#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_২
#লেখিকা_তাসফিয়া_আনজুম
ঝুমুর নিচে এসে দেখল ড্রয়িং রুমে বসে আছে তার বাবা। কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন তিনি। ঝুমুর গিয়ে বসল বাবার সামনের সোফাটায়। কথা প্রায় শেষপ্রান্তে আসায় সে বুঝতে পারছে না কার সাথে কথা বলছে। আফতার সাহেব ফোন রেখে ঝুমুরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, শোনো কাল জুমার নামাজের পর ওয়াহিদ আসবে তোমাকে নিতে তৈরি হয়ে থাকবে।
বাবার কথা শুনে কপাল কুঁচকে গেল ঝুমুরের, ওয়াহিদ কে?
ঝুমুরের এমন কথা শুনে আফতার সাহেব কিছু বলার আগেই, আরে গাধা! এটাই তো আমার দুলাভাই। হাসতে হাসতে পেছন থেকে বলে উঠে জাবির।
জাবির এটা বড় বোনের সাথে কথা বলার ধরন? আপু বলবে!আর যেন তুই তোকারি করতে না শুনি। ধমকের সুরে বললো শিকদার সাহেব।
জি বাবা। মন খারাপ করে হেঁটে চলে গেল জাবির।
যেতে যেতে বলে উঠে, ধুর এই ঘরে কেউ আমাকে ভালবাসে না।সব ভালোবাসা শুধু ওই ঝুনঝুনির জন্য। হুহ!
——–
আজকের আকাশটা বেশ ফকফকা। ভোররাতের দিকে হালকা বৃষ্টি থাকলেও এখন বেশ ভালোই রৌদ্রের দেখা দিয়েছে। শুক্রবার বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠে ঝুমুর। এতে অবশ্য বাড়ির কেউ কিছু বলে না। একটা দিন নিজের ইচ্ছামতো কাটানোই যায়।ফজরের নামাজ আদায় করে আবার পাড়ি জমায় সে ঘুমের রাজ্যে। দশটা কিংবা এগারোটার আগে কানের কাছে ঢোল পিটিয়েও তাকে ঘুম থেকে তোলা যায় না।এতটাই ঘুম কাতুরে সে!
কিন্তু আজ সাকলের কাহিনী কিছুটা ভিন্ন। সকাল আটটা থেকে মায়ের ডাকাডাকিতে আর বিছানায় বিছানায় পিঠ লাগিয়ে রাখার সুযোগ হলো না। ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে রান্না ঘরে উঁকি দিলে একবার। মাকে সকাল সকাল এতো রান্নাবান্না করতে দেখে খানিকটা চিন্তায় পড়লো ঝুমুর। পরক্ষনেই বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই বাড়িতে কোনো মেহমান আসবে।তাই এতো আয়োজন। মায়ের মেজাজ ঠিক নেই ভেবে আর জিজ্ঞেস করল না কারা আসছে।
সকালে খাবার টেবিলে বসে একাই নাস্তা করছিল ওয়াহিদ। সে পেশায় একজন ডাক্তার।গত দুই বছর আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে এমবিবিএস শেষ করে এসেছে। এক বছর ইন্টার্নশিপ করার পর গত ছয় সাত যাবত নিজেদের হাসপাতালে বসছে। যদিও ওখানে অনেক সিনিয়র ডাক্তার আছে। তবে ডাক্তার হওয়ায় তার কাজের কোনো সময়সীমা নেই। যখন তখন ছুটে যেতে হয়। যদিও আজ তার ডিউটি নেই তবে একবার রোগী ভিজিট করতে যাবে হসপাতালে।
শুক্রবারে সাধারণত ঘরের সবাই একটু দেড়িতেই উঠে। তাদের পরিবারে মানুষ বলতে মা,বাবা আর ওয়াহিদ। ওয়াহিদ এর বড় ভাই ওয়ালিদ শেখ বিয়ে করে আমেরিকায় স্যাটেল। বছরে একবার আসে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে এমনিতেও ফোনে প্রায় প্রতিদিনই যোগাযোগ হয় তাদের। ওয়ালিদ বাবা মাকে নিজের সাথে আমেরিকায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু তার বাবা শাকিল শেখ এখনো সরকারি কলেজের প্রফেসর। বাড়িঘর,চাকরি ছেড়ে কোথাও যেতে চান না তিনি।
নাস্তা শেষ করেই গাড়ি নিয়ে ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল ওয়াহিদ। সাধারণত সে গাড়ি দিয়ে যাতায়াত করে না, কারণ গাড়িটা তার বাবার। অবশ্য তার বাবা তাকে গাড়ি কিনে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু ওয়াহিদ এতে দ্বিমত পোষণ করে জানায়, যখন সে নিজের টাকায় কেনার যোগ্য হবে তখন কিনবো। ছেলের এমন কথায় গর্বে হেঁসে বলে উঠছিলো,”প্রাউড অফ ইউ মাই সান।আই এক্সেপ্ট দ্যা বেস্ট ফ্রম ইউ।”
_____
ঝুমুর গোসল করে একটা কালো আর গোলাপী মিশ্রনের থ্রি পিছ পড়েছে। গায়ের রং ফর্সা হওয়ায় তাকে প্রায় সব রঙেই মানায়, তবে কালো রঙে তাকে একটু বেশিই ভালোলাগে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করতে করতে ভেজা চুল আঁচড়ে নিল। মুখেও হালকা প্রসাধনী ব্যবহার করে নিল। তার অবশ্যই পরিপাটি হয়ে থাকতেই ভালো লাগে। শুধু ভালো লাগে না যা পড়াশোনা টা! এসব ভাবনার মাঝেই ,”আপি কে যে এসেছে তাড়াতাড়ি আসো আমি উপরের লকটা খুলতে পারছি না।” হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকে বলে উঠে জাবির।
বাবা এসেছে ভেবে নিচে গিয়ে দরজা খুলে দিল ঝুমুর। দরজা খুলে বাজারের ব্যাগ হাতে ওয়াহিদ কে দেখে মুখ হা হয়ে গেল তার।এই আপনার সমস্যা কি বলেন তো? কালকে থেকে পিছনেই পড়ে আছেন! কোনো কিছু না ভেবেই বলে উঠলো ঝুমুর।
ওয়াহিদ তড়িঘড়ি করে একহাতে বাজারের ব্যাগ ধরে রেখে অন্য হাতে ঝুমুরের মুখ চেপে ধরে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল। পেছনে ঝুমুরের বাবা তার মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে বাড়ির দিকেই আসছে।এসে মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে নিশ্চয়ই রাগ করবেন আফতাব শিকদার। তাই ঝুমুরকে চুপ করাতে মুখ চেপে ধরলো ওয়াহিদ। এগিয়ে এসে ঝুমুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে হালকা স্বরে বলে উঠলো,”আমার সমস্যা তো তুমি, সমাধান ও তুমি! তাইতো পিছনে পড়ে আছি।আর এই সমস্যা কে নিজের না করা অব্দি হাল ছাড়ছি না।
এই একদম ফালতু কথা বলবেন না! পাড়ার ঝন্টুদের মতো কথাবার্তা যত্তসব! আচ্ছা আপনি না ডাক্তার? তো রোগীদের অসুখ কি এমন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ভালো করেন?
নাহ! তা করবো কেন? তবে তুমি চাইলে তোমার অসুখ ভালো করতে পারি! এরচেয়ে হাই ডোজের ঔষুধও আছে আমার কাছে। চলো তোমার উপর প্রয়োগ করে দেখি! দুষ্টু হেসে বলে উঠলো ওয়াহিদ। হঠাৎ পেছন থেকে আফতার সাহেবের কন্ঠ শুনে ঝুমুরের কাছ থেকে সরে আসে ওয়াহিদ।
আফতাব সাহেব ঘরে ঢুকেই ঝুমুরকে বলে উঠলেন, আম্মু যাও তো ওয়াহিদ আর তোমার আন্টির জন্য একটু সরবত বানিয়ে আনো। আর বাজারের ব্যাগটা রান্নাঘরে রেখে আসো, নামাজ থেকে আসার পথে একটু বাজারে গিয়েছিলাম। আসার সময় ওদের সাথে দেখা আর ওয়াহিদ জোর করে ব্যাগটা আমার হাত থেকে নিয়ে নিল। আরে ওয়াহিদ বাবা তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসো।
জি আঙ্কেল বসছি। আঙ্কেল আমরা বেশিক্ষণ বসবো না, আমার আবার একটু হসপিটালে যেতে হবে সন্ধ্যায়। ঝুমুরকে আসতে বলুন,আমরা অপেক্ষা করছি।
না না আজ কোন কথা শুনছি না। গতদিন কিচ্ছু মুখে নাও নি। আজ না খেলে তোমার আন্টি কিন্তু খুব রাগ করবে! তুমি বসো আমি তোমার আন্টিকে বলছি খাবার রেডি করতে, বেশি সময় লাগবে না।
খাওয়ার কথা শুনে ওয়াহিদের আম্মু দ্বিমত পোষণ করলেন। কারণ তিনি মাত্রই ঘর থেকে খেয়ে বের হয়েছেন। ওয়াহিদ সরাসরি মসজিদ থেকে এখানে আসায় দুপুরে এখনো তার কিছু খাওয়া হয়নি তাই সে খেয়ে নিল।
ঝুমুর নিচ থেকে এসেই জামা কাপড় বদলে নিল। তার মনে হলো সে মায়ের কথা শুনে অনেক বড় ভুল করেছে। যেখানে সে বিয়েটাই করতে চাচ্ছে না সেখানে এমন পুতুল সেজে বসে থাকার কোন প্রশ্নই আসে না! আর ওই লোকের সাথে বাহিরে যাওয়া তো অসম্ভব! কখনোই যাবে না সে।
কিরে জামা বদলে নিলি কেন? অন্য আরেকটা দিব? আলমারির দিকে যেতে যেতে বলে উঠে ঝুমুরের মা। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যা ওনারা নিচে অপেক্ষা করছে।
আম্মু আমি কোথাও যাবো না। ওনাদের বলে দাও।
কি! কেন যাবি না? দেখ এখন কোনো ঝামেলা করিস না।তোর বাবা রেগে যাবেন।
আম্মু….
চুপ।আর কোনো কথা না,যা বলার তোর আব্বুকে বল যা!
আচ্ছা রেডি হয়ে আসছি। তুমি যাও। অসহায় মুখ করে বলল ঝুমুর।
হাসি লুকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ঝুমুরের আম্মু। এই মেয়েটা বাবার নাম শুনলেই অজ্ঞান হয়ে যায়! অথচ কোনদিন মারা তো দূরের কথা জোরে একটা ধমক দিয়েছে কিনা তাও মনে পড়ে না।
হালকা কাজের জার্জেট একটা মেরুন গাউন পরে মাথায় একটা গোল্ডেন হিজাব পড়ে নিল।ঠোঁটে শুধুমাত্র হালকা একটু লিপটিন্ট দিয়ে নিল। তাছাড়া আর কোন ধরনের সাজগোজ করলো না। সাজগোজ ছাড়াও তাকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। একটা সাইড ব্যাগ আর মোবাইল নিয়ে নিচে নেমে গেল।
ওইসময় ওয়াহিদের সাথে কথা বলার পর উপরে চলে যাওয়ায় ওয়াহিদের মা সায়লা বেগমের সাথে দেখা হয়নি ঝুমুরের।
সায়লা বেগমকে দেখা মাত্রই ঝুমুর,”আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আন্টি?”
এইতো আম্মু আলহামদুলিল্লাহ। শরীরটা তো ভালোই ছিল কিন্তু আমার বউমাকে দেখে এখন মনটাও ভালো হয়ে গেল। মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর লাগছে আমার মেয়েটাকে।তুমি কেমন আছো আম্মু?
জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
আচ্ছা আম্মু চলো যাই,নাহলে শপিং এর জন্য সময় বেশি পাবে না। আমার ফিরতে হবে সন্ধ্যার আগে।
হ্যাঁ যাচ্ছি বলে আগে হেঁটে গাড়িতে গিয়ে বসলেন সায়লা বেগম।
আব্বু আম্মুর থেকে বিদায় নিয়ে ঝুমুর আর ওয়াহিদ গাড়ির কাছে যাচ্ছে, হঠাৎ ঝুমুরের হাত আঁকড়ে ধরে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিয়ে গিয়ে হালকা কন্ঠে বলে উঠে, “ইউ আর লুকিং সো প্রিটি মাই সুইটহার্ট! আই কান্ট ওয়েট টু হ্যাভ ইউ।”
চলবে।