প্রেমসুধা পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
412

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৪

পৌষ’র কাঁধে হাত রাখতেই কিছুটা ছুঁড়ে ফেলে পৌষ। তৌসিফ দমলো না বরং চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— পৌষরাত? কি হয়েছে? বাসার কথা মনে পরছে?

বলতে বলতে শোয়া থেকে এইবার উঠে গেলো তৌসিফ। সবেই বিছানায় গা দিয়েছিলো তখনই কেন জানি মনে হলো পৌষ ঘুমায় নি। তখনই শিওর হতে কাঁধে হাত রাখে।
টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালাতেই হলদেটে আলোয় মাখোমাখো হলো কক্ষ। তৌসিফ পৌষ’র দিকে তাকিয়ে এবার ওর বাহু টেনে ধরলো। বসানোর চেষ্টা করতেই এবার হু হু করে কেঁদে উঠলো পৌষ। ওর চঞ্চলা মনটা মানতে পারছে না। কিছুতেই না। হোক তার কোন আশা নেই তৌসিফ থেকে তাই বলে রাত বিরাতে তৌসিফের এহেন সোহা’র রুমে যাওয়াটা ও মানতে পারছে না। স্বভাবসুলভ ই নারী মন। তার মধ্যে পৌষ’র মনটা অতি নরম। মাতৃ সুলভ। সেখানে ছোট খাট অনুভূতি রোজ খেলা করে। এরমধ্যে সবচাইতে বড় বন্ধন। পবিত্র এক বন্ধনে আটকা দু’জন। হয়তো কোন আবেগ তাদের এই বিয়েকে ঘিরে নেই। তবুও প্রাকৃতিক ভাবেই টান সৃষ্টি হয়ে যায়।

পৌষ’র কান্নায় তৌসিফ নিজেই ভরকে গেল। দুই হাতে ওর চোখটা মুছতে নিলেই পৌষ সরাতে চাইলো ওকে। এক প্রকার জোর করে চোখ মুছে দিলো তৌসিফ। অতি নরম স্বর বের হলো কণ্ঠনালী ভেদ করে,

— বাসার কথা খুব বেশি মনে পরছে জান?

–জান, প্রাণ, কুত্তা,বিলাই আমাকে ডাকতে হবে না। সরুন আমার সামনে থেকে।

কাঁদতে কাঁদতে হিচকি তুলে বললো পৌষ। তৌসিফ অবাকের উপর অবাক হলো। তবুও বউ’কে আদর করে বললো,

— আচ্ছা হানি একটু আগে না ঘুমালে? কি হয়েছে বলো।

এতটা ন্যাকা সাজা পৌষ’র হজম হলো না। রুক্ষ কণ্ঠে ঝরঝরে বললো,

— বর হওয়ার অধিকার দিয়েছিলাম আপনাকে। আপনি নেন নি। আমার সামনে ভালো সাজা বন্ধ করুন। আপনার আসল চেহারা পুরো এলাকা জানে। আমিও জানতাম। তবে আজ স্ব চোখে দেখলাম।

বলেই তৌসিফ থেকে দূরত্ব রেখে শুয়ে পরলো পৌষ। ফোঁস করে দম ছাড়লো তৌসিফ। দিনের বেলা সোহা’র কাছাকাছি যাওয়াটা একটু ঝামেলাকর তাই তো রাতে গেলো পৌষ ঘুমানোর পর। মেয়েটাকে গভীর ঘুমে দেখে গেলো অথচ কিভাবে জানি ধরা খেয়ে গেলো। বড্ড অসহায় অনুভব করলো তৌসিফ। এমনটা তো না হলে ও পারতো।
পাশে তাকিয়ে দেখলো পৌষ হয়তো ঘুমিয়েছে। নাক টানার আওয়াজ আসছে না মানেই ঘুমাচ্ছে। মেয়েটা আজ কাঁদলো কেন? তৌসিফ’কে ভিন্ন নারীর রুম থেকে বের হতে দেখে? আচ্ছা সে তো জানে তৌসিফ আগে ও কোন নারীতে গভীর ভাবে মত্ত ছিলো। সেই নারী’র মাঝে বিচরণ করেছে। পিয়াসী’কে সে অতিরিক্ত ভালোবাসতো। এক ঘন্টাতে যে কতবার ফোন দিতো তার ইয়াত্তা নেই। বন্ধু মহলে মানুষ হাসাহাসি ও করতো ওকে নিয়ে। “বউ পা গলা” উপাধি পেয়ে ও কোনদিন নিজেকে ছোট করে নি তৌসিফ। সবসময় তার মনটা চাইতো তার পিয়ু’র কাছাকাছি থাকতে। মনে হতো যত দিচ্ছে তত ই বুঝি ভালোবাসা কম হচ্ছে। এত এত সুখ, প্রেম সে যাকে উৎসর্গ করলো দিন শেষে সেই নারীটা তার চোখে এক মুঠো বালি দিয়ে চলে গেলো। তৌসিফের ও উচিত ছিলো না তার পিয়ু’কে দেখিয়ে অন্য নারী’র প্রেমের সুধা পান করা?

____________________

সকাল সকাল চিৎকার, চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙে যায় তৌসিফে’র। রাতে দেড়ীতে ঘুমানোর ফলে মাথা টিস টিস করছে ওর। চোখ ভর্তি ঘুম থাকায় উঠে বসে ও একটু ঝুমছে ও। দুই হাতে চোখটা ডলে খুলার আগেই ওর কান সজাগ হলো। পৌষ’র গলা শুনা যাচ্ছে। কাউকে ধমকাচ্ছে। মস্তিষ্ক তড়িৎ প্রবাহের ন্যায় চটপট চলা ধরলো। ফট করে চোখ মেললো তৌসিফ। তারাতাড়ি নরম বিছানা ছেড়ে হাবিলদারের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। ওর বউ যে সকাল সকাল গ্যাঞ্জাম পাকিয়েছে তা বুঝতে এক মিনিট ও লাগলো না। হুরমুর করে বেরিয়ে এলো তৌসিফ। পায়ে চপ্পল দেয়ার সময়টুকু র বড্ড অভাব। বাইরে আসতেই চমকালো তিনগুণ বেশি। মিনু’কে সমান তালে ধমকাচ্ছে পৌষ। মিনু মাথা নিচু করে ফুঁসে যাচ্ছে তবে কথা বলছে না। তখনই একটা সিল্কের নাইটি গায়ে ওরনা পেঁচিয়ে সোহা বেরিয়ে এলো। সবেই তার ঘুম ভেঙেছে বুঝা যাচ্ছে। মিনু তার আপাকে দেখে সাহস পেলো। সোহা আশেপাশে তখন ও দেখে নি। কপাল কুঁচকে ঘুমু কণ্ঠে ই বললো,

— চিল্লাচিল্লি কিসের সকাল সকাল? এটা বাসা না অন্য কিছু? কাল কত রাতে বাসায় ফিরেছে মানুষটা। ওনার কি ঘুম দরকার নেই?

তৌসিফ’কে অবশ্য দেখে নি সোহা৷ মিনু দৌড়ে ওর আপা’র কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। সোহা কপাল কুঁচকে বললো,

— তোকে বকেছে?

— হ্যাঁ আপা। অনেক বকেছে। গালি দিয়েছে।

আর কিছু বলার আগেই রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে পৌষ এগিয়ে আসতে নেয় মিনু’র দিকে। তৌসিফ বুঝে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে যে কোন সময়। তারাতাড়ি পেছন থেকে পৌষ’র পেট জড়িয়ে ধরে। তবে বিশেষ লাভ হলো না। পৌষ রেগে আগুন হয়ে চিল্লিয়ে উঠলো,

— মিথ্যুক। মিথ্যা বলে। কখন গালি দিয়েছি তোকে। শা’লী এদিকে আয়। দেখ তোকে কি করি। তোর মুখ খামচে দিব একদম। ওই বান্দরের মতো চুল একদম টেনে উপড়ে দিব৷ চিনিস আমাকে? তোর চৌদ্দ গুষ্টি’কে ঘোল খায়িয়ে ছাড়ব।

সোহা হা করে তাকিয়ে রইলো। তৌসিফ পৌষ’কে দুই হাতে নিজের সাথে মিশিয়ে উঁচু করে নিলো কিছুটা। পৌষ’র পিঠটা ওর বুকে ঠেকলো। ওভাবেই ওকে নিয়ে রুমে এসে পা দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। সমান তালে হা পা ছুঁড়ে যাচ্ছে পৌষ। তৌসিফ না পেরে ওকে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো। নিজেও ওর পাশে শুয়ে ওর দুটো হাত শক্ত করে নিজের হাতে ধরে নরম স্বরে বললো,

— এমন করছো কেন পৌষরাত? কি করেছে মিনু?

রাগে কাঁপতে কাঁপতে পৌষ বললো,

— সকালে আমাকে দেখে হাসছিলো। কিছুই বলি নি। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সামনে ঘুরঘুর করতে করতে কাকে জানি বলছিলো যে নতুন মানুষের সুখ নেই। সকালে গোসল করে না। ও যে আমাকে বলছিলো তা আমি বুঝি নি? ওর ঐ চাপা ভেঙে দিব আমি। কত্ত সাহস! আগেও এমন করেছে। কিছুই বলি নি। কাজের মেয়ে এত উড়াউড়ি কিসের?

পৌষ’কে অবাক করে দিয়ে ওর দুই গালে হাত রাখলো তৌসিফ। ঠিক দ্বিতীয় দিনের ন্যায় গালে আদর দিতে লাগলো। পৌষ প্রশয় দিলো না। ঝটাক করে হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,

— রাতে মন ভরে নি না? আচ্ছা রাতে কেন যেতে হবে এখন ই যান না। কে আটকালো? আমি? রাতে গেলে যা করেন দিনের আলোয় করতে ভয়…..

আচমকা তৌসিফের থাবার শিকার হলো পৌষ। ওর তোঁতা পাখির মতো মুখটা বন্ধ হয়ে গেলো। তৌসিফের প্রচন্ড রাগ হলো তবে দমন করলো ও। পৌষ’র কপালে কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— যা ভাবছো ভুল। আর কি শুনতে চাও।

— মানুষের কথা মিথ্যা না।

— শুনা কথায় কান দিও না।

— চোখে দেখা মিথ্যা নয়।

— মাঝে মধ্যে হয়।

— সোহা কাজের মেয়ে। এত কিসের ক্ষমতা ওর? কেন এত নাক গলায় সব কিছুতে? কেন?

— এসবে মাথা ঘামিও না পৌষরাত।

— একশত বার ঘামাব।

— পৌষরাআআআত।

টেনে টেনে পৌষ নাম নিয়ে মুখটা নামিয়ে ওর থুতনিতে চুমু খেলো তৌসিফ। ঝনঝন করে উঠলো পৌষ’র দেহটা। এই লোকের এই ছোঁয়া ওর সহ্য হয় না। তৌসিফ নিজেই সরে গেলো বটে। ওয়াশরুমে যেতে যেতে বললো,

— আমি আসলে বেরুবো একসাথে।

কথা বুঝি শুনে পৌষ। তরতর করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। বের হতে হতেই দেখা মিললো সোহা’র। পৌষ একটা মুখ ঝামটা দিয়ে সোজা কিচেনে ঢুকলো৷ বুয়া তখন পরটা বেলছেন। পৌষ নিজে পরটা ফ্রাইপ্যানে দিয়ে বললো,

— ঘি কোথায়?

বুয়া যেন ভুত দেখার মতো চমকালো। কখনো মালিকরা রান্না ঘরে পা রাখেন না৷ চমকানো টা বড়ই স্বাভাবিক। বুয়া কিছুটা তোতলানো গলায় বললো,

— আ আপনি? আমি করে দিচ্ছি নতুন বউ। আপনি টেবিলে বসুন।

— কেন? আমি করতে পারি তো।

— মামা দেখলে রেগে যাবেন। আপনি….

— আপনার মামা’র কাঁথা পুড়ি আমি।

বুয়া’র যেন ঘাম ছুটে গেলো। চাকরিটা ছুটে যাবে কি তাহলে?
পৌষ তাগাদা দিতেই কিশোরী মেয়ে টা ঘি’য়ের বোয়ামটা বের করে দিলো। চামচ ভরে ভরে ঘি দিয়ে পরটা ভাজছে রোদ। মুহুর্তে ই যেন ঘ্রাণে মৌ মৌ করে উঠলো রান্না ঘর সহ পুরোটা ড্রয়িং রুম।

বুয়াদের সাথে অতি সহজ গলায় কথা চালালো পৌষরাত। বেচারীরা ভয় পাচ্ছে তা চেহারার স্পষ্ট। তাদের এত আতঙ্ক বুঝে আসলো না পৌষ’র। মেজাজ ওর কিছুটা ফুরফুরা হলো। সেই ফুরফুরা মেজাজটাকে ঝুরঝুর’রা করতে হাজির হলো সোহা। এসেই নাক চেপে ধরে বলে উঠলো,

— এসব কি রান্না হচ্ছে এখানে? সকাল সকাল এত ভারী খাবার কেউ খায় না এখানে।

— এখন খাবে।

পৌষ তীক্ষ্ণ গলায় বললো। সোহা সরল চোখে তাকিয়ে বললো,

— এসব এখানে খাওয়া হয় না।

— বললাম তো এখন খাবে।

— আনহেলদি খাবার তুমি খাবে খাও। বাকিদের জোর করছো কেন?

পৌষ দাঁত কটমটালো। চোখ রাঙিয়ে তাকালো এহেন ভাবে যেন সোহা সহ ওর মাথা ফাটিয়ে দিবে। সোহা অতটুকু মেয়ের এইরুপ চাহনি দেখে চমকালো। ভরকালো। পৌষ দাঁত চেপে বললো,

— কাজের মেয়ে কাজের মেয়ে’র মতো থাকার চেষ্টা করবেন। আমার উপর কথা বলবেন না৷ আমার যা মন চাইবে রান্না করব। মন চাইলে থাকবেন নাহয় অন্য কোথাও চাকরি দেখুন৷ এই বাড়ীতে কাজ করতে হবে না। এমনিতে গতকাল রেস্ট নিয়েছেন কিছু বলি নি আজ থেকে কাজে হাত লাগান। যত কাজ শরীর তত চাঙ্গা। আর একটা কথা ঐ রংঢং এর নাইটি পরে সকাল সকাল রুম থেকে বের হবেন না। কুরুচিপূর্ণ লাগে।

সোহা এতটাই শক্ড হলো যে বাক্য হারিয়ে ফেললো। কোন কিছু বলার মতো খুঁজে পেলো না। ওখানে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতেই পৌষ এবার যথেষ্ট উঁচু গলায় বললো,

— কি হলো? বের হন!

সোহা বের হলো ঠিক ই তবে নিজের রুমে গেলো না। ও সোজা ঠুকলো তৌসিফের রুমে। তৌসিফ মাত্র ই বের হচ্ছিলো। সোহা’কে দেখেই দাঁড়ালো। বিরক্ত গলায় বললো,

— রাতে না কথা হলো। এখানে কি করছো?

সোহা’র চোখ ভর্তি পানি। তৌসিফে’র দিকে তাকালো ও। তৌসিফ ওর চোখে পানি দেখে ও তেমন কিছু বললো না। বের হতে নিলেই সোহা বললো,

— আপনার এই বউ আমাকে পদে পদে অপমান করে যাচ্ছে। আমি নাকি কাজের বুয়া। আমাকে বলছে কাজ করতে। আমার পোশাক নিয়ে ও কথা বলেছে। এমনকি আমাকে এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে।

তৌসিফে’র গলা বড়ই শান্ত শুনালো,

— অভিযোগ করার সুযোগ দিচ্ছো কেন?

— আপনি…….

— সু। গো নাও সোহা।

সোহা দুই পা এগিয়ে আসলো। তৌসিফ ওকে সাইড কেটে বেরিয়ে এলো। সোহা’র চোখ দিয়ে পানির বিন্দু কণা গড়ালো। আঙুলের সাহায্য তা মুছে ফেললো সোহা। মিনমিন করে বললো,”এই দুই পয়সার মেয়ে’কে আমি দেখে নিব”।
.
তৌসিফ রুম থেকে বেরুতেই ঘ্রাণে ওর পেট ভরে গেলো যেন। একবার গলা উঁচু করে ডাক ও দিলো,

— পৌষরাত?

পৌষ অবশ্য উত্তর দিলো না। খনিক পরই হাতে প্লেট নিয়ে এগিয়ে এলো। পৌষ’র নাকটা ঘামা ঘামা। মেয়েটা রান্না ঘরে গিয়ে ঘেমে উঠেছে। ওকে বলার সুযোগ না দিয়েই তৌসিফ ডাকলো বুয়া’কে।
ভয়ে ভয়ে বুয়া ছুটে আসতেই তৌসিফ ধমকে উঠলো,

— তুমি থাকতে পৌষরাত কেন কিচেনে বুয়া? এত টাকা বেতন কেন দিচ্ছি? যদি আমার বউ ই রান্না করে তো তোমরা কি করো?

তৌসিফে’র ধমক খেয়ে বুয়া মাথাটা নামিয়ে নিতে না নিতেই পৌষ ফোঁস করে উঠলো যেন সর্বদা ই প্রস্তুত সে লড়াই করার জন্য।

— কি সমস্যা আপনার? ওনাকে কেন ধমকাচ্ছেন? আমি একবার ও বলেছি উনি আমাকে ওখানে যেতে বলেছে? যাকে ধমকানোর তাকে তো টু শব্দ ও বলেন না। দূর্বলের প্রতি ই অবিচার করে যাবেন আপনি।

কাঠখোট্টা গলায় কথাগুলো বলে হাতে থাকা কাঁচের প্লেট’টা সজোরে টেবিলে রেখে পৌষ রুমে চলে গেলো। তৌসিফ দেখলো সেখানে গরম গরম পরটা রাখা। ঘ্রাণে ই লোভ জেগে উঠলো ওর।
চাইলে ও খেতে পারলো না তৌসিফ। বউ রেগে আছে। উঠে রুমে যেতেই দেখলো পৌষ ব্যাগ গোছাচ্ছে। তৌসিফ ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে বললো,

— চলো খাবে।

— খাব না।

— পৌষরাত।

পৌষ ঘুরে দাঁড়ালো। দাঁত খিটমিট করে বললো,

— কি পৌষরাত পৌষরাত সারাদিন? রাত হলে তো ঐ ছেড়ীর কথাই মনে পরে আপনার। যান ওর কাছে। কি মনে করেছেন দেখি নি একটু আগেও যে আমার নামে বিচার দিতে এসেছিলো। একটা কাজের মেয়ে হয়ে মালিকের বেড রুমে যখন তখন ঢুকে যায় এরমানে কি? নোংরামো তো মানুষ ঘরের বাইরে করে অথচ এই প্রথম দেখলাম মানুষ ঘরের মধ্যে দিন দাহারে, রাতের অন্ধকারে নিজ ঘরে নোংরামি করে।

তৌসিফ বরাবরই রাগ সামাল দিতে ব্যার্থ হচ্ছে। পৌষ’র মুখটা আচমকা চেপে ধরে বললো,

— বেশি বলছো।

পৌষ নিজেকে ছাড়াতে চাইলো। বরাবরই ছটফট করা ওর স্বভাব। এবারেও ব্যাতিক্রম ঘটলো না। তৌসিফের হাসি পেলো নিজের উপর। পৌষ’র মুখটা আলতো করে ধরলো এবার। দুই গালে হাত রেখে বললো,

— তুমি আমাকে কতটা রাগিয়ে দাও হানি।

পৌষ তাচ্ছিল্য করে বললো,

— কাপুরুষের মতো রাগ হলে বউ’কে সিগারেটের ছেঁকা দিবেন। সমস্যা তো নেই।

— সেদিন দোষ টা কার ছিলো?

পৌষ’র ঠোঁটে তাচ্ছিল্য’র গাঢ় হাসি দেখা গেলো। তৌসিফ চট জলদি ওর হাত দুটো ধরে চোখে চোখ রেখে বললো,

— আজ পর্যন্ত এই তৌসিফ তালুকদার এতটা অপমান হয়নি যতটা তুমি করছো। রোজ করছো।এখন ও বুয়াদের সামনে করলে। আমি কিন্তু রাগ করছি না।

— ওমা সে কেন? কোথায় আপনার সিগারেট? দিন লাইটার জ্বালিয়ে দেই। আমাকে ছেঁকা দিন। পৌষ’র তো শরীর মাংসে গড়া না। আমার কোন ব্যাথা লাগে না।

বলেই তৌসিফের পকেটে হাত দিলো সিগারেটের খোঁজে। তৌসিফ হাতদুটো ধরে থামালো। গাঢ় কণ্ঠে বললো,

— আর হবে না।

— আপনি না সকালে বললেন আমি যা ভাবি তা ভুল। তাহলে আমাকে বিশ্বাস করাতে সোহা আর মিনুকে বাসা থেকে বের করে দিন।

তৌসিফ কথা বললো না। একটু সময় নিয়ে বললো,

— আমি ওয়াদাবদ্ধ পৌষরাত।

পৌষ নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। তৌসিফ’কে ধাক্কা দিয়ে বললো,

— আপনি যে একটা বুদবুইদা শয়তান তা আমি আগেই জানি।

— হোয়াট! এসব কেমন শব্দ পৌষরাত?

— বুদবুইদা মানে আপনি। যার ভেতরে ভেতরে, রগে রগে শয়তানি। মেয়েবাজ লোক। ঐ **** হচ্ছে বড় খারাপ। শা’লী’কে ধরে টাকলা বানিয়ে দিতে মন চায়। চুলে ফ্লিপ মা’রে আমার সামনে।

তৌফিক ওর মুখটা হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরে। ফিসফিস করে বলে,

— এসব গালি কে শিখায় তোমাকে? হোয়াট ইজ দিস পৌষরাত? তুমি গালি দাও কেন?

পৌষ নিজের মুখটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

— ওহ ওই *** আকাম কুকাম করবে তা দোষ না। পৌষ গালি দিলে দোষ। এখন ওর সামনে গিয়ে গালি দিব।

বলেই বের হতে নিলো পৌষ। তৌসিফ ক্লান্ত হলো। সকাল থেকে এই মেয়ে আজ জোশে আছে। কোন দুঃখে যে গতরাতে ঐ রুমে গেলো? নিজের কপালটা দেয়ালে ঠুকতে মন চাইছে এখন৷ পৌষ’কে বহু কষ্টে আটকে শান্ত স্বরে বললো,

— জান আমার,প্লিজ। এখন থামো। চলো খাব এখন। তোমার শক্তি হবে তাহলে। শক্তি পেলে আরো ভালো মতো চুল ছিড়তে পারবে।

পৌষ থামলো বটে। টেবিলে খেতে বসলেই পৌষ তৌসিফের প্লেটে গরুর বট ভুনা আর গরম ঘিয়ে ভাজা পরটা তুলে দিতেই সোহা বললো,

— এসব খেয়ে পরে পেটে সমস্যা হবে। আনহেলদি খাবার।

পৌষ রসিয়ে বললো,

— ওরে সোনা, তোমার এই আউলা প্রেমে’র বাউলা বাতাস অন্য বেটাকে করো যাও। এই ব্যাটা’কে বাতাস করার জন্য আমি আছি।

তৌসিফ শুনেও শুনলো না কিছু। এই গরম পরটা আর বট ভুনা আজ বহু বছর পর খেলো ও। আগে মা খাওয়াতো। তিন ভাই বোন একসাথে গোল হয়ে বসে খেতো। এখন খাওয়া হয় না৷ কুরবানিতে এত এত গরু কুরবানী করার পরও বট খাওয়া হতো না। বুয়ারাই খায়। আজ খেয়ে অনেক ভালোলাগা কাজ করলো। একসাথে পাঁচটা পরটা খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো তৌসিফ। পৌষ একটাই এখনও শেষ করতে পারে নি। তৌফিক ভাবলো এই মেয়ে তো ততটা খায় ও না অথচ তেঁজ দেখো যেন সবাইকে চিরে ফেলবে। পারলে কখন জানি তৌসিফ’কেই খেয়ে নেয়।

#চলবে…..

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৫

আকাশ-পাতাল ধ্যান ধরে ভাবছে পৌষ। মাথায় ওর যে কিড়া উঠেছে তা এত সহজে শান্ত হবার নয়। তৌসিফ মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভিং করছে। মাঝে মধ্যে ফাঁকফোকর দিয়ে পৌষ’কেও দেখে নিচ্ছে। মেয়েটা এত উতলা হয়ে থাকে যা বলার বাইরে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সোহা শুধু তৌসিফ’কে লোফার বের করে দিয়েছিলো। ব্যাস এই মেয়ে কান্ড ঘটিয়ে এলো। অগত্যা পৌষ’র দেয়া ভেলভেটের লোফার পরলো তৌসিফ। এতে অবশ্য পৌষ শান্ত আছে কিছুটা। আচমকা পৌষ সিটি বাজাতেই তৌসিফ ওর দিকে তাকালো। ভ্রুঁ উঁচু করে জিজ্ঞেস করলো,

— কি?

— গাড়ি থামান।

— হানি লেট হচ্ছে।

— তাতে আমার কি?

ফোঁস করে শ্বাস ফেললো তৌসিফ। গাড়িটা থামাতেই জানালা খুললো পৌষ। পাশে পুড়া ভুট্টা বিক্রি করছে। পৌষ জোরে হাঁক ছেড়ে ডাকলো,

— ওয় ভুট্টা ওয়ালা মামা। একটা ভুট্টা দিন।

লোকটা ভুট্টা এনে দিতেই পৌষ বিশ টাকা দিলো। যদিও তৌসিফ দিতে চাইলো টাকা কিন্তু পৌষ মুখ ঝামটা দিয়ে নিজেই টাকা দিলো। লোকটা বিশ টাকা দেখেই বললো,

— ভুট্টা ত্রিশ টাকা খালাম্মা।

পৌষ মুখ ভেটকিমাছের মতো করে বললো,

— ত্রিশ টাকা? এই ভুট্টা বিশ টাকা খেয়ে এলাম আজীবন। আপনার ভুট্টা কি মহাসাগরের নিচে জন্মায় যে ত্রিশ টাকা?

লোকটা কিছু বলতে চেয়ে ও যেন মিনমিন করলো। পৌষ ব্যাগ হাতড়ে দেখলো ভাঙতি নেই তাই বলে উঠলো,

— আপনার খালুজানের কাছে চান। উনি দিবে দশ টাকা।

তৌসিফ আহত চোখে তাকালো। দশ টাকা দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে শুকনো মুখে বললো,

— আমাকে তোমার খালুজান মনে হয় পৌষরাত?

পৌষ জহুরী চোখে তাকালো। পলক ফেললো পিটপিট করে অতঃপর ভুট্টায় কামড় দিয়ে বললো,

— উহ। টক বেশি।

তৌসিফ আশাহত হলো। এই মেয়ে কি দিয়ে তৈরী? কোন মাটি? মাটির জাত কি? তৌসিফের জানতে মন চাইলো। পৌষ হঠাৎ ওর মুখের সামনে ভুট্টা ধরে বললো,

— নিন কামড় দিন৷ পরে আমার পেট ব্যাথা করবে।

— করবে না৷ নজর দেই নি।

— বিশ্বাস করি না।

— সত্যি বলছি।

— ঋণ রাখে না পৌষ। দশটাকা আপনার ছিলো তাই চার পাঁচ কামড় খাবেন৷

তৌসিফ কথা বাড়ালো না। ড্রাইভিং করতে করতে ভুট্টা কামড়ে খেলো। খেতে খেতে সে পুরোটাই খেলো। পৌষ অবশ্য কিছু বলে নি তাতে। শেষে চার পাঁচটা দানা অবশিষ্ট ছিলো যা পৌষ খেলো। তৌসিফের এসব খাওয়া হয় না৷ সর্বোচ্চ বয়েল কর্ণ খায় ও। এভাবে পুড়া টা খাওয়া হয় নি কখনো।
পৌষ হয়তো বুঝলো তাই কিছু বললো না ওকে।

ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে ই তৌসিফ বললো,

— আমি নিতে আসব আজ।

— কোন দুঃখে?

— এত ঝগড়া পারো তুমি। এই দিক দিয়ে ই বাসায় যাব তাই বললাম।

— আচ্ছা। আমি গেলাম তাহলে।

বলে অপেক্ষা করলো না পৌষ। গেইট পেরিয়ে ভেতরে চলে গেল।

__________________

দীর্ঘ এক মাস পর শশুর বাড়ী এসেছে হেমন্ত। এতদিকের ঝামেলা পোহাতে পোহাতে এদিকে পা রাখার সময় ই হয় নি। শ্রেয়া অবশ্য বুঝদার মেয়ে। সহসা রাগ করে না। তবে আজ রেগে আছে কি না হেমন্ত বুঝতে পারছে না। সাথে ওর কোলে, কাঁধে, হাত ধরে আর পিছু পিছু কাজিন গুলো ও এসেছে। তাদের একমাত্র ভাবী শ্রেয়া। ভাবী’কে দেখে না আজ মাস খানিক হলো। ইনি,মিনি দরজা খুলেই হেমন্তের কোল থেকে নেমে শ্রেয়ার রুমে দৌড় দিলো৷ পিহা ও ঢুকলো পিছু পিছু। হেমন্ত’কে দেখেই ওর শশুর শাশুড়ী তড়িঘড়ি শুরু করলো। হেমন্ত তাদের ব্যাস্ত হতে না বললো। পিছনে দুই ভাত ভর্তি সদাই নিয়ে ঢুকলো চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য। শ্রেয়ার বাবা এগিয়ে আসতেই দু’জন বিনয়ের সহিত সালাম জানিয়ে বললো,

— আমরা ভেতরে রাখছি আঙ্কেল।

একদম কিচেনে গিয়ে রাখলো সব। হেমন্ত শুধু শাশুড়ী’কে বললো,

— মা ঐ ব্যাগটাতে কাঁচা মাছ। ওগুলো ফ্রীজে রেখে দিন। কাটিয়ে এনেছি।

ভদ্র মহিলা খুবই সন্তুষ্ট মেয়ের জামাইয়ের উপর। ছেলে টা অনেক বুঝদার। এমন সংসারী, ভদ্র, নম্র ছেলে আজকাল মেলা মুশকিল। এই যে সে মেয়ের জামাই তার কি দায় মাছগুলো কাটিয়ে আনার? তবুও সে এই কাজ করবে। বাড়ীতে ছেলে না থাকায় যেই কাজ গুলো করা ঝামেলার তা সব হেমন্ত করে দিবে। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। যথাযথ সব কাজ সামাল দিতে সমস্যা হয় কিন্তু হেমন্তের মতো মেয়ে জামাই থাকাতে সেই কষ্ট লাঘব ঘটেছে। গত সপ্তাহে নিজে আসতে পারে নি তাই মানুষ দিয়ে বাজার পাঠিয়ে দিয়েছে। কোন দায় ছাড়াই সে এই কাজগুলো করছে।

হেমন্তের শাশুড়ী ঠান্ডা শরবত বানিয়ে দিতেই জৈষ্ঠ্য আর চৈত্র এক চুমুকে শেষ করে সোজা হেটে ভাবীর রুমে চলে গেল। অসহায়, লাচার ভাবে বসে রইলো হেমন্ত। বউটাকে সরাসরি দেখে না মাস হলো। ছুঁয়ে দেখা হয় না। ভাগ্য ক্রমে একটা দুটো চুমু ও খাওয়া হচ্ছে না।
শশুর শাশুড়ী’র সাথে দীর্ঘ সময় আলোচনা চললো। মেইন মুদ্দা অবশ্য পৌষরাত। ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রলোক যথেষ্ট বুঝদার। সবটা শুনে শুধু বললেন,

— ওর কপালে সুখ খুবই কম ছিলো হেমন্ত। যার মা, বাবা নেই আসলে তারা কোনদিন ই প্রকৃত সুখ পায় না৷ আমাদের পৌষ হয়তো এখন সুখ পাবে।

— ও মানিয়ে নিতে পারছে না। অভিমান ধরে বসে আছে। প্রথম দিন যখন দেখলো আমাকে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। আমার অনেক আদরের এই বোনটা৷ ফাস্ট কাজিন। মায়া বা টান যেটাই বলুন একটু বেশি।

— চিন্তা করো না বাবা৷ সময় মানুষ কে মানাতে শিখিয়ে দেয়। পৌষ নাদান। শিখে যাবে।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হেমন্ত এদিক ওদিক তাকালো। ওর শাশুড়ী একটু হেসে বললো,

— রেগে লাল হয়ে আছে। দেখো মানে কি না।

— কেন যে কথা বুঝে না।

— এসেছো না তুমি। তোমাকে দেখলেই রাগ পরে যাবে।

শশুরের মুখে এহেন কথা শুনে কিঞ্চিত লজ্জা পেলো হেমন্ত। পুরুষের এই লাজ বড়ই সুন্দর। হেমন্ত উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো তার প্রেয়সীর রুমে। ঢুকতেই দেখা মিললো খাটে গোল হয়ে বসা শ্রেয়ার দিকে। ঢোলা একটা ফ্রক পরে মাথায় ওরনা দিয়ে আছে মেয়েটা। গালটা ফুলেছে একটু। মোটা হয়েছে অল্পস্বল্প। হেমন্তর খারাপ লাগলো। বউটাকে দেখে না আজ ঠিক গুনে গুনে সাতাস দিন। মুখের কথা বুঝি এটা? ভিডিও কলে কি মন মানে? ইনি,মিনি একদম লেগে ঘেঁষে আছে শ্রেয়ার কাছে। এদের কথার ও জের সেই পৌষ’কে ঘিরে। মন খারাপ করে কথা বলছে শ্রেয়া।

হেমন্ত গলা খেঁকালো। শুধালো,

— বের হ সবগুলো।

সবগুলো দাঁত বের করে হাসলো। এরা জানে হুরুমতারুম করা হেমন্ত ভাই এখন ম্যাউ ম্যাউ করবে। যদিও তাদের ভাবী অতি নরম মানুষ তবে কেন জানি হেমন্ত ভাই তাকে আরো নরম মনে করে আগলে রাখে। কিছু পুরুষ ই থাকে এমন। এরা হয় অতি যত্নশীল। দায়িত্ববান। নিষ্ঠা পক্ষপাতমুক্ত। একদম হাসবেন্ড ম্যাটারিয়াল। একে একে সবগুলো হেমন্ত ভাইকে দেখে দাঁত কেলাতে কেলাতে বের হতেই ঝড়ের বেগে দরজা লাগালো হেমন্ত৷ তার অবশ্য দেড়ী হলো না জানালা লাগিয়ে একহাতে পর্দা ও টেনে দিলো।

শ্রেয়া তখন ও বসা খাটে। টলমলে চোখে তাকিয়ে সে। হেমন্তর বুকে ঝর উঠে গেলো মুহুর্তে ই৷ এক লাফে খাটে উঠে শ্রেয়ার কাছে চলে এলো সে। চোখের পানিটুকু পরার সুযোগ না দিয়েই দুই চোখ ভরে চুমু খেলো। পরণে থাকা শার্টটা খুলে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো শ্রেয়া’কে। শ্রেয়া ফুঁপিয়ে উঠলো। হেমন্ত অস্থির হলো। তার বুক চিনচিন করছে। রোজ কথা হতো তবুও আজ মনে হচ্ছে জনম বুঝি পেরিয়ে গেলো। শ্রেয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

— শ্রেয়ু কাঁদে না। বাবু প্লিজ কাঁদে না।

নরমমনা শ্রেয়া বড়ই স্বামী সোহাগী। এতগুলো দিন পর তার আগমনে রাগ পুষে রাখতে পারলো না সে। দুই হাত মেলে তার পিঠ আঁকড়ে ধরলো। হেমন্ত আলগোছে ওর ফ্রকটা খুলে দিলো। অতি যত্নে বিছানায় শুয়ে দিয়ে চোখ দুটো মুছে দিয়ে বললো,

— কাঁদলে ও কষ্ট ওতো কাঁদে শ্রেয়ু।

বলেই চার মাসের পেটটা’র দিকে তাকালো হেমন্ত। হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

— কেমন আছেন আপনি আব্বু?

— ও রাগ করেছে। আমাকে বলেছে কথা বলবে না।

— তাই?

বলেই পেট ভর্তি চুমু খেতে লাগলো হেমন্ত। এই সাতাশটা দিন যতগুলো আদর ছিলো সবগুলো পুষিয়ে দিয়ে হেমন্ত উপরে উঠে এলো। নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো শ্রেয়া’কে। নীরবে তাদের প্রেম চললো। সবটা চললো একদম নীবিড় ভাবে।
.
বুকের মধ্যে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে শ্রেয়া। ওর চুলে হাত চালাচ্ছে হেমন্ত। শ্রেয়া গাঢ় গলায় বললো,

— পৌষ টা রেগে আছে।

— হু।

— আপনি যান নি আর?

— গেলাম গতকাল। ঘুরিয়ে আবার বাসায় দিয়ে এলাম৷ জানো শ্রেয়ু মনে হলো আমার কলিজাটা কেটে রেখে এলাম।

শ্রেয়া’র চোখ গলিয়ে পানি পরলো। হেমন্তের বুক ভিজলো৷ শ্রেয়ার কপালে চুমু দিয়ে বললো,

— মন খারাপ করো না তুমি পাখি। জানো ই তো রাগ পুষে রাখতে পারে না ও। বড্ড জেদী কি না৷ মনে জমিয়ে রাখে না কিছু।

— আমি যদি বুঝতাম এমন কিছু হবে তাহলে এখানে আসতাম ই না।

— তোমাকে আসার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো ই এরজন্য যাতে এসবে তুমি স্ট্রেস না নাও।

— পৌষ’কে দেখতে যাব।

— এখন না।

— ওকে সত্যি টা বলেছেন?

— অর্ধেক।

হেমন্তের বুকে মাথা এলিয়ে রাখলো শ্রেয়া। তার আফসোস হয়। এক প্রকার জোর করে ই বাবার বাসায় এসেছিলো ও৷ শশুর থেকে অনুমতি নিয়েছিলো এক মাসের। আজ সাতাশ তম দিনেই হাজির তার জামাই। অনেক ভালোবাসে কি না৷ তাদের সেই ভালোবাসার অস্তিত্ব আসবে অতি শিঘ্রই। শ্রেয়া এতে খুব বেশি খুশি অথচ এই বাবুকে ঘিরে সবচাইতে বেশি পা*গল তো পৌষ। নামটা ও নাকি সে রাখবে।

___________________

তৌসিফ পৌষ’কে বাসায় নামাতেই হঠাৎ কল পেয়ে বেরিয়ে গেলো৷ খেয়ে দেয়ে এক ঘুম দিয়ে উঠলো পৌষ৷ রান্না ঘরে ঢুকে এক প্যাকেট চিপস নিয়ে বিশাল বড় ড্রয়িং রুমে আরামদায়ক কাউচে হাত পা উঠিয়ে বসলো। টিভিতে একটা কার্টুন চ্যানেল দেখতে দেখতে মুখে যতটা পারলো চিপস ঠুসতে লাগলো পৌষ। এভাবে মুখ ভরে চিপস না খেলে ওর শান্তি লাগে না।
আচমকা মিনু পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললো,

— এটা আমার টিভি দেখার সময়।

— দলিল দেখা।

মিনু নাক ফুলালো। সোহার রুমে গিয়ে বিচার দিলো,

— আপা টিভি দেখতে দিচ্ছে না।

সোহা হাতে লোশন লাগাতে লাগাতে বললো,

— এই আপদ যে কবে বিদায় হবে।

— আপদ আসতে দিলে কেন আপা?

— তুই বুঝবি না। চল।

সোহা ঘরে ও যথেষ্ট পরিপাটি হয়ে থাকে। আজও তাই। দামি পোশাক তার পরনে। সোহা একদম পৌষের সামনে দাঁড়ালো। আচমকা টিভির সামনে দাঁড়াতেই পৌষ চমকালো। মুখে চিপস থাকার কারণে কোন মতে বললো,

— কিইই?

— এই সময় মিনু টিভি দেখে।

মুখের টুকু শেষ করে পৌষ বললো,

— আমি কি ওর চোখ ধরে রেখেছি?

— এসব বাচ্চাদের জিনিস অফ করে ওকে দেখতে দাও।

— আমি এই বাড়ীর কে?

সোহা হকচাকালো এহেন প্রশ্নে। পৌষ নিজেই বললো,

— বউ আমি। তৌসিফ তালুকদারের বউ। চোখের সামনে থেকে গুনে গুনে দশ হাত দূরে যান।

সোহা দাঁত কটমটিয়ে উঠতেই হাতে থাকা রিমোট টা ছুঁড়ে পাশের কাউচে ফেলে পৌষ। উঠে চলে যায় অন্য দিকে। মিনু এসেই বাংলা সিরিয়াল চলালো। সোহা বসলো ওর পাশে।

পৌষ এদিক ওদিক হেটে সোহা’র রুমে নজর দিলো। এত ঝাকানাকা রুম দেখে ভেতরে ঢুকে ও। ঢুকা মাত্র ই অবাকের শেষ প্রান্তে পৌছালো ও। কোন কাজের মেয়ের রুম এতটা বিলাসিতা পূর্ণ কেন হবে? আলমারি খুলেও আরেকদফা চমকালো ও।
শক্ত চোয়াল করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। কিচেনে পুণরায় ঢুকতেই বুয়া এসে বললো,

— কিছু বানিয়ে দিব ছোট ভাবী? সন্ধ্যায় কি খান আপনি?

— চলো চা খাই।

বুয়া এক কাপ বসাতেই পৌষ বললো,

— আমরা তো টোটাল পাঁচজন আছি। চাচা সহ ছয়জন৷ ছয়কাপ বসাও।

বুয়া আশ্চর্য হলেও তা ই করলো। পৌষ মিনি টেবিলে চা নিয়ে বসতেই সোহা কোথা থেকে এসে বুয়ার সাথে ধমকে উঠলো,

— কখন পাসতা করতে বলেছি বুয়া? আমার গ্রীণ টি কোথায়? মিনু’র ক্ষুধা পেয়েছে।

পৌষ ই বুয়াদের বলেছে ওর সাথে চা খেতে। একা মজা লাগে না চা খেতে। সোহার আচরণে উঠে দাঁড়ালো পৌষ। উঁচু গলায় বললো,

— কোন সাহসে তাকে কাজের বুয়া ডাকো? নিজে কি খেয়াল আছে? বয়সে তোমার থেকে বড় উনি। উনি কেন তোমাদের কাজ করবে?

সোহা দাঁত চেপে বললো,

— তোমার সাথে কথা বলছি না আমি মেয়ে। চুপ থাকবে একদম।

পৌষ ওর হাতে থাকা চা ছুঁড়ে মা’রলো সোহা’র দিকে। ভাগ্য ক্রমে শরীরে লাগে নি। সোহা’র সাদা পোশাকে চায়ের দাগ বসে গেলো। এহেন অপমানে সোহা রাগে কটমট করে বলে উঠলো,

— বেজন্মা কীট কোথাকার। আজ বাসায় ফিরুক….

আর কিছু বলার আগেই গ্লাস ভর্তি পানি ওর মুখে মা’রলো পৌষ। সোহা’কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওর হাত ধরে টেনে দরজা খুলে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে বললো,

— তোর কাজ আজ থেকে এই বাড়ীতে নিষিদ্ধ। যা ভাগ *****।

একদম সেই মুহুর্তে ই তৌসিফ এলো। সিঁড়ি বেয়ে তারাতাড়ি এসে আশ্চর্য গলায় শুধালো,

— কি হয়েছে?

— বা*ল হয়েছে। এই *** ভাগান এখান থেকে নাহলে আজ একে….

বলতে বলতে রান্না ঘড়ে ঢুকে কিছু না পেয়ে ডাল ঘুঁটনি নিয়ে এলো পৌষ। এসেই তা ছুঁড়ে মা’রলো সোহা’র দিকে। তৌসিফ হতভম্ব হয়ে গেলো মুহুর্তে ই। সোহা এতক্ষণ না কাঁদলেও তৌসিফ’কে দেখে কান্নার সুর তুললো। তৌসিফ বিরক্ত হয়ে বললো,

— চুপ করো সোহা।

বলেই উদ্দীগ্ন গলায় পৌষ’কে বললো,

— হানি, কুল ডাউন। আমাকে বলো কি হয়েছে।

বলতে বলতে ভেতরে ঢুকলো তৌসিফ। পৌষ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো,

— একে এক্ষুনি বের করুন৷

বলেই তাকালো মিনু’র দিকে। মিনু ভয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। পৌষ দাঁত খামটি মে-রে বললো,

— এটাকেও বিদায় দিন। কত টাকা পায় দিয়ে এখনই বিদায় করবেন নাহলে আমি চলে যাব।

তৌসিফ বুঝলো পরিস্থিতি বড়ই এলোমেলো। পৌষ’কে টেনে ওখান থেকে রুমে নিয়ে দরজা আটকালো বাইরে থেকে। সোহা তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে। বুয়া’কে ইশারা করতেই পটপট করে সবটা বললেন উনি। তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

— যে যার রুমে যাও।

সোহা বাইরে থেকে দৌড়ে এসে রুমে ঢুকলো। মিনু ও গেলো আপা’র কাছে। তৌসিফ বুয়াকে বললো,

— পৌষ’র জন্য রাতে আজ খাসি রেঁধো তো বুয়া। সাথে নাকি ঘন ডাল পছন্দ করে।

— ছোট ভাবী আজকে নিজের হাতে আপনার জন্য পায়া দিয়ে বিরিয়ানি রেঁধেছে মামা। সারাদিন বাসায় এসে এসবই করেছে। বললো আপনাকে নাকি সারাদিন জ্বালিয়েছে তার রিটার্ন দিবে। অনেক সখ করে রেঁধেছে মামা। আজ যদি ওটা খেতেন।

বুয়া সঙ্কোচ নিয়ে বললো অথচ তৌসিফের মুুখে ভর করলো এক রাশ মায়া। মেয়েটার মন একদম ই পরিষ্কার। কোন ঝামেলা নেই। যা আছে ওর মুখে। আজ কিভাবে জানি হাত ও চালিয়ে দিলো।

সমান তালে দরজায় ধাক্কাছে পৌষ। তৌসিফ বুকে ফুঁ দিয়ে ঢুকলো ভেতরে। ঢুকা মাত্র ওর বুকে ধাক্কা দিলো পৌষ। তৌসিফ দরজা লাগিয়ে পৌষ’কে শান্ত করতে চাইলো। তবে আজ পানি যে মাথার উপর উঠে গিয়েছে তা বুঝে গেলো তৌসিফ। পৌষ সোজা গিয়ে নিজের ভার্সিটি ব্যাগ হাতে তুলে ফোন বের করলো। তৌসিফ এগিয়ে এসে ফোনটা কেড়ে নিতেই পৌষ চোখ রাঙিয়ে তাকালো। তেঁজী গলায় বললো,

— আমার দ্বারা আর সম্ভব না। এমন রং তামাশা দেখা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার ভুল ছিলো আমাকে বিয়ে করা। চোখের সামনে নোংরামি সহ্য করা সম্ভব না আমার দ্বারা।

তৌসিফ চোখ বুজে শ্বাস নিয়ে বললো,

— আমি তোমাকে বললাম ই তো।

— বিশ্বাস করি না।

— কি করতে পারি আর আমি?

— কাজের বুয়ার এমন বিলাসিতা! জাস্ট ওয়াও। এত দামী দামী কাপড়। আমাকে অন্ধ ভাবেন আপনি? আমি বুঝি না? আমি যা তা স্বীকার করি। স্বীকার করি আমি বেজন্মা….

তৌসিফ বাধ্য হয়ে ওর মুখ চেপে ধরে। লাল চোখে তাকিয়ে বলে,

— শান্ত থাকো।

ধাক্কা দিলো ওকে পৌষ। চিৎকার করে বললো,

— ডিভোর্স চাই আমার। আজ ই দিবেন৷ কাজের মেয়ে নিয়ে সুখে থাকুন আপনি।

“ডিভোর্স” শব্দ টা কানে বিঁধলো ওর। মনের কোণে বিঁধলো যেন। তীব্র বেদনায় ওর বুকে চাপ সৃষ্টি হলো৷ মুখে বললো,

— সংসার বাঁচাতে মিথ্যা বলা ও জায়েজ আমি নাহয় ওয়াদা ভঙ্গ করলাম।

পৌষ শুনতে চাইলো না। তৌসিফ’কে ঠেলে বের হতে নিলেই তৌসিফ বললো,

— সোহা আমার সৎ বোন হয় পৌষরাত।

#চলবে…..

রাত তখন প্রায় ১২টা। ক্ষুধায় পেট চু চু করতে লাগলো তাঁরার। কি খাবে কি খাবে করতে করতে উঠে বসলো। সোজা বসার ঘর পেরিয়ে ফ্রিজ খুলে ঘুটলো। কিন্তু তেমন কিছু পেল না। ভাত, তরকারি আছে কিন্তু গরম করে খেতে মন চাইলো না ওর। তাই এক বোতল ঠান্ডা পানি নিয়ে রুমে ডুকলো। আর কিছু না থাকলেও রুমে চাটনি আছে। সিদ্ধান্ত নিলো তাঁরা আজ নাহয় চাটনি আর পানি দিয়ে পেট ভরবে। মনে মনে শ খানেক গালি দিলো চাঁদকে। শা*লা কোন দুঃখে যে তাঁরার পিছনে বাঝে বুঝে না তাঁরা।
রুমে ডুকার পরপরই খট খট আওয়াজ হলো। তাঁরা তেমন পাত্তা দিলো না। আবারও খট খট আওয়াজ হতেই তাঁরা ভীতু গলায় বললো,
— ক..কে?
শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ ফিসফিস করে কেউ বললো,
— জানালা খুল।
ভীতু তাঁরা সিটিয়ে গেল। কে ডাকে এভাবে? ভুত টুত না তো?
অপর পাশ থেকে আবারও ডাক পরলো,
— খুলিস না ক্যান? থাপ্পড় খাবি?
তাঁরার ভয় ডর সবই চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে গেলো তখন শুনলো,” থাপ্পড় খাবি”। এ আর কেউ না চাঁদ ভাই। ভুত ডাকলেও খুলে দিতো তাঁরা কিন্তু চাঁদের ডাকে খুলবে না। এই লোক নিশ্চিত মারতে আসছে আবার। হঠাৎ ধারাম করে আওয়াজ হওয়ায় ভয় পেয়ে গেল তাঁরা। এবার চাঁদ চাপা ধমক দিয়ে বললো,
— অ্যাই দরজা খুলবি নাকি ভাঙবো আমি?
বলতে দেড়ী চাঁদের কিন্তু তাঁরার খুলতে দেরী হয় নি। দরজা খুলতেই চাঁদ জানালা টপকে রুমে ডুকে পড়লো। আবার বাইরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
— তোরা এখন যা। আমি কল করলে আসবি৷ বিপদ দেখলেই ডাক দিবি।
বলে জানালা লাগিয়ে দিলো। যেয়ে আবার দরজার খিল লাগিয়ে ভালোকরে তাকালো তাঁরার দিকে। ভয়ে পড়ার টেবিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে তাঁরা। চাঁদ নিজের হাতের ব্যাগ টেবিলে রাখলো। তাঁরার দিকে এগিয়ে গিয়ে পকেটে হাত গুজে বললো,
— তাকা।
তাঁরার কোন হেলদুল নেই। নিজের মতো কাঁপা-কাঁপি করতে ব্যাস্ত ও। এবার একটু চাপা ধমক দিয়ে চাঁদ বললো,
— তাকাতে বললাম না?

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৬

ফাটা বাঁশের চিপা বলা হোক বা মাইনকার চিপা তৌসিফ পরলো দু’টোর মাঝ বরাবর। না বেরুতে পারছে না টিকতে। দরজা কপাট আটকে ওর মুখোমুখি বিছানায় পা ভাজ করে বসেছে পৌষ। চোখ মুখে তার উপচে পড়া দুত্যি যার পুরোটাই ছড়াচ্ছে তৌসিফ’কে বড় মাপের এক আইক্কা ওয়ালা বাঁশ দেয়ার জন্য। পৌষ’র এহেন চকচকা চোখ তৌসিফ আজ অবদি দেখেছে বলে মনে পরলো না৷ মেয়েটার চোখে শুধু পানি, দুষ্টামি অথবা রাগের দেখা মিলতো। আজ তার কেন এত কৌতুহল? হওয়ার অবশ্য কথা কিন্তু তৌসিফের মনে হচ্ছে ভিন্ন কিছু। পৌষ’র এই একাগ্রতা শুধু মাত্র তৌসিফের সাথে সোহা’র কোন অবৈধ সম্পর্ক নেই এটা জানার জন্য। নারী যেমন ই না কেন তার স্বামীর সঙ্গে অন্য নারীকে সহ্য করবে না। প্রকৃতি তাদের সহ্য করার ক্ষমতা বেশি দিলেও তা ক্ষেত্র বিশেষে। স্বামী যতই খারাপ হোক না কিন্তু চরিত্রহীন মানতে নরাজ নারী৷
তৌসিফের কেন জানি ভালো লাগলো ব্যাপারটা। পৌষ’র উৎসুচক মুখটা দেখে মৃদুস্বরে হেসে বললো,

— হানি…..

— আপনার হানির কাঁথা পুড়ি। মুদ্দায় ফিরুন।

খটখটা গলায় পৌষ কথা বলতেই তৌসিফ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। শুধালো,

— আমার বাবাকে চিনো?

— নামে৷

— হু। তুমি ছোট ছিলে যখন মা’রা গিয়েছেন। হাফ প্যান্ট পরতা।

রাগে দাঁত কটমট করলো পৌষ। এসব শুনতে চায় নি ও। তবুও ধৈর্য ধরলো। মুখে শুধু বললো,

— আপনি এখনও পরেন। সেসব বাদ দিন৷

তৌসিফ একটু হেসে বললো,

— বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলো। আমরা কেউ জানতাম না পৌষরাত। কিন্তু বাবা যখন মা’রা গেলেন তার আগে শুধু আমাকে বলেছিলেন এই কথা। তার দ্বিতীয় পক্ষে একজন মেয়ে আছে। বড় ভাই বা মেঝো ভাই কেউ ওকে স্বীকার করলো না। অবশ্য বাবা ওর নামে যথেষ্ট সম্পদ ও রেখেছেন। ভাই রা এতে আপত্তি করে নি কিন্তু তারা কেউ সোহা’র দায়িত্ব নিতে নারাজ।

— বোনকে কাজের মেয়ের পরিচয়ে কেন রেখেছেন?

— আমি রাখি নি। আমি কখনো বলি নি কাজের মেয়ে। ভাবীরা ছড়িয়েছে এই কথা। প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেও লাভ নেই পৌষরাত। আমার দুই ভাই আগে। আপা আগে। তাদের সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হবে সোহা’কে নিয়ে কিছু বললে। বড় ভাইকে ওয়াদা দিয়েছিলাম সোহা’র বংশীয় সত্যি কাউকে জানাব না। আজ তা ভাঙতে হলো তোমার জন্য।

— তাই বলে আপনার গায়ে লাগে না যখন সবাই আপনার চরিত্রে আঙুল তুলে? আপন সৎ বোন নিয়ে কথা এসব নোংরা কথা বলে?

— আমার সামনে আজ পর্যন্ত কেউ বলে নি। ভাসা কথায় কান দেই না আমি।

— সব জেনেও আপনার ভাইয়া কেন চুপ করে থাকে? তাদের বংশের নাম নীচু হয় না এতে?

— নাম নীচু হবে যদি শুনে যে বাবা’র অবৈধ সন্তান আছে।

মৃদু কেঁপে উঠলো পৌষ। চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। তৌসিফ আচমকা পৌষ’কে নিজের দিকে টেনে নিলো। আচমকা এমনটা ঘটাতে চকমকানো সুযোগটা ও পেলো না পৌষ। তৌসিফ ওর চোখে আসা চুলগুলো যত্ন সহকারে কানের পিছনে গুজে দিতে নিলেই দেহ বাঁকিয়ে গেলো পৌষ’র। জানা নেই কেন এই লোকের স্পর্শ গায়ে লাগলেই কেমন জানি অনুভূতি হয় পৌষ’র। মনে হয় তারা সারা অঙ্গ আন্দোলিত হয়। বুকের মাঝে থাকা গভীর হৃদে পানির ঝলাৎ ঝলাৎ শব্দ হয়। তৌসিফ দুই হাতে পৌষ’র গাল সহ কান দুটো ও নিজের তালুর ভাজে নিয়ে নিলো। চোখে চোখ রেখেও নামিয়ে নিলো পৌষ। তৌসিফ গাঢ় কণ্ঠে বললো,

— তাকাও।

পৌষ সাহস যোগাতে অক্ষম হলো। কেন জানি হঠাৎ ই তার ভয় কাজ করছে। তৌসিফ ওর চোখে চোখ রাখার জন্য থুতনিটা তুলে ধরলো। পৌষ’র চোখ টলমল করছে। তৌসিফ এর কারণ জানে। এই অতিরিক্ত লাফঝাপ করা, চঞ্চল মনা প্রাণগুলো অতি আবেগী হয়। পৌষ’র মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আরেকটা সত্যি শুনবে পৌষরাত।

এবার কাজ হলো। সত্যি শুনার জন্য তাকালো পৌষ। তৌসিফ ওর থুতনির দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলে ধীরে ধীরে মুখটা আগালো। আলগোছে একটা চুমু দিলো ওর থুতিনিতে। পৌষ গললো এতেই। হাত বাড়িয়ে তৌসিফের কলারটা চেপে ধরলো ও। তৌসিফ মুখটা সরিয়ে নিয়ে বললো,

— তুমি কারো পাপ না পৌষরাত।

ফট করে চোখ মেললো পৌষরাত। অতি আগ্রহ ওর চোখে মুখে। তৌসিফ বললো,

— বড় ভাই ওয়াদা করিয়েছিলো আমাকে যাতে সোহা’র সত্যি কাউকে না বলি। সোহা’র মা’কে বাবা বিয়ে করেন নি। কোন এক অতীত আছে এর যা আপাতত না জানলেও চলবে তোমার। তবে হ্যাঁ ভাইয়া পুরোপুরি অস্বীকার করেন। কিন্তু আমি ছোট ছেলে হয়ে বাবা’র কথা অস্বীকার করতে পারি নি।

পৌষ ভাঙা গলায় বললো,

— আপনার বড় ভাইয়ের মুখে শুনেছি আমি জারজ।

— তুমি জারজ না পৌষরাত। তুমি শরৎ ফুপির মেয়ে। কিন্তু শরৎ ফুপি হয়তো……

“ফুপি” শব্দ শুনে ভ্রু কুঁচকায় পৌষ। শরৎ তার মায়ের নাম। তৌসিফ ওকে আরেকটু নিজের কাছে টেনে বললো,

— দাদা চারটা বিয়ে করেছিলো।

— জানি।

— সবচেয়ে ছোট বউয়ের ই এক মেয়ের নাম শরৎ। শরৎ তালুকতার।

পৌষ’র মাথা ঘুরে উঠলো। এত এত প্যাঁচ তার ছোট সাদামাটা মস্তিষ্কে ঢুকছে না। তবুও জিজ্ঞেস করলো,

— তাহলে জারজ সন্তান কেন বললো?

— ভাইরা সৎ কারো সাথেই সম্পর্ক রাখে নি। রাগের মাথায় হয়তো শরৎ ফুপিকে জারজ বলেছে। শুধু মাত্র সেই সম্পর্কের জেড়ে ই তুমি আজ আমার ঘরণী।

এত এত অতীত একসাথে শুনে ধাক্কাগুলো সামলাতে পারলো না পৌষ। আচমকা ঢলে পরলো বিছানায়। তৌসিফ দুই হাতে আগলে নিয়ে বালিশে মাথাটা রাখলো। এক হাতে গালে আলতো চাপড় মে’রে ডাকলো চিন্তিত কণ্ঠে,

— পৌষরাত? পৌষরাত?

পৌষ চোখ খুললো না। তৌসিফ অস্থির হলো এবার। এতগুলো অতীত একসাথে মেয়েটাকে না বললেও হতো। তবে কেন জানি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে এলো। বলতে বলতে সবটাই বলে দিলো নাহয় পৌষ বারংবার নিজেকে ছোট করে দেখতো। জারজ ভেবে তৌসিফ সহ সকল থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতো।

___________________

রাতের বেলায় ই বউ নিয়ে বাড়ীতে পা রাখলো হেমন্ত। যেমন জোঁকের মতো বেঝে ভাই-বোন গুলো সাথে গিয়েছিলো তেমন ভাবেই ফিরলো। এদের হই হুল্লোড় দেখে মনে হচ্ছে হেমন্তের চলন আজ। সেখান থেকেই বুঝি প্রথম বউ নিয়ে বাড়ী ফিরলো। কমতি অবশ্য একজনের আর তা হলো পৌষ। না জানি কেমন আছে মেয়েটা। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে কি না তাও জানা নেই। বাড়ীর বড়রাও শ্রেয়া’কে দেখে যেন মাথায় তুলে ফেললো। বাড়ীর একমাত্র বউ সে আপাতত মা চাচীদের পরে। অতি আদরের কি না। ইনি,মিনি ঘুমে লেটকে আছে। চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য ওদের চাচির কাছে দিয়ে দিতেই চাচি তারাতাড়ি দুটোকে রুমে রেখে এলেন৷ এই কুট্টি চুনোপুঁটি দুটো সারাক্ষণ বড় দামড়া ভাই,বোনের সাথে পাল্লা দিয়ে সব জায়গায় যাবে। মুখের জড়তা কাটে নি অথচ এরা ধেই ধেই নেচে বেড়াবে ভাই, বোনের সাথে।

রাতে যেহেতু শশুর বাড়ী থেকে খেয়ে এসেছে তাই এখন ওরা কেউ ই খাবে না। হেমন্ত হাজার না করলেও শাশুড়ী শুনে নি। অগত্যা তাদের খেয়ে দেয়ে এত রাতে বাড়ী ফিরা। বাপ-চাচাদের সামনে বউ নিয়ে রুমে যেতে পারছে না হেমন্ত। ডাক দিতেও কিছুটা সঙ্কোচ বোধ করছে। চৈত্র সবার সামনে একদম সটান হয়ে দাঁড়িয়ে তার সদ্য হওয়া পুরুষ কণ্ঠে বললো,

— ভাবী রুমে যেতে বলেছে হেমু ভাই। তোমার নাকি মেডিসিন আছে।

ভাইয়ের এহেন ডাহা মিথ্যা আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলো না হেমন্ত। শ্রেয়া উঠে যেতে যেতে মুচকি হাসলো। সে নিজেও ক্লান্ত।
.
রুমে ঢুকতেই দ্রুত হাতে দরজা কপাট লাগিয়ে শ্রেয়ার মাথার হিজাবটা খুলে দিলো হেমন্ত। মেয়েটার নিশ্চিত এতক্ষণ অসস্তি লেগেছে৷ হাজার খারাপ লাগলেও সে মুখ ফুটে বলে না৷ এটা ওর বহু পুরাতন স্বভাব যা হাজার বলে কয়ে হেমন্ত ঠিক করতে পারে নি। বোরকা খুলতেই ওয়াশরুমে ঢুকে শ্রেয়া। হেমন্ত যত তারাতাড়ি পারলো সব গুছালো। শ্রেয়া একটু অতিরিক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ওর জানা এখন এই মেয়ে পোশাক বদলাবে অথচ সবেই ঐ বাসা থেকে বদলে এসেছে। খুঁত খুঁতে না হলেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নিয়ে যথেষ্ট কড়া বলা চলে।

ওর জন্য একটা গোল ফ্রক আর প্রয়োজনীয় সব নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে হেমন্ত,

— শ্রেয়ু? তোমার কাপড়গুলো।

দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে নিলো শ্রেয়া। কাপড় বদলে বাইরে আসতেই হেমন্ত ও ফ্রেশ হলো। বের হতেই রুমের বাইরে পা রাখলো। কিচেনে ঢুকে গরম এক গ্লাস দুধ নিয়ে ফিরত এলো। শ্রেয়া তখন হাত পা গুটিয়ে বসেছে। হেমন্ত দুধ ওর মুখের সামনে নিয়ে বললো,

— এক টানে শেষ করো।

— পরে খাই?

— উহু। এখনই।

শ্রেয়া দুই চুমুক খেয়ে বললো,

— বাকিটুকু পরে খাই?

— এখন গন্ধ লাগছে না যতটুকু পারো খেতে থাকো প্রেয়ু। কিছুদিন পর যদি গন্ধ লাগা শুরু হয় তখন তো খেতে পারবে না।

অগত্যা সবটুকু গিলে খালি গ্লাস ফেরত দিলো হেমন্ত’কে। ওর ঠোঁটের উপরে লাগা দুধ টুকু হাত দিয়ে মুছে কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— গুড ওয়াইফ।

— ব্যাড হাসবেন্ড।

হেমন্ত লাইট অফ করে বিছানায় আসতে আসতে বললো,

— দাঁড়াও দেখাচ্ছি কিভাবে ব্যাড হাসবেন্ড হতে হয়।

শ্রেয়া হাসলো। হেমন্ত অতি নরম হাতে তাকে নিজের কাছে টানতেই জোরে শ্বাস টানলো শ্রেয়া। মুগ্ধ হওয়া চোখে তাকিয়ে দেখলো তার স্বামী’কে। চোখ জুড়িয়ে যায় যেন। হেমন্ত একটু হেসে বললো,

— কি দেখো?

— আপনাকে।

— সারাজীবন দেখতে পাবে।

— মন যে ভরে না।

হেমন্ত ওর চোখের পাতায় চুমু খেলো। হাত দুটো ধরে বললো,

— ভালোবাসি।

_____________________

তৌসিফের সম্পূর্ণ ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে পৌষ জ্ঞান ফিরার পর থেকেই এটা ওটা বলে যাচ্ছে। একটু খাওয়াতেই শক্তি পেয়েছে সে। আয়রন ডেফিসিয়েন্সি হওয়াতে এমনি সময়ই ওর মাথা ঘুরে। মেয়েটার স্নায়ু দূর্বল অথচ এর আচরণ বাঘা বাইন মাছের মতো। কাকে যে খাবে কাকে ছাড়বে নিজেও জানে না। তৌসিফ কপালে হাত দিয়ে ডলতেই পৌষ কড়কড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলো,

— এই যে কথা শুনেন না কেন?

— হানি, কথা শুনো৷

— আগে আমার কথা শুনুন৷ ওকে বিয়ে দিয়ে বিদায় দিন৷ না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশি।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তৌসিফ বললো,

— ও বাঁশি বাজাবে না পৌষরাত।

— কি সমস্যা আপনার হ্যাঁ? আর হ্যাঁ মিনু…..

— শুউউউ।

পৌষ একটু থামতেই তৌসিফ বললো,

— মিনু আমার বোন না৷

— কিহ!

— ওর বয়স দেখে মনে হয় ও আমার বোন?

— আপানার খানদান’কে বিশ্বাস নেই। কোন জায়গায় কাকে পয়দা করে রেখে লুকিয়ে রেখেছে কে জানে।

— মিনু’কে সোহা এনেছে। এতিম একটা মেয়ে। সোহা ই পেলে বড় করেছে। ওর মা থাকে গ্রামে।

ভ্রুঁ কুঁচকায় পৌষ। এত কাহিনি শুনে সে বিরক্ত। খটখটে মেজাজে বললো,

— আমি ওকে সহ্য করব না।

— আচ্ছা করো না।

— এএএই মামাতো ভাই।

বি’স্ফোরিত চোখে তাকালো তৌসিফ। এই মেয়ে নতুন শব্দ কোথা থেকে বের করলো? শেষ পর্যন্ত কি না ওকে ভাই ডাকে? মামাতো ভাই?

#চলবে…..