প্রেমসুধা পর্ব-২০+২১+২২

0
413

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২০

[পর্বটা রোম্যান্টিক। চাইলে স্কিপ করতে পারেন]

সবে মাত্র ই দাঁত ব্রাশ করলো তৌসিফ। ওয়াশরুম থেকেই জোরে জোরে ডাকতে লাগলো পৌষ’কে,

— পৌষরাত? পৌষরাত?

অলস পৌষ তখন খাটে পা ঝুলিয়ে ফোন টিপছে। শুনেও না শুনার মতো করে পরে রইলো ও। এখন উঠতে মন চাইছে না। ওয়াশরুম থেকে কেন ওকে ডাকতে হবে? তৌসিফ সাড়া শব্দ না পেয়ে নিজেই উঁকি দিলো রুমে। পৌষ’কে আরামে থাকতে দেখেই এবার নরম গলায় ডাকলো,

— হানি? একটু শুনে যাও না।

পৌষ আড় চোখে তাকালো। তৌসিফ চোখের ইশারায় ডাকলো। মুখে “চ্যাহ” শব্দ করলো পৌষ। উঠে পরণে থাকা জামাটা টেনেটুনে ঠিক করে আসতে আসতে বললো,

— কি চাই? কি দিব?

— তোমাকে চাই। এখানে এসো তারাতাড়ি।

পৌষ ভ্রু সামান্য কিঞ্চিত করে এগিয়ে যেতেই ভেতরে ডাকলো তৌসিফ। দুই পা পিছিয়ে গেলো পৌষ। চোখ কপালে তুলে বললো,

— লুচ্চামি আর কতকাল করবেন? স্বৈরাচার পালালো অথচ আপনি ভালো হলেন না। দিন দাহারে আমাকে ওয়াশরুমে ডাকেন কেন?

তৌসিফ অসহায় চোখে তাকিয়ে নিজেই বেরিয়ে এলো। পৌষ’র চোখের সামনে ই করে দুই পাটি দাঁত বের করে বললো,

— দেখ তো কোথায় ময়লা? দুই বার ব্রাশ করলাম। মাউথ ওয়াশ দিয়ে গার্গল করলাম। দেখো টাং ও ক্লিন।

মুখ খুলে দেখালো তৌসিফ। উঁকিঝুঁকি দিয়ে পৌষ দেখলো একটু। হ্যাঁ সত্যি ই দাঁত গুলো চমলোক্ক দেখাচ্ছে। কথা বলাতে ফ্রেশ ঘ্রাণ আসছে।
পৌষ অভিজ্ঞ স্বরে বললো,

— হু। পরিষ্কার দেখাচ্ছে কিন্তু আমাকে দেখাচ্ছেন কে…..

মুখে আসা প্রশ্নটা আর করা হলো না ওর। তৌসিফ শুনেছে পৌষ বলেছে ওর দাঁত পরিষ্কার। একটু আগেও এই মেয়ে ওকে অপমান করেছে। বলেছে তৌসিফের নাকি মুখে গন্ধ। কি লজ্জা! কি লজ্জা! এখন যেহেতু মুখে স্বীকার করেছেই তাহলে আর বসে থাকবে কেন তৌসিফ। প্রথমেই পৌষ’কে টেনে ওর থুতনিতে এক চুমু দিলো। এতেই বাক হারা পৌষ কিন্তু তাকে সুযোগ না দিয়েই আবার অধরে চুমু খেলো তৌসিফ। একটা, দুটো পরপর কয়েকটা। এভাবে ছাড়া ছাড়া স্পর্শ পেয়ে পৌষ’র শরীর শিউরে উঠলো। তৌসিফের বুকের দিকে টিশার্ট টা খামচে ধরলো ও। তৌসিফ দুই হাতে পৌষ’র গাল চেপে ধরা তখনও। কপালে কপাল ঠেকিয়ে প্রশ্ন করলো,

— কেমন লাগলো?

পৌষ মৌন৷ কথা বলে না। তৌসিফ ওর নাকে ছোট এক চুমু দিলো। বললো,

— কথা বলো হানি।

— জা..জানি না।

— আমার তোতাপাখি তোতলাচ্ছে কেন?

পৌষ থমকে আছে। তৌসিফের এসব স্পর্শ ওকে নাড়িয়ে দেয়। ওর দেহ মন চনমন করে উঠে। না চাইতেও পৌষ স্বীকার করতে বাধ্য সে হেরে যায়। তৌসিফ এভাবে কাছে এলেই সে হেরে যায়। এতদিন যা ও একটু রোক ঠোক ছিলো। চরিত্র নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন ছিলো কিন্তু তা এখন অনেকটাই পরিষ্কার। যদিও সোহা’কে নিয়ে তার মনে প্রশ্ন অনেক। কিন্তু বর্তমানে সে তৌসিফের বউ। পিয়াসা তার অতীত যাকে তৌসিফ মনে রাখে নি। পৌষ রাত বিরাতেও চমকে উঠে। তৌসিফ’কে নিজের কাছাকাছি দেখলেই সে এলোমেলো হয়ে যায়। চাপা হাজার নাড়িয়ে হয়তো সাময়িক কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করে কিন্তু যখন তৌসিফ এভাবে তার দিকে কাতর দৃষ্টি ফেলে, চোখে চোখে আবদার ধরে তখন বেসামাল হয়ে উঠে পৌষ। ওর হাত পা সমান তালে ঝিম ঝিম করে। মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ ফাঁকা।

তৌসিফ দেখলো। বুঝলো। মুগ্ধ চোখে আলতো হাতে আদর দিলো পৌষ’র মুখে যা একদম ই সহ্য করতে অক্ষম পৌষ। ও নড়ে উঠতেই তৌসিফ এবার ওর ওষ্ঠাধর আঁকড়ে ধরলো। পান করলো প্রেমসুধা। পৌষ ছটফট করে উঠতেই আচমকা ওকে কোলে তুলে নিলো তৌসিফ। গলা জড়িয়ে ধরে পৌষ। চোখে চোখ মিলাতে ব্যার্থ ও। তৌসিফ ওকে নরম বিছানায় রেখে ঝট করে দরজা লক করে লাইন গুলো অফ করে দিলো। পৌষ’র কাছে চলে এলো অতি শিঘ্রই। নিজের কাছে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে বিনিত গলায় বললো,

— মে আই হানি?

পৌষ’র বুক লাগাম ছাড়া ঘোড়ার মতো ছুটছে। বুকে বাজছে ড্রাম। চারদিকে যেন বেসুরা সিতারা বাজছে। মাঝখানে পৌষ। তৌসিফ ওর গলায় থাকা চিকন ওরনাটা সরাতেই হাত পরলো বুকে। তাগড়া এক পুরুষ তৌসিফ যে পূর্বে ও নারী স্পর্শে এসেছিলো। বহুবার মেতেছিলো তাতে। আজ এত বছর পর পৌষ’কে টানছে সে। কেন জানি মনটা বেশিই টানছে। তৌসিফ ভুলে গেলো দিন ক্ষণ। আচমকা কান্নায় ও থেমে গেলো। পৌষ সত্যি ই কাঁদছে। স্বাভাবিক কোন কান্না না। ও ছাড়া চাইছে তৌসিফ থেকে। কান্নার ধরণ ঠিক এমন যেন তৌসিফ তাকে নোংরা স্পর্শ দিচ্ছে। তবুও তৌসিফ ঘন ঘন শ্বাস ফেলে বললো,

— হা..হানি আমি…

— প্লিজ না। ন…না প্লিজ না৷

অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ পুরুষ তৌসিফ। নারীর অনিহা সে বুঝে।তড়িৎ বেগে ওকে ছেড়ে দিলো তৌসিফ। ওর টিশার্ট তখন ফ্লোরে। তা তুলেই সেকেন্ডের ব্যবধানে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো তৌসিফ। বেয়াক্কেল বনে গেলো পৌষ। ওর কেন কান্না এলো তা ও নিজেও জানে না। ও তো জোয়ারে ভাসছিলো। একটুর জন্য তৌসিফ’কে নিজেকে বিলিয়ে ও দিতো কিন্তু হঠাৎ ই কেন জানি ওর সহ্য হলো না৷ সহজ হতে পারলো না পৌষ তাই তো কান্না চলে এলো। একদম ই অভিজ্ঞ না পৌষ। ও জানে না৷ বুঝে না৷ হয়তো বয়সের তাড়না বা আবেগে গা ভেসে যায় কিন্তু হুট করে যে তৌসিফ তাকে কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া চাইবে তা কে জানতো? পৌষ নিজেকে সময় বা প্রস্তুতি কোনটাই দিতে বা নিতে পারে নি।

ওভাবেই বিছানায় পরে রইলো পৌষ। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। গোসল করছে তৌসিফ। তৌসিফকে আচমকাই ভয় লাগলো পৌষ’র। লোকটার সাথে হাজার বেয়াদবি করুক কিন্তু তার সাথে আজ এই মুহুর্তে এমন কাজ করাটা যে ঠিক হলো না তা পৌষ বুঝে। সে কি পৌষ’কে আবার মা’রবে? ভয়ে কোণায় গুটিসুটি মে’রে শুয়ে পরলো পৌষ। গায়ে ভালোমতো কাঁথা টেনে একদম মাথা সহ পেঁচিয়ে নিলো। কখন যে ঘুমালো তা ও নিজেও জানে না।

দীর্ঘ ঘন্টা খানিক পরে তৌসিফ টাওয়াল পেঁচিয়ে বের হলো। এক পলক পৌষ’কে দেখে আলমারি থেকে একটা টাউজার নিয়ে পরেই বারান্দায় চলে গেলো। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটের ভাজে গুজে আগুন ধরালো তাতে। বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে উড়ালো অলস ভঙ্গিতে। একদিকে বিষাক্ত ধোঁয়া অন্যদিকে বিষাক্ত অনুভূতি। আজ বহু দিন পর নারী চাইছিলো ও। বললে অবশ্য ভুল। পৌষ’কে চাইছিলো। এই চঞ্চল মেয়েটাকে তার ইদানীং ভালো লাগে। এটা যদিও ভালোবাসা কি না তা বুঝতে অক্ষম তৌসিফ অথবা স্বীকার করতে চায় না। একবার কি ভালোটাই না বাসলো। সেই ভালোবাসা তাকে ভরা মাঠে মুখে কালি মেখে দিয়েছে। ভালো বাসতেও যেন ভয় লাগে। ইজ্জতহানীর ভয়।
উদাম শরীরে ঠান্ডা লাগলো। বাতাস বইছে। বৃষ্টি শুরু হলো আবার তবে ঝিরিঝিরি। গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি পরতেই ভেতরে চলে গেল ও। খাটের একদম কোণায় ঘুমিয়ে পৌষ। অপর পাশে শুয়ে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক করলো তৌসিফ। অতঃপর কাঁথা সহ পৌষ’কে টেনে একদম নিজের কাছে শুয়ে পরলো। একবার চাইলো নিজেও কাঁথার নিচে ঢুকে বুকে জড়িয়ে ধরবে কিন্তু পরক্ষণেই কি মনে করে আর ধরলো না। ঘুমিয়ে গেলো। রয়ে গেলো বুকে কিছু যন্ত্রণা যা অতি কাছে শুয়ে থাকা মানুষটির অজানা।

_________________

সকাল সকাল বমি হচ্ছে শ্রেয়ার। হেমন্তের চোখে মুখে চিন্তা। ভোররাত থেকে বমি করেই যাচ্ছে শ্রেয়া। করতে করতে এবার কেঁদেই দিলো। বড্ড আদুরে কি না। হেমন্ত ওর মুখ ধুয়িয়ে দিলো। রুমে নিয়ে খাটে বসিয়ে ছুটলো পৌষ’র রুমে। বারান্দায় লেবুর চারা লাগানো। পৌষ অনেক কিছুই লাগিয়ে রেখেছে। সেবার ওর কলেজ থেকে লেবুর ছোট্ট এক চারা এনে লাগিয়েছিলো। বছর হলো তবে গাছ ঠ্যাটা এটা। একদম পৌষ’র মতো। গাট হয়ে আছে। তাই আর মাটিতে লাগানো হয় নি। টবেই আছে। দুটো পাতা ছিড়ে নিলো হেমন্ত। রুমে এসে পাতা ছিড়ে শ্রেয়া’কে দিতেই নাকে ধরে লম্বা শ্বাস নিলো ও। একদম সতেজ ঘ্রাণ। হেমন্ত সস্তির শ্বাস ফেললো। মর্নিং সিকনেস হচ্ছে ইদানীং শ্রেয়ার। নরম স্বভাবের বউটার বড়ই কষ্ট হচ্ছে। হেমন্ত মানতে পারছে না। চিরুনী দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো অতি যত্ন করে আঁচড়ে এক করে বেঁধে দিলো। ক্লান্ত শ্রেয়া দূর্বল কণ্ঠে বললো,

— ক্ষুধা লেগেছে।

চট করে দাঁড়িয়ে গেলো হেমন্ত। শ্রেয়াকে তুলে বারান্দায় খোলা বাতাসে বসিয়ে বললো,

— দুই মিনিট জান৷ এখনই আসছি।

বের হতে হতেই দেখলো চৈত্র স্যুপের বাটি নিয়ে এদিকেই আসছে। হেসে ওর হাত থেকে বাটি নিলো হেমন্ত। বললো,

— এত সকালে উঠলি যে?

— ফজরের পর ঘুম এলো না তাই পড়ছিলাম ভাই। ভাবীর কথা শুনলাম তাই ভাবলাম কিছু খাবে কি না।

একটু লজ্জা ই পাচ্ছে চৈত্র। হেমন্ত ওর পিঠ চাপড়ে চলে গেল। ওর অনুপস্থিততে ওর ভাই-বোন গুলোই যথেষ্ট। টাইম টু টাইম ধরে বেঁধে খাওয়াবে শ্রেয়াকে। পৌষ’র পর ওদের পেটের কথা শুনার মানুষ ই তো শ্রেয়া।
স্যুপ পুরোটাই খেলো শ্রেয়া। খেতে খেতেই বললো,

— আজ না বললেন পৌষ’কে আনবেন।

— হ..হু?

একটু আনমনা ছিলো হেমন্ত। শ্রেয়া ওর গালে হাত দিয়ে বললো,

— কি হয়েছে?

— কিছু না শ্রেয়ু।

বলেই হাসলো হেমন্ত। শ্রেয়া তাকিয়ে রইলো। লোকটা হাসলে তার বুকে শান্তি লাগে। হেমন্ত ওর গাল টেনে দিলো। আদুরে গলায় বললো,

— আমার বাবুটার আম্মু দিন দিন এত সুন্দর হচ্ছে কেন?

— বাবুর আব্বু ও সুন্দর হচ্ছে।

— তাই?

— হু।

— এই সুন্দর বাবুর আব্বু আদর করে দিলে রাগ হবে না তো?

লজ্জা পেয়ে বসলো শ্রেয়া। তাতেই সম্মতি ভেবে ওকে কোলে তুলে রুমে নিলো হেমন্ত। পৌষ’র কথা আরেকবার জিজ্ঞেস করলেও উত্তর এলো না। শ্রেয়া ও তখন স্বামীর বুকে পরম শান্তিতে শুয়ে আছে। তার একমাত্র ভালো লাগার স্থান এটা।

___________________

সকাল সকাল মিনুকে চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখেই চোখ উল্টে তাকালো পৌষ। মিনু মিনমিন করে বললো,

— ছোট ভাবী আপনাকে ডাকে।

ভ্রু কুঁচকে পৌষ জিজ্ঞেস করলো,

— কে?

— বড় মামা।

পৌষ মনে করার চেষ্টা করলো বড় মামাটা কে৷ পরক্ষণেই মনে হলো তৌফিক তালুকদার। পৌষ পরটা উল্টে জিজ্ঞেস করলো,

— কেন ডাকবে আমাকে? আমার সাথে কি কাজ?

— জানি না তো কিন্তু ডাকে।

তখনই উচ্চ স্বরে কথা শুনলো পৌষ। তৌসিফের গলা ও শুনা যাচ্ছে। দরজার সামনে থেকেই কথা আসছে। পৌষ উঁকি দিতেই দেখলো তৌসিফ’কে টেনে সাইডে নিলো তায়েফা। উচ্চ স্বরে তখন ধমকাচ্ছে তৌফিক। তৌসিফ ও কম না৷ তৌফিকের গলা কানে এলো পৌষ’র,

— ডাক তোর বউ’কে। দেখি কতবড় সাহস ওর!

পৌষ ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ ই যেন ঝড়ের বেগে ওর গালে থাপ্পড় পরলো। এত জোরে থাপ্পড় শেষ কবে খেয়েছে ওর মনে নেই। মাথাটা পাক্কা এক মিনিট ঝিম ধরে রইলো। মুখে নোনতা স্বাদ পেতেই পৌষ বুঝলো গাল কেটেছে। হুঙ্কার ছেড়ে তৌফিকে ডাকলো তৌসিফ। এদিকে হু হু করে কেঁদে উঠলো পৌষ। ওকে কেন মা’রলো? কি করেছে পৌষ?

#চলবে…..

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২১

হতভম্ব, বাক হারা পৌষ। তায়েফা নিজেও চমকে তাকিয়ে আছে। হুংকার ছেড়ে চিৎকার করে উঠে তৌসিফ,

— বড় ভাই!

তড়িৎ বেগে ছুটে এসে ধরলো পৌষ’কে। নিজের কাছে বাহুতে টেনে নিয়ে আলতো হাতটা ওর মাথায় রেখে র’ক্ত চক্ষু নিয়ে তাকালো তৌফিকের দিকে। হিসহিসিয়ে শুধু বললো,

— কাজটা ঠিক করলেন না।

তৌফিক জানে তৌসিফ ঠিক কি করতে পারে কিন্তু তাই বলে এই মেয়েকে ও ছেড়ে দিবে না ও। আজও পৌষ’কে জারজ হিসেবেই মেনে আসছে তৌফিক। বিয়ের সময় তৌসিফ পৌষ’কে দেন মোহর হিসেবে যা দিয়েছে তা কল্পনা অতীত। গত এক সপ্তাহ ধরে নিজের নামের অর্ধেক সম্পত্তি ও তৌসিফ পৌষ’কে দিতে চাইছে। তৌফিককে জানাতেই এক বাক্যে না করে দেয়। তৌসিফের কি হয়েছিলো আল্লাহ মালুম। ঐ প্রথম ভাইয়ের কথার উপর দিয়ে গিয়ে সে নাকোচ করেছে। তার কথা একটাই। জীবনে তো আপাতত পৌষ বাদে কেউ নেই। তৌসিফের কিছু হলে কেউ যাতে পৌষ’কে এই বাসা থেকে তাড়াতে না পারে তাই তৌসিফ পৌষ’কে নিজের অর্ধেক জীবিত থাকতেই দিতে চায়। তৌফিক রাজি না কিছুতেই। আজ সকাল সকাল গার্ডেনে হাঁটতে গেলেই তৌফিক কথা তুলে। তৌসিফকে বলে যাতে সিদ্ধান্ত বদলায় কিন্তু তৌসিফ তা করবে না। রেগে তখন বাড়ীর ভেতরে ঢুকে যায় তৌফিক। ওর বউ ওকে কি বলেছে তা তায়েফা জানে না কিন্তু এতটুকু জানে তৌফিক ভাবছে তৌসিফ’কে হয়তো পৌষ ই এসব পাঠ পড়িয়েছে নাহলে কেন তৌসিফ চাইবে তার সম্পত্তির মালিকানা পৌষ’কে দিতে। কথা কাটাকাটির এক পার্যায়ে না পেরেই পৌষ’কে চর মে’রে দিলো তৌফিক। তায়েফা কোনমতে টেনে তৌফিককে নিয়ে নিচে চলে যায়। ওরা যেতেই মিনু দরজা লাগিয়ে দিলো। ভয়ে ওর বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে। সোহা নিজের রুমে দাঁড়িয়ে দেখেছে সবটা। মিনু’র দুঃখী মুখ দেখেই সোহা বললো,

— নাস্তা খেয়েছিস?

মিনু মাথা নাড়লো। ওর আজ পৌষ’র হাতের নাস্তা খাওয়ার ইচ্ছে ছিলো। ভালো লাগে খেতে। সোহা রুম থেকে বের হতে হতে বললো,

— আয় আপা নাস্তা দিচ্ছি।

ছোট ছোট পা ফেলে সোহার পিছন পিছন গেলো মিনু। কাজের বুয়া একজন বাকি পরটা গুলো ভেজে রাখলো। তাদের খারাপ ই লাগলো। এত সুন্দর হাসি খুশি মেয়েটা’কে এভাবে থাপ্পড় মা’রাটা মোটেও ঠিক হয় নি বড় মামা’র।
.
পৌষ’কে বিছানায় বসিয়ে ওর গালে হাত দিতে নিলেই পৌষ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। তৌসিফের চোখ মুখ শক্ত অথচ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে নিজেও ব্যথিত। তুলা দিয়ে ঠোঁটের কোণাটা মুছে দিতে নিলেই “উপফ” শব্দ করে পৌষ। তৌসিফ ওর হাতটা ধরে নরম করে। হাতেই চুমু দিয়ে নরম স্বরে বললো,

— আ’ম সরি হানি। এক্সট্রিমলি সরি।

পৌষ কথা বলে না। তার কান্না থেমে থেমে চলছে এখন। ফুঁপিয়ে কাঁদছে এখন। প্রতিবাদী পৌষ’র এহেন রুপ মোটেও কাম্য নয়। বিনা কারণে তাকে কেন মা’রা হলো তার উত্তর চাই তার। তৌসিফ ওর গালে মলম লাগাতে নিলেই কেঁদে উঠে। ব্যথায় টনটন করা গালে হাত লাগানো যাচ্ছে না। তৌসিফের মন চাইলো কারো বুক খাবলে নিতে এখন। ওর নিজের বুকেই অসহ্য পীড়া হচ্ছে। তবে কি ভালোবাসা হলো?
পৌষ ভাঙা গলায় বললো,

— ব্যথা।

— আমি অনেক ধীরে ধীরে করব পৌষরাত। একটু লাগাতে দাও।

বহু কষ্টে মলম লাগাতেই পৌষ উঠে দাঁড়ালো। তৌফিক সাথে সাথে হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করলো,

— কোথায় যাচ্ছো?

— আপনার ভাই এর কাছে।

বলেই নিজের গালে আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে বললো,

— এটার কারণ কি? আমার অন্যায় আমাকে জানাতে হবে।

পৌষ’কে টেনে নিজের কাছে নিলো তৌসিফ। ভালো গালটাতে হাত দিয়ে বললো,

— আমাকে সামলাতে দাও।

— নিজের জন্য যথেষ্ট আমি।

— জানা আছে আমার।

— ছাড়ুন। উত্তর আমার চাই ই চাই। কোন সাহসে গায়ে হাত তুললো আমার? কি পেয়েছে আমাকে? আমি আমি…

বলতে গিয়েই কেঁদে ফেললো ও। তৌসিফের সহ্য হয় না এই মেয়ের কান্না। সঙ্গে সঙ্গে বুকে টেনে নিতেই ওর পিঠের দিকের কাপড় আকড়ে ধরলো পৌষ। কাঁদতে কাঁদতে ই বললো,

— আমি তো না জায়েজ না এখন। আপনি না বললেন? তাহলে কেন মা’রলো? কি করেছে পৌষ? তাকে জিজ্ঞেস করুন তার কোন ভরা ভাতে ছাই দিয়েছি আমি?

— হুশ! হানি, তুমি কিছু করো নি। তোমার ব্যথার থেকেও হাজার গুন আফসোস ব্যথা দানকারী করবে।

পৌষ সাময়িক সময়ের জন্য থামলেও ওর ভেতরের ঝর থামে নি। উত্তর তার চাই ই চাই। অপরাধ কি তাকে বলতে হবে।
তৌসিফ ওকে বিছানায় বসিয়ে নরম স্বরে বললো,

— তুমি থাকো আমি নাস্তা নিয়ে আসি।

— কেন? নাস্তা এখানে কেন আসবে? আমার কি পা নেই যে উঠে যেতে পারব না?

ফোঁস করে শ্বাস ফেললো তৌসিফ। মাথা নেড়ে বললো,

— চলুন ম্যাডাম।

পৌষ উঠে যেতেই তৌসিফের চোখ দুটো ক্রমশ লাল হয়ে উঠলো। মাথাটা তার এখনও ঝিমঝিম করছে। বড় ভাই এর আজকের আচরণ কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না তৌসিফ।

খাবার টেবিলে একদম নীরব ভাবে বসা পৌষ। টেবিলে পাউরুটি দেখে ওটা নিতে নিলেই তৌসিফ এসে বুয়াকে ডাক দিলো। বুয়া’কে দেখেই গম্ভীর কণ্ঠে তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,

— পৌষরাত না পরটা ভেজেছে। নিয়ে আসো।

বুয়া এনে দিতেই তৌসিফ নিজে প্লেটে নিলো। সেখান থেকে ছিড়ে ডিম দিয়ে পৌষ’র মুখের সামনে ধরতেই চোখ তুলে তাকালো পৌষ। তৌসিফ ইশারায় ওকে খেতে বললো। মুখ খুলে খেয়ে নিলো পৌষ। সোহা বাঁকা চোখে দেখলো সেদিকে। বিতৃষ্ণায় ওর মন ভরে উঠলো। এসব আদিখ্যেতা ওর পছন্দ হলো না বরং সে খুশিই ছিলো যখন পৌষ’কে সবার সামনে চড় মারা হলো। যেই পরিমান বাড় বেড়েছিলো এই মেয়ের জন্য একদম উচিত শিক্ষা ছিলো আজ।
একটু খেয়েই পৌষ উঠে গেলো। তৌসিফ ডাকলেও শুনলো না। সোজা রুমে ঢুকে বিছানায় উঠে বসলো। তৌসিফ নিজের খাওয়ায় মন দিলো। খেতেও যেন আজ ভালো লাগলো না। পৌষটা পাশে থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। কফিটাও টেবিলে দিতো সে। বুয়াকে ডেকে তৌসিফ বললো,

— আমার কফি আর পৌষরাত যেভাবে চা খায় সেভাবে বানিয়ে রুমে পাঠাও।

বলেই টিস্যু দিয়ে হাত মুছে উঠে পরলো। রুমে যেতেই দেখলো পৌষ পা গুটিয়ে বিছানায় বসা। এখন পর্যন্ত সে শান্ত ই আছে। তৌসিফ কেন জানি মানতে পারলো না। এত শান্ত পৌষ সে চায় না। ঐ ছটফট করা বউটাই তার চাই। নিজেও বিছানায় উঠে পৌষ’র মুখোমুখি হলো তৌসিফ। আশ্চর্য হয়ে গেলো ওর গালের দিকে তাকিয়ে। এক সাইড হঠাৎ ই ফুলে উঠেছে। তৌসিফ ভেবে পেলো না ঠিক কতটা জোরেই না আঘাত পেয়েছে। রাগে ওর কপালের শিরা ফুলে উঠলো। সাইড ড্রয়ার থেকে একটা পেইন কিলার নিয়ে পানির গ্লাসটা পৌষর সামনে দিয়ে বললো,

— মুখ খোলো।

পৌষ মুখ সরিয়ে নিলো। তৌসিফ জানে কাজ হবে না তাই আলতো হাতে পৌষ’র ভালো গালটা ধরে নিজের কাছে ফিরিয়ে বললো,

— ব্যথা চলে যাবে হানি। প্লিজ কথা শুনো।

— শুনব না।

— আচ্ছা ঠিক আছে। এটা খাও।

— খাব না।

— একটু।

— এক ফোঁটা ও না। আপনার ভাই কেন মা’রলো আমাকে? জবাব দিন আমাকে। আমি মানব না। কি ভেবেছে পৌষ’র মা-বাবা নেই বলে ওকে সবাই আঘাত করবে? এতই সোজা। জোর করে বিয়ে দিলো এখন জোর করে মে’রে যায় আমাকে। আমি থাকব না আপনার সাথে। আমাকে এতিম খানায় দিয়ে আসুন।

চোখে মুখে কান্নার ছাপ দেখে তৌসিফের বুকে চাপ সৃষ্টি হলো। দাঁতে দাঁত চেপে ও পৌষ’র মুখে পেইন কিলারটা দিয়ে পানি খাওয়ালো। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

— তুমি তার আফসোস দেখবে হানি। আই প্রমিজ টু ইউ।

বলেই পৌষ’র হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ালো। চোখ দুটো মুছিয়ে দিতে দিতেই চা হাতে মিনু দরজায় নক করলো। তৌসিফ আসতে বলতেই মিনু চায়ের ট্রে টা রেখে নিচু স্বরে বললো,

— বড় আপা….

— শু। গো নাও।

কথা না শুনেই ওকে যেতে বললো তৌসিফ। মিনু চলে যেতেই চায়ের মগটা পৌষ’র হাতে দিলো তৌসিফ। চা অনেক আদরের পৌষ’র কাছে। শ্রেয়া কত বলতো ঠোঁট কালো হয়ে যাবে তবুও গিভ আপ করে নি পৌষ। ওর ভালো লাগে চা খেতে।
পৌষ’র সাথে তাল মিলিয়ে কফির মগে চুমুক দিলো তৌসিফ। কি মনে করে বললো,

— এক সিপ নেই হানি?

পৌষ অবুঝ নয়নে তাকাতেই ওর মগ থেকে এক চুমুক খেলো তৌসিফ। পৌষ সমতায় বিশ্বাসী তাই তো ঝট করে নিজেও তৌসিফের মগ থেকে চুমুক বসাতে নিলেই ওয়াক ওয়াক করে উঠলো। এত স্ট্রং ব্লাক কফি বাপের জন্মে সে খায় নি। তৌসিফ হাসলো। মুখটা একদম প্যাঁচার মতো করে রেখেছে পৌষ। তৌসিফের হাসি পেয়ে গেলো। ড্রয়ার থেকে একটা চকলেট দিয়ে বললো,

— চুষতে থাকো।
.
বিছানায় তখনও পৌষ বসা। তৌসিফ রেডি হচ্ছে। মনোযোগ দিয়ে ওকে দেখতে ব্যস্ত পৌষ। আঙুলে আঙুলে গুনছে ঠিক কয় পদের স্কিন কেয়ার তৌসিফ করতে পারে। পারফিউম ও একটা লাগায় না। একটা ঘঁষে ঘঁষে লাগায়, একটা খালি বডিতে লাগায়, তারপর পোশাকের উপর দুটো লাগায়। এত সব কম পরে বিঁধায় কানের পিছনে আর হাতে লাগায় আরেকটা। আশ্চর্যের বিষয় হলো হ্যান্ড ক্রিমটা ও বাদ রাখে না। তৌসিফ পকেটে ওয়ালেট ভরতে ভরতে বললো,

— আজ ভার্সিটি তো অফ। রেস্ট নাও। কিছু লাগলে বুয়াদের বলবে নয়তো একটা মিস কল দিলেই হবে আমাকে। ছাদে যেও মন চাইলে।

বলতে বলতে পৌষ’র একদম কাছে এসে থুতনিতে চুমু দিয়ে নরম স্বরে বললো,

— আই উইল কাম সুন হানি।

এতটা কাছে আসাতে তৌসিফের ঘ্রাণে ম-ম করে উঠলো পৌষ’র চারপাশ। ঘ্রাণ সামলে উঠতে উঠতে কখন যে তৌসিফ গেলো তা টের ই পেলো না। শরীর খারাপ লাগাতে লাইট অফ করে শুয়ে পরলো ও। হালকা হালকা শীত ও লাগছে তাই রিমোট দিয়ে এসিটা ও অফ করে দিলো। ক্রমশ ই তাপমাত্রা বাড়তে লাগলো। এক সময় কুঁকড়ে উঠলো পৌষ। অন্ধকার রুমটাতে কেউ তাকে দেখতে এলো না৷

___________________

হক বাড়ীতে হৈ হৈ রৈ রৈ লেগে আছে। পৌষ’কে আনতে যাবে তারা। হেমন্ত একবার বলেছে শুধু গতরাতে যে পৌষ’কে আনতে যাবে সেই থেকে লেগে আছে বাচ্চাদের হুরো পাসরি। বাবা’র চাপা উত্তেজনা ও দেখেছে হেমন্ত। মা আর চাচি তো সেই থেকে ভেবে রেখেছে কি রাঁধবে। বাড়ীর বড় মেয়ে হওয়াতে সকলের আদরের ও। পরিস্থিতির কবলে পরে হয়তো সেদিন তৌসিফের হাতে তুলে দিতে তারা বাধ্য ছিলো কিন্তু কেউ ই চাইতো না এমনটা হোক। সম্পর্কের খাতিরে তৌসিফকে না করা হয় নি। এতদিন দেখে না কেউ। তাই তো সকাল হতেই লেগে পরেছে ওরা। হেমন্তের দুই কাঁধে ঝুলছে ইনি,মিনি। বারংবার তোতলানো গলায় বলেই যাচ্ছে,

— হেমু বাই আপি আতে না ত্যান?

হেমন্ত ইনি’কে টেনে কোলে তুলে বললো,

— দুটো মিলে চুল টেনে দে। তাহলেই আনব।

ছোট ছোট হাতের থাবা পরছে তখন হেমন্তের চুলে। ভালোই লাগে। মাথা টা ব্যথা করছিলো। এখন শান্তি লাগছে। চৈত্র’কে দিয়ে ও আজ কাজ করিয়েছে। সুযোগের সৎ ব্যবহার করছে হেমন্ত। শ্রেয়া এতক্ষণ কিছু না বললেও এবার বলে উঠলো,

— আপনি এমন করছেন কেন? নিয়ে আসুন না পৌষ’কে।

হেমন্ত এক পলক বৌ’কে দেখলো। মৃদু হেসে বললো,

— আগে আমার সেবা করুক। খাটাখাটুনি আছে অনেক।

— কিসের খাটুনি এত তোমার?

পেছন থেকে বাবা’র গলা শুনেই তাকালো হেমন্ত। অসন্তুষ্ট গলায় তিনি বললেন,

— নিয়ে এসো যাও।

— তুমি যাও আব্বু।

— আশ্চর্য! আমি কিভাবে?

— যেভাবে বিয়ে দিলেন।

— হেমুর মা দেখো তোমার ছেলে কত বড় ঢপবাজ হয়েছে। কাল থেকে ঘুরিয়ে এখন আমাকে বলে যেতে।

খুন্তি হাতে বেরিয়ে এলো হেমন্তের মা। ছেলের দিকে তাকিয়ে মায়া মায়া চোখে বললেন,

— যা না বাবা। কতদিন দেখি না আমার মেয়েটাকে।

আড়মোড়া ভেঙে হেমন্ত বললো,

— কল ধরছে না তৌসিফ তালুকদার। ধরলেই যাব।
.
অফিসে ঢুকেই নিজেদের কেবিনে ঢুকলো তৌসিফ। ওর পিএ সাথে সাথে ঢুকলো পিছনে। গায়ের কোর্ট টা না খুলেই তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

— বড় ভাই এর সাথে হওয়া দুটো শিপ এর ডিল এখনই ক্যান্সেল করে দাও সাথে যেই কম্পানি ওনাকে স্পনসর করবে তাদের হুশিয়ারী দাও যে তার সাথে এই কাজে থাকলে আমি তাদের সাথে করা সব ডিল ক্যান্সেল করে দিব। আর হ্যাঁ, আজকের বন্দরের সব জাহাজ শুধু আমার গুলো ঢুকবে। আমার নামে ভাইয়ের একটা শিপ ও ঢুকবে না। যা আসবে ফেরত পাঠাবে।

পিএ ইমু চমকে তাকালো। নিজের ভাইয়ের সাথে এমন করবে তাও কি না তৌসিফ তালুকদার ভাবা যায়? যে নিজের ভাই বাদে কিছু বুঝে না সে করবে এই কাজ! তোতলানো গলায় ইমু শুধু বললো,

— স..স্যার যদি আরেকবার ভাবতেন…

— জাস্ট ডু ইট ফুল!

একদম হাবিলদার ইয়েস স্যার এর মতো ইমু পরি কি মরি করে বের হলো। এক দৌড়ে গেলো ম্যানেজারের কাছে। পরপর দৌড়ালো এমডির কাছে। আজকের জাহাজ ভিরতে না দেয়ার জন্য এরপর ছুটলো চট্টগ্রামে থাকা তাদের এমডিকে কল করতে। হায়! কত জ্বালা! এই চিকন দেহটা নিয়ে কতদিকে যাবে ইমু। এমনিতেই শরীরে রসকষ নেই তার মধ্যে এত খাটুনি। জীবনটা আর চলে না। একটা বউয়ের শূন্যতা ওকে কতটা পুড়ায় তা কি বুঝে তৌসিফ তালুকদার? নিজে বিছানা তো বউ দিয়ে গরম থাকে তাই আরেকজনের কষ্ট বুঝে না৷ কাল কত করে ছুটি চাইলো। শা’লা দিলোই না।

#চলবে….

[এতদিন গ্যাপ দেয়াতে এখন হাত স্লো হয়ে গিয়েছে। যতটুকু লিখেছি তা লিখতে গত কাল আর আজকে সময় লাগলো। আশা করি ছোট বলে আমাকে আরো ডিমোটিভেট করবেন না।]

আরহাম দৌড়ে এসে ধরলো তোঁষা’কে। বুকে চেপে ধরে অস্থির কণ্ঠে বলতে লাগলো,

— এই প্রাণ? এই? তুঁষ? তাকা আমার দিকে। তাকা। বল কি হয়েছে? কেন কাঁদছিস? কষ্ট হচ্ছে? কোথায় হচ্ছে বল না? প্রাণ!

তোঁষা’র কান্নার বেগ থেমে গেলো। জ্ঞান হারিয়েছে বুঝলো আরহাম। ঠোঁট কামড়ে তোঁষা’কে শুয়িয়ে দিয়ে ছেলেকে বুকে তুলে নিয়ে তোঁষা’র মুখে পানির ছিটে দিলো। অনেকটা সময় পর চোখ খুললো তোঁষা। আরহামে’র জানে পানি এলো যেন। তোঁষা শুকনো হেসে বললো,

— কেন কাঁদছো বাবা ছেলে?

মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ। ছোট ছোট হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মা’কে। হিচকি তুলতে তুলতে বলে,

— তুমি কাঁদো কেন মাম? প্রাণের কষ্ট হয় তো। ব্যাতা পেয়েতো তুমি মাম?

তোঁষা ছেলেকে বুকে চেপে ধরে আরহামে’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— আর কাঁদে না বাবু’র আব্বু। বাবু’র মাম ঠিক আছে তো। মাথা ব্যাথা করছিলো।

আরহাম নিজে তোঁষা’র পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে। কাঁধে মুখ গুজে বললো,

— ভয় পেয়েছিলাম আমি।

— ঠিক আছি।

— কাল ডক্টরের কাছে যেতে হবে তুঁষ।

— আচ্ছা যাব।

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২২

বাড়ী ফিরতে আজ ভালোই দেড়ী হলো তৌসিফের। মাঝখানে খাবারের ব্রেকে কল দিলো তার একমাত্র বউকে। হায় আফসোস! এই বউটা যদি কল ধরতো তাহলে অন্তত তৌসিফ একটু শান্তি পেতো।কিন্তু ঐ যে ওর ভল্লুকী বউ, সে হলো মহা ত্যাড়া। নিশ্চিত সকালের ঘটনা কেন্দ্র করে তৌসিফের কল ধরে নি। বাচ্চাদের জন্য যেমন চিপ্স, চকলেট নিয়ে বাড়ী ফেরে মানুষ তৌসিফ ও আজ বাড়ী ফিরলো হাতে চাট্ঠা পাট্ঠা নিয়ে। বউ এগুলো দেখলেই খুশি হবে। কলিং বেলটা বাজতেই আজ সোহা খুললো। ওকে দেখা মাত্র ই ভীষণ বিরক্ত বোধ করলো তৌসিফ। এতদিন তো বউটা দরজা খুলতো। খুলেই মুখ ঝামটা মা’রতো। আজও তৌসিফ প্রস্তুত ছিলো যা সোহা’কে দেখে ভেঙে গেলো। মুখে তা প্রকাশ না করে সাইড কেটে ভেতরে ঢুকলো তৌসিফ। এদিক ওদিক তাকালেও দেখা মিললো না ওর বউ এর। টিভিতেও ড্রামা চলছে যা পৌষ দেখে না তা জানে তৌসিফ। রাত ও হয়েছে তাহলে কি বউটা ঘুমিয়ে গেলো? ভেবে তৌসিফ রুমে চলে গেলো। পেছন থেকে ডাক দিলো সোহা,

— কথা ছিলো।

— নট নাও।

পেছনে ফেরার প্রয়োজনীয়তা বোঁধ করলো না তৌসিফ। গটগট পায়ে রুমে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকতেই দেখলো অন্ধকার রুম। কেমন গুমোট লাগছে। তৌসিফের যেন দম বন্ধ লাগলো হঠাৎ। দরজা, জানালা সব বন্ধ করে রেখেছে। এসি তো দূর ফ্যানটাও বন্ধ করা। গলার বাটন খুলতে খুলতে তৌসিফ ডাকলো,

— পৌষরাত? মাই হানি, ক্যান আই হ্যাব জুস?

না, এত আদুরে ডাকের উত্তর এলো না৷ ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক তাকিয়ে লাইন অন করলো তৌসিফ। চমকালো হঠাৎ। সকালে যেভাবে কাঁথা নিয়ে শুয়ে ছিলো ঠিক সেভাবেই পৌষ ঘুমাচ্ছে। অবস্থান বদলালেও বদলায় নি ভঙ্গি। একদম পেঁচিয়ে শুয়ে আছে। তৌসিফ বুঝলো না কিন্তু ওর ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো হুট করে। তারাতাড়ি পৌষ’র পাশে বসেই কাঁথার উপর হাত দিয়ে ডাকলো,

— পৌষরাত?

উত্তর এলো না। তৌসিফ ভালোই বিচলিত হচ্ছে। তার মন মানছে না। টেনে পৌষ’র মাথা থেকে কাঁথা সরাতেই দেখা মিললো মূর্ছে যাওয়া এক খানা মুখ। তৌসিফ জানে না ওর হলো কিন্তু শুধু এটা মনে হলো ওর অস্থির লাগছে। মাত্রারিক্ত বুকটা ওঠানামা করছে। পৌষ’র গালে হাত দিলেই আরেক দফা চমকালো। অসম্ভব গরম। একে একে কপালে, গলায় হাত ছোঁয়ালো। জ্বরে গা পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। আতঙ্কিত হলো তৌসিফ মুহুর্তেই। ঝট করে কাঁথা সম্পূর্ণ টা সরালো। চিৎকার করে ডাকলো,

— বুয়া! বুয়া!

ডেকেই পৌষ’কে নিজের বুকে টেনে নিলো। জ্ঞান নেই পৌষ’র। তৌসিফের মনে হচ্ছে ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। এই বুকের মধ্যে থাকা পাখিটা তো চুপ থাকার নয়, সে এক চঞ্চল প্রাণ। সে তো বোবা পাখি নয় সে হচ্ছে তৌসিফের তোতা পাখি। তোতাপাখিটা চুপ করে পরে আছে তৌসিফের বুকে। ঢোক গিললো তৌসিফ। পৌষ’কে আরেকটু বুকে চেপে ধরলো। তখনই বুয়া দরজা খুলে ঢুকলো। পেছনে সোহা আর মিনু ও এসে দাঁড়িয়েছে। বুয়া মামা বলে ডাক দিতেই তৌসিফ ধমকে উঠলো,

— ও ও কখন থেকে এখানে পরে আছে? কেউ কেন দেখো নি? বলি নি ওকে দেখে রাখতে? টাকা দিয়ে কেন রেখেছি যদি একটা মানুষের ই খেয়াল রাখতে না পারো!

বুয়া সহ পেছনে থাকা মিনু ভয় পেয়ে গেলেও সোহা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো,

— সারাক্ষণ লাফালাফি করে। শান্ত ছিলো ভালো কথা।

আর কিছু বলার আগেই তৌসিফ হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো,

— একটা কথা বললে বাড়ী ছাড়া করব আমি।

আচমকা কথাতে সোহা চুপ হয়ে গেলো। নাকের পাটা ফুলিয়ে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। মিনু তখনও দাঁড়িয়ে। তৌসিফ বুয়াকে অস্থির গলায় বললো,

— ডক্টর ফোন করো। এখনই আসতে বলো।

বুয়া ছুটে গেলো। তৌসিফ পৌষ’র গালে আলতো চাপড় মা’রলো। অস্থির অথচ চঞ্চল গলায় ডাকতে লাগলো,

— হানি? হানি প্লিজ ওপেন ইউর আইস। এই পৌষরাত, তাকাও না। কি হয়েছে তোমার? আমার তোতাপাখি টা কেন কথা বলছে না? পৌষরাত? দয়াকরে তাকাও না। আমাকে বকো। একটুও রাগ করব না। প্লিজ পৌষরাত। একবার তাকাও।

পৌষ তাকালো না। তৌসিফ আরেকটু বুকের গভীরে নিলো ওকে। পৌষ’র মুখটা ঠেকলো ওর গলাতে। উষ্ণতা অনুভব করলো তৌসিফ। গলদেশ টা যেন পুড়ে যাচ্ছে। না জানি কখন থেকে এভাবে পরে আছে। বুয়া দৌড়ে এসে বললো,

— ডাক্তার আসছে মামা।

— পানি আনো বুয়া। ওর মাথা অনেক গরম।

বুয়া যাওয়ার আগেই মিনু দৌড়ে গেলো। তৌসিফ রুমাল ভিজিয়ে ধরলো পৌষ’র কপালে। একবারের জন্য ও বুক থেকে সরালো না। ডক্টর আসতেই তৌসিফ বললো,

— সকাল থেকে শুয়ে আছে। জলদি দেখুন।

ডক্টর চেক করার জন্য বললো,

— বালিশে শুয়িয়ে দিন স্যার।

— কি? না না৷ আমার কাছেই থাকবে। এভাবেই চেক করুন।

এক পলকের জন্য বুক থেকে সরালো না তৌসিফ। ডক্টর চেক করে মেডিসিন দিয়ে তৌসিফের দিকে তাকিয়ে বললো,

— একটু ফ্রেশ করিয়ে দিন। জ্বর নেমে যাবে এখনই। মাথায় পানি দিয়ে পারলে গোসল করান। খায়িয়ে বাকি মেডিসিন গুলো দিন। সকাল সকাল একদম ফিট হয়ে যাবে।

— টেস্ট করা উচিত আই থিংক।

— প্রয়োজন দেখছি না৷

— স্টিল। আই নিড টু নো।

— ইয়াহ্। শিওর। আম টুমরো এট ক্লিনিক।

— হুম।

ডক্টর বিদায় নিতেই বুয়া মেডিসিন আনাতে গেলো। তৌসিফ আস্তে ধীরে ডাকলো,

— পৌষরাত? হানি, একটু উঠতে হবে।

ওকে ধরেই তৌসিফ নিলো ওয়াশরুমে। ইনজেকশন দেয়াতেই ঘেমে উঠেছে একদম। তৌসিফ সোজা হুমকি দিয়েছে এখনই বৌ’কে জ্বর ছাড়াতে হবে। ডক্টর না চাইতে ও ইনজেকশন টা পুশ করেছেন। ওয়াশরুমে কোলে করে ওকে নিলো তৌসিফ। সাইডে বসিয়ে শুরুতেই বেসিনে নিয়ে মাথায় পানি দিলো। পরণে থাকা জামাটা অতি স্বাভাবিক ভাবে খুলে একদম শাওয়ারের নিচে নিলো ওকে। ঠান্ডা পানিতে লাফিয়ে উঠতে চাইলো পৌষ লাভ অবশ্য হলো না৷ তৌসিফের বাহু থেকে ছাড়া পেলো না। একদম শাওয়ার করিয়ে ওকে ছাড়লো তৌসিফ। মাথায় একটা টাওয়াল পেঁচিয়ে আরেকটা প্যাঁচালো গায়ে। বাকিটা সাহায্য করতে নিলেই অনেকটা দূর্বল কণ্ঠে পৌষ বলে উঠলো,

— পারব।

— আমি করছি।

— প্লিজ। পারব। কাপড় দিন।

তৌসিফ বের হয়ে একটা গোল ওয়ান পিস নিলো সাথে শর্ট প্যান্ট। পৌষ’কে না দিয়ে নিজেই ওয়ান পিসটা ওকে পরিয়ে দিলো। পৌষ বাকিটা করতেই ওকে নিয়ে এসে খাটে বসিয়ে নিজে তারাহুরো করে ফ্রেশ হয়ে এলো তৌসিফ। এই প্রথম! জীবনে এই প্রথম সে এত তারাতাড়ি শাওয়ার নিলো। কোন মতে মুখে একটু ফেইস ওয়াশ আর শরীরে জেল দিয়ে শাওয়ার কম্পিলিট করেছে। শুধু মাত্র পৌষ’র জন্য ই এই ত্যাগ। নাইট স্কিন কেয়ার তার করা হলো না।
পৌষ’র কাছে এসেই দেখলো ও বসে আছে। তৌসিফ ঝট করে ওর মাথা মুছে দিলো। হাতের টাওয়ালটা ছুঁয়ে সাইডে ফেলেই পৌষ’র কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে থুতনিতে এক চুমু খেয়ে বললো,

— ভয় পেয়েছিলাম।

— ঘুমাব।

— উহু। আগে খাবে।

বুয়া ততক্ষণে খাবার নিয়ে এসেছে। তৌসিফ খাবার ওর মুখে তুলে দিতেই পৌষ বললো,

— বমি পাচ্ছে।

— করো।

— খাব না।

— ঔষধ আছে।

বলে জোর করে মুখে দিলো। তৌসিফ বুঝলো ও সত্যি ই খাবে না। কোন মতে চেপে ধরে একটা ডিম খায়িয়ে দুধটা খাওয়ালো। ঔষধ খায়িয়ে বালিশে শুয়িয়ে দিয়ে ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে দিলো। পৌষ’র চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরতেই তৌসিফ চট করে মুছে দিলো। পৌষ’র একদম কাছে এসে নিজের সাথে জড়িয়ে নিতেই কেঁদে উঠলো পৌষ। তৌসিফ সাথে সাথে আরেকটু বুকে চেপে নিলো। আদুরে গলায় বললো,

— হানি, একটু পরই সুস্থ হয়ে যাবে। ঝাল করে পাস্তা রান্না করব আমার তোতাপাখির জন্য। কথা বলো না পৌষরাত। আমার খারাপ লাগছে।

কাঁদতে কাঁদতে ই পৌষ ভাঙা গলায় বলে উঠলো,

— আমি অনেক কেঁদেছি। আমার শরীর অনেক ব্যথা করেছে। কোমড়ের ব্যথায় মনে হচ্ছিলো আমি ম’রে যাব। ম’রে গেলে ভালো হতো। আমার মা-বাবার কাছে চলে যেতাম। কেউ দেখে নি আমাকে। আমার কেউ নেই। পৌষ এতিম। পৌষ’কে কেউ ভালোবাসে না। কেউ না। পৌষ কেন ম’রে যাচ্ছে না? আমি কত কাঁদলাম কেউ এলো না। কেউ না। আমি অনেক কেঁদেছি। চাচির বোন বলে আমার মুখ বেশি চলে তাই কেউ আমাকে ভালোবাসে না। কেউ না।

তৌসিফের বাম চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি পরলো। জীবনে শেষ বার কবে পানি পরেছিলো? তৌসিফের মনে পরছে না। পরবেও না কারণ সে কাঁদে না। পৌষ’কে বুকে শক্ত করে রেখে শুধু বললো,

— ভালোবাসি হানি। আমি তোমাকে ভালেবাসি। অনেক বেশি ভালোবাসি আমার তোতাপাখি কে।

#চলবে…..