প্রেমময়ী সন্ধ্যা পর্ব-০৪

0
7

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_৪
#লেখিকা_তাসফিয়াহ_আনজুম

পুরো রাস্তাজুড়ে গাড়িতে ছিল পিনপতন নীরবতা। কেউ কোন কথা বলেনি। বলবেই বা কি? অচেনা অজানা মানুষের সাথে কি আর কথা বলবে!কেয়া’র বাসা সামনে হওয়ায় তাকে আগে নিয়ে যেতে হলো। যাওয়ার আগে সুশীল ব্যক্তিটিকে ধন্যবাদ দিতেও ভুললো না। অগত্যা ঝুমুর একাই বসে রইল গাড়িতে।
“কোথায় থামবো?” সম্মুখে দৃষ্টি রেখেই ঝুমুরকে জিজ্ঞেস করল ওয়াহিদ।
কি! থামবেন মানে? আমি কি আপনার সাথে ঘুরতে যাচ্ছি নাকি!
মানে,”বাসায় যাবেন না?” এড্রেস চেয়েছি।
ওহ! এটা বললেই পারতেন আমি কোথায় নামব।
“খালি কলসি বাজে বেশি।” বিরবির করে বলে উঠলো ওয়াহিদ।
কিছু বললেন?
কই না তো।
ওহ আচ্ছা। এইতো সামনেই থামাবেন। এখানেই আমার বাসা।
দক্ষ হাতে গাড়িটা ব্রেক করলো ওয়াহিদ।
ঝুমুর নিজেই গাড়ি থেকে নেমে গেল। গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে বসে থাকা মানুষটার দিকে একপলক তাকালো। কিন্তু গাড়ির অভ্যন্তরীণ আলো বন্ধ থাকায় শুধুমাত্র একটি অস্পষ্ট কায়া ব্যাতীত আর কিছু নজরে এলো না। তার মধ্যে আর দ্বিতীয়বার ঘুরে দেখার আকাঙ্ক্ষাও দেখা দিল না। পিছন ফিরে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল সে। কি মনে করে আবার পিছন ঘুরে তাকালো তাকিয়েই দুজন একসঙ্গে বলে উঠলো,”ধন্যবাদ।”
ঝুমুর বলে উঠলো,এত কষ্ট করে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমাদের জন্য আপনার অনেকটা সময় নষ্ট হলো। কিন্তু আমাকে ধন্যবাদ কেন?
“আমার জীবনে আসার জন্য!” ধীর কন্ঠে বলে উঠে ওয়াহিদ।
কিহ!!
বললাম, আমাকে বিশ্বাস করার জন্য ধন্যবাদ।
ওহ!
কেন আপনি কি অন্য কিছু শুনেছিলেন নাকি?
নাহ, ভুল হয়তো।
ওহ।
আচ্ছা, ভালো থাকবেন। আবার দেখা হবে। দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল ঝুমুর।
দেখা তে হতেই হবে। আমার হৃদয় আপনি ছিনিয়ে নিয়েছেন! সেটা ফেরত নিতে হবে না? ঝুমুরের যাওয়ার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে কথাগুলো বলতে থাকে ওয়াহিদ। গাড়িটা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল আরো মিনিট পাঁচেক। তারপর ছুটলো নিজ গন্তব্য।

******

বর্তমান,

চৈত্রের দুপুর। সূর্য যেন অবিচল মাথার উপর। তার তাপদাহে টগবগ করে ফুটছে চারি ধার। সারাদিনের ব্যস্ততার শেষে ফিরছে যে যার আপন প্রকোষ্ঠে।দুপুর ২ টা। বেশ বিলাসবহুল একটা রেস্টুরেন্টের নিচতলায় বসে আছে ওয়াহিদ। তবে সে একা নয়। সঙ্গে আছে তার বন্ধুবান্ধব।যেই ওরা শুনেছে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে তখনই সবাই মিলে ধরে বেঁধে তাকে নিয়ে আসলো ‘ট্রিট’ নামক কুরবানী দিতে। যদিও ওয়াহিদ এগুলোকে তেমন একটা সে প্রশ্রয় দেয় না। তবুও বন্ধুদের সঙ্গ দিতে আসতেই হলো।

“এই ওটা ঝুমুর না?”
হঠাৎ করেই বাইরের দিকে ইশারা করে বলে উঠে রায়হান। রেস্টুরেন্টের সামনের জায়গাটা গ্লাস সিস্টেম হওয়ায় ভেতরে থেকেই বাইরের সবকিছু দেখা যায়।‌‌ ওয়াহিদের বন্ধুমহলে ঝুমুরের কথা প্রায় কম বেশি সবাই জানে। তাই আর ওকে চিনতে অসুবিধা হয়নি রায়হানের।

রায়হানের কথা শুনে, মাথা তুলে চেয়ে দেখলো ওয়াহিদ। আসলেই ওটা ঝুমুর। রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন হেঁসে হেঁসে কথা বলছে।

এই ওকে এখানে ডেকে নেই? এখনো পর্যন্ত একবারও কথা হলো না। একসাথে খাওয়া-দাওয়া গল্প-গুজব হয়ে যাবে।

নাহ। দরকার নেই! তোরা কি খাবি অর্ডার দে। আমাকে আবার একটু হসপিটালে যেতে হবে।

ভাই তুই আসলেই একটা! এতো রসকষহীন মানুষ কেমনে হয় ভাই! আচ্ছা তোর প্রেম হইলো কেমনে? চিন্তিত ভঙ্গিতে ওয়াহিদের দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ল শিহাব।

ওয়াহিদ আর কোন কথা বললো না। উষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো শিহাবের দিকে। কিন্তু কে দেখে এসব!আবার শুরু হলো হাসি ঠাট্টা।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার গন্তব্যে রাওনা দিল।

*******

বেশ অনেকক্ষণ যাবত বাবার রুমে বসে আছে ঝুমুর। মেয়ে যে তার কাছে কিছু চাইতে এসেছে তা মেয়ের মুখখানা দেখে বুঝতে পেরেছেন আফতার সাহেব।
“কি হয়েছে আম্মু? তোমার কি কিছু চাই বাবার কাছ থেকে?” মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আফতার সাহেব।
না বাবা।‌আমি একটা কথা বলতে চাই।
কি কথা?
বাবা আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।
কিহ! কেন? তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?
না বাবা। আমার কোনো পছন্দ নেই। আমি শুধু এখন বিয়ে করতে চাই না। আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারবো না, বলতে বলতেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে সহসা কেঁদে উঠলো ঝুমুর। মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন আফতার সাহেব। তার ও তো মন খারাপ হয়। সারাদিন রাত ঘর মাতিয়ে রাখা মেয়েটাকে ছাড়া তারাই বা থাকবে কেমন করে। কিন্তু এটাই তো নিয়ম। মেয়েদের তো অন্যের ঘরে যেতেই হবে।
এটা কোনো কথা হলো বাবা! তুমি তো আমাদের থেকে খুব বেশি দূরে যাচ্ছ না। এইতো কাছেই ওয়াহিদ’দের বাসা‌। যখন মন চায় চলে আসবে।
ঝুমুর বাবার কথার উপর আর কিছু বললো না। চুপচাপ বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইলো। আফতার সাহেবও পরম মমতায় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

“যার বিয়ে তার খবর নাই,পাড়া-পড়শীর ঘুম নাই।” প্রবাদ বাক্যটা যেন ঝুমুরের সাথে একদম মিলে যায়। তার বিয়ে নিয়ে পুরো ঘর ভর্তি মেহমান আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছে আর তার ওইসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আজ ঝুমুরের গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান। সকাল থেকেই বেশ তোড়জোড় চলছে এসবের। বিকালের দিকে ওয়াহিদের বাড়ি থেকে ঝুমুরের হলুদ আর বিয়ের পোশাকসহ যাবতীয় জিনিসপত্র পাঠানো হয়েছে।এটাই নাকি নিয়ম।

সন্ধ্যার দিকে কাজিন’রা মিলে ঝুমুরকে একটা হলুদ জামদানি পড়িয়ে দিল ।সাথে পড়ানো হয়েছে কাঁচা ফুলের। পুরানো স্টাইলে শাড়ি পড়ানো হয়েছে তাই লম্বা চুলগুলো খোলাই রাখলো। হালকা সাজেই ঝুমুরকে যেন বসন্তবৌরি দেখাচ্ছিল। হলুদ অনুষ্ঠানের জন্য পাশাপাশি দুটি স্টেজ করা হয়েছে। একটাতে ঝুমুরকে নিয়ে বসানো হলো। অপরটাতে সাদা পাঞ্জাবি হলুদ কোট পড়ে আগে থেকেই বসে ছিল ওয়াহিদ। পরিবারের ইচ্ছায় তাদের হলুদ অনুষ্ঠান একসাথেই করা হচ্ছে। ঝুমুর এই বিষয়টা সম্পর্কে জানতো না। বিয়ে হওয়ার আগেই পিছু ছাড়ছে না, পরে তো আমি শেষ! ওয়াহিদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বিরবির করে বলে উঠে ঝুমুর। ওয়াহিদ ও ঝুমুরের দিকে তাকাতেই নজর মিলে গেল দু’জনের।
এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখার কি আছে, তোমারই তো বর। যেভাবে ইচ্ছা যত ইচ্ছা দেখতে পার।চাইলে রুমে গিয়েও দেখতে পারো! দেখবে? চোখ টিপে বলল ওয়াহিদ।
“অসভ্য” অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে উঠল ঝুমুর।
যাহ! তুমি দেখলে কিছু না! আর আমি বললেই দোষ?

“ভাইয়া! চল আমরা ছবি তুলি।” হঠাৎ কোথা থেকে দৌড়ে এসে বলতে লাগলো জাবির। চমকে উঠে ঝুমুরের কাছ থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বসলো ওয়াহিদ।

অবশ্যই! আমার একমাত্র সালা বাবুর সাথে ছবি তুলবোনা তো কার সাথে তুলবো? বলেই,সে তার বন্ধু শিহাবকে ডেকে নিল ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। শিহাব খুব ভালো ফটোগ্রাফি করে।এটা ওর এক ধরনের প্যাশন বলা চলে। প্রচন্ড আগ্রহে ছবি তোলার জন্য জাবির ঝুমুর আর ওয়াহিদের মাঝখানে গিয়ে বসল। ছবি তোলার বাহানায় ওয়াহিদ ঝুমুরের কাছ ঘেঁষে বসলো আরোএকটু। কয়েকটা ছবি তোলার পর জাবির উঠে চলে গেল। আগেরমতোই
বসে রইলো তারা দুজন।
কিরে ভাই একটু কাছাকাছি বস! এখন কি মাঝখানে বসানোর জন্য আরেকটা শালা ভাড়া কইরা নিয়া আসমু নাকি!
শিহাবের কথায় হেঁসে উঠল আশেপাশের সবাই। কিন্তু ঝুমুরের কোন পরিবর্তন দেখা গেল না।

অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বারোটার মতো বেজে গেল। ওয়াহিদরা বাড়ি ফিরে গেল। নিজের ঘরে গিয়ে শাড়ি পাল্টে বিছানায় শুয়ে পড়লো ঝুমুর। কয়েক ঘণ্টা একটানা বসে থাকার কারণে পিঠ,কোমর ব্যথায় লেগে এসেছে। বিছানায় পিঠ লাগতেই হারিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।

চলবে…?