প্রেমময়ী সন্ধ্যা পর্ব-২১+২২

0
3

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_২১
লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম

সকাল সকাল মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে মন চাইছে আফরার। আজ তার ভার্সিটির প্রেজেন্টেশন। আর সেখানে সবাইকে বাধ্যতামূলক শাড়ি পড়ে যেতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখন তার কাছে পড়ার মতো একটা শাড়িও নেই। ক্লাস শুরু হতে আর মাত্র দেড় ঘন্টা বাকি। এই এতটুকু সময়ের মধ্যে কখন শাড়ি কিনবে আর কখন রেডি হবে ভাবতেই মাথা খারাপ হয়ে গেল আফরার। আর কারো কাছে যে চাইবে এমন পরিচিত ও কেউ নেই এই শহরে তার। পরে অনেক ভেবেচিন্তে লজ্জা কাটিয়ে বাড়িওয়ালার বউয়ের কাছ থেকে চেয়ে একটা শাড়ি নিয়ে আসলো।

আকাশি জমিনে সোনালী রঙের ছোট ছোট কাজ করা একটা জামদানি শাড়ি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে আফরা।
শুনতে হাস্যকর লাগলেও এই একুশ বছরের বছরের জীবনে দ্বিতীয় বার শাড়ি পড়ছে সে।প্রথমবার পড়েছিল এক মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে। সেবার শাড়ি পরে যা কান্ড ঘটিয়েছিল, সেই ভয়ে আর কোনদিন শাড়িই পড়েনি। শাড়ি কিভাবে পড়তে হয় সেটাও জানে না, ইউটিউব দেখে কোনরকম পড়ে নিল। কিন্তু হাঁটতে গেলেই হচ্ছে বিপত্তি পা বাড়ালেই শাড়ির সাথে আটকে পড়ে যাচ্ছে বারবার। সেসবে আর পাত্তা না দিয়ে অল্পসল্প সেজে নিল। একহাতে আকাশী রঙের ভেলভেট চুরি, অন্য হাতে একটা ঘড়ি পরে নিল। পিঠের একটু নিচ পর্যন্ত আঁকাবাঁকা চুলগুলোকে ছেড়ে দিল। মুখে একটুখানি প্রসাধনী লাগালো। চাইলেও এরচেয়ে বেশি সাজতে পারবে না কারণ তার কাছে সাজগোজের জিনিস বলতে আছেই শুধু পাউডার, লিপস্টিক, একটা কাজল আর একটা কালো টিপের পাতা। এই অল্প সাজেই ফর্সা গুলুমুলু মুখটা ভীষণ মায়াবী দেখাচ্ছে। আয়নায় নিজেকে একবার দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

*

নীরবের মন সকাল থেকেই ফুরফুরে আজ। কারন গতকাল রাতেই বাবার একাউন্ট থেকে টাকা এসেছে।এতোদিনে মনের মধ্যে যেন একটা রাজা রাজা ভাব এসেছে। আলমারি খুলে একটা কুঁচকানো শার্ট পড়ে নিল।গলা ছেড়ে গান গাইতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। কাল থেকে কলেজ খোলা থাকবে চাইলেও আর এইসময় ঘুরতে পারবে না। আজ নাহয় একটু আড্ডা মেরে আসা যাক। বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তার সামনে এসে সকাল সকাল এক বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে মুখ হা হয়ে গেল। শাড়ি পড়ে সেজেগুজে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে আফরা। হয়তো গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। আদিল সেদিকেই এগিয়ে গেল। আফরা নিচের দিকে তাকিয়ে মোবাইল চালাচ্ছিল বলে আদিলকে দেখতে পেল না।

“বাহ! দুই দিন ধরে আমার সাথে শুধু ভালোই হচ্ছে। আজকাল সকাল সকাল পরীদের সাক্ষাৎ ও পাচ্ছি।”

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে আফরা মাথা তুলে তাকাল। নীরবকে দেখে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল। মুখটা দেখে মনে হচ্ছে যেন সে প্রচন্ড বিরক্ত নীরবের উপর। নীরবের্র হঠাৎ মনে হলো তাদের মাঝে কি এরকম কিছু হয়েছিল যে সিনিয়র আপু তার উপর রেগে আছে? পরক্ষণেই মনে পড়ল দুই তিনদিন আগে তার আফরাকে রাগিয়ে দেওয়ার কথা। সেই দিনের পর আর দেখাই হয়নি তাদের। মুখে হাসির রেখা টেনে আফরাকে জিজ্ঞেস করল,
“কোথাও যাচ্ছেন নাকি?”

আফরার কপালের ভাজ আর একটু গাঢ় হলো,
“না ঘুমাচ্ছি!”

নীরব এবার শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বলল,
” আরে কি বলছেন! আপনার তো গিনেস বুকে নাম লেখানো উচিত!মানুষ হয়েও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছেন। এমন প্রতিভাও কারোর হয় নাকি?”

আফরা রেগে গিয়ে হাতের তর্জনী নিরবের মুখের সামনে ধরে বলে,
” এই ছেলে তোমার সমস্যা কি?দেখছো যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি তখন নিশ্চয়ই কোথাও যাচ্ছি, তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছো কেন? মেয়ে দেখলেই খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে তাই না?”

নীরব মাথা চুলকে পিচ ঢালা রাস্তার দিকে তাকায়। আবার আফরার দিকে তাকিয়ে বলে,
” নাহ শুধু আপনাকে দেখলেই কথা বলতে ইচ্ছা করে। আমার মনে হয় আপনার আর আমার মধ্যে কিছু একটা আছে। এই যেমন বিপরীত জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ।”

আফরা চেঁচিয়ে উঠলো।
” কি বললে!”

নীরব হতচকিত হয়ে যায়।
” এই ধরুন আমি পানি আর আপনি আগুন। আপনাকে দেখলেই মনে হয় যাই একটু হিট নিয়ে আসি। কিন্তু কথায় যা ঝাঁজ, শুধু হিট কেন একদম জ্বলে যাই।”

নীরবের কথার মাঝেই একটা অটো এসে থামল তাদের সামনে। আফরা হাত বাড়িয়ে অটো থামিয়ে তাতে উঠে পড়ল। গাড়ি ছাড়তেই নীরবও চট করে উঠে বসে পড়লো আফরার পাশে।আফরা আবার চেঁচিয়ে উঠলো।
“এই তুমি আবার এখানে এসেছো? তাড়াতাড়ি নামো বলছি!”

অটোওয়ালা তড়িৎ গতিতে আফড়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপা আপনেরে বিরক্ত করতাছে নাকি?”

নীরব চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আফরাকে ইশারায় না বলতে বলল। আফরা নিরবের দিকে তাকিয়েই অটোওয়ালাকে না বলল।

নীরব আফরার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
“আপনাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। ভার্সিটিতে কি অনুষ্ঠান নাকি? আচ্ছা আপনি যে ঐদিন আসলেন এরপরে তো আর দেখলামও না। বাড়ি থেকে বের টের হন না নাকি?”

আফরার কপালে আবার ভাজ পড়লো।
“এই ছেলে তুমি এত কথা বলো কেন? মুখটা কি দুই মিনিটের জন্য বন্ধ রাখা যায় না?”

“মুখ বন্ধ রাখার জন্য তো মুখে কিছু থাকতে হয়। আমার তো কিছুই নেই। আপনি কিছু দিয়ে একটু বন্ধ করে দিন না।”

” কিহ!”

“ওই যে হাতে চুইংগাম। মানে ওইটার কথা বলছিলাম।” দাঁত বের করে হেসে বলে নিরব।

আফরা হাতের চুইংগাম টা নীরবের দিকে ছুড়ে মারে। নিরব ক্যাঁচ ধরে বলে,
” এত হট হয়ে থাকেন কেন সব সময়?”

আফরা চোখ দিয়ে ভস্ম করে দেয়ার মতো করে তাকালো নীরবের দিকে।
নীরব এবার মুখ কাচুমাচু করে বলে।
“আরে মেজাজ! মেজাজ এত গরম থাকে কেন সেটা বলছিলাম।”

অটো ভার্সিটি রোডের সামনে এসে দাঁড়ালে নিজের ভাড়া মিটিয়ে আফরা গেইটের দিকে পা বাড়ায়।
নীরব পেছন থেকে নিরব ডেকে বলে,
“আমার ভাড়া দিবেন না?”
আফরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
“কেন তোমাকে কি আমি আসতে বলেছিলাম?দেখো অন্য মেয়ে পাও কিনা তাদের থেকে নিয়ে ভাড়া মিটাও।” বলেই সে চলে গেল।

অটোর ছেলেটা শুরু থেকেই ওদের দুজনের উপর বিরক্ত। গাড়িতে উঠার পর থেকে ঝগড়া করেই চলেছে।
“ওই মিয়া কি শুরু করছেন আপনেরা? তাড়াতাড়ি আমার ভাড়া দিয়া যান।”
নিরব বলে,
“যেইখান থেকে আসছেন ওইখানেই যান।”

“মানে” অটোওয়ালা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

“মানে আগের জায়গায় নিয়ে যান।”

“তাইলে এইখানে আইছেন ক্যান?ওই আপারে দিতে আইছিলেন নাকি? আপনের প্রেমিকা লাগে নাকি?”কমবয়সী অটোওয়ালা ছেলেটার চোখেমুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আগ্রহ।

নিরব হেঁসে উঠল,
“প্রেমিকা না বউ লাগে। এবার যান ভাই!”

*

ওয়াহিদ আর ঝুমুরের ঢাকায় আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেল। বাসায় গিয়ে কোনরকম জামা কাপড় বদলেই দুজন ছুটলো হসপিটালে। গতকাল রাতে সামিয়া সিঁড়ি থেকে স্লিপ করে পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু ওদের দুজনকে সকালে জানানো হয়েছে। খবরটা শোনার পর থেকেই ঝুমুরের ভীষণ মন খারাপ। তাদের পরিবারে আসতে যাওয়া ছোট্ট প্রাণটার কথা ভেবে বাসেও কিছুক্ষণ কেঁদেছে। কতকিছু ভেবে রেখেছিল ওই ছোট্ট বাচ্চাটার জন্য। ওয়াহিদের মা ফোনেই জানিয়েছে সামিয়ার কন্ডিশন মোটামুটি হলেও বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায় নি। হসপিটালের করিডোরে নিষ্প্রাণ হয়ে বসে আছেন শায়লা বেগম। ঝুমুরকে দেখে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন তিনি। তার মেয়ের মতো বউয়ের এমন অবস্থা মোটেই তাঁদের কাম্য ছিল না। একসময় ঝুমুরকে ছেড়ে চেয়ারে বসে পড়লেন। ঝুমুর সামিয়ার কেবিনের ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। ঠিক সেই সময় ওয়াহিদ হাত ধরে আটকে দিল। নিচু কন্ঠে বলে,
“ভিতরে ভাইয়া আছে। পরে যেও।”

কাঁচের দরজার পর্দার ফাঁকা দিয়ে ওয়ালিদকে বসে থাকতে দেখা গেল সামিয়ার বেডের পাশে। ঝুমুর কিছু না বলে শায়লা বেগমের পাশে বসে রইল।
প্রায় আধঘন্টা পর ঝুমুর আর ওয়াহিদ সামিয়াকে দেখে আসলো। ওর এখনো জ্ঞান ফিরে নি।

ওয়ালিদ ঝুমুর আর ওয়াহিদকে বসে থাকতে দেখে বলল,
“তোরা দুজন বাড়ি যা এখন। অনেকটা রাস্তা জার্নি করে এসেছিস।বাড়ি গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নে।”

ঝুমুর দ্বিমত করল,
“না ভাইয়া আমরা এখানেই থাকি আপুর কাছে। আপনি বরং মাকে নিয়ে বাড়িতে যান।”

ওয়ালিদ বলে,
“আমি থাকবো সমস্যা নেই, তোমরা সবাই বাড়িতে চলে যাও।”

ওয়ালিদের কথায় সায় দিয়ে ওয়াহিদ বলে,
“হ্যাঁ ঝুমুর তুমি মাকে নিয়ে বাড়িতে যাও। একটু ফ্রেশ হয়ে বিকালে আবার এসো। ততক্ষণে ভাবীরও মনে করি জ্ঞান ফিরে যাবে।”

*
বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সবার জন্য না রান্না করে নিল শায়লা বেগম। খাবার প্যাক করে ঝুমুরকে নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
সামিয়ার কেবিনের সামনে পা রাখতেই রুমের ভেতর থেকে প্রবল কান্নাকাটির শব্দ ভেসে এলো। রুমের ভেতরে ঢুকতেই দেখে সামিয়া চিৎকার করে কাঁদছে। ওয়ালিদ একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে রেখে থামানোর চেষ্টা করছে। ঝুমুর দৌড়ে গিয়ে সামিয়ার সামনে দাঁড়ায়।
“আপু কেঁদো না। কাঁদলে তো যে চলে গেছে সে আর ফিরে আসবেনা। এতে তোমার আরো শরীর খারাপ করবে। তুমি না আমার স্ট্রং আপু? প্লিজ শান্ত হও এবার।”

সামিয়া ঝুমুরকে দেখে ওকে আগলে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
“ঝুমুর ও চলে গেছে! আমার সাথে রাগ করে চলে গেছে। ঝুমুর ও কি ভেবেছে ওকে আমি ভালোবাসি না? কিন্তু আমি তো ওকে অনেক ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো?” কাঁদতে কাঁদতে সামিয়ার গলা নিভে এল। একসময় চুপ হয়ে ঝুমুরকে আগলে ধরে বসে রইলো।

ওয়াহিদ কেবিনের ভেতর এসেছিল সামিয়ার কান্নাকাটি শুনে। ভেতরে এসে ঝুমুরের সামিয়াকে আগলে ধরে রাখার দৃশ্যটা দেখে মুহূর্তেই মনে হলো ঝুমুর তাদের জীবনে খাঁ খাঁ রোদ্দুরের পরে এক পশলা বৃষ্টি। কত সুন্দর করেই না আগলে নিচ্ছে তার পরিবারটাকে!

চলবে ….

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_২২
লেখিকা:তাসফিয়া আনজুম

সেই বিষন্ন দিনের পর পেরিয়ে গেছে প্রায় কয়েকমাস। সামিয়াকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেয়ার প্রায় এক মাসের মাথায় ওয়ালিদ আর সামিয়া আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছে। ঝুমুরের কলেজ, প্রাইভেট, কোচিং সবকিছু মিলিয়ে একদন্ড অবসর নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে একবার আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার ছাড়া আর ওয়াহিদের সাথে কথাই হয় না এখন। ঝুমুর কোচিং থেকে ফিরে শায়লা বেগমের দেখা করে রুমের দিকে পা বাড়ায়। যেদিন ওয়াহিদের বিকেলে হসপিটালে যেতে হয় সেদিন ঝুমুরকে বাড়ির ড্রাইভার নিয়ে আসে কোচিং থেকে। আজও তাই হল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ঝুমুর রুমে ঢুকে দেখলো ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। তারমানে ওয়াহিদ বাসায় চলে এসেছে। আজ ওয়াহিদকে এতো তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে দেখে ঝুমুর বেশ অবাক হলো। অন্যমনস্ক হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে মাথার হিজাব খুলল। গায়ের বোরকা খুললো। এর মধ্যেই ভেজা চুল মুছতে মুছতে ওয়াহিদ বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। ঝুমুরকে দেখেই বলল,
“তুমি এসেছো? আর একটু দেরি হলে তো আমিই আনতে চলে যেতাম। আজ এত দেরি হল কেন?”

“আজ তো কোচিংয়ে পরীক্ষা ছিল তাই আধা ঘন্টা দেরি হয়েছে।”

“ওহ হ্যাঁ তুমি তো বলেছিলে। পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

“ভালো।”

“আচ্ছা ঠিক আছে এখন ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও।”

“রেডি হবো কেন? আমরা কি কোথাও যাচ্ছি নাকি?”

“হ্যাঁ। আলমারির ডানপাশের তাকে একটা শপিং ব্যাগে ড্রেস আছে সেগুলোই পরবে।”

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?” কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো ঝুমুর।

“সেটা গেলেই দেখতে পাবে।” ওয়াহিদ বারান্দায় চলে গেল।

ঝুমুরের মন খারাপ হয়ে গেল। কেন জানে না মনে হয় কয়েকদিন যাবত ওয়াহিদ ওকে এড়িয়ে চলছে। আগের মতো কথাও বলে না তার সাথে। শুধু হসপিটালে যাওয়ার সময় কলেজের নামিয়ে দেয়া আর রাতে এসেও সেই পড়ালেখা নিয়েই একটু কথাবার্তা। এসব ভাবতে ভাবতেই আলমারির কাছে যায় ঝুমুর। আলমারি খুলতেই বেরিয়ে এলো লাল রঙের বেশ বড়সড় একটা শপিং ব্যাগ। ব্যাগ তুই খুলতেই দেখা গেল হালকা গোলাপি রঙের গর্জিয়াস সিকুয়েন্স করা একটা শাড়ি। শাড়িটার দিকে তাকাতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল যে এত সুন্দর। ওয়াহিদের পছন্দ বরাবরই খুব সুন্দর। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা কিছু জুয়েলারিও আছে। ঝুমুর আর কিছু না ভেবে শাড়িটা বিছানার উপরে রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেল। দুপুরেই গোসল করেছিল তাই এখন হাত মুখ ধুয়েই বেরিয়ে এলো। রুমে এসে দেখল ওয়াহিদ কোথায় বসে ল্যাপটপে কিছু করছে।

“আমরা কখন বের হবো?”

ওয়াহিদ ঝুমুরের দিকে তাকালো।
“এইতো আর কিছুক্ষণ পরেই।”

*

রাতের আকাশে অসংখ্য তারা ঝলমল করছে। রেস্টুরেন্টের ছাদটি হালকা আলো আর ফুলের সাজে সজ্জিত। চারপাশে মৃদু বাতাস বইছে,পরিবেশটা আরও স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। ছাদের এক কোণে একটি ছোট্ট টেবিল। টেবিলের উপর নিভু নিভু কিছু মোমবাতি জ্বলছে, তার পাশেই রাখা লাল গোলাপের একটা বুকে।

ঝুমুর চারপাশের সব ভুলে আশ্চর্য হয়ে রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। হঠাৎ পেছন থেকে একজনা ঠান্ডা হাত জড়িয়ে ধরে তার উদর। কেঁপে ওঠে ঝুমুরের সমস্ত শরীর। ঝুমুর নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারবে মানুষটা ওয়াহিদ ছাড়া আর কেউ নয়।

“প্রিয়তমা,আজকের এই দিনটা একটু বেশি বিশেষ তাই না? কারন এই দিনেই তুমি পৃথিবীতে এসেছিলে। তোমার জন্য বিশেষ না হলেও আমার জন্য বিশেষ। তুমি এসেছিলে বলেই আমি বলতে পারছি, ‘ভাগ্যিস তুমি এসেছিলে, না হলে যে এত রঙিন জীবনটা বাঁচা হতো না।’শুভ জন্মদিন, আমার ভালোবাসা’। হয়তো তোমার জন্মদিনের শেষ উইশটা আমিই করলাম। এভাবেই প্রতিটা জন্মদিনে তোমার সাথে কাটাতে চাই। শুধু একটুখানি সায় দিও আমার পাগলামিতে”

শান্ত কন্ঠে ওয়াহিদের বলা কথাগুলো শুনে ঝুমুর কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল। ওয়াহিদের হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়ালো। মনের ভিতর হাজারো অনুভূতি একত্রিত হলো ঝুমুরের। মুখে শুধু বলল,
“এই সবকিছু আপনি করেছেন? আমার জন্য?”

ওয়াহিদ হালকা হেঁসে বলল,
“হ্যাঁ।”

ওয়াহিদ ঝুমুরের হাত ছেড়ে দিয়ে টেবিলের উপর থেকে একটা বক্স নিয়ে এসে ঝুমুরের হাতে দেয়।
“খুলে দেখো।”
ঝুমুর বক্সটা খুলতেই বেরিয়ে এলো একটা রিং বক্স আর একটা খাম। ঝুমুর চিঠির খামটা ওয়াহিদ কে দেখিয়ে বলে,
“এটা আমার?”
“হ্যাঁ।”
ঝুমুর কৌতূহল নিয়ে খামটা খুলে চিঠিটা পড়তে শুরু করল।

প্রিয় চন্দ্রমল্লিকা,

আজ আমি যা লিখছি, তাতে তুই হয়তো ভীষণভাবে আশ্চর্য হবে। তুমি কি জানো তোমার সঙ্গে বিয়ের আগে থেকেই আমার অনেক অনুভূতি ছিল, কিন্তু কখনোই তা তোমাকে বলার সুযোগ হয়নি। হয়তো ভেবেছি, সময়টা সঠিক ছিল না। কিন্তু আমার ভেতরের কষ্ট ও দ্বিধা বাড়ছিল, কারণ আমি জানতাম, তুমি জানো না যে আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি।

তোমাকে আমি চন্দ্রমল্লিকা কেন বলি জানো? কারণ এই ফুলটা রাতের বেলা ফুটে আর পূর্ণিমা রাতে সুগন্ধ ছড়ায়। তুমি হচ্ছো আমার জীবনের একান্ত চন্দ্রমল্লিকা। যার সৌন্দর্যে কেবল আমি একাই বিমোহিত হই সর্বদা। মনে পড়ে আমাদের প্রথম সাক্ষাতের কথা? ঠিক সেই পূর্ণিমার রাতে আমার জীবনের চন্দ্রমল্লিকা হয়ে এসেছিলে তুমি। তুমি প্রথম মেয়ে যাকে দেখে আমি এক অন্যরকম অনুভূতি পেয়েছিলাম, যা প্রথমে আমাকে হতবাক করে দিয়েছিল। আমি নিজেও বুঝতে পারিনি, কেন এমন হলো। কিন্তু তার পরও, এই অনুভূতি ্টি আমার মনে নানা প্রশ্ন রেখে গিয়েছিল। আজ আমি বুঝতে পারি, যে আমি সেই অনুভূতিগুলির সাথে শান্তি খুঁজে পেতে চেয়েছিলাম, আমি তোমার মাঝে শান্তি খুঁজতে চেয়েছিলাম। তুমি আমার জীবনে অনেক মূল্যবান, অনেক ভালোবাসার। আর আমার লেখা সর্বশেষ চিঠিটার জবাব কিন্তু এখনো পাইনি।

ইতি,
যাকে তুমি বিশ্বাস করে কৃতজ্ঞ করেছিলে।

চিঠিটা শেষ করে ঝুমুর অবাক হয়ে ওয়াহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্ফুট স্বরে বলে,
“আপনিই সেই চিঠিদাতা? সেদিন রাতে আপনিই ছিলেন ওই গাড়িতে?”

ওয়াহিদ মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয় না।
“হ্যাঁ। কিন্তু আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়েছিল যখন দেখলাম তুমি আমার কন্ঠ ও চিনতে পারোনি। আমি ভাবলাম আরো কিছুদিন ঘুরিয়ে নেই তোমাকে।”

“তাহলে আপনি এতদিন কেন বললেন না এই কথাটা? আর চিঠিতে তো আপনি কোনদিন ভালোবাসার কথা বলেননি। আপনি তো শুধু বলেছিলেন আপনি শুধুমাত্র আমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী।”

“কেন শুভাকাঙ্ক্ষীরা কি ভালোবাসতে পারেনা?”

“তাহলে এখন যদি আমার আপনার সাথে বিয়ে না হয়ে অন্য একজনের সাথে হতো তাহলে কি করতেন?”

ওয়াহিদ হেঁচকা টানে ঝুমুরকে নিজের কাছে টেনে নেয়।
“হুশ। অন্য একজনকে বিয়ে করতে দেওয়ার জন্য ভালবেসেছিলাম নাকি?”

ঝুমুর বলে,
“কিন্তু আমি চিঠির আপনিটাকে শুধুমাত্র একজন বন্ধু হিসেবেই ভেবেছিলাম।”

“আচ্ছা। তাহলে এই আমিটা কে নিশ্চয়ই ভালোবাসা হিসেবে ভেবেছ?”

ঝুমুরের মনের ঢেউ খেলে যায় হাজারো অনুভূতি। চোখে মুখে ফুটে ওঠে লজ্জা মিশ্রিত হাসি। কাঁপা কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দিল ওয়াহিদের বুক। ওয়াহিদের চোখে চোখ পড়তেই মুচকি হাসি দিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে। না বলা কথাগুলোর সমাপ্তি ঘটালো চোখে চোখেই।

কিছু সময় পর ওয়াহিদ বলল,
“চলো কেকটা কেটে নেই।”

দুজনে ফুল আর মোমবাতি দিয়ে সাজানো শুভ্র টেবিলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। টেবিলের উপর সাজানো একটা কেক। যার উপর ছোট্ট করে লেখা ‘Happy Birthday my love’। ওয়াহিদ টেবিলের উপর থাকা একটা মোমবাতি নিয়ে ঝুমুরের মুখের সামনে ধরে। ঝুমুর সেটাতে ফু দিয়ে কেকটা কাটে। ওয়াহিদ কেকের ছোট্ট একটা স্লাইস নিয়ে ঝুমুরের মুখে দিতে গিয়ে নাকে লাগিয়ে দেয়। ঝুমুর ও তাই করলো ওয়াহিদের পুরো মুখে কেকের ক্রিম লাগিয়ে দিল। দু’জনে দুজনের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে কুপোকাত। এরকম সুন্দর মুহূর্তের কিছু স্মৃতি ক্যামেরায় বন্দি করে নিল ওয়াহিদ।

*

“শা*লা! তুমি তলে তলে টেম্পু চালাও আর মানুষ কইলেই হরতাল?”

রাত তখন প্রায় একটার কাছাকাছি।বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেয়ার সাথে ফোনে কথা বলছিল আদিল। হঠাৎ পেছন থেকে আদিলের ফোন কেড়ে নিয়ে কথাগুলো বলে নিরব। এখন সারাদিন রাত নিরবের সাথে থাকে বলে কেয়ার সাথে কথা বলাও হয় না কলে। দুইদিন ধরে কলেজ যাচ্ছে না কেন সেটা জানতেই কল দিয়েছিল আদিল।

নিরব কল কানে লাগিয়েই বলতে থাকে,
“হ্যালো আপা। এইটা রং নাম্বার। আপনি যারে শাহরুখ খান ভাইব্বা কল দিছেন ওইটা আসলে আমার বন্ধু কুদ্দুস খান। আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করার জন্যে কুদ্দুস খান থুক্কু আমার বন্ধুর হইয়া মাফ চাইলাম। গুড নাইট।”

ওপাশ থেকে ভেসে আসে মেয়েলী কন্ঠস্বর,
“ওহ আচ্ছা। কুদ্দুস খান যদি রং নাম্বার হয়, তাহলে রাইট নাম্বারটা কোথায় পাবো বলতে পারবেন?”

নিরবের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো।
“কেয়া তুই? তুই এত রাত্রে ফোন দিছোস ক্যান?”

কেয়া কি বললো শোনা গেল না।

নিরব শুধু আদিলের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনলো। কল কেটে আলনার ভাঙ্গা একটা কাঠ নিয়ে আদিলের দিকে তেড়ে যায়।
“ওই শা*লা! তুই আমারে আগে বললি না ক্যান? তোগো দুইটারে আমার আগেই ঘাপলা লাগছিল। তাইলে এই হইলো আসল কাহিনী?”

আদিল মুখ কাচুমাচু করে বলে,
“কি বলতাম এখন? ভাবছিলাম কিছুদিন পরে বলবো। আচ্ছা বাদ দে চল ঘুমাই।”

নিরব চেঁচিয়ে উঠল,
“কিসের ঘুম শা*লা! সর সামনের থেইক্কা। মাগার আমার কপালেই খালি প্রেম নাই!”

আদিল এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও নিরবে এই কথা শুনে এবার হা হা করে হেসে ওঠে।
“আরে সয়তান! তাইলে এই কাহিনী?

গুনগুন করতে করতে বিছানার দিকে যায় আদিল,
ফাইট্টা যায়,বুকটা ফাইট্টা যায়।
বন্ধু যখন বউ লইয়া,
আমার বাড়ির সামনে দিয়া।
রঙ্গ কইরা হাইট্টা যায়।
ফাইট্টা যায়,বুকটা ফাইট্টা যায়।

নিরব রেগেমেগে হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে মারে আদিলের দিকে। আদিল সুযোগ বুঝে সরে পড়ে।

আদিল ব্যঙ্গ করে আবারও বলে,
“ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়!”

এরপর হঠাৎ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো। আদিল আবারো বলে,

“তোর সিনিয়র আপুর যা অবস্থা!এই ইহজীবনে তোর কপালে প্রেমট্রেম কিছু আছে বইল্লা তো মনে হয় না।”

চলবে….