প্রেমময়ী সন্ধ্যা পর্ব-১৫+১৬

0
6

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_১৫
লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম

রৌদ্রজ্জ্বল শীতের সকাল। সকালের মিষ্টি রোদ জানালা ভেদ করে ছুঁয়ে দিল ঝুমুরের চোখ মুখ। আরামে আরেকটু নড়েচড়ে ওয়াহিদের গা ঘেঁষে শুয়ে রইল। আধো আধো খোলা চোখে দেখলো ওয়াহিদের উন্মুক্ত সুঠাম দেহের প্রতিটা ভাঁজ। পরক্ষনে রাতের কথা মনে পড়তেই রক্তিম হলো কপোলদ্বয়। মাথা নুইয়ে নিজের দিকে নজর দিতেই দেখলো তার গায়ে ওয়াহিদের সেই কালো শার্ট জড়ানো। ঝুমুর অন্যপাশ ফিরে গলা অবদি ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে শুয়ে রইল। হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাত তার গায়ের শার্ট গলিয়ে উদর ছুঁলো। সেই সঙ্গে নিজের কাছে টেনে নিল ঝুমুরের কোমল শরীরটা। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠে ওয়াহিদ,
“গুড মর্নিং বৌ।”
“গুড মর্নিং”। হালকা হেসে বলে ঝুমুর।
ঝুমুরকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় ওয়াহিদ। ঝুমুরের দিকে ঝুঁকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“ইউ লুক সো বিউটিফুল ইন মাই শার্ট। এখন থেকে আমার সবগুলো শার্ট তোমার জন্য উন্মুক্ত, মন চাইলেই মাঝে মাঝে পড়ে ফেলবে।”
ঝুমুর কিছু না বলে ওয়াহিদকে সড়িয়ে দিয়ে উঠে চলে গেল।
ঝুমুর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে ওয়াহিদ হসপিটালে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে।
ঝুমুর খাটের উপর থেকে ওয়াহিদের মোবাইল আর ওয়ালেট নিয়ে এগিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
“নাস্তা করে যাবেন না?”
ওয়াহিদ হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে আয়নায় ঝুমুরের দিকে তাকায়। ঝুমুরের পড়নে একটা লাল খয়েরী পাড়ের শাড়ি। ওয়াহিদ ঝুমুরের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
” নাস্তা পরে অফিসে করে নিবো।আর আজ তোমার কলেজ যাওয়ার দরকার নেই বাসায় রেস্ট নাও। মন চাইলে বই নিয়ে বসো।
.
.
.
সকাল সকাল পেটের ডাকে বিছানায় বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারলো না নিরব। রাতে না খাওয়ার ফলে ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। বিছানা থেকে উঠে কোনো রকম হাত মুখ ধুয়ে চলে গেল মেসের সামনের গলির খাবারের দোকানে। আজ বাকিতে নাস্তা করতে হবে, হাতে আর কানাকড়িও যে অবশিষ্ট নেই।হোটেলের সামনে যেতেই তোরো-চৌদ্দ বছর বয়সী একটা ছেলে এগিয়ে এলো। নিরবকে দেখেই হাসিমুখে বলতে লাগলো,
“কি অবস্থা ভাই? তিন-চার দিন ধইরা দোকানে আসলেন না ক্যান?
“আমার অবস্থা ভালোই রে রিপন, কিন্তু পকেটের অবস্থা খারাপ। যা গরম গরম পরোটা আর ডিম ভাজি নিয়া আয়।আর আজকে কিন্তু বাকিতে খামু আরচোখে ক্যাশ কাউন্টারে বসা হুমায়ুনের দিকে তাকিয়ে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বললো।
হুমায়ুন সাহেব নিরবের কথা শুনলেন। তিনিও চিল্লিয়ে ওই রিপন নামের ছেলেটাকে বলতে লাগলেন,
“এই রিপন এই হোটেলে বাকিতে খাওন যায় না, সবার কানে ভালোমতো ঢুকায় দিস।
“আচ্ছা ওর বিল আমি দিব। আমার জন্য ও পরোটা ডিম ভাজি দিও।”
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে তাকালো নিরব। এদিকে আফরা রিপনকে কথাগুলো বলে হোটেলের ভিতরে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। নিরব আফরাকে সকাল সকাল এখানে দেখে বেশ আশ্চর্য হলো। নিরব ভেতরে ঢুকে আফরার বরাবর সামনের চেয়ারটাতে বসলো।
“আপনি এখানে?”
“কেন আসা যাবে না নাকি? তুমি যে কারনে এসেছ আমিও ঠিক সে কারনেই এসেছি।”
“বাকিতে খেতে?”মুখ ফসকে বলে ফেলল নিরব।
আফরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল নিরবের দিকে।
নিরব,”না আসলে আমি বাকিতে খেতেই এসেছিলাম।”
এর মাঝেই খাবার নিয়ে এলো রিপন। টেবিলে খাবার রেখে দাঁড়িয়ে রইল।নিরব জিজ্ঞেস করলো,
“কিরে কিছু বলবি?”
রিপন নিরবের দিকে তাকিয়ে বলে,
” সাহস দিলে একটা কতা কইতাম।”
নিরব বলে,”কি কথা?”
আফরা ততক্ষণে খাওয়া শুরু করেছে। খাওয়া শেষ করে তাকে আবার ক্লাসে যেতে হবে। এদের সাথে বক বক করতে শুরু করলে ক্লাসটাই মিস হয়ে যাবে।
রিপন আফরার দিকে আঙ্গুল তাক করে বলে,
“নিরব ভাই আপনের বয়প্রেন্ড টা কিন্তু মেলা সুন্দর।
আফরা মুখে খাবার নিয়ে কাশতে শুরু করলো।নিরব রিপনের কথা শুনে টেবিল কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো। আফরা পানি খেয়ে কোনরকম কাশি আটকে রিপনকে বললো এই তুমি যাও তো এখান থেকে।
নিরব রিপনকে আটকে দিয়ে বললো,
“শোন বলদ মাইয়ারা বয়ফ্রেন্ড হয় না বয়ফ্রেন্ড হইলাম আমরা যেমন তুই আর আমি।’
রিপন অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে,
” তাইলে আপনে এই সুন্দরী আপার বয়ফ্রেন্ড?”
“না।” বলে উঠে আফরা।
তারপর আর কোনো কথা হয় না দুজনের মাঝে।খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ায় আফরা। খাবারের বিল দিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে যায়। নিরব আফরার পাশে হাঁটতে লাগলো।
“আপনি আমার খাবারের টাকা দিলেন কেন?”
“তুমি কালকে আমাকে রিকশায় করে বাসার সামনে পর্যন্ত নামিয়ে দিলে কেন?”
“এমনিই। আপনি গাড়ি পাচ্ছিলেন না তাই।
“আমিও এমনিই।তোমার পকেটে টাকা ছিল না তাই খাইয়েছি। হিসাব বরাবর।”
আমরা দ্রুত হেঁটে সামনে চলে গেল। নিরব দাঁড়িয়ে রইল।
হঠাৎ চিল্লিয়ে বলতে লাগলো,
” আমার পকেটে যদি প্রতিদিন টাকা না থাকে,তাহলে কি প্রতিদিন খাওয়াবেন?”
আফরার পায়ের গতি কমলো। হাঁটা থামিয়ে নিরবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“জি না। পকেট খালি থাকলে পেট ও খালিই থাকবে।”
নিরব আবার বললো,
“ভেবে দেখবেন! পরে কিন্তু গাড়ি না পেলে রিক্সায় বসার জায়গা দিব না।”
আফরা কিছু বললো না। নিঃশব্দে হেঁসে চলে গেল সেখান থেকে।
.
.
.
কয়েকদিন ধরে আদিল পড়েছে মহা বিরক্তিতে। আদিলদের দাদা বাড়িতে তার বাবারা তিন ভাই একসাথে থাকতো। এখন তার বাবা না থাকলেও তার দুই কাকা তার পরিবার নিয়ে এখানেই থাকে।যদিও আদিলের দাদা তিন ছেলেকে জায়গা জমি আগেই ভাগ করে দিয়েছিলেন।সেই সুবাধে আদিলের বাবা তার বাবার ঘরের পাশের জায়গাটা পেয়েছিল, সেখানেই ছোট খাঁটো একতলা একটা ঘর বানিয়েছিলেন। যেটাতে এখন আদিলরা থাকে।
কিন্তু সমস্যাটা হলো আদিলের ছোট কাকার মেয়ে পলি। যে সারাক্ষণ মাছির মতো ভনভন করে আদিলের পেছনে ঘুরে বেড়ায়। ক্লাস নাইনে পড়া একটা মেয়ের এমন আচরণে আদিল রিতিমত বিরক্ত হয়ে উঠেছে। নেহাতই আপনজন বলে কিছু বলতে পারে না।
আদিলদের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে একটা মেলা বসবে বিকালে। সেখানে পলিসহ আরো বাকি ভাই-বোন গুলো যেতে চাইছ। সাথে আদিলকে যাওয়ার জন্যও রাতিমত পাগল করে তুলছে। আদিলের মা সাহেদাও ছেলেকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করালেন।
বিকাল ঠিক চারটায় সবাই রেডি হয়ে আদিলদের ঘরের সামনে চলে এলো। আদিল বেরিয়ে আসতেই পলি তার সামনে দাঁড়িয়ে ডং করে বলে উঠলো,
“আমাকে কেমন লাগছে আদিল ভাইয়া?”
পলির দিকে তাকালে যে কেউ মনে করবে সে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। পাথরের কাজ করা ড্রেস,কানে বড় বড় দুল, ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক।
আদিল পলির আপাদমস্তক দেখে বলে,
“চলো মেলায় গিয়ে জোকার দেখাবো।”
পলি আদিলের কথার মানে না বুঝতে পেরে খুশি মনে বললো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ চলেন দেখবো।”
পলির ছোট বোন লিলি খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো ওর কথা শুনে।
.
.
.
এই প্রথম এতো কাছ থেকে এতো বড় মেলা দেখছে কেয়া। দুপুরে রাফিদের বাড়িতে এসে পৌঁছালেও বিকেলে মেলা দেখার লোভ সামলাতে পারলো না। মেলায় এসে নিমিষেই শরীরের ক্লান্তি দুর হয়ে গেল কেয়ার । রাফির বোন রিনি আর কেয়া দুজন একাই এসেছে। তাঁরা দুজনে একটা ফুচকার স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। বেশি ভীর থাকায় জায়গা খালি হওয়ার পর ফুচকা নিয়ে খালি বেঞ্চিতে বসলো। হঠাৎ নজর গেল তাদের সামনে বসে থাকা একটা মেয়ের দিকে। কেয়া আর রিনি হা করে একে অপরের দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবলো,
“আমরা কি ভুল করে বিয়েতে চলে এসেছি নাকি?”
সামনে বসা মেয়েটা আর কেউ না পলি। পলি একাই বসে ফুচকা খাচ্ছিল।আর আদিল বাকিদের জন্য আইসক্রিম কিনতে গিয়েছিল। আদিল এসে পলির পাশে দাঁড়ালো। আর বাকিরা আইসক্রিম খেতে খেতে হেলেদুলে আসছে।পলি আদিলের হাত খালি দেখে বলে উঠলো,
“আমার জন্য আইসক্রিম আনোনি আদিল ভাই?”
আদিল নামটা শুনে কেয়া চমকে উঠলো। মুখ তুলে তাকাতেই আদিলের সঙ্গে দৃষ্টি মিলে গেল

চলবে….?

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_১৬
লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম

দিবসের শেষভাগ। প্রকৃতির ধরাবাঁধা নিয়মে ধীরে ধীরে সূর্য তার উষ্ণতা হারাচ্ছে। রক্তিম আলোর ছড়াছড়ি আকাশ জুড়ে। সুগভীর নদীর বক্ষে মৃদু ঢেউ, চারপাশে বইছে ফিনফিনে ঠান্ডা হাওয়া। সেই হাওয়ায় তালে দুলছে নদীর ধারে অবহেলায় বেড়ে ওঠা বুনোফুল গুলো। বাতাসে ভেসে আসছে বুনোফুলের ঘ্রাণ। প্রকৃতির এই অপার্থিব সৌন্দর্যে মেতে আছে কেয়া। তার বসে থাকা কাঠের বেঞ্চটা একটু নড়ে দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি জানান দিল।

আদিল নিঃশব্দে বসলো কেয়ার পাশে। তাদের মাঝের দুরত্ব বেশ। আদিল তার হাতের চায়ের কাপ দুটো দুজনের মাঝখানে রাখলো। তখন কেয়া আর আদিলের দেখা হয়ে যাওয়ার পর কেয়া চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে আদিল পলিদের গাড়ি করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে কেয়ার কাছে গিয়ে বললো তোর সাথে আমার কথা আছে। তাই কেয়াও রিনিকে বলে থেকে গেল। কিন্তু সন্ধ্যার পর রিনির একটা টিউশনি থাকায় সে থাকতে পারলো না কেয়ার সাথে।

” তুই এখানে কিভাবে?”

আদিলের কথা শুনে কেয়া তার মুখের দিকে তাকালো। তাদের শেষ দেখা হয়েছিল প্রায় একমাস আগে প্রথম পরিক্ষার দিন। এরপর থেকে আর দেখা হয়নি। কারনটা হয়তো আলাদা হলে পরীক্ষার সিট পড়া, নয়তো আদিল চায়নি তাদের দেখা হোক। আদিলের চোখে তাকালেই বিষাদে ভরে উঠে তার হৃদয়। একটা মানুষ দুনিয়ার সবকিছু বুঝতে পারে অথচ তার এমন প্রগাঢ় অনুভূতি বুঝতে অক্ষম,এটা ভাবতেই তাঁর নিজের উপর ভীষণ হাঁসি পায়। এতোই ঠুনকো তাঁর অনুভূতি? এতটাই ভিত্তিহীন!

“কি হলো কি বলছিস না কেন?”

আদিলের কন্ঠে ধ্যান ভাঙল কেয়ার। সোজা হয়ে বসে আদিলের দিকে দৃষ্টি তাক করে বললো,
“রাফি ভাইদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি।”

“ওহ।”

নে এই চা টা খা। বেশ ভালোই ঠান্ডা পড়ছে। শীতের পোশাক পড়ে আসিস নি কেন?”

আদিল এমনভাবে কথাগুলো বললো মনে হয় কেয়ার সাথে তাঁর সম্পর্ক স্বাভাবিক।আদিল একটা চায়ের কাপ কেয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।

কেয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে নিরুত্তাপ বসে রইলো। আদিলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“এই তাহলে তোর গুরুত্বপূর্ণ কাজ? যার কারণে কোনোরকম পরীক্ষা শেষ করেই ছুটে আসা। তবে মেয়েটা সুন্দর, দুজনকে একসাথে মানাবে।”

“কোন মেয়ে? তুই কার কথা বলছিস?

“কেন বুঝতে পারছিস না? যাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছিস অবশ্যই তার কথাই বলছি।”

“কি আবোল তাবোল বকছিস! তুই যা ভাবছিস সেরকম কিছু্ই না। পলি আমার ছোট চাচার মেয়ে। মেলায় নিয়ে আসার জন্য জোরাজুরি করছিল । আর মা ও বারবার বলছিল তাই।”

“ওহ আচ্ছা।”

“হুম।”

কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দে কাটলো। কেয়া বলে উঠলো,

“আদিল তুই এমন করছিস কেন?ফোন দিলে ফোন ধরছিস না।দেখাও করিস না এখন। আমি জানি তুই ঝুমুরের সামনে পড়তে চাস না তাই এখানে চলে এসেছিস।ওকে ভুলে যা প্লিজ, যে মানুষটা তোর জীবনে কোনদিন আসেইনি তাকে ভেবে কষ্ট পাওয়া কি বোকামি নয়? নিজের অনুভূতি লুকাতে অন্য একজনকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস?”

“আমি কাউকে ভালোবাসি না। আর না কারো কাছ থেকে অনুভূতি লুকাতে এখানে এসেছি। আর আমি আমার জন্য কাউকে কষ্ট পেতে তো বলি নি। তবুও আমার জন্য কেউ কষ্ট পাক তা আমি কখনোই চাইবো না। পারলে আমার হয়ে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিস।”

” কেয়ার গভীর চোখজোড়া অশ্রুতে ভরে উঠলো। আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বলতে লাগলো,
” যার জীবনে কষ্টই সই,তার আবার নতুন করে কষ্ট কিসের? তুই শুধু চাইলে তার যখমের মলম হতে পারিস।”

“একবার ফুলের দিকে হাত বাড়ানোর আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছি, দ্বিতীয়বার কাঁটার আঘাত খাওয়া নিশ্চিত জেনেও হাত বাড়াতে চাই না।”

“কাঁটা ছাড়াও তো ফুল হয়। হয়তো খুব কমদামি,তবে ফুল তো।এই যেমন বুনোফুল গুলো। যখন খুশি ধরা যায় ছোঁয়া যায়!”

এতো বিষাদের মাঝেও মুখভরে হাসলো আদিল,
” গরিব হতো পারি তবে কমদামি জিনিসে আমার পোষায় না।”
আদিলের কথায় মুখ অন্ধকার নেমে এলো কেয়ার।
একটু থেমে আদিল আবার বললো,
“তবে বুনোফুল আমার পছন্দের।”

আদিল কেয়ার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠে,
“কেয়া হবি কি আমার হৃদয়ের বুনোফুল? যাকে ছুঁতে গেলে থাকবে না কোনো কাঁটার আঘাতের ভয়। থাকবি তো সবর্দা বুনোফুলের মতো এমন কোমল, নিরহংকার?

কেয়া নিরুত্তর, নির্বাক। অপ্রত্যাশিত কিছু পেয়ে গেলে হয়তো মানুষ এমনই হয়ে যায়! কিছু সেকেন্ড পরেই কেয়া আর দ্রুত গতিতে মাথা নাড়ালো।

আদিল কেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে উদাস কন্ঠে বলে,
“কেয়া আমি তোর অনুভূতিগুলো উড়িয়ে দিতে চেয়েও বারবার অক্ষম হয়েছি। ঢাকা থেকে এসেও আমি একটু স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। গলায় কাঁটা আটকে গেলে যেমন অনুভূতি হয় ঠিক তেমন মনে হচ্ছিল আমার। প্রতিটা পদে পদে নিঃসঙ্গ অনুভব করছিলাম। তবে জানিস,আজ তোর মুখটা দেখেই আমার উদাসীনতার প্রতিফলন তোর চোখে দেখতে পেলাম।
“আমরা মনে হয় আমরা চাইলেই দুজন দুজনের নিঃসঙ্গতা ভাগাভাগি করে নিতে পারি।”

*

ওয়াহিদ বাড়ি ফিরল রাত নয়টার। ঘরে ঢুকে দেখলো ঝুমুর টেবিলে বসে খাতায় কিছু আঁকাআঁকি করছে। ওয়াহিদ হাতের ব্যাগটা সোফায় রেখে নিঃশব্দে ঝুমুরের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। কড়া পারফিউমের পরিচিত ঘ্রাণ ঝুমুরের নাকে ঠেকতেই পেছন ফিরে তাকালো ঝুমুর। ওয়াহিদকে দেখে তড়িঘড়ি করে খাতাটা লুকিয়ে ফেললো। ওয়াহিদ বলে উঠলো,
“বুঝলে কি করে আমি এসেছি?”
“পারফিউমের ঘ্রাণ।”
“ওহ আচ্ছা! খাতায় কি লুকাচ্ছো দেখি?”

ঝুমুর খাতাটা আড়াল করে ফেললো,
“না না, কিছু না।”

ওয়াহিদ কৌশলে ঝুমুরের হাত থেকে খাতাটা নিয়ে নিল। খাতায় করা ঝুমুরের অভাবনীয় শিল্প দেখে তার মাথায় হাত।

খাতায় এপ্রোন পড়া লম্বা একটা ছেলে আঁকা। যার গালে সুই এর মত দাড়ি, চুলগুলোও সুইয়ের মত লম্বা লম্বা,সুন্দরের মধ্যে আছে শুধু চোখগুলো সেগুলোর আবার লেন্স গুলো লাল লাল ঠিক যেন ভ্যাম্পায়ার। নিজের এমন অনিন্দ্য সুন্দর চিএ দেখে ওয়াহিদ ঠিক কি রিয়েকশন দিবে বুঝতে পারছে না। তবে খুব কষ্টে নিজের হাসি চেপে রাখলো। কন্ঠে গাম্ভীর্য এনে বলে,

“তাহলে সারাদিন তুমি ঘরে বসে বসে এগুলো করো? এই তোমার পড়ালেখার নমুনা? এভাবে পড়লে তোমার প্লাস আসবে?”

ঝুমুরের চোখেমুখে অমাবস্যার চাঁদ নেমে এলো।

ওয়াহিদ গাঁয়ের শার্ট খুলতে খুলতে আলমারির দিকে যায়। টিশার্ট ট্রাউজার বের করে আবার ঝুমুরের কাছে আসে।
ঝুমুরের বায়োলজি বই নিয়ে একটা চ্যাপ্টার দাগিয়ে দিল। আর বললো,
“তোমার হাতে একঘন্টা টাইম পড়া শেষ করো। আমি পড়া জিজ্ঞেস করবো।”

পড়া শেষ করতে করতে ঝুমুর একঘন্টা শেষ করে দুইঘন্টায় পা দিয়েছে। তবুও তার মনে পড়ার চেয়ে অন্য চিন্তা বেশি।
ওয়াহিদ ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিল। ঝুমুর অনেকক্ষণ যাবত তাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে তা লক্ষ্য করেছে ওয়াহিদ।
“কি বলবে বলে ফেলো?”
ঝুমুর হকচকিয়ে গেল।
“আচ্ছা আপনার ওই বান্ধবী কনা যে উনি কি করেন?”
ওয়াহিদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
“কেন? ওর ব্যাপারে জেনে তুমি কি করবে?”
“নাহ এমনিই জানতে ইচ্ছা হলো আরকি।”

“ওহ। কনা একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার। ও খুব দক্ষতার সাথে ডিজাইন বিশ্লেষণ করতে পারে। আমি তো ভাবছি আমাদের হসপিটালের নিউ লোগো ওকে দিয়েই ডিজাইন করাবো। হসপিটালে যাওয়ার পথেই তো ওদের বাসা , একদিন তোমাকে নিয়ে যাব।”

“হসপিটালে যাওয়ার পথেই বাসা? তাহলে তো এদিকে আশেপাশেই বাসা তাই না?”

“হ্যাঁ এইতো মিরপুর ১০ কাজীপাড়া। ‘ও’ তো এতদিন দেশের বাইরে ছিল এই কয়েকদিন হলো বাংলাদেশ এসেছে।”

ঝুমুর ইনিয়ে বিনিয়ে ওয়াহিদের কাছ থেকে কনার বাসার ঠিকানা টা জেনে নিল।
ঝুমুরের মাথায় কিছু ঢুকছে না।ওইদিনের সেই ঘটনার জন্য যদি কনা দায়ি হয় তাহলে সে এইসব কেন করেছে? উদ্দেশ্যে কি তার?
.
.
.
ঘড়ির কাঁটা যখন দশটার ঘরে তখন আদিল ঘরে ফিরলো। কেয়াকে বাসায় পৌছে দিয়েছে অনেক আগেই। এতোক্ষণ বাইরে ঘুরেছে, চা খেয়েছে। ঘরে ঢুকতেই দেখলো খাবার সামনে নিয়ে মা বসে আছে। আদিলকে দেখে এগিয়ে গেলেন সাহিদা।

“জমিদারের এতক্ষনে ফেরার সময় হয়েছে?আমি তে ভাবলাম নতুন থাকার জায়গা জুটেছে। আর তখন ছেলেমেয়েগুলোকে এমন একা পাঠিয়ে দিলি কেন? কি এমন কাজ পরেছিল তোর?”

“আমি তো ওদেরকে গাড়ি ঠিক করে পাঠিয়েছি। খাবার দাবার কিছু আছে? থাকলে দাও। খিদের পেটের পোকামাকড় পেটের নাড়িভুঁড়ি সব খাওয়া শুরু করেছে।”

“কেন? এতক্ষন যার সাথে ঘুরছিলেন তার সাথে কি আসতে পারলেন না?”

“কি বলছো আমি আবার কার সাথে ঘুরছিলাম?”

“এই কথা ঘুরাবি না একদম পলি আমাকে সব বলেছে।তুই নাকি কোন মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য বসেছিলি?”

“ওহ মা! এই এক তুমি আর তোমার পলি। পাগল করে দিচ্ছো দুজনে। কেয়ার সাথে দেখা হয়েছিল তাই একটু কথা বললাম।আর এতক্ষণ তো এমনিই ঘুরলাম। ছোটবেলার এক বন্ধুর সাথে দেখা এইজন্য আরো দেড়ি হয়ে গেল।”

আদিলের মা কি আর কথা শুনে চমকে গেলেন।
“কেয়া! ও এখানে কি করছে?”

“ওর খালার বাড়িতে এসেছে।”

“ওহ এখানে নিয়ে আসিস তো একদিন। অনেকদিন হয়ে গেল মেয়েটাকে দেখি না। আসার সময় তো তাড়াহুড়ায় বলেও আসতে পারলাম না।”

“আচ্ছা একদিন একবারে নিয়ে আসবো নে। এখন খাবার দাও।”

আদিল কথাটা আস্তে বললেও সাহিদা বেগমের কানে গেল কিছুটা।
“কি বললি?”

“বললাম যে আচ্ছা নিয়ে আসবো একদিন।’

“ওহ আচ্ছা। তুই হাত মুখ ধুয়ে আয় আমি খাবার দিচ্ছি।”
.
.
.
.
কুশাময় শীতের সকালে প্রায় একঘন্টা মনিং ওয়ার্ক শেষ করে ঘরে ফিরে এলো ওয়াহিদ। ঝুমুর এখনো কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আজ ওর কলেজ বন্ধ। ওয়াহিদ ঝুমুরকে ডেকে দিল। ঝুমুর মিটমিট করে চোখ খুলে দেখলো ঘড়ির কাঁটা সাতটার ঘরে। আরো একটু ঘুমিয়ে নিবে ভেবে যেই আবার বিছানায় শুতে যাবে, ওয়াহিদ এসে তার হাত টেনে ধরলো।

“তাড়াতাড়ি উঠো। তোমার রুটিনে সাড়ে ছয়টায় উঠার কথা লেখা আছে তুমি অলরেডি আধা ঘন্টা লেইট। হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসো।”

ঝুমুরের সকাল সকাল এতো আরামের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় ঘটায় চোখমুখ কুঁচকে বসে রইল। কি আর করার শেষমেশ উঠতেই হলো।

সাড়ে আটটা বাজে ওয়াহিদ বেরিয়ে গেল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। ততক্ষণে ঝুমুরের ঘুম পুরোপুরি কেটে গেল।
.
.
.
সাদা রঙের ডুপ্লেক্স বাড়িটা। অদ্ভুতভাবে বাড়িটার দরজা জানালা হতে দেয়ালের রং সবকিছুই সাদা। তবে সাদা রংটা খুব সচ্ছ, সুশ্রী। সবকিছুর সাথেই খুব সুন্দরভাবে মিলে যায়।
বাড়ির দোতলায় খোলা বারান্দায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে কনা।
গেটের দারোয়ান এসে জানিয়ে যায় বাড়ির কেটে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা পরিচিত মানুষটার মুখ দেখে চমকে উঠে কনা।

“ও এখানে কি করছে?”

চলবে…?