প্রেমময়ী তুমি পর্ব-৬২+৬৩

0
456

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৬২
#নিশাত_জাহান_নিশি

“খবরদার। যদি গাড়ি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছ তো!”

তৎক্ষণাৎ চাঁদের বিমূর্ষ মুখমণ্ডলে হিংস্রতার ছাপ প্রগাঢ়ভাবে ফুটে উঠল! রাগে অতি ক্ষুব্ধ হয়ে সে গাড়ির দরজায় হাত রাখল। নূরের একরোঁখা তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে সে মুখমণ্ডলে যতটা সম্ভব অমসৃণতা ফুটিয়ে তুলল। কঠোর হাত দ্বারা গাড়ির দরজায় সজোরে এক ধাক্কা মারল। মৃদুস্বরে বলল,,

“আমি আপনার সাথে ঐ বাড়িতে যাব নায়ায়ায়া।”

চাঁদ তার কাজে ব্যর্থ হলো। কিছুতেই নূরের বলিষ্ঠ হাতের বাঁধা পেরিয়ে গাড়ির দরজাটি খুলতে পারল না! নূরের তীক্ষ্ণতা এবার চাঁদের থেকে দ্বিগুন হারে বুদ্ধি পেল। চোয়াল উঁচু করল সে। চাঁদের মুখের দিকে খানিক ঝুঁকে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“চুপচাপ বসে থাকো। বেশি জেদ দেখাতে আসবে না। তখন কিন্তু কেঁদেও কুল পাবেনা।”

নূরের গরম মাথার হুমকিতে যদিও চাঁদের বিশেষ কিছু আসল গেল না তবুও সে চুপ থাকতে বাধ্য হলো! কারণ, এখন জেদ দেখিয়েও তার কোনো উপায়ন্তর নেই। গাড়ি থেকে নেমে যে সে বাড়ির ভেতর ঢুকবে সেই ঠায়টাও নেই। তার মা যে তাকে সেই ঘাড় ধরে টেনে এনে গাড়িতে উঠিয়ে দিবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই! তাছাড়া সোহানীর জন্যও তার মন কেমন করছে। সোহানীকে একা ছাড়তে মন চাইছেনা। সোহানীর থেকে কোনো রকম দূরত্বে যেতে চাইছেনা। তাই এরচেয়ে ভালো বরং গাড়িতেই বসে থাকা। দুদিনের-ই তো ব্যাপার।

রাগ জেদ বিসর্জন দিয়ে চাঁদ নূরের সূচালো দৃষ্টি থেকে ঝাঁজালো দৃষ্টি সরিয়ে নিলো! মাথা নুইয়ে নাক টানতে লাগল। আড়ালে হাত-পা কচলাতে লাগল! চাঁদকে পূর্বের তুলনায় স্বাভাবিক হতে দেখে নূর স্বস্তির শ্বাস ফেলল! পাঞ্জাবির কলারটা ঠিক করে জায়গা থেকে সরে দাঁড়ালো। জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়াকে ডেকে বলল দ্রুত গাড়িতে ওঠে বসতে। এক্ষুণি গাড়ি ছেড়ে দিবে। নূরের ডাকে ব্যাগপত্র নিয়ে দৌঁড়ে এসে তারা তিনজন ব্যাক সিটে এসে গাদাগাদি করে বসল। চাঁদকে চাপতে চাপতে তারা তিনজন একেবারে গাড়ির সাথে ফিট করে ফেলল! তবুও যেন কিছু ভাবান্তর হলোনা চাঁদের! জেদের চেয়ে শরীরের অস্বস্তিকে বেশি প্রাধান্য দিতে চাইলনা! চাঁদের বেখায়ালী ভাবমূর্তি দেখে জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। কীসের জন্য চাঁদ এতটা রাগ নিয়ে বসে আছে তাই তাদের ভীষণভাবে ভাবাতে লাগল।

নতুন করে আরও একটি মাইক্রো ভাড়া করতে হলো নূরদের। সবার জায়গা হচ্ছিলনা মোট আটটি গাড়িতে! নতুন করে আরও চারজন যোগ হলো তাই। শেষের ভাড়া করা গাড়িটিতে বসল নূর, মাহিন, সাদমান এবং নীড়ের সব ফ্রেন্ডসরা। সবাই ঠিকঠাক মতো বসতেই ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলো। হুট করেই পুচির কথা মনে পড়ল চাঁদের! এতক্ষণ জেদের বসে পুচির কথা একদমই ভুলে বসেছিল সে। জোরে চিৎকার করে সে বলল গাড়ি থামাতে। অমনি ড্রাইভার হলগেইটের বাইরে এসে চট জলদি গাড়িটা থামিয়ে দিলো। উপস্থিত সবাই হঠাৎ গাড়ি থামানোর কারণ জানতে চাইল। চাঁদ কোনো প্রতিউত্তর না করেই বেশ উত্তেজিত হয়ে গাড়ি থেকে নামতে চাইল। অমনি নূর অবিশ্বাস্য ভাবে পুচিকে কোলে নিয়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো! নাক টিপে ধরে সে গাড়ির দরজাটি খুলল। পুচিকে চাঁদের কোলে বসিয়ে দিয়ে নাক থেকে হাত সরালো। খরখরে গলায় বলল,,

“নাও। এবার ঠিক হয়ে বসো। খবরদার আর গাড়ি থামাতে বলেছ তো।”

নূরের মুখের উপর চাঁদ ঠাস করে গাড়ির দরজাটি লাগিয়ে দিলো! বুঝাতে চাইল সে ভীষণ রেগে আছে তার প্রতি। ইশারা বেশ বুঝে নিলো নূর। বাঁকা চাহনিতে সে জানালার কাঁচ ভেদ করে চাঁদের রাগে টইটম্বুর রক্তিম মুখশ্রীতে তাকালো। ঠোঁট কামড়ে ধরে মনে মনে অভিসন্ধি কষিয়ে বলল,,

“আপনার রাগ কীভাবে ভাঙাতে হয় আমার জানা আছে জানেমান!”

পাঞ্জাবির কলারটা ঝাকিয়ে নূর জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। নূরের যাওয়ার পথ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো চাঁদ। পুচির দিকে মনোযোগ দিলো। পুচি এখনো লাল টুকটুকে বউ সেজে বসে আছে। দেখেই কেমন আদর আদর পাচ্ছে! জ্বরটা হওয়ার পর থেকেই পুচি কেমন যেন শান্ত হয়ে গেছে। মনমরা অসহায়দের মতো থাকে সারাটাক্ষণ। চুপচাপ থাকতে বেশ পছন্দ করে। আহ্লাদি হয়ে চাঁদ পুচিকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। কপালে অনবরত চুমু খেয়ে বলল,,

“আমার মেয়েটা।”

অমনি গাড়ি ছেড়ে দিলো। শাঁ শাঁ বেগে গাড়ি ছুটে চলল সোহানীর শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে। গাড়িতে ওঠার পর থেকেই তাশফিয়া কেমন যেন মুখটা ভাড় করে বসে আছে! বিষয়টা যদিও জায়মা এবং তিথী প্রায় অনেকক্ষণ যাবত অনুমান করছে। কারণটা তাদের বেশ ভালোভাবেই জানা। তবুও তারা তাশফিয়াকে ঘাটাতে চাইছে! নীরবতা ভেঙে জায়মা গলা খাকিয়ে টিটকারিপূর্ণ গলায় বলল,,

“শুনলাম আয়মন ভাইয়া নাকি আমাদের সাথে যাচ্ছেনা। আহারে বেচারা! প্রেম বুঝি আমার এই ভাইটার কপালে নেই!”

মুখ টিপে হাসল জায়মা! তিথীও কম না। সেও মুখ চেপে হেসে জায়মার টিটকারীকে ইন্ধন যুগিয়ে বলল,,

“ঠিকই বলেছিস রে জায়মা। সত্যিই তাশফিয়ার কপালটা পোঁড়া! দেখছিস না? কেমন মুখ ফুলিয়ে বসে আছে বেচারীটা?”

তাশফিয়া ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল! দুই কা’র্লপ্রিটের দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকালো। অকপট গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“মজা নিচ্ছিস না? দুজনে মিলে মজা নিচ্ছিস? আয়মন ভাইয়া আমার কিছু হয়না ওকে? সো উনি আমাদের সাথে গেলেই কী বা না গেলেই কী?”

চাঁদ এবার মৌনতা ভাঙল। হেয়ালীপূর্ণ দৃষ্টিতে তাশফিয়ার দিকে তাকালো। ব্যঙ্গাত্নক গলায় বলল,,

“ওহ্ আই সি। আয়মন ভাইয়া তোমার কিছু হয়না না? তাহলে হাতের আঙুলে ওটা কী পড়ে রেখেছ সোনা? ছেঁড়া তেনা?”

জায়মা এবং তিথী হু হু শব্দে হেসে দিলো! চাঁদকে জিয়ো জিয়ো করতে লাগল। তাশফিয়া ভীষণ লজ্জা পেয়ে বসল। শীঘ্রই হাত দ্বারা মুখটা ঢেকে নিলো! মিনমিনে গলায় বলল,,

“যাহ্! আমার লজ্জা করছে!”

___________________________________

গভীর রাত। চাঁদের আলোয় দীপ্তিময় নিশুতি রাত। স্বয়ং চাঁদ আকাশে আজ তার পূর্ণ আলো মেলে দিয়েছে! চাঁদের পাশে তাঁরারাও বেশ দম নিয়ে ছুটোছুটি করছে। মাঝে মাঝে হালকা বাতাস এসে তাদের গাঁ ছুঁয়ে দিচ্ছে। জানালায় থাকা পর্দার ফাঁকা অংশ দ্বারা চাঁদ এবং তাঁরার সেই লুকোচুরি খেলা দেখতে ব্যস্ত সোহানী! নীড়ের প্রশ্বস্ত বুকের উপর মাথা রেখে চাঁদ, তাঁরার এই লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে সোহানীও কেমন নীড়ের সাথে লুকোচুরি খেলছে! কিছুতেই নীড়ের কাছে ধরা দিতে চাইছেনা! সোহানীর সাথে ছুটোছুটি করতে করতে একপর্যায়ে এসে নীড়ও বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই সোহানীকে বুকে নিয়েই শুয়ে আছে।

রকমারী ক্যান্ডেলের আলোতে গভীর অন্ধকারে ঢাকা রুমটাও এখন মৃদু আলোতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। চারিপাশ থেকে বাহারী ফুলের মন মাতানো সুবাস নাকের তলদেশে প্রখরভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। নিঃশ্বাসে যেন আজ বসন্তের হাওয়া বইছে। ফাল্গুনের রঙ লেগেছে বুঝি আজ বিবাহিত দুই নব দম্পতির দেহ ও মনে। সোহানীর চেয়েও নীড় বেশি প্রভাবিত হচ্ছে সেই রঙে! নেশার মতো সোহানী তাকে টানছে। সেই নেশা তাকে ক্রমশ পাগল করে তুলছে। সোহানীকে কখন সে নিজের করে পাবে সেই মাদকতায় গভীর ভাবে মত্ত হয়ে আছে। ক্লান্তি দূর হতেই নীড় পুনরায় সোহানীকে হেঁচকা টানে বিছানার উপর শুইয়ে দিলো! এবার আর সে হার মানতে রাজি নয়। সোহানীর দুষ্টুমি কীভাবে বন্ধ করতে হয় তার বেশ ভালো করে বুঝা হয়ে গেছে! লাজ লজ্জা বিসর্জন দিয়ে নীড় শক্ত হাতে সোহানীর শাড়ির আঁচল টেনে ধরল! অমনি সোহানী ভড়কে উঠল। লজ্জায় মুখ ঢেকে নিলো। নীড় বাঁকা হাসল। সোহানীর কানের কাছে তার নরম ওষ্ঠদ্বয় ঠেকালো। কানের লতিতে উষ্ণ ঠোঁট ছুঁইয়ে মন্থর গলায় বলল,,

“এবার আমাকে আটকে দেখাও!”

সোহানী এবার ইচ্ছে করেই হার মানল! গভীর রাত হতে চলল। এভাবে আর চলতে দেওয়া যাবেনা। ভালোবাসা তারও এবার খুব গাঢ়ভাবে পেয়েছে! লজ্জা ভুলে নীড়কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল সোহানী! নীড়ের বেসামালহীন ভালোবাসায় নিজেকে ভাসাতে লাগল। সোহানীর সায় পেয়ে নীড় আরও তৎপর হয়ে উঠল। ভালোবাসার গভীরতা সোহানীকে বুঝাতে লাগল!

,
,

ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফ্যাসফ্যাস করে কান্না করছে চাঁদ! যাকে বলে নাকে কান্না। চাঁদের এহেন কান্নাকাটি দেখে নূরের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। চুল টেনে সে রাগ নিবারণ করছে। মাথামুথা আরেকটু গরম হয়ে গেলেই কখন যে সে চাঁদের গাঁয়ে হাত তুলে বসে বলা যায়না! ঠোঁট কামড়ে রাগ সংবরণ করল নূর। বেহায়া হয়ে চাঁদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,,

“হইছে তো। এত কাঁদতেছ কেন হ্যাঁ? থামতে বলতেছিনা?”

চাঁদ নাক টানল। বিভৎস গলায় বলল,,

“থামতে বললেই আমি থামব কেন হ্যাঁ? আমিও তো একদিন বলছিলাম সিনিয়র টিনিয়র আপুদের সাথে কথা বলা আমার পছন্দ না। মেলামেশাও পছন্দ না। তবুও তো কেউ মিশেছে। হাসাহাসি করে কথাও বলেছে। রিকশায় অবধি উঠিয়ে দিয়ে এসেছে। কই? কেউ তো আমার কথা শুনেনি। তবে আমি কেন শুনব তার কথা হ্যাঁ?”

“তুমি শুনবা। কারণ, তুমি শুনতে বাধ্য। আমি যা বলব তুমি তাই শুনতে বাধ্য।”

“না আমি বাধ্য না! আমি কারো কথা শুনতে বাধ্য না। আমার মন যা বলবে আমি তাই করব।”

তুখোড় রাগ দেখিয়ে চাঁদ পিছু ঘুরে দাঁড়াতেই নূর পেছন থেকে চাঁদকে জাপটে ধরল! রাগ শান্ত করে গলায় মাধূর্যতা নিয়ে এলো। চাঁদের ঘাড়ে মুখ ঠেকিয়ে মসৃণ গলায় বলল,,

“আচ্ছা হইছে। আর মিশবনা আমি ঐ সিনিয়র আপুর সাথে। তুমি যা বলবা এখন থেকে তাই হবে। তুমি উঠতে বললে উঠব, বসতে বললে বসব, খাইতে বললে খাব, ম’র’তে বললে ম’র’ব!”

“বালাইষাট! আমি আপনাকে ম’র’তে বলব কেন?”

“আমি তোমার জন্যই বাঁচি! তোমার জন্যই ম’রি! আমার ভাগ্যরেখা যে তুমিই।”

“থাক হইছে। আর নাটক করতে হবেনা। মাঝরাতে আমাকে এখানে ডেকে আনছে নাটক করার জন্য।”

“আমার ভালোবাসা তোমার নাটক মনে হয় না?”

“হ্যাঁ হয়! খুব হার্ট করেছেন আজকে আমাকে। ঐ নায়লা ফায়লার সাথে মিশে।”

“কেন ভুলে যাও বলো তো? উনি আমার সিনিয়র। কিছুতেই কিছু সম্ভব না। তাছাড়া আমার বউ আছে! পৃথিবী সমান ভালোবাসি আমি তাকে। আমি তাকে যতটা চাই এই যামানার কেউ কাউকে এতটা চায়না।”

চাঁদ মৃদু হাসল। দৃষ্টি ঘুরিয়ে নূরের দিকে তাকালো। চাঁদের নেশাভরা হাসি দেখে নূরের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। টুপ করে সে চাঁদের গালে চুমু খেয়ে দিলো! চাঁদ লজ্জা পেয়ে গেল! সঙ্গে সঙ্গেই নূরের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। মাথা নুইয়ে ফিচেল স্বরে বলল,,

“চুমু খেলেন কেন হুম? এখন যদি আমার মুখের ব্রনগুলো আপনার ঠোঁটে চলে যায় তখন?”

“তখন আর কী? দুজনেরই একই রোগ হবে। আমিও তোমার আক্রান্ত হব। সত্যি বলতে আমার কোনো সমস্যা নেই এতে।”

“আচ্ছা ছাড়ুন। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমুতে যেতে হবে।”

“আজ না ঘুমালে হয়না?”

“মানে? ঘুমাব না কেন?”

নূর খুব আদুরে হয়ে উঠল! চাঁদকে আরও দ্বিগুন ভাবে আঁকড়ে ধরল। নেশায় মত্ত হয়ে চাঁদের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো। ঘোরজড়ানো গলায় বলল,,

“কারণ, আজ আমার খুব প্রেম প্রেম পাচ্ছে।”

চাঁদ ফিক করে হেসে দিলো। নূরের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য হাত-পা ছুড়োছুড়ি করল। আড়ষ্ট গলায় বলল,,

“ধ্যাত! আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি।”

“আচ্ছা৷ চলো আমরা বিয়ে করি!”

“কীভাবে?”

“কীভাবে আবার? তুমি তিনবার কবুল বলবা এরপর আমি তিনবার কবুল বলব! ব্যস! বিয়ে হয়ে গেল।”

চাঁদ হু হা শব্দে হেসে দিলো! ঠাট্টার স্বরে বলল,,

“এই আপনি কি নিব্বা-নিব্বিদের মতো শুরু করছেন?”

“শুরু করলে ক্ষতি কী হুম? তুমি তো নিব্বিই! কিছু হতে না হতেই চোখের জল ছেড়ে দাও। মাথামুথা গরম করে দাও।”

চাঁদ আবারও মুখ ফুলিয়ে নিলো। অভিমানী স্বরে বলল,,

“হ্যাঁ। আমি তো নিব্বিই। আপনার তো সিনিয়র আপু লাগবে না? যান না যান ঐ নায়লার কাছে যান। যথেষ্ট ম্যাচিরিউড আছেন উনি। আপনাকেও বুঝবে আর আপনিও তাকে বুঝবেন। তখন আর মাথামুথা গরম হবেনা আপনার।”

“উঁহু। আমার সিনিয়র আপু আমার লাগবেনা। আমার এই পাগলীটাকেই চাই। তাকে পেলেই আমার সব পাওয়া হয়ে গেল।”

হেঁচকা টানে চাঁদকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো নূর। ঘোরে আসক্ত হয়ে নির্দ্বিধায় চাঁদের কোমল ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরল! চাঁদ চোখজোড়া বড়ো বড়ো করে নূরের দিকে তাকাতেই নূর চোখ মেরে দিলো চাঁদকে! আরও শক্তপোক্তভাবে আঁকড়ে ধরল চাঁদের ঠোঁট জোড়াকে।

,
,

করিডরের ফাঁকা কর্ণার জুড়ে একটি ছোট্টো সোফায় মাথা নুইয়ে বসে আছে তিথী! অকথ্য কিছু জড়তায় উসখুস করছে সে। হাত-পা কচলে ওড়নার অংশটা কেমন হাতে পেঁচাচ্ছে! দুর্ভেদ্য লজ্জায় ভুগছে সে। বারবার কেমন কেঁপে কেঁপেও উঠছে! চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিচ্ছে। অদ্ভুত এক মন মাতানো শিহরণ অনুভব হচ্ছে তার সর্বাঙ্গ জুড়ে! লাল বার্ল্বের লালচে আলোতে চারপাশটা বেশ রঙিন হয়ে আছে। সুন্দর এক পরিবেশ বিরাজ করছে আশপাশ জুড়ে। কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই। সমস্ত বাড়ি নীরবতায় তলিয়ে আছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা।

তিথীর পাশে বসে মাহিন গভীর মনোযোগের সহিত অতি গুরুত্বপূর্ণ এক কাজ করছে। তিথীর জামার পেছনের অংশে থাকা জং ধরা চেইনটিকে টেনে উপরে তোলার চেষ্টা করছে! তাশফিয়া অনেক চেষ্টা করেও পারেনি চেইনটিকে উপরে তুলতে। তাই বাধ্য হয়ে তিথী ওড়না দ্বারাই পিঠের অংশটি কোনো রকমে ঢেকে রেখেছিল। তবে মাহিনের সাথে দেখা করতে এসেই ঘটেছিল মহা বিপত্তি। হঠাৎ করেই তার পিঠ থেকে ওড়নাটি সরে গিয়েছিল! যার ফলস্বরূপ মাহিন-ই এখন চেষ্টা করছে চেইনটিকে টেনে ঠিকভাবে উপরে তোলার! যদিও তিথী প্রথমে রাজি হতে চায়নি তবে মাহিনের জোরাজুরিতে এক পর্যায়ে এসে সে বাধ্য হয়েছিল রাজি হতে! টানাটানির শেষ পর্যায়ে এসে মাহিন বেশ বিরক্ত হয়ে উঠল। চেইনটায় জোরে এক টান দিলো! অমনি সাথে সাথেই চেইনটি গেল গোঁড়া থেকে খুলে! সরাসরি মাহিনের হাতে চলে এলো চেইনটি। জিভ কেটে মাহিন কোনাকুনি হয়ে বসে থাকা তিথীর দিকে তাকালো। তিথী আড়চোখে মাহিনের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল মাহিন নিশ্চয়ই বড়ো কোনো অঘটন ঘটিয়েছে! ঘুরে বসল তিথী। মাহিনের দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মাহিন চেইনটি হাতে নিয়ে ছোটো বাচ্চাদের মতো নির্বোধ ভাবমূর্তি নিয়ে তিথীর দিকে তাকালো। তিথী ফোঁস করে শ্বাস ফেলে চেইনটির দিকে তাকালো। মাহিনের হাত থেকে চেইনটি কেড়ে নিলো। খরতর গলায় বলল,,

“বলছিলাম না পাকনামি না করতে? জোর করে কেন চেইনটা নিয়ে টানাটানি করতে গেলেন হ্যাঁ?”

মাহিন শুকনো ঢোঁক গিলল। অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে তিথীর দিকে তাকালো। ধরাশায়ী গলায় বলল,,

“আরে আমি কী করব? একটু টান দিলেই চেইনটা হাতে চলে আসবে কে জানত? তাছাড়া আমি তো তোমার হেল্প-ই করছিলাম তাইনা?”

“হ্যাঁ এই হেল্পের নমুনা? জামাটা নষ্ট করে আমার হেল্প করা হচ্ছিল না? আমার শখের জামাটার এখন কী হবে হ্যাঁ? কী করব এখন এটাকে দিয়ে আমি? গলায় ঝুলাব?”

“আচ্ছা হইছে তো। এমন হুবহু একটা ড্রেস-ই আমি তোমাকে গিফট করব। তাহলেই তো লেটা চুকে গেল না? এত রাগ দেখানোর কী আছে?”

চেইনটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলল তিথী। মাহিনকে পেছন দিয়ে উল্টোদিকে ঘুরে বসল। অভিমানে মুখ লুকালো! মাহিন তার ভুলের জন্য বেশ অনুতপ্ত হলো। ধীর শ্বাস ফেলে তিথীকে হেঁচকা টানে তার দিকে ঘুরিয়ে নিলো। অবুঝ ভঙ্গিতে দু’কানে হাত রাখল। ভোলাভালা চেহারায় ঠোঁট উল্টে বলল,,

“সরিরিরিরি।”

তিথী মুখ বাঁকালো। ব্যঙ্গ করে বলল,,

“ঢঙ!”

“আরে ঢঙ না। সত্যি সরি।”

তিথী পুনরায় মুখটা বাঁকাতেই মাহিন টুপ করে তিথীর বাঁ গালে দীর্ঘ এক চুমু এঁকে দিলো! সঙ্গে সঙ্গেই তিথী গালে হাত রেখে তাজ্জব দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। অমনি মাহিন ব্যগ্র হেসে পুনরায় তিথীর গালে চুমু খেয়ে দিলো! অবাকের চরম শীর্ষে পৌঁছে তিথী চোখগুলো রসগোল্লার মতো বড়ো করতেই মাহিন বাঁকা হেসে তিথীর ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরল! গভীর রোমাঞ্চে রোমাঞ্চিত হয়ে তিথীকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে লাগল!

,
,

আয়মন প্রায় অনেকক্ষণ যাবত তাশফিয়ার নাম্বারে ডায়াল করছে। বারবার ফোনটা শুধু ওয়েটিং দেখাচ্ছে! রাগে-জেদে-দুঃখে তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। এই গভীর রাতে তাশফিয়া কার সাথে ফোনে এত কথা বলছে? তাও আবার ঘণ্টা খানিক ধরে? সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে আয়মনের মনে। যা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। টানা একঘণ্টা পর আয়মনের চল্লিশ নম্বর কলটি তাশফিয়ার ফোনে ঢুকতেই তাশফিয়া তাড়াহুড়ো করে ফোনটি রিসিভ করল! জিভ কেটে অস্থির স্বরে বলল,,

“হ্যাহ্যাহ্যালো।”

আয়মন দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠল। হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটটি দুই ঠোঁটের মাঝখানে রাখল। অস্ফুটে গলায় মৃদু চিৎকার করে বলল,,

“এই কার সাথে তুই এতক্ষণ ফোনে ছিলি হ্যাঁ? কার সাথে?”

তিথী থতমত খেয়ে উঠল। শুকনো ঢোঁক গিলে ভয়ে কাঁপতে লাগল। অস্বাভাবিক গলায় বলল,,

“আআআম্মুর সাসাথে কককথা বলছিলাম!”

“এতক্ষণ যাবত তুই আম্মুর সাথে কথা বলছিলি না? বেয়াক্কল বুঝাস আমাকে?”

“সত্যি বলছি আয়মন ভাইয়া! আমি সত্যিই আম্মুর সাথে কথা বলছিলাম। বিশ্বাস না হলে আপনি এসে কললিস্ট চেক করে যান।”

আয়মন তার আগ্রাসী জেদ হালকা করল। হাত থেকে সিগারেটটি ফেলে সামনের অগোছালো চুল গুলো টেনে ঠিক করল। নাক মুখ থেকে ধোঁয়া বের করে শান্ত স্বরে বলল,,

“আম্মু কেমন আছে?”

“ভালো আছে। কাল পরশুর মধ্যেই আমাকে কুমিল্লা ব্যাক করতে বলেছে!”

“বলো নাই যে কাল পরশুর মধ্যে যাওয়া সম্ভব না?”

“আম্মু অসুস্থ আয়মন ভাইয়া। কীভাবে কথাটা বলি বলুন?”

আয়মনের মেজাজ আবার বিগড়ে গেল! চোখ-মুখ লাল করে তেজী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আমি এখনো তোমার ভাইয়া হই?”

তাশফিয়া রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। নিচু গলায় বলল,,

“সরি!”

“শুধু নাম ধরে ডাকো।”

তাশফিয়া বেশ বিব্রতবোধ করল। হঠাৎ নাম ধরে ডাকতে তার বড্ড কুণ্ঠিতবোধ হলো। তবুও যেন আয়মনের ডরে-ভয়ে সে অসমতল গলায় বলল,,

“আআয়মন!”

না চাইতেও ম্লান হাসল আয়মন! তাশফিয়ার মুখে তার নামটি শুনতে বেশ মিষ্টি লাগল। গলা ঝেড়ে আয়মন স্থির গলায় বলল,,

“আচ্ছা আমি আন্টির সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলব। তাছাড়া আমরা পরশুর মধ্যেই চেষ্টা করব এখান থেকে বের হয়ে যেতে। কুমিল্লায় আমারও অনেক কাজ পড়ে আছে।”

“হুম।”

“কী করো?”

“আপনার সাথে কথা বলি।”

“খাইছো?”

“হুম। আপনি?”

আয়মন প্রসঙ্গ পাল্টে নিলো। দেয়ালে পিঠ ঠেঁকিয়ে চোখ জোড়া বুজে দাঁড়ালো। সম্মোহনী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আমি আসব?”

“মানে?”

“যা বুঝছ তাই!”

“তাই বলে এত রাতে?”

“তুমি বললে রাত-ই আমার কাছে দিন মনে হবে!”

“যদি না বলি?”

“তাহলে বলব আমাকে দেখার ইচ্ছে নেই তোমার!”

“উমমমম! নেই বৈ তো কী?”

“তাহলে আসি?”

তাশফিয়া মিষ্টি হাসল! মাথা নুইয়ে লজ্জা ঢাকল। বিছানার এপাশ থেকে ওপাশ হয়ে ক্ষীণ গলায় বলল,,

“আসুন!”

,
,

ভীরু পায়ে হেঁটে জায়মা নিচে নেমে গেল পানি খেতে। তাদের রুমে থাকা পানির জগটিতে পানি ফুরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। তাশফিয়াকে অনেক টানা-হেছড়া করেও সে নিচে নামাতে পারলনা! আয়মনের সাথে আলাপচারীতায় ব্যস্ত তাশফিয়া। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই মাঝরাতে ওঠে পানির তৃষ্ণা মেটাতেই তাকে একা এভাবে ছুটে আসা। যদিও ড্রয়িংরুমে মিটমিটে আলো জ্বলছে। তবুও যেন গাঁ টা কেমন ছমছম করছে তার! পা ফেলে সামনে এগিয়ে যেতেও কেমন ভয় ভয় করছে। নিজেকে অভয় যুগিয়ে তাশফিয়া বুকে হাত রেখে পা টিপে টিপে হেঁটে ফ্রিজের কাছে এগিয়ে গেল। এদিক ওদিক ভয়াল দৃষ্টি ফেলে ফ্রিজের দরজাটি খুলল। ঠাণ্ডা পানির বোতলটি বের করল। পিপাসা অনুযায়ী গড়গড় করে পানিটুকু খেয়ে নিলো। খালি বোতলটি পুনরায় ফ্রিজের ভেতর রেখে সে যেই না পিছু ঘুরতে যাবে অমনি কারো গাঁয়ের সাথে জোরে এক ধাক্কা খেলো! অত্যধিত ভয়ে জায়মা চিৎকার করার শক্তিটুকুও হারিয়ে বসল। মুখে হাত চেপে ধরে সে ভীতু দৃষ্টিতে সামনে তাকালো। অমনি মিহি আলোতে সাদমানের রক্তশূল মুখমণ্ডল তার চোখে পড়ল! কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই জায়মাকে উপেক্ষা করে সাদমান রান্নাঘরে ঢুকল। রান্নাঘরের প্রতিটি তাক ঘেটেঘুটে সে কী যেন খুঁজতে লাগল। অস্থিরতায় সামনের চুলগুলো টানতে লাগল। সাদমানের এই বিভৎস অবস্থা দেখে জায়মার পিলা চমকে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ হতে লাগল। দৃষ্টি জোড়া আরও ভীতসন্ত্রস্ত হতে লাগল। গলা দিয়ে আপনাআপনি বের হলো,,

“এভাবে কী খুঁজছেন সাদমান ভাইয়া?”

সাদমান হিংস্র জন্তুদের মতো ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছাড়তে লাগল। হাত জোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে চক্ষুজোড়া বুজে নিলো। মুখমণ্ডল বিকৃত করে ভয়াল চিৎকার ছেড়ে বলল,,

“লাইটার খুঁজে পাচ্ছিনা কেন?”

জায়মা মুখ চেপে চোখের জল ছাড়ল! প্রতিউত্তরে পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“লালালাইটার দিয়ে আআআপনি কী করবেন?”

“সিগারেট ধরাব। মাথায় আগুন জ্বলছে আমার। মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে আমার পালপিটিশান বাড়িয়ে দিলো!”

#চলবে…?

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৬৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

“সিগারেট ধরাব। মাথায় আগুন জ্বলছে আমার। মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে আমার পালপিটিশান বাড়িয়ে দিলো!”

হিংস্রতায় পরিপূর্ণ সাদমান। ঘাড় থেকে শুরু করে কপালের অগ্রভাগের রগগুলোও অবধি টান টান উত্তেজনা নিয়ে সুস্পষ্টভাবে দাঁড়িয়ে আছে! দেহের প্রতিটি শিরা-উপশিরা টগবগ করছে। অকাতরে ঘাম ঝরছে গাঁ থেকে। শরীরময় তীব্র অস্থিরতা নিয়ে সাদমান এদিক থেকে ওদিক পায়চারী করছে। মনে হচ্ছে যেন মাথার চুলগুলো সে এক্ষুণি টেনে ছিঁড়ে ফেলবে! সাদমানের এহেন ভয়ংকর ভাবমূর্তি দেখে জায়মা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে আদোতে কী ঘটেছে! তবে যাই ঘটে থাকুক না কেন সাদমানকে এই বিভৎস রূপে দেখতে তার মোটেও ভালো লাগছেনা! ভেতরে কেমন ক্ষুদ্র ধরনের ব্যথার অনুভূতি হচ্ছে! যে ব্যথার কারণ খণ্ডানো এত সহজ নয়! এখন যেকোনো উপায়েই হোক সাদমানকে তার শান্ত করতেই হবে! স্বাভাবিক করে তুলতে হবে। এই ভেবে ফুসফুসে দম সঞ্চার করল জায়মা। বুকে যথেষ্ট সাহস যুগিয়ে সে পা টিপে টিপে হেঁটে সাদমানের ঠিক মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। নির্ভীক গলায় অধীর হয়ে থাকা সাদমানকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“আপনি চাঁদ এবং নূর ভাইয়াকে ছাদে একসাথে দেখে ফেলেছেন তাইনা?”

ঝট করে সাদমান তার গোলন্দাজ দৃষ্টিতে জায়মার চতুর দৃষ্টিতে দৃষ্টি ফেলল! পুনরায় মুখমণ্ডলে তীব্র কঠোরতা ফুটিয়ে তুলল। জায়মার এই উপযোগী প্রশ্নে সে যে শুধু তেতে উঠেছে তা কিন্তু নয় বরং খানিকটা অবাকও হয়েছে! ছাদে সে কাকে দেখে আসল না আসল তা তো জায়মার জানার কথা নয়! তবে জায়মা জানল কীভাবে এসব? গভীর ভাবনাচিন্তায় নিমজ্জিত থাকতেই জায়মা ঝেড়ে কাশল। বুকে হাত গুজে মলিন সুরে বলল,,

“শুনেছি বুদ্ধিমানরা কখনো অন্যের সুখ দেখে নিজে অকারণে কষ্ট পায়না। বরং নিজে কীভাবে সুখে থাকবে তা নিয়ে বিরাট ভাবনাচিন্তা করে। নিজে সুখে থাকার উপায় নিজেই খুঁজে বের করে। কারণ নিজে নিজেকে খুশি করতে না পারলে অন্য কেউ তাকে খুশি করতে পারবেনা। এখন আমার প্রশ্ন হলো, আপনি কি সেই বুদ্ধিমানদের দলে নন?”

চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে সাদমান জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। জায়মার নীতিবাক্য তার মোটেও পছন্দ হলোনা। বরং কাটা গাঁয়ে লবণের ছিঁটা মনে হলো! দাঁতে দাঁত চিবিয়ে সাদমান খরখরে গলায় বলল,,

“লাইটার খুঁজতে এসেছিলাম জ্ঞান নিতে নয়!”

গ্যাসের তলা থেকে জায়মা হাতিয়ে একটা লাইটার খুঁজে পেল! দ্রুত পায়ে হেঁটে জায়মা হাওয়ার বেগে ছুটতে থাকা সাদমানের পিছু নিলো। পেছন থেকে সাদমানকে মৃদু আওয়াজে ডাকতে লাগল। লাইটার খুঁজে পেয়েছে বলে চ্যাঁচাতে লাগল। তবে সাদমান রাগে-জেদে নিজের মধ্যে এতটাই বিভোর ছিল যে কর্ণকুহরে তার শোঁ শোঁ বিকট শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ-ই পৌঁছালোই না! এক পর্যায়ে সাদমানকে ডিঙিয়ে এসে জায়মা সোজাসুজি হেঁটে সাদমানের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। হাঁপাতে হাঁপাতে লাইটারটি সাদমানের মুখের সামনে ধরল। শ্রান্ত গলায় বলল,,

“এই নিন আপনার লাইটার। দয়া করে মাথাটা এবার ঠাণ্ডা করুন।”

সাদমান যেন আলোর দিশা খুঁজে পেল! স্বস্তির শ্বাস ফেলল। খানিকটা বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাওয়ার মত খুশি হলো! প্যান্টের পকেট থেকে একটি সিগারেট সে হাতে তুলে নিলো৷ দুই ঠোঁটের মাঝখানে সিগারেটটি ধরে ঝট করে জায়মার হাত থেকে লাইটারটি কেড়ে নিলো! ব্যস্ত ভঙ্গিতে লাইটার দ্বারা সিগারেটটি ধরালো। সিগারেটটিতে দীর্ঘ এক টান দিয়ে সে অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে জায়মার দিকে তাকালো৷ করিডরের রেলিংয়ে ঢ্যাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটটি দু’ঠোঁটের মাঝখানে রেখেই সামনের চুলগুলো ঠিক করল। অসমতল গলায় জায়মাকে শুধালো,,

“কী বলছিলা ঐ সময়? আমি বুদ্ধিমান কি-না?”

জায়মা শুকনো ঢোঁক গিলল। মাথা নুইয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। সাদমান শ্লেষাত্মক হাসল! নাক মুখ থেকে ধোঁয়া নির্গত করে বলল,,

“হ্যাঁ আমি বুদ্ধিমান! আর সে কারণেই নূর এবং চাঁদের জীবন থেকে সরে যাচ্ছি। বহুদূরে চলে যাচ্ছি। আর চাইলেও হয়তো অনেকগুলো বছর আমাদের আর দেখা হবেনা!”

জায়মার নিঃশ্বাসে সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়া হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করছিল৷ যদিও তার নিঃশ্বাস নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল তবুও যেন সে এই যন্ত্রণা থেকে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার অন্তঃপ্রাণ চেষ্টা করল। কারণ, সাদমান এখন যে কথাটি বলল সে কথাটি তার প্রাণ ছেদ করে দেওয়ার মত যথেষ্ট ছিল। নিঃশ্বাসের কষ্ট সেখানে কিছুইনা! অতি তুচ্ছ। রুদ্ধশ্বাস ফেলল জায়মা। ব্যথীত দৃষ্টি ফেলে সাদমানের দিকে তাকালো। কণ্ঠে কাতরতা এনে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”

সাদমান ভাবলেশহীন। সিগারেটটিতে তৃতীয়বারের মতো ফুঁক দিলো সে। স্বাভাবিক স্বরেই বলল,,

“জর্ডান।”

“আর কখনো ফিরবেন না?”

“এখনও ভেবে দেখিনি।”

লোহিত রক্তের ন্যায় লাল হয়ে থাকা জায়মার আঁখিযুগল থেকে টলটলিয়ে শ্রাবণের বারিধারা বইতে লাগল! ভেতর থেকে আসা গোঙানীর আওয়াজটা সাদমানের কান এড়ালো না! দ্রুত দৃষ্টি ফেলে সাদমান জায়মার দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গেই সে সিগারেটটি হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলল! উদ্বেগীচিত্তে অস্থির গলায় বলল,,

“সরি সরি৷ আ’ম এক্সট্রেমলি সরি জায়মা। আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম তুমি সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারো না!”

বিনা শব্দ প্রয়োগে জায়মা জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! মুখ চেপে ধরে সে কাঁদতে কাঁদতে রুমের দিকে গতিপথ নির্ধারণ করল। সাদমানকে বুঝি সে জীবনের তরে হারিয়ে ফেলল! আর কখনো বুঝি তাদের দেখা হবেনা, কথা হবেনা, ভালোবাসা বাসি ও হয়তো হবেনা! তার একতরফা অনুভূতিগুলো এভাবেই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে, অব্যক্ত রয়ে যাবে। সাদমান কখনো জানতেও পারবেনা জায়মা সত্যি সত্যিই মন থেকে তাকে ভীষণ রকম ভালোবেসে ছিল! যে ভালোবাসার কোনে পরিধি ছিলনা! কোনো সীমা-পরিসীমা ছিলনা।

________________________________

অরুণ রাঙা ভোর। প্রভাতের সমস্ত আমেজ কাটিয়ে সূর্য যেন আজ তার লাল আবির মেখে দীপ্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি আনাচে কানাচে। প্রতিদিনের ন্যায় সূর্য আজও তার নির্দিষ্ট রূঢ়তায় সীমাবদ্ধ। মেজাজ যেন বেশ খরতর! সূর্যের পাশাপাশি আজ সকাল সকাল নীড়ের মেজাজটা ও বেশ খরতর হয়ে উঠল! কারণ ঘুম ভেঙে ওঠে সে সোহানীকে তার পাশে পায়নি। বিয়ের দ্বিতীয় দিনও সোহানী প্রতিদিনকার ন্যায় কিচেনে গেছে খুন্তি নাড়তে। নীড়কে আলাদা সময় না দিয়ে। তাই জেদ দেখিয়ে নীড় ঘাপটি মেরে বিছানাতেই শুয়ে আছে। শাওয়ার নেওয়াও এখনো অবধি হয়নি তার। প্রয়োজনও মনে করছেনা। যতক্ষণ অবধি না সোহানী এই রুমে আসবে ততক্ষণ অবধি তার শাওয়ার নেওয়া হবেনা বলে কঠিন এক পণ করে রেখেছে।

সকাল নয়টা গড়ালো ঘড়িতে। চাঁদ, জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া মরার মতো বিছানায় ঘুমিয়ে রইল।তারা প্রত্যেকেই এখানে মাঝরাতে ঘুমিয়েছে। তবে তিনজন ঘুমিয়েছে প্রেম করে করে আর একজন ঘুমিয়েছে বিরহে কাঁদতে কাঁদতে! নূর, মাহিন এবং সাদমানও ধুমসে পড়ে ঘুমুচ্ছে। শার্ট-প্যান্টের কোনো ঠিক নেই তাদের! একজন আরেকজনের গাঁয়ের উপর লেদালেদি দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। এরমধ্যেই হঠাৎ নূরের ফোনটি বজ্রপাতের ন্যায় বেজে উঠল! তার কানের কাছেই ভোঁ ভোঁ শব্দে বেজে উঠল ফোনটি। ঘোর তিক্ততায় নাক-মুখ সিটকালো নূর। ভ্রু যুগল খরতরভাবে কুঁচকে আড়মোড়া জড়ানো গলায় বলল,,

“শিট। এই সাত সকালে আবার কে কল করল?”

চক্ষুজোড়া দুর্ণিবার ঘুম নিয়ে নূর ফোনটি হাতে তুলে নিলো। কোনোমতে এক চোখ মেলে সে ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকালো। তবুও যেন ঘুম আচ্ছাদিত দৃষ্টিতে কিছুই ঠাওড় করতে পারলনা সে। আদো স্ক্রীনে কার নাম্বারটি ভাসছে তাও না! মেজাজ খারাপ করে নূর ঝট করে ফোনটি তুলে নিলো। অমনি ঐ পাশ থেকে মিষ্টি মধুর স্বরে মেয়েলী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। মিস নায়লা মৃদু হেসে বলল,,

“গুড মর্ণিং নূর।”

নূর হকচকিয়ে উঠল। ফটাফট সে শোয়া থেকে ওঠে বসল৷ মাথা ঝাকিয়ে কপাল ঘঁষল। থতমত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কে? নায়লা আপু?”

“হুম। কে ভেবেছিলে?”

চোখ-মুখ মুছল নূর। ঝিমিয়ে আসা গলায় বলল,,

“আসলে আমি ঘুমুচ্ছিলাম তো। তাই আইডিয়া করতে পারিনি।”

প্রসঙ্গ পাল্টাল মিস নায়লা। বাম হাতের সাহায্যে সাদা এপ্রোণটা গাঁয়ে জড়িয়ে নিল। কপালের মাঝখানে থাকা কালো টিপটিকে আরও একদফা ঠিক করে পড়ল। প্রফুল্লিত গলায় বলল,,

“আচ্ছা। এসব বাদ দাও৷ এখন বলো তুমি আজ বিকেলে ফ্রি আছো কি-না?”

“আপু। আমি আপনাকে ফ্রি হয়ে কল দিই?”

“না নূর। এখনই বলো। কারণ তোমার আনসারের উপরই ডিপেন্ড করবে আজ বিকেলে আমি চেম্বারে যাব কি-না!”

বিষয়টাকে নূর বেশ সিরিয়াসলি নিলো! কোনো ভাবে মিস নায়লার ইশারা নূর বেশ বুঝতে পারল। কোনো কিছুতেই অতিরিক্ত রকমের বাড়াবাড়ি ভালো নয়। প্রতিটা সম্পর্কের-ই নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে থাকতে হয়! যে সীমা এখন মিস নায়লা অতিক্রম করছেন। আর একটু প্রশ্রয় দিলেই তিনি হয়তো মহামারীর আকার ধারণ করবেন! মাহিন এবং সাদমানকে গাঁয়ের উপর থেকে ঠেলেঠুলে নূর বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। এলোমেলো পা ফেলে সে গুমোট অন্ধকার রুম থেকে বের হয়ে উদোম শরীর নিয়ে ছাদের দিকে রওনা হলো! চাঁদ সবেমাত্র ঘুম থেকে ওঠে রুম থেকে বের হলো। অমনি সে পেছন থেকে দেখতে পেল উদোম শরীরে নূর দ্রুত পা ফেলে ছাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কানে আবার ফোনও চেপে রেখেছে। বিষয়টিতে চাঁদের বেশ সন্দেহ হলো! কৌতূহলী হয়ে সে ভ্রু কুঁচকালো। রহস্য উদঘাটন করতে উদগ্রীব হয়ে উঠল। সাবধানে পা ফেলে নূরের পিছু নিলো!

ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নূর সকালের কড়া রোদ উপেক্ষা করার জন্য হাত দ্বারা কপাল ঢাকল। ম্যাচম্যাচে শরীরে আলসেমি কাটানোর জন্য হাত- পা ঝাকালো। ফোনে লাইনে থাকা মিস নায়লাকে উদ্দেশ্য করে গুরুগম্ভীর গলায় বলল,,

“আচ্ছা আপু? আপনি হঠাৎ আমার সাথে মিট করতে চাইছেন কেন?”

“আহা নূর। আপু কেন? আমি তো তোমার তিন বছরের-ই সিনিয়র হই তাইনা? এ আবার বড়ো কী ব্যাপার হলো বলো? তুমি বরং আমাকে নাম ধরেই ডাকতে পারো। আমি মাইন্ড করবনা। উল্টে খুশি হব!”

বিব্রতবোধ করল নূর। সামনের চুলগুলো টেনে কর্কশ গলায় বলল,,

“আপু আপনি হয়তো আমার থেকে একটু বেশিই এক্সপেক্ট করে ফেলছেন! যা সত্যিই বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে আমার কাছে।”

“মানে?”

“মানেটা খুব সহজ আপু। আমি আপনাকে জাস্ট সিনিয়র আপুর চোখে-ই দেখি। কখনো অন্য কোনো নজরে দেখিনি।”

মিস নায়লা রসালো হাসল! ঠোঁট কামড়ে ফিচেল স্বরে বলল,,

“ওকে। কোনো ব্যাপার না। এবার থেকে অন্য নজরে দেখো তাহলেই হবে!”

নূর পূর্বের তুলনায় অধিক রূঢ় হয়ে উঠল! মেজাজ গরম করে চোয়াল শক্ত করল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“আপনি বুঝতে পারছেন না আপু। আমার গার্লফ্রেন্ড আছে! চাঁদ শুধু আমার কাজিন নয় আমার গার্লফ্রেন্ডও বটে! শুধু তাই নয়, অনার্স কমপ্লিটের পর আমি চাঁদকে বিয়েও করছি। ফ্যামিলিতে এই বিষয় নিয়ে কথাও হচ্ছে।”

মিস নায়লা যেন টুপ করে আকাশ থেকে পড়ল! ঘটনার আকস্মিকতায় হাতে থাকা ফোনটি তার ঢিলে হয়ে এলো। শরীরটাও কেমন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল! চোখজোড়া আতঙ্কে বড়ো হয়ে উঠল। কম্পিত স্বরে বলল,,

“কীকীকী বললে?”

“হ্যাঁ আপু। ইট’স ফ্যাক্ট। আমি সত্যিই চাঁদকে ভীষণ ভালোবাসি। ভীষণ বলতে ভীষণ। যার কোনো পরিমাপ হয়না।”

ঝট করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলো মিস নায়লা! চোখের জল ছেড়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। কপাল চাপড়ে হাউমাউ করে কেঁদে বলল,,

“কী শুনলাম এসব আমি হ্যাঁ? নূর কি তবে সত্যিই অন্য কাউকে ভালোবাসে?”

কান থেকে ফোনটা সরিয়ে নূর হাতে রাখল। স্বস্তির শ্বাস ফেলে সামনের পেছনের চুলগুলো টানল। বড়ো কোনো এক বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছে এমন একটা ভাব নিলো। স্থবির গলায় বলল,,

“উফফ বাবা। জোর বাঁচা বাঁচা গেল! চাঁদ দেখতে পেলে আজ খবর ছিল।”

চুল টেনে নূর পিছনে ফিরতেই হঠাৎ রণরঙ্গিণী রূপে দাঁড়িয়ে থাকা চাঁদের মুখোমুখি হয়ে গেল! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাঁদ ভ্রু উঁচিয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে রইল। নূর বিষম খেল। অস্থির দৃষ্টি ফেলে চাঁদের দিকে তাকালো। মাথার পেছনে চাপড় মেরে আনমনে বলল,,

“আইলা! যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়?”

নূরের ধরাশায়ী ভাবমূর্তি দেখে চাঁদ মনে মনে ভীষণ হাসল! বাঘকে বিড়াল হতে দেখলে কার-ই বা ভালো না লাগে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিলো চাঁদ। নূরকে ভয় দেখানোর জন্য পুনরায় মুখমণ্ডলে রুদ্রময়ী ছাপ ফুটিয়ে তুলল। রাশভারী গলায় শুধালো,,

“কার সাথে ইন্টু পিন্টু করছিলেন হ্যাঁ?”

নূর নির্বোধ ভাব নিলো। অবুঝ স্বরে বলল,,

“হোয়াট? ইন্টু পিন্টু আবার কী?”

“বুঝেননা না? কলা খান?”

“ছ্যাঁ! কলা আমি খাইনা!”

“ঢঙ দেখো! ফোনে মিস নায়লা ছিল না?”

নূর মাথা চুলকালো। অপরাধীর ন্যায় মাথা নুইয়ে নিলো। ভীরু গলায় বলল,,

“হুম!”

“প্রেম করছিলেন তার সাথে?”

নূর জিভ কাটল। সরল দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। হতবিহ্বল গলায় বলল,,

“আস্তাগফিরুল্লাহ্! পাশে এত চান্দের মত সুন্দরী প্রেমিকা থাকতে আমি আবার কার সাথে প্রেম করব হ্যাঁ?”

বেশ ভাব নিয়ে চাঁদ মুখ বাঁকালো। বুকে হাত গুজে নূরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ব্যগ্র হেসে নূর কোনো দিকে কালক্ষেপণ না করেই চাঁদকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল! আদুরে হয়ে চাঁদের চোখে-মুখে অজস্র চুমু খেয়ে বলল,,

“ভালোবাসি আমার চাঁদপাখিটাকে।”

,
,

রান্নাঘরের টুকটাক কাজকর্ম সেরে সোহানী গরম গরম দু’কাপ কফি হাতে নিয়ে তাদের শোবার ঘরে প্রবেশ করল। নীড়কে নিয়ে একসাথে কফি খাবে বলে মনোস্থির করল। দরজা খুলে সোহানী যেই না বিছানায় পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করল অমনি দেখতে পেল নীড় উবুড় হয়ে পূর্বের ন্যায় বিছানায় শুয়ে আছে! ঘুমুচ্ছে নাকি সজাগ আছে ঐপাশ থেকে কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা। তবে যতদূর বুঝা যাচ্ছে নীড় হয়তো এখনো ঘুমুচ্ছে। কপাল কুঁচকে সোহানী কফির মগটা নিঃশব্দে ডেস্কের উপর রাখল। রাগে দাঁতে দাঁত চাপল। সকাল দশটা বাজতে চলল অথচ জনাবের এখনো ঘুম ভাঙলো না?

খোঁপায় বাঁধা ভেজা চুলগুলো সোহানী পাখার বাতাসে মেলে দিলো। অমনি চুলের ঘ্রাণে গোটা ঘর আমোদ হয়ে গেল। ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকা নীড়ের নাকে এই মাতাল করা চুলের সুঘ্রাণ প্রবেশ করতেই নীড় ফট করে আঁখিযুগল খুলে নিলো! সোহানীর উপস্থিতি তার আশেপাশে টের পেল। উবুড় হওয়া অবস্থা থেকে সে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। নেশাক্ত দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল সোহানী বেশ মনোযোগের সাথে চুলগুলো সামনে এনে ঝাড়ছে। পিঠের উন্মুক্ত ধবধবে সাদা অংশটা নীড়ের দু’চোখে স্পষ্ট। রাগ বেশিক্ষণ পুষে রাখতে পারলনা নীড়! সোহানীর রূপে কাত হয়ে গেল। বিনা সময় ব্যয়ে নীড় সোহানীর শাড়ির আঁচলে হেঁচকা টান দিলো! সোহানীকে সরাসরি তার উন্মুক্ত বুকের উপর ফেলল! অমনি নীড়ের চোখে-মুখে সোহানীর দীর্ঘ, ঘন এবং মসৃণ চুল গুলো এসে লেপ্টে পড়ল। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় নীড় চুলের মিষ্টি ঘ্রাণটা চোখ বুজে নিতে লাগল। শ্বাসে প্রশ্বাসে তার মাদকতা ছড়াতে লাগল। সোহানীকে তার শরীরের সাথে আরও প্রখরভাবে আঁকড়ে ধরল। অনুভূতিহীন হয়ে পড়ল সোহানী। নীড়ের ভালোবাসায় মাখামাখি হতে লাগল। না চাইতেও অস্ফুটে সুরে বলল,,

“উঠুন। কফি খাবেন।”

সোহানীর কানের লতিতে নীড় উষ্ণ ঠোঁট ছুঁয়ালো। ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,,

“আগে পানিশমেন্ট ভোগ করো। এরপর কফি।”

সোহানীকে প্রতিউত্তর করার সুযোগ দিলোনা নীড়। তাকে নিজের করে পেতে কেমন মরিয়া হয়ে উঠল! সোহানীও যেন বিশেষ বাঁধা দিতে পারলনা নীড়কে! হাসিমুখে তার পাগলাটে ভালোবাসায় গাঁ ভাসাতে লাগল।

,
,

তাশফিয়া এবং আয়মন পাশাপাশি একই বিছানার উপর বসে আছে! তাশফিয়া ব্যাপক লজ্জায় এবং জড়তায় ভুগছে। অন্যদিকে আয়মন তাশফিয়াকে চোখে চোখে হারাচ্ছে! এই বিপত্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাশফিয়া শেষবারের মত রুদ্ধশ্বাস ফেলে জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়াতেই আয়মন পেছন থেকে তাশফিয়ার ডান হাতটি টেনে ধরল! উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই কই যাও?”

সঙ্গে সঙ্গেই তাশফিয়া কেঁপে উঠল! তপ্ত শ্বাস ফেলে কম্পিত গলায় বলল,,

“বাবাইরে।”

“বাইরে কেন?”

“চাঁদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

“চাঁদ কারো জন্য অপেক্ষা করছেনা। বরং তুমিই আমাকে ইগনোর করছ!”

“কককই? না তো!”

“তাহলে জায়গায় বসো।”

হেঁচকা টানে তাশফিয়াকে জায়গায় বসিয়ে দিলো আয়মন। নিবিষ্ট দৃষ্টিতে মাথা নুইয়ে বসে থাকা তাশফিয়ার দিকে তাকালো। ঘোর জড়ানো গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“ভালোবাসো না আমাকে?”

তাশফিয়া নাজুক দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকালো। বেশিক্ষণ দৃষ্টি মিলাতে পারলনা আয়মনের ঐ মোহভরা প্রেমেসিক্ত দু’চোখে! সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো তাশফিয়া। মাথা নাড়িয়ে বলল,,

“বাসি।”

“তাহলে এত ছটফট করো কেন আমার কাছ থেকে দূরে যেতে?”

“আপনাকে দেখলেই আমার কেমন দম বন্ধ আসে আয়মন! আপনার ছোঁয়া আমাকে অগোছালো করে তুলে। আপনার চাহনি আমাকে ভেতর থেকে মে’রে দেয়! কী করব আমি বলুন?”

আয়মন স্মিত হাসল! তাশফিয়ার করা মিষ্টি স্বীকারোক্তিতে প্রানোচ্ছ্বল হয়ে উঠল। সন্তোষ জনক দৃষ্টিতে তাশফিয়ার দিকে তাকালো। দ্বিধা দ্বন্ধ ভুলে এক ঝটকায় তাশফিয়াকে তার বুকের পাজরে আকঁড়ে ধরল। প্রবিষ্ট গলায় বলল,,

“এই বুকে একবার ভালোভাবে মিশে দেখো। আজ থেকে আর আমার কাছ থেকে পালানোর জন্য ছটফট করবেনা! বরং বারংবার ছটফট করবে আমার এই প্রেমে উত্তাল বুকের সাথে একাকার হয়ে মিশে থাকতে!”

,
,

সারারাত অঝরে কাঁদার দরুন জায়মার আঁখি পল্লব লাল বর্ণ ধারণ করেছে। চোখ দুটো কেমন ফুলকো হয়ে আছে! সুশৃঙ্খল দৃষ্টিতে সে কোথাও তাকাতে পারছেনা। দৃষ্টি কেমন ভারী হয়ে আছে। জায়মার পাশে বসে তিথী ফোনে স্ক্রলিং করছিল। হঠাৎ-ই তার দৃষ্টি পড়ল জায়মার বিবর্ণ মুখমণ্ডলে। বিশেষ করে চোখের কোটরে। সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটা হাত থেকে সাইডে রাখল তিথী। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে পাশ ফিরে জায়মার দিকে ঝুঁকে তাকালো। তৎপর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,,

“এই জায়মা তোর কী হয়েছে রে? মুখটা কেমন শুকনা শুকনা লাগছে। চোখদুটোও কেমন ফোলা ফোলা লাগছে। কী হয়েছে বল তো?”

ঘটনার আকস্মিকতায় জায়মা মুখ লুকিয়ে নিলো। কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল! উত্তেজিত হয়ে অধীর গলায় বলল,,

“শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে রে। তাই দেখতে এমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে!”

ইতোমধ্যেই চাঁদ ওয়াশরুম থেকে পুচিকে পটি করিয়ে রুম ঢুকল। অবেলায় জায়মা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকায় চাঁদের বেশ সন্দেহ হলো। সন্দিহান হয়ে সে ভ্রু কুঁচকালো। পাশে হতভম্ব হয়ে বসে থাকা তাশফিয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“এই কী হয়েছে রে? জায়মার কী শরীর খারাপ?”

#চলবে…?