প্রেমময়ী সন্ধ্যা পর্ব-১৩+১৪

0
5

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_১৩
লেখিকা: তাসফিয়াহ

এভাবেই কেটে গেল প্রায় মাস তিনেক। প্রকৃতিতে চলছে শীতের শাসন। সূর্যের প্রখরতা কম। আজ ঝুমুরদের টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলো। এ নিয়ে ঝুমুরের মনে খুশির ফোয়ারা বইছে। এতদিন পরীক্ষার কারণে পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু ভাবার বিন্দুমাত্র অবকাশ ছিল না। সামিয়া তো ঝুমুরের পরীক্ষা শেষ হলে সাজেক যাওয়ার প্ল্যান করে রেখেছে। সাজেক ঝুমুরের অনেক পছন্দের একটা জায়গা। এইসব ভেবে ভেবে খুশিতে তার মনে লাড্ডু ফুটতে লাগল।
কলেজের বাউন্ডারি ঘেঁষে হাঁটছে ঝুমুর,নিরব আর কেয়া। কেয়া আর ঝুমুরের সম্পর্ক এখনো পুরোপুরি আগের মতো না হলেও দুজনের মধ্যে প্রায় সব ঠিকঠাক।
“ধুর আজকে হল গার্ডে দুইটাই স্যার পড়লো। দুই স্যার একলগে পড়লে প্রতিযোগিতা কইরা গার্ড দেয়, মাঝখান থেইকা আমি বাশ খাই।”কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বললো নিরব।
ঝুমুর হেঁসে দিল নিরবের কথায়। বলে উঠে,
“নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা। তুই যে পারিস না ওইটা বল!”

নিরব গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে,
“ধুর এতো পড়ালেখা কইরা কি হবে? শোন মানুষ পড়ালেখা করে ভালো একটা বিয়ে করার জন্য, আমার পিছনে তো এমনিই এত মাইয়ার লাইন লাইগা আছে। কোনটা রাইখা কোনটা নিবো বুঝি না। এইজন্য ভাবলাম পড়ালেখাটা কম করি তাইলে যদি বাছাবাছি করতে একটু ঝামেলা কম হয়।”

ঝুমুর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
কেয়া ঝুমুরের পাশে হাঁটছে ঠিকই কিন্তু তার মন অন্য জায়গায়।

ঝুমুর কেয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কিরে এদিক ওদিক এত কি দেখছিস?”
নিরবও কেয়াকে লক্ষ্য করছিল বেশ কিছুক্ষণ ধরে। নিরব বলে,
“যার জন্য এতক্ষণ ধরে এদিক সেদিক দেখছিস, সে মনে হয় এতক্ষণে যশোর।”

“কি আদিল আজকেই যশোর চলে গেছে? কই কিছু তো বললও না।” ঝুমুর জিজ্ঞেস করে।

নিরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“কবে আর বইলা গেছে? আদিল টার যে কি হইলো কিচ্ছু বুঝিনা।”
কেয়ার ভাবমূর্তি পরিবর্তন হয় না, সে ভেবেছিল এমন কিছুই হবে। কোনদিন আর তাকে বলে গেছে যে আজ বলবে!

তিনমাস আগের কথা,
আদিল অসুস্থ শুনে তার জন্য নিজের হাতে রান্না করা খাবার পাঠিয়ে দিল মা। কেয়াও আদিলের সঙ্গে দেখা করার বাহানা খুঁজছিল। কিন্তু খাবারের বক্স হাতে নিয়ে আদিলদের বাসার সামনে এসে দেখে বাসায় তালা মারা।পাশের বাসার এক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো আজ সকালেই নাকি তারা এ বাসা ছেড়ে চলে গেছে।কেয়া কথাটা বিশ্বাস করতে না চাইলে ওই মহিলা তাদের কাছে আদিলদের বিক্রি করে দিয়ে যাওয়া কিছু পুরনো আসবাবপত্র দেখালো। কেয়া দৌড়ে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। পরে নিরবের থেকে জানতে পারল আদিল তার বাবা বাড়িতে উঠেছে।
সেই থেকে আদিলের প্রতি কেয়ার রাগ। অন্য কেউ না ভাবুক অন্তত বন্ধু ভেবে বলে তো যেতে পারতো।
ঝুমুর আর নিরব কেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাঁরা আদিলের প্রতি কেয়ার অব্যক্ত অনুভূতি বুঝতে পেরেছে বহু আগেই। কিন্তু কখনো কিছু বলার সাহস পায় না। কারণটা আদিলের ছন্নছাড়া স্বভাব।
কথা বলতে বলতে আর একটু এগিয়ে দেখলো গাড়ি নিয়ে ওয়াহিদ দাঁড়িয়ে আছে। ঝুমুর ওদেরকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

______

নিরব কেয়াকে বাসার সামনে ছেড়ে দিয়ে নিজে একটা রিকশা ঠিক করে নিল। যে রিকশাতে উঠে বসবে তখনই রিকশাওয়ালা বৃদ্ধ লোকটি বলে উঠলো,

“বাজান একটু বও আমি এক প্যাকেট বিড়ি নিয়া আই।”

নিরব লোকটিকে থামিয়ে দিয়ে বলল আচ্ছা আপনি থাকেন আমি নিয়ে আসি।

“এক প্যাকেট সিগারেট দেন তো।”

যখনই দোকানদারের কাছ থেকে প্যাকেটটা হাতে নিবে তখন পাশ থেকে ভেসে আসলো একটা মেয়েলী কন্ঠস্বর।

“বাহ সিগারেট ও খাও দেখছি! তো আর কি কি গুণ আছে তোমার?”

পেছনে ফিরে তাকিয়ে মেয়েটার মুখটা দেখে প্রথমে অচেনা মনে হলো। পরে মনে পড়লো আরে এই মেয়েটাই তো ঐদিন রাস্তায় কুকুর গুলোকে খাওয়াচ্ছিল।

“আসলে এটা আমার না ওই রিকশাওয়ালা চাচার।”
রিকশায় বসে থাকা লোকটাকে দেখিয়ে বলল।

“নাইস এক্সকিউজ!”

নিরব বলে,”এক্সকিউজ দেয়ার কি আছে? আর নিজে খেলেও খেতে পারি তাতে আপনার কি!”

আফরা বলে ওঠে,”রাস্তাঘাটে ছোটরা কি করে বেড়ায় তা দেখার দায়িত্ব বড়দের তাই না!”

নিরব ভ্রু কুঁচকে তাকায় আফরার দিকে। বলে,
“ওহ আচ্ছা। তা এমন খেয়াল কি সবারই রাখেন নাকি?”

আফরা হেঁসে উঠল।বলে,”না শুধু যারা বখাটেপনা করে তাদের রাখি।আর একদম সোজা করে দেই।”

লিস্টের সঙ্গে দোকানদারের দেয়া জিনিসপত্রগুলো মিলিয়ে নিয়ে টাকা দিয়ে চলে গেল আফরা। কিন্তু ঘটালো আরেক বিপত্তি। পার্সে হাতিয়ে দেখলো সব টাকা খরচ করে ফেলেছে,গাড়ি ভাড়ার টাকাও বাকি নেই। নিরব আফরার দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টা লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় তার দিকে।

“আপনি যেহেতু আমার খেয়াল রাখছিলেন,আমারও তো উচিত আপনার জন্য কিছু করা। আপনি চাইলে আমার রিক্সায় আসতে পারেন। মনে হয় না এই দুপুরে আর রিকশা পাবেন! আমি হোস্টেলের সামনে দিয়েই যাব।”

আপনার প্রথমে যেতে চাইলো না,কিন্তু পরে ভাবলো এখন তো কোন গাড়ি ও পাবে না। তাই সে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু নিরবকে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে যাবো কিন্তু একটা শর্তে, রিক্সা ভাড়া দুজনে অর্ধেক করে দিব। তবে টাকাটা আমি এখন দিতে পারবো না।পরে তোমাকে দিয়ে দিব।”

নিরব আর কিছু বলে না। জানে এই মেয়ের সাথে সে কথায় পেরে উঠবে না।

_____

“কি আজকে পরীক্ষা বেশি ভালো হয়েছে নাকি?এতো খুশি খুশি লাগছে কেন?”ঝুমুরের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে ওয়াহিদ।
ঝুমুর বলে,
“কোথায় খুশি? ওটা তো এভাবেই।”

ওয়াহিদ গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,

“হ্যাঁ এভাবে হলেই ভালো কয়েকমাস পর ফাইনাল পরীক্ষা। এখন এতো খুশি হয়ে লাভ নেই। এখন শুধুই পড়াশোনা”
ঝুমুররের মুখে অন্ধকার নেমে এলো। জানালা দিয়ে বাহিরে দেখতে লাগলো।মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“সাজেক হয়তো আর যাওয়া হবে না।”

ওয়াহিদ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“এখন আবার কি হয়ছে? তোমার এতো ঘন ঘন মুড সুইং হচ্ছে কেন?”

“সবার যে কারণে হয় আমারো তাই!”

“আর ইউ সিউর?আমার জানামতে প্রেগন্যান্সির টাইমে মেয়েদের এমন মুড সুইং হয়,বাট ইউ আর নট। রাইট?”এক চোখ টিপে বলল ওয়াহিদ।

ঝুমুর রেগেমেগে ওয়াহিদকে কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলো না।

______

ঝুমুররা বাড়িতে এসে দেখলো সামিয়া আর ওয়ালিদ কোথাও যাচ্ছে। পরে জানা গেল চেকআপের জন্য হসপিটালে যাচ্ছে। সামিয়ার প্রেগনেন্সির চারমাস চলছে। আগে সবাই ভেবেছিল ঝুমুরের পরীক্ষা শেষ হলে বাইরে থেকে ঘুরে আসলে হয়তো ভালো লাগবে, কিন্তু এখন সামিয়ার শারীরিক কন্ডিশন বেশি ভালো না। ঝুমুর সামিয়ার সঙ্গে কথা বলে ঘরে গিয়ে দেখলো ওয়াহিদ রুমে নেই। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ টিশার্ট ট্রাউজার পরে বেরিয়ে এলো ওয়াহিদ। ঝুমুর কাপড় হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিল তখন ওয়াহিদ আলমারি থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করে খাটের রেখে বলল,

“আজকে সন্ধ্যায় রেডি থেকো। আমার এক ফ্রেন্ডের এনগেজমেন্ট ইভেন্ট আছে।আমি হসপিটাল থেকে এসে নিয়ে যাবো তোমাকে।”

________

আধঘন্টা ধরে শাড়ি পরে রেডি হয়ে চুল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে ঝুমুর। কোনোমতেই আজ চুলটা সেট করতে পারছে না। বার বাঁধছে আবার খুলছে। তার পরনে একটা শিফন কাপরের মেরুন শাড়ি। হাতে গলায় সামান্য কিছু জুয়েলারি। চুল নিয়ে আবার কিছু করতে গেলেই ওয়াহিদ রুমে আসলো। সে মাএই হসপিটাল থেকে ফিরেছে। ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে ঝুমুরের উদ্দেশ্যে বলল,
“আলমারির বাম পাশের তাকে একটা ব্যাগ আছে সেটা বের করো।”

ঝুমুর ব্যাগটা বের করে কৌতুহলবশত দেখলো,
ভেতরে কালো রঙের একটা শার্ট। ব্যাগের ভেতরের সবকিছু গুছিয়ে খাটের উপর রাখল।

বিরক্ত হয়ে চুল বান করে ফেললো। ওয়াহিদ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তা দেখে বলল,
“চুল খুলে রাখো। আর বাইরে অনেক একটা সোয়েটার নিয়ে নাও পরে খুলে ফেলো।”

ঝুমুর রেডি হয়ে খাটে বসে রইল। বসে বসে ওয়াহিদের রেডি হওয়া দেখছে ।আজকে সব ব্ল্যাক পড়েছে ওয়াহিদ। ওয়াহিদ বডিতে পারফিউম স্প্রে করতে করতে আয়নায় ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আই নো আই এম হ্যান্ডসাম। বাট এভাবে লুকিয়ে দেখার কি আছে?তুমি বললেই তো আমি তোমার সামনে বসে থাকি আর তখন যত খুশি দেখতে পারবে।”
ঝুমুর লজ্জা পেয়ে কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওয়াহিদ হাসতে হাসতে বলে উঠে,
“ভাঙ্গবে তবুও মচকাবে না।”

পার্টিতে গিয়ে ওইদিনের সেই বিরক্তিকর মেয়েটা মানে কনাকে দেখতে পেলো। মেয়েটা খুব সুন্দর। পড়নে একটা ব্ল্যাক গাউন। কনা তাদের দু’জনকে দেখে এগিয়ে এলো। ওয়াহিদকে দেখে বললো,
“ইউ লুকস সো হ্যান্ডসাম ওয়াহিদ! তারপর ঝুমুরের উদ্দেশ্যে বলো,এন্ড অলসো ইউ লুকস প্রিটি।”

ঝুমুর সৌজন্যে হাসলো। শুরু থেকেই কেন জানি তার এই মেয়েটাকে ভালো লাগে না। ওয়াহিদ একপাশে দাঁড়িয়ে এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিল হঠাৎ একটা ওয়েটার তার হাতে থাকা জুসের গ্লাস ওয়াহিদের শার্টে ফেলে দিলো।ছেলেটা কয়েকবার সরি বলে চলে গেলো। ঝুমুর দুর থেকে দাঁড়িয়ে সবটা দেখলো। কিন্তু কেন জানিনা সব তার ইচ্ছাকৃত মনে হলো।মনে মনে ভাবলো,

” যদি ইচ্ছাকৃতভাবেই হয় তবে ছেলেটা কার কথায় এসব করলো?”

চলবে…?

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_১৪
লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম

পার্টি ফ্লোরের একপাশে হাতে একটা জুসের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমুর। প্রায় দশমিনিট আগে ওয়াহিদ ড্রেস ক্লিন করতে ওয়াশ রুমে ঢুকেছিল। কিন্তু বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও ওয়াহিদকে আসতে না দেখে ঝুমুর সেদিকে এগিয়ে গেল। ইতস্তত বোধ করলো জেন্টস ওয়াশ রুমে ঢুকবে কি না তা ভেবে।পরে ঢুকে দেখলো ভেতরে কেউ নেই। ঝুমুরের মাথা ঘুরে গেল। সে তো এই দরজার কাছ থেকে একবার ও চোখ সরায় নি।তাহলে ওয়াহিদ বের হলো কখন? আর বের হয়েই বা কোথায় গেল? ঝুমুরের নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল। নিজেও বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে এসব!
কাঁপতে থাকা হাতে ওয়াহিদের ফোনে কল দিল। কল ঢুকছে না।
ঝুমুর ইভেন ম্যানেজমেন্টের একজন লোককে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ভাইয়া এখানে কি কোনো এক্সট্রা রুম আছে? আর থাকলে সেগুলো কোনদিকে।”
লোকটা বললো,
“আমাদের এখানে তো তিনটা রুম আছে। একটা বুকড। আর বাকি দুইটার মধ্যে একটাতে কাজ চলছে আরেকটা এখন খালি আছে। আর রুমগুলো সব সেকেন্ড ফ্লোরে।”

ঝুমুর উপরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি খুঁজতে থাকে। তাড়াতাড়ি হেটে সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় ম্যানেজমেন্টের লোকটা দৌড়ে এসে ঝুমুরকে বলতে লাগলো,

“সরি ম্যাম একটা ভুল হয়েছে। যে রুমটা খালি ছিল সেটাও পাঁচ মিনিট আগে বুক হয়ে গেছে।”

কথাটা শুনে ঝুমুরের মাথা ভনভন করতে লাগলো।
আর কিছু না শুনে সেই রুমের দিকে দৌড়ে গেল। রুমের সামনে গিয়ে ওয়াহিদের নাম ধরে ডেকে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। কিন্তু কয়েক মিনিট কেটে গেলেও ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ এলো না। হঠাৎ কিছু একটা পড়ে যাওয়ার একটা বিকট শব্দ হলো। ঝুমুর আবার দরজা ধাক্কাতে লাগলো। ওর কেন জানি না মনে এই রুমেই ওয়াহিদ আছে।

হঠাৎ করেই খুলে গেল রুমের দরজাটা। সেই সাথে ভেতর থেকে একটা মেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এলো, মেয়েটাকে ধরতে গিয়ে তার ধাক্কায় ঝুমুর মাটিতে পড়ে গেল। আর কোনোদিকে তোয়াক্কা না করে ঝুমুর উঠে রুমের ভেতরে চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমের মধ্যে। অন্ধকারে দেয়াল হাতরে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিল। তার আশঙ্কাই সত্যি হলো, ওয়াহিদ এই রুমেই আছে। নিস্তেজ হয়ে বিছানায় পরে আছে ওয়াহিদ তার কালো শার্টের উপরের বোতামগুলো খোলা,কোট টা পরে আছে বিছানার একপাশে, হাতঘড়িটা ফ্লোরে পরে আছে, কাঁচের একটা ফুলদানি ভেঙ্গে পুরো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়েছে আছে। রুমের এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে তার মাথা ঘুরতে লাগলো। দৌড়ে গিয়ে পানি এনে ওয়াহিদের চোখে মুখে ছিটিয়ে দিল।ওয়াহিদ একটু নড়েচড়ে আবার বিছানায় পড়ে রইলো। ঝুমুর ওকে ধরে বিছানা থেকে উঠানোর চেষ্টা করলো কিন্তু বলিষ্ঠ নিস্তেজ শরীরটা তেমন নাড়াতে পারলো না। ঝুমুরের তখন মনে আজ তো তাঁরা ড্রাইভার সাথে নিয়ে এসেছে। ফোন করে ড্রাইভারকে ডেকে নিল। তারপর দুজনে ধরাধরি করে ওয়াহিদকে বাড়িতে নিয়ে এলো।
.
.
.
কেয়া ভাতের প্লেটে হাত নাড়াচাড়া করছে, কিন্তু কিছুই খাচ্ছে না। কেয়ার মা-বাবা মেয়েকে নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে চিন্তিত। মেয়েটা কেমন যেন অন্যমনষ্ক হয়ে থাকে সারাক্ষণ।
কেয়ার বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে মা আজ কি তোর পরীক্ষা খারাপ হয়েছে নাকি? মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন?”
কেয়া বাবার কথা শুনে বলে,
“নাহ কিছু না এমনিই ভালো লাগছে না, পরীক্ষা ভালোই হয়েছে।”
“এমনিই ভালো লাগছে না? আচ্ছা শোন তাহলে তোর বড় খালার বাড়ি থেকে ঘুরে আয় ভালো লাগবে। রিনি‌ও নাকি ছুটিতে বাড়ি এসেছে। রাফি তো ঢাকায় এসেছে যাওয়ার সময় তোকে নিয়ে যাবে।”
কেয়া বললো, ‘আচ্ছা দেখি’।
“আরে এতো ভাবাভাবির সময় নেই। রাফি মনে হয় কাল সকালেই চলে যাবে।তুই রাতে জামাকাপড় গুছিয়ে রাখিস। আমি ফোন দিয়ে বলে দিলে সকালে এসে তোকে নিয়ে যাবে।”

কেয়া প্লেটের কিছু ভাত খেয়ে রুমে চলে গেল। আজকাল কিছুই ভালোলাগে না তার। তবুও যাওয়ার জন্য নাকোচ করলো না কারন তার বড় খালার বাড়ি যশোর। যেখানে আদিল থাকে।যদি আদিলের সাথে দেখা হয়ে যায় সেই আশায় যাচ্ছে। রাতে টুকটাক ব্যাগ গুছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম থেকে উঠেই দেখে রাফি ড্রয়িংরুমে বসে আছে। চা খেতে খেতে তার বাবার সাথে কথা বলছে। রাফি কেয়াকে দেখেই বলে উঠলো,
“কেমন আছো কেয়া?”
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া ভালো। তুমি কেমন আছো?”
কেয়ার বাবা বললেন,
“আচ্ছা তুমি নাস্তা করে রেডি হয়ে যাও।আর একঘন্টা পরেই বাস।”
কেয়া নাস্তা শেষ করে রুমে গিয়ে রেডি হয়ে গেল। একটা পিচ রঙের টপস পড়ে কোমর সমান চুলগুলোকে উঁচু করে ঝুঁটি করে ফেললো। মুখে হালকা পাউডার আর ঠোঁটে লিপস্টিক দিলো। উজ্জ্বল শ্যামলা মেয়েটাকে হালকা সাজেই ভীষণ সুন্দর লাগছে। কেয়া বাবা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাফির সাথে বেরিয়ে পড়ল।
.
.
.
রাত নয়টা। আজকের মতো রাতের ঘুরাঘুরির পর্ব শেষ করে নিজের বরাদ্দকৃত রুমে ফিরলো নিরব। দরজার তালা খুলে রুমে ঢুকে রুমের অসম্ভব সুন্দর অবস্থা দেখে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করলো তার।এই অবস্থা সকালে সে নিজেই করেছিল। হাত চালিয়ে ফ্লোরে পরে থাকা সব কাপড়চোপড় ঠেলে রুমের ছোট্ট একপাটের আলমারিটাতে ঢুকিয়ে দিল।দক্ষ হাতে বিছানা ঝাড়ু দিয়ে সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বিছানায় পিঠ ছোঁয়াতেই পেটের ক্ষুধায় পেটে ইঁদুর ছুটাছুটি করতে শুরু করলো। পরক্ষণেই মনে পড়ল আজ রাতে তো বাইরে থেকে খাবারও কিনে আনে নি। কারন তার রাজার ভান্ডার ফুরিয়েছে।আরেকদিকে এখন চলছে মাসের শেষ সময়। কে বলবে যে মাসের শুরুতে রাজের হালে চলা ছেলেটা মাসের শেষ দিনগুলোতে কত রাত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। টাকা না থাকলেও হাত পেতে বাবার কাছে টাকা চাইছে তার বিশাল অস্বস্তি। যেখানে তিনি মাসের শুরুতেই দশ হাজার করে টাকা পাঠিয়ে দেয়। আর এই মাসে পরীক্ষার কারণে আদিল ও তার সাথে ছিল তাই খরচ বেশি হয়ে গেছে। যদিও আদিল এখানে থাকতে চায়নি সে নিজেই জোর করে রেখেছে। পেটে ক্ষুধা আর শরীরে ক্লান্তি নিয়েই বিছানায় শুয়ে রইল নিরব। এভাবে শুয়ে থাকতে থাকতেই একসময় ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।
.
.
.
ঝুমুর বাড়িতে এসে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ওয়াহিদকে রুমে নিয়ে গেল। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে । ঝুমুর তাদের জাগাতে চাইলো না। ওয়াহিদকে রুমে শুইয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে একগ্লাস লেবুর পানি নিয়ে এলো। শুয়ে থাকা ওয়াহিদের মুখে চামচ দিয়ে কয়েকবার লেবুর রস দিল। ওয়াহিদ চোখ মুখ কুঁচকে মাথা ধরে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। ঝুমুর গ্লাসটা মুখের সামনে নিয়ে আরেকটু লেবুর পানি দিতেই ওয়াহিদ দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গিয়ে বমি করতে লাগলো। প্রায় কিছু সময় পর হাত মুখ ধুয়ে বাইরে এলো। বাইরে এসে ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে বললো,

“সরি আসলে আমি একটু ড্রিংকস করে ফেলেছিলাম। আসলে ফার্স্ট টাইম করেছি তাই এমন লাগছে। মাথাটা এত ভার হয়ে আছে। কিন্তু আমরা বাড়িতে আসলাম কখন?”
ঝুমুর কিছু বললো না। আলমারি থেকে কাপর বের করতে লাগল।
ওয়াহিদ ঝুমুরের কাছে গিয়ে বলল,
“তুমি কিছু বলছো না কেন? ড্রিংকস করেছি বলে আমার সাথে রাগ করেছো? আসলে আমি ইচ্ছে করে করতে চাইনি, কনার জোরাজুরিতে একটু খেয়েছিলাম কিন্তু এতটা নেশা হয়ে গেলে কিভাবে বুঝতে পারছি না।
ঝুমুর অবাক হয়ে তাকাল ওয়াহিদের দিকে। বললো,
” আপনার ফ্রেন্ড কনা? তারপর কি হয়েছিল মনে আছে?”
ওয়াহিদ মাথায় হাত দিয়ে গিয়ে বিছানায় বসলো। বলতে লাগলো,
“না আর কিছু মনে পড়ছে না। বাড়িতে কখন এলাম সেটাও মনে পড়ছে না।”
ঝুমুর আর কিছু বললো না। তার ভাবনাই সঠিক হয়েছে। কিন্তু এখন এসব ওয়াহিদ কে জানানো যাবে না।ওই মেয়েটাকে তার শুরু থেকেই ভালো লাগতো না, মেয়েটা কেন এমন করছে সেটা তাকেই খুঁজে বের করতে হবে।

ঝুমুরকে অন্যমনস্ক দেখে ওয়াহিদ আবার বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে গেল ওর দিকে। ঝুমুর ওয়াহিদ কে এত কাছে দেখে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই একজোড়া শুষ্ক ঔষ্ঠ তার কোমল ঔষ্ঠজোড়া দখল করে ফেললো। ওয়াহিদের ঔষ্ঠজোড়ার তীব্র দংশনে অশান্ত হয়ে উঠলো তার হৃদয়। খামচে ধরলো ওয়াহিদের পিঠ। ঝুমুরের অবচেতন মন সাড়া দিতে লাগলো ওয়াহিদের নিগূঢ় স্পর্শে। আচমকা ঝুমুর নিজেকে হাওয়ায় অনুভব করলো। ওয়াহিদ তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। আবারো মেতে উঠলো ঔষ্ঠসুধা পানে। ঝুমুরের কায়া হতে খসে পড়লো শাড়ির শেষ প্রান্ত। রাত্রির মধ্যভাগে সে নিজেও গা ভিজিয়েছে ওয়াহিদের প্রেমের অবাধ বৃষ্টিতে। যে বৃষ্টিতে হতে চলেছে তাদের জীবনের এক নব্য সূচনা।

চলবে…?