা।
বাবার সঙ্গে আর না পেরে বাধ্য হয়েই ছাদের দিকে পা বাড়াল ঝুমুর। যেতে যেতে ফন্দি আটতে লাগলো কিভাবে এই বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়া যায়। তখন কিছু একটা মনে পরতেই দাঁত বের করে হেঁসে উঠলো।
আমি তো ভেবেছিলাম ভূত-পেত্নী মানুষকে রাতে ভর করে, কিন্তু তোমাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না এই দিনে দুপুরেও এমনটা হয়! আড়চোখে ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো ওয়াহিদ।
গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠস্বরের অপমানজনক বাক্য কানে পৌঁছাতেই রাগে কিলবিল করে উঠলো ঝুমুর।
“এই! কি বললেন আপনি? আমাকে ভূত পেত্নী ভর করেছে? আসল ভূত তো আপনি! যে না বলে কয়ে আমার ঘাড়ে চড়ে বসেছেন।” রাগে গজগজ করতে করতে এমন কথা বলে উঠলো ঝুমুর।
ঝুমুরের কথা শুনে রাগ না করে উল্টো আরো হা হা করে হেসে উঠলেন অপর পাশের ব্যক্তিটি। হাসতে হাসতেই বললেন,”ধানিলঙ্কা!”
“কি বললেন আপনি!আমি ধানিলঙ্কা? তো আপনি কি? আপনি একটা বানর! একটু সুযোগ পেয়েই লাফিয়ে লাফিয়ে আমার জীবনে ঢুকে পড়তে চাচ্ছেন”। দাঁতে দাঁত মিশিয়ে কথাটা বলে উঠে সে।
আবারো হু হা করে হেসে উঠলো লোকটা। আবারো গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো, কিন্তু আমার এতে কোন সমস্যা নেই! তুমি যদি ধনীলঙ্কা হও তবে আমি মিষ্টি হয়ে তোমার সব ঝাল মিটিয়ে দেবো। বলেই আমাকে একটা চোখ টিপ মারলো। বায় দ্যা ওয়ে, আমি তো এমন ঝাল মেয়েই পছন্দ করি। আর সেটা তুমি হলে তো কথাই নেই। দুষ্টু স্বরে কথাটা বলে আবারও হেসে উঠলো ওয়াহিদ।
উনার এমন হাসি দেখে ঝুমুরের মাথায় ধা করে আগুন জ্বলে উঠল। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,কিন্তু আপনাকে বিয়ে করতে চাই না। আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি, চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে জীবনের সবচেয়ে বড় মিথ্যাটা বলে ফেললো সে। কিন্তু ঝুমুরের এমন কথায় লোকটার মুখের কোন পরিবর্তন না দেখে কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হলো। কি হলো আপনি আশ্চর্য হননি এ কথা শুনে?
কেন? আশ্চর্য হবো কেন? তোমার বয়সটা এখন আবেগের,এমন হতেই পারে স্বাভাবিক। এখন যাকে পারো যত ইচ্ছা পারো ভালোবেসে নাও। কিন্তু বিয়ের পর মন, প্রান সব দিয়ে শুধু আমাকেই ভালোবাসবে! বুঝলে? আমার দিকে ঝুঁকে হালকা স্বরে কথাটা বলে উঠলেন উনি। তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস গলায় আছড়ে পড়তেই কেঁপে উঠলাম আমি। উনাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলাম আমি।
আমার সমস্যা আছে! আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আবারো বলে উঠলো ঝুমুর।আপনি নিচে গিয়ে বাবাকে বলবেন, আপনার আমাকে পছন্দ হয়নি।ব্যাস!
আচ্ছা! বললে আমি বিনিময়ে কি পাব?
কি চান বলুন? আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল ঝুমুর।
তোমাকে!
হালকা স্বরে কথাটা উচ্চারণ করেই ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো ওয়াহিদ। ঝুমুর সেদিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল।সে তড়িঘড়ি করে চোখ ফিরিয়ে ফেললো। লোকটার হাসিটা ভীষন সুন্দর। হাসলেই দাতের দুই পাশের ছোট ছোট দুটি গজ দাঁত বেরিয়ে আসে এতে যেন মুক্তো ঝরে। মুখের সামনে তুড়ি বাজাতেই কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে এলো ঝুমুর।
আপনি তো ভারি নির্লজ্জ! আপনার সাথে কথা বলেই সময় নষ্ট! শুনে রাখুন আপনি যা ইচ্ছা করতে পারেন কিন্তু আমি মরে গেলেও আপনাকে বিয়ে করবো না, কথাগুলো বলেই ছাদ থেকে নামার জন্য পা বাড়াল ঝুমুর।
“মরে গেলে না দেহে প্রাণ থাকতেই তুমি আমাকে বিয়ে করবে, আর নিজের ইচ্ছাতেই করবে। মনে রেখো!” হালকা চেঁচিয়ে উঠে কথাটা বললো ওয়াহিদ।
______
ছাদ থেকে নেমে সোজা নিজের ঘরে এসে দরজাটা লাগিয়ে বসে রইলো ঝুমুর। রাগে কান্না পাচ্ছে তার। এমন সময় মোবাইলটা ঘর কাঁপিয়ে বেজে উঠলো। প্রথমে না ধরলেও বারবার বাজতেই থাকলো। তাই আর না পেরে বাধ্য হয়ে ধরতেই হলো বন্ধু নামক শত্রুটার ফোন।
হ্যালো..
কিরে তুই কই? আধাঘণ্টা ধরে ফোন দিচ্ছি এক নিঃশ্বাসে বলে উঠে কেয়া।
বাসর ঘরে বসে আছি,আয় দেখে যা! রাগে গজগজ করতে করতে বললো ঝুমুর।
কিইইই! তুই বিয়ে করে ফেলছোস! আরে দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বান্ধবী আমি তোর আমাকে একটাবার বলার প্রয়োজন মনে করলি না?আহ!এ জীবন রেখে কি লাভ!
থাম!বেশি ডং করবি না নাইলে বিয়ে সত্যি সত্যি না করলেও এখন যা করতে মন চাচ্ছে ওইটা করে ফেলবো…. দাঁতে দাঁত চেপে হালকা চিৎকার করে বললো ঝুমুর।
আবার কি করতে মন চাচ্ছে তোর?
তোর মার্ডার! ভাবলেশহীন ভাবে বললো ঝুমুর।
কিহ! মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর ?কি হয়েছে তোর বলবি তো!
এখনো হয়নি কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে, বিয়ে।
ধুর ! ফাজলামো করিস না আর আমি সিরিয়াস।
নারে আমি সত্যিই বলছি, আজকে আমাকে পাএপক্ষ দেখতে আসছিলো। ওরা বিয়ের তারিখ ও ঠিক করে দিয়েছে। কিন্তু আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। কি করবো কিছু বুঝতেছি না, তুই কিছু একটা কর!
কে ওরা? তুই চিনিস?
হ্যাঁ, শাকিল স্যারে…
কিহ! শাকিল স্যার! এই বুড়া বয়সে ওনার আবার বিয়া করার ভীমরতি জাগছে? আমি তোকে আগেই সাবধান করছিলাম, বলছিলাম না উনি তোর দিকে কেমন কেমন করে তাকায়। দেখেছোস! আমি কোনোদিন ভুল বলি না, বাহবার সুরে বলে উঠে কেয়া।
এই তোর মাথায় কি গোবরে ঠাসা? তোর মতো বেকুব আর দেখি নাই। আমার বাবার বয়সী স্যার আমার জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসবে? সিরায়াসলি! রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো ঝুমুর। স্যারের ছোট ছেলের জন্য আমাকে দেখতে এসেছিলেন গাঁধী।
ওহহহ আচ্ছা!আগে বলবি না এইটা! তা কেমন দেখতে রে? হ্যান্ডসাম?
আমি তো আর বিয়ে করছি না তাই আমি দেখিওনি, তুই দেখ তোর পছন্দ হলে বিয়ে করে ফেল। আর আমাকেও উদ্ধার কর!
ধুর তুই আসলেই একটা….
আচমকা দরজায় করাঘাতের শব্দে কথায় ব্যাঘাত ঘটে ঝুমুরের।কল রেখে দরজা খুলে দেয় সে।
দরজা খুলতেই এক বক্স কিটক্যাট চকলেট হাতে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ে জাবির। আপি দেখ দুলাভাই আমাকে কি কিনে দিয়েছে!তুই খাবি? ভাইয়া বলেছে তোকেও একটা দিতে,নে খা বলে ঝুমুরের দিকে একটা চকলেট বাড়িয়ে দিল।
জাবিরের মুখে দুলাভাই শব্দটা শুনে ঝুমুর যেন আকাশ থেকে পড়ল। দুলাভাই! এই কে তোর দুলাভাই? তোর কোন বোনের বিয়ে হয়েছে?রাগে গজগজ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো ঝুমুর।
আমার তো একটাই বোন,আর সেটা হলে তুমি।তাহলে তোমার বর মানেই তো আমার দুলাভাই।ঘোর চিন্তাভাবনা করে বললো জাবির।
এই যা তো বের হ আমার ঘর থেকে!
বোন রেগে করেছে ভেবে জাবির ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কিছু সেকেন্ড পরেই আবার ফিরে এসে দরজার ফাঁকে মাথা ঢুকিয়ে বললো,বাবা তোমাকে নিচে ডাকছে। তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে।
ভাইয়ের পিছু পিছু সেও বেড়িয়ে গেল ঘর বাবাকে প্রচন্ড ভয় পায় বলে কথা!
_______
গত কয়েকদিনের অবিশ্রান্ত রৌদ্রের উষ্ণতায় দগ্ধ হয়ে উঠেছিলো চারিপাশ। তবে আজ মধ্যাহ্নের শেষ ভাগে স্বচ্ছ নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘ জমেছে। হালকা মেঘ মৃদু বাতাস সবমিলিয়ে যেন চারিপাশে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে প্রকৃতি। শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে উবু হয়ে শুয়ে থাকা ওয়াহিদের পিঠ। জানালা খোলা থাকায় মৃদু বাতাসে উড়ছে ঘরের শ্বেত পর্দাগুলো। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে বাইরে। মোবাইল নামক যন্ত্রটার শব্দে ওয়াহিদের আরামের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো। হালকা চোখ খুলে বিছানায় উঠে বসে ফোনটা রিসিভ করলো সে,
‘হ্যালো।’ আসসালামু আলাইকুম।
‘হ্যালো।’ ওয়ালাইকুম আসসালাম।বাবা আমি তোমার আফতার আঙ্কেল বলছি।ঝুমুর এর বাবা।”
“জি আঙ্কেল চিনতে পেরেছি।কেমন আছেন আঙ্কেল?”
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো বাবা?”
“জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
একটা কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলাম বাবা। যেহেতু সামনের মাসে বিয়ে,তাই হাতে আর বেশি সময় নেই। তোমার আম্মু কিছুক্ষণ আগে আমাকে ফোন করে ঝুমুর কে নিয়ে কবে বিয়ের কেনাকাটা করতে যাবে তা জিজ্ঞেস করছিল।তো আগামীকাল তো শুক্রবার। কালকে ঝুমুর যেতে পারবে তোমার আম্মুকে বলে দিও। তোমরা যাওয়ার সময় ওকে বাসার সামনে থেকে নিয়ে যেও।
আচ্ছা ঠিক আছে আঙ্কেল।
আচ্ছা বাবা ভালো থাকো। এখন রাখছি।
জি।
ফোনটা রেখেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সে মাএ একঘন্টা ঘুমাতে পেরেছে। গতকাল সারারাতের ডিউটি সঙ্গে সারাদিনের ব্যস্ততা মিলিয়ে সে ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করছিল,তাই বিছানায় পিঠ লাগতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
চলবে।