#প্রেমমোহ
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_২২
সে বুঝতে পারে স্পর্শটা কার। মুচকি হেসে পিছনে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলতে লাগলো,
–” এই যে মহারাজা কিভাবে রুমে আসলে হুম?”
আট বছরের ছেলেটি তার কথা বুঝলো না। সে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। শুভ্রতা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকালো। ছেলেটির নাম রাজা। সে আদুর করে মহারাজা নাম দিয়েছে। গতকাল এই ছেলেটির সাথে তার বেশ জমেছে। লাজুক টাইপের ছেলেটি। শুভ্রতা বারবার জিজ্ঞাসা করছে কিভাবে রুমে আসছে কিন্তু ছেলেটা হেসেই যাচ্ছে। হঠাৎ কিসব বলল যার অর্থ শুভ্রতা বুঝলো না। মনে মনে আফসোসের সুরে বলল,
–” একজন মানুষের সব দেশের ভাষা জানা উচিৎ। স্পন্দন উনি তো কি সুন্দর ওদের ভাষা বুঝে এবং বলতেও পারে আর আমি কিনা কিছুই পারি না। লজ্জা থাকা উচিৎ শুভ্রতা তোর।”
শুভ্রতার বিড়বিড় করা দেখে ছেলেটি আবারো মুচকি হেসে দৌঁড় দিল। শুভ্রতা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলো। জানালার পাশে একটা পেয়ারা গাছ। ছেলেটি ইশারা করে বুঝালো সে পেয়ারা গাছে উঠে জানালা টপকে রুমে ঢুকেছে। শুভ্রতা হেসে চোখ দিয়ে ইশারা করলো সে বুঝেছে। পেয়ারা গাছ থেকে দুটো বড় বড় পেয়ারা শুভ্রতার হাতে দিয়ে ইশারা করলো খাওয়ার জন্য। শুভ্রতা অসহায়ের ভঙ্গীতে ইশারা করে বুঝালো সে ফ্রেশ হয়নি। ছেলেটি তখন শুভ্রতার হাত ধরে টেনে নিয়ে বাহিরে নিয়ে গেলো।
সবুজ গাছের উপরে পা ছোঁয়াতেই শুভ্রতা নেচে উঠলো। ইচ্ছা করছে সারাজীবন এইখানেই থাকতে। কিছুটা হাঁটার পর পায়ের নিচে পানি অনুভব করলো সে। ছেলেটি ইশারা করলো সামনে তাকানোর জন্য। পাহাড়ের গায়ে বেয়ে স্রোতের ভেগে ছুটে আসছে ঝর্ণা। পাহাড়ের উপরে তাকাতেই শুভ্রতার মাথা ঘুরানো শুরু করলো। কিন্তু বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে পাহাড় কন্যার এই জলস্রোত। নিম গাছের ডাল এনে শুভ্রতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাদের ভাষায় বলল শুভ্রতা এইবার কিছুটা বুঝলো। ছেলেটির চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
–” আমার দাঁত এমনিতেই শক্ত। দেখেছিস কি সাদা? আমার নামের সাথে দাঁতের কিন্তু বড্ড মিল হিহিহিহি।”
রাজা কি বুঝলো কে জানে সেও হাসতে লাগলো। শুভ্রতা একটু নিচে নেমে ঝর্নার পানিতে মুখ ডুবিয়ে দিল। ফ্রেশ হবার পর পেয়ারা দুটো হাতে ধরিয়ে দিল শুভ্রতার। শুভ্রতা চোখ ছোট ছোট করে, রাগী ভাব নিয়ে রাজার হাতে একটি পেয়ারা ধরিয়ে দিয়ে রাগী কণ্ঠে বলল,
–” একটা তুমি খাবে আরেকটা আমি। আসো পাহাড়ে উঠি।”
শুভ্রতা কিছুটা উঠতেই হাঁপিয়ে গেলো। রাজা দৌঁড়ে দৌঁড়ে উঠছে। হতাশ চোখে রাজার দিকে তাকিয়ে আছে শুভ্রতা। তারও বড্ড ইচ্ছা করছে এইভাবে দৌঁড়ে দৌঁড়ে উঠতে কিন্তু পাহাড়ের চূড়ায় তাকালেই তার বুক কেঁপে উঠে। পা ধরে বসে পড়লো শুভ্রতা। জোরে জোরে কান্না করছে সে। যেভাবেই হোক তাকে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হবে। রাজা হাত ধরে চোখে কান্না কান্না ভাব নিয়ে অনেক কিছু বলল। শুভ্রতা বুঝতে না পেরে কান্না করেই যাচ্ছে। হঠাৎ শুভ্রতার কোমরে কারো স্পর্শ পেতেই পিছন তাকালো। স্পন্দন তাকে কোলে তোলে নিচ্ছে। ভয়ে একবার পাহাড়ের চূড়ায় আরেকবার নিচে তাকিয়ে আতকে উঠলো সে,
–” দেখুন এইখান থেকে পরলে সোজা কবরে যেতে হবে। আমাকে নামান। পনেরো দিন যেহেতু থাকবো তাই একটু একটু করে পাহাড়ে উঠবো। তাড়াহুড়ো করার কিছুই নেই।”
–” তারমানে পনেরো দিন পাহাড়ে থাকার চিন্তা তোমার? একটু একটু করে উঠবে রাত এইখানে কাটিয়ে দিবে। তাহলে বিয়ারের সঙ্গে পাঠিয়ে দেই। সাপ, তেলাপোকা, কুমির, পঁচা মাছ খেয়ে জার্নি করবে তাছাড়া তোমাদের দুজনকে বেশ মানাবে।”
–” বাজে কথা ছাড়া আপনার মুখে আর কোনো কথাই শুনি নাই। জন্মের পর আন্টি মধু দেয়নি।”
–” তোমাকেও দেয়নি মধু ওকে। এইদিক দিয়ে আমরা বেশ মিলে গেছি সো কথা কম কাজ বেশি।”
শুভ্রতা স্পন্দনের গলা জড়িয়ে ধরলো। স্পন্দন হেঁটে চলছে শুভ্রতাকে কোলে নিয়ে। রাজা জোরে জোরে হাসছে। অনেকটা পথ হাঁটার পর শুভ্রতা পাহাড়ের দিকে আবারো তাকালো। নিচ থেকে যেমন উচুঁ এখনও ঠিক তেমন লাগছে। স্পন্দনের পুরো শরীর ঘামে ভিজে একাকার। ফর্সা মুখ দেখে টপটপ করে ঘাম বেয়ে পড়ছে। এই প্রথম শুভ্রতার স্পন্দনের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। মায়াও লাগছে খুব।
–” বাকিটুকু হেঁটে যেতে পারবো, আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে?”
–” চুপ একদম চুপ। আমাকে আমার মত চলতে দেও। বাঁধা দিলে খবর আছে।”
শুভ্রতা কথা বাড়ালো না। স্পন্দন হাঁটতে হাঁটতে একদম পাহাড়ের চূড়ায় উঠলো। শুভ্রতাকে দাঁড় করিয়ে সবুজ ঘাসের উপর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। শুভ্রতা স্পন্দনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
–” আর ইউ ওকে। আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?”
–” পানি হবে একটু?”
কথাটা যেন শুভ্রতার মনে তীরের মত বাঁধলো। রাজার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বুঝালো পানি চাচ্ছে। রাজা এক দৌঁড়ে চলে গেল পানি আনতে। পাহাড়ে বাতাস বইতে লাগলো কিন্তু স্পন্দনের শরীর এখনো ঘামছে। ওড়না দিয়ে পাখা বানিয়ে বাতাস করতে লাগলো শুভ্রতা। শুভ্রতার ঘাম ওড়না দিয়ে পরিষ্কার করে এইবার সে কাঁদতে শুরু করলো। কেন যেন তার মনে হচ্ছে, তার খুব কষ্ট হচ্ছে, আপন কাউকে হারানোর কষ্ট। স্পন্দন ক্লান্ত মাখা কন্ঠে বলল,
–” আরেহ পাগলী আমি ঠিক আছি। পানি পান করলেই চাঙ্গা হয়ে যাবো তাছাড়া তোমাকে না জ্বালিয়ে পুড়িয়ে আমি সহজে মরছি না। জানো আমার নাতি নাতনির বিয়ে দিয়ে তাদের আন্ডা বাচ্চা থেকে আরো আন্ডা বাচ্চা দেখার ইচ্ছা । সো কান্না না করে তোমার শুভ্র রঙের ওড়না দিয়ে বাতাস করো আমায়।”
স্পন্দনের কথা শোনে আরো কান্না করতে লাগলো শুভ্রতা। স্পন্দনের সেই ধমক কণ্ঠে বলা কথা, কিছুটা অভিমান, কিছুটা রাগ, কিছুটা দুষ্টুবি, কেয়ারিং সেই কথাকে সে বড্ড মিস করছে।
রাজা মাটির গ্লাসে পানি আনলো। এক চুমুকে সবটুকু সাবাড় করে ফেলল স্পন্দন। হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠলো,
–” শুভ্রতা? তোমার কোলে মাথা রাখতে পারি? আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে?”
শুভ্রতা স্পন্দনের কথায় সায় দিল। ঘাসের উপরে বসে স্পন্দনের মাথা তার কোলে রেখে মাথায় হাত বুলাচ্ছে শুভ্রতা। রাজা নানান ধরনের কথা বলছে সেই কথা বাংলায় রিপিট করছে স্পন্দন। শুভ্রতার কথা আবার ওদের মত করে বুঝাচ্ছে রাজাকে।
এইভাবে চলে গেলো পনেরো দিন। কথায় আছে সময় কিংবা স্রোত কাহারো জন্য অপেক্ষা করে না তাই স্পন্দন শুভ্রতার একত্রে থাকাটাও বেশিদিন স্থায়ী হলো না। হরতাল অবরোধ সব মিটমাট। গ্রামের মানুষরাই ঢাকা যাবার বাস ধরিয়ে দিল। রাজা তো কান্না করে অবস্থা খারাপ করে ফেলছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। যার যেখানে থাকা উচিৎ তাকে সেখানে যেতেই হবে। শুভ্রতার বেশি কষ্ট হয়েছিল রাজার জন্য। এই কয়দিনে রাজা ওর মন জয় করে ফেলেছে। ছোট্ট ভাইয়ের আসন নিয়েছিল রাজা।
বাসে বসে আছে অন্তু এবং আসু। স্পন্দন ফোন দিয়ে জানিয়েছে তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে তারা যেন চলে যায়। এতদিন পর তাদের বুক থেকে পাহাড় সমান পাথর সরলো ভেবেই শান্তির নিশ্বাস নিচ্ছে দুজন। আসু চট করে বলেই ফেলল,
–” স্যার? আমাকে আপনার কেন পছন্দ না? আপনার কি গার্লফ্রেন্ড আছে?”
–” কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। তাছাড়া তোমাকে পছন্দ করি না কে বলেছে?”
–” তাহলে আমায় ইগনোর কেন করেন?”
–” তুমিই তো আমাকে ইগনোর করেছ। প্রথম স্পন্দনের কাছে গিয়েছ ঐখানে পাত্তা না পেয়ে এখন আসছো আমার কাছে। তাহলে পাত্তা কেন দিবো?”
–” স্যার, স্পন্দন ভাইয়া আমার ক্রাশ ছিল। সে ছিল মৌহ, অল্প বয়সের আবেগ। তখন হয়তো ভালোবাসা কি আমি জানতাম না। যাকে ভালো লাগতো তাকেই ভাবতাম ভালোবাসি। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি। আমি কখনো প্রেমে পড়েনি । কিন্তু হ্যাঁ আপনাকে অনেক পছন্দ করি। এই পছন্দ শুধু মোহ নয় এইটা প্রেমমোহ। মোহ ত্যাগ করতে পারলেও প্রেমমোহ কখনো ত্যাগ করা যায় না। প্রতিদিন আপনি নামক মানুষটা নিয়ে ভাবলে সময় কিভাবে চলে যায় আমি বুঝি না। সব সময় আপনাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। অল্প বয়সের আবেগের কারণে আমায় এত বড় শাস্তি দেওয়া কি আপনার ঠিক হবে মিস্টার স্যার?”
অন্তু হাসলো। সে এতদিন ধরে আসমানীর মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনতে চেয়েছিল অবশেষে সে শুনতে পেরেছে। পিছনে একবার তাকিয়ে দেখলো সবাই যার যার মত ব্যাস্ত। এক হাতে আলতো করে আসুকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল,
–” আমি তো প্রথম দেখায় তোমাকে পছন্দ করে ফেলছিলাম আসু। যখন জানলাম তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের বোন তখন থেকেই তোমার ভাইকে শালাবাবু ডেকে আসছি। তুমি কি জানো তোমার ভাই আমাদের এই সম্পর্ক জানে। শুধু আশিক নয় স্পন্দনও জানে। সেদিন স্পন্দন তোমায় থাপ্পড় দিতো না শুধু মাত্র আমার জন্য থাপ্পড় খেয়েছো তুমি। তোমার হাবভাব দেখে খুব কষ্টে ছিলাম আমি। জানো তখন সিগারেট খাওয়া শুরু করে দিছিলাম। এই দেখে স্পন্দন তোমার উপর ক্ষেপে ছিল। যেদিন প্রপোজ করলে তাই রাগটা দমিয়ে না রেখে থাপ্পড় মারলো যেন ওর আশেপাশে না ঘুরো। আমার মতে বন্ধু হওয়া মানে স্পন্দনের মত হওয়া উচিৎ।”
অন্তুর কথা শোনে রেগে গিয়ে তার সেই ফেমাস মার্কা গালি দিতে লাগলো অন্তুকে। যখন ক্লান্ত হলো দেখলো অন্তু কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে ইংলিশ গান শুনছে। রাগে অভিমানে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। অন্তু মুচকি হেসে আসুর একটি হাতে কিস করে বসলো। কানের কাছে গিয়ে আবারো ফিসফিস করে বলল,
–” ভালোবাসি এই দুষ্টুর রাণীকে।”
___________________________
শুভ্রতা বাসায় ফিরার এক সপ্তাহ পর সাকিবকে যেতে হলো বিদেশে। কাজের কারণেই তার যাওয়া। স্পন্দনকে প্রথম বলা হয়েছিল কিন্তু সে যেতে রাজি হয়নি তাই বাধ্য হয়েই যেতে হলো সাকিবকে। সাকিবকে ঐখানে থাকতে হবে ছয়মাস। নীলু তো কেঁদে কেঁদে প্রায় পাগল হবার উপক্রম। বহু কষ্টে তাকে বুঝালো শুভ্রতা। ছয় মাস দেখতে দেখতে চলে যাবে। সাকিব ভাইয়া বিদেশ থেকে যদি ব্যাবসায়ের উন্নতি করতে পারে তাহলে সাকিবের বাবা মা খুশি হয়ে তাদের দুজনের বিয়েটাও দিয়ে দিতে পারে। সাকিবের কাছে চ্যালেঞ্জ এইটা। এর মাধ্যমে মা বাবার মন তাকে জয় করতে হবে। অবশেষে বুঝলো নীলু। সাকিব চলে গেলো দূর অজানা দেশে।
এইভাবে চলতে চলতে প্রায় তিনমাস কেটে দিলো। শুভ্রতাকে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা সব স্পন্দন করে। স্পন্দনের জন্য শুভ্রতার মনে কিছু একটা হয় কিন্তু কি হয় শুভ্রতা জানে না। অন্তু আসুর প্রেম জমে ক্ষীর। খুব তাড়াতাড়ি তারা বিয়ে করবে। নীলু এবং সাকিবের ফোনালাপের প্রেম চলছে।
_______________
দিয়া এবং শুভ্রতা মিলে শপিং করছে। শুভ্রতা এখনও সাদা পোশাক পরে। দিয়া অনেক বড় একটা টেডি দেখে বায়না করলো সে ওইটা কিনবে। দোকানের সামনে এসে দামদর করছে শুভ্রতা। ছোট্ট একটা বাচ্চা নিয়ে একজন মহিলা এসে দাঁড়ালো শুভ্রতার পাশে। শুভ্রতাকে দেখে হাসি দিয়ে বলল,
–” তুমি শুভ্রতা?”
অজানা এক মহিলার মুখে নিজের নাম শোনে অবাক হওয়ারই কথা। শুভ্রতা এবং দিয়াও বেশ অবাক হলো।
–” আমার নাম কিভাবে জানলেন আপনি?”
–” তোমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানি আমি। যদি জানতে চাও আসো কোথায় গিয়ে বসি আর তোমাকে বলি কিভাবে তোমাকে জানি আমি।”
শুভ্রতা দিয়ার দিকে তাকাতেই দিয়া সম্মতি দিল। রেস্টুরেন্টের এক কোণায় গিয়ে বসলো তারা। শুভ্রতার বলার আগেই মহিলাটি বলে উঠলো,
চলবে,
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।