প্রেমময়ী সন্ধ্যা পর্ব-১৭+১৮

0
7

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_১৭
লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম

“স্যার আসতে পারি?”
“ইয়েস কাম।”
“গুড মর্নিং স্যার। চা বা কফি কিছু দিবো আপনার জন্য?”
“গুড মর্নিং। নো থ্যাংকস।”
“ওয়েলকাম। স্যার আজকে পুরাতন পেশেন্ট দেখার ডেট ছিল। আমি কি একজন একজন করে ভেতরে পাঠিয়ে দিব?”
“জি পাঠিয়ে দিন।”

ওয়াহিদ তার কেবিনে বসে আছে। প্রতিদিন মূলত রোগী দেখাই তার কাজ। সপ্তাহে দুদিন অপারেশনের ডেট থাকে তার।এত অল্প সময়েও অনেক যশখ্যাতি রয়েছে তার। সারাদিন কাজেরও প্রচুর চাপ থাকে। রোগীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট সহ আরো যাবতীয় সমস্যা দেখাশোনার জন্য আছে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট মিশকাত। সে প্রায় এক বছর ধরে ওয়াহিদের সাথে আছে।

*

ঝুমুর বসে আছে একটি আভিজাত্যে পরিপূর্ণ বাড়ির ড্রইংরুমে। মিনিট পাঁচেক পরে সেখানে একজন সুদর্শন পুরুষের দেখা পাওয়া গেল। ঝুমুর কাঙ্খিত ব্যাক্তির দেখা না পেয়ে আশাহত হলো। পুরুষটি ঝুমুরের সামনে গিয়ে বলল,
“কাকে চাই?”
” মিস কনা’র সাথে দেখা করতে চাই।”
“ওহ ওয়েট। বাই দা ওয়ে আমি হচ্ছি কনার ফিয়ন্সে।”
“ওহ আচ্ছা।”

“হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ! ঝুমুর তুমি এখানে! কিভাবে কি? ওয়াহিদ এসেছে?”সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল কেয়া।

কেয়াকে দেখে ঝুমুর উঠে দাঁড়ালো।
“নাহ আমি একাই এসেছি। আসলে আপু আপনার সাথে আমার একটু কথা আছে।”

বেশ চমকালো কেয়া। কারণ ঝুমুরের সাথে তার তেমন কথাই হয়নি।

“আমার সাথে? আচ্ছা চা কফি কিছু দিতে বলি? তারপর নাহয় রিল্যাক্সে বসে কথা বলব।”

“নাহ। আমার একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে কেয়া তোমরা কথা বলো আমি এখন আসি।”বলে শাহিদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

” কংগ্রাচুলেশন। আপনার বিয়ের জন্য।”
কেয়া হাসলো সামান্য,
“এনগেজমেন্টে গেলে সেদিন আর আজ কংগ্রাচুলেট করছো? বাহ তুমি তো খুব ইউনিক?”
ঝুমুর চমকে উঠলো,
“কিহ! সেদিন আপনার এনগেজমেন্ট ছিল?”

“হ্যাঁ তুমি কি জানো না যে সেদিন আমার এনগেজমেন্ট ছিল? আর সেদিন তোমরা দুজন হঠাৎ চলে এসেছিলে কেন? আমি এনগেজমেন্ট সেরেমনি শেষ করে দেখি তোমরা নেই।পরে একজন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকের থেকে শুনলাম তোমরা চলে এসেছো।”

ঝুমুরের মাথা ঘুরতে লাগলো। সেদিন কনার এনগেজমেন্ট পার্টি ছিল! তাহলে তো কনা নিচেই ছিল। আর নিজের অনুষ্ঠান ফেলে রেখে সেখানে যাবেই বা কেন? আর যদি ওয়াহিদ কে পছন্দ করে তাহলে বিয়েই বা করছে কেন? নাহ এসব কনা করতে পারে না!

ঝুমুর উঠে দাঁড়ালো।ঝুমুর কি বলবে কিছু বুঝতে পারলো না।

“আপু আমি আসলে সেদিনের জন্য সরি বলতে এসেছিলাম।আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওয়াহিদ আমাকে নিয়ে বাসায় চলে গিয়েছিল। আপনার সাথে দেখাও করতে পারিনি আমরা। প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না। আর আপু আমি আজকে যাই অন্য আরেক দিন এসে অনেকক্ষণ গল্প করবো। আসলে বাসায় না বলেই চলে এসেছি। ওয়াহিদ একদিন এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় আপনার বাসাটা দেখিয়েছিল তাই ভাবলাম আজ একটু দেখা করে যাই আপনার সাথে।”

“আরে কোনো সমস্যা নেই। আমি কিছু মনে করি নি, ভেবেছিলাম কি না হলো! নাহলে ওয়াহিদ তো না বলে চলে যাওয়ার মতো ছেলে না। আর বাসা যেহেতু চিনেই গেছো মাঝে মাঝেই চলে আসবে। একসাথে গল্প করবো।”

“আচ্ছা আপু আমি এখন যাই।” ঝুমুর দ্রুতপায়ের বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। ঝুমুর শায়লা বেগমকে বান্ধবীর কাছ থেকে বই আনার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। এতক্ষণ দেরি হচ্ছে দেখলে নিশ্চয়ই সন্দেহ করবে।

*

আজ নিরবের সকালটাই শুরু হলো খারাপ দিয়ে। সারাটা দিন না জানি কি যায়! সে যে বিল্ডিংয়ে থাকে তার উপর তলায় আজ একজন নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছে। হয়তো তার মতই ব্যাচেলর কেউ একজন। তারই মালপত্র উঠানো হচ্ছে উপরে।এই সকাল সকাল তার আরামের ঘুম হারাম করে দিল। গতকাল রাত জেগে পড়াশোনার কারনে ঘুমিয়েছে তিনটে নাগাদ। কানের উপর বালিশ চাপা দিয়েও তেমন কোন লাভ হলো না, যেন শুধু কান দিয়ে নয় সারা শরীরের সমস্ত লোমকূপ দিয়ে বিদঘুটে শব্দ ঢুকেছে। বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। দেয়ালে টাঙানো ছোটখাটো ভাঙ্গাচোরা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো এগারোটার একটু বেশি বাজছে। ধুর আর একটু পরে উঠলেই তো একবারে দুপুরের খাবার খেয়ে ফেলতো। এখন আবার নাস্তার জন্য টাকা নষ্ট! ভেবেই সেই ভাড়াটিয়াকে ডজনখানেক গালি দিল। দাঁত ব্রাশ হাতে নিয়ে জানলায় উঁকি দিল নিচে দেখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু একটা ছোট খাটো ভ্যানগাড়ি আর দুজন কুলি ছাড়া কাউকে দেখতে পেল না।
হাত মুখ ধুয়ে গেল নাস্তা করতে। আজ নিজেই নাস্তা বানাবে। কিছু বিধিবাম! ঘরে চাল, কিছু ডাল আর দুইটা আলু ছাড়া কিছুই নেই। যেই দেখা সেই কাজ! ঠিক করে নিলো আজ কোন নাস্তাও হবে না লাঞ্চ ও হবে না। আজ হবে ‘ব্রাঞ্চ’!

প্রায় দশমিনিট ধরে নিজের তৈরি করা অতি সুস্বাদু খিচুড়ি সামনে নিয়ে বসে আছে নিরব। কি একটা অবস্থা না পারছে গিলতে আর না পারছে ফেলতে। এত সুন্দর চকচকে সাদা খিচুড়ি সে আর কোনদিন দেখেনি। খিচুড়ি রান্না করতে গিয়ে দেখেছে, বাড়িতে একট চিমটি লবণ ছাড়া আর কিচ্ছুটি বাকি নেই। রাগে দুঃখে এখন এই খিচুড়ি মাথায় ঢালতে মন চাচ্ছে।

রাগের মাত্রা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে বেজে উঠলো ফোনটা। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে আদিলের কন্ঠস্বর,
“কিরে? কি অবস্থা?”

“তোর অবস্থার মা*য়েরে বাপ শা*লা!”

নিরবের কথায় কোনো হেলদোল দেখা গেল না আদিলের মধ্যে। এটা যেন তার নিত্যদিনের জানা ঘটনা। নির্বিকার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,
” আজকে কোন রেসিপির উপর এক্সপেরিমেন্ট করছিলি?”

নিরবের বিরক্তির পারদ কয়েক ধাপ বেড়ে গেল।
” খিচুড়ি রানতে গেছিলাম। এখন লেটকা খিচুড়ি হ্ইছে নাকি লুজ** খিচুড়ি নিজেই বুঝতাছি না।”

আদিল হাসতে হাসতে শেষ।
“তাও ভালো যে ছাদে ডিম পোঁচ করতে যাস নাই। গতবার ডিমের উপর এক্সপেরিমেন্ট করতে যাইয়া যেই কাহিনীটা হইলো। মাফ চাই ভাই!”

নিরব প্রসঙ্গ পাল্টালো।
“কিরে কাহিনী কি? আজকে তোরে এত খুশি খুশি লাগতাছে ক্যান?”

আদিল চুপ হয়ে গেল। একবার ভাবলো নিরবকে তার আর কেয়ার কথা বলবে। কিন্তু পরে ভাবলো না এখন বলা যাবেনা পরে সময় করে বলবে নাহয়। আদিল বলে,
“আচ্ছা শোন তুই যেই বাড়িতে থাকস ওইটার ভাড়া কত মাসে? আর একটা রুম দেখিছ তো।”

“ক্যান তুই এইসব জাইন্যা কি করবি?”

“আমি ঠিক করছি পরীক্ষা পর্যন্ত ঢাকায় থাকবো। এরপরে যা করি করবো। এইখান থেইক্কা যাওয়া আসা যাওয়া কইরা পরীক্ষা দেয়া অনেক ঝামেলার। তুই কোন রুম খালি পাইলে বলিস।”

” ভন্ডামি কম কর শা*লা। টাকা কি বেশি হইছে নাকি? এতো বেশি হইলে আমারে কিছু দিস। আমার বাসা থাকতে তুই আবার বাসা ভাড়া নিবি ক্যান? আবার ভাবিস না ফ্রি দিতেছি,ভাড়া কিন্তু হাফ হাফ। কিন্তু তুই যদি এখানে আইসাই পরছ তাইলে তোর মা এখন গেল কেন?”

“আরে চাচারা বুঝাইছে এইখানে থাইকা অনেক খরচ হেনতেন। বাড়িতে গেলে আমি আব্বার ব্যবসার হাল ধরতে পারমু কিন্তু আমি এখন পরিক্ষা না দিয়া কিছু শুরু করতে চাইতাছি না। দেখা যাক সামনে কি হয়।”

“আচ্ছা আইসা পর। আর আমার লুজ খিচুড়ি খাওয়ার প্রিপারেশন নিয়া আসিস।”

“ধুর সয়তান। তোর খিচুড়ি তোর বউরে খাওয়া। রাখ!”

নিরব কল কেটে তার অতিকষ্টে করা খিচুড়ির প্লেট সরিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়লো বাইক নিয়ে। কলেজের এক ছেলের কাছ থেকে তার পাওনা দুইশো টাকা আদায় করাই এখন তার মূল উদ্দেশ্য। এরপরে না হয় আজকের ব্রাঞ্চটা সেই টাকা দিয়েই করবে!
.
.
.
আজ ওয়াহিদ বাড়ি ফিরে এলো দুপুর বারোটার আগেই।ওয়াহিদের আজ রিটার্ন পেশেন্ট ছিল বলে সাড়ে এগারোটার মধ্যেই রোগী দেখা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ঘরে আসার অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও ঝুমুরকে দেখলো না। শায়লা বেগমকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন কেন বান্ধবীর কাছ থেকে বই আনতে গেছে। ওয়াহিদের জানামতে ঝুমুরের বন্ধুদের কেউই আসেপাশে থাকে না। অনেকটা দুরেই সবার বাসা। আর ঝুমুরের কি এমন বইয়ের প্রয়োজন হতে পারে যে তাকে কিছু না বলেই চলে গেল! ঝুমুরের নাম্বারে কল দিয়ে দেখলো ফোনটা ঘরেই রেখে গেছে। রেগে গেল ওয়াহিদ। কোথায় না কোথায় গেছে ফোনটাও নিয়ে যায়নি। আশ্চর্য!

ওয়াহিদ বাড়িতে ফেরার প্রায় চল্লিশ মিনিট পর ঝুমুর আসলো। গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেড়ি হয়ে গেছে। নাহলে তো কনাদের বাড়ি তাদের বাড়ি থেকে মিনিট পঁচিশের রাস্তা হবে।

রুমে ঢুকে ওয়াহিদকে বসে থাকতে দেখে নির্বাক ঝুমুর। কি আশ্চর্য! তার সাথে আছো আমি উল্টাপাল্টা হচ্ছে কেন! এখন কি বলবে ওয়াহিদকে?

” বই পেয়েছো?”

ওয়াহিদের শান্ত কন্ঠ শুনে খানিকটা ভয় পেল ঝুমুর। মা তাহলে বলে দিয়েছেন যে সে বই আনতে গিয়েছে। কিন্তু এখন কি বলবে?

” আপনি কখন আসলেন? আসলে বই আনতেই গিয়েছিলাম কিন্তু কেয়া বইটা খুঁজে পাচ্ছিলো না।”

ওয়াহিদ বিছানা থেকে উঠে ঝুমুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ঝুমুরের তিরতির কাঁপতে থাকা নাকের ডগার ঘাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে ঝুমুরের চোখে চোখ রেখে বলে উঠে,

“তুমি কি আমাকে বোকা ভাবো সুন্দরী?”

চলবে….?

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_১৮
লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম

ঝুমুর কি বলবে বুঝতে পারছে না। প্রচন্ড ভয় ও লাগছে মিথ্যা বলতে। তাও বুকে সাহস জুগিয়ে বলে উঠে,
“আরে দেখুন না আমি আসলে মোবাইলটা নিতেই ভুলে গিয়েছিলাম। আমার বান্ধবী মানে কেয়া তো এদিকে আসবে বলেছিল তাই বললো আমি যেনো ওর সাথে দেখা করি।‌ বইটা তো আসলে আমার দরকার ছিল কিন্তু আমি যাওয়ার আগে ওকে বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম।

ওয়াহিদ ভ্রু তাকিয়ে রইল ঝুমুরের দিকে।
“ওহ আচ্ছা। কোন বই নাম বলো আমি লাইব্রেরী থেকে আনিয়ে দিচ্ছি।”

“না না লাগবে না। ওকে বলেছি পরে নিয়ে আসবে।”
“আচ্ছা এখন ফ্রেশ হয়ে আসো।”

ওদের কথার মাঝেই রুমে আসলো সামিয়া।
ওয়াহিদ আর ঝুমুরের উদ্দেশ্যে বলে,
“বাবা তোমাদের দুজনকেই নিচে ডাকছে।”

ওয়াহিদ বলে,
“এখন?”

“হুম।”

আচ্ছা আমি যাচ্ছি ঝুমুর তুমি ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো।”

*

ড্রইং রুমে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে বসে আছেন শাকিল শেখ। ওয়াহিদ গিয়ে তার সামনের সোফায় বসলো।
“বাবা ডেকেছিলে নাকি?”
“হুম ঝুমুর কোথায়?”
“আসছে। তুমি কি বলবে বলো।”

শাকিল শেখ ওয়াহিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ঝুমুরের তো মাএই পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আর তোমরা দুজনেই তো বিয়ের পরে একসাথে কোথাও ঘুরতে যাওনি। তাই আমি ভাবলাম কয়েকদিন একটু ঘুরে আসো দু’জনে ভালো লাগবে।”

“এখনো তো এইচএসসি পরীক্ষাই বাকি তারপরে আবার এডমিশনের ঝামেলা। পরে যাওয়া যাবে কোনো এক সময়।এখন ক্যানসেল করে দাও।”

শাকিল শেখ পাঞ্জাবির পকেট থেকে দুটো টিকিট বের করে ওয়াহিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“আমি তো টিকিট কেটেই ফেলেছি আর রিসোর্ট বুক করাও হয়ে গেছে। সমস্যা নেই তিন-চারদিন ঘোরাঘুরি আসলে কিছু হবে না। একটু ঘোরাঘুরি করে আসলে মন ফ্রেশ হবে তখন কাজেও মনোযোগ বসবে ভালো।”

ওয়াহিদ আর কিছু বলতে পারলো না।
“আচ্ছা ঠিক আছে।”

“কালকেই কিন্তু রওনা দিতে হবে। আজকে রাতের মধ্যে হসপিটাল থেকে চার-পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে নিবে।”

“আচ্ছা।”

*

প্রায় আধঘন্টা ধরে স্টেশন লাইব্রেরীতে বসে আছে আফরা। একটা টিউশনি তে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল কিন্তু মাঝরাস্তায় পৌঁছানোর পর স্টুডেন্টের মা ফোন দিয়ে বলে আজ স্টুডেন্ট পড়তে পারবে না। কাল রাত থেকেই মন মেজাজ প্রচন্ড খারাপ। বাড়ি ওয়ালীর সাথে একদফা ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়ার কারন ওই মহিলাই। আফরা তিনটা টিউশন করায়। একটা সাধারণত দিনে আর দুইটা সন্ধ্যার পরে। তো গতকাল রাতে টিউশন শেষ করে আসতে আসতে রাত দশটার কাছাকাছি বেজে যায়। এই বাড়ির বেশিরভাগ প্রত্যেকটা রুমেই ভার্সিটির স্টুডেন্ট কিংবা ব্যাচেলর মেয়েরাই ভাড়া থাকে। তাদের সবার জন্যই কিছু নিয়ম বরাদ্দ ছিল যেগুলো মেনেই সবাই এখানে উঠেছে। সবাইকে রাত নয়টার মধ্যেই বাড়ির গেটে ঢুকতে হবে যেখানেই থাকুক না কেন। কিন্তু আফরা গতকাল রাতে এই নিয়ম ভঙ্গ করেছিল। সেই নিয়ম ভঙ্গের শাস্তি স্বরপ আজ সকালেই তাকে বাসা খালি করতে হয়েছে। তাও ভাগ্য ভালো যে এক বন্ধুর কাছে একটা খালি বাসার সন্ধান ছিল। সকাল সকালই সেই বাসার মালিকের সাথে দেখা করে বাসাটা ঠিক করে ফেলল। আফরা উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলো ভাবলো আজকে আর কোন টিউশনিতে যাবে না। নতুন বাসা গোছাতে হবে আবার দুপুরের রান্নাও করতে হবে।

নিরব সেই ছেলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভরপেট খাওয়া দাওয়া করে রুমে ফিরল। রুমে ঢুকেই শার্ট প্যান্ট খুলে মোবাইলে হাত দেয়া মাএই নিচ থেকে কারোর চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ কানে গেল। বিরক্ত হয়ে উঠে রুমের জানালাটা বন্ধ করে দিতে যায় তখনই নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আফরাকে নজরে এলো। আফরাকে এখানে দেখেই চমকে উঠলো নিরব। আফরা রিক্সাওয়ালাকে
বলছে,
” বিশ টাকার ভাড়া আপনি চল্লিশ টাকা চাচ্ছেন কেন? না জিজ্ঞেস করে উঠেছি বলে কি ভাবছেন আপনি যত টাকা বলবেন তাই দিয়ে দিব নাকি?আমি কি ভাড়া জানি না নাকি?”

“দেখেন এত ক্যাচাল পাইরেন না। এই দুফুরে এমনেও আমি রিসকা নিয়া বাইর হইতাম না হইলে। আপনে কইছেন দেইখ্যা আইছি। এহন ভাড়াটা দিয়া দেন আমি যাইগা।”

“দেখেন এখন এসব কথা বলে লাভ নেই আমি কি আপনাকে আসতে জোর করে ছিলাম নাকি? আমি তো শুধু বলেছিলাম এই দিকে আসবেন নাকি। আপনার যদি ইচ্ছা না থাকতো তাহলে না নিতেন! সেজন্য তো এখন ভাড়া বেশি চাইতে পারেন না। নিন ধরুন।” বলে আফরা বিশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেয় রিক্সাওয়ালার দিকে।

” আইচ্ছা যান তিরিশ ট্যাকা দেন। আমি যাইগা।”

“কেন মামা বাড়ির আবদার নাকি? আমি এক টাকাও বেশি দিবো না। নিলে এইটা নিবেন নাহলে যান।”

“লোকটা আফরার সাথে নিজের মিথ্যা যুক্তিকে হেরে গিয়ে তার পাওনা টাকা নিয়েই রফাদফা হয়েছে।”

আফরা আর দাঁড়িয়ে না থেকে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যায়। আদিল আফরাকে উপরের দিকে আসতে দেখে জানলার কাছ থেকে সরে দরজা খুলে দাড়িয়ে থাকে।

“সমাজসেবিকা হিসেবেও ভালো, ঝগড়াতেও ভালো, দামাদামিতেও ভালো। বাহ! বাহ! কেয়া বাত হে।”

“আফরা সিড়ি থেকে মাথা উঠিয়ে আদিলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কপাল কুচকে তাকিয়ে বলে,
“এই ছেলে তোমার এখানে কি? আমি যেখানে যাই সেখানেই পিছু পিছু চলে আসো তাই না? আমি যে তোমার বড় সে খেয়াল আছে তোমার?বড়দের রেসপেক্ট করতে জানো না? আর ঝগড়ায় ভালো আমাকে বললে নাকি? তুমি আমাকে কোথায় ঝগড়া করতে দেখেছো হ্যাঁ? আমি কোন কারোর সাথে ঝগড়া করছিলাম না। যা সঠিক তাই করেছি। আর তোমার এখানে কি?”

“আস্তে একটু জিরিয়ে নিন আপুওওও। এটাতো আমারই রুম আপুওওও। এক গ্লাস পানি দিব আপুওওও? রুমে এসে বসুন আ…..

“এই চুপ! পু পু করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে একদম! আমার পরেছে যত,’বিপদে আপদ।” বলেই চারতলার সিঁড়িতে পা বাড়ায় আফরা।

“ধুর শা*লা! কি করলি জীবনে? অন্তত প্রেমিক হিসেবে ভালো হইতে পারতি!” হা হুতাশ করে রুমে ঢুকলো নিরব।

*

ঝুমুর ওয়াহিদ সকাল সকাল রওনা দিবে সাজেকের উদ্দেশ্যে। মনে মনে তো ঝুমুর খুশিতে আত্মহারা। পছন্দমতো অনেক জামাকাপড় ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছে। যদিও ওরা মাএ তিনদিন থাকবে। ওয়াহিদ হসপিটাল থেকে চারদিনের ছুটি ম্যানেজ করতে পেরেছে। হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা তার বাবা হলেও সে বাকি সব ডাক্তারদের মতো সব নিয়মকানুন মেনেই চলে। ওয়াহিদ একটু কাজে বাইরে গিয়েছিল। ঘরে এসে দেখে ঝুমুর আগে থেকেই রেডি হয়ে বসে আছে। ঝুমুর একটা লং টপস পড়েছে আর লম্বা চুলগুলোকে ঝুঁটি করে নিল। সকাল সাতটায় বাস ছাড়বে তাই ভোর সাড়ে ছয়টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত বাসে যাওয়ার টিকিট আগেই কাঁটা ছিল। ঝুমুরকে বাসে বসিয়ে রেখে ওয়াহিদ বাহিরে যায়। কিছুক্ষণ পর হাত ভর্তি চিপস,চকলেট,জুস নিয়ে ফিরে আসে। ঝুমুর এত কিছু দেখে বলে,
“এগুলো কে খাবে?”

“কেন তুমি।”

“আমাকে কি আপনার রাক্ষস মনে হয় নাকি? এতকিছু এনেছেন কেন?”

ওয়াহিদ কিছু বললো না।
“বাস একেবারে খাগড়াছড়ি গিয়ে থামবে। এর আগে যদি কোথাও থামেও কোন দোকান পাবো বলে মনে হয় না, তাই নিয়ে এলাম। যখন মন চায় খাবে।”

ঝুমুরদের বাস খাগড়াছড়ি গিয়ে থামল দুপুর দুইটায়। বাস থেকে নেমে ওয়াহিদ ঝুমুরকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যায়। হাত মুখ ধুয়ে দুজনেই দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়। খাওয়া দাওয়া শেষ করে প্রায় একঘন্টা পর ওয়াহিদ একটা চান্দের গাড়ি ঠিক করে ঝুমুর কে নিয়ে উঠে পরলো। ছাঁদ খোলা গাড়িটির নাম চান্দের গাড়ি। খোলা ছাদ দিয়ে আকাশ দেখা যাবে বলেই হয়তো এই নাম দেয়া হয়েছে। তাদের সাথে আরে চার পাঁচ জন যাত্রী ছিল। প্রায় ঘন্টাখানেকের পথ পাড়ি দিয়ে খাগড়াছড়ি থেকে দিঘানালায় পৌঁছালো তারা। তারপর সেখানে কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে গাড়ি ছুটলো সাজেকের উদ্দেশ্যে। সবুজ পাহাড়ের বুকে আঁকাবাঁকা পিচ ঢালা পথ। সেই পথের দুই পাশে শুধুই সবুজের সমারোহ। বাতাসে ঢেউ খেলে যাচ্ছে লম্বা লম্বা ঘাস গুলো। পাহাড়ের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষরাজি গুলো দেখলে মনে হয় যেন এক একটা সৌন্দর্যের নিদর্শন। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে আদিবাসীদের ছোট ছোট ঘরবাড়ি। গাড়ি যতই সামনে এগোচ্ছে ততই যেন নীল-সাদায় মোড়া আকাশটা হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে আঁকাবাঁকা ঢেউ খেলানো রাস্তার উচ্চতা সেইসঙ্গে যেন কমছে আকাশের সঙ্গে দূরত্ব। অদূরে ঐ আকাশের গায়ে যেন পাহাড় ঢলে পড়েছে। পেজা তুলোর মতো মেঘগুলো যেন চাইলেই হাতের মুঠোয় আটকে ফেলা যাবে। ঝুমুর এসব নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কখন যে উঠে দাঁড়িয়েছে তা ঠিক জানে না। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইলো একটুকরো মেঘখন্ড। ওয়াহিদ ঝুমুরের এতো খুশি দেখে তৃপ্ত হয়। অদূর পাহাড়ে শুভ্র মেঘের খেলা দেখতে দেখতে ঝুমুররা পৌঁছল সাজেক ভ্যালি।

সাজেক ভ্যালি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল পাঁচটা বেজে গেল।কংলাক পাড়ায় আগে থেকেই ওয়াহিদদের রিসোর্ট বুক করা ছিল। সেখানেই উঠল দুজন। ‘মেঘপুন্জি’ রিসোর্টটা নামটা যেমন সুন্দর তার চেয়েও বহুগুণ সুন্দর তার চাক্ষুষ সৌন্দর্য। উঁচু পাহাড়ের বুকে গড়ে উঠেছে এই রিসোর্ট। ছোট ছোট পাখির বাসার মতো কতগুলো ঘর। হ্যাঁ ঠিক যেন পাখির বাসা ই , ঘরের দেয়াল থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত পুরোটাই ছনের। ঝুমুর হা হয়ে তাকিয়ে দেখছে সবকিছু। রিসোর্টটার খোলা বারান্দায় দাঁড়ালে কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হবে যেন মেঘের সমুদ্র। সেই সমুদ্রের বুকে মাথাচড়া দিয়ে উঠেছে কিছু বৃক্ষরাজি। ঝুমুর মেঘ দেখতে দেখতে খোলা বারান্দাটার একদম কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল।
ওয়াহিদ এসে হাত ধরে বলল,

“এই কোথায় যাচ্ছ? তোমার কি মনে হচ্ছে নিচে মাটি? এই পাহাড়ের উচ্চতা কত তোমার কোন আইডিয়া নেই। এত কিনারায় যাবে না বুঝেছ। এখন চলো ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করো, কালকে সকাল থেকে ঘুরতে যাব।”

ঝুমুর ওয়াহিদের সব কথা শুনলো কিনা কে জানে! শুধু বলল,
“কাল কেন? আজকেই যাই।”
“এখানে রাতে বাহিরে যাওয়া তেমন ভালো না। আর দেখার মতো তেমন কিছু না থাকবে না রাতে গাড়িও পাওয়া যাবে না তাই সকালেই যাব। একদম ভোরে উঠলেই তুমি দেখতে পাবে আসল সৌন্দর্য।”
“ওহ আচ্ছা তাহলে সকালেই যাব।”
“হুম এখন রুমে আসো।”
.
.
.
‘হ্যালো।’
‘হুম বল?’
‘কেমন আছিস?’
‘এইতো ভালোই। তুই?’
‘তুই? হুম ভালোই।’
তো কি বলবো,’ওগো শুনছো?’
আদিল খাট কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো। বলে,
‘ওই মামা না প্লিজ! তুই ই চলবে।’
কেয়াও হাসতে হাসতে বলে,’ হুম।’
আদিল বলে,’ তুই ঢাকা কবে যাচ্ছিস?
‘এই তো আরো দুদিন পর।’
‘ও আচ্ছা। তাহলে কালকে বিকালে বাইরে যাবি?’
‘কেন?’
‘ আমাদের শহরটা একটু ঘুরে দেখাইতাম আরকি। পরে তো ঠিক ই খোটা দিবি। আর আম্মাও বললো তোর সাথে দেখি দেখা করবো। আমাদের বাড়িতেও নিয়া আসবো ঘুরে যাবি।’
কেয়ার ফোনের ওপাশে মিটমিটিয়ে হাসে। আদিলের ঘুরে দেখানোর বাহানা সে ভালই বুঝতে পেরেছে। মুখে বলে,
“আচ্ছা গেলাম না হয় কিন্তু খালাকে কি বলবো?’
‘বলবি তোর কোনো বান্ধবীর সাথে যাচ্ছিস।’
‘আরে আজব! এইখানে আমার বান্ধবী আসবে কোথা থেকে?’
আদিল কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর হঠাৎ বলে,
‘আইডিয়া! সব হয়ে যাবে শুধু কালকে বিকালে রেডি থাকিস।’

কেয়া কিছুই বুঝলো না কি করবে আদিল। তবুও বললো,
‘আচ্ছা।’

চলবে…