প্রেমময়ী তুমি পর্ব-২২+২৩

0
454

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_২২
#নিশাত_জাহান_নিশি

অন্যদিকে নীড় এবং সাব্বির রেডি হয়ে বাড়ির মেইন গেইটে নূর এবং আয়মনের জন্য অপেক্ষা করছে। ভাড়া করা মাইক্রো নিয়ে তারা বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

ভর সন্ধ্যা। রজনীর প্রথম ভাগ শুরু হয়েছে মাত্র। অন্তরিক্ষে সূর্যের রক্তিম আভা মিলিয়ে বিদঘুটে কালো অন্ধকারে ছেঁয়ে গেছে বিস্তীর্ণ ভূ-মণ্ডল। মৃদুমন্দ বাতাসে আচ্ছন্ন বৃক্ষরাজি। পাখির কলতান মিইয়ে নির্বাক ধরণী। পূর্ব আকাশে কিঞ্চিৎ জায়গা জুড়ে চন্দ্রকরের বুৎপত্তি! সেই উপলক্ষে যেনো কান্তিমান আকাশের সৌন্দর্য দ্বিগুন, তিনগুন, চারগুন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে! শর্বরে নিমগ্ন ভূ-খণ্ড যেনো ক্রমশ ক্ষীণ আলোর দিশা খুঁজে পাচ্ছে! আবির মাখানো চন্দ্রকরের আলোয় নবচিত্তে মেতে উঠছে ধরা! মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে দিক থেকে বিদিক। চারপাশ আলোকিত সেই বিভোর সৌন্দর্যকে কোনো উপমা দ্বারা ব্যক্ত করার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না নূর! কেবলই মগ্ন দৃষ্টিতে এক ধ্যানে চেয়ে আছে শোভন আকাশের পানে! টং দোকানের বেঞ্চিতে বসে হাতে ভাড়ের চা নিয়ে তার যেনো মনগড়া হরেক রকম জল্পনা কল্পনা! মন খারাপের নানান বিজ্ঞাপন!

নূরের পাশেই বসে আছে আয়মন এবং সাদমান। দুজনই চায়ের ভাড়ে চুমুক দিয়ে শরীরকে নানানভাবে হেলিয়ে দুলিয়ে এয়ারফোনে গান শুনছে! কর্কশ গলায় আবার সেই গানের লিরিক্স ধরে টান দিচ্ছে! তাদের বেপরোয়া কার্যকলাপে নূর বড্ড বিরক্ত হচ্ছে। নাক-মুখ কুঁচকে তিক্ততা প্রকাশ করছে। এই মুহূর্তে গানে বুদ হয়ে থাকা দুই কুখ্যাত গায়ককে পিটিয়ে তক্তা বানাতে ইচ্ছে করছে তার! তবে মন-মানসিকতা খারাপ থাকার দরুন কোনোকিছুতেই মন বসছে না তার। নীরবে নিভৃতে নিজের মধ্যেই ডুবে থাকতে ইচ্ছে করছে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে নানা শ্রেণির লোকজন যাতায়াত করছে। ছেলে, মেয়ে, মহিলা, পুরুষ নির্বিশেষে। অনেক বয়োজ্যেষ্ঠরা আবার তাদের পাশে বসে ভাড়ে চা খাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে পারিবারিক, সাংসারিক, পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করছে। এসব দিকে আয়মন এবং সাদমানের। তারা দুজনই গানের নেশায় বিভোর। এরমধ্যেই আয়মন হঠাৎ প্রচলিত একটি হিন্দি গান ধরে জোরে টান দিলো! গানটা খুব প্রিয় হওয়ায় নূরও এবার নিস্তব্ধতা ভেঙে আয়মনের সাথে তাল মিলিয়ে শুষ্ক গলায় বলল, “তু চিজ বারি হে মাস্ত মাস্ত, তু চিজ বারি হে মাস্ত!”

আয়মন অনেক আগেই থেমে গিয়েছিল। শুধু গানের সাথে লিপ সিং করছিল। যাকে বলে গুনগুন করে গান গাওয়া। তবে নূর গানের এই লাইনটা প্রায় দু থেকে তিনবার জোরে জোরে গেয়েছিল! কেউ ভাবতেই পারেনি এরমধ্যেই হঠাৎ করে কোমল হাতের চড় এসে আয়মনের গালে পড়বে! কেউ আক্রমনাত্নক হয়ে তেড়ে আসবে তাদের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় আয়মন ভড়কে উঠল! চোখ তুলে চড় মারা মেয়েটির দিকে তাকালো। নূর বেকুব হয়ে মুখ চেপে মেয়েটির দিকে অধীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল! রাগে ফোঁস ফোঁস করে মেয়েটি আয়মনের দিকে হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মনে হলো যেনো এক্ষণি আয়মনকে আস্ত চিবিয়ে খেতে পারবে মেয়েটি! নূর এবং সাদমান আর এক মুহূর্তও ব্যয় করল না। অতিশয় বিপাকে পড়ে দুজনই চোরের মতো জায়গা থেকে ওঠে দৌঁড়ে পালালো! ডানে-বায়ে তাকিয়ে আয়মন হতাশ হলো। মনে মনে নূর এবং সাদমানকে গালি গালাজ করতে লাগল! সবার জীবনেই এমন কিছু হারামী বন্ধু আছে যারা বিপদে পড়লে বন্ধুকে রেখেই দৌঁড়ে পালায়! আড়ালে দাঁড়িয়ে মজা নেয়। বিপদ উদ্ধার হলেই চারিপাশ থেকে তাকে ঘিরে ধরে। বিভিন্নভাবে তাকে ক্ষেপানোর জন্য প্রস্তুত থাকে! নূর এবং সাদমানও সেই হারামী বন্ধুদের দলেই অন্তর্ভুক্ত হলো!

রোষ সংবরণ করে আয়মন নিরুপায় দৃষ্টিতে মেয়েটির তাকালো! অবুঝের মতো ভান ধরল। মেয়েটি রাগে নাক ঘঁষল। আয়মনের দিকে আক্রোশিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“রাস্তাঘাটে সুন্দুরী মেয়ে দেখলেই মুখ থেকে আজেবাজে গান বের হয়ে আসে না? তাদের টিজ করতে মজা লাগে?”

আয়মন ভোলা ভালা দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালো! নির্বাক গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী? আমি আপনাকে টিজ করেছি?”

“হ্যাঁ করেছেন। আলবাদ করেছেন! আমাকে উদ্দেশ্য করেই আপনি বিশ্রী গানটা গাইছিলেন!”

আয়মন এবার প্রচণ্ড ক্ষেপে উঠল! তড়িৎ বেগে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। নির্ভীক গলায় মেয়েটিকে বলল,,

“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে বুঝেছেন? আমি জাস্ট এয়ারফোনে গান শুনছিলাম। আর মনে মনে গানটা গুনগুন করে গাইছিলাম। এরমধ্যে যদি আপনি হঠাৎ ছুটে এসে আমার গালে চড় বসিয়ে দিন এখানে আমার কী দোষ হ্যাঁ?”

মেয়েটি ধমকের স্বরে পুনরায় বলল,,

“মনে মনে গুনগুন করছিলেন হ্যাঁ? নাকি জোরে জোরে গানটা গাইছিলেন? আমি সব শুনেছি বুঝেছেন? আপনি যে আমাকে দেখেই জোরে জোরে গানটা গাইছিলেন আমি বেশ বুঝতে পেরেছি!”

আয়মন অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল। রুক্ষ গলায় বলল,,

“আরেহ্! কখন থেকে কী যা তা বলছেন? আমি আপনাকে দেখে জোরে জোরে গানটা গাইতে যাব কেন হ্যাঁ? আমি তো জাস্ট লিপ সিং করছিলাম। জোরে জোরে তো গানটা গাইছিল আমার বন্ধু নূর!”

“ঢপবাজি করবেন না আমার সাথে, একদম না। আমি আপনাকেই জোরে জোরে গানটা গাইতে শুনেছি! রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না, না? কখন তাদের টিজ করবেন সেই ধান্দায় থাকেন? অসভ্য, বেহায়া, নির্লজ্জ ছেলে কোথাকার! বাড়িতে নিশ্চয়ই মা-বোন নেই? তাই এই বেহায়াপনা দশা আপনার। খবরদার বলছি নেক্সট টাইম থেকে যেনো আপনাকে কোথাও না দেখি যে রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে মেয়েদের টিজ করছেন। সাবধান করে গেলাম কিন্তু! পরেরবার আর সাবধান করব না। সোজা পুলিশে দিয়ে দিব!”

তুখার রাগ নিয়ে মেয়েটি আয়মনের সামনে থেকে প্রস্থান নিলো! আয়মন হতবিহ্বল দৃষ্টিতে মেয়েটির যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল! সে যেনো বিশাল এক ঘোরে ডুবে আছে! ঘোর কাটিয়ে কিছুতেই বর্তমানে ফিরতে পারছে না সে। কিছুটা দূর থেকে দাঁড়িয়ে আয়মনের নাজেহাল অবস্থা দেখে নূর এবং সাদমান হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে! দুজনই বেশ ভালোই মজা নিচ্ছে। হাসাহাসির পর্ব শেষ হতেই দুই কালপ্রিট মন্থর পায়ে হেঁটে আয়মনের দিকে এগিয়ে এলো! তন্মধ্যেই আয়মন মেয়েটির যাওয়ার পথ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে অগ্রে তাকালো। নূর এবং সাদমানের দাঁত কেলানো হাসি দেখামাত্রই আয়মনের মাথায় রক্ত ওঠে গেল! রক্তিম দু’চোখে আয়মন নূর এবং সাদমানের দিকে তাকালো। ভাড়ের চা’টা বেঞ্চির উপর রাখল। কিছু বলার বা করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগল। এরমধ্যেই নূর হঠাৎ সাদমানের কাঁধে হাত রেখে শ্লেষাত্মক গলায় বলল,,

“কী খবর মামা? কেমন লাগল মেয়েদের নরম হাতের চড়?”

আয়মন এবার কন্ট্রোললেস হয়ে পড়ল! কটমট দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। শার্টের হাতা ফোল্ড করে নূরের দিকে তেড়ে এসে বলল,,

“শালা হারামী! আমারে ফাঁসাইয়া এখন আমার খবর নিতে আসছস তাই না? বোকার হদ্দ পাইছস আমারে? দাঁড়া আজ তোর একদিন কী আমার একদিন!”

নূর আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না! দৌঁড়ে জায়গা থেকে পালালো। যেতে যেতে বলল,,

“যাই বলছ মামা, মেয়েটা কিন্তু জুস!”

নূরের পিছু নিলো আয়মন। কড়া গলায় বলল,,

“জুস হলে গিলে খা। যত ইচ্ছা তত খা। জাস্ট একবার তোকে হাতের কাছে পেয়ে নিই নূর! চড়ের প্রতিশোধ তো আমি কড়ায় গণ্ডায় শোধ করব-ই করব।”

“চড়ে খেয়েছিস ভালো কথা! মেয়ের নাম্বারটা কালেক্ট করতে পারলি না? লাইন টাইন মারতি একটু। আর কতকাল সিংগেল থাকবি বল?”

“মিংগেল হইয়া তোর মতো ছ্যাঁকা খাওনের ইচ্ছা নাই আমার!”

“ছ্যাঁকা আমি খাই নাই মামা! ছ্যাঁকা তো খাইছে রোজ! নূরকে হারাইছে সে! বুঝতে পারছস? নূরকে হারাইছে! নূরের মতো বিশাল মনের একটা ছেলেটাকে হারাইছে।”

দুজনই দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হাঁপিয়ে উঠল! ক্লান্ত হয়ে দুজনই এয়ারপোর্টের প্রবেশ দ্বারে এসে থামল। তাদের পিছু পিছু সাদমানও দৌঁড়ে এলো। অমনি তিনজনের আকস্মিক দৃষ্টি পড়ল এয়ারপোর্টের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা মাহিন, সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরীর দিকে! তাদের এগিয়ে আনার জন্য এয়ারপোর্টের লটে দাঁড়িয়ে আছে নীড় এবং সাব্বির। নীড়কে দেখামাত্রই তারা তিনজন হাসিমুখে এগিয়ে এলো তাদের দিকে। নূর খুশিতে হেসে উঠল। আয়মন এবং সাদমানকে লক্ষ্য করে বলল,,

“ভেতরে চল। মাহিন এসেছে!”

আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না নূর! আয়মন এবং সাদমানকে নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে এয়ারপোর্টের ভেতর প্রবেশ করল। মাহিন বেশ আনন্দঘন হয়ে সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরীকে রেখে দৌঁড়ে এলো নীড়ের দিকে। আষ্টেপৃষ্টে নীড়কে জড়িয়ে ধরে প্রফুল্লিত গলায় বলল,,

“কেমন আছো ভাইয়া?”

নীড় খুশিতে প্রায় আত্মহারা! ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরে সে উদ্বেলিত গলায় বলল,,

“ভালো আছি মাহিন। তুই কেমন আছিস?”

“আমি তো খুব বেশি ভালো আছি ভাইয়া! এতো গুলো বছর পর আমার পরিবারের লোকজনদের সাথে আমার দেখা হচ্ছে। আর আমি ভালো থাকব না বলো?”

“জানিস? মা-বাবা খুব খুশি হবে তোকে পেয়ে। বাড়িতে এতক্ষণে এলাহি কাণ্ড বেঁধে আছে তোকে ঘিরে। তারা হয়তো মরিয়া হয়ে উঠেছে কখন তোকে কাছে পাবে!”

“আমিও ভীষণ উত্তেজিত ভাইয়া। মা-বাবকে কাছে পাওয়ার জন্য! সবাইকে কাছ থেকে দেখার জন্য।”

মৃদু হেসে নীড় মাহিনকে তার বুক থেকে উঠিয়ে নিলো। দিশেহারা হয়ে মাহিনের কপালে চুমু খেল! মাহিনকে পাশ কাটিয়ে নীড় এবার সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। প্রফুল্ল গলায় দুজনকে সালাম জানিয়ে বলল,,

“কেমন আছেন আঙ্কেল-আন্টি?”

দুজনই মিষ্টি হেসে নীড়ের দিকে তাকালো। নীড়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সমস্বরে বলল,,

“আমরা ভালো আছি বাবা৷ তুমি কেমন আছো?”

“আপনাদের দোয়ায় আমিও ভালো আছি। বাড়িতে মা-বাবা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কখন আপনারা মাহিনকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছাবেন সেই দুঃশ্চিতায় অস্থির হয়ে উঠছেন!”

সেলিনা চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন! ক্ষীণ গলায় বললেন,,

“আমরা যতোই করি না কেন বাবা, মা-বাবার টান কিন্তু আলাদাই হয়! মাহিন এত বছর ধরে আমাদের সাথে আছে তবুও আজও অবধি তার মা-বাবার জায়গাটা আমরা দখল করতে পারলাম না! ছেলে শুধু নিজের মা-বাবাকেই কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে! উত্তেজনায় ছেলেটা দু’রাত ধরে ঘুমায় নি জানো? কখন দেশে ফিরবে সেই চিন্তায় ছিল!”

নীড় মলিন হাসল! সেলিনা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল,,

“আপনার ধারণা হয়তো ভুলও হতে পারে আন্টি! মাহিন শুধু নিজের বাবা-মাকে নয় আপনাদেরও ভালোবাসে। আপনারা কাছে থাকেন বলে হয়তো টের পান না, তবে দূরে গেলে ঠিকই টের পাবেন। তখন মাহিন আপনাদেরও কাছে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে!”

আফতাব চৌধুরী কথায় ফোড়ন কাটলেন। নীড়কে লক্ষ্য করে বললেন,,

“আমিও সেলিনাকে তাই বলি। দূরত্বে গুরুত্ব বাড়ে। আমরা যখন মাহিনের থেকে দূরে যাব তখন মাহিন আমাদেরও গুরুত্ব বুঝবে।”

নীড় সায় জানালো। মৃদু হেসে বলল,,

“জি আঙ্কেল আপনি ঠিক বলেছেন!”

তাদের তিনজনেরই দৃষ্টি পড়ল অট্ট হাসিতে ফেটে পড়া মাহিন এবং নূরের দিকে। দুজনই দুজনের কাঁধে হাত রেখে হাসতে হাসতে কাহিল। মূলত তাদের হাসির কারণ হচ্ছে আয়মনের একটু আগের চড় খাওয়ার মর্মান্তিক কাহিনী! দূর থেকে বুঝাই যাচ্ছে না কে মাহিন আর কে নূর! দুজনই পড়েছে নীল শার্ট তার উপর দুজনই টুইন! নিজে থেকে তারা পরিচয় না দিলে কেউ তাদের চিনতে পারবে না এটা শিওর। আয়মন এবং সাদমান বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে অনেক আগেই! নূর এবং মাহিনকে আলাদা করতে পারছে না তারা! নতুন করে আবার বিভ্রান্ত হয়ে উঠল সেলিনা চৌধুরী, আফতাব চৌধুরী এবং নীড়ও! সেই বিভ্রান্তি নিয়েই তাদের গাড়িতে ওঠে বসা! বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া। গাড়িতে বসেছে নীড়, মাহিন, নূর, সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরী। বাসে করে বাড়ির পথে রওনা হয়েছে আয়মন, সাদমান এবং সাব্বির। সারা পথ জুড়ে ননস্টপ কথা বলে গেছে নূর এবং মাহিন! যতো রাজ্যের জমানো কথা আছে সব তারা গাড়িতে বসেই সেরে নিচ্ছে। সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরী তাদের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে। ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে নীড় পিছু ফিরে ব্যাক সিটে তাকালো। নূর এবং মাহিনের দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই তোদের মধ্যে নূর কে?”

নূর হাত তুলল! আচ্ছন্ন গলায় বলল,,

“আমি ভাইয়া। কেন?”

“তুই গাড়ি থেকে নাম! সি.এখন.জি বা রিকশা করে বাড়ি ফির। তোদের দুজনকে একসাথে দেখলে বাড়ির সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যাবে! তাই আমি চাই না মাহিনের আগমন বিভ্রান্তি দিয়ে হোক।”

নূর গম্ভীর মুখে নীড়ের দিকে তাকালো। মাহিন রাশভারী গলায় নীড়কে লক্ষ্য করে বলল,,

“থাক না ভাইয়া। আমি এবং নূর একসাথেই যাই প্লিজ।”

নীড় দ্বিমত পোষণ করল। নমনীয় গলায় বলল,,

“বাড়ি পৌঁছে তো আবার এক হবি-ই। এখন নূরকে যেতে দে। ভাইয়া যা বলছি তাই শোন।”

নূর রাগে গজগজ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল! সি.এখন.জিতে ওঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মনে মনে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,,

“গাড়ি থেকে নামানোর হলে আগেই নামিয়ে দিতো। আয়মন আর সাদমানের সাথে এক বাসে করে বাড়ি ফিরে যেতাম। অযথা রাস্তার মাঝখানে এনে আমাকে অপদস্ত করল!”

,
,

ঘড়িতে রাত প্রায় নয়টা চলমান। মাহিনকে নিয়ে বাড়ির ড্রয়িংরুমে খুশির স্রোত বহমান। সাবরিনা আবরার এবং হাবিব আবরার মাহিনকে পেয়ে খুশিতে ফেটে পড়ছে। পারছেনা তারা মাহিনকে বুকে পুড়ে নিতে। মাহিনও তাদের পেয়ে ভীষণ খুশি। কিছুক্ষণ পর পর মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরছে। পুরো বাড়িতে খুশির রোল পড়ে গেছে। সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরীও মাহিনকে ঘিরে বসে আছে। সাবরিনা আবরার এক এক করে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন মাহিনের। ড্রয়িংরুমে সবার উপস্থিতি টের পাওয়া গেলেও চাঁদের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে না। একটু আগেই চাঁদ ঘুমিয়ে পড়েছে! পুচিকে বুকে নিয়েই ঘুমাচ্ছে সে। নূর একটু আগেই বাসে করে বাড়ি ফিরেছে। আয়মন, সাদমান এবং সাব্বিরের সাথে ড্রয়িংরুমে এসে জয়েন করেছে। সবার মধ্যখানে নূর চাঁদকে দেখতে না পেয়ে জায়মার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“জায়মা। চাঁদ কোথায়?”

জায়মা অবাক হলো। মনে মনে বিড়বিড়িয়ে বলল,,

“ওমা! এ তো দেখছি ভূতের মুখে রাম নাম!’

গলা ঝাঁকালো জায়মা। ক্ষীণ গলায় বলল,,

” চাঁদ তো ঘুমাচ্ছে ভাইয়া।”

“আচ্ছা ঐ আপদটা কি এখনো আছে না গেছে?”

“কোন আপদ ভাইয়া?”

“ঐ যে বিড়ালছানাটা!”

“ওহ্ পুচি? পুচি তো এখনো চাঁদের সাথেই আছে ভাইয়া!”

নূর শুকনো ঢোক গিলল! পাশ কাটিয়ে মাহিনের পাশে এসে বসল। মাহিনের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“আচ্ছা তোর ও তো বিড়ালে এলার্জি আছে তাই না?”

মাহিন ভ্রু কুঁচকালো! সহমত পোষণ করে বলল,,

“নেই মানে? সাংঘাতিক এলার্জি আছে।”

মাহিন খানিক নড়ে-চড়ে বসল। নূরের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“আচ্ছা নূর, আমার বেডরুমটা কোনদিকে? একটু ফ্রেশ হতে হবে।”

নূর বাঁকা হাসল! মনে মনে বিড়বিড়িয়ে বলল,,

“এই সুযোগ মাহিনকে অপদস্ত করার! শুধু আমিই এলার্জির প্রবলেমে ভুগব কেন? তুইও ভোগ!”

নূর গলা ঝাঁকালো। ধীর গলায় বলল,,

“দুতলায় ওঠে ডান পাশের রুমটাই তোর।”

মাহিন ওঠে দাঁড়ালো। উপস্থিত সবার থেকে পারমিশন নিয়ে উপরে ওঠে গেল। নূরের কথামতো দুতলার ডান পাশের রুমে প্রবেশ করা মাত্রই মাহিন আচম্বিতে কারো সাথে ধাক্কা খেলো! উদগ্রীব দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে দেখল চাঁদ কটমট দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকিয়ে আছে! মাহিন ভড়কালো। ভ্রু যুগল কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,

“কে আপনি?”

চাঁদ মুখটা হা করে মাহিনের দিকে তাকালো। বিস্মিত গলায় বলল,,

“এ্যাঁ?”

“আরে এ্যাঁ আবার কী? আপনি আমার রুমে কী করছেন হুম?”

“মাথা কি সত্যি সত্যিই গেছে আপনার? আমাকে চিনতে পারছেন না আপনি?”

“আরে আশ্চর্য তো! আমার মাথা যাবে কেন? আর আপনি কে? কাকেই বা চিনতে পারছি না আমি?”

চাঁদ কোমরে হাত রাখল। খড়তড় দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। তেজী গলায় বলল,,

“আজও আবার নেশা-ভান করেছেন হ্যাঁ? মাতলামি করছেন আমার সাথে?”

মাহিন তেজী দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“ভালোয় ভালোয় জিজ্ঞেস করছি কে তুমি বলো?”

চাঁদ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। কোনো কথা না বাড়িয়ে সে বিছানা থেকে ঘুমন্ত পুচিকে কোলে তুলে নিয়ে এলো! মাহিনকে নূর ভেবে ভয় দেখানোর জন্য মাহিনের মুখের সামনে পুচিকে ধরল। বাঁকা হেসে বলল,,

“এবার অটোমেটিকলি আপনার স্মৃতিশক্তি ফিরে আসবে! মনে করে দেখুন কে আমি!”

অমনি মাহিন হাত দ্বারা নাক-মুখ চেপে ধরল। প্রকাণ্ড চক্ষুজোড়ায় ঘোর আতঙ্ক নিয়ে জোরে চিৎকার করে বলল,,

“মামামামা। আমার এলার্জি।”

পেছন থেকে অট্ট হাসির আওয়াজ ভেসে এলো! নূর হাসতে হাসতে মাহিনের পাশে এসে দাঁড়ালো। চাঁদের দিকে তাকিয়ে নমনীয় স্বরে বলল,,

“থ্যাংকস চাঁদ! আমার মনের আশা পূরণ করার জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

চাঁদ তাজ্জব দৃষ্টিতে নূর এবং মাহিনের দিকে তাকালো! বারংবার চোখ ঘুরিয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“মাহিন ভাইয়া কখন এলো?”

নূর এখনো ননস্টপ হেসে চলছে! হাসতে হাসতে নাজেহাল অবস্থা তার। দ্বিধা ভুলে চাঁদ ধীর দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। এক নজরে নূরের দিকে তাকিয়েই রইল! এক অবিচ্ছেদ্য টানেই নূরের মোহভরা হাসিমুখ থেকে কিছুতেই দৃষ্টি সরাতে পারল না সে!

#চলবে…?

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_২৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

নূর এখনো ননস্টপ হেসেই চলছে! হাসতে হাসতে নাজেহাল অবস্থা তার। দ্বিধা ভুলে চাঁদ ধীর দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। এক নজরে নূরের দিকে তাকিয়েই রইল! এক অবিচ্ছেদ্য টানেই নূরের মোহভরা হাসিমুখ থেকে কিছুতেই দৃষ্টি সরাতে পারল না সে!

অচিরেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো চাঁদ। হঠকারিতায় মাথা নুইয়ে নিলো! জিভ কেটে নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালো। মিনমিনে গলায় বলল,,

“ছিঃ! এসব আমি কী করছিলাম? নূর ভাইয়ার দিকে ওভাবে বেহায়ার মতো তাকিয়েছিলাম? আমার চিরশত্রুর দিকে ওভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়েছিলাম? ভাগ্যিস, লোকটা কিছু আন্দাজ করে নি! নয়তো আজ আমার খবর ছিল! কী না কী ভাবত আমায় নিয়ে! হয়তো আমাকে নিয়ে মনগড়া অনেক খারাপ ধারণাও পোষণ করত! পরবর্তীতে তা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত।”

নূর হাসি থামালো। চাঁদের কাণ্ডকীর্তি তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেল! স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তব্ধিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা মাহিনের দিকে। অপরদিকে মাহিন নির্বোধ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো! ভ্রু যুগল খানিক কুঁচকে জিজ্ঞাসু গলায় বলল,,

“এখানে কী হচ্ছে একটু বলবি? এই চাঁদ মেয়েটা কে? প্লিজ পরিচয়টা ক্লিয়ার কর।”

নূর গলা ঝাঁড়লো। মাহিনের কাঁধে হাত রেখে অধীর গলায় বলল,,

“আরেহ্ চাঁদকে চিনলি না? চাঁদ হলো আমাদের মেঝো খালামনির ছোটো মেয়ে। যে বি’চ্চু মেয়েটার কথা আম্মু তোকে বার বার ড্রয়িংরুমে বলছিল এই সেই মেয়ে!”

তাৎক্ষণিক চাঁদ ক্ষেপে উঠল! পুচিকে কোলে নিয়ে নূরের দিকে আরও একটু তেড়ে এলো। তটস্থ গলায় বলল,,

“কী বললেন আপনি হ্যাঁ? আমি বি’চ্চু? আপনার কোন পাঁকা ধানে মই দিয়েছিলাম আমি হ্যাঁ? কেন মাহিন ভাইয়ার সামনে আমাকে এভাবে অপদস্ত করছেন? নিজে তো আমাকে সম্মান দিতে পারবেনই না সাথে অন্য কাউকেও সম্মান দিতে দিবেন না? পেয়েছেনটা কী আপনি আমাকে হ্যাঁ?”

পুচি মাত্র ঘুম ভেঙে উঠল। আলসেমি কাটাতে অগত্যাই হাত-পা ছুঁড়ল নূরের মুখের সামনে! জিভ চেটে খর্ব গলায় ম্যাও বলে ডেকে উঠল। অমনি নূর ভড়কে উঠল! এক পা দু’পা করে পেছনের দিকে হাঁটা ধরল। ডান হাতের তর্জনী আঙুলটা চাঁদের দিকে তাক করে কম্পিত গলায় বলল,,

“খবরদার বলছি চাঁদ। আর এক পা ও আমার দিকে এগুবে না। ওয়ার্ণ করছি কিন্তু হ্যাঁ? যদি এর বাইরে যাও না? তবে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে এই বলে দিলাম!”

“কী খারাপটা হবে শুনি? কী করবেন আপনি আমার? শকুনের মতো ওভাবে তাকানো ছাড়া আর কী-ই বা এলেম আছে আপনার?”

নূর আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না! ঝগড়া ভুলে দৌঁড়ে পালালো জায়গা থেকে! যেতে যেতে আক্রোশিত গলায় বলল,,

“জাস্ট একদিন শুধু মারপ্যাচে পাই তোমায়! কী যে একটা সাংঘাতিক অবস্থা করব তোমার যা তুমি ভাবতেও পারছ না! তখন কিন্তু হাজার কান্নাকাটি করেও পাড় পাবে না বলে দিলাম। আমি কিছুতেই তখন ছাড় দিব না তোমায়। কড়া গণ্ডায় প্রতিটা অপদস্তের প্রতিশোধ নিব।”

“আরেহ্ যান যান। খালি মুখে মুখেই বড়ো বড়ো কথা আপনার! ধাঁর ধাঁরি না আমি আপনার এসব আউল ফাউল কথার বুঝলেন? ছ্যাঁকাখোর কোথাকার! আইছে আমারে হুমকি দিতে। ফাটা পোস্টার নিকলা হিরো!”

নূরের ছায়াটিও আর দেখা গেল না! সোজা রুমের ভেতর ঢুকে পড়ল সে। অস্থিরমনা হয়ে সারাঘরে পায়চারী করতে লাগল! রাগে গজগজ করে নিজের হাতে নিজেই ঘুঁষি বসাতে লাগল! ঘাড়ের রগ টান টান করে উত্তেজিত গলায় বলল,,

“শিট। আর পারা যাচ্ছে না ঐ ধূর্ত মেয়েটার সাথে৷ সুযোগ বুঝে ঠিক আমার দুর্বল জায়গাগুলোতেই বার বার আঘাত করছে। সিরিয়াসলি আর সহ্য করা যাচ্ছে না এত অপমান। আমারও সুযোগ বুঝে মেয়েটার দুর্বল জায়গায়গুলোতে আঘাত করতে হবে! চূড়ান্ত একটা শাস্তি দিতে হবে ঐ মেয়েটাকে! তবেই নূরকে ভয় পেতে বাধ্য হবে ঐ বি’চ্চু মেয়েটা। এট অ্যানি কস্ট আমার ভয় মেয়েটার মনে ঢুকাতেই হবে।”

নূরের যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ বিদ্বেষী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চাঁদ পুচিকে কোলে নিয়ে মাহিনের দিকে এগিয়ে এলো। জোরপূর্বক হেসে কিছু বলার পূর্বেই মাহিন নাক সিটকে হাত দ্বারা নাকটা ঢেকে নিলো। চোখের ইশারায় তার সমস্যার কথা বুঝালো! মাহিনের ইশারা বুঝে চাঁদ শুকনো হাসল। তাড়াহুড়ো করে পুচিকে ওড়নার তলায় ঢুকিয়ে নিলো! শুষ্ক গলায় মাহিনকে বলল,,

“এবার আমাকে চিনতে পেরেছেন তো মাহিন ভাই?”

মাহিন ম্লান হাসল৷ নাকে হাত রেখেই অস্পষ্ট গলায় বলল,,

“হ্যাঁ, পেরেছি। আর হ্যাঁ, একটু আগে তোমাকে না চিনেই অনেক কিছু বলে ফেলেছিলাম চাঁদ। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড ওকে?”

চাঁদ দাঁত কপাটি দেখিয়ে হাসল৷ সরু দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। স্বস্তিজনক গলায় বলল,,

“আর যাই হোক, আপনি ঐ মাতাল নূরটার মতো হন নি! যথেষ্ট নস্র, ভদ্র এবং নরম মনের হয়েছেন! কী সুন্দর প্রথমে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেও পরে আবার তা স্বীকার করলেন। এমনকি মাইন্ড করতেও বারণ করলেন। সত্যিই আপনার ব্যবহারে আমি খুবই ফুলফিল হয়েছি মাহিন ভাইয়া।”

বেশ সক্রিয় হয়ে মাহিন নাক থেকে হাতটি সরিয়ে নিলো৷ এক ভ্রু উঁচু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। তৎপর গলায় শুধালো,,

“হোয়াট ডু ইউ মিন বাই মাতাল? আমার ভাই মাতাল?”

চাঁদ শুকনো ঢোক গিলল। রাগান্বিত অবস্থায় মাহিনকেও নূরের মতোই ভয়ংকর দেখাচ্ছে! অতিশয় বিপাকে পড়ে চাঁদ মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,

“আইলা এ তো দেখছি দুইটাই এক পিস! একটাকে মাতাল বলাতে আরেকটা ক্ষেপে গেল? তার মানে আমি এতক্ষণ ধরে যা যা ভাবছিলাম সব ভুল ছিল? মাগো! এ কোন মহা ফ্যাসাদে ফেঁসে গেলাম আমি? এখন কি একেও আমার স্যরি বলতে হবে? যদিও একে স্যরি বলতে আমার কোনো সমস্যা নেই! তবে নূরের বাচ্চাকে কিছুতেই স্যরি বলা যাবে না! এ হলো আমার জন্মের শত্রু! শত্রুদের সাথে কোনো কম্প্রোমাইজ নয়।”

চাঁদ গলা ঝাঁড়লো। কম্পিত দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। আড়ষ্ট গলায় বলল,,

“স্যরি ভাইয়া। ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো আপনার সামনে আপনার টুইন নূর ভাইয়াকে মাতাল বলব না।”

মাহিন কপাল কুঁচকালো। ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“মানে? অন্য কারো সামনে নূরকে ঠিকই মাতাল বলবে?”

“না তো ভাইয়া! আমি একথা কখন বললাম? আমি তো কারো সামনেই মাতালকে মাতাল বলব না! শুধু মনে মনেই আত্মার শান্তির জন্য তাকে মাতাল মাতাল বলে জপ করব!”

মাহিন কটমট দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো! চাঁদ আর এক মুহূর্ত ব্যয় করল না। রাস্তা মাপতে আরম্ভ করল! মাহিনকে উপেক্ষা করে সামনে পা বাড়িয়ে গলা খাদে এনে বলল,,

“আমি এখন যাচ্ছি মাহিন ভাইয়া! পুচিকে ওর বাড়ি রেখে আসছি। এই রুমের পাশের রুমটাই আপনার বুঝেছেন? গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। সকাল থেকেই হয়তো অনেক ধকল গেছে আপনার উপর।”

এক মুহূর্তের জন্য থামল চাঁদ। পুনরায় লাগামহীন গলায় বলল,,

“বাই দ্যা ওয়ে, নাইস টু মিট ইউ মাহিন ভাই।”

চাঁদ আর ডানে-বায়ে তাকালো না। এক দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে মাহিন অট্ট হাসল! মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,,

“নূর ঠিকই বলেছে, এই মেয়ে সত্যিই বিচ্চু!”

হাসতে হাসতে মাহিন তার রুমে প্রবেশ করল। গাঁয়ের ব্লু শার্টটা খুলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। চাঁদ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। ড্রয়িংরুমের পরিবেশ এখন বেশ রমরমা। বাড়ির প্রতিটি সদস্য ড্রয়িংরুমে উপস্থিত। একে-অপরের সাথে নানা ধরনের খোশগল্পে মশগুল। সবার চোখে- মুখে হাসি-খুশি ঠিকরে পড়ছে। মাহিন এবং সেলিনা চৌধুরীকে পেয়ে সবাই বেশ খুশি। এই মুহুর্তে চাঁদ কাউকে ডিস্টার্ব করতে চাইল না। উপস্থিত সবাইকে উপেক্ষা করে মন্থর পায়ে হেঁটে বাড়ির সদর দরজায় চলে এলো। অমনি পেছন থেকে রুহির গলার স্বর ভেসে এলো। চাঁদ তৎক্ষনাৎ পিছু ফিরে তাকালো। রুহি দ্রুত পায়ে হেঁটে চাঁদের দিকে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞাসু গলায় বলল,,

“কোথায় যাচ্ছ আপু?”

“পাশের বাড়ি যাচ্ছি। পুচিকে ওর বাড়ি পৌঁছে দিতে।”

“তুমি একাই যাবে?”

“কেন? তুই যাবি?”

“হুম! এখানে খুব বোর লাগছে আপু। একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসলে হয়তো ভালো লাগত।”

চাঁদ মৃদু হেসে সম্মতি জানালো। রুহির কাঁধে হাত রেখে রুহিকে নিয়ে বাড়ির সদর দরজা পাড় হলো। বাড়ির মেইন গেইটের কাছে আসতেই রুহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। সন্দিহান গলায় বলল,,

“আচ্ছা আপু? ইনিই কী সেই সেলিনা চৌধুরী? যার জন্য মেঝো খালামনির সাথে বড়ো খালামনির খুব ঝগড়া হয়েছিল? যার কারণে অনেক বছর আগে বড়ো খালামনির সাথে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছিল?”

চাঁদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ব্যগ্র গলায় বলল,,

“হ্যাঁ রে! এই সেই সেলিনা চৌধুরী! যার জন্য খালামনির সাথে আম্মুর ঝগড়া হয়েছিল। আম্মুর মুখ থেকে যতটুকু শুনেছি মূলত ঝগড়া হওয়ার কারণ ছিল মাহিন ভাইয়া! আম্মু এবং ছোটো খালামনি চায়নি সেলিনা চৌধুরীর কাছে মাহিন ভাইয়াকে দত্তক দিতে!”

“সিরিয়াসলি আপু? বড়ো খালামনি মাহিন ভাইয়াকে দত্তক দিয়েছিল?”

“হ্যাঁ এরকমই কিছুটা। যদিও এই বিষয়ে আমি তেমন কিছু জানিনা। তবে সোহা আপু এই বিষয়ে খুব ভালো জানেন।”

“আমার না খুব জানতে ইচ্ছে করছে আপু, বড়ো খালামনি কেন মাহিন ভাইয়াকে দত্তক দিয়েছিল?”

“আমারও খুব জানতে ইচ্ছে হয়। তবে আম্মু এবং আপুর ভয়ে খালামনিকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয়ে ওঠে না। আর একটা কথা, তুই কিন্তু ভুলেও আম্মু, আপু কিংবা খালামনিকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবি না।”

“আচ্ছা আপু জিজ্ঞেস করব না। তবে একটা জিনিস ডাউট হচ্ছে আমার!”

“কী?”

“মেঝো খালামনি আসবে তো বিয়েতে? সেলিনা চৌধুরী কিন্তু এখানেই আছেন!”

“আরেহ্ আসবে। আসবে না কেন হ্যাঁ? আর কতকাল এভাবে রাগ-অভিমান পুষিয়ে রাখবে? সবকিছুর-ই একটা তো সীমা থাকে না-কি? এবার আমি কিছুতেই আম্মুকে সেই সীমা অতিক্রম করতে দিব না।”

কথা বলতে বলতে দুজনই পাশের বাড়ির মেইন গেইট অবধি চলে এলো। গেইট ক্রস করে দুজনই দুতলায় ওঠে গেল। চাঁদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফ্ল্যাট নাম্বার দুই এর কলিং বেল চাপল। অমনি পুচি আহ্লাদি হয়ে চাঁদের মুখ চাটতে লাগল। পাশ থেকে রুহি খুব হেসে পুচিকে আদর করতে লাগল। পুচির থাবায় মোলায়েমভাবে চিমটি কাটতে লাগল! পুচি রেগে বোম হয়ে খড়তড় গলায় ম্যাও বলে ডাকতে লাগল। প্রায় তিন থেকে চারবার কলিংবেল চাপ দেওয়ার পর আকস্মিকভাবেই একজন মাঝবয়সী ছেলে এসে ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলে দিলো! চোখ দুটো লাল হয়ে আছে ছেলেটির! দেখেই মনে হচ্ছে নেশাগ্রস্ত। শরীরটাও কেমন ঢুলু ঢুলু করে কাঁপছে ছেলেটির। নাক ঘঁষে কম্পিত দৃষ্টিতে বার বার চাঁদ এবং রুহির দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটির বর্তমান ভয়ানক অবস্থা দেখে চাঁদ এবং রুহি দুজনই শুকনো ঢোক গিলল। একে-অপরের দিকে ভয়াল দৃষ্টিতে তাকালো। নাক টেনে ছেলেটি চাঁদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,

“কী চাই?”

সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটির মুখ থেকে তামাকের বিশ্রী গন্ধ বেরিয়ে এলো! চাঁদ এবং রুহি তৎক্ষনাৎ নাক-মুখ চেপে ধরল। কম্পিত দৃষ্টিতে চাঁদ ছেলেটির দিকে তাকালো। রুহি শুকনো কেশে চাঁদের ঠিক পেছনের দিকটায় লুকালো। রুহির হাত ধরে চাঁদ রুহিকে অভয় দিলো। কাঠ কাঠ গলায় জবাবে ছেলেটিকে বলল,,

“আআআন্টি কোথায়?”

“আন্টি নেই। যা বলার আমাকে বলুন।”

কাঁপা কাঁপা হাতে চাঁদ পুচিকে ছেলেটির দিকে ধরল। ভয়ার্ত গলায় বলল,

“পুচিকে দিতে এসেছি।”

পুচিও কেমন যেনো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকালো! মাথাটা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে পুচি চাঁদের দিকে মায়াময়ী দৃষ্টিতে তাকালো। ছেলেটির কাছে যেতে সে আপত্তি প্রকাশ করল! চাঁদ সচকিত দৃষ্টিতে পুচির দিকে তাকালো। অমনি ছেলেটি চাঁদের হাত থেকে পুচিকে কেড়ে নিলো! সঙ্গে সঙ্গেই পুচি আর্ত গলায় ম্যাও বলে ডেকে উঠল! চাঁদ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। উদগ্রীব গলায় হা করে কিছু বলার পূর্বেই ছেলেটি মুখের উপর দরজাটি বন্ধ করে দিলো! চাঁদ এবার উত্তেজিত হয়ে উঠল। অধৈর্য্য হয়ে দরজায় টোকা মারতে লাগল। উদ্বেগি গলায় বলল,,

“প্লিজ দরজাটা খুলুন। পুচি হয়তো আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে!”

অমনি রুহি চাঁদকে টানতে টানতে নিচ তলায় নেমে এলো। অস্থিরমনা চাঁদের দিকে তাকালো। শঙ্কিত গলায় বলল,,

“আপু প্লিজ চলো এখান থেকে। ছেলেটা খুবই ডেঞ্জারাস। কেমন যেনো গাঁজাখোর টাইপস। ভয়ে আমার শরীরটা কেমন যেনো কাঁপছে আপু!”

“কিন্তু আমার তো পুচিকে নিয়ে অনেক ভয় হচ্ছে রুহি! ছেলেটা পুচির কোনো ক্ষতি করবে না তো? তাছাড়া আন্টি কোথায়? আন্টিকে তো কোথাও দেখলাম না। আচ্ছা? আন্টি ঠিক আছে তো?”

“আপু প্লিজ থামো। চুপচাপ এখান থেকে চলো। আর কখনো তুমি পুচিকে নিতে এই বাড়িতে আসবে না। ছেলেটা কিন্তু ভালো নয় আপু।”

চাঁদকে আর কথা বাড়াতে দিলো না রুহি। প্রতিবার চাঁদের কথায় বেগড়া দিলো। চাঁদকে নিয়ে দ্রুত পা ফেলে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। ড্রয়িংরুম এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা। আড্ডার আসর ভেঙে যে যার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে৷ একটু পর টেবিলে রাতের খাবার সাজানো হবে। আর সেই কারণেই সোহানী, জায়মা এবং সাবরিনা আবরার ব্যস্ত রান্নাঘরের কাজে। খাবারের রকমারী আইটেম আজ রান্না করেছেন সাবরিনা আবরার। সেই তালিকায় যুক্ত আছে মাহিনের সমস্ত প্রিয় খাবার। রান্নাঘর থেকে সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে ড্রয়িংরুমের প্রতিটি আনাচে-কানাচে। খুশি যেনো ধরছে না উনার। ছেলেকে কীভাবে খাইয়ে-দাইয়ে সন্তুষ্ট করবেন সেই চিন্তায় উনি বেখবর!

চাঁদ এবং রুহি ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করেই প্রথমে গড়গড় করে দু’গ্লাস পানি খেলো। মাথায় হাত দিয়ে দুজনই সোফায় বসে পড়ল! বলা নেই কোয়া নেই এরমধ্যেই নূর হঠাৎ পেছন থেকে এসে চাঁদের মাথায় সজোরে গাড্ডা মারল! ব্যথায় চাঁদ কুঁকড়ে উঠল। ব্যথাযুক্ত জায়গায় হাত রেখে কৌতূহলী দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকালো। নূর রক্তিম চোখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে! বুকে দু’হাত বেঁধে। চাঁদ অবাক হলো। পিটপিটে দৃষ্টিতে নূরের তাকালো। নির্বোধ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী হলো ব্যাপারটা? আপনি হঠাৎ আমার মাথায় গাড্ডা মারলেন কেন?”

তেজের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিলো নূর! বুক থেকে হাত দু’খানা সরিয়ে নিলো। খড়খড়ে গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“আমার বেডে বিড়ালের পশম এলো কোত্থেকে শুনি? আমি যাওয়ার পর বেডটা ক্লিন করো নি তুমি? কাম অন স্পিক আপ।”

চাঁদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“ক্যান ভাই? আমারে কি বাসার কাজের বুয়া পাইছেন? আপনার বেড ক্লিন করব আমি? খেয়ে-দেয়ে আর কোনো কাজ নাই আমার? আপনার বাসায় আমি কাজ করতে আইছি?”

“হ্যাঁ তুমিই করবে। কারণ তোমার কারণেই বিড়ালের পশম আজ আমার বেড অবধি পৌঁছাতে পেরেছে। ইট’স অল অফ ইউর ফল্ট ওকে?”

“পারব না আমি! পা র ব না! শুনতে পেরেছেন আপনি? যান এবার বিদায় হন!

“তুমি পারবে না তোমার ঘাড় পারবে!”

চাঁদের ডান হাত ধরে টান দিলো নূর! সুঠাম হাতে টানতে টানতে চাঁদকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুলটা বাঁকাতে হয় বুঝছ? আর তুমি সোজা কথার মানুষ না। সবসময়ের ঘাড়ত্যাড়া!”

চাঁদ গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠল! আর্ত গলায় বলল,,

“খালামনি দেখে যাওওও। তোমার ছেলে আমার সাথে কী করছে।”

সাবরিনা আবরার দ্রুত পায়ে হেঁটে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলেন। কাপড়ের আঁচলে হাত মুছে উদ্বেগী দৃষ্টিতে সিঁড়ির দিকে তাকালেন। রুহি হাসতে হাসতে প্রায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে! নূর এক প্রকার টেনে হেছড়ে চাঁদকে তার রুমের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চাঁদ শত চেষ্টা করেও নূরের হাতটা ছাড়াতে পারছে না! সাবরিনা আবরারও এবার ফিক করে হেসে দিলেন! চাঁদ কান্নাজড়িত দৃষ্টিতে পিছু ফিরে সাবরিনা আবরারের দিকে তাকালো। ঠোঁট উল্টে বলল,,

“খালামনি তুমিও হাসছ? তোমার ছেলেকে কিছু বলবে না?”

চাঁদের কথায় ফোড়ন কাটল নূর। চোয়াল শক্ত করে বলল,,

“কী বলবে হ্যাঁ? মা কী বলবে আমায়? দোষ তো তোমারই ছিল। তুমি কেন আমার বেডটা ক্লিন করে রাখলে না? এই? কেউ তোমাকে বলছিল বিড়াল নিয়ে আমার রুমে যেতে? এবার ভুগো। যেমন কর্ম তেমন ফল ওকে? তোমার কাজ এবার তুমিই করো।”

চাঁদ নাক টেনে কেঁদে উঠল! অসহায় দৃষ্টিতে পিছু ফিরে সাবরিনা আবরারের দিকে তাকালো! সাবরিনা আবরার এবার হাসি থামালেন। শান্ত গলায় চাঁদকে লক্ষ্য করে বললেন,,

“যা মা বিছানাটা পরিষ্কার করে আয়! অল্প একটুই তো কাজ। তাছাড়া নূর তো তোর খালাতো ভাই-ই হয় তাই না? বিছানাটা একটু পরিষ্কার করে দিলে কিচ্চু হবে না।”

হাসি চেপে সাবরিনা আবরার জায়গা থেকে প্রস্থান নিলেন। চাঁদ এবার নিরুপায় দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। নূর বাঁকা দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। ঠোঁটে কোণে লেগে আছে তার রাজ্য জয়ের হাসি! চাঁদকে অপদস্ত করতে পেরে সে মহা খুশি। শার্টের কলারটা পেছনের দিকে হেলিয়ে নূর বেশ ভাব নিলো। এক চোখ টিপে চাঁদের কানে গুঞ্জন তুলে বলল,,

“কী করবে এবার মিস ঝগড়ুটে চাঁদ? আমার কাজ তো এবার তোমাকে করতেই হবে। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ বাক্য আছে না? টিথ ফর টেথ? এই মুহূর্তে প্রবাদ বাক্যটা তোমার সাথে একদম পার্ফেক্টলি ম্যাচ হয়ে যাচ্ছে।”

নূর অট্ট হাসল। পরিস্থিতির চাপে পড়ে চাঁদ বিড়াল হয়ে গেল! নূরের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। আক্রোশিত গলায় মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,

“সুযোগ বুঝে মাতালটা আমার থেকে রিভেঞ্জ নিচ্ছে। ইচ্ছে করে আমাকে হেনস্তা করছে। এবার কী হবে আমার? এই ছেলের বেড ক্লিন করতে হবে আমার? আমি তো নিজের বেডটাই কখনো গুছাই নি। সবসময় কাজ থেকে গাঁ বাঁচিয়ে চলেছি! এখন সেই মহা ঝামেলার কাজ-ই আমাকে করতে হবে?”

,
,

মাহিনের রুমে আয়মন এবং সাদমানের আড্ডার আসর জমেছে। তারা তিনজনই একসাথে বসে নানারকম আলাপচারিতায় মগ্ন৷ মাহিন তার বাইরের দেশে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত দুই ফ্রেন্ডের সাথে শেয়ার করছে। আয়মন এবং সাদমান খুব মনযোগ দিয়ে তার সব কথাগুলো শুনছে। মাঝে মাঝে মেয়েলী বিষয় নিয়ে মাহিনকে ক্ষেপিয়েও দিচ্ছে। বিপরীতে মাহিনও ঠাস ঠাস করে দুজনের গাঁয়ে কিল ঘুঁষি মারছে। তাদের আড্ডাকে আরও প্রাণবন্ত করার জন্য সোহানী হাতে করে তিন মগ কফি নিয়ে এলো! কফি পেয়ে তারা তিনজনই ব্যাপক খুশি হয়ে গেল। হাসিমুখে সোহানীকে তারা ধন্যবাদ জানালো। বিপরীতে সোহানীও মুচকি হেসে মাহিনকে লক্ষ্য করে বলল,,

“আরও কিছু লাগলে আমাকে বলবে কেমন? আমি এসে দিয়ে যাব।”

মাহিন মৃদু হেসে সোহানীর দিকে তাকালো। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। সোহানী হঠাৎ মাথা চুলকে মাহিনকে বলল,,

“আমি না প্রথমে কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম তুমি মাহিন না-কি নূর৷ পরে তোমার আচরণ দেখে কনফার্ম হলাম তুমি মাহিন!”

মাহিন খিলখিলিয়ে হেসে বলল,,

“এই তো ব্যাস শুরু আপু। আরও কত কনফিউশনের বাকি আছে! মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানেন? আমাদের দুই ভাইয়ের কপালে বউ জুটবে না! এত কনফিউশন নিয়ে কে আমাদের সাথে থাকতে চাইবে?”

সোহানী ফিক করে হেসে দিলো! সাথে আয়মন এবং সাদমানও। জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো সোহানী। যেতে যেতে পিছু ফিরে বলল,,

“কথাটা কিন্তু মন্দ বলো নি তুমি!”

এরমধ্যেই হঠাৎ সোহানী কারো সাথে ধাক্কা খেলো! হঠকারি দৃষ্টিতে অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অমনি দৃষ্টির সীমানায় নীড়কে দেখতে পেল সোহানী। নীড় এক ভ্রু উঁচু করে সোহানীর দিকে তাকালো। তৎক্ষনাৎ সোহানী জিভ কেটে গলা খাদে এনে বলল,,

“সরি ভাইয়া। আপনাকে খেয়াল করি নি আমি।”

নীড় ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে দাঁড়ালো৷ সোহানীর দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,,

“তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।”

সোহানী অবাক হলো। নীড়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী কথা ভাইয়া?”

“তুমি ঐ সময় যেনো অনুকে নিয়ে কী বলছিলে? অনু এই বিয়েতে রাজি না তাই তো?”

“আমি কিন্তু স্পেসেফিকলি কিছু বলি নি ভাইয়া। জাস্ট ধারণা থেকে সন্দেহ করছিলাম। আর সেই সন্দেহটাই আমি আপনার কাছে ক্লিয়ার করেছিলাম। বাকিটা তো আপনি আর ভাবি জানেন তাই না?”

“এই বিষয়ে আমার কথা হয়েছিল অনুর সাথে। অনু নিজের মুখেই স্বীকার করেছে সে এই বিয়েতে রাজি। সো এখানে তো আমি সন্দেহ করার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না!”

“সবসময়ই যে কানে শোনা কথা বা নিজ চোখে দেখা কোনো ঘটনা সঠিক হতে পারে তা কিন্তু নয়! হতে পারে আমার দেখার ভুল ছিল কিংবা আপনার শোনার ভুল ছিল! তাই আগে থেকেই হলফ করে কিছু বলা ঠিক না।

#চলবে…?