প্রেমময়ী তুমি পর্ব-৪৬+৪৭

0
491

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৪৬
#নিশাত_জাহান_নিশি

“পুচিকে খুঁজতে এসেছিলাম। দিন দিন ফা’জিল হয়ে যাচ্ছে পুচিটা৷ বারবার পড়ার মাঝখানে এসে আমাকে ডিস্টার্ব করছিল। তাই রাগের চোটে দু’ঘা দিয়েছিলাম! এরপর থেকে আর খুঁজে পাচ্ছিনা। আপনি দেখেছেন পুচিকে কোথাও?”

নূর বিচলিত হয়ে উঠল। এই পর্যায়ে এসে ঠিক বুঝতে পারল পুচি হঠাৎ কেন তার সাথে এতো ভাব জমালো! কেন অবলা প্রাণীর ন্যায় নিজেকে আড়াল করার জন্য নূরের পেছনে এসে এভাবে আশ্রয় নিলো। অভিমান জমেছে পুচির চাঁদের উপর! বোবা প্রাণী বিধায় ভাষায় প্রকাশ করে বুঝাতে পারছেনা। ভাবভঙ্গিতে ঠিক বুঝিয়ে দিচ্ছে। কী অদ্ভুত লীলা জগতের! সৃষ্টির প্রতিটি প্রাণীর-ই রাগ, অভিমান, হিংস্রতা, দয়া-মায়া, ভালোবাসা সব কাজ করে। হয়তো কেউ বলে বুঝাতে পারে, আর কেউ বা পারেনা। পুচির ভঙ্গিমা দেখে আনমনেই নূর কিঞ্চিৎ হাসল! মাথাটা ঈষৎ ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,,

“মালকিনের মতোই হয়েছে আগা গোড়া ঢঙি! কেউ কোনো অংশেই কম নয়! পুচিকে এখন কীভাবে সেইফ করব আমি? চাঁদকে বলব পুঁচি এখানে আসেনি? মিথ্যে বলব চাঁদকে? আবারও তার কাছে নিজেকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করব?”

নূরের মৌনতা দেখে চাঁদ বিরক্তবোধ করল। এদিক-ওদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে পুচিকে খুঁজতে লাগল। তবে বরাবরই সে ব্যর্থ হলো। কোথাও খুঁজে পেলনা পুচিকে। অতঃপর চাঁদ নাক সিটকালো। কোমরে দু’হাত গুজে বলল,,

“কী হলো বলুন? পুচিকে কোথাও দেখেছেন?”

দোটানায় জর্জরিত নূর। কী বলবে না বলবে ভেবে হয়রান হয়ে উঠছিল। জ্বরের তাড়নায় তার শরীরটাও ক্রমাগত বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ হয়ে উঠছিল। সমস্ত শরীর জ্বালা-পোড়া করে উঠল। মাথাটাও কেমন ঝিম ধরে এলো। আশেপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। নাকের গড়িয়ে পড়া সর্দি মুছে নূর অস্ফুটে গলায় বলল,,

“না দেখিনি কোথাও! তুমি এখন যেতে পারো। রুমে যাব আমি।”

চাঁদ পুনরায় চিন্তিত হয়ে উঠল। পুচি কোথায় গেল বা কোথায় যেতে পারে তা ভাবতে ভাবতে সে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। চোখে-মুখে দুঃশ্চিতার ছাপ ফুটিয়ে উল্টোদিকে ঘুরল চাঁদ। দ্রুত পা ফেলে দু’তলার সিঁড়িতে পা বাড়ালো। এতো রাতে পুচি বাড়ির বাইরে কোথাও যাবেনা এই বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত সে। হয়তো প্রচুর রাগ করে বাড়ির চিপায়-চাপায় কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে। লণ্ডভণ্ড শরীর নিয়ে নূর বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। মিনমিনে গলায় পুচিকে বলল,,

“চলে গেছে ভূমিকম্পটা। তুই কি আজ রাতটা আমার সাথেই থাকবি?”

অমনি পুচি নূরের পায়ের ফাঁক দিয়ে পেছন থেকে তার সামনে চলে এলো। আহ্লাদি হয়ে নূরের পা দুটো আঁকড়ে ধরে পুনরায় ম্যাও বলে ডেকে উঠল। ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো আজ রাতটা সে নূরের সাথেই থাকতে চায়! পুচির প্রতি আলাদা এক মায়াবোধ জন্ম নিলো নূরের! অকেজো শরীরেই সে উবুড় হয়ে পুচিকে তার কোলে তুলে নিলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পুচিকে তার উষ্ণ বুকের মাঝে একাত্নভাবে মিশিয়ে নিলো। আক্ষেপভরা গলায় বলল,,

“চাঁদকে দেখলে তার প্রতি যে মায়াবোধের জন্ম নেয় না? আজ কেন জানিনা তোকে দেখেও আমার সেই মায়াবোধের জন্ম নিচ্ছে! তোরা দুজনই কি একই সত্ত্বা? কী জাদু আছে তোদের মাঝে বল তো?”

অমনি নূরের হাচ্চি-কাশির মাত্রা আরও বেড়ে গেল! এক সেকেন্ড অন্তর অন্তর সে হাচ্চি দিতে লাগল। তার শরীর আরও অতিরিক্ত খারাপ হয়ে উঠল। উপরের তলা থেকে চাঁদ হঠাৎ নূরের হাচ্চি-কাশির আওয়াজ শুনতে পেল। সন্দিহান হয়ে সে বিড়বিড় গলায় বলল,,

“এই লোকটা হঠাৎ এতো হাচ্চি দিচ্ছে কেন হ্যাঁ? পুচি কি তাহলে এই লোকটার কাছেই আছে? একবার গিয়ে দেখে আসব?”

যেই ভাবা সেই কাজ। এক দৌঁড়ে চাঁদ দু’তলার সিঁড়ি টপকে একতলায় নেমে এলো। নূরও এই সময় ফ্ল্যাটের দরজাটা লাগাতে যাচ্ছিল। অমনি চাঁদ প্রাণপণে দৌঁড়ে এসে নূরকে বাঁধা দিলো! স্ব-চক্ষে নূরের কোলে পুচিকে দেখতে পেল। তৎক্ষণাৎ তার মাথায় রক্ত চেপে বসল। চোয়াল শক্ত করে সে চুপসে থাকা নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“এই? এতো মিথ্যেবাদী কেন আপনি হুম? একটু আগে না বলছিলেন পুচিকে আপনি দেখেন নি?”

নূর কম্পিত দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। কিছুতেই সে কোথাও তার দৃষ্টি স্থির করতে পারছেনা। শরীরের অবস্থা বেহাল তার। ক্রমাগত নেতিয়ে উঠছে। তাই সে অস্পষ্ট সুরেই জবাবে বলল,,

“আমি কী করব? পুচিই তো তোমার সাথে যেতে চাইছিলনা। আবদার করে বলল আজ আমার কাছেই থাকবে।”

চাঁদ রাগান্বিত ভাব নিলো। নূরের সাথে কোনো কথা না বাড়িয়ে সে পুচিকে নূরের কোল থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। দাঁতে দাঁত চেপে অভিমান পুষে রাখা পুচিকে বলল,,

“তুই আমার সাথে যাবিনা তাই না? আমাকে ছেড়ে অন্য একটা ছেলের সাথে থাকবি? অন্যায় করলে মারধরও করা যাবেনা না এখন? মুখটা ফুলিয়ে রাখতে হবে? আদরে আদরে বাঁদর তৈরি করছি।”

পুচি মন্থর গতিতে ম্যাও ম্যাও বলে ডাকতে লাগল। নূরকে ছেড়ে সে চাঁদের কাছে যেতে নারাজ বুঝাল। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে এসে চাঁদের হঠাৎ অনুভব হলো নূরের শরীরটা সাংঘাতিক গরম হয়ে আছে। একটু স্পর্শ লাগাতেই মনে হলো হাতটা যেনো তার পুড়ে গেল! উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল চাঁদ। নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নূরের দিকে তাকালো। শুকনো গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“জ্বর আপনার?”

নূর ডানে-বায়ে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। চাঁদ একরত্তিও বিশ্বাস করলনা নূরের কথায়। উতলা হয়ে সে বিনা সংকোচে নূরের কপালে হাত রাখল! আগুনে হাত রাখা আর নূরের মাথায় হাত রাখা তার কাছে একই মনে হলো! অমনি চাঁদ হাতটা সরিয়ে নিলো। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। উত্তেজিত গলায় শুধালো,,

“মিথ্যে বলছিলেন কেন হ্যাঁ? সত্যিই তো আপনার সাংঘাতিক জ্বর।”

নূর হেয় হাসল। অর্ধখোলা দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। শ্লেষাত্মক গলায় বলল,,

“আমার সব কথাই তো তোমার মিথ্যে মনে হয় তাই না? তাই আপাতত সত্যি বলাটাকে বাঞ্চনীয় মনে করছিনা! তুমি এখন যেতে পারো চাঁদ। আমি এখন ঘুমুবো!”

“এতো জ্বর নিয়ে কীভাবে ঘুমাবেন হ্যাঁ? ঘুম আসবে?”

“আমাকে নিয়ে তোমার এতো ভাবতে হবেনা চাঁদ। অসুখ তুমি দিয়েছ। সারানোর মালিক আমি। যেভাবেই হোক আমি নিজেকে সারিয়ে তুলব। যদি উপর ওয়ালা সহায় হোন তো! এবার তুমি যেতে পারো।”

“খালামনিকে ডেকে দিই একবার?”

“না। মা ঘুমুচ্ছে। অযথা বিরক্ত করতে হবেনা। ঘুম ভালোভাবে না ফুরালে মায়ের শরীর খারাপ হয়ে যায়। চাইছিনা মা অসুস্থ হয়ে পড়ুক।”

রাগে বুদ হয়ে থাকা পুচিকে নিয়ে চাঁদ জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! মনটা তার হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে উঠল। বুঝতে পারছিলনা নূরকে এভাবে ফেলে যাওয়াটা তার উচিৎ হবে কিনা। বিমূর্ষ হৃদয় নিয়ে নূর দরজা আটকানোর পূর্বেই চাঁদ হঠাৎ আবার দৌঁড়ে এলো নূরের কাছে! দরজা আটকানোতে বেগড়া দিলো সে। পুচিকে কোল থেকে নামিয়ে বিক্ষুব্ধ নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। ছটফটে গলায় বলল,,

“একজন মানুষকে এভাবে অসুস্থ অবস্থায় রেখে আমি চলে যেতে পারিনা নূর ভাইয়া। তার সেবা করাটাকেই এখন পরম দায়িত্ব বলে মনে করছি।”

জবাবে নূরকে কিছু বলার সময় দিলোনা চাঁদ! নূরের ডান হাতটা আঁকড়ে ধরে সে নূরকে টেনে হেছড়ে জোর করে সোফায় শুইয়ে দিলো। নূর নির্বোধ দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। কী থেকে না হচ্ছে কিছুই তার মাথায় ঢুকলনা। তার শরীর এখন এতোটাই খারাপ হয়ে গেল যে কোনোরকম রিয়েক্টও করতে পারলনা সে। কেবল অসহায়ত্বে ভরা চোখ দিয়ে সব দেখছে। বাকশক্তি বিলুপ্ত হয়ে গেছে তার। ভেতরে ভেতরে পুরোটা শরীর কবেল চিবিয়ে উঠছে। সারা শরীর ব্যথা করছে। শরীরের অসহ্য যন্ত্রণায় চোখ থেকে তার টলটলিয়ে পানি ঝড়ছে! অবিলম্বেই চোখজোড়া বুজে এলো তার। নূরের এই মুমূর্ষু অবস্থা দেখে চাঁদ আরও ঘাবড়ে উঠল। উদগ্রীব হয়ে সে নূরের সামনে থেকে ওঠে আয়মনের রুমের দিকে হাঁটা ধরল। আয়মনের রুমে উঁকি মারতেই দেখল আয়মনও যেনো কারো মাথায় পানি ঢালছে! আরেকটু ভেতরে যেতেই দেখতে পেল আয়মন মাহিনের মাথায় পানি ঢালছে। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা মাহিনেরও জ্বর হয়েছে। আয়মনের ঠিক পেছনের দিকটায় দাঁড়ালো চাঁদ। উদ্বেগি গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“ইশশশ দু-ভাইয়েরই একসাথে জ্বর হয়েছে?”

পিছু ফিরে তাকালো আয়মন। চাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এতো রাতে তুই এখানে কী করছিস?”

“সে কথা না হয় পরে হবে ভাইয়া। আগে রোগীকে সুস্থ করতে হবে।”

একমুহূর্তও দাঁড়ালোনা চাঁদ। আয়মনের ওয়াশরুমে প্রবেশ করে ছোটো একটি বালতিতে পানি ভরে একটি মগ এবং একটি তোয়ালে নিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে রওনা হলো। সোফায় নূরের পাশে সে হাঁটু গুজে বসল। নূরের মাথাটা খানিক ডানপাশে হেলিয়ে দিলো। তারপর মগ কেটে নূরের মাথায় পানি ঢালতে লাগল। হঠাৎ ঠাণ্ডার অনুভূতি পেয়ে সে নড়েচড়ে উঠল। দাঁতে দাঁত সংঘর্ষ হতে লাগল। শরীরের প্রতিটা লোমকূপ দাঁড়িয়ে উঠল। হাত দ্বারা শরীরটা ঢেকে নেওয়ার চেষ্টা করল। চোখ বুজে রেখেই মিনমিনে গলায় বলল,,

“শীশীশীত।”

উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে চাঁদ তার গাঁয়ের ভারী সুতির ওড়নাটা নূরের গাঁয়ে মেলে দিলো! ব্যস্ত গলায় বলল,,

“নিন। এবার আর শীত করবেনা।”

ওড়নাটা ভালোভাবে গাঁয়ে পেচিয়ে নিলো নূর। তবুও সে শীতে কাঁপতে লাগল। মিনমিনে গলায় প্রলাপ বকতে লাগল। চাঁদ খুব যত্নের সহিত নূরের মাথায় পানি ঢালতে লাগল। নূরের প্রতি জমে থাকা রাগ-অভিমান কিছু মুহূর্তের জন্য সে মাটিচাপা দিলো। জ্বরের ঘোরে নূর হঠাৎ করেই চাঁদের বাঁ হাতটা টেনে নিয়ে গেল! পরম ভালোবাসায় হাতটা তার বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরল। অধীর গলায় বলল,,

“প্লিজ চাঁদপাখি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না! তুমি ছেড়ে গেলে আমার এই হার্টটা বিট করা বন্ধ করে দিবে চাঁদ৷ ম’রে যাব আমি! বিশ্বাস করো ম’রে যাব আমি! তোমার বিরহে আমি ম’রতে বাধ্য হবো।”

নূরের প্রলাপকে আমলে নিলো না চাঁদ! বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নিলো। তৎক্ষণাৎ নূরের বুকে পাজর থেকে এক ঝটকায় সে হাতটা সরিয়ে নিলো! গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে আবারও নূরের মাথায় পানি ঢালতে লাগল। প্রায় আধঘণ্টা যাবত মাথায় ঢালার পর নূরের হঠাৎ চোখ লেগে এলো। জ্বরের প্রকোপ নামতেই সে শান্তির ঘুম দিলো। যাওয়ার সময় চাঁদ নূরের কপালে ভালো করে জলপট্টি দিয়ে গেল। তার গাঁয়ের ওড়নাটাও নূরের গাঁয়েই রয়ে গেল। শেষবারের মতো নূরের দিকে তাকিয়ে সে বিদ্রুপাত্নক হেসে বলল,,

“রোজ আপুর সাথে ব্রেকাপের সময়ও আপনি এই কথাটাই বলেছিলেন নূর ভাইয়া। রোজ আপুকে ছাড়া আপনি বাঁ’চবেন না! কিন্তু বেঁচে তো আছেন? এসব শুধু কথার কথা নূর ভাইয়া। আদোতে কেউ কারো জন্য ম’রেনা! সবাই বাঁচে। হয়তো সীমিত সময়ের জন্য কষ্ট পায়। তবে একটুখানি সুখের ছোঁয়া পেলেই আবার সেই পুরোনো ক্ষত ভুলে যায়।”

,
,

পরের দিন সকাল ঠিক এগারোটায় ঘুম ভাঙল চাঁদের! সারারাত পড়াশোনা করে সে প্রায় ভোরের দিকে ঘুমিয়েছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই ঘুম থেকে উঠতে অনেকটাই বেলা হয়ে গেল তার। অর্ধখোলা চোখে সে ঘুম থেকে ওঠেই পুরো বাড়িটা ফাঁকা দেখতে পেল! বাড়িভর্তি মেহমান কাউকেই দেখতে পেলনা কোথাও। পুরো বিষয়টাতে চাঁদ বেশ অবাক হলো। কৌতূহল দূর করতে সে চোখ কচলাতে কচলাতে সোহানীর রুমে প্রবেশ করল। ঘটে গেল আরেক বিপত্তি! বিছানার উপর হাঁটু ভাজ করে সোহানী ন্যাকা কান্না করছে! কিছুক্ষণ পর পর শাড়ি দিয়ে চোখের জল মুছছে তো কিছুক্ষণ নাকের জল মুছছে। তৎক্ষণাৎ চোখ থেকে হুড়মুড়িয়ে ঘুমেরা বিদায় নিলো চাঁদের। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সে সোহানীর দিকে তাকালো। দরজার ওপার থেকেই প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী হয়েছে আপু? তুমি কাঁদছ কেন?”

জলে ভেজা চোখ দুটো উঠিয়ে সোহানী দরজার ঐ প্রান্তে থাকা চাঁদের দিকে সরল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। হেচকি তুলে বলল,,

“ওরা সবাই ঢাকা ফিরে গেছে চাঁদ।”

চাঁদ অবাক হলো। নাক-মুখ কুচকে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত গলায় বিড়বিড় করে বলল,,

“এ্যাঁ! এই জ্বর নিয়ে নূর ভাইয়া ঢাকা ফিরে গেছে? জ্বরটা ভালো হলে আর একদিন পরে গেলে কী হতো?”

মনে মনে দুঃশ্চিন্তা করলেও চাঁদ সোহানীর সামনে স্বাভাবিক থাকার ভাব নিলো। ভাবলেশহীন গলায় বলল,,

“হ্যাঁ তো? কী হয়েছে? এর জন্য কাঁদতে হবে?”

“তুই কী বুঝবি হ্যাঁ? তুই কী বুঝবি? তোর কি জামাই আছে যে বুঝবি? কত ভালো লাগত যখন নীড়টা আমার আশেপাশে থাকত। এখন তো টানা পনেরোদিন দেখা হবেনা আমাদের! কীভাবে থাকব আমি হ্যাঁ?”

চাঁদ হেঁতো হাসল! ব্যগ্র গলায় বলল,,

“ছিঃ আপু ছিঃ! তুমি এতো জামাই পাগলি? বাপের বাড়িতে থেকেও কেমন জামাই জামাই করছ?”

সোহানী বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল। রাগ দেখিয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চাঁদের দিকে রুখে এসে বলল,,

“দাঁড়া আজ আমি তোরে খা’ইছি। আমার ইমোশন নিয়া ফাই’জ’লামি করিস না?”

চাঁদ আর একমুহূর্তও এখানে দাঁড়ালোনা। দৌঁড়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে নিচতলায় নেমে গেল। উচ্চ আওয়াজে চিৎকার করে বলল,,

“তোমার মতো এতো জামাই পাগলি মেয়ে আমি কোথাও দেখিনি আপু! তুমিই আছো এক পিছ! বাপের বাড়িতে সুখে থেকেও কেবল জামাই জামাই করো।”

ফ্ল্যাটের সদর দরজা চাঁদ বাইরে থেকে আটকে দিয়েছিল বিধায় সোহানী হাজার চেষ্টা করেও ফ্ল্যাট থেকে বের হতে পারেনি। চাঁদকে আর ধাওয়াও করতে পারেনি। শরীরের সব রাগ তার শরীরেই মজলো। ভাগে না পেয়ে চাঁদকে আচ্ছেমতো বকতে লাগল সে। দু’বোনের কাণ্ড দেখে সামিয়া আহমেদ রান্নাঘর থেকে খিলখিল করে হেসে উঠলেন। কোথাও না কোথাও কষ্টের ছাপও বয়ে বেড়ালেন! আর মাত্র পনেরো দিন! পনেরো দিন পরই এই বাড়িটা পুরো ফাঁকা হয়ে যাবে। দুবোনের খুনশুটি আর দেখা হবেনা তাদের! কথায় কথায় ঝগড়া, মারামারি সব বন্ধ হয়ে যাবে! পুরো বাড়িটা নীরবতায় বিলীন হয়ে যাবে।

গতকাল রাতেই সোহানী এবং নীড়ের বিয়ের ব্যপারে সমস্ত কথাবার্তা ভাঙচূড় করা হয়েছে। আজ বৈশাখ মাসের দশ তারিখ। বৈশাখ মাসের আগামী পঁচিশ তারিখ সোহানী এবং নীড়ের বিয়ের দিন/ তারিখ/ ক্ষণ ঠিক করা হয়েছে। এর ফাঁকে চাঁদ এবং জায়মার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনালও শেষ হয়ে যাবে। এমনকি বিয়ের প্রস্তুতিও সুস্থ মতো নেওয়া যাবে। আর মাত্র দুটো পরীক্ষা বাকি আছে তাদের। আগামী ছয়দিনের মধ্যেই পরীক্ষার অন্তিম ক্ষণ পাড় করবে তারা। সোহানীর বিয়েটাও ফ্রিলি এঞ্জয় করতে পারবে।

এরমধ্যে আরেকটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। সোহানীর বিয়েটা কুমিল্লা থেকে নয় বরং ঢাকা থেকেই হবে! কারণ কুমিল্লা টু ঢাকা জার্ণি করতে করতে দুই পরিবারের সবারই বেশ অসুবিধা হবে। ধকলের উপর ধকল যাবে। তাছাড়া তাদের সমস্ত রিলেটিভসদের বাড়ি ঢাকাতেই। তাই বিয়েতে এটেন্ড করতে কারো তেমন কোনো অসুবিধা হবেনা। সবদিক বিবেচনা করেই অতঃপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে চাঁদ এবং জায়মার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরই তারা সবাই ঢাকায় একটি হলরুম বুক করবে। ঐ হলরুম থেকেই সোহানী এবং নীড়ের বিয়েটা হবে। এখন থেকেই জিনিসপত্র যা আছে যাবতীয় সব গোছগাছ করে রাখতে হবে। পরবর্তীতে যাওয়ার সময় যেনো কোনো ভেজাল না হয় তাই।

চাঁদ হাসতে হাসতে বাড়ির আঙিনায় পা বাড়াতেই হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ল দোলনায় বসে থাকা দুষ্টু পুচির দিকে। পুচি কোনো একটা সাদা রঙের কাগজ নিয়ে বেশ খেলাধূলা করছে। কাগজটাকে সে কিছুক্ষণ কামড়াচ্ছে তো কিছুক্ষণ পা দিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে। তার বেশ কঠিন মনোযোগ এই কাগজটির দিকে। যেকোনো মূল্যেই হোক ভাজ করা কাগজটিকে তার খুলতেই হবে। দেখতে হবে কাগজটিতে কী আছে। কোনো মাছের কাটাকুটা আছে কিনা! আদুরে হয়ে চাঁদ পুচির দিকে এগিয়ে গেল। আহ্লাদি গলায় শুধালো,,

“উলে লেলেলে! আমার পুচিসোনাটা এখানে কী করছে হ্যাঁ? কী নিয়ে খেলছে সে?”

চাঁদের আওয়াজ পেয়ে পুচি চোখ তুলে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে অগ্রে তাকালো। চাঁদকে দেখামাত্রই সে পিছু ফিরে গেল! কাগজটা লুকানোর অন্তঃপ্রাণ চেষ্টা করল। শেষ অবধি কোনো উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে সে কাগজটির উপরই বসে পড়ল! চাঁদের দিকে ক্ষুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আক্রোশিত গলায় ম্যাও বলে ডেকে উঠল৷ চাঁদকে বারণ করল যেনো তার কাছে না আসে। এই সময়ে চাঁদের উপস্থিতি তাকে বড্ড বিরক্ত করছে। পুচির পাকামো দেখে চাঁদ হাসতে হাসতে ফিট হয়ে গেল। বুকে হাত রেখে সে মন্থর পায়ে পুচির দিকে এগিয়ে এলো। অস্পষ্ট গলায় শুধালো,,

“আমার মেয়েটা দেখছি খুব পাকা হয়ে গেছে হ্যাঁ? কী লুকোচ্ছ তুমি মায়ের থেকে? দেখাও মাকে?”

পুচি গর্জে উঠল। কিছুতেই সে চাঁদকে নিজের কাছে ঘেঁষতে দিলোনা। এমন একটা পর্যায়ে এসে সে ফেঁসে গেল যে চাইলেও সে জায়গা থেকে উঠতে পারছেনা। জায়গা থেকে উঠলেই কাগজটা চাঁদ পেয়ে যাবে। ঘটবে তখন আরেক আপত্তি! কাগজটা নিয়ে সে একদণ্ডও খেলতে পারবেনা। পুচির বাঁদরামো টের পেয়ে চাঁদ কৌশলে পুচির দিকে এগিয়ে দিলো। সুযোগ বুঝে খপ করে পুচিকে কোলে তুলে নিলো! টুপ করে চিঠিটা তার হাতে তুলে নিলো। সঙ্গে সঙ্গেই পুচি ক্ষেপে গেল। ভয়ঙ্করভাবে ডেকে ওঠে চাঁদের গাঁয়ে আঁচড় কাটতে লাগল। পুচির এই অদ্ভুত আচরণ দেখে চাঁদ হেসে কুটিকুটি। অশান্ত পুচিকে শান্ত করার জন্য সে মোলায়েম স্বরে বলল,,

“আচ্ছা বুঝেছি তো কাগজটা তোমার লাগবে। আগে মা একটু দেখি নিই কাগজটাতে কী আছে। এরপর না হয় প্রমিস করছি কাগজটা মা তোমাকে দিয়ে দিব।”

কার কথা কে শুনে? পুচি সমানে চাঁদকে আচড় কেটে যাচ্ছে। একদণ্ডের জন্যও শান্ত হচ্ছেনা। চাঁদের উপর প্রখর বিদ্বেষ ফুটিয়ে তুলছে। চাঁদ কিছুক্ষণ পর পর ব্যথায় কুঁচকিয়ে উঠছে। তবুও কাগজটা সে খুলে দেখার অন্তঃপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শেষ অবধি চাঁদ কাগজটা খুলেই ফেলল! অমনি তার চক্ষুজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেল। এটা শুধু একটা সাদা কাগজ নয়। এটা একটা খোলা চিঠিও বটে! গুটি গুটি অক্ষরে অনেকগুলো বাক্য লিখা চিঠিটিতে। সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ কৌতূহলী হয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। হিংস্র পুচির কাছ থেকে সরে এসে অনেকখানি দূরে দাঁড়ালো। অত্যন্ত মনোযোগের সহিত সে সূক্ষ্মদৃষ্টিতে চিঠিটি পড়তে লাগল। চিঠিটিতে সুন্দর, সাবলীল এবং গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,,

“প্রিয় চাঁদপাখি। ওহহো সরি! তোমাকে তো ‘চাঁদপাখি’ বলে সম্বোধন করার অধিকারটুকুও নেই আমার! সেই অধিকারটুকু হয়তো কেবলমাত্র সাদমানের জন্যই বরাদ্দ! জানি কথাটা শুনে খুব অবাক হয়েছ। তবে এটাই সত্যি! আমার ভালোবাসা তোমার চোখে মিথ্যা প্রমাণিত হলেও সাদমানের ভালোবাসা তোমার চোখে মিথ্যে হতে পারেনা। কারণ, একসাথে দুটো মানুষ মিথ্যে হতে পারেনা! আমার ইমোশন তোমার কাছে ফালতু মনে হলেও সাদমানের ইমোশন তোমার কাছে একটু পাগলাটে মনে হবে! কারণ, একসাথে দুজন প্রেমিকের ইমোশন কখনো ফালতু হতে পারেনা। একজনকে ঠিক হতে হবে আর অন্যজন ভুল। সেই ভুলের খাতায় যেহেতু আমার নামটাই তোমার চোখে পড়ল তো ঠিক মানুষটা নিশ্চয়ই সাদমান হবে! এই নিয়ে দু’দুটো বার আমি ভালোবাসা নামক ধোঁয়াশায় হেরে গেলাম। খুব বাজেভাবে হেরে গেলাম। জানিনা কেনো একফোঁটাও আপসোস হচ্ছেনা এতে! তবে নিজের প্রতি খুব ঘৃণা হচ্ছে। আমি এমন একটা নিকৃষ্ট মানুষ যাকে কেউ মন থেকে ভালোবাসতে পারেনা! তার অনুভূতি নিয়ে সবাই কেবল হাসি তামাশাই করতে পারে! তাই এবার আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি চাঁদ! কারো কাছ থেকে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা পাওয়ার আশা আমি ছেড়ে দিব! নিজের ভাঙা মনকে বুঝাব পৃথিবীতে ভালোবাসা বলতে কিছু নেই। যা আছে সব হলো আপেক্ষিক, মিছে মায়া। মায়া জিনিসটা আমি যতোই কাটিয়ে উঠতে পারব ততোই এই নিঃসঙ্গ জীবনে আমি খুশি থাকতে পারব। আজকের পর থেকে আমি তোমাকে আর জ্বালাবনা চাঁদপাখি। এটা আমার বিবেকের কাছে আমার ওয়াদা! আর থ্যাংকস হ্যাঁ? মাঝরাতে দয়া করে এসে একজন মুমূর্ষু ব্যক্তির সেবাযত্ন করার জন্য। সুস্থ হয়ে ওঠে আমার একবারের জন্যও মনে হলোনা তোমার সাথে অন্তত একটিবার দেখা করা উচিৎ! কারণটা খুবই সহজ। যার মনে আমি নেই। তাকে দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে পোষণ করাটাও সেখানে নেহাত বোকামী। কারো ভালোবাসায় পিছলে পড়ে আমি আর বোকা হতে চাইনা! এবার থেকে আমাদের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব থাকবে চাঁদপাখি! তোমাকে ভালোবাসার আগে দূরত্বটা যেমন ছিল ঠিক তেমনই থাকবে! আই হোপ এবার সাদমানকে মন থেকে মেনে নিতে তোমার আর কোনো আপত্তি থাকবেনা! মাঝের রাস্তাটা তো একদম ক্লিয়ার হয়ে গেল! তোমার সাথে সম্পর্কটা আমার মনের জানো? কাগজে কলমে লিখা কোনো দলিল বা শারীরীক সম্পর্কের নয়! তোমার কাছে এসব বাড়াবাড়ি মনে হলেও আমার কাছে এটাই ফিলোসফি! অনেককিছুই লিখার ইচ্ছে ছিল আজ। তবে হাতটা খুব ঘামছে, কাঁপছে, কলমটা বারবার থেমে যাচ্ছে, চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে আসছে, অনুভূতিরা বারবার আত্মাহুতি দিচ্ছে, ভেতরে এক নিগূঢ় জ্বলন হচ্ছে চাঁদপাখি। তুমি কি টের পাও ভেতরের সেই জ্বলন? আমার কোমল হৃদয়টা ভেঙে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাও তুমি? হয়তো পাও না! পাওয়ারও কথা না। হৃদয়হীনারা কখনো অন্যের হৃদয় ভাঙার কষ্ট বুঝতে পারেনা।”

ইতিতে আর কী লিখব বলো? তোমার কাছ থেকে চরম আঘাত পাওয়া একজন ছ্যাঁকাখোর নিঃস্ব প্রেমিক? যার আদোতে কোনো নিজস্বতা নেই? কারো লাইফে যার কোনো তাৎপর্যতা নেই?

ঝট করে চাঁদ চিঠিটা দুহাত দিয়ে দলেমোচড়ে একদম নিংড়ে দিলো! চিঠিটাকে বল আকারে রূপান্তরিত করে সে ছুড়ে মারল বাড়ির এক কোণায়। রাগে ফোঁস ফোঁস করে সে হাত-পা কচলাতে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“হ্যাঁ আমি ঐ সাদমান ভাইয়ার সাথেই প্রেম করব! ঐ সাদমান আপনার চেয়ে ঢেঁড় ভালো! আপনার চোখের সামনে আমি উনাকে বিয়ে করব! দেখব কীভাবে এই যন্ত্রণা সহ্য করেন আপনি। ইডিয়ট, ননসেন্স, ইস্টুপিট কোথাকার! বলা নেই কওয়া নেই হুট করে এতো বড়ো একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে গেছে। পড়তেও তো আমার সময় লেগেছে নাকি? এই কথাগুলো মুখে বলে গেলে কী হতো?”

#চলবে…?

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৪৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

“হ্যাঁ আমি ঐ সাদমান ভাইয়ার সাথেই প্রেম করব! ঐ সাদমান আপনার চেয়ে ঢেঁড় ভালো! আপনার চোখের সামনে আমি উনাকে বিয়ে করব! দেখব কীভাবে এই যন্ত্রণা সহ্য করেন আপনি। ইডিয়ট, ননসেন্স, ইস্টুপিট কোথাকার! বলা নেই কওয়া নেই হুট করে এতো বড়ো একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে গেল? পড়তেও তো আমার সময় লেগেছে নাকি? এই কথাগুলো মুখে বলে গেলে কী হতো?”

রাগে গটগট করে চাঁদ জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। নূরের মুখটাও দেখবেনা বলে শপথ করে নিলো! নূরের প্রতি তার পূর্বের তুলনায় আরও অধিক ক্ষোভ জন্মাতে শুরু করল। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো সেই দুর্নিবার ক্ষোভের কারণটিই চাঁদ চিহ্নিত করতে পারলনা! নূরের প্রতি তার হঠাৎ এতো ক্ষোভ জমে যাওয়ার কারণটা আসলে কী? নূর চলে যাওয়াতে সে কষ্ট পেল নাকি নূর তাকে আর বিরক্ত করবেনা, ভালোবাসি বলে পাগলামি করবেনা, তার পিছু পিছু ঘুরবেনা এই বিষয়টিতে সে আঘাত পেল? ঠিক এই জায়গাটিতেই বড়ো একটি বিস্ময়কর ধাঁধাঁ রয়ে গেল!

পুচি রাগে ফোঁস ফোঁস করে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। একছুটে সে ছুড়ে ফেলা চিঠিটির দিকে এগিয়ে গেল। চিঠিটির মধ্যে সে কী এমন মধু পেল তাই আমার ছোটো মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারলনা! চিঠিটিকে আবারও সে পূর্বের ন্যায় নাড়তে চাড়তে লাগল। গভীর মনোযোগ দিয়ে চিঠিটির সাথে খেলা করতে লাগল!

চাঁদ লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে ওঠে গেল। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই সোহানীর মুখোমুখি হয়ে গেল। কটমট দৃষ্টিতে সোহানী চাঁদের দিকে তাকালো। ঝট করেই সে হাতের পেছনে লুকিয়ে রাখা একমুঠো রঙিন জরি চাঁদের চোখে-মুখে ছিটকে দিলো! হেলেদুলে পৈশাচিক হেসে বলল,,

“আর লাগবি আমার পেছনে হ্যাঁ?”

তাৎক্ষণিক চাঁদ খকখক করে কেশে উঠল। নাকে-মুখে ঢুকে গেল কয়েকগুচ্ছ জরি! অস্বস্তিতে চাঁদ চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলো। তুখাড় জেদ দেখিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“এটা তুমি কী করলা আপু?”

সোহানী খিলখিলিয়ে হাসল। প্রতিশোধপরায়ন হয়ে উগ্র গলায় বলল,,

“টিথ ফর টেথ ওকে?”

চাঁদ চোখ খুলল। পিটপিটে চোখে সোহানীর দিকে তাকালো। আচমকা চোখের জল ছেড়ে দিলো সে! তিক্ত গলায় বলল,,

“সবসময় ফাইজলামি ভাল্লাগেনা আপু। মানুষের মনমর্জি সবসময় একরকম থাকেনা সেটা তোমার বুঝতে হবে।”

সোহানী উদ্ভট দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। উদ্বিগ্নমনা হয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই কী হইছে রে তোর? হঠাৎ কাঁদছিস কেন?”

সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ বাঁ হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা চোখের গড়িয়ে পড়া জলটা মুছে নিলো! ভরাট গলায় জবাবে বলল,,

“কিছু হয়নি। সামনে থেকে সরো।”

হনহনিয়ে চাঁদ জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। টুপ করে আবারও একফোঁটা জল তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল! চোখের জলটা চাঁদ সযত্নে হাতে তুলে নিলো। কিয়ৎক্ষণ সূক্ষ্মদৃষ্টিতে জলটিকে পর্যবেক্ষণ করল। অতঃপর মিনমিনিয়ে জলটার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“কী আশ্চর্য! তোরা এভাবে আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিস কেন? আমি তো কারো জন্য আদোতে কোনো আঘাত পাইনি। তবে কেন তোরা এভাবে ঝরে পড়ছিস? কোন কারণে আমাকে কাঁদাচ্ছিস?”

হেয় হাসল চাঁদ। জলটা জামায় মাখিয়ে নিলো। পুনরায় তার রুমের দিকে পা বাড়ালো। সোহানী হতবিহ্বল দৃষ্টিতে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। চাঁদ সচরাচর এতো সহজে রেগে যাওয়ার মেয়ে নয়। উল্টো সে সোহানীকে সবসময় বিভিন্নভাবে ক্ষেপায়। বিনিময়ে সোহানীর কাছ থেকে মার খায়, বকা খায়, কটু কথাও কম শুনেনা। এতকিছুর পরেও তার চোখে কখনো জল জমেনা। তবে আজ কী এমন হলো তার? কেন সামান্য একটু বিষয়েই তার চোখ থেকে এভাবে জল গড়িয়ে পড়ল? কোন কারণে চাঁদ এতোটা বিমূর্ষ রূপ ধারণ করল? বিষয়টা সেহানীর কাছে ধাঁধাঁ-ই রয়ে গেল!

,
,

বৈশাখ মাসের বাইশ তারিখ আজ। আর দুদিন বাদেই নীড় এবং সোহানীর বিয়ে! দুটো প্রাণের মিলনের শুভক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে পিলপিল পায়ে। বিয়ের আমেজে সাঁই সাঁই করছে দুই পরিবার। সবার মনে বইছে আনন্দ-উল্লাস একঝাঁক খুশির বন্যা।

চাঁদ এবং জায়মার পরীক্ষা গতকাল-ই শেষ হলো। তাই তারা দুজনই এখন বেশ রিলাক্স মোডে আছে। সকাল প্রায় এগারোটা বাজতে চলল অথচ তারা দুজনই এখনো নাক টেনে ঘুমুচ্ছে! দুপুরের মধ্যেই যে তাদের ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে তা তারা প্রায় ভুলে বসেছে। এতোদিনের রাত জাগা সব ধকল তারা আজ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নিচ্ছে। একটু পরেই হয়তো তাশফিয়া এবং তিথী তৈরী হয়ে চলে আসবে চাঁদের পরিবারের সাথে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য! তাশফিয়া এবং তিথীর পরিবার প্রথমে রাজিই হচ্ছিলনা তাদের দুজনকে চাঁদ এবং জায়মার সাথে ঢাকায় সোহানীর বিয়েতে পাঠানোর জন্য। তাদের মানাতে চাঁদ এবং জায়মার প্রায় আদাজল খেয়ে পড়তে হয়েছিল! বিগত চার-পাঁচদিন তাদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে এরপর তাদের দুই পরিবারকে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিল চাঁদ এবং জায়মা। অবশ্য এক্ষেত্রে আয়মন বেশি চাপ দিয়েছিল চাঁদকে! উল্টোদিকে আয়মনকে চাপ দিয়েছিল মাহিন! মাহিন যেমন মনে মনে তিথীকে চায়। তিথীর জন্য পাগল পাগল করে। তেমনি আয়মনও এখন মনে মনে তাশফিয়াকে চায়! হুট করেই ভালো লেগে গেছে তাশফিয়াকে তার! তাছাড়া তাশফিয়ার প্রতি তার আলাদা একটা সফট কর্ণারও কাজ করে। কারণ, তাশফিয়ার বাবা নেই। শুধু একটা মা বলতে মা-ই আছে তার। সেই মা’টাও দুদিন পর পর অসুস্থ হয়ে পড়ে! একাই তাশফিয়াকে সব ঝামেলা সামলাতে হয়। তার মাকে আগলে রাখতে হয়। এসব দিক বিবেচনা করেই তাশফিয়ার প্রতি আয়মনের একটা সফট কর্ণার কাজ করে! যা সে চেয়েও অস্বীকার করতে পারেনা। সারাক্ষণ তাশফিয়ার দুঃশ্চিন্তায় সে বিমূঢ় হয়ে থাকে। তাশফিয়াকে দেখলেই তার মনের ভেতর একধরনের আকুপাকু শুরু হয়।

চাঁদ এবং জায়মা যেহেতু এখন ঘুমুচ্ছে তাই তাদের হয়ে ব্যাগপত্র গোছগাছ করছেন সামিয়া আহমেদ, জায়মার মা এবং আয়মনের মা। চার থেকে পাঁচটা বড়ো বড়ো ব্যাগ ভর্তি হয়ে গেছে তাদের কাপড়চোপড়ে। বাড়ির পুরুষরা ভারী সব জিনিসপত্র এক এক করে গাড়িতে তুলছে। বড়ো একটা মাইক্রো গাড়ি প্রায় রিজার্ভ হয়ে গেছে শুধু ভারী ভারী জিনিসপত্রে। আয়মন কিছুক্ষণ পর পর কেবল বাড়ির মেইন গেইটের দিকে অধীর দৃষ্টি বুলাচ্ছে। কখন তাশফিয়া আসবে সেই চিন্তায় সে ব্যাকুল হয়ে আছে। কাজেও ঠিকঠাকভাবে মন দিতে পারছেনা সে। তাশফিয়ার একটুখানি সান্নিধ্য পেতে বিভোর হয়ে আছে!

টানা পাঁচদিনের জন্য ঢাকায় বিশাল হলরুমটা বুক করেছেন জামান আহমেদ। পাতার মতো টাকা উড়াচ্ছেন উনি। পরিবারের বড়ো মেয়ের বিয়ে বলে কথা। আহামরি তো হবেই! এরমধ্যে কাজের ফাঁকেই হঠাৎ আয়মনের ফোনটা সাইলেন্ট মোডে বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই সে ব্যাগপত্র রেখে গাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। তার জায়গায় সাব্বিরকে বসিয়ে দিয়ে এলো। ব্যাগপত্র ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে গাড়িতে রাখার জন্য। বাড়ির পুরুষদের উপেক্ষা করে আয়মন একটুখানি দূরে সরে এলো। ব্যাকুল হয়ে প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই স্ক্রিণে নূরের নামটি ভেসে উঠল। মৃদু হেসে আয়মন তাড়াহুড়ো করে ফোনটা তুলল। অমনি অপর প্রান্ত থেকে নূর শিথিল গলায় বলল,,

“হ্যালো।”

“হ্যালো হ্যাঁ বল? কেমন আছিস?”

নূর নাক টানল। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা থেকে তার গলায় কফ জমে গেল। তাই সে কেমন যেনো খসখসে গলায় বলল,,

“ভালো আছি। কতদূর তোরা?”

“কই ভালো আছিস? ভয়েস শুনে তো মনে হচ্ছে না।”

“এসব ছাড় তো। আগে বল কতদূর আছিস তোরা?”

“আরে এখনো তো বাড়ি থেকেই বের হলাম না আমরা! বাড়ির মেয়েরা এখনো রেডিই হয়নি। তো কখন বের হবো বল?”

“নীড় ভাইয়া তাড়া দিচ্ছিল। তোরা আসবি বলে সকাল থেকেই হলরুম ওপেন করে রাখা হয়েছে। সেইফটিরও তো একটা ব্যাপার আছে তাইনা? তারপর মালিক হলো একদম খিটখিটে টাইপ।”

“আমাদের আসতে আসতে বিকেল হবে রে। চাঁদ আর জায়মা এখনো ঘুমুচ্ছে। গতকালই তাদের পরীক্ষাটা শেষ হলো মাত্র। বুঝিসই তো এখন তাদের একটু রেস্টের প্রয়োজন। কীভাবে জোর দিই বল?”

চাঁদের নামটা শুনতেই নূরের বুকে যেনো ধারালো তীর গেঁথে যাওয়ার মতো অনুভব হলো! সঙ্গে সঙ্গেই সে ফোনটা কেটে দিলো। কান থেকে ফোনটা সরিয়ে সে শোয়া থেকে ওঠে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল। বুকে হাত রেখে পরপর রুদ্ধশ্বাস ছাড়তে লাগল। মাথা নুইয়ে সামনের পেছনের এলোমেলো চুলগুলো কিছুক্ষণ টানল। চোখজোড়া বুজে সে নিজেকে স্থির করার প্রাণপণ চেষ্টা করল। চাঁদকে মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল। কিন্তু না লাভ কিছু হলোনা এতে। উল্টো ক্রমাগত তার আনচান মন বিগলিত হয়ে উঠল৷ চাঁদের মাঝেই ডুবে যেতে লাগল। অস্থির হয়ে সে কঠোর গলায় বলল,,

“না। এভাবে আর হবেনা। আমাকে আরও কঠিন হতে হবে। চাঁদের নাম শুনেই এভাবে মোলায়েম হয়ে গেলে চলবেনা। এনাফ স্ট্রং হতে হবে। চাঁদকে বুঝিয়ে দিতে হবে তাকে ছাড়া আমি ভালো আছি! যথেষ্ট ভাব নিয়ে চলতে হবে আমার। এটিটিউড দেখাতে হবে। এভোয়েড করতে হবে তাকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট। নূর ঠিক কী জিনিস তাকে হারে হারে বুঝিয়ে দিতে হবে। নূর একবার কঠিন হলে মানে সে কঠিন। কিছুতেই তাকে গলানো সম্ভব নয়।”

নিজেকে যথেষ্ট শক্ত করে নূর শার্ট নেওয়ার জন্য আলমারিটা খুলল। অমনি তার মুখের উপর এসে চাঁদের সেইদিনের সেই সুতির ওড়নাটা উড়ে এসে পড়ল! সঙ্গে সঙ্গেই নূর ওড়নাটা মুখ থেকে সরিয়ে নিলো। আবেগপ্রবণ হয়ে হাতে তুলে নিলো ওড়নাটিকে। কিয়ৎক্ষণ ওড়নাটির দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। অতঃপর অবিশ্বাস্যভাবে ওড়নাটিতে দীর্ঘ এক চু’মু খেলো! ভরাট গলায় বলল,,

“আমি যতোই তোমার থেকে পিছু ছাড়াতে চাই চাঁদ তুমি ততোই আমার সামনে চলে আসো! ভুলতে পারিনা আমি তোমাকে। হাজারবার চেষ্টা করেও ভুলতে পারিনা। কিছু কিছু স্মৃতি এমন হয় যা চাইলেও ভোলা যায়না। তুমিই হলে আমার সেই স্মৃতি চাঁদ যা আমার আত্মার সাথে বন্দি। যাকে ভোলার চেষ্টা করা মানে দেহ থেকে আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করা। নিজেকে বারবার মৃ’ত বলে ঘোষিত করা। এভাবে আমাদের রাস্তা আলাদা হয়ে যাবে আমি ভাবতে পারিনি চাঁদ। সত্যিই ভাবতে পারিনি! আর আমরা যা ভাবতে পারিনা তাই আমাদের সাথে হয়। বার বার হয়, হাজারবার হয়।”

এরমধ্যেই হঠাৎ সাদমানের আবির্ভাব ঘটল নূরের রুমে! চওড়া হাসি হেসে সে নূরের ঠিক পেছনের দিকটায় দাঁড়ালো। উৎফুল্লিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কীরে কী অবস্থা তোর? সর্দি-কাশি ভালো হইছে?”

সঙ্গে সঙ্গেই নূরের পিলা চমকে গেল! এই মুহূর্তে সাদমানের আকস্মিক উপস্থিতি সে মোটেও আশা করেনি। তড়িঘড়ি করে সে চাঁদের ওড়নাটি দিয়েই গড়িয়ে পড়া চোখের জলগুলো মুছে নিলো। সাদমান কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই সে ওড়নাটিকে বিশৃঙ্খলভাবে গুছিয়ে আলমারির তাকে রেখে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে ধাতস্থ করে সে তড়িৎ বেগে পিছু ঘুরে তাকালো। শুকনো হেসে সাদমানকে বলল,,

“বাঃহ। তোকে তো আজ বেশ হাসি-খুশি দেখাচ্ছে। কারণ কী হ্যাঁ?”

সাদমান মাথা চুলকালো। স্মিত হেসে বলল,,

“আরেহ্ আজ চাঁদ আসবেনা? ভুলে গেলি?”

নূর নির্বোধ ভাব নিলো! শুষ্ক হেসে বলল,,

“উফফফস সরি। একদমই ভুলে গেছি!”

“ভুলিস নি। আসলে নাটক করছিলি!”

“মানে?”

সন্দিহান দৃষ্টিতে সাদমান নূরের দিকে তাকালো। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আগে বল তুই কাঁদছিলি কেন?”

নূর ভড়কে উঠল! চক্ষুজোড়া চড়কগাছে পরিণত হলো তার। শুকনো ঢোঁক গিলে সে মন্থর পায়ে হেঁটে সাদমানের দিকে এগিয়ে এলো। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বোকা সুরে বলল,,

“কোথায় আমি কাঁদছিলাম হ্যাঁ? কীসব বলছিস তুই হ্যাঁ?”

“সত্যি করে বল কাঁদিস নি?”

“কই না তো!”

“তাহলে চোখ-মুখ ফোলা ফোলা দেখাচ্ছে কেন?”

নূর অট্ট হাসল! সাদমানের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য সে হেঁতো গলায় বলল,,

“আরেহ্ ওটা তো আমার হাচ্চি-কাশির প্রভাব ছিল। কালরাত থেকে নাক টানছি তো তাই চোখ-মুখ কেমন ফুলে গেছে। আমার নিজেরই এখন অতিষ্ট লাগছে। ভাইয়ের বিয়েও এলো আর আমারও অসুখ বাঁধল।”

“সত্যিই কি চাঁদকে তুই ভুলতে পেরেছিস?”

“না ভোলার মতো এমন কঠিন কী জিনিস?”

“সত্যিই কী এতো সহজ চাঁদকে ভুলে যাওয়া?”

“চেষ্টা করলেই ভোলা যায়!”

“করেছিলি চেষ্টা?”

“হ্যাঁ করেছি, অনেকবার করেছি। চেষ্টা করেছি বলেই তো আজ তাকে ভুলতে পেরেছি। বিশ্বাস হয়না তোর?”

সাদমানের দৃষ্টি এখনো সন্দিহান৷ তবে সে বিষয়টাকে বেশি ঘাটাতে চাইলনা। প্রসঙ্গ পাল্টে রাশভারী গলাঢ বলল,,

“বাইরে চল নীড় ভাইয়া অপেক্ষা করছে।”

“আচ্ছা তুই যা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

সাদমান প্রস্থান নিলো! উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে নূর সাদমানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। কিছুদূর যেতেই সাদমানের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল। প্রবল জেদ দেখিয়ে নূর আলমারির কার্ণিশে সজোরে এক লাথ মারল! ঘাড়ের রগগুলো টান টান করে সে মৃদু চিৎকার করে বলল,,

“কেন আমি আমার নিজের ইমোশনগুলো লুকিয়ে রাখতে পারিনা কেন? কেন সবাই খুব সহজেই আমার অভিনয়গুলো ধরে ফেলে? কেন? এতো ইমোশনালফুল কেন আমি? কেন আমি আজও অভিনয় শিখতে পারলামনা?”

রাগে গটগট করে নূর ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ঝর্ণা ছেড়ে সে সোজা ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল! ভেতর থেকে গোঙাতে গোঙাতে সে লুকিয়ে রাখা কষ্টে বিশৃঙ্খলভাবে হাঁপাতে লাগল।

,
,

রৌদ্রোজ্জল বিকেল। চারটা বেজে প্রায় পয়ত্রিশ মিনিট ঘড়িতে। সূর্যের প্রখর তাপে অতিষ্ট ধরণী। চারিদিকে মানুষের বুকফাঁটা হাহাকার। ঝলসে যাচ্ছে চামড়াশুদ্ধ মানুষ! মুখ থেকে আপনাআপনি জিহ্বা বের হয়ে আসছে। এই সাংঘাতিক রোদের ঝাঁঝ আর মানা যাচ্ছেনা। এই কাঠ ফাঁটা রোদের মধ্যেই নূর এবং মাহিন তাদের বাইকে করে ডেকোরেশন ম্যানেজারের অফিসের দিকে রওনা হয়েছে। দুই বাড়ির প্যান্ডেল এবং বিয়ের গেইট প্রফেশনাল ডেকোরেশন ম্যানেজারদের দিয়ে সাজানো হবে। মাঝরাস্তায় আসতেই অমনি নীড়ের মেসেজ এলো মাহিনের নাম্বারে। ব্যাকসিটে থেকে মাহিন এক নজরে মেসেজটি পড়ে দেখল। মেসেজটিতে লিখা,,

“এই শোন? তোদের দুজনকে একসাথে এক কাজে যেতে হবেনা। তুই মাহিন ম্যানেজারের সাথে কথা বলে আয়। আর নূরকে পাঠিয়ে দে হলরুমে। সোহানীর সাথে কথা বলে ফুলের অর্ডার নিতে হবে। সব রকমের ফুল কিন্তু এখন এভেইলঅ্যাবল নয়। তাই একদিন আগে থেকেই অর্ডার করে রাখতে হবে।”

নূরকে ডেকে মাহিন বিস্তারিত বলল। নূর প্রথমে নাকাচ করলেও পরে চাপে পড়ে তাকে মেনে নিতে হলো। নূরকে মাঝরাস্তায় দাড় করিয়ে মাহিন বাইকে করে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পিছু ফিরে মাহিন চিৎকার করে নূরকে বলল,,

“তিথীকে আমার সালাম দিস নূর! ঐখানের কাজটা সেরেই আমি হলে আসছি। তুই আর সাদমান কিন্তু থাকিস ওকে?”

নূর ডানে-বায়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তবে সে মনে মনে দোটানায় ভুগল হলে যেতে! এখন হলে গেলেই তাকে চাঁদের মুখোমুখি হতে হবে। যা সে এখনি চাইছেনা। নিজের ফিলিংস, ইমোশন, খারাপ লাগার জায়গাগুলো সে লুকিয়ে রাখতে চাইছে। যা চাঁদের সামনে গেলে আদোতেই সম্ভব নয়। রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে দাঁড়িয়ে নূর দু থেকে তিনটি সিগারেট একটানে শেষ করে ফেলল। মনে মনে সাহস যোগাতে লাগল। চাঁদের কাছে গেলে ভেঙে পড়বেনা বলে নিজেকে শক্ত করতে লাগল। মুখে একটা সেন্টার ফ্রেশ নিয়ে সে রিকশা করে হলের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

হলের কাছাকাছি পৌঁছাতেই নূর রিকশা থামাতে বলল। ভাড়া চুকিয়ে হলের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে সে বড়ো একটি তাজা শ্বাস নিলো! ফুসফুসে যতোটা সম্ভব দম সঞ্চার করল। মনে মনে নিজেকে বুঝিয়ে বলল,,

“বি স্ট্রং ওকে? নিজেকে যতটা সম্ভব শক্ত রাখতে হবে। কোনোভাবে চাঁদের সামনে পড়ে গেলেও তার দিকে তাকানো যাবেনা। আইসক্রিমের মতো একদমই গলে যাওয়া চলবেনা। কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে হবে। মনের কথা শুনতে হবে। ডোন্ট কেয়ার ভাবসাব নিতে হবে। বুঝছস না?”

নিজেকে বুঝিয়ে শুঝিয়ে নূর হেলে থাকা শার্টের কলারটা ঠিক করল। ভীরু পায়ে হেঁটে গেইটের ভেতর পা বাড়াতেই অমনি সে থেমে গেল! আকস্মিকভাবেই তার চোখের সামনে চাঁদ এসে হাজির হলো। সঙ্গে সঙ্গেই নূর ভূত দেখার মতো চমকে উঠল! থমথমে গলায় গড়গড় করে বলল,,

“এই তোমার মুখের এই অবস্থা কেন?”

ঠোঁট উল্টে চাঁদ জলদি করে ঘুরে নিলো। মুখে মাস্ক পড়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,,

“আপনার অভিশাপেই আজ আমার মুখের এই অবস্থা বুঝেছেন? যেদিন থেকে আপনি ইয়া বড়ো একটা চিঠি লিখে ঢাকা ফিরে এসেছেন সেদিন থেকেই আমার মুখে এসব ভ্রুনো গজানো শুরু করেছে! সব আপনার দোষ বুঝেছেন?”

নূর বেশ ভাব নিলো। কঠোরতাকে এখনই কাজে লাগানোর পায়তারা করল। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,,

“রুহের হায় বুঝো হ্যাঁ? রুহের হায়? এই রুহের হায়-ই লাগছে তোমার৷ যাই হোক এখন আমি এসব ভুলে গেছি! নতুনভাবে সব শুরু করছি! এসব অতীত ফতীত মনে রেখে এখন কোনো কাজ নেই আমার। দেখি সামনে থেকে সরো। কেন যে তোমার সামনেই আমাকে পড়তে হলো! আজকের দিনটাই খারাপ হয়ে গেল আমার। ডেম ইট!”

#চলবে…?