প্রেমময়ী সন্ধ্যা পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0
5

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
সমাপ্তি পর্ব
লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম

বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। এডমিশন পরীক্ষা শেষ হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো।আজ রেজাল্ট দিবে। সকাল থেকেই ঝুমুর রেজাল্টের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছে।

ঝুমুরের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো দুপুরে। ঝুমুর ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে। এই খবরে পরিবারের সবাই আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি খুশি ওয়াহিদ।

ঝুমুরের মেডিকেলে চান্স পাওয়ার খবরে ওয়াহিদের আনন্দ যেন সীমাহীন। ঝুমুর ওয়াহিদের এমন খুশি দেখে নিজেই অবাক হয়েছিল।

ঝুমুর তার নতুন জীবনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ওয়াহিদও তার প্রতিটি পদক্ষেপে পাশে থাকছে সবসময়। আদিল যশোরে ই একটা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসার দায়িত্বও সামলাচ্ছে। এদিকে কেয়াও ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।নিরব আফরার ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। পাশাপাশি একটা কোচিং সেন্টার খুলেছে।আফরা নিজের টিউশনগুলো বাদ দিয়ে নিরবের কোচিং সেন্টারে অস্থায়ীভাবে পড়ানো শুরু করেছে।

*

দুই বছর পর,

ঝুমুরের মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষ চলছে। পড়াশোনার ফাঁকে ওয়াহিদের সঙ্গে তার সময় কাটানোর সুযোগ খুব কম হয়। তবে ছুটির দিনগুলোতে ওয়াহিদের একটু একান্ত সময় কাটানোর পরিকল্পনা থাকে।

এক ছুটির দিনে ঝুমুর ওয়াহিদকে বলল,
“চলুন আজ একটু ঘুরে আসি। অনেক দিন কোথাও যাইনি।”
ওয়াহিদ ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“বাহ, আজ আমার চন্দ্রমল্লিকার মন খুব ভালো মনে হচ্ছে!”
ঝুমুর মুচকি হেসে বলল,
“আমার মন তো প্রতিদিনই ভালো থাকে। এই আর নতুন কি!”

ওরা শহরের বাইরে একটি সুন্দর জায়গায় গেল। প্রকৃতির মাঝে হাঁটতে হাঁটতে ওয়াহিদ ঝুমুরকে বলল,
“ঝুমুর তোমার ইয়ার সেমিস্টার ফাইনাল কবে?”
ঝুমুর আর চোখে ওয়াহিদের দিকে তাকালো। চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
ওহ এখানে এসেও পড়ালেখা! আপনি কিন্তু এখন খুব সিরিয়াস হয়ে থাকেন সবসময়।”
ওয়াহিদ মৃদু হেসে বলল,
“কি করবো বলো ভবিষ্যৎ ডাক্তারনীর হাজব্যান্ড বলে কথা!”
“আচ্ছা সেসব কথা বাদ দিন। আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।”কথাটা বলতে বলতে ঝুমুরের গাল লাল হয়ে গেল।
ওয়াহিদ ঝুমুর কে বলল,
“অবশ্যই, একটা কেন হাজারটা বলো!”
ঝুমুর আমতা আমতা করেই বললো,
“জানেন আমার ব্যাচমেট একটা মেয়ে আছে না গত সপ্তাহে ওর অনেক কিউট একটা বেবি হয়েছে। আচ্ছা আপনার বাবুদের কেমন লাগে?”
ওয়াহিদ অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“ওহ আচ্ছা এই কথা! আমার বেবি খুব ভালো লাগে, কিন্তু এখন বেবিকে আনতে গেলে বেবির মায়ের যে খুব অসুবিধা হয়ে যাবে। ঝুমুর আমি চাই তুমি আগে পড়াশোনা শেষ করো, তারপর আমরা ভাববো। কয়েকটা বেবি নিয়ে এসে না হয় দেখব কেমন লাগে। ঠিক আছে?”

ঝুমুর ওয়াহিদকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে,
“যান সব সময় শুধু বেশি বেশি বোঝেন!”

*

কেয়ার জন্য পাত্র দেখেছিলেন তার বাবা-মা। পাত্রটি অত্যন্ত ভালো এবং শিক্ষিত। কেয়া বাবা-মা দুজনেই ছেলেটাকে পছন্দ করেন।

কেয়ার কাছ থেকে এই খবর শুনে আদিলের মাথা ঘুরে যায়। তৎক্ষণাৎ সে তার মা সাহিদা বেগমকে নিয়ে যশোর থেকে কেয়াদের বাসায় ছুটে যায়। সাহিদা বেগম সরাসরি কেয়ার বাবা-মার সামনে বসে বললেন,
“আপনার মেয়েকে আমরা চাই। আমার ছেলে আদিল আর কেয়া দুজনই একে অপরকে পছন্দ করে। ওদের ভালোর জন্য আমাদের এই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।”

কেয়ার বাবা প্রথমে একটু রেগে যান। কিন্তু কেয়ার মায়ের অনুরোধে তিনি কিছুটা শান্ত হন। কেয়া লাজুক মুখে সব স্বীকার করে নিলে তার বাবা শেষ পর্যন্ত রাজি হন। তিনি বললেন,
“যদি আমার মেয়ে খুশি থাকে, তাহলে আমার আর কি বলার থাকে?”

অবশেষে একমাস পর আদিল আর কেয়ার বিয়ের তারিখ ঠিক হয়।

*

আফরা এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নিরব আফরার সম্পর্কটা এখন আপনি থেকে তুমি তে এসেছে। প্রায় এক বছর ধরেই নিরব আফরাকে কোচিং সেন্টারে পড়াতে দেয় না। নিজেও যতটা পারে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে। রান্নায় আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে, প্রায় সময় তো নিজেই রান্না করে ফেলে।

দুপুরে নীরব কোচিং সেন্টার থেকে বাসায় ফিরল। ঘড়ির কাঁটায় তখন তিনটা। ঘরে ঢুকেই সে দেখে টেবিলে ভাত সাজানো। আফরা খেতে বসেনি। রেগে গিয়ে বলল,
“তোমাকে কতবার বলেছি আমার জন্য না খেয়ে বসে থেকো না! তোমার নিজের খেয়াল রাখা উচিত। এখনো ভাত খাওনি, ওষুধ খাবে কখন?”

আফরা মৃদু হেসে বলল,
“তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। রাগ করো না তো। বাবু আজকে তোমার হাতে খেতে চাইছে। তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে এসো।”
নীরব তার কথা শুনে গলায় রাগ কমিয়ে বলল,
“আচ্ছা! তো কোন বাবু খেতে চাই ছোটটা না বড়টা?

আফরা চোখ রাঙিয়ে বলে,
“এই তুমি যাবে! আমার কিন্তু খিদেয় পেট চো চো করছে।”

নিরব নিজ হাতে আফরাকে ভাত খাইয়ে দিল। তারপর সেই প্লেটে নিজে খেয়ে নিল। দুজনে একসাথে রুমে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পর নিরবের ফোন বেজে উঠল।

কল রিসিভ হতেই আদিল উত্তেজিত স্বরে বলল,
“শালা, তোরে চাচ্চু ডাক শোনানোর অফিসিয়াল পারমিশন পেয়ে গেছি!”
নিরব অবাক হয়ে বলল,
“কি!কবে? তুই এখন ঢাকায়?”
আদিল হেসে বলল,
“হ্যা, সন্ধ্যায় দেখা কর সব বলতেছি।”

*

আদিল আর কেয়ার বিয়ের দিন চলে এলো। সাজসজ্জায় পুরো বাড়ি আলো ঝলমলে। ঝুমুর, ওয়াহিদ, নীরব, আফরা সবাই উপস্থিত। বিয়ের অনুষ্ঠানে কেয়া লাল বেনারসি পড়েছে।

বিয়ের সময় আদিল একটু ঘামছিল। ওয়াহিদ কাছে গিয়ে বলল,
“নার্ভাস লাগছে নাকি?”
আদিল হেসে বলল,
“ভাই, এটা তো লাইফটাইম ব্যাপার। একটু তো লাগবেই।”

অবশেষে কেয়া আর আদিলের বিয়ে সম্পন্ন হলো। সবাই তাদের নতুন জীবনের জন্য দোয়া করল। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে কেয়া আর আদিলকে নবদম্পতি হিসেবে সবাই শুভকামনা জানাল।সবাই একসঙ্গে ছবি তুলল। হাসি-আনন্দ আর শুভেচ্ছার মধ্য দিয়ে আদিল-কেয়ার নতুন জীবন শুরু হলো।

রাত দশটা। ঝুমুর আর আদিলের কয়েকজন কাজিন কেয়াকে আদিলের ঘরে বসিয়ে রেখে গেছে। কেয়াকে দিয়ে যাওয়ার প্রায় এক ঘন্টা পর আদিল ঘরে আসে। আদিল দরজা বন্ধ করে খাটের কাছে যেতেই কেয়া বলে ওঠে,
“এই এতক্ষণে আসার সময় হলো? এদিকে মশা কামড়ে আমার রফাদফা করে দিল।”
আদিল দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“একদম ঠিক করেছে। পর পুরুষের সাথে কথা বলা নারীদের সাথে এমনই হওয়া উচিত।”
কেয়া শাড়ি ধরে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়,
“এই কি বললি! আমি পর পুরুষের সাথে কথা বলি? আর নিজে যে ওই পলিথিন এর সাথে সারাদিন লেপটে থাকিস! তখন কি?”
কেয়া সাধারণত এক আদিলকে এখন তুই বলে না। কিন্তু খুব রেগে গেলে তুই বলে ফেলে।
“ছিহ। এই জন্যই মানুষ বলে বেস্ট ফ্রেন্ডকে বিয়ে করতে নেই। দেখো কেমন উঠে পড়ে ঝগড়া করছে স্বামীর সাথে।”
“ওরে বাবা! আমি ঝগড়া করছি আর নিজে মনে হয় খুব সাধু!”
“তো পরপুরুষকে পরপুরুষ বলবো না তো কি বলবো? তোকে না বলেছি ওই রাফির সাথে কথা বলবি না। ওই শা*লারে একদম দেখতেই পারি না!”
“দেখা দিল ওইটা আমার কাজিন। আর আমি যার সাথে ইচ্ছা তার সাথে কথা বলি তোর কি?”
আদিল রেগে কেয়ার দিকে তাকালো।
“আমার কি? দাঁড়া দেখাচ্ছি!”
এই….
কেয়া আর কিছু বলতে পারল না। আদিল তার মুখ বন্ধ করে দিল। কিছুক্ষণ পর তাদের ঝগড়া অন্যদিকে রূপ নিল। দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়ার মাঝেই ভালোবাসা বৃষ্টি হয়ে ঝরলো দুজনের মাঝে।

*

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঝুমুর আর ওয়াহিদের বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। ওয়াহিদ গাড়ির স্টেয়ারিং এ হাত রেখে মাঝে মাঝে ঝুমুর কে দেখছিল। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঝুমুর বলল,
“আজকের দিনটা খুব স্পেশাল ছিল আমাদের জন্য।”
ওয়াহিদ হেসে বলল,
“আমার জন্যেও। কারন,তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই আমার জন্য স্পেশাল।”

ঝুমুর একটু লজ্জা পেল। বলল,
“আপনি সব সময় একটু বেশি বেশি বলেন।”
ওয়াহিদ গাড়ি থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা!শুধু বেশি বেশি বলি?আর কিছু করিনা?”

ওয়াহিদ গাড়ি থামিছিল রাস্তার পাশে। চারপাশটা একদম শান্ত। ঝুমুর জানালার বাইরে তাকিয়ে চাঁদের আলো দেখছিল।

ওয়াহিদ তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “কি দেখছো?”
“চাঁদ। আজকের চাঁদটা মনে হয় একদম কাছেই,” ঝুমুর শান্ত গলায় বলল।
ওয়াহিদ হেসে বলল, “চাঁদটা দেখার দরকার নেই। এই নাও আয়নায় নিজেকে দেখো। বলে গাড়ির সামনের মিরর টা ঝুমুরের দিকে ফিরিয়ে দিল।

ঝুমুর লজ্জায় হেসে বলল, “আপনি এসব কথা না বললেই নয়?”
ওয়াহিদ তার দিকে একটু ঝুঁকে এসে বলল, “তাহলে কি করব? সত্যি কথা বললেও দোষ?”
ঝুমুর মাথা নিচু করে মুচকি হেসে বলল, “এত কথা না বলে চলুন, বাড়ি ফিরি?”
ওয়াহিদ একটা ভুরু উঁচিয়ে বলল, “বাড়ি যাবার আগে একটা কাজ বাকি।”
“কি কাজ?”
ওয়াহিদ ঝুমুরের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, “তোমার এই সুন্দর মুখটা একটু ভালো করে দেখা। সারাদিন সবাইকে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলে যে তোমাকে ভালো করে একবার দেখতেও পারিনি, এখন তো শুধু তুমি আর আমি।”

ঝুমুর একটু হেসে বলল, “আপনার তো কথা শেষ হবে না। ঠিক আছে, দেখি কতক্ষণ এমন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে পারেন।”
ওয়াহিদ হেসে বলল, “শুধু মিষ্টি কথা কেন, তুমি চাইলে আমিই মিষ্টি হয়ে যাই। সেই সুযোগে যদি কেউ একটু টেস্ট করে দেখে!”

ঝুমুর চোখ কুঁচকে,
“ছিহ! সবসময় শুধু বাজে কথা!”

ওয়াহিদ হেঁসে আবার গাড়ি চালাতে শুরু করল। ঝুমুর আর ওয়াহিদের এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই যেন তাদের জীবনকে ভরিয়ে রাখে।

সমাপ্ত।