#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৭
পৌষ’র দাঁত বের করা হাসি চক্ষুগোচর হলো তৌসিফের। ওর দেহ মন চিৎকার করে বলছে, “পাপ করেছিস তৌসিফ, নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছিস তুই”।
কাজটা অবশ্য তা ই হলো। পৌষ’র এরেগেরে হেলেদুলে চলন ই বুঝ দিচ্ছে সে তৌসিফের খুব গভীর তথ্য বের করতে সক্ষম হয়েছে। তৌসিফ বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,
— এসব বলে না হানি। পাপ লেগে যাবে।
— লাগুক।
তৌসিফ বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,
— তোমাকে পাপ তো দূর একটা ফুলের পাপড়ির ছোঁয়া ও লাগতে দিব না আমি।
— এবার কথা শুনুন আমার।
তৌসিফ দাঁড়ালো আয়নার সামনে। সামনে সাজিয়ে রাখা এক গুচ্ছ জিনিস পত্র। তৌসিফ ওর রেগুলার মসচুরাইজারটা মুখে লাগাতে নিলেই পৌষ দুই লাফে ওর সামনে দাঁড়িয়ে হেয়ালি গলায় বললো,
— আপনি জানেন আমি যে সাবান দিয়ে মুখ ধুঁই এতেই বহু কষ্ট হয় আমার। আর আপনি ব্যাটা মানুষ এত কি ভংচং লাগাতে হয় মুখে?
তৌসিফ হাতে হ্যান্ড ক্রিম লাগাতে লাগাতে বললো,
— এই যে এত সুন্দর দেখো আমাকে তার গোপন রহস্য হলো রেগুলার জিম আর নিজের যত্ন করা৷ নাহলে আমার বয়সী মানুষদের দেখেই তুমি দৌড়ে পালাতে।
পৌষ পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে নিজেকে উঁচু করে তুললো যথেষ্ট খাটো কি না তৌসিফ থেকে। তৌসিফের নাক বরাবর আঙুল তুলে শাসিয়ে বলতে লাগলো,
— আমাকে কি ভেবেছেন আপনি? আপনার রুপ জৌলুশ দেখে এখানে থাকি আমি। বুইড়া দামড়া একটা। ধাঁচ দেখে মনে হয় কঁচি খোকা। তলে তলে যে টেম্পু চালান তা জানা আছে আমার।
তৌসিফ ওর আঙুলটাকে নিজের আঙুল দিয়ে পেঁচিয়ে নিলো। পৌষ’র মুখের সামনে নিজের মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
— আমার জন্য এখনো ভাইদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব আসে।
ঝটাক করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো পৌষ। ঠ্যাসকা মে-রে বললো,
— করুন না বিয়ে। দুটো তো করেছেন ই আর দুটো করে ফেলুন। চার রীতি পূরণ হোক। আমার বহু দিনের সখ সতীনের সংসার করব। তাদের আন্ডা বাচ্চা পালব।
তৌসিফ বেয়াক্কেল বনে গেলো। এই মেয়ে কথা মাটিতে পড়তে তো দিবেই না উল্টো মাটি সহ তৌসিফের মুখে ছুঁড়ে মা’রে। তৌসিফ একটু মিনমিন করেই বললো,
— সত্যি তুমি এমন ভাবো?
— ওমা! বলে কি ব্যাটা? চুলাচুলি, লাত্থি, উস্টা এসব আমার বহু পুরাতন শখ। বুকের ভেতর গেঁথে রেখেছি সব। আপনি বিয়ে করে আনুন। বটি নিজ দায়িত্বে ধার দিয়ে রাখব আমি।
এই মেয়ে যে কু’পাকু’পি করতে একটু ও পিছুপা হবে না তা জানা আছে তৌসিফের। কোন বংশের র’ক্ত ওর শিরা দিয়ে যায় দেখতে হবে না।
তৌসিফ ওকে নিজের কাছে ডাকলো কাউচে। পৌষ বাধ্য মতো গেলো অবশ্য। একটু দূরত্ব রেখে পাশে বসলোও। তৌসিফ গাঢ় দৃষ্টি ফেলে বললো,
— সোহা’র বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
হকচকালো পৌষ। ওর চোখ দুটো ভাবখানা এমন যেন চমলোক্কো কোন সংবাদ মাত্র সে শুনলো। নিজেদের মাঝে থাক দূরত্ব ঘুচিয়ে একটু ভাব জমানোর চেষ্টা করে বলে উঠলো,
— ফিরোজ ভাইয়ের সাথে?
খুক খুক কাশির শব্দ শুনা গেলো। ফিরোজ হলো তৌসিফের ড্রাইভার। ওর দুটো বাচ্চা আছে। সোহা’কে নাকি ওর সাথে বিয়ে দিবে? তৌসিফ অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো,
— দুই বাচ্চার বাপ ও। ড্রাইভার।
— তাতে কি? আপনার দাদা চারটা বিয়ে করলো। বোন ও কারো ঘরের দ্বিতীয় জন হোক। সমস্যা তো দেখি না৷ বংশীয় রিতী ধরে রাখতে হবে না যেমন আপনি সবে দুটো করে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
— শখে করি নি।
— বলা তো যায় না।
— তুমি এত কথা প্যাঁচাতে পারো।
— তো কোন নাল কাটা সাপ , মুখ পুড়া বান্দরের সাথে বিয়ে দিবেন সৎ বোনকে?
— ছেলেটা শিক্ষিত, মার্জিত। ভার্সিটিতে লেকচার আপাতত।
পৌষ গোল গোল চোখ করে তাকালো। মুখে বললো,
— চুহ চুহ। বেচারার জন্য আমার চোখ ভিজে উঠেছে। না জানি কোন ভদ্র ঘরে ভাদ্র মাসের উত্তাপ নিয়ে যায় আপনার বোন।
তৌসিফ উঠে বিছানায় যেতে যেতে পৌষ’র ও হাত ধরে টেনে নিলো। সোজা বালিশে ওকে ঠেলে দিতেই পৌষ চেঁচামেচি করে বলতে লাগলো,
— আমার মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মা’রতে চান আপনি।
— কিসব বলো তুমি।
— ব্যাটা খাড়া শয়তান।
তৌসিফ নিজের কপলে দুই আঙুল ঘঁষে বিরক্ত স্বরে বললো,
— কিসব ভাষা তোমার হানি? হোয়াট ইজ খাড়া শয়তান? শয়তান আবার খাড়া বা বসা হয়?
— হয়তো। যেমন আপনি।
তৌসিফ বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে লাইটটা অফ করে দিলো। বাথরুমের লাইট পাল্টে এনার্জি লাইট লাগিয়েছে পৌষ। রুমেরটার দিকে ও তার শয়তানী নজর আছে। না জানি কখন এটাও খুলে সাদা লাইট লাগিয়ে দেয়। কোন ভরসা নেই।
.
সবে হয়তো এক ঘন্টা গেলো। তৌসিফের চোখ বুজে আসছিলো। কুচুরমুচুর শব্দ কানে আসতেই ঘুম আলগা হলো। যথেষ্ট হালকা ঘুম হয় ওর। পাশে হাত রাখতেই যা বুঝার বুঝলো। পৌষ নেই। নিশ্চিত ক্ষুধা লেগেছে। ঠিক মিললো ওর ধারণা। তৌসিফের পায়ের দিকে খালি জায়গায় বসে কিছু খাচ্ছে ও। তৌসিফ উঠে বসলো। পৌষ অবশ্য পাত্তা দিলো না। তৌসিফ চোখ ডলে লাইট অন করতেই চোখ বুজে ফেললো পৌষ। তীব্র আলো চোখ সহ্য করতে পারলো না হুট করে। তৌসিফ ঘুমু গলায় বললো,
— চিপস খেয়ো না এত হানি।
— কেন টাকায় টান পরবে আপনার?
তৌসিফ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে বাইরে যেতেই পৌষ ও পিছনে গেলো। ফ্রীজ খুলে ঠান্ডা রান্না করা পাসতা ওভেনে দিলো তৌসিফ। গরম হতেই চামচ সহ পৌষ’র সামনে দিয়ে বললো,
— এখন থেকে রোজ রাতে কিছু থাকবে রান্না করা। আমি বলে রেখেছি বুয়া’কে। বুয়াদের ডেকে দিবে নাহয় আমাকে ডাকলেই গরম করে দিব।
— বুয়া বুয়া করেন কেন হ্যাঁ? বুয়া কি শব্দ? খালা বা আপা ডাকবেন।
— বুয়া মানে বোন ই।
— শুনতে কটু লাগে।
— অনেক বছরের অভ্যাস। সময় লাগবে।
পৌষ মুখে পাসতা পুরেছে ইতিমধ্যে চার পাঁচ চামচ। তৌসিফ ওর পাশের চেয়ারে বসে চিপসের প্যাকেটে হাত দিয়ে দুটো চিপস মুখে দিলো। পৌষ দেখলো তবে কিছু বললো না।
___________________
আকাশে আজ ভরপুর ঘন কালো মেঘ। রাত থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাতাস। রোমাঞ্চিত মুহুর্তটা প্রেমিক জুগলদের জন্য একদম উত্তম সময়। মৃদু মৃদু বাতাস যতটুকু পারছে ঘরের ফাঁকফোকর দিয়ে শুরশুর করে ঢুকছে। হেমন্তের বুকের ভিতরে একদম ঢুকে ঘুমাচ্ছে শ্রেয়া। যতটুকু ওম পাওয়া যায় তার সবটুকু ই সে শুষে নিচ্ছে তবুও যেন ঠান্ডা কমছে না৷ হেমন্তের দেয়া উত্তাপে ও কুলাচ্ছে না তার। নাক, মুখ সহ নিজে যতটা পারলো ঢুকলো। হেমন্ত ও পরম সোহাগে ওকে জড়িয়ে রাখলো নিজের সাথে। শ্রেয়া’র ঠান্ডা কমলো না। ঘুমের মাঝেই টের পেলো হেমন্ত। টেনে চোখ খুলতেই বুঝলো কিছুটা। ধীরে সুস্থে শ্রেয়া’কে রেখে উঠে আলমারি থেকে কাঁথা এনে ওকে ঢেকে দিলো। নিজেও পাশে শুয়ে জড়িয়ে ধরতেই শ্রেয়া’র ঘুম কিছুটা আলগা হলো।
হেমন্ত ওর মাথায় হাত রাখলো। চুলের ভাজে আঙুল চালাতে চালাতে বললো,
— ঘুমাও শ্রেয়ু। সকাল হয় নি।
— বৃষ্টি হচ্ছে?
— হু।
একটু এগিয়ে কপালে চুমু খেলো হেমন্ত। কাঁথার নীচ দিয়ে ই নিজের পুরুষ্টু হাতটা রাখলো শ্রেয়ার পেটে। ঘুম জড়ানো গলায় শ্রেয়া বললো,
— ও কিন্তু জেগে আছে।
— কে বললো?
— আমি বুঝি।
— ওর মা কেন ঘুমাচ্ছে না?
— দাড়ান জিজ্ঞেস করে দেখি।
হেমন্ত ওর গলায় মুখ লাগিয়ে বললো,
— দুষ্ট হচ্ছো দিন দিন।
— উমম।
এরপর ও প্রায় দুই ঘন্টা পর ওরা উঠলো। হঠাৎ ই দরজায় ছোট ছোট হাতের থাপ্পড় শুনা গেলো তাও একসাথে চারটা। হেমন্ত জানালা খুলতে খুলতে বললো,
— কি?
— বাই দরতা থুলো না।
ইনি,মিনি একসাথে বললো। শ্রেয়া মুখ মুছতে মুছতে দরজা খুলতেই ইনি,মিনি ঢুকলো। ওদের হাতের মুঠোয় চিতই পিঠা। শ্রেয়া ইনি’র গাল টেনে দিয়ে বললো,
— কি খায় ভাবীর জান?
ইনি,মিনি ঠোঁট দুটো গোল করে বললো,
— অনেত দাল।
হেমন্ত এসে দেখলো চিতই আর সাদা দেখা যাচ্ছে না। দুটো যে শুকনো মরিচ লাল দেখে ওটার ভর্তা ই নিয়ে এসেছে তা বুঝলো ও। ওদের হাত থেকে পিঠা নিয়ে নিজের মুখে দিয়ে বললো,
— চিতই কে বানাচ্ছে?
— মা আর চাচি বানায় হেমু ভাই। নিচে ডাকে।
পিহা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো। শ্রেয়া ওরনা মাথায় দিয়ে নিচে। ইনি,মিনি উঠলো হেমন্তের দুই কাঁধে।
গতরাতে যেহেতু বাচ্চারা কেউ বাসায় খায় নি তাই গরুর ভুনা বেঁচে গিয়েছিলো। সেটা আর ভর্তা দিয়ে আজ নাস্তা। চিতই খেতে খেতে আজ পাঁচটা খেয়েছে শ্রেয়া। হেমন্ত এবার একটু রাগ করলো। শ্রেয়ার মুখের সামনে গোশত ধরে বললো,
— আর একটু ও ভর্তা না। শরীরে র’ক্ত কম। গোশত খাও।
— এটা খাই শুধু ভর্তা দিয়ে।
হাতে থাকা অর্ধেক চিতই দেখালো শ্রেয়া। মানলো না হেমন্ত। চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য আজ চুপচাপ। দুই জন নিজেরা খাচ্ছে মাঝেমধ্যে ইনি,মিনি’র মুখে দিচ্ছে। বাবা’র সাথে কথা বলে না তারা। তাই এতটা সন্নাটা।
হেমন্ত এক পলক দেখেও কিছু বললো না। তার পরিকল্পনা ভিন্ন।
_________________
তৌসিফের ঘুম ভাঙলো মাত্র। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে সে। আঠারো তে এসি চলেছে সারারত সেই সাথে বাইরের আবহাওয়া। জানালার কাঁচসহ ভিজে উঠেছে। পাশে তাকাতেই দেখলো কাঁথা পেঁচিয়ে মুড়া দিয়ে এক কোণায় গুটিয়ে আছে পৌষ। যেকোন সময় খাট থেকে ও পরে গিয়ে গোল দিতে পারে। কাঁথা এমন ভাবে প্যঁচ দিয়েছে যে তৌসিফ যে নিবে তার জোঁ নেই। তৌসিফ ওকে ধরে সামনে আনবে তার আগেই কাঁথা নিয়ে এক মোচড় দিয়ে ধারাম করে নিচে পরলো। ধারাম করে এক শব্দ হতেই তৌসিফ ডেকে উঠলো,
— পৌষরাত!
কিসের বলতে কি পানতা ভাবে ঘি। পৌষ উঠেই খেঁকিয়ে উঠলো। তৌসিফ নাকি ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে। হতভম্ব তৌসিফ তবুও বউ’কে খাটে তুললো। কোমড় চেপে ধরে শুয়ে আছে পৌষরাত। তৌসিফ এই মুহুর্তে বলতেও পারলো না কমড় টিপে দেয়ার কথা। রেগে গেলে তৌসিফের গলা ই না টিপে দেয় সে। বিশ্বাস নেই এই মেয়ের।
পৌষ বালিশে মুখ গুজে উল্টো হয়ে শুয়ে থাকাতে তৌসিফ ভাবলো ঘুমিয়েছে। যেই না কোমড়ে হাত রাখলো ওমনিই যেন কারেন্টের শক খেলো পৌষ। তবে ব্যথা থাকার কারণে কিছু বললো না। তৌসিফ হালকা হাতে টিপে দিচ্ছিলো কিন্তু এক মিনিট যেতেই আর টিকতে পারলো না পৌষ। দিন শেষে সে এখন উঠতি যৌবনা এক নারী। বিশ বছর বয়সী পৌষ চাইলেও সামাল দিতে পারে না নিজেকে। সম্মুখের প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষটার কাছে বাজে ভাবে হেরে যায়।
পৌষ সরে গিয়ে মিনমিন করে বললো,
— লাগবে না।
— কেন?
— না বলেছি না। বেশি মন চাইলে রাস্তায় নামুন। দেখুন কোন মহিলা আছাড় খেয়ে কোমড় ভাঙলো। তাদের কোমড় টিপে দিয়ে আসুন।
তৌসিফ বিছানা ছেড়ে উঠলো। যেতে যেতে বললো,
— না জানি কোন পাপ করেছিলাম। কপালে জুটেছে একটা।
পৌষ হরিণের কানে শুনলো যেন। শুয়ে শুয়েই জোরে বললো,
— এএএই মামাতো ভাই। আমি জুটি নি। আপনি ধরে বেঁধে জুটিয়েছেন।
তৌসিফ ধারাম করে দরজা লাগিয়ে দিলো। চোখের সামনে সাদা আলোয় ঝলমলিয়ে উঠলো বিলাসবহুল ওয়াশরুমটা।
.
ভাঙা কোমড় নিয়ে খিচুড়ি বসিয়েছে পৌষ সাথে হাঁসের গোশত। টানা বৃষ্টি পরছে গতরাত থেকে। সকালে মন চাইলেও পরটা দিয়ে চা খেয়েই ক্ষ্যান্ত ছিলো ও। দুপুরে খিচুড়ি চাই ই চাই। তৌসিফ আজ বের হয়ে ও ফেরত এসেছে। রাস্তায় পানি উঠেছে। গাড়ি চলাচল সম্ভব না।
এই আবহাওয়াতে মিটিং সম্ভব নয়। তার শিপ আটকা পরেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। বারবার ফোনে ধমকা ধমকি করে যাচ্ছে। পৌষ তো চমকালো তখন যখন দেখলো রাগে তৌসিফ তালুকদার লাল হয়ে উঠেছিলো। লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা বলে কথা। পৌষ অবশ্য আজ নিয়ে তৌসিফকে রাগতে দেখলো দুই দিন। তাই ওই ড্রয়িং রুমে আর পা রাখে নি ও।
খিচুড়ি প্রায় শেষের দিকে। বুয়ার দিকে তাকিয়ে পৌষ বললো,
— আচ্ছা উনি খিচুড়ি খায় তো?
— জানি না তো ছোট ভাবী। সচরাচর রান্না হয় না।
তৌসিফের বর্তমান রাগ দেখে আজ আর জোর করে ওকে খিচুড়ি খাওয়াতে সাহস পেলো না পৌষ। তাই বুয়াকে বললো,
— তবুও ভাত রেঁধে রাখুন খালা। যদি পা’গলা কুত্তার মতো ক্ষেপে যায় তখন তো মুশকিল।
— পৌষরাত!!
তৌসিফের কণ্ঠ। বুকটা হঠাৎ ই ধুপধুপ ধুকপুক করতে লাগলো ওর। তাহলে কি শুনে নিলো তৌসিফ। আচমকাই কেন যেন ভয় হতে লাগলো ওর। না যাওয়াতে এবার উচ্চস্বরে ডাক পরলো। পরি তো ম’রি করে দৌড়ে গিয়ে পৌছালো পৌষ। তৌসিফ ল্যাপটপ থেকে নজর সরিয়ে বললো,
— খিচুড়ি রান্না করছো?
— হু।
— তোমার না শরীর অসুস্থ? আর করতে হবে না৷ রুমে যাও।
— একটু বাকি আছে।
— যেতে বলেছি।
হঠাৎ ধমক খেয়ে চুপসে ফাটা বেলুনের মতো মুখ হলো পৌষ’র। তৌসিফ দেখেও কিছু বললো না। এই মেয়ে একটা বাদর। লাই পেলেই গাছে উঠে বসে থাকে।
#চলবে…..
#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৮
দুপুর হলেও বৃষ্টির উৎপাৎ থামে নি। তৌসিফের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাদে এসেছে পৌষ। লোকটা এখনও হাউকাউ করছে ফোনে। বৃষ্টি’র ফোঁটা ক্রমশ বাড়ছে বৈ কমছে না। পৌষ আজ এই প্রথম তালুকদার বাড়ীর ছাদে এসেছে। বিশাল বড় এক ছাদ। সম্মুখেই মেইন রোড দেখা যাচ্ছে। ছোট বড় অসংখ্য চারা গাছে ভরপুর ছাদটা। মাঝখানে বিশাল বড় এক দোলনা। পৌষ’র মুখটা উজ্জ্বল হলো। ছাদে পা রাখতেই ঠান্ডা পানির বিন্দু গুলো সিক্ত করে তুললো ওর দেহ, মন। ছুটন্ত পা ওর চললো ও মধ্যখানে। দোলনায় বসতেই ভিজে চুপচুপা হয়ে গেল ও। এত ভারী দোলনা ও নড়াতে পারলো না। কাপল দোলনা এটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। এতটাই বড় যে তৌসিফ তালুকদারের দাদা চার বউ নিয়ে উঠে দোল খেতে পারবে।
মাথায় আজগুবি সকল ধারণা হানা দিলো পৌষ’কে। দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ালো ও। এদিক ওদিক ছুটতে ছুটতে ভিজে একাকার হলো।
.
বেশ সময় পর তৌসিফ ডাক দিলো পৌষ’কে। ওর পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই যেই না হাত বাড়াবে তখনই ওর নজর যায়। সোহা দাঁড়িয়ে। বিরক্ত বোধ করলো তৌসিফ। মাত্র ই তো হাত ধরে টেনে কাছে নিতো। তখন ধমকে দেয়াতে মুখটা চুপসে ছিলো। ওর চটপটির মতো চটপটা বউটার ওমন মুখ বুঝি মানায়? উহু। মোটেও না। সোহা’কে দেখেই তৌসিফ যেই না উঠে দাঁড়ালো ওমনিই সোহা বলে উঠলো,
— একটু কথা ছিলো।
— বলো।
— আমি বিয়েটা করতে চাই না।
— কারণ?
— আমি চাইছি না এটাই কি যথেষ্ট নয়?
— না।
সোহা ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। অতঃপর কিছু বলতে উদ্যোত হতেই তৌসিফ বলে উঠলো,
— তোমার নিজে চলার যথেষ্ট মাধ্যম আছে। আরো প্রয়োজন হলে আমি আছি। দিব। কিন্তু যদি বিয়ে না করো তাহলে আমার বাসায় আর থাকা সম্ভব হবে না তোমার। পৌষরাত পছন্দ করে না তোমাকে। এন্ড ইউ নো……
— জানি। তবে এটা আমার বাবা’র বাসা…..
চোখ গরম করে তাকায় তৌসিফ। সোহা সহসা মাথা নামিয়ে নিলো। তৌসিফ তিরস্কার করে বললো,
— তোমার বাবা’র বাসা? হাসালে সোহা। আমাকে খারাপ রুপে দেখতে চেয়ো না। যা দিয়েছি তাতেই শুকরিয়া করো। পৌষরাত থেকে দূরে থাকো। আর হ্যাঁ যদি ওর কানে উল্টো পাল্টা কিছু ভরেছো তখন তুমি দেখবে আমার বিশ্রী রুপ।
সোহা দাঁড়ালো না আর এক সেকেন্ড ও। পা ঘুরিয়ে চলে যেতে নিলেই তৌসিফ বলে উঠলো,
— অর্ণব আসলেই তোমার সাথে দেখা করবে। হয় সোজা ইজ্জত সহিত শশুর বাড়ী যাবে নাহয় এই বাড়ী ছাড়বে আজীবনের জন্য।
সোহা আর দাঁড়ালো না। তৌসিফ গা ছাড়া ভাব নিয়ে রুমে গেলো। নাহ্। ওর খাট্টামিঠা বউটা নেই। ওয়াশরুম ও খালি। কিচেনে বুয়াকে জিজ্ঞেস করলেও সে জানালো তখন ধমক খেয়েই পৌষ রুমে ঢুকেছিলো। তাহলে কোথায় গেলো তৌসিফের বউ? এদিক ওদিক কোণা কোণা খুঁজলো তৌসিফ। বাইরে যে বৃষ্টি নীচে তো যাওয়ার কথা না। ফোনটা হাতে নিয়ে সিসিটিভিতে এক নজর দিতেই দেখলো চোরের মতো বেরিয়েছে পৌষ। উঠেছে সিঁড়ি দিয়ে উপরে।
বউ খুঁজে পেয়ে শান্তি পেলো ও। নিজেও ছুটলো ছাদের দিকে। যাওয়া হয় না অনেকদিন।
ছাদের গেট টা বিশাল বড়। সাইড দিয়ে ঢুকতে নিলেই তৌসিফ আটকে গেলো। বড়সড় দুটো ফাঁকা ঢোক গিললো। তৌসিফ নিজেই পৌষ’র জন্য কাপড় চোপড় এনেছিলো। মেয়েটা অভিযোগ করে নি এই পর্যন্ত। ওর পরণে এখন ও পাকিস্তানী ঢোলা এক কামিজ। গায়ের সাথে সেটে আছে ওরনাটা। দুই হাত মেলে চঞ্চলা মেয়েটা এদিক ওদিক ঘুরঘুর করছে। ওর শরীরের দিকে তাকিয়ে এই প্রথম বোধহয় তৌসিফের আকাঙ্খা জাগ্রত হলো। মেয়েটার জন্য ওর ভালোবাসার অঙ্কুরোদগম শুরু করলো বুঝি। সারা শরীর অবস হতে চাইলো। তরতাজা পুরুষ মন যেন হঠাৎ ই যুবকে পরিণত হলো। তৌসিফের ভীষণ মন চাইলো প্রেম করতে। এই মেয়েটার প্রেমে পরতে। এর প্রেমের সুধা পান করার তীব্র বাসনা জেগে উঠলো হৃদপিণ্ডে।
কখন যে পা চলা শুরু করলো আর কখন যে ও পৌষ’র কাছে এলো তা টের পেলো না কেউ। একদম ওর পিছনে এসে দাঁড়ালো তৌসিফ। ওর শক্তপোক্ত হাতটা ধীরে ধীরে ছুঁয়ে দিলো পৌষর মেদহীন কোমড়। আচমকা স্পর্শে আগুনের মতো জ্বলে উঠলো পৌষ। পিছনে না ঘুরেই ধাক্কা মা’রলো তৌসিফকে। পিচ্ছিল হওয়াতে তৌসিফ পরতে পরতে যেই না পৌষ’কে ধরলো ওমনিই দু’জন একসাথে পরলো। জমা পানিতে দু’জন একসাথে পরাতে ঝপাৎ করে শব্দ হলো। পৌষ খ্যাঁক করে উঠলো,
— লুচ্চামি করার জায়গা পান না? কোথা থেকে উদয় হলেন আপনি? জান গলায় এসে পরেছিলো।
বলেই হা করে দেখালো। তৌসিফ মুগ্ধ নয়নে মুখের ভিতর উঁকি দিলো। দেখার চেষ্টা করলো পৌষ’র জান। তবে আফসোস দেখা গেলো না। পৌষ’র উঠার তাগাদা দেখা দিলো না। এদিকে তৌসিফ ও ওকে নিজের উপর থেকে সরালো না। তৌসিফের দেহের উপর উঠে আছে ও। তৌসিফ হঠাৎ ই জিজ্ঞেস করলো,
— রেগে আছো?
— না তো।
— বৃষ্টিতে ভিজছো যে?
— মন খারাপ থাকলেই কি মানুষ বৃষ্টিতে ভিজে?
— জানি না তো।
— উঠবেন না?
— মন চাইছে না।
ঠান্ডা ক্রমশ বাড়ছে। বৃষ্টি ও পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো। পৌষ’র ও যেন কিছু হলো। ও মাথা এলিয়ে দিলো। তৌসিফ দুই হাতে ওকে জড়িয়ে ধরলো।
এই তীব্র বর্ষণ উপেক্ষা করে দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষ ছন্দে বিমোহিত হচ্ছে। মনে জাগ্রত কামনা বা বাসনা কোনটাই প্রকাশে তারা ব্যার্থ।
অল্প অল্প বিদুৎ চমকাতেই পৌষ উঠতে চাইলো তবে তৌসিফ ছাড়বে না। ও দুই হাতের বেষ্টনী আরো দৃঢ় করলো। পৌষ এবার মুচড়া মুচড়ি জুড়ে দিলো। তৌসিফ নরম সুরেই বললো,
— আরেকটু থাকো না পৌষরাত।
পৌষ বুঝি মানার মেয়ে? নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর আগেই ওর মুখ ছুটলো রেলের গতিতে,
— আপনি তো মিয়া বহু ঢিলা। এই ছাদে টাংকির পিছনে প্রেম পিরিতি করতেন নিশ্চিত আগে। তাই না? কি ভেবেছেন আমি বুঝব না?
তৌসিফ ওকে ছেড়ে দিতেই উঠে দাঁড়ালো পৌষ। এক হাত বাড়িয়ে দিলো তৌসিফের দিকে অথচ দু’জন ই জানে পৌষ ইহকালে টেনে ওকে তুলতে পারবে না। তৌসিফ অবশ্য হাতটা ধরলো। নিজে উঠে দাঁড়িয়ে পৌষ’র গাল দুটো ধরে বললো,
— টাংকির পিছনে যাওয়া আমার অভ্যাস না। আমি যা করি খোলামেলা ই করি। মুক্ত গগনতলে।
বলতে বলতে পৌষ’র থুতনিতে চুমু দিলো। কাজ অবশ্য হলো। মাথাটা নিচু করে নিলো পৌষ।
তৌসিফ বেশ উপভোগ করে এই মুহুর্তটা। পৌষ সরে গেলো ওর সামনে থেকে। পৌষ’কে দোলনায় বসতে দেখে তৌসিফ ও ওই দিকে পা বাড়ালো। দোলনা পেছন থেকে দুই হাতে ঠেলে দিলো। মুখে হাসি ফুটলো পৌষ’র। উচ্ছসিত গলায় শুধু বললো,
— আরো জোরে দিন।
___________________
বৃষ্টি আজ না কমার প্রতিশ্রুতি নিয়েছে। প্রায় দেড় ঘন্টা বৃষ্টিতে ভিজেও মন ভরে নি পৌষ’র। অবশেষে না চাইতেও ধমকে নিয়ে এসেছে তৌসিফ। সেই থেকে মুখ পেঁচার মতো করে রেখেছে ও। আপাতত ওয়াশরুমে ঢুকে আর বের হচ্ছে না। ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম এবার। ওয়াশরুম যদিও আরো আছে তবুও দরজায় নক করলো ও,
— পৌষরাত? হানি? হলো তোমার?
— হয়েছে তো সেই কখন।
— আশ্চর্য তাহলে বের হচ্ছো না কেন?
— জামা কাপড় আনার সুযোগ দিয়েছিলেন আপনি? খেউ খেউ করে ভেতরে ঠেলে দিলেন।
তৌসিফ নিজের কপালেই আলতো চাপড় মা’রলো। জীবন পার হয়ে যাবে পৌষ’র ভাষা ঠিক করতে করতে। এই মেয়ে কবে সুধরাবে?
ওকে অপেক্ষা করতে বলে তৌসিফ আলমারি খুলে এক সেট কাপড় নিয়ে দরজায় টোকা দিলো,
— হানি খুলো।
— কেন?
— ড্রেস নাও।
দরজা খুলে একটু ফাঁক করলো পৌষ। এক চোখ দিয়ে উঁকি দিয়ে ছিনিয়ে নিলো কাপড়। ঝাঁঝালো কণ্ঠে একটু পরই পৌষ চিল্লিয়ে উঠলো। তৌসিফ দরজায় নক করলো পুণরায়। পৌষ না খুলেই দাঁত কটমট করে বললো,
— আমি বলেছি এসব ধরে দিতে?
— কিসব?
— ন্যাকা সাজলে একদম মুখের উপর ফেঁকে মা’রব।
তৌসিফ হঠাৎ বুঝলো। স্বাভাবিক গলায় ই বললো,
— ওহ। আরে তোমার তো লাগবেই তাই না?
— চেয়েছি আমি? ব্যাটা খাটাস! নিলজ্জ! মেয়েদের জিনিস হাতাহাতি করতে মন চায় তাই না? আন্ডার গার্মেন্টস এর ফ্যাক্টরী খুলে নিন তাহলেই তো হয়।
তৌসিফ বেয়াক্কেল বনে গেলো। দরজা খুলে বের হলো পৌষ। তৌসিফ’কে দেখে ও না দেখার মতো করে চলে গেল সাইড কেটে। তৌসিফ ওয়াশরুমে ঢুকেই দেখলো একদম গোছানো ওয়াশরুম। মেয়েলী ঘ্রাণে ভরপুর। এমনিতে এলোমেলো পৌষ ওয়াশরুমের ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোর। রোজ পরিষ্কার করাতে হবেই হবে।
.
খেতে বসা মাত্র ই তৌসিফে’র জন্য আলাদা ভাত আনা হলো। কপাল কুঁচকে তৌসিফ বললো,
— পৌষরাত না খিচুড়ি করেছে।
–জ্বি মামা কিন্তু আপনার জন্য ভাত করতে বললো।
— খিচুড়ি ই খাব।
পৌষ ততক্ষণে রান্না ঘর থেকে এলো। ওর হাতে একটা বাটি। খেতে বসতেই তৌসিফ বললো,
— আমাকে বেড়ে দাও।
এমন আবদার তার মুখে আজ এই প্রথম। একদম ই নতুন। নিজের টা নিজেই নিয়ে খায় ও। পৌষ অবশ্য ভাত দিতে নিলেই তৌসিফ বললো,
— খিচুড়ি দাও হানি।
পৌষ’র মুখে হাসি ফুটলো৷ নিজ হাতে বেড়ে দিলো৷ পৌষ নিজেরটা নিয়ে বসতেই তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,
— বাটিতে কি?
— খাবেন?
— কি সেটা তো বলো।
— শুকনো মরিচ এর ভর্তা। একদম ফটাফট করে এনেছি।
ভর্তা’র ঘ্রাণেই মুখে পানি এলো ওর। কাঁচা পেঁয়াজ, ধনিয়াপাতা আর ভাজা শুকনো মরিচ লবন আর সরিষার তেল দিয়ে মেখে দুই মিনিটে বানিয়ে এনেছে পৌষ। তৌফিক একটু মুখে দিতেই নাক,কান জ্বলে উঠলো ওর। পৌষ’র দিকে তাকাতেই দেখলো দিব্যি খেয়ে যাচ্ছে ও। এই মেয়ে যে একটা ঝাল খোড় তা এতদিনে জানলো তৌসিফ। মনে মনে বললো,”আমিও তো বলি এত তেঁজ আসে কোথা থেকে”।
#চলবে…..
#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৯
— আপনার আওতা বোন আপনাকে ভাই ডাকে না কেন?
“আওতা” শব্দটা কেমন শুনালো? তৌসিফ ল্যাপটপ থেকে নজর সরিয়ে বললো,
— আওতা বোন?
— সোহা। কেন ভাই ডাকে না আপনাকে?
তৌসিফ উত্তর দিলো না। দুটো মেইল পাঠাতে হবে তার। একটু দরকারি। মেইল পাঠাতে পাঠাতে পৌষ’র জহুরী চোখ ও দৃষ্টি কাড়লো ওর। পৌষ চোখ দুটো একদম ছোট ছোট তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তৌসিফ দ্রুত আঙুল চালালো কিবোর্ডে। এই মেয়ে প্রশ্ন যেহেতু তুলেছে উত্তর ও তার চাই।
পৌষ আধ শোয়া হয়ে বসা কাউচে। একটা ছোট বোলে করে কাজু খাচ্ছে সে। তৌসিফ কাজের ফাঁকে হাত বাড়িয়ে একবার একটা তুলে মুখে দিলো। মজাই লাগলো। সল্টি একটা টেস্ট। মেইল সেন্ড করে ল্যাপটপটা পাশে রেখে বাটিতে আবার হাত দিতেই পৌষ বাটি সরিয়ে নিলো। তৌসিফের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বললো,
— খেতে মন চাইলে নিয়ে আসুন। আমারটা কেন খাচ্ছেন? ছোঁচা।
— কে ছোঁচা?
— কে আবার? আপনি।
বলেই মুখ ভেঙালো পৌষ। তৌসিফ জোর করে বাটি থেকে দুটো কাজু নিয়ে মুখে দিতেই বিজয়ের হাসি হাসলো। পৌষ মুখ ঝামটা দিতেই তৌসিফ ও ভেঙানোর মতো মুখ করলো। পৌষ দুই হাত কানে দিয়ে আঙুল নাড়িয়ে বললো,
— ভেঙালে ব্যাঙ খায়, ম’রা গরুর ঠ্যাং খায়।
পৌষ’র এহেন কথায় তৌসিফের মুখটা ছোট হয়ে এলো। এসব আজগুবি সকল বাক্য কোথা থেকে শিখেছে এই মেয়ে?
তৌসিফ হঠাৎ ই খেয়াল করলো বউ ওর দিকে এগিয়ে আসছে। হাবভাব মোটেও ভালো ঠেকলো না। কাছে আসা ভালোবাসার বউ তো তার না। তাহলে এই আলগা পিরিত কেন দেখানো হচ্ছে তাকে। ডালে যে কালো আছে বুঝে গেলো তৌসিফ। এক ইঞ্চি ফাঁকা রেখে বসলো পৌষ। তৌসিফ নিজের সকল ভাবনা দমন করে প্রশ্ন করলো,
— কিছু বলবে হানি?
— হ্যাঁ ক্লোজ আপের এড দিব।
— না, এত আদর লাগাচ্ছো যে।
কটমট করে তাকিয়ে পৌষ বলে উঠলো,
— কোথায় আদর লাগালাম আমি হ্যাঁ? দুই চারটা চুমু দিয়েছি নাকি রাস্তার মোড়ে থালা হাতে বসে তৌসিফ তৌসিফ করেছি? মিথ্যা কেন বলেন?মিথ্যুক লোক? চাপা মা’রার জায়গা পায় না।
যতটুকু ও কাছে এসেছিলো তার থেকে তিন হাত দূরে গিয়ে বসলো পৌষ। তৌসিফ দিনে রাতে আর কত চমকাবে? আর কত অবাক হবে? তার এই অবাক হওয়ার দিন কি আদৌ শেষ হবে? কবেই বা শেষ হবে? যাকে আশেপাশে র সকলে ভয় পায়, যার সামনে মুখ তুলে সত্যি টা অবদি বলে না তাকে যে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায় এই এতটুকু পৌষ তা কি কেউ জানে? জনগন কি আদৌ মানবে এ কথা? লাগামটা ও হাত ছাড়া করে না। অন্য কেউ হলে তৌসিফ হয়তো হাত তুলে ফেলতো এতক্ষণে তবে কেন জানি পৌষ’কে তার ধমকটাও দিতে কষ্ট হয়। এই মায়াবী মুখটা ধমকের উপযুক্ত না। এই মুখে শুধু আদর মানায়।
নিজেকে বেহায়া উপাধি দিয়ে আগ বাড়িয়ে পৌষ”র কাছে গেলো তৌসিফ। বাটি থেকে দুটো কাজু নিতে নিতে আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলো পৌষ’র গাল। ডাকলো মিষ্টি কণ্ঠে,
— পৌষরাত?
পৌষ মৌন রইলো। তার উত্তর চাই। তৌসিফ জানে, বুঝে তাই বললো,
— যাকে তুমি ভাই মানো না তাকে কেন ডাকবে?
চকিত দৃষ্টি ফেলে চাইলো পৌষ। তৌসিফ একটু হেসে বললো,
— সোহা কোনদিন ই আমাকে ভাই বলে ডাকে নি। এর হয়তো কারণ আছে বা হয়তো নেই। সম্পর্কে ভাই-বোন হলেও তা আদৌ কতটুকু আছে জানি না। সে ডাকে না। আমি জোর করব কেন? আমার আপন ভাই আছে। বোন আছে। এমনটা কিন্তু নয় সোহা জানে না বাইরের লোক ওকে কাজের মেয়ে ভাবে। ও জানে কিন্তু ভাবীদের সাথে তর্কে গেলেই ভাইরা কেউ চুপ থাকবে না। মূল কথা হলো আশ্রয় কেউ ছাড়তে চায় না। ও এখানে আশ্রয় পেয়েছে তাই ছাড়তে চায় না।
— তাই বলে নোংরা অপবাদ শুনবে.?
পৌষ’র কথার প্রেক্ষিতে আর কথা বললো না তৌসিফ। পৌষ তাকিয়ে রইলো ড্যাবড্যাব করে। বুঝার চেষ্টা করলো তৌসিফের মনোভাব। কিছুতেই সক্ষম হলো না ও। এই লোকের মন আর মস্তিষ্ক আদৌ এক ভাবে কি না কে জানে।
উঠে যেতে যেতে কিছু কাজু তৌসিফ’কে দিয়ে বললো,
— কাল আবার আনবেন কাজু।
— কাজের লোক কাউকে বললেই হবে। এনে রাখবে?
পৌষ’র মনটা কিন্তু ভালোই ছিলো কিন্তু ওর মাথা খারাপ করে দিলো। খটখটে মেজাজে পৌষ বললো,
— আমি কি কাজের লোককে বিয়ে করেছি? বিয়ে করেছেন আপনি। চুমু খান আপনি তাহলে আমি কেন কাজের লোককে বলবো আমাকে বাদাম এনে দিতে? এখন কি যাব কাজের লোকের কাছে?
বলতে বলতে উঠে গেলো পৌষ। তৌসিফ হকচকিয়ে গিয়ে তারাতাড়ি টেনে ধরলো ওকে। একদম কোলে বসিয়ে কোমড়টা চেপে ধরতেই বাইন মাছের মতো তিড়িং বিড়িং শুরু করলো পৌষ। ঝাঁঝালো গলায় বললো,
— এক নাম্বারের লুইচ্চা আপনি। বিয়ের দিন ও আমার কোমড়ে চেপে ধরেছেন। ছাড়ুন বলছি। একদম কামড়ে ধরব বলে দিলাম।
বলতে বলতে তৌসিফের বাহুতে সত্যি ই কামড়ে ধরলো পৌষ। তৌসিফ আচমকা হামলায় হাতটা আলগা করতেই দুই লাফে সরে গেলো পৌষ। দরজার কাছে যেতে যেতে বললো,
— কাজের লোক ডেকে তার কোলে উঠব এখন।
বলে সত্যিই বেরিয়ে গেলো পৌষ। তৌসিফের বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। যেই ছ্যাড়াব্যাড়া বউ ওর বলা তো যায় না সত্যি যদি কারো কোলে উঠে বসে? হায় আল্লাহ! এই মেয়ে এমন কেন? লাই পেয়ে এখন তৌসিফের কাঁধে উঠে নাচছে। তৌসিফ তারাতাড়ি দৌড়ে বের হলো। পৌষ সত্যি ই মেইন দরজার দিকে যাচ্ছে। পিছন থেকে গিয়ে ওর বাহু টেনে ধরতেই পৌষ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। তৌসিফ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললো,
— ভালো কি তুমি হবেই না?
— আপনি হতে দিলে তো।
পৌষ পায়ের উপর পা তুলে সোফায় বসে নবাবের মতো বললো,
— টিভির রিমোট টা দিন।
তৌসিফ গিয়ে রিমোট দিতেই টিভি অন করলো পৌষ। কার্টুন চ্যানেল ছেড়ে দেখতে দেখতে পা নাচাচ্ছে ও। তৌসিফ বসলো একদম ওর পায়ের কাছে। পৌষ একটু ভদ্রতা দেখালো। পা নামিয়ে নিলো। বয়সে হলেও বড়। চাপা যথেষ্ট নাড়ালেও পা তুলে বসাটা একটু ভিন্ন দেখায়। ও পা নামাতেই আচমকা তৌসিফ ওর পা ধরলো। পৌষ’র শ্বাস আটকে গেলো। স্নায়ু বুঝে উঠার আগেই যেন ও পা সরাতে চাইলো তবে পারলো না। তৌসিফ ছাড়ে নি। নিজের কোলের উপরে পা রেখে বললো,
— থাকুক।
— না। ছাড়ুন।
বলতে বলতে পৌষ উঠে বসার চেষ্টা করলো। তৌসিফ সত্যি ই পা ছাড়লো না। ফর্সা পা দুটো নিজের হাত দিয়ে কোলে ধরে রাখলো। পৌষ’র দম আটকে যাবে যাবে ভাব। তৌসিফে’র পুরুষ হাত দু’টোর বিচরণ ওর পায়ে। পায়ের তালুতে ছোঁয়া দিতেই শিরশির করে উঠলো ওর বদন। একে একে প্রতিটা আঙুল নেড়ে চেড়ে দেখলো তৌসিফ। নরম তুলতুলে পা দুটো। পৌষ’র পা দুটো অত্যধিক ফর্সা। চোহারা থেকে হাত পা বেশি ফর্সা মেয়েটার। ন্যাচারাল সৌন্দর্য হয়তো এটাই। হাত পা দেখেই বুঝা যাচ্ছে এই মেয়ে মুখের যত্ন নেয় না। পৌষ কাতর গলায় বলে উঠলো,
— প্লিজ পা ছাড়ুন।
— বাট হোয়াই হানি?
— প্লিইইজ।
তৌসিফ তবুও ছাড়লো না। ওকে তো কম জ্বালায় না। তৌসিফ ও বদলা নিবে তবে ভিন্ন উপায়ে।
হঠাৎ ওর দিকে একটু এগিয়ে এসে তৌসিফ শুধালো,
— ক্যান আই টেস্ট হানি?
পৌষ’র চোখ মুখ শুকিয়ে এলো। গলাটা পানির অভাবে খা খা করছে। মন চাইছে তৌসিফের মাথাটাই চিবিয়ে নিতে। একবার তো এমন হলো ও। মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন জিনিস কামড়াতে মনে চাইতো পৌষ’র। চাচি তো বলতো পৌষ’র দাঁত নাকি ইঁদুরের দাঁত। কিছু কাটতে না পারলে শিরশির করে তাই সারাক্ষণ দাঁতের ব্যবহার করে এরা। পৌষ সারাক্ষণ ই নখ কাটতো। একবার তো হেমু ভাই এনে দিলো নতুন স্ট্রবেরি সোপ। হায় কি সুন্দর নাক জুড়ানো ঘ্রাণ। সইতে পারলো না পৌষ। বসিয়ে দিলো এক কামড়। ইনি,মিনি ছিলো ওর সামনে। হাত পেতে চাইলো একটু। পৌষ দেয় নি দেখে সেদিন লুকিয়ে দুই বোন এক কামড় করে সাবান খেয়েছিলো যদিও গিলার আগেই চৈত্র দেখেছিলো। হেমন্ত সেদিন কতটাই না ধমকালো ওকে। ভাবীর জন্য বেঁচে গিয়েছিলো পৌষ।
তৌসিফ কখন যে ওর ভাবনার মাঝেই পৌষ’র কাছাকাছি এলো তা টের পায় নি পৌষ। একদম ওর মুখের সামনে এসে বললো,
— কি হলো?
— আপনার মুখে গন্ধ তাই নো টেসটিং।
একদম ঝামা ঘঁষার মতো মুখটা হলো তৌসিফের। পৌষ উঠে দৌড়ে পালালো রুমে। মুখে গালি দিলো,
— ব’দমাইশ ব্যাটা। আমার সাথে বদ’মাইশি করতে আসে। একদম টয়লেট ধোঁয়ার ব্রাশে হারপিক লাগিয়ে দাঁত মেজে দিব।
সবটাই শুনলো তৌসিফ। প্রতিনিয়ত দুই বেলা দাঁত ব্রাশ করা হয় দামি টুথপেষ্ট দিয়ে। মাউথ ক্লিনার দিয়েও ক্লিন করা হয়। এই যে এখনও মুখে ফ্রেশ গন্ধ অথচ পৌষ কি জঘন্য অপবাদ টা ই না দিলো।
তবুও একবার হা হা করে দেখলো তৌসিফ। কই নাই তো গন্ধ। এই মেয়ে এত বজ্জাত কেন?
#চলবে…..
মৃদু আলো চোখে পড়তেই কপাল কুঁচকালো প্রাণ। সকাল সকাল বড্ড বিরক্ত অনুভব হলো। মুখটা বালিশে চেপে ধরে উল্টো হয়ে শুয়ে রইলো। খালি গায়ে থাকার দরুন হাতের পেশি গুলো স্পষ্ট দেখা গেলো। ফর্সা উন্মুক্ত পিঠটা নজর কারলো প্রিয়মে’র। আলতো করে হাত রাখলো তাতে। ধীরে ধীরে সেই উঠলো চুলের দিকে। অতি আদুরে ভঙ্গিতে হাত বুলালো ও প্রাণে’র চুলে। আরাম পেয়ে মুখে “উম” শব্দ করে প্রাণ৷ প্রিয়ম এবার ধীরে ধীরে চুল টানতে টানতে ধীর গলায় ডাকলো,
— প্রাণ? উঠবে না?
— উউম।
— বললে যে সকালে ডেকে দিতে। আস্তে ধীরে উঠো।
বলতে বলতে প্রাণের কপালে হাত রাখলো প্রিয়ম। দুই গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
— প্রাণ, উঠো না।
টেনে টুনে চোখ খুললো প্রাণ৷ তার ঘুম পুরো হয় নি। চোখ দুটো বেশ লাল হয়ে আছে৷ ওর চাহনি দেখে প্রিয়ম ঢোক গিললো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে রাখলো। কিছু বলার ও সাহস করে উঠতে পারলো না। প্রাণ ঘুম জড়ানো গলায় বললো,
— ঘুমাস নি রাতে?
ফট করে বড় বড় চোখ করে তাকালো প্রিয়ম৷ প্রাণ কিভাবে টের পেলো ও সারারাত ঘুমায় নি। ও বাবা’র ডায়রিটা পড়েছে। কখন যে সকাল হয়েছে টেরই পায় নি। জেগে থাকার অবশ্য আরেকটা কারণ আছে। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। প্রাণ নামক কারণ। যেই কারণ ওকে জাগিয়ে রাখে। ঘুমোতে দেয় না অথবা প্রিয়ম নিজেই ঘুমায় না।
— কি হলো? কথা বল।
— কক…কই? ঘুমিয়েছি তো।
কোনমতে উত্তর করলো প্রিয়ম। প্রাণ হেচকা টানে একদম ওকে নিজের কাছে টেনে নিলো। প্রিয়’র বুকটা তখন তীব্র বেগে ধুকপুক শুরু করেছে। প্রাণ ওর চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
— হা কর।
প্রাণ আত্মা যেন শুকিয়ে গেলো প্রিয়মে’র। চোখের পাপড়িগুলো সমান তালে নড়তে লাগলো ভয়ে। গলাটা ও যেন শুকিয়ে কাঠ। ওর ভীতু মুখটা নজর কাড়লো প্রাণে’র। তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
— কি হলো? হা কর!
ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে প্রাণে’র। সাহস হলো না প্রাণে’র কথার খেলাপ করার৷ কাঁপা কাঁপা মুখটা অল্প খুলে হা করতেই প্রাণ তাকালো মুখের ভেতর। প্রিয়’র চোখ মুখ ভয়ে অন্ধকার হয়ে এলো যেন। থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা। প্রাণ তখনও মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে মুখের ভেতর৷ হঠাৎ তার চিন্তিত কণ্ঠ কর্ণগোচর হলো,
— তোর জিহ্বা তো সাইজ ঠিকই আছে৷ আমি ভাবলাম জিহ্বা বড় হয়ে গিয়েছে। হয়তো একহাত সমান হবে নাহলে কি আর তুই মিথ্যা বলার সাহস পাস? বড় হলে নাহয় কেটে দিতাম এখন কি করি প্রিয়?
চলবে।