#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১১
পৌষ’কে কোলে তুলে একদম বারান্দায় এসে নামালো তৌসিফ। পৌষ চমকালো। জীবনের কাছে এসে এই বয়সে অনেক বড় হারাটা ও হেরেছে। নিজের হেরে যাওয়া মানতে না পারা মেয়েটা চেয়েছিলো নিজের সবটা শেষ করতে। তৌসিফের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে কিন্তু তৌসিফ তা করে নি। সে সোজা ওকে কোলে তুলে বারান্দায় নিয়ে এসে বসিয়েছে। পৌষ মৌন রইলো। তৌসিফ তাকালো বাইরের আকাশে।
আজ চাঁদের দেখা নেই। মেঘের আড়ালে সে ঘাপটি মে’রে বসে আছে। মেঘের কানাগোনা ও আজ বেশি। এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে ওরা। তৌসিফের মনে পরলো কোন একটা সময় এই বারান্দায় রাত্রি বিলাস করতো তারা। রাতের পর রাত পা’গল করা প্রেমিকের ন্যায় তৌসিফ তাকিয়ে থাকতো এক নারীর মুখের দিকে। তার কোলে মাথা রেখে শুনতো সকল অহেতুল অযৌক্তিক কথা। সেই অযৌক্তিক কথাগুলোই তৌসিফের মন ভোলাতো। সারাদিনের খাটুনির সমাপ্তি ঘটাতো। নরম তুলতলে হাতটা নিজের হাতে ধরে বুকে রাখতো। চোখ জুড়াতে সময় যায় যায় অথচ প্রাণ জুড়াতো না।
আজও সময়টা এক। তৌসিফ এক। পাশে নারীটি ভিন্ন। এতটুকু ফারাকের কারণে আজ তৌসিফে’র মন টানলো না সেদিনের মতো তবুও কোথায় যেন সূক্ষ্ম এক আকাঙ্খা জাগলো। পৌষ’কে নিয়ে এই রাত্রি বিলাসের আকাঙ্খা।
সুদূর আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে ও তাকালো পৌষ’র দিকে। ছটফট করা পৌষ আজ শান্ত বটে। একজন চঞ্চলা প্রাণ’কে যদি থামাতে চাও তবে শুধু তার দূর্বল দিকে দুটো টোকা মা’রো সে আপনা আপনি থমকে যাবে। পৌষ’র ক্ষেত্রে তা ই হলো। প্রশ্ন যখন নিজের অস্তিত্বের উপর তখন মানুষ তো থম ধরবেই। সেখানে পৌষ অতি আবেগী একটা মেয়ে যা তৌসিফ বুঝেছে। ধীরে সুস্থে পৌষ’র পাশে বসে ও। এমনি সময় হলে মেয়েটা সরে যেতো তৌসিফ জানে। আজ না সরার কারণ টা ও তার জানা। তৌসিফ কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
— বলেছিলাম কিছু প্রশ্নের উত্তর দিব।
— নিজেকে তো দিয়ে দিলাম আপনাকে। ভোগ করুন অতঃপর মুক্ত করুন আমাকে।
“ভোগ করুন” শব্দটা শুনে তৌসিফের রুচিতে বাঁধলো। আর মুক্ত? ও করবে পৌষ’কে মুক্ত? ইহকালে এটা সম্ভব না। পৌষ’কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ধারালো কণ্ঠে বললো,
— ভোগ?
— হ্যাঁ ভোগ। আপনারা এটা বাদে আর কি পারেন?
— ভোগ করার হলে প্রথম রাতেই তা করতাম। হাত-পা বাঁধা ছিলো না আমার আর না ই আমার পুরুষত্বের কমতি আছে।
— তাহলে বসে আছেন কেন? যা করার করুন। আপনাদের নোংরামি থেকে আমাকে মুক্ত করুন৷
এক প্রকার চিৎকার করে উঠে বললো পৌষ। দাঁড়িয়ে গিয়ে বুক থেকে আঁচলটা সরিয়ে বললো,
— আহবান করছি আপনাকে। আমাকে নোংরা করুন৷ মুক্তি দিন৷ আপনার মোহরানা লাগবে না আমার। আপনার ঘরেই রাখা আছে। দয়া করুন আমার প্রতি।
তৌসিফ উঠে এলো। হাত বাড়ালো পৌষ’র দিকে। আঁচলটা টেনে ওর কাঁধে দিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
— তোমার আহবান কবুল করলাম পৌষরাত।
একটু থেমে পৌষ’কে নিজের পাশে বসিয়ে বললো,
— তবে কথা দিচ্ছি কোনদিন নোংরা করব না। ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখব। আমার ভালোবাসা পবিত্র হবে।
পৌষ ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো পুণরায়। ধারালো কণ্ঠে বললো,
— হা। পবিত্র? তাও আপনারা? জঘন্য থেকে ও জঘন্য আপনারা। কি ভেবেছেন আদি’র ফোনালাপ শুনে আমি ওইসব হাবিজাবি বিশ্বাস করব? এই আমাকে বোকা মনে হয়? মনে হয় আমি বোকা৷ পানিতে যদি ও আমার ছায়া দেখতে পারে তবে আমি কেন আপনার ছায়া দেখতে পারব না? নিজের গাড়ি আগে পাঠিয়ে অন্য গাড়িতে আপনি গিয়েছেন। ভেবেছেন আদি’কে দিয়ে এসব বলিয়ে আমাকে দূরে সরাবেন ওর থেকে? এই মিথ্যা’র কোন প্রায়োজন ছিলো না। জারজ হতে পারি তবে দুশ্চরিত্রা না।
এতকথা বলে দম ফুড়িয়ে এলো পৌষ’র। তৌসিফ পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে একটা ভিডিও প্লেয়ার অন করলো। যাতে কিছুটা নেশার ঘোরে আদিত্য নিজ মুখে স্বীকার করছে পৌষ’কে বাজি ধরে কথা বলা শুরু করেছিলো ও। কিছু ম্যাসেজ দেখায় তৌসিফ যা দেখে গা শিউরে উঠে পৌষ’র। পৌষ’কে বেড পর্যন্ত নেয়া ই ছিলো আদিত্য সহ ওর বন্ধুদের একমাত্র লক্ষণ। অবিশ্বাসের কিছু দেখলো না পৌষ। এই ভিডিও না হলেও দুই মাস আগের। কোন এক জাহাজের মধ্যে নেশায় বুদ হওয়া আদিত্য।
তৌসিফ ফোনটা সরিয়ে বললো,
— মাত্র এক ঘন্টা পৌষরাত। এক ঘন্টা লেগেছে এগুলো কালেক্ট করতে।
পৌষ’র মুখে কথা রইলো না। তৌসিফ এখানে অর্ধেক সত্যি বললো। আদিত্য দুই মাস আগ পর্যন্ত ও পৌষ’কে খারাপ নজরে দেখলেও ধীরে ধীরে সে অনেকটাই দূর্বল ছিলো পৌষ’র প্রতি। বাবা-মায়ের ছেড়ে দেয়া এক গরু হলো আদিত্য যে যেখানে ঘাষ দেখে সেখানেই মুখ দেয়। আদিত্য’র গার্লফ্রেন্ড সংখ্যা অসংখ্য। হয়তো এতসবে সে পৌষ’কে পছন্দ করা শুরু করেছিলো যা প্রকাশ হওয়ার আগেই ধ্বংস হয়ে গেলো।
তৌসিফ পৌষ’র হাতটা ধরলো শক্ত করে। অতি ঠান্ডা গলায় বললো,
— বিয়ের আগে আমি জানতাম না তুমি কোনভাবে আদিত্য’র সাথে জড়িত তাহলে আজীবন একা থাকলেও তোমাকে বিয়ে করতাম না। আর রইলো মুক্তি? তা ইহকালে হচ্ছে না পৌষরাত। বিয়ে যেহেতু করেছি ছাড়ব না। ভাবছো তোমাকেই কেন বিয়ে করলাম? এর উত্তর অনেক। তুমি নিজেকে জারজ বলো আর যা ই বলো না কেন তুমি এই তালুকদার বাড়ীর সাথে জড়িত। আমার সূত্রে না বরং ভিন্ন ভাবে। শুধু জেনে রাখো তোমাকে নদীতে যাতে না ভাসতে হয় তাই তোমাকে এখানে আনা হয়েছে। বড় ভাই না করেছিলো। মেঝ ভাই ও ততটা রাজি ছিলো না। কিন্তু জানো ছোট ছিলাম বলে বাবা আমাকে সব বলতো। কারণ জানি না৷ আমার আব্বার কথা রাখতেই তুমি এখানে।
তৌসিফের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পৌষ। ওর গলাটা এবার ভাঙা শুনালো,
— দয়া করে বলবেন, আমি কি কারো পাপ নাকি কারো করা পূর্ণ্য?
— নিজের মা’কে দেখেছো?
পৌষ মাথা নাড়ে। তৌসিফ পুণরায় জিজ্ঞেস করে,
— দেখবে?
হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়তেই তৌসিফ পকেট থেকে একটা সাদাকালো ছবি দেখালো। চিকন গড়নের দুই বেণী করা কোন এক যুবতীর ছবি। অসম্ভব সুন্দর। তবে পৌষ’র চেহারা ওর বাবা’র মতো। ও দেখেছে বাবা’র ছবি।
টলমলে চোখে দেখতেই তৌসিফ বললো,
— তোমার চোখ দুটো তোমার মায়ের মতো।
— হুউ।
— আরেকটা রিজন বলব তোমাকে বিয়ে করার?
পৌষ ওর মায়ের ছবি দেখতে দেখতে ই বললো,
— হু।
— প্রথম বিয়ে প্রেম করে করেছিলাম। বউ আমাকে ঘোল খায়িয়ে পালিয়ে গেলো। আমার প্রেমের সুধা তার পোষায় নি। তাই এবার আব্বা’র করা পছন্দে বিয়ে করলাম। দেখি আমার প্রেমের সুধা তোমায় পোষায় কি না।
— আপনার আব্বা মা’রা গিয়েছে বহু বছর আগে।
— হ্যাঁ। তার আগেই তোমাকে বিয়ে করার কথা বলেছিলো আমায়। যেহেতু আমিই ছোট ছিলাম ছেলেদের মাঝে।
— ফাইজলামি করেন? আমি তখন ক্লাস টুতে পড়তাম। হেমু ভাই বলেছিলো।
— বয়সে তুমি আমার অনেক ছোট পৌষরাত। তাই চাইনি তোমাকে বিয়ে করতে তবে ঐ যে বলে বুড়ো বয়সে ভীমড়ি ওটাই বোধহয় হলো।
পৌষ উড়ে দাঁড়িয়ে রুমে যেতে যেতে বললো,
— অবশ্য ই। কেন নয়? নিজের চরিত্রহীন ছেলের জন্য জারজ ধরে আনতে চাইছিলেন তিনি। চমৎকার ব্যাপার।
___________________
হক বাড়ীতে এক প্রকার কলহ সৃষ্টি হয়ে গেলো। টেবিলে থাকা পানির জগটা ভেঙে চুরমার হয়ে ফ্লোর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হেমন্ত’র হাত থেকে টুপটাপ ফোঁটায় ফোঁটায় র’ক্ত পরছে। পাশে দাঁড়িয়ে সেটা দেখে পিহা হিচকি তুলে তুলে কাঁদছে। চাইলেও হেমন্তের কাছে গিয়ে বলতে পারছে না হাতটা বেন্ডেজ করাতে। এই মুহুর্তে ওর ধারে কাছে যাওয়াটা ও সাহসের ব্যাপার স্যাপার। ইনি,মিনি গলা ফাটিয়ে কাঁদছিলো বিধায় ওদের মা দুটোকে ধরে রুমে নিয়ে গিয়েছে। এখনও ওখান থেকে সমান তালে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। রাগে ফুঁসতে থাকা হেমন্ত বাবা’র দিকে তাকিয়ে গমগমে গলায় বললো,
— এবার খুশি?
উনি দ্বিগুণ ক্ষেপে গিয়ে বললেন,
— বাড়াবাড়ি করছিস হেমু।
— একশত বার করব। হাজার বার করব। বোন ও আমার। সত্যিটা ওকে আগে বললে ও যখন ভাঙতো তখন সেই ভাঙা পৌষ সামলাতে আমরা থাকতাম ওর কাছে অথচ ওকে এমন সময় জানানো হলো যে যখন ও নিজেই অর্ধেক ভাঙা ছিলো। কেমন চাচা আপনি বাবা? আজ নিজের মেয়ে হলে পারতেন? এই আপনি না ওকে বুকে বুকে রাখতেন? আপনার এই বুক কাঁপলো না? কেমন পাষান আপনি বাবা?
বাবা’র থেকে দ্বিগুণ চিৎকার করে বলে উঠলো হেমন্ত। ওখানে না দাঁড়িয়ে হনহন করে ছাদে চলে গেলো। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে সুদূরপ্রসারী অতলে হারিয়ে গেলো হেমন্ত। কাটা হাতে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে কোনমতে ঠোঁটে গুজে এদিক ওদিক পকেট হাতালো। লাইটার টা নেই। বিরক্তিতে “চ্যাহ” শব্দ করে র’ক্ত মাথা হাতটা ঝাড়া দিতেই দেখলো গুটি গুটি পায়ে অন্ধকার ঠেলে কেউ এদিকে আসছে। আকাড় তত বড় না। ছোট্ট খাট্টো এক দেহ। ধীরে ধীরে চোখের সামনে আসতেই হেমন্ত’র হাতে ধরে ধীরে ম্যাচ দিয়ে পিহা বললো,
— লাইটার পাই নি হেমু ভাই।
হেমন্ত ম্যাচ নিলেও সিগারেট ধরালো না। শুধু বললো,
— কোন বোন ভাইকে সিগারেট খেতে ম্যাচ এনে দেয়? পৌষ’র আত্না তোর মাঝে এলো কিভাবে?
পিহা কথা বললো না এই বিষয়ে। হেমন্ত’র হাতটা ধরে বললো,
— বেন্ডেজ করে দেই হেমু ভাই?
— দে।
অদক্ষ হাতে সেভলন দিয়ে মুছে গজ পেঁচিয়ে দিলো পিহা। হেমন্ত সেটার দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে বললো,
— তোর পৌষ আপা থেকে অন্তত ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো শিখতি। মানুষ ভালোটা শিখে অথচ তুই শিখলি খারাপ টা।
— জানেন মা বলেছে পৌষ আপা নাকি আর আসবে না।
— সত্যি বলেছে।
— জৈষ্ঠ্য আর চৈত্র ভাই রাতে এখন বাসায় আলুর দম আনে না। বলেছে পৌষ আপা না আসলে আর কোন দিন খাবে না ওগুলো।
— তাহলে খাওয়া ভুলে যা।
— ইনি,মিনি দুধ খেতে চায় না হেমু ভাই।
— এটা ওদের মা দেখবে।
— হেমু ভাই ও আগের মতো আমাদের আদর করে না।
— এটা তাকে গিয়ে বল।
— কোথায় সে?
হেমন্তের হঠাৎ ই টনক নড়লো। আসলেই কি তাই? ও তো একদিন ওদের কাছে টেনেছিলো পৌষ যাওয়ার পর। আর একদিন ও ভাই বোন গুলোকে বুকে টানা হয় নি। আচমকাই যেন ওর বুকে চাপ লাগলো। পিহা’র দিকে তাকিয়ে বললো,
— তোর নিজের জন্য কোন অভিযোগ নেই?
মাথা নাড়ে পিহা। বলে,
— আমাকে পৌষ আপা এনে দিলেই হবে। আমি শুনেছি পৌষ আপার জামাই খারাপ লোক।
— কে বলেছে তোকে?
— স্কুলে গেলাম তখন রজনীর মা বলেছে। সাথে এটাও বলেছে আমি যাতে কখনো ওনার সামনে না যাই।
ধ্বক করে উঠলো হেমন্তের বুকটা। ওর ছোট ভাই-বোন গুলোকে ওর নিজের ই বুঝানো উচিত ছিলো।
আজ বাবা’র সাথে কথা কাটাকাটি ও হয়েছে ওটা নিয়ে। তৌসিফ মানুষ আদৌ কতটা ভালো বা খারাপ তা কেউ জানে না?
___________________
সকাল সকাল মিনু’র চিল্লা চিল্লিতে ঘুম ভাঙে পৌষ’র। পাশে তাকিয়ে দেখলো তৌসিফ নেই। গতরাতে পৌষ এই রুমে ই ঘুমিয়েছিলো। বিরক্ত হয়ে উঠে মাথা ধরে রাগে দাঁত চেপে বললো,
— এই মিনুর বাচ্চাকে আজ এমন শিক্ষা দিব। সকাল সকাল ওর চিল্লাচিল্লি বের করব আজ।
পৌষ বিছানা ছাড়বে তার আগেই তৌসিফ রুমে ঢুকলো। পৌষ’কে বিছানায় থাকতে দেখে বললো,
— গুড মর্নিং।
পৌষ কিছুটা খেঁকিয়ে উঠলো,
— কাজের লোক সকাল সকাল এভাবে চিল্লা চিল্লি করে ঘুম ভাঙাবে আর মনিব এসে বলবে গুড মর্নিং। ওয়াও। নাইস।
তৌসিফ গায়ে থাকা জিমের জ্যাকেটটা খুলতে খুলতে বললো,
— কে চিল্লিয়েছে?
— আপনার মিনু।
— ওহ। আচ্ছা তুমি নাকি ওকে কাল মে’রেছো?
কথাটা বলতে দেড়ী দুই লাফে বিছানা ছাড়তে পৌষ’র দেড়ী হলো না। তৌসিফের সামনে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে বললো,
— বাহ্ বাহ্ আপনার কান ভরে দিয়েছে?
— মানে?
— ঐ ছেড়ী কেন বিচার দিবে আমার নামে? কে হয় ও? একশত বার মা’রব। থাপ্পড়ে ওর চাপা ভেঙে দিব। আমাকে পার্সোনাল কথা জিজ্ঞেস করে। আর একবার যদি ও আমাকে খোঁচায় ওর মাথার ঐ লাল, নীল চুল টেনে ছিড়ে শাক রেঁধে আপনাকে খাওয়াব আমি। নিশ্চিত আপনার বুকে পরে পরে বিচার দিয়েছে। শালী ******
রাগে কাঁপতে কাঁপতে কথাগুলো বললো পৌষ। তৌসিফ হতভম্ব ভাব কাটাতে পারছে না। মিনু সকালে কেঁদে কেটে ওকে বিচার দেয়ার পর মিনুকে হাতে দুই হাজার দিয়ে তৌসিফ চলে গিয়েছিলো। ও তো এমনিতেই পৌষ জিজ্ঞেস করলো তাতেই এই মেয়ে রেগে বোম। শেষে কি গালিটাই না দিলো।
তৌসিফের ভাবনার মাঝেই মিনু’র চুল ছিঁড়তে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো পৌষ। তৌসিফ ওকে ধরতে ধরতেই পৌষ হাতছাড়া। যেই না মিনু’কে ধরবে ওমনিই দরজা দিয়ে সোহাকে ঢুকতে দেখে মিনু চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে ডাকলো,
— আপা। আপা। আমার আপা এসেছে। মামা দেখে যান আপা এসেছে।
সোহা ভেতরে ঢুকে ই মিনু’কে জড়িয়ে ধরে। পৌষ’র দিকে তাকিয়ে বলে,
— এই মেয়েটা কে? আর এমন বেহাল দশা কেন এর?
পৌষ খিটমিটিয়ে উঠলো। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো আসলেই বড্ড এলোমেলো হয়ে আছে ও। রাতে ঘুমালে দিন দুনিয়ায় হুশ ওর থাকে না। মাঝে মধ্যে তো সকালে নিজেকে আয়নায় দেখে গুলিস্তানের ফুটফাটে বসা গঞ্জাখোড় মনে হয়।
#চলবে…
রোদ হিসেবে ব্যাস্ত তখনই পুরুষটা জিজ্ঞেস করলো,
— বলো? কোন দরকার?
–হ্যাঁ।
— কি দরকার?
— বিয়ে করব।
খুকখুক করে কেঁশে উঠলো বুড়োটা। পুণরায় জিজ্ঞেস করলো,
— কাকে?
— আপনাকে?
এবার রীতিমত ঘাম ছুঁটে গেলো তার। রোদ টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা তাকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
— আরে আরে আঙ্কেল ঠিক আছেন?
পরপরই জিহ্বা কাটলো। আঙ্কেল ডাকা যাবে না। তাই বলে উঠলো,
— আরে ভাইয়া পানি খান আপনি। নিশ্চিত রেডি হওয়ার সময় পান নি।
লোকটা পানি খেতে কিছুটা শান্ত হলো। নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
— দেখ মা আমার বউ, বাচ্চা আছে। তুমি কি বলছো এসব?
“বউ” আছে শুনে তেঁতে উঠলো রোদ। বুড়ো বউ রেখে তাহলে আবার বিয়ে করতে চাইছিলো? হায় আল্লাহ! রোদ ফেঁসে গেলো না তো? বিয়ের নাম করে পরকীয়া করবে না এই বুড়ো? রোদ তো ইয়াজের বুদ্ধিতে মজা করে নিজের পকেট ভারী করতে এসেছিলো এখন না ফাঁসলেই হলো।
কিছুটা তেঁতে উঠা গলায় রোদ বললো,
— আগে তো বলেন নি বউ আছে? শুধু বাচ্চার কথা বলেছেন কেন?
— বউ ছাড়া বাচ্চা আসবে কোথা থেকে?
#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১২
গটগট পায়ে তারাতাড়ি করে রুমে ঢুকতে গিয়ে তৌসিফের বুকের সাথে সজোরে ধাক্কা খেলো পৌষ। একদম নাক বরাবর গিয়ে লেগেছে তৌসিফে’র বুকে। ধাক্কাটাও কম জোরে লাগে নি। একদম যাহাকে বলে “জোরকা ঝাটকা হ্যা জোরোসে লাগা”। পৌষ পরতে পরতে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে গেলো। তৌসিফ অবশ্য ধরা বা ছুঁয়া’র সুযোগ পায় নি। সটান হয়ে একদম সিনা টান টান করে দাঁড়ালো পৌষ। গলায় একবার খক করে শব্দ করে পরিষ্কার করলো। ঘুম ভাঙা মুখ আর অসংলগ্ন পরিস্থিতি। সব মিলিয়ে নাস্তানাবুদ পৌষ অথচ রাগীনির রাগ নাকের ডগায়। নাকের পাটা ফুলিয়ে অগ্রসর হলো তৌসিফে’র দিকে। সকাল সকাল উড়নচন্ডী বউয়ের এহেন হাবভাব দেখে তৌসিফ কিছুটা বিব্রত। ভাবা যায় তৌসিফ তালুকদার বিব্রত? পৌষ দাঁত খিটমিট করলো ঠিক টক খাওয়া দাঁত যেমন লাগে তেমন ভাবে। তৌসিফের একদম দুই ইঞ্জি দূরে থেকে ঘাড়টা উঁচু করে চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করে,
— কিহ? কই যাওয়া হচ্ছে সক্কাল সক্কাল?
তৌসিফ যেন এই প্রথম অধিকার বোধ দেখতে পেলো তবে ও জানে পৌষ রাগে এসব জিজ্ঞেস করছে। সকালে মিনু’র ব্যাপার টা নিয়ে এখনও খচমচ করছে ও। তৌসিফ বেশ শান্ত স্বরে বললো,
— সোহা এসেছে….
বাকিটা বলার আগেই পেছনে সোহা হাজির হলো। হাসি মুখে “কেমন আছেন” জিজ্ঞেস করে রুমে ঢুকতে নিতেই পৌষ দরজা অর্ধেক ভিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মেকি হেসে বললো,
— সরি, আসলে আমাদের রুমে প্রাইভেসির ব্যাপার স্যাপার আছে। আপনি যেতে পারেন এখন। সকাল সকাল আমি রোম্যান্টিক মুডে আছে। বাই।
বলেই ধারাম করে দরজা লাগিয়ে দিলো। ঘটনার আকষ্মিকতায় চমকাল দুজন। সোহা’র মনে হলো ওর মুখটাতে কেউ বুঝি ঝামা ঘঁষে দিলো। এদিকে তৌসিফ হতভম্ব ভাব ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পৌষ’র মতো একটা দূরন্দার মেয়ে ঠিক কতটা রাগ থেকে এসব কথা বলে? অবশ্য বলাটাও স্বাভাবিক। হঠাৎ ই তৌসিফে’র মাথায় দুষ্টামি চাপলো। পায়ে থাকা সেন্ডেলে চপ চপ আওয়াজ তুলে সামনে যেতে নিলেই তৌসিফ ওর হাতটা টেনে ধরলো। ছোঁ মে’রে হাত ছাড়িয়ে নিলো পৌষ। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
— চুহ! চুহ! কষ্ট হচ্ছে সোহা ডার্লিং’কে আসতে দিলাম না দেখে?
— হোয়াট রাবিশ পৌষরাত?
— এএই খবরদার আমাকে রাবিশ বলবেন না। ঐ ছেড়ী রাবিশ! ওর বোন রাবিশ!
— পৌষরাত আস্তে কথা বলো। আমার সাথে একদম উঁচু গলা চলবে না। না জেনে না বুঝে কি শুরু করলে সকাল সকাল?
বেশ ঠান্ডা গলায় ই বললো তৌসিফ। একটু দমে গেলেও নিভলো না পৌষ। ঠিক রবি সিমের মতো জ্বলে উঠলো আপন শক্তিতে। পৌষ’র হঠাৎ মনে হলো গত মাসে তার ফোন থেকে গ্রামীন সিম তেইশ টাকা কেটে নিয়েছে। কারণ নেই কোন। মানেই হুদাই। কল সেন্টারে কল দিয়ে উড়াধুড়া ঝেরেছে পৌষরাত। যদিও এতে করে কোন লাভ হয় নি তবে কথা হলো মনের শান্তি বড় শান্তি।
নিজের গভীর চিন্তায় ভাটা পরলো ওর যখন তৌসিফ বললো,
— ফ্রেশ হয়ে এসো। নাস্তা করবে। বেরুতে হবে একটু পর।
পৌষ আড় চোখে তাকিয়ে গটগট পায়ে চলে গেল। বাথরুমে ঢুকেই কিছুটা জোরেই বললো,
— আমি বুঝি না বড় লোক হয়েও মানুষের নজর কেন ছোট হয়। হলুদ বাত্তি কেন লাগাতে হবে? সাদা লাইটের কি আকাল পরলো?
তৌসিফ শুনেও কিছু বললো না। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বের হলো দরজা খুলে। না জানি কি অপেক্ষা করছে সামনে যদিও ততটা পরোয়া তৌসিফ করে না। ফোন হাতে নিয়ে রুম ছাড়তেই দেখলো সোফায় সোহা মাথা নিচু করে বসে আছে তার পাশে বসেই এটা ওটা বলছে মিনু।
— আপা মন খারাপ করো না। তাকাও না আপা। কথা বলো। আচ্ছা রুমে চলো। কিছু খাবে? নিয়ে আসি?
সোহা উত্তর করলো না। তৌসিফ টেবিল থেকে আপেল নিয়ে তাতে কামড় বসালো। ওখানে থেকে একটু সামনে এসেই জিজ্ঞেস করলো,
— কেমন কাটলো ছুটি?
ব্যাস। তৌসিফে’র গলা শুনেই মাথা তুললো সোহা। টলমলে চোখে তাকালো ওর দিকে। তৌসিফের হাবভাব একদম স্বাভাবিক। পৌষ একটু আগে যে সোহা’কে সাবান ছাড়া ধুঁয়ে দিলো তা যেন তৌসিফ দেখতেই পায় নি। সোহা কান্না আটকে কোনমতে বললো,
— ভালো।
বলতে বলতে কেঁদে ফেললো মেয়েটা। মিনু আপাকে জড়িয়ে ধরলো। তৌসিফ উঠে যেতে যেতে বললো,
— ও ছোট মানুষ। এতসব বুঝে না। ভুলে যাও।
ফোনে কল আসতেই তৌসিফ ড্রয়িং রুম সংলগ্ন বড় বারান্দায় গেলো। সকাল সকাল আজ মিষ্টি রোদ উঠেছে।
.
মুখটা নরম তুলতুলে টাওয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে বের হলো পৌষ। একই টাওয়াল দিয়ে হাত মুছে এক পা সোফায় তুলে মুছে একই ভাবে আরেক পা মুছলো। মুছামুছি শেষ হতেই ঢিল মে’রে ছুঁড়ে মা’রলো সোফায়। যেই না ঘুরে দাঁড়ালো ওমনিই তিনশত ষাট ডিগ্রী এঙ্গেলে ওর মাথা ঘুরে গেলো। পৌষ’র মনে হলো হিন্দি সিনেমার মিউজিক বাজছে ওর কানে, “ধুমতানা না না না”।
সোহা ওদের বেড গোছাচ্ছ। এই মেয়ে এতটা বেহায়া কিভাবে হলো? পরক্ষণেই ভাবলো যেই মেয়ে টাকার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে সেই মেয়ে বেহায়া নাহলে আর কে হবে? তৌসিফে’র মতো চরিত্র ঠিক না থাকা পুরুষের জন্য একদম উত্তম হলো এই কাজের মেয়ে।
পৌষ শুনেছে তৌসিফ যেখানেই যায় এই মেয়েকে সাথে করে নিয়ে যায়। সেবার নাকি এই কাজের মেয়ে নিয়ে ও ইন্ডিয়া ঘুরে এসেছে। ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠলো পৌষ’র। কোন নরকে এসে পরলো ও?
নিজের সাথে হেরে যাওয়া মানুষ গুলো বিভিন্ন প্রকৃতির হয়। এরমধ্যে পৌষ হলো চঞ্চল প্রকৃতির। অতিরিক্ত কথা, চঞ্চলতায় নিজে ব্যাস্ত রাখে সবটা ভুলে থাকতে অথচ প্রতিটা জিনিস ওকে ভেতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।
সোফায় ফেলা টাওয়ালটা হাতে তুলে বিছানায় একদম সোহা’র হাতে ছুঁড়ে মা’রে ও। সোহা চমকে তাকাতেই পৌষ দাঁত বের করে হেসে বলে,
— আমাদের বেড গোছানোর প্রয়োজন নেই আপনার। অন্য কাজগুলো করবেন তাহলেই হলো। টাওয়ালটা ধুঁতে দিন। আর হ্যাঁ, বাথরুম রোজ ক্লিন করা হয় এটা। আজ নাহয় আপনি করে ফেলুন কাজ যেহেতু করবেনই।
অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেলো সোহা’র। শ্যামলা চেহারায় সেটা স্পষ্ট। পৌষ পরখ করলো। নাহ্। কোন দিক দিয়ে যায় না৷ এই মেয়ের ফিনফিনে এক শরীর, একদম কাট কাট একটা মুখ। কোথায় রুপ? কোথায় লাবণ্য? পৌষ’র বুঝে আসলো না তৌসিফ নষ্টামি তো চাইলেই রুপবর্তী কারো সাথে করতে পারতো কিন্তু না ও করলো এত অতি সাধারণ চাসা মেয়ের সাথে। এর কারণ কি?
অতশত আর ভাবলো না পৌষ। সোহা তখনও ঠাই দাঁড়িয়ে। পৌষ এবার জোরেই বললো,
— কি হলো? যান এখন।
এক প্রকার দৌড়ে বেরিয়ে এলো সোহা। তৌসিফ ফোনে কথা বলছিলো কিন্তু সোহা গিয়ে দাঁড়ালো ঠিক ওর সামনে। টলমলে চোখ করে তাকিয়ে বললো মাত্র ওকে করা অপমানের কথা। আশ্চর্যের বিষয় তৌসিফ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শুধু বললো,
— ওকে ওর মতো থাকতে দাও।
বলেই চলে গেলো। সোহা হা করে তাকিয়ে রইলো। ও কি কিছু করেছে ঐ মেয়ে’কে? উল্টো কথা কেন বললো তৌসিফ? রাগে গা রি রি করে উঠলো ওর। চোখ দিয়েই যেন ভস্ম করে দিবে পৌষ’কে।
.
তৌসিফ রুমে ঢুকেই দেখলো এলোমেলো রুম। পৌষ মাথা আঁচড়ে হিজাব বাঁধছে। তৌসিফ ফোনটা ড্রেসিং টেবিলে রেখেই বললো,
— অন্য কাউকে ডাকতে রুম গোছাতে।
— আপনার হাত নেই?
— মানে?
— বিছানায় দেখুন।
তৌসিফ দেখলো তবে বুঝলো না। পৌষ হিজাবের শেষ পিনটা লাগাতে লাগাতে বললো,
— আমার সাইড আমি গুছিয়ে রেখেছি। আপনারটা আপনি গোছান।
তৌসিফ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,
— কিহ্?
— কি না বলুন জ্বি।
— এত টাকা দিয়ে কাজের লোক রেখেছি কেন?
— আমি কি জানি? হয়তো খায়েশ মিটাতে।
তৌসিফ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। পৌষ একটু জোরেই বললো,
— এই রুমে যাতে কোন কাজের মেয়ে না আসে আমার শোয়া বোড গোছাতে। বেশি প্রয়োজন হলে নিজের রুমে ডেকে নিক….
তৌসিফ আচমকা হাতের তালু দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলো। চোখ রাঙিয়ে বললো,
— চুপ থাকো একটু। আমি গুছাচ্ছি বেড।
নিজের মুখ ছাড়িয়ে নিলো পৌষ। শয়তানি হাসি দিতে দিতে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। তৌসিফ বদলের মতো কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইলো। এত এত টাকা মাস শেষে দেয়া হয় কাজের লোকদের এখন কি না নিজের কাজ নিজের করতে হবে?
রুমের বাইরে আসতেই তৌসিফ দেখলো পৌষ সোহেল নামের মধ্য বয়স্ক লোকটাকে বলছে,
— চাচা শুনুন, বেড রুমে যত ফকিন্নি ফকিন্নি লাইট আছে সব পাল্টে এনার্জি লাইট আনবেন। টাকার চিন্তা নেই। এত বড়লোক মানুষ এদের টাকা পয়াসা রাখার জায়গার শুধু অভাব। আপনিই বলুন এত টাকা দিয়ে কি হবে? কবরে নিবে? আরে বাবা কিপ্টামির লিমিট থাকা উচিত। এত টাকা থাকতে কেন চারশত চল্লিশ বোল্ডের হলুদ বাত্তি লাগাব?
পৌষ’র কথা শুনে তৌসিফের এবার মাথা ঘুরে উঠলো। ওর এই লাইটিং করাতে যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে সেখানে পৌষ দেড়শত টাকার এনার্জি লাইটের সাথে এসবের তুলনা দেয়? তুলনা বললেও তো ভুল। এগুলো পাল্টে কি না সাদা লাইট লাগাবে? কাকে কি বুঝাবে ও? এই মেয়েকে তো সোজা বললে উল্টো বুঝে। সাদা বললে কালো বুঝে। শুধু বিয়ে বললে বাসর বুঝে না।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তৌসিফ বললো,
— খেতে বসো পৌষরাত। তোমাকে ভার্সিটি ড্রপ করে অফিসে যাব। নতুন সিপ মেন্ট এসেছে।
— যেই না ছাতা মাথা নাস্তা এসব আপনিই খান। ফালতু যত্তসব ফকিন্নিদের খাবার। বলি যে আটার দম কি এতই বেশি যে সকালে সাদা রুটি বানানো হয় না এখানে?
রাগে গজরাতে গজরাতে চলে গেল পৌষ। তৌসিফ ও উঠে দাঁড়ালো। সকাল দশটা বাজে। আজ নাহয় নাস্তাটা বউয়ের সাথে বাইরে হবে। তৌসিফ’কে উঠতে দেখেই ব্যস্ত হলো সোহা। তৌসিফ থামিয়ে দিয়ে বললো,
— এরপর থেকে নাস্তায় ঝামেলা হলে সবগুলোর চাকরি বাতিল করে দিব৷ টাকা দিয়ে কাজ করাই চারা দিয়ে না।
সোহা মাথা নামিয়ে রাখলো। ও ই রুটি বানাতে নিষেধ করেছিলো।
#চলবে…..
#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৩
গাড়িতে যাবে না করতেই তৌসিফ এবার গম্ভীর কণ্ঠে ধমকালো। ড্রাইভার দরজা খুলতেই কাঁধের ব্যাগটা এক প্রকার ছুঁড়ে ভেতরে ফেললো পৌষ। রাগে গজরাতে গজরাতে ভেতরে ঢুকে আসতেই তৌসিফ নিজে ও ভেতরে ঢুকে ডোর লক করলো। মাঝ খানের সিটটা ফাঁকা পরে রইলো। এ যেন দুই কুলে ডেরা গেড়ে বসলো দুই জামাই বউ। কেউ কারো কাছে আসার তাগিদ দেখালো না। শুধু পৌষ একটু আকটু রেগে বোম হয়ে আছে। রাতে ওর প্রচুর ক্ষুধা লাগে। সারা রাত ঘুম হয় না। পেট মোচরায়। পেটের ভেতর থাকা ইঁদুর গুলো হাহাকার করে বলে,”কিরে পৌষ, কোথায় বিয়ে হইলো তোর? কোন হা ভাতে বড়লোক জামাই পরলো তোর কপালে যে রাতে তোর পেটে কিছু পরে না?”
ইঁদুরের কথার উত্তর খাবার দিয়ে দিতে পারে না পৌষ। হালকা পাতলা নগন্য লজ্জা করে ওর। কি একটা যা তা অবস্থা। পৌষ খাবার পায় না।
বাড়ীতে থাকাকালীন চাচি ওর জন্য রাতে খাবার পর কিছু বানিয়ে রুমে দিয়ে রাখতো। মাঝেমধ্যে যখন পৌষ একা কিচেনে যেতো কোথা থেকে জানি জৈষ্ঠ্য, চৈত্র হাজির হতো। অবাক করা বিষয় ইনি, মিনি ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে রান্না ঘরে এসে দুই ভাইয়ের কোলে উঠে বসতো। এরা যে সজাগ পেতো কিভাবে পৌষ জানে না। শেষ রক্ষা অবশ্য হতো না। হেমন্ত ও হাজির হতো। পিহা ছোট ছোট হাতে আপা’কে সাহায্য করতো। ইন্সটেন্ট নুডলস চার পাঁচটা একবারে রেঁধে ওরা গুটিগুটি পায়ে সব ঢুকতো হেমন্তর রুমে। কাড়াকাড়ি মা’রামারি লাগতো ডিম নিয়ে। আহা। পারতো না র’ক্তারক্তি হয়ে যেতো। হেমন্ত ধমক না দিলে সেই মা’রামারির অন্ত থাকতো না। খেতে খেতে অবশ্য ইনি, মিনি ঘুমিয়ে যেতো। কত রাত পর্যন্ত জেগে জেগে গল্প করতো। হেমন্ত ওর ড্রয়ার ভরা পাপড়, চিপস রেখে যেতো। টানা কোন কালই ঘুমাতে পারতো না পৌষ।
খাবারের অভাবে হতাশার শ্বাস ফেলে পৌষ।
তৌসিফে’র কানে গেলো সেটুকু শ্বাস তবে বুঝলো না এর পেছনে থাকা কারণ।
তৌসিফে’র ধৈর্য কুলালো না। ও জানে ড্রাইভারের বুকের পাটা অতটাও বড় না যে পিছনে তাকাবে। লম্বা হাত বাড়িয়ে এক টানে পৌষ’র ধরে টেনে নিজের কাছে আনলো ও। ঘটনা ঘটলো আলোর বেগে যা বাস্তবে সম্ভব নয়। পৌষ বরাবর ফিজিক্সে দূর্বল। তাই বুঝে উঠলো পারলো না এটা কি আদৌ ও আলোর বেগ ছিলো না অন্য কিছু। মানে হকচকাতে ও তো সময় লাগে মানুষের যা তৌসিফ ওকে দিলো না। হাত বাড়িয়ে পেছন থেকে কুশন নিয়ে দু’জনে র মাঝখানে একটা আরেকটা পৌষ’র পিঠের পেছন দিয়ে বললো,
— বুঝলাম না এত কমফোর্টেবল কারে তুমি এতটা ছটফট করছো?
পৌষ দাঁত দিয়ে নখ কাটতে লাগলো। আপাতত ক্ষুধায় ওর জান আপ ডাউন করছে। এনার্জি লো হয়ে যাচ্ছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এতসব সমস্যা’র কারণে তৌসিফের সাথে চাপা নাড়াতে পারলো না। এতে ও আফসোস হলো কিছুটা।
ভ্রুঁ কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো তৌসিফ। ওর জানা চেনার মধ্যে পৌষ এতটা শান্ত ধাঁচের না। আজ সকালে ও তেঁজে টাইটুম্বুর ছিলো। হঠাৎ মুখে ব্রেক কষলো কেন তৌসিফ বুঝলো না। মেয়েটার শ্যামলা মুখটা একটু খানি হয়ে আছে। তৌসিফ একটু বুঝলো হয়তো বেশি ক্ষুধা লেগেছে।
ডান হাত দিয়ে পৌষ’র হাতটা মুখ থেকে নামিয়ে দিলো। মুখে বললো,
— দাঁত দিয়ে নখ কাটে না পৌষরাত।
ক্লান্ত গলায় ই পৌষ বললো,
— একশত বার কাটব। হাজার বার কাটব। ম’রে গেলেও মুখে হাত দিয়ে ম’রব।
তৌসিফ আড় চোখে তাকিয়ে বললো,
— দাঁত পরে গেলো কিন্তু কথা থামলো না।
পৌষ মুখ ভেঙালো। গাড়িটা থামতেই তৌসিফ বের হলো। পৌষ’র দিকে দরজা খুলে দিতেই ও কোনমতে বের হতে গিয়েই মাথা ঘুরে উঠলো। এটা স্বাভাবিক সময় তেও হয়। আজ এত সময় না খেয়ে থাকাতে একটু বেশি হচ্ছে। আয়রন ডেফিসিয়েন্সি থাকার জন্য বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেও এমন মাথা ঘুরায়। তৌসিফ ওর বাহু চেপে ধরে কিছুটা উদিগ্ন গলায় বললো,
— কি হলো? পৌষরাত? আর ইউ ফিলিং লো?
মাথা নেড়ে নিজের বাহু ছাড়িয়ে নিলো ও। গাড়ি থেকে তৌসিফ পৌষ’র ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে বললো,
— চলো।
এত হাই ফাই জায়গাতে পৌষ সচরাচর আসে না। বছরে হয়তো তিন চার বার আসা হয়। হেমন্ত ঘুরাতে নিয়ে আসে। বাট ব্রেকফাস্ট করতে এত ঢং ওরা করে না। পৌষ মিনমিন করে বললো,
— পটাতে চায় আমাকে শা’লা।
“শালা” শব্দ টা অবশ্য শুনলো তৌসিফ। ভাবলো এই মেয়ে একটা চিজ। এ ভাঙলেও মোচকায় না সহজে। মুখে তার খই ফুটতে থাকে অল দ্যা টাইম।
বুক্ড করা এক রাউন্ড টেবিলে বসলো ওরা। ওয়েটার আসতেই তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,
— অর্ডার করো পৌষরাত।
— ঘি দিয়ে পরটা আর দুধ চা। চায়ে দুধ বেশি দিবেন।
ওয়েটার একটু তব্দা খেলো। তৌসিফ ইশারায় সাইডে যেতে বললেই ওয়েটার বিনয়ের সাথে বললো,
— ওকে ম্যাম। এনিথিং এল্স?
— নো ভাইয়া। ধন্যবাদ।
পৌষ’র মুখটা হাসি হাসি দেখালো। তৌফিক চমকালো। ওর বউ দেখি হাসে। তাও এই ওয়েটারকে দেখে। এর চাকরি না খেয়ে দিবে তৌসিফ? পৌষ নিজ থেকেই আবার বললো,
— গতবারের মতো আবার চা ফেলে দিয়েন না।
একটু লজ্জা পেলো বেচারা। এর আগে একবার চা ফেলে দিয়েছিলো ও। ম্যানেজার ধমকে ধামকে দেয়ার আগেই পৌষ বলেছিলো, “ওটা কোন ব্যাপার না। যে কারো হাত থেকে পরতে পারে।”
তৌসিফ বুঝলো পৌষ হয়তো আগে থেকে চিনে। তাই ছেলেটার চাকরি খাওয়ার কথা বাদ দিলো। আপাতত নাস্তা ই খাবে।
ওয়েটার যাওয়ার পরপর ই তৌসিফ ও উঠে গেলো। ওয়েটারের দিকে সোজা তাকিয়ে বললো,
— গরুর বটি আর এক্সটা ডিম সাথে একটা ফ্রুট সালাদ আর ফ্রেশ জুস দিয়ে যাও। চা লাস্টে এনো।
ছেলেটা মাথা নেড়ে চলে গেল। তৌসিফ আসতে ই দেখলো পাশের সুইমিং পুলে গোটা গোটা চোখে তাকিয়ে আছে পৌষ। পুলে কয়েকজন শর্টস পরে পানিতে নেমেছে। আর ওদের দিকে ই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ওর বউ। মানে এতটা হাবলা’র মতো তাকানোর কি আছে বুঝে আসে না ওর। কই তৌসিফ’কে তো দেখে না।
আচমকা ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
— ঐ দিকে চলো।
— কেন?
কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললো পৌষ। তৌসিফ চেয়ে ও আসল ঘটনা বলতে পারলো না। তাই মিথ্যা টাই বললো,
— এদিকে রোদ চলে আসবে পৌষরাত। কাম ফাস্ট।
কপাল কুঁচকে পৌষ গেলো ওর পিছু পিছু। সস্তির শ্বাস ফেললো তৌসিফ তবে অতি গোপনে।
খাবার এলো মিনিট পনেরো পর। চোখ উল্টে একবার তৌসিফ’কে দেখতেই তৌসিফ ঠান্ডা গলায় বললো,
— জুস শেষ না করলে চা আসবে না।
— না আসলো।
এই মেয়ে যে জন্মের বাঁকা তা জানে তৌসিফ। কিন্তু জুসটা খেলো পৌষ। গরুর বটি দিয়ে পরটা ও মুখে দিলো। তৌসিফ দেখলো পৌষ অনেকটা আগ্রহ নিয়ে বটি খাচ্ছে। হয়তো পছন্দ হয়েছে। নিজের প্লেটে থাকা বটিগুলো পৌষ’কে দিতে দিতে বললো,
— সকালে বটি ভালো লাগছে না। তুমি নাও। আমি ডিম খাচ্ছি।
পৌষ মনে মনে খুশি ই হলো। তৌসিফের প্লেটে থাকা ঝোল টুকু ও নিজের পরটা দিয়ে মুছে নিয়ে নিলো। ভাবখানা এমন যে, “দিবি যখন সব দে। ঝোল ও কেন বাকি থাকবে?”
ডিম একটা পৌষ’কে দিতে নিলেই ও না করলো। জানালো,
— পেট ভরে গেছে। খাব না আর। চা আসবে কখন?
— ডিম খতম হলেই আসবে।
— না খেলাম।
এবার সত্যি সত্যি ই খেলো না। তৌসিফ নিজেই ডিমটা খেয়ে নিলো। চা আসতেই পৌষ ওয়েটার’কে বললো,
— একস্ট্রা সুগার লাগবে ব্রাউনটা।
ছেলেটা মাথা নেড়ে দুই প্যাকেট এনে দিলো। পৌষ দুই প্যাকেট নিজের ব্যাগে ভরে বাকি দুটো চায়ে মিক্স করলো। তৌসিফ হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— এটা কি ছিলো?
— কোনটা?
— ওগুলো ব্যাগে নিলে কেন পৌষরাত?
— কেন নিব না? জানেন এই চায়ের দাম কত? পুরো চারশত টাকা। ভ্যাট পনেরো পারসেন্ট। আমি আমি তো শুধু চিনি নিলাম।
বলতে বলতে টিস্যু ও ব্যাগে পুরে নিলো। তৌসিফ এবার ধমকে উঠলো চাপা স্বরে,
— স্টপ ইট পৌষরাত। মাথা খারাপ তোমার? কি করছো?
পৌষ বুঝি পাত্তা দেয়? সে দেখলো তৌসিফ সুগার ছাড়া চা খাচ্ছে। তৌসিফের ট্রে থেকে ও দুটো সুগার নিজের ব্যাগে ভরে চায়ে চুমুক দিলো। তৌসিফ অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো। বললো,
— প্লিজ হানি, ওগুলো রেখে দাও এখানে। বাসায় অনেক আছে। এর থেকেও ভালো ব্যান্ড আছে। কেউ দেখলে কি ভাববে?
খেয়ে দেয়ে চাঙ্গা এখন পৌষ। একটা ছোট খাট ঢেকুর তুলে বললো,
— শুনুন। আজ একটা গোপন কথা বলি আপনাকে। এই যে আমরা যা যা খেলাম এর মধ্যে ই এসবের টাকা উসুল করে রাখা হয়। এমনকি ওয়াশরুম যাওয়ার টাকা ও আগেই রেখে দেয় এনারা। কথা হলো ব্যবহার করলেও পে করতে হবে না করলেও। তাহলে আমার টাকায় কেনা জিনিস আমার ব্যাগে ভরলে সমস্যা টা কোথায়?
যুক্তিতে ভুল থাকলে বলুন।
পৌষ’র যুক্তি শুনে তৌসিফ আপাতত কিছু বললো না। মান ইজ্জত আজ পকেটে ভরে যেতে হবে ভাবতে ভাবতে চায়ে চুমুক দিলো ও।
.
পৌষ’র ভার্সিটির গেটে এসে গাড়ি থামলো। তৌসিফ মানি ব্যাগ থেকে পাঁচশত টাকার কচকচা কিছু নোট পৌষ’কে দিয়ে বললো,
— এটা রাখো।
— কেন?
— হাত খরচ তোমার।
— লাগবে না।
— লাগবে। রাখো।
— বললাম তো লাগবে না। হেমু ভাই দিবে।
ভ্রুঁ উঁচু করলো তৌসিফ। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— আমার বউ তুমি এখন পৌষরাত। তোমার চাচাতো ভাই কেন হাত খরচ দিবে?
— কারণ সারাবছর সে ই দিয়েছে।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তৌসিফ বললো,
— বাট ইটস নট দ্যা সেইম টাইম না? বুঝো। রাখো এটা।
কিছু একটা ভেবে ওখান থেকে পাঁচশত টাকার একটা নোট টান দিয়ে নিলো পৌষ। গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে বললো,
— এত লাগে না আমার। যাই।
তৌসিফ’কে বলার সুযোগ না দিয়ে পৌষ চলে গেলো। হাতে থাকা সাড়ে চার হাজার টাকার দিকে তাকিয়ে রইলো তৌসিফ।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। তৌসিফে’র মনে পরলো সে রোজ পাঁচ হাজার হাত খরচ দিয়ে ও পোষাতে পারতো না। প্রতি মাসে গোল্ড গিফট করে ও ঠিকঠাক সেই নারীটির হাসি মুখ দেখতে পেতো না। সর্বোচ্চ যখন ডায়মন্ড গিফট দিতো তখন গদগদ হয়ে তিন, চার রাত সে তৌসিফে’র বুকে ঘুমাতো। তাকে আদর যত্ন করতো এরপর যা তাই। তৌসিফ তাকে সবটুকু সুখ দিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। টাকা,পয়সা,দেশ, বিদেশ সব। কিচ্ছু বাকি রাখে নি। কিচ্ছু না। দিন শেষে সে শুন্য। ভালোবাসার কাঙ্গাল কাঙ্গাল ই হয়ে গিয়েছিলো।
_____________________
ভার্সিটিতে ভাগ্য ক্রমে আদিত্য’র সাথে দেখা হয় নি পৌষ’র। তবে আদিত্য’র বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলো। সিনিয়র হওয়ার সুবাদে সালাম পর্যন্ত এক সম্পর্কে আবদ্ধ তারা। এর মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র হচ্ছে রিহাব নামে একজন। সে পৌষ’কে ডেকে নিলো সাইডে। জিজ্ঞেস করলো,
— ক্লাস কখন?
— মাত্র একটা শেষ হলো ভাইয়া। আরেকটা আধ ঘন্টা পর।
— কিছু জানানোর ছিলো তোমাকে আদিত্য’র ব্যাপারে।
পৌষ ভদ্র ভাবে উত্তর করলো,
— আমি এখন ম্যারিড ভাইয়া। তার সাথে যোগাযোগ নেই। জেনে কি হবে?
— তবুও জানা উচিত তোমার পৌষ।
পৌষ কথা বললো না। রিহাব নিজেই চোখে থাকা চশমাটা ঠেলে দিয়ে বললো,
— হি জাস্ট ওয়ান টু টেইক ইউ টু হিজ বেড পৌষ। ও বেট ধরে করেছে সব।
— জানি।
বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো পৌষ। রিহাব হাসলো। বললো,
— তৌসিফ স্যার’কে প্রমান গুলো আমি ই দিয়েছিলাম। তবে আরো কিছু দেই নি এতে আদি ঝামেলায় পরতো।
— আমাকে কেন জানাচ্ছেন?
— কারণ একটাই পৌষ। তৌসিফ স্যার ভালো মানুষ। মুভ অন করো। দ্যাট উইল বি বেটার ফর ইউ।
— ঐ বেটে আপনিও শামিল ছিলেন। এটা ও জানি আমি।
রিহাব আচমকা এটা শুনে ঘাবড়ালো। পৌষ বাঁকা হাসলো। বললো,
— তৌসিফ তালুকদার শুধু আপনার প্রমানের ভিত্তিতে চলে না। আপনার উপরের প্রমান ও আছে তার কাছে। আমার থেকে দূরে থাকুন ভাইয়া।
— লাইফে প্রথম বার ছিলো ওটা।
— যততম বার ই হোক না কেন ভাইয়া। পৌষরাত’কে কারো বিছানাতে নেয়া এতটা সহজ না। আমার সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো না। ভালো লাগা ছিলো। আমার প্রথম ভালোলাগা ছিলো আদিত্য। আবার বলছি ছিলো। এর মানে এখন নেই। কোনদিন প্রেমিকার দাবি করি নি। সে প্রেমিক হতে চেয়েছিলো। প্রেম হতো আমাদের মধ্যে যদি না সেদিন চাচা ধরে ফেলতো। তবে হ্যাঁ। অপেক্ষা ছিলো। তীব্র অপেক্ষা ছিলো আমার তার জন্য। কারণ একটাই আমার প্রথম ভালোলাগা ছিলো সে যা এখন নেই।
কথাগুলো বলে গটগট পায়ে ক্লাসে ঢুকে পরলো পৌষ। আপাতত বিরক্ত লাগে এসব তার।
.
ক্লাস শেষ হলো বিকেল পাঁচটা নাগাদ। ওকে অবাক করে দিয়ে ক্যাম্পাসে হাজির কাজিনদের দলবল। ইনি,মিনি আর পিহা দৌড়ে এলো। আপা আপা ডাকতে ডাকতে মুখে ফ্যানা তুললো তিনজন। ইনি,মিনি’কে কোলে তুলে জড়িয়ে ধরলো ও। বলা হয় বড় বোন হলো মায়ের মতো। ইনি,মিনি আর পিহা’র ক্ষেত্রে ও তা। তিনটা হিচকি তুলে কাঁদছে তাদের কলিজার আপা’কে পেয়ে। ছোট ছোট ঝুঁটি করা মাথাটা নাড়িয়ে বললো,
— আপা তুমি নাই কেন?
— এই যে আছি তো আপা।
— বাথায় তলো না আপা।
— চলব তো সোনারা। তোরা এখানে কেন?
চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য মাথা নিচু করে এগিয়ে এলো। ইনি,মিনি লাফিয়ে ওদের কোলে যেতেই দুই ভাইয়ের হাত জড়িয়ে ধরে পৌষ। ছেলে গুলো পারলে কেঁদে দিতো। দূরে দাঁড়িয়ে আছে হেমন্ত। দেখেও না দেখার ভান ধরলো পৌষ। ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে এগিয়ে এলো হেমন্ত। পৌষ ধরা গলায় ডাকলো,
— হেমু ভাই?
— বল।
— কান্না পাচ্ছে।
— কেঁদে ফেল।
— সত্যি তো।
ওর মাথায় হাত রাখলো হেমন্ত। পৌষ হাসলো। পৌষদের হাসি ছাড়া কান্না মানায় না৷ সারাক্ষণ ছটফট করে গভীর কষ্ট চাপা দিয়ে হাসার মানুষ ই তো পৌষ। আজ ও ব্যাতিক্রম ঘটলো না।
পৌষ’র উস্কানিতে সবগুলো গেলো টিএসসি। মমো থেকে নিয়ে বুট কিছু বাদ রাখলো না। বুট খেতেই ইনি,মিনি হু হা শুরু করেছে। ওদের পানি খায়িয়ে ঠান্ডা করলো চৈত্র। উঁচু সিঁড়িগুলো তে বসে একসাথে মালটার চা খেলো ওরা। এটা অবশ্য ইনি,মিনিকে দেয়া হলো না। সারাটা সন্ধ্যা কাটলো ওদের সাথে। পাঁচটা কাজিনের মুখে শুধু “আপা” ডাক। পৌষ’র খাঁ খাঁ করা কলিজা প্রশান্তি পেলো। এই ভাই-বোন গুলো যে ওর প্রাণ। হেমন্তর দিকে তাকিয়ে পৌষ বললো,
— মাসের শেষ দিক চলে। আমার পকেট মানি দাও।
মানি ব্যাগ থেকে পাঁচশত টাকার দুটো নোট দিলো হেমন্ত। বাকিদের পাঁচশ করে। শুধু ইনি,মিনি আর পিহা এখনও পকেট মানি পায় না৷
পৌষ’কে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে ওরা চলে গেল। পৌষ’র মনটা পুণরায় খারাপ হলো। কলিং বেল বাজাতেই মিনু খুলে দিলো। পৌষ’কে দেখে মুখটা চোখা করে চলে যেতেই পৌষ শ্বাস ফেললো। আপাতত এখন মুড খারাপ করার সময় নেই ওর।
____________________
— দিন কেমন কাটলো পৌষরাত?
পৌষ আকাশে থাকা চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— অনেক ভালো।
— আমাকে জিজ্ঞেস করলে না?
— বলার হলে নিজেই বলবেন।
— অনেক স্ট্রেস ছিলো আজ হানি। শিপিং ডিলে হলো। জাহাজে মাল এসেছে। লিগ্যাল ডকুমেন্টস সব আমার তবুও পুলিশ আটকে রেখেছে। যখন এসআই কে কল দিলাম তখন ছেড়ে দিলো। এরা চিনে শুধু টাকা। বুঝলে?
পৌষ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। এসব তাকে কেন বলা হচ্ছে? সে কি বুঝে?
পৌষ গিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। তৌসিফ ও গুড নাইট জানিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পরলো। ঘড়ির কাটা ঘন্টা পেরুলো। একদম সোজা হয়ে আছে। পৌষ’র পেট মোচরালো। এদিক ওদিক করে এবার উঠে বসলো। ক্ষুধায় পেট চু চু করছে ওর যদিও খেয়েছে দশটা নাগাদ। অভ্যস বলে কথা। টিকতে না পেরে কিচেনে গেলো ও। এদিক ওদিক খুঁজে ও যখন পেলো না হঠাৎ পেছন থেকে কারো গলা শুনে চমকে তাকালো। তৌসিফ টাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে বললো,
— কি খাবে?
— জানি না৷ ক্ষুধা লেগেছে।
তৌসিফ ফ্রোজেন পিৎজা বের করে ওভেনে দিলো। ওটা গরম হতে হতে জিজ্ঞেস করলো,
— রাতে ক্ষুধা লাগে?
— হু।
— এতদিন ও লেগেছিলো অবশ্য ই।
— স্বাভাবিক।
— বলো নি কেন?
পৌষ চুপ রইলো। তৌসিফ নিজেই বললো,
— লজ্জা? আচ্ছা আর পেয়ো না। বাসায় খাবার থাকে। তোমার বাসা। যা মন চাইবে খাবে। ফেলবে।কেউ কিছু বলবে না। কে আছে আমার বলো? তুমি আর আমি।
“তুমি আর আমি” কথাটা অদ্ভুত ভাবে পৌষ’র পেটে প্রজাপতি উড়ালো। পিৎজা গরম হতেই ওরা কিচেনেই উঁচু জায়গাতে উঠে বসে খেলো। টুকটাক কথা হলো দু’জনের। ঘুমাতে এলো রাত দুটোর দিকে।
.
রাত প্রায় তিনটার দিকে ওয়াশরুমে যেতে উঠে পৌষ। পাশে তৌসিফ নেই। ওয়াশরুম থেকে এসেও দেখলো নেই। কি মনে করে বাইরে তাকাতেই দেখলো সোহা’র রুম থেকে বের হলো তৌসিফ। রাত তিনটা বাজে সোহা’র রুমে কেন গিয়েছিলো তৌসিফ এটার উত্তর জানা নেই পৌষ’র। তবে এত বছর ধরে শুনা কথাগুলো মনে পরলো ওর। কাজের মেয়ে’র সাথে সম্পর্ক তৌসিফে’র। নিশ্চিত এত রাতে ভালো উদ্দেশ্যে ওখানে যায় নি তৌসিফ।
চুপ করে নিজের পাশে শুয়ে পরলো পৌষ। জানে না কেন কিন্তু পৌষ’র মতো মেয়ের চোখ ভিজে উঠেছে যদিও সেই পানি গড়িয়ে পরলো না। দহন সৃষ্টি হলো যদিও তা কাউকে পুড়ালো না। নিজেকে সান্ত্বনা দিলো পৌষ,”তোর ভাগ্য এটা পৌষ। মেনে নে।”
#চলবে…..