#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_১৯
লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম
সকাল সকাল আফরার ঘুম ভাঙলো কর্কশ ফোনের শব্দে। ফোনের অপর পাশের মানুষটা মা ছাড়া আর কেউ না। আর কিছুক্ষণের মধ্যে কলটা না রিসিভ করলে মা নির্ঘাত ফোনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে। ফোন কানে উঠিয়ে ঘুমঘুম কন্ঠে বলতে থাকে,
“কেমন আছো মা?”
“এই তুই এখানো ঘুমাচ্ছিস? বেলা কয়টা বাজে সেই খবর আছে? এগারটা বাজতে চললো নাস্তা করবি কখন?”
“উফ মা আজকে শুক্রবার। আজকে ঘুমাবো না তো কোনদিন ঘুমাবো?”
“হ্যাঁ তাই কর।পরে তো আছিস সেই শহরে, কি খাচ্ছিস কি করছিস কিছুই দেখছি না। কত করে বলি বাড়িতে চলে আয় তাও আসছিস না।”
“তুমি কি চাচ্ছ আমি আর পড়াশোনা না করি? বাড়িতে এসে করবো টা কি আমি? প্লিজ এখন অন্তত বিয়ের কথা বলো না। ”
“এই শোন না একটা ভালো কথা মনে করেছিস। তোর জন্য একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে। ছেলেটা খুব ভালো, নেভিতে চাকরি করে। তুই সামনের সপ্তাহে একবার বাড়িতে আয় না। আমি তো বিয়ে করতে বলছি না অন্তত একবার দেখে যা। পরে যদি ভালো লাগে সেটা অন্য কথা।”
“আচ্ছা মা তোমার কাছে কি এই বিয়ে ছাড়া আর অন্য কোন কথা নেই? আমি বিয়ে করবো না এমন তো না, আর কিছুটা দিন যাক। তুমি যেই ছেলেকে নিয়ে আসবে তাকেই বিয়ে করে ফেলব।”
“আচ্ছা দেখ। তুই যা ভালো মনে করিস।”
“হুম।”
“এখন কি নাস্তা বানাবি নাকি একেবারে দুপুরের রান্না করবি?”
“দেখি কি করা যায়। নতুন বাসায় তো বাজার ও নেই।”
“নতুন বাসা মানে? বাসা বদলেছিস নাকি? কই কাল তো কিছু বললি না?”
“আরে তেমন কিছু না ওই বাসা থেকে ভার্সিটিতে যাওয়া আসা করতে একটু অসুবিধা হতো তাই অন্য বাসা নিয়েছি।”
“ওহ।”
“হুম। বাবা আর আয়রা কেমন আছে? বিচ্ছুটা পড়াশুনা করছি তো ঠিকঠাক মতো?”
” বিচ্ছু আগের মতোই আছে। স্কুল, প্রাইভেট যাওয়া ছাড়া আর পড়াশোনার সাথে তার সম্পর্ক নেই।”
“আর বাবা?”
বাবার কথা জিজ্ঞেস করাতে থেমে গেল আফরার মা। কি বলবেন স্বামীর কথা? বলবে যে একটু আগেই তার সাথে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“হ্যাঁ ভালোই আছে।”
আফরা নিজেই তার বাবার সম্বন্ধে জানে। তাই মাকে আর বেশি ঘাটলো না।
“আচ্ছা এখন রাখছি। খিদেয় পেট চো চো করছে। কিছু একটা রান্না করতে হবে।”
“আচ্ছা সাবধানে থাকিস। আর টাকা লাগলে বলিস পাঠিয়ে দিব।”
“হুম আচ্ছা। নিজের খেয়াল রেখো।”
*
পরের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই ওয়াহিদ আর ঝুমুর ওদের রিসোর্ট থেকে সকালের নাস্তা শেষ করে কংলাক পাড়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। কংলাক পাড়া হচ্ছে কংলাক পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু স্থান। সেখানে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা,ঘরবাড়ি, দোকানপাট সবকিছুই ছিল বৈচিত্র্যময়। ওয়াহিদ সেখান থেকে ঝুমুরের জন্য নীল রঙের একটা তাঁতের শাড়ি নিল। দুপুরের আগেই দুইজন আবার কটেজে ফিরে আসে। সকাল থেকে পাহাড়ে হাটাহাটির ফলে দুইজনেই বেশ ক্লান্ত হয়ে যায়। ওয়াহিদ রুমে ঢুকেই ফ্রেশ হতে চলে যায়। ঝুমুর ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখছে ওয়াহিদের কেনা সেই শাড়িটা। এতো সুন্দর কারুকাজ করা শাড়িটার উপর। যে কারোর চোখ আটকে যেতে বাধ্য। ঝুমুর শাড়িটাকে গায়ের উপর জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিল।
ওয়াহিদ সেই সময় বের হলো ওয়াশরুম থেকে। শরীরের উন্মুক্ত অধাংশে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। অর্ধভেজা টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে ঝুমুরের কাছে গিয়ে বলে,
“আজকে এই শাড়িটাই পরো।”
“আজ কি আর কোথাও যাবো?”
ওয়াহিদ ভেজা হাতটাকে ঝুমুরের গালে ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
“এতটুকুতেই ক্লান্ত হয়ে গেলে নাকি? ঘুরার জন্য না এতো লাফালাফি করছিলে?”
“ক্লান্ত হবো কেন আমি তো এমনিই বলছিলাম।”
“ওহ আচ্ছা। হলেও সমস্যা নেই তোমার সকল ক্লান্তি দূর করতে তোমার ডক্টর হাসবেন্ড তো আছেই।”
“মানে?”
একজোড়া হাত ঝুমুরকে বেঁধে নিল নিজের সাথে। সেই সাথে বন্ধ হয়ে গেল দুজনের ওষ্ঠদ্বয়। ঝুমুর খামচে ধরলো ওয়াহিদের খোলা পিঠ। ওয়াহিদের ভেজা শরীরের স্পর্শে কেঁপে উঠছে ঝুমুরের সবাঙ্গ। কিছু সময় পর ওয়াহিদ ঝুমুররকে ছেঁড়ে দিয়ে এক চোখ টিপে দিয়ে বলল,
“বুঝলে কেমন ক্লান্তি?”
ঝুমুর হাতের শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। প্রায় আধঘন্টা সময় নিয়ে গোসল শেষ করলো। শাড়ি পড়তে গিয়ে দেখলো তাড়াহুড়োয় শুধু শাড়িটা নিয়েই চলে এসেছে। ওয়াহিদকে বাকি জিনিসগুলো দেয়ার কথা বলতে হবে লজ্জা পাচ্ছে ভীষণ।
ওয়াশরুমের দরজা খুলে মাথায় কিছুটা বের করে দেখলো রুমে ওয়াহিদ নেই। তাই ভেজা কাপড় পড়েই বাকি কাপড়গুলো নিয়ে আবার দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
ভেজা চুলে গামছা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বেরিয়ে আসলো ঝুমুর। রুমে এসে দেখলো ওয়াহিদ খাবার নিয়ে বসে আছে। বারান্দায় গিয়ে ভেজা কাপড় গুলো ছড়িয়ে দিয়ে এসে বলল,
“আমরা কি এখন রুমেই খাব?”
“হ্যাঁ এখন বাহিরে অনেক মানুষ। এতো সামনে খেতে তুমি আনইজি ফিল করবে তাই রুমেই নিয়ে এলাম।”
“ওহ।”
“হুম এখন আসো খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
ঝুমুর গিয়ে বসলো ওয়াহিদের পাশে। খাবার গুলো দেখে অনেক অবাক হলো কারণ এখানেবেশিরভাগ খাবার বেশি প্রথম দেখছে।
ঝুমুর কিছু বলার আগে ওয়াহিদ একটা করে খাবার দেখিয়ে বলে,
“এগুলো হচ্ছে ব্যাম্বো চিকেন, হাসের মাংস,লাউ চিংড়ি, কলা ভর্তা,ডাল আর জুম শাক। ব্যাম্বো চিকেন সকালেই অর্ডার করে রেখেছিলাম। এখানে এটার এত ডিমান্ড যে পাওয়াই যায় না। খেতে এত টেস্টি ডিমান্ড হওয়ারই কথা। এই দেখো তুমি ফ্যান হয়ে যাবে। আমি যখনই আসতাম প্রতিদিন এটাই খেতাম।”
“আপনি এখানে আগেও এসেছেন?”
“হ্যাঁ আমাদের মেডিকেল ক্যাম্পিং এর জন্য আগে দু-তিনবারবার আসা হয়েছিল। তাই জন্যই তো এখানকার অনেক জায়গাই চেনাজানা।”
“ওহ।”
ঝুমুর ভাত নিতে গিয়ে দেখল ওয়াহিদ একটাই প্লেট নিয়ে এসেছে।
” প্লেট একটাই যে? আচ্ছা আপনি খেয়ে নিন তারপর আমি খাব। বলে ঝুমুর খাটে বসলো।
ওয়াহিদ কিছু না বলে প্লেটে ভাত নিয়ে ঝুমুরের সামনে বসলো। প্রথম লোকমাটা ঝুমুরের সামনে বাড়িয়ে দিল। ঝুমুর তাকিয়ে রইল ওয়াহিদের দিকে।
“কি হলো খাও।”
“আপনি খাবেন না?”
“হ্যাঁ একসাথেই খাবো।”
ঝুমুর কিছু না বলে ভাত মুখে নিল। দু’জনে এক প্লেটে খেয়ে উঠলো। ওয়াহিদ হাত ধুয়ে এসে একজনকে কল করে বলল ভাতের প্লেটগুলো নিয়ে যেতে।
ওয়াহিদ বলল ,”চলো বারান্দায় যাই।”
ঝুমুর খোলা বারান্দায় গিয়ে দোলনায় বসলো। ওয়াহিদ পিছন থেকে হালকা ধাক্কা দিচ্ছে। খুশিতে ঝুমুরের মনে প্রজাপতি উড়ছে। সবকিছু এতো সুন্দর লাগছে কেন? আসলেই কি সব এতটা সুন্দর? নাকি তার পাশের মানুষটার জন্য সব এত সুখময় হয়ে উঠেছে?
*
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর রিনির কাছ থেকে একটা শাড়ি চেয়ে নিল কেয়া। রিনি তো বারবার জিজ্ঞেস করছি শাড়ি দিয়ে কি করবে? কোথাও যাচ্ছে নাকি? কিন্তু কেয়া কিছুই বলল না। ওদের কথার মাঝেই বাড়ির কলিং বেল বাজলো। রিনি গিয়ে দরজা খুলে দিল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল পলি। রিনিকে দেখা মাত্রই পলি বলে উঠলো,
“কেয়া আপু কোথায়? আমি ওনার সাথে দেখা করতে এসেছি।”
রিনি বলে,
“কেয়ার সাথে দেখা করতে এসেছ? ওকে তুমি কিভাবে চিনো?”
কেয়া দরজায় চিনির সাথে কারো কথা বলতে শুনে এগিয়ে গেল। পলিকে দেখে চরম আশ্চর্য হলো কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
“আরে রিনি আপু ওকে আমিই আসতে বলেছি। ঐদিন আমার বন্ধুর সাথে কথা বললাম না তোমাকে? পলি ওরই বোন হয়।”
“ওহ। ভেতরে এসে বসো।”
পলি ঘরের ভেতরে ঢুকে বলল,
“আমি বেশিক্ষণ বসবো না আপনি রেডি হয়ে আসুন।”
রিনি বলে,
“রেডি হয়ে আসবে কেন?”
“আপু আপনাকে বলেনি যে উনি আমাদের বাড়িতে যাচ্ছেন। আমার মা বলেছে কেয়া আপুকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে।”
“কিরে কেয়া সত্যি নাকি?”
“আসলে আপু হ্যাঁ। আদিলের আম্মু আসার সময় আমার সাথে দেখা করতে পারেনি তাই বলেছি যে উনার সাথে দেখা করতে একটু যেতে। আমিও ভাবলাম যাই অনেকদিন আন্টির সাথে দেখা হয় না।”
“ওহ আচ্ছা। তো কি একাই যাবি? নাকি ভাইয়া দিয়ে আসবে?”
“নাহ ও তো আছেই যেতে পারবো।আর আসার সময় আদিলকে বলবো গাড়িতে উঠিয়ে দিতে।”
“আচ্ছা রেডি হয়ে নে।”
রিনি ড্রয়িংরুমে বসে পলির সাথে টুকটাক কথা বললো। প্রায় বিশ মিনিট পর কেয়া একটা আকাশি রঙের শাড়ি পড়ে বের হয়ে আসলো। কেয়াকে দেখে রিনি কপাল কুঁচকে বললো,
“এতো সেজেছিস যে?”
“কই এত সেজেছে শুধু শাড়িই তো পড়েছি।”
“হ্যাঁ। কিন্তু তোকে খুব সুন্দর লাগছে আজ।”
কেয়া মুচকি হেসে বললো,
“থ্যাঙ্ক ইউ।”
“আচ্ছা সাবধানে যা। আর তাড়াতাড়ি চলে আসবি।”
কেয়া রিনিকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু দিয়ে বলে,
“ওকে মাই সুইট সিস্টার।”
কেয়া পলির সাথে বের হলো ঠিকই কিন্তু তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য কিছু।
“পলি ওকে নিতে এসেছে? এটাও সম্ভব নাকি?”
চলবে….
#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_২০
#লেখিকা:তাসফিয়া আনজুম
কেয়া আর পলি বাড়ির গেইটের সামনে এসে দেখলো আদিল বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদিলকে দেখেই পলি দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। সামনে গিয়ে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ এখন চলেন। আমি তো ওনাকে নিয়ে এসেছি।”
“কোথায় যাব?”
“কেন আদিল ভাই আপনি না বললেন এই আপুকে বাড়ি থেকে বলে নিয়ে আসলে আপনি আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবেন?”
কেয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো আদিলের দিকে।
“ওহ হ্যাঁ যাব তো। কিন্তু ওকে আগে দিয়ে আসি ওর প্রেমিকের কাছে। আর চোখে চোখে কেয়ার দিকে তাকিয়ে বলে আদিল।
কেয়ার চোখ তো পারছেনা কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। মনে মনে ভাবছে,
“পাগল হয়ে গেল নাকি! কি সব বলছে?”
পলির চোখে মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে।
“ওনাকে কেন দিয়ে আসতে হবে? উনি কি একা যেতে পারবে না?”
“নাহ। ও এই শহরে নতুন এখানকার কিছুই চিনে না। তুমি এখন বাড়ি যাও।”
পলি আর কিছুই বলল না। রাগ করে সেখান থেকে চলে গেল।
কেয়া বাইকের পিছনে উঠে বসলো। আদিল পিছনে তাকিয়ে বলল,
“শাড়ি ঠিক করে বস। না হলে দুইজনে একসাথে ওপারে টপকে যাবো।”
কেয়া হেসে শাড়ির আঁচলটা সামনে নিয়ে আসলো। আদিল বাইকের গতি কমিয়ে রাখলো। বিকেলের শীতল বাতাসে গা হিম হয়ে আসলো কেয়ার। অনেকক্ষণ ধরেই কেয়া আদিলকে কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বাতাসের শব্দে সেসব আদিলের কান পর্যন্ত যাচ্ছে না। আদিল কিছুটা পেছনের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে বলে,
“কি বললি? শুনতে পাচ্ছিনা জোরে বল!”
“তুই মেয়েটাকে মিথ্যা বললি কেন?”
“কই মিথ্যা বললাম?তোকে তোর প্রেমিকের কাছে দিয়ে আসতে যাচ্ছি না?।”
কেয়া জোরে আদিলের পিঠে একটা থাপ্পর বসাল।
“উফ। মারলি ক্যান বেয়াদব? এইজন্যই মানুষের উপকার করতে নাই।”
“ওরে বাবা! আসছে আমার মানবতার ফেরিওয়ালা!”
আদিলের এবার বাইক ছুটলো হাওয়ার গতিতে। কেয়ার শেষ কথাটা শুনল কিনা বোঝা গেল না।
আদিল আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় যাবি?”
“তুই যেখানে যাবি।”
আদিল চেঁচিয়ে বলে,”জাহান্নামে যাচ্ছি! যাবি?”
কেয়া আবার ঘুষি মেরে দিল আদিলের পিঠে।
আদিল ছ্যাত করে উঠলো,
“ওফ! কথায় কথায় হাত নড়ে ক্যান? তুই ই তো বললি আমি যেখানে যাব সেখানেই যাবি।”
*
সাজেকে তখন সন্ধ্যা নামার আগ মুহূর্ত। বিকেলের কিছু সময় আগে ঝুমুর আর ওয়াহিদ বেরিয়েছিল কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। সাজেকের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে পুরো সাজেক উপত্যকার সৌন্দর্য অনুভব করছে তারা। নীলাম্বরে তখনো চলছে শুভ্র মেঘের আনাগোনা। ধীরে ধীরে রক্তিম সূর্য লুকিয়ে পড়লো মেঘের আড়ালে।এমন দৃশ্য দেখে ঝুমুরের চোখে মুখে ফুটে উঠে একরাশ মুগ্ধতা। ওয়াহিদের সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই,সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল তার তৃপ্ত বধূর মুখপানে। ধীরে ধীরে যখন অন্ধকার নেমে আসলো কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় এখন তারা পাহাড় থেকে নেমে আসলো। ‘চান্দের’ গাড়িতে একসাথে আসা সবাই ঠিক করলো পাহাড়ে আজকে রাতে তাঁরা পাহাড়ে বারবিকিউ পার্টি করবে। আর সেই বারবিকিউ করা হবে পাহাড়ি হাঁসের মাংস দিয়ে।
*
কনকনে ঠান্ডায় আগুন জ্বেলে তার পাশে বসে আছে ঝুমুর। সাথে বসে আছে আরো সাত, আটজন। ওয়াহিদ ধোঁয়া ওঠা দুই কাপ গরম চা নিয়ে বসলো ঝুমুরের পাশে। পাশ থেকে ভেসে আসছে গিটারের সুর কেউ কেউ সেই সুরে তাল মিলিয়ে গান গাইছে। ওয়াহিদকে দেখে ঝুমুর দু হাতের তালু ঘষে গাঁয়ের চাদরটা আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে নিতে নিতে বলে,
“উফ কি ঠান্ডা! আপনার ঠান্ডা লাগছে না? শুধু শার্ট পরেই তো চলে আসলেন।”
“লাগলে কি তুমি তোমার চাদরের ভাগ দিবে?”
ওয়াহিদের কথা শুনে ঝুমুর আশেপাশে তাকালো। লজ্জায় কিছু না বলে চায়ের কাপে চুমুক বসালো। কিছুক্ষণ পর তাদের সাথে বসে থাকা একটা ছেলে ওয়াহিদকে একটা গান গাওয়ার অনুরোধ করলো। অনেক জোরাজুরির পর ওয়াহিদ একটা গান ধরলো,
তুমি বৃষ্টি চেয়েছো বলে
কত মেঘের ভেঙ্গেছি মন,
আমি নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি।
তুমি যাওনি কিছুই বলে
আজও পাল্টে ফেলিনি মন,
শুধু নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি,
তুমি জানতেই পারো না তোমায়
কত ভালবেসেছি, ওও…
তুমি জানতেই পারো না তোমায়
কত ভালবেসেছি।
তুমি বৃষ্টি চেয়েছো বলে
কত মেঘের ভেঙেছি মন,
আমি নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি।
তুমি যাওনি কিছুই বলে
আজও পাল্টে ফেলিনি মন,
শুধু নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি।
তুমি জানতেই পারো না তোমায়
কত ভালোবেসেছি, হুম…
তুমি জানতেই পারোনা তোমায়
কত ভালোবেসেছি।
গান শেষ হতেই উচ্ছাসে মুখরিত হয়ে উঠলো চারপাশ। ঝুমুর অপলক তাকিয়ে রইল ওয়াহিদের দিকে।
“আপনি এত সুন্দর গান গাইতে পারেন?”
“কই এত সুন্দর! তুমি মন থেকে অনুভব করেছ বলেই হয়তো ভালো লেগেছে।”বলেই হাসলো ওয়াহিদ।
ঝুমুর ওয়াহিদের কাঁধে মাথা রাখলো।
“তাহলে আমি প্রতিদিন মন থেকে অনুভব করতে চাই, সেই সুযোগ কি দিবেন আমাকে?”
ওয়াহিদ হেঁসে উঠল। নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
“জো আপকি মার্জি মেরি বেগম।”
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে যে যার মত রিসোর্টে চলে গেল। শুধু বসে রইল ওয়াহিদ আর ঝুমুর। এই কনকনে ঠান্ডায় শুধু ওয়াহিদের কথায় এখনো বসে রইলো ঝুমুর। পাহাড়ের মাঝে জ্বালিয়ে রাখা লাকড়ি গুলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মানুষে পরিপূর্ণ জায়গাটা ফাঁকা হতেই ওয়াহিদ টুপ করে ঝুমুরের চাদরের নিচে ঢুকে পড়লো। ঝুমুর কিছু বলার সুযোগই পেলো না। আরো প্রায় আধা ঘন্টার একসাথে মত বসে থেকে রাত প্রায় বারোটার দিকে দুজনে রুমে ফিরলো। রুমে ঢুকেই দু’জনেই গোসল করে নিল, সারাদিন পাহাড়ে ঘোরাঘুরির কারনে ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। ঝুমুর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ওয়াহিদকে রুমে না দেখতে পেয়ে বারান্দায় যায়। ওয়াহিদ বারান্দায় বেতের সোফায় বসে আছে। ঝুমুরের পায়ের শব্দ পেয়ে টেনে নিয়ে ওকে কাছে বসিয়ে দিল ওয়াহিদ। পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে পিঠ ছুঁতেই টের পেলেও ঝুমুরের চুলগুলো ভেজা।
“তুমি তো ভালো করে চুল মুছলেও না। যাও তোয়ালেটা নিয়ে এসো আমি মুছে দেই। এমনিতেই রাতে গোসল করেছ পরে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
ঝুমুরকে না নড়তে দেখে নিজেই গিয়ে রুম থেকে তোয়ালে নিয়ে এসে ঝুমুরের পেছনে দাঁড়িয়ে সযত্নে চুল মুছে দিল। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে ঝুমুরের। হঠাৎ ওয়াহিদ ঝুমুরকে কোলে তুলে নিল। ওয়াহিদ হাসতে হাসতে বলে,
“কোলে ওঠার শখ হয়েছে তা মুখে বললেই পারতে।”
ঝুমুরের ঘুম ঘুম চোখ পুরোপুরি খুলে গেল।
“কি বললেন আমি আপনার কোলে উঠতে চেয়েছি? আর আমার ঘুম ধরেনি।”
ওয়াহিদ আশ্চর্য হওয়ার ভান করল।
ঝুমুরকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে ,”ও আচ্ছা তাহলে কি চেয়েছো? চুমু খেতে?”
ঝুমুর ওয়াহিদের সাথে কথায় পেরে উঠলো না। লজ্জায় মুখ রক্তিম হয়ে উঠছে। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লো। আচমকা ওয়াহিদ আবার হাত টেনে বসিয়ে দিল তাকে।
” এই তুমি না মাত্রই বললে তোমার ঘুম আসেনি। সো এখন ঘুমানো যাবে না।”
ঝুমুর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।
“ঘুমাব না তো কি করব? হা-ডু-ডু খেলবো?”
ওয়াহিদ ঝুমুর কে টান দিয়ে নিজের উপর ফেলে দেয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“তোমার ইচ্ছা, তুমি চাইলে খেলতেই পারো! তবে আমি কিন্তু তোমার পার্টনার হতে রাজি।”
ঝুমুর ফের লজ্জায় নুইয়ে পড়লো। ঝুমুরের সারা মুখ উষ্ণ আদরে ভরিয়ে তুললো ওয়াহিদ। কাঁপা ওষ্ঠজোড়ায় নিজ ওষ্ঠের সন্ধি ঘটালো। এভাবেই কেটে গেল প্রনয়ের আরেকটি রাত।
*
সকালে ঝুমুরের ঘুম ভাঙলো ঠান্ডা বরফ খন্ডের স্পর্শে। চোখ খুলে দেখে এটা কোনো বরফখন্ড নয় বরং জলজ্যান্ত একজন মানুষের হাত। ওয়াহিদ তার সদ্য ভেজানো ঠান্ডা হাত দুটো ঝুমুরের গালে চেপে ধরে রেখেছে। ঝুমুর গাল থেকে ওয়াহিদের হাত দুটো সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল।
” উফ কি ঠান্ডা! হাত সরান।”
ওয়াহিদ হাত সরিয়ে নিল। হাসতে হাসতে বলে উঠে,
“তোমাকে ঘুম থেকে উঠানোর নতুন টেকনিক পেলাম। এখন থেকে ঘুম থেকে না উঠলেই এই থেরাপি চলবে।”
“ইশ আসছে আমার থেরাপি নিতে! যান গিয়ে নিজের রোগীদের থেরাপি নেন।” বলতে বলতে বিছানায় বসে অগোছালো চুলগুলোকে হাতের মুঠোয় নিয়ে বাঁধলো। ওয়াহিদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সবচেয়ে সাধারণ তবে সুন্দর দৃশ্যটা দেখলো।
“তুমি জানো সকালের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কি?”
“কি?”ঝুমুর আগ্রহের সাথে জানতে চাইল।
“তোমার চুল বাধার দৃশ্য।”
ঝুমুর কিছু বলবে তার আগেই ওয়াহিদের ফোনটা বেজে ওঠে। ফোন কানে নিয়ে বারান্দায় চলে যায় ওয়াহিদ। কয়েক মিনিট কথা বলে রুমে এসে ঝুমুরকে বলে,
“তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নাও।আমরা এখনই ফিরে যাব।”
“আজকে যাবো? আমাদের না কালকে যাওয়ার কথা ছিল?”
“হ্যাঁ আজকেই।”
ঝুমুর তখনই ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“বাড়ির সবাই ঠিক আছে তো?”
ওয়াহিদ কিছু সময় চুপ করে থেকে বলে,
“সামিয়া ভাবী সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে।”
চলবে….