#প্রেমমোহ
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_১২
–” শুভ তোর হঠাৎ কি হলো। শোন, ওর নাম আকাশ। আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড। আজকের পর থেকে তোরও।”
–” হ্যালো শুভ্রতা। আমার নাম আসমানী কিন্তু নীলু সংক্ষেপে আকাশ ডাকে।”
আনমনে হঠাৎ করেই বলে উঠলো শুভ্রতা,
–” আকাশ কেন ডাকবে? আসু নামটাও তো সুন্দর। আজ থেকে তোমার নাম আকাশ নয় আসু।”
আসমানী নীলুর দিকে তাকালো। নীলুর চোখে রয়েছে তীব্র সন্দেহ। সে ভাবছে এই নাম হয়তো শুভ্রতার প্রেমিকের কিংবা এক্স প্রেমিকের। তবুও মনের ভিতর উঁকি দেওয়া সন্দেহ মনে জমিয়ে রাখতে পারলো না সে। প্রশ্ন করেই ফেলল শুভ্রতাকে,
–” কেন শুভ? আকাশ নামের কেউ আছে নাকি?”
–” ছিল কিন্তু এখন নেই তবে মনে আজীবন থাকবে।”
নীলু আবারো বলল,
–” দেখছিস আসু আমি যা ভাবছি তাই । শুভ্রতার এক্সের নাম আকাশ তাই তোর নিকনেম ওর পছন্দ হয়নি।”
নীলুর কথা শোনে শুভ্রতা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
–” আকাশ আমার হাজবেন্ডের নাম। উনি মারা গেছেন কিছুদিন হতে চলল।”
শুভ্রতার গলা ধরে আসছে তবুও নিজেকে কন্ট্রোল করছে সে। অতীত নিয়ে পরে থাকা তার জন্য বোকামি। অতীত হলো তার বেদনাময়। সে অতীত নিয়ে আর ভাবতে চায় না।
অন্যদিকে আসমানী এবং নীলু অবাক। তারা ভাবেনি শুভ্রতা যে বিবাহিত। তাদের ভাবতেও ইচ্ছা করছে না। এত ছোট মেয়ের বিয়ে কি করে হতে পারে? তার উপর এখন তার হাজবেন্ড মৃত। নীলু শুভ্রতার মুখ দেখে বুঝতে পারল মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে । তাই শুভ্রতাকে হাসানোর জন্য বলল,
–” শুভ শোন, তোকে একটা মজার ঘটনা বলি। আমাদের একজন স্যার আছেন। নাম অন্তু, সেই অন্তু স্যারের উপর প্রেম ওয়ালা ক্রাশ খেয়ে বসে আছে আমাদের আসু বেবি। কিন্তু অন্তু স্যারকে ভয়ে বলতে পারছে না। এদিকে বেচারি স্যারের ক্লাসের সময় মুখ হা করে তাকিয়ে থাকে। তবে অন্তু স্যারকে আমারও ভালো লাগে। দেখতে একদম চকোলেট বয়। জানিস আমি হিন্দু না হলে কোনদিন স্যারকে পটিয়ে ফেলতাম। এই মেয়েকে কত কত প্ল্যান দেই মেয়েটা ভয়ে পিছ পা হয়ে যায়। একদিন বলছি তুই ইচ্ছা করে স্যারের সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে যেতে নিবি কিন্তু এই মেয়েটা স্যারের সামনে না পরে আমাদের এক সিনিয়র আবুল ভাইয়ের সামনে গিয়ে পড়ছে। ”
আসু মুখটা রাগী ভাব করে নীলুর পিঠে দু এক ঘা দিল। নীলু তখন হাসতে হাসতে বলল,
–” একদিন আমি ইচ্ছা করে আসুকে ধাক্কা মেরে স্যারের কোলে ট্রান্সফার করেছিলাম।”
শুভ্রতা এইবার হো হো করে হেসে উঠলো। এত পাজি মেয়ে সে কোনদিন দেখে নাই। শেষমেষ ফ্রেন্ডকে কিনা স্যারের কোলে ট্রান্সফার করেছে ভাবতেই তার পেট ফেটে হাসি পাচ্ছে।
অন্তু এবং স্পন্দন রেস্টুরেন্টে বসে আছে। অন্তুকে একে একে সব কিছুই বলেছে সে। অন্তু মুখটা গম্ভীর করে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু স্বরে বলল,
–” মেয়েটা কিন্তু ছোট থেকেই কষ্ট পেয়ে আসছে স্পন্দন। আমার মতে ওকে আর কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। মেয়েটার মুখটা বড্ড মায়াবী। দেখলেই তো ভালোবাসতে ইচ্ছা করে।”
অন্তুর মুখে শুভ্রতাকে ভালোবাসার কথাটা শোনে মনে মনে বেশ রেগে গেল সে। সে চায় না শুভ্রতাকে কেউ ভালোবাসুক আবার শুভ্রতার কষ্টের মাঝেও সে কষ্ট পায়। প্রিয় চাচার মেয়ে বলে কি তার এমন হয়? নাকি অন্য কিছু।
–” আমি যে ছোট থেকে কষ্ট পেয়ে আসছি তার বেলা? আমার কষ্টের কোনো দাম নেই। আমার কষ্ট কি কষ্ট না ? শুভ্রতা মেয়ে বলে কি তারই কষ্ট হয়।”
–” তোর কষ্টকে ছোট করছি না আমি। দেখ ছোট থেকেই মেয়েটা বাবা মা হারা কই তোর বাবা মা তো বেঁচে আছে। মামা মামীর অত্যাচারে বড় হয়েছে মেয়েটি, কই তোকে কেউ কষ্ট দিয়েছে? শারীরিক কষ্ট তুই পেয়েছিস? না পাসনি কিন্তু মেয়েটা শারীরিক এবং মানসিক দুই কষ্ট নিয়েও এখনও বেঁচে আছে। তোর চাচার চলে যাওয়াতে শুভ্রতার কোনো হাত নেই। একজন মানুষকে আটকে রাখার অধিকার তোর নেই। পৃথিবীতে কষ্ট পেয়ে যেভাবে আমরা হতাশ হই, তা অনন্ত সুখী জীবনের তুলনায় শিশুকে টিকা দেওয়ার মতোই। পৃথিবীর এসব কষ্টকে কেউ ধৈর্যৈর সাথে সহ্য করতে পারলে , তার জীবনে হতাশা বলে আর কিছু থাকে না। বুঝতে পারছিস তো আমার কথা স্পন্দন?”
ঘাবড়ে গেল স্পন্দন অন্তর কথা শোনে। সে ভাবছে, তাহলে তার অন্যায়টা অতিরিক্ত, নাকচ বোকামি। কিন্তু কি করবে সে? মন তো বারবার বলে প্রতিশোধ। মনের কথা শুনবো না তাহলে? ভালো থাকার উপায় কি আর আছে?
স্পন্দনের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে অন্তু আবারো বলল,
–” বাদ সেসব কথা। যেহেতু মেয়েটি আমার ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে ওর উপরে আমি এক্সট্রা কেয়ার রাখবো চিন্তা করিস না।”
রেগে গেল স্পন্দন। অন্তুর বলা এক্সট্রা কেয়ার তার কাছে শুনতে একটুও ভালো লাগেনি। সে চায় না শুভ্রতার দিকে কেউ তাকিয়ে থাকুক। কারণ শুভ্রতার মুখখানি মায়ায় ভরা যে কেউ দেখলেই মায়ায় জড়িয়ে পড়বে। মায়া থেকে ভালোবাসা শুরু হতে সময় লাগবে না। তাই কঠিন কণ্ঠে বলল,
–” তোর কিছু করতে হবে না। যা করার আমিই করবো। তুই শুধু দেখবি ঠিক মত যেন পড়াশোনা করে। ছেলেদের সাথে কথা যেন না বলে, তাছাড়া ও যেমন মেয়ে ছেলেদের কাছ থেকে একশো হাত দূরে থাকবে তবুও বলছি কারন সৎ সঙ্গে সর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।”
অন্তু স্পন্দনের কথা শোনে মুচকি হাসলো। হঠাৎ করেই তার হাসি পাচ্ছে। হাসিটা রহস্যময় রেখে সে আবারো অন্য কথায় মনোযোগ দিলো।
দিগন্ত রেখা ছুঁতে একা একা হেঁটে চলা পড়ন্তকাল
অস্তগামী সূর্যের আলপিন আলাপ রবে অনন্তকাল।
সন্ধ্যা নেমে এসে আসে বলেই পড়ন্ত
বিকেলের শেষ রোদটুকু এত কদর।
পড়ন্ত বিকেলের রোদ এসে যখন সন্ধ্যা নামায়
উদাসী বাতাস এসে কত্ত কথা বলে যায়।
শেষ বিকেলের শান্ত আলো এসে পড়ে শুন্য আঙ্গিনায় আমি খুঁজি ফিরি তাকে দুচোখ থাকে মিথ্যে আশায়।
–” বাহ ভাইয়া আপনি তো খুব সুন্দর করে কবিতা বলতে পারেন। এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে শুনছিলাম হঠাৎ থেমে গেলেন কেন?”
শুভ্রতার কথা শোনে পিছনে তাকিয়ে মৃদু হাসলো সাকিব। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে ভীষণ কষ্টে আছে। শুভ্রতার জানতে খুব ইচ্ছা করছে কষ্টের কারণ কি কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ না করে ঠোঁটের কোণায় হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল,
–” আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম না ভাইয়া।”
সাকিব উদাসীন সুরে আকাশ পানে তাকিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে ধীর কণ্ঠে বলল,
–” একজনকে ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু আমার পরিবার তাকে কোনোদিনও মানবে না। কিন্তু আমি তাকে ছাড়া বাঁচবো না। ও যদি আমার না হয় তাহলে আমি আমার এই জীবন রাখবো না।”
সাকিবের দু’চোখ পানিতে ভরে উঠলো। শুভ্রতা সাকিবের কাছে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সাকিবকে ইশারা করলো,
–” ভাইয়া আপনার ঠিক বাঁ পাশে দেখুন দুইটা কবুতর।”
সাকিব বাঁ পাশে ফিরে তাকালো । দুইটা কবুতর তার দুটো বাচ্চাকে খাবার খাওয়াচ্ছে। বাচ্চা দুটো বাবা মায়ের মুখ থেকে আনা শস্য পরম আদুরীর সহিত মুখে নিচ্ছে। এক আকাশ মুগ্ধতা নিয়ে কবুতরের দিকে তাকালো সাকিব কিন্তু সে বুঝতে পারছে না শুভ্রতা কবুতর কেন দেখতে বলল তাকে। জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শুভ্রতার দিকে। শুভ্রতা মুচকি হেসে বলল,
–” আচ্ছা এখন যদি আপনি বাচ্চাদের আনতে যান দেখবেন কবুতর দুটো ঝাপটা দিয়ে ধরবে তাদের বাচ্চাদের। সহজে কি আপনাকে দিতে চাইবে? দেখুন দূর থেকে খাবার এনে মুখে ভরে বাচ্চাদের জন্য আনছে, এই খাবার শেষ হতেই আবারো ছুটবে বাচ্চাদের জন্য খাবার আনতে। সারাদিন কত উড়বে তারা। উড়তে উড়তে হয়তো ডানা দুটো ব্যাথায় টনটন করবে তবুও কিন্তু তারা হাল ছাড়বে না কারণ ওই যে বাচ্চাদের মুখের খাবার যেভাবেই হোক দিতে হবে। সন্তানের কষ্ট বাবা মা কখনই দেখতে পারে না। শত অন্যায়ের পরেও দেখবেন সন্তানের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে ভালো থাকার দুআ চাইবেন তারা।”
শুভ্রতার মুখে এমন কথা শোনে হতবাক হয়ে গেলো সাকিব। কি সুন্দর করে বুঝাতে পারে মেয়েটি। এত সুন্দর উদাহরন তাও আবার সরাসরি। সাকিব না চাইতেও কান্না করে দিলো। শুভ্রতা কোনো উপায় না পেয়ে সাকিবের হাত দুটো শক্ত করে ধরলো। সাকিব অবাক চোখে তাকিয়ে আছে শুভ্রতার দিকে।
চলবে,
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।