প্রেমসুধা পর্ব-২+৩

0
726

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২

তীব্র বর্ষণের ইতি টেনে আকাশ ঠমক ধরে বসলো। স্থির মেঘমালার তাতে ধ্যান নেই। তারা উড়ো উড়ি করতে ব্যাস্ত। রাতের আকাশ অথচ একদম ফকফকা যেন। গাড়ির কাঁচটা বন্ধ থাকায় পৌষ আবহাওয়া ঠিক ঠাওড় করতে ব্যার্থ। শুধু জানালায় মাথা এলিয়ে বাইরে দেখে যাচ্ছে। পাশের মানুষটার দিকে তার ধ্যান জ্ঞান কিছুই নেই আপাতত। সে নিজেকে নিয়ে বিভোর। ভাবনায় তার চিরায়ত চিরপরিচিত বাড়ীটা। এমন আবহাওয়াতে নিশ্চিত ওর দলবল নিয়ে ছাদে আড্ডা জমাতো। আড্ডার মাঝেই ইনি,মিনি দুইজন চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য’র কোলে ঘুমিয়ে পরতো। রাত যখনই একটু বাড়তে শুরু করবে তখনই ছাদে আগমন ঘটতো হেমন্ত’র। সবগুলোকে ধমকে, ধামকে, থাপড়ে নিচে নামাতো। এটাই তো হতো। কিন্তু আজ হলো না। আর কোনদিন হবে বলে ও মনে হচ্ছে না। পৌষে’র বুক চিরে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো। মাথায় হঠাৎ ই যন্ত্রণা হচ্ছে। সেই যন্ত্রণা বাড়লো যখন তীব্র হর্ণের শব্দ হলো। পৌষ চমকালো। সম্মুখে দৃষ্টিপাত করতেই বুঝলো ওরা পৌঁছে গিয়েছে। এই বাড়ী পৌষ’র চেনা। খুব গভীর ভাবে না হলেও একটু চেনা। বাইরটা সে অনেকবার ই দেখেছে। ভেতরে যাওয়া হয় নি। ঐ সর্বোচ্চ গেট পর্যন্ত তাও খুব দরকারে। একবার বোধহয় ঢুকা ও হয়েছিলো তবে এই চরিত্রহীন পুরুষের ফ্ল্যাটে নয়। তার ভাইয়ের ফ্ল্যাটে।
“উফ” শব্দ করে সরতে চাইলো পৌষ। তার ভাবনায় ছেদ পরেছে। ব্যাথা দেয়া কোমড়টাতে পুণরায় শক্ত করে ধরেছে তৌসিফ তালুকদার। রাগে র*ক্ত যেন পৌষ’র টগবগিয়ে উঠছে। এই লোকের এসব ছোঁয়াছুঁয়ি ওর পছন্দ হচ্ছে না। গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। পৌষ কিছু বলার আগেই হঠাৎ জমে গেলো। তার অনুভূতি মুহুর্তেই থিতলে গেলো যেন। তৌসিফ তালুকদার তার অতি নিকটে। সহসা খিঁচে চোখ বুজে নিলো পৌষ। তাকালো না আর। তাকাবেও না। মরণ হোক তার তবে চোখ যে খোলা যাবে না।
ভারী পুরুষের নিঃশ্বাস শিঘ্রই তার সামনে থেকে হটলো। দরজা খুলে গটগট পায়ে নেমেও দাঁড়ালো। মৃদুস্বরে ড্রাইভার বলে উঠলো,

— ম্যাডাম, আমরা পৌঁছে গিয়েছে। আপনি কি এখন নামবেন?

ফট করে চোখ মেলে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো পৌষ। এদিক ওদিক তাকিয়ে ও যখন কাঙ্ক্ষিত পুরুষটাকে দেখলো না তখন শাড়ী সামলে বেরিয়ে এলো। নাহ, কোন বিয়ে বিয়ে আমেজ নেই এখানে। একদম ই না। সারা জনম কার সাদামাটা ই আছে। একটু কি সাজানো যেতো না? নিজের ভাবনায় বিরক্ত পৌষ। কেন সাজাবে? পৌষ কি আর ইচ্ছে করে বিয়ে করেছে? পরক্ষণেই খেয়াল হলো এক শক্ত হাতের মুঠোয় ওর নরম হাতটা আটকা পড়েছে। লোকটা তাকে তাকানোর বা বুঝার সময়টুকু ও দিলো না। তার বড় বড় পায়ের ধাপে পা মিলাতে বেশ বেগ পোহাতে হলো পৌষ’র। শাড়ী পরায় সেই ঝামেলা বাড়লো একটু। এক প্রকার হুমড়ি খেয়ে পরলো নীচে অথচ তার ডান হাতটা এখনও তৌসিফ ধরে আছে। পরা মাত্র ই যেন না পৌষ কান্নার সুর তুলবে ওমনিই তাকে ফট করে কোলে তুলে নিলো তৌসিফ। কান্নার সুর তো দূর ক উচ্চারণ করার সময়টুকু ও পেলো না পৌষ। বড়ই আফসোস হলো তার। কান্না করতে না পারলে তার ভেতর ফুলেফেঁপে উঠে, শ্বাস কষ্ট হয়। মনে হয় এই বুঝি ম’রে গেলো। দম আটকে আসে কেমন করে। তবে আজ সেসবের সময় হলো না। কেউ তাকে হাতে ধরে সময় দিলো ও না৷ সোজা দরজায় নক করতেই এক মহিলা দরজা খুলে দিলো। তৌসিফ কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা ড্রয়িং রুম পেরুলো। একদম মাস্টার বেড রুমে ঢুকে সযত্নে নরম বিছানাটার মাঝে রাখলো পৌষ’কে। পরপর গেলো দরজা লাগাতে।
ফাটা চোখে এদিক ওদিক তাকালো পৌষ। সারাটা ঘরময় আভিজাত্যের ছোঁয়া। পৌষ মুগ্ধ হলো। গোল গোল চোখ করে দেখলো সবকিছু। তবে সোনালী আলো থাকায় ততটাও দেখতে পেলো না। মনে মনে গালি দিলো,

— ফকিন্নি।

এমন সোনালী আলো তার কাছে ফকিন্নি ই মনে হলো। চারশত চল্লিশ বোল্ডের বাতিতে এমন হলুদ হলুদ দেখায়। তাদের বাসায় এনার্জি বাল্ব। সাদা ঝকঝকা, ফকফকা আলো ছড়ায়। একদম চকচক করে চারপাশ। আর এত বড় লোকের বাড়ীতে কি না ড্রিম লাইটের বদলে এই হলুদ বাত্তি? মানা যায় এসব? এই বাল্ব গুলোতে চৈত্র পানি ঢুকিয়ে দুটো বিটা ফিশ ছেড়েছিলো একবার। রাতে হলে চোখ ধাধানো সুন্দর লাগতো দেখতে।
পৌষ যখন ওর এলোমেলো ভাবনাতে মশগুল তখনই হঠাৎ ওর আঁচলে টান পরলো। চমকে উঠে ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো ও। বড় বড় চোখে দেখে গেলো তৌসিফ’কে। হ্যাঁ, এইতো সেই পুরুষটা। সুন্দর পুরুষ। চেহারা, দেহ, চুল, ব্যাক্তিত্ব কোনটাতেই সে পিছিয়ে নেই। পেছানো শুধু চরিত্রের দিক থেকে। যেটা একজন ব্যাক্তির সবটুকু সত্বা বহন করে তৌসিফ তালুকদারের সেটাই নেই।
কথাটা মনে পরতেই সবে মাত্র মুগ্ধ হতে শুরু করা পৌষ ভাবনার জাল ভেদ করে বেরিয়ে এলো। তৌসিফ তালুকদার ততক্ষণে এগিয়ে আসছে পৌষ’র দিকে। এই একা বাড়ীতে বদ্ধ দরজার ভেতরে পৌষ’র সকল সাহস পালালো। তার নজর বন্দী হলো শুধু হলুদ আলোয় আলোকিত এক সুদর্শন পুরুষ যে এগিয়ে আসছে পৌষ’র দিকে। পৌষ যেন এই মুহূর্তে বাক শক্তি ও হারিয়ে ফেললো। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তৌসিফ তালুকদারের দিকে। তবে কি আজ ই তার জীবনের বড় বড় দুটো ধাক্কা একসাথে এলো?

___________________

— হেমু?

বাবা’র ডাকে হেমন্ত তাকালো। ছাদে একা দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান বসিয়েছিলো মাত্র। দুটো টান দেয়া হয়েছে সবে। এমনটা নয় সে লুকিয়ে লুকিয়ে খায়। সবাই জানে কিন্তু ততটাও অভদ্রতা হেমন্ত দেখায় না যে বাপ-চাচাদের সামনে সিগারেট টানবে। তাই তো জলন্ত সিগারেটটা নীচে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললো। জ্বলন্ত আগুন নিমিষেই বুজে গেলো শুধু বুজলো না হেমন্তের বুকের আগুনটা। ওর বাবা ওর পাশে এসে দাঁড়াতেই হেমন্ত মাথা নিচু করেই বললো,

— কিছু বলবে?

— আমার কি কিছু বলার আদৌ বাকি আছে?

— সেটা তো আমি জানি না বাবা। নিজের যা ইচ্ছে হলো করলে তুমি। এখন বলছো বলার বাকি আছে নাকি নেই?

— শুধু আমার একার ইচ্ছেতে এটা হয় নি হেমু। তুমি জানো সেটা। পৌষ আমার দায়িত্ব।

তাচ্ছিল্য হাসলো হেমন্ত। বললো,

— দায়িত্ব বরাবর পালন করেছো বাবা। গুড নাইট।

বলে এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলো না হেমন্ত। গটগট পায়ে নীচে নেমে এলো। এই মুহুর্তে তার সহ্য হচ্ছে না তার বাবাকে।
নীচে সোজা পৌষ’র রুমে ঢুকলো হেমন্ত। ঢুকা মাত্র ই চমকালো। পাঁচ বাদর বসা এখানে। এদের মধ্যে দুটো ঘুমে কাঁদা। পিহা ও ঢুলছে। জৌষ্ঠ্য আর চৈত্র সজাগ পুরোপুরি। এদের সন্ধ্যা থেকেই দেখা যাচ্ছিলো না। মাতম জমাচ্ছে তারা তাদের ভালোবাসার একমাত্র বোনের জন্য। পৌষ এ বাড়ীর কি তা প্রতিটা ইট জানে। প্রতিটা জান জানে অথচ চঞ্চলা পৌষটা এখন নেই। থাকলে এখন দৌড়ে হেমন্তের কাছে এসে আবদার জমাতো। রাত হলেই তার হাবিজাবি খেতে মন চায়। তার নাকি ভয়ংকর ক্রেভিং হয়। না জানি পৌষ’টা খেলো কি না? ওখানে কি কেউ জানে দিন ভর না খাওয়া পৌষ রাত হলেও ক্ষুধায় কেঁদে ও ফেলে? তার যে ঝুড়ি ঝুড়ি আবদার। কে পূরণ করবে সেগুলো? তৌসিফ তালুকদার কি তার খবর রাখবে নাকি পৌষ’টাকে শুধু স্ত্রী দায়িত্ব ই পালন করতে হবে?

#চলবে….

[আপনাদের আগ্রহ আর ভালোবাসা দেখে আমি সত্যি ই আপ্লূত।]

রোদ আজ আর ঘুমাতে পারে নি। সকাল সকাল যেই কান্ড’টা আজ ঘটলো। মনটা রোদের এখনও খুঁচখুঁচ করেই যাচ্ছে। লোকটার কন্ঠস্বরের নিরুত্তাপ ভাবটা ওকে ভাবিয়ে তুলছে বারংবার। কেমন ভরাভরা একটা গলার স্বর। শুনতেই মন চায়। দুষ্ট রোদের মাথায় দুষ্টামি চাপলো। নিজের সকল আকাজ, কুকাজে ও সঙ্গী বানায় ইয়াজ’কে। রোদের বন্ধু ইয়াজ। একই গলিতে বাসা ওদের। নাস্তা না খেয়েই ওরনা মাথায় পেঁচিয়ে ছাদে উঠলো রোদ। পুরাণ ঢাকার বাসা হওয়ার এই এক সুবিধা হলো ছাদ টপকে আরেকজনের বাসায় ঢুকা যায়। এই যে রোদ এখন পরপর ছয়টা ছাদ টপকে ইয়াজদের ছাদে ল্যান্ড করলো। ইয়াজ ছাদেই ছিলো। বেচারা হাতে ডাম্বল তুলে বডি বিল্ড করার চেষ্টা করছে। রোদ খিকখিক করে হেসে উঠলো। ওমনিই চোখ তুলে তাকালো ইয়াজ। বজ্জাতটা দাঁড়িয়ে সামনে। রোদ ফটাফট বলে উঠলো,

— কিরে ইয়াজ পিয়াজ? আর কত ডাম্বল নিয়ে হুরোহুরি করবি? এদিকে আয়। গুড নিউজ আছে একটা।

ইয়াজ ঠিকই ডাম্বল রাখলো। বয়স দু’জনের এক না। ইয়াজ বড় বছর তিন চারের অথচ এদের মিল যেন সমবয়সী। ইয়াজকে দেখেই মুখটা চোরা চোরা বানালো রোদ। এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— একটা মাল পেয়েছি দোস্ত। একদম টাকা পয়সা ওয়ালা। মজা হবে। হেল্প করবি?

খুকখুক করে কাশলো ইয়াজ। “মাল” পেয়েছে মানে? রোদের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিতেই রোদ সবটা খুলে বললো। ইয়াজ মজা পেলো ব্যাপারটা নিয়ে। নিজেও দাঁত কেলিয়ে হাসলো। ভালো ইনকাম হবে শালা বুড়াটার থেকে।
ইয়াজ দাঁত বের করে হেসেই বললো,

— অন্যের টাকা মারার মজাটাই আলাদা।

— একদম।

হঠাৎ নিচ থেকে ডাক পরতেই ইয়াজ বললো,

— চল। নাস্তা খাবি।

রোদ না করলেও ইয়াজ শুনলো না। দুইজন নিচে নামতেই ইয়াজের মা হেসে বললেন,

— রোদ মা আমার, এত দাম দিয়ে তোর চাচা গেট বানালো একদিন গেট দিয়ে বাসায় ঢুক।

রোদ কলাতে কামড় বসাতে বসাতে বললো,

— গেট দিয়ে ঢুকতে হলে অনেক হাটতে হবে চাচি।

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩

ভেজা গায়ে একটা টাউজার পরে কাঁধে টাওয়াল নিয়ে বেরিয়ে এলো তৌসিফ। চুলগুলো থেকে টুপুরটুপুর এখনও বিন্দু কণা ঝড়ে যাচ্ছে। সুন্দর মানুষটাকে বেশ মানালো এতে। বড়ই আফসোস হলো তার জন্য। এত সুন্দর এই পুরুষটার এহেন ভেজা রুপ কারো মতিভ্রম করালো না? খাটের কোণে বসা রমণীর কি একটু চক্ষু ও ধাধালো না?
পুরুষটার শরীরের মতাল মতাল ঘ্রাণটা কি নারীটির নাসারন্ধ্রে ও ঠেকলো না?
তৌসিফ গভীর দৃষ্টি ফেলে দেখলো পৌষ’কে। হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। কিছুটা মায়া হলো তৌসিফের। এমন টা না হলেও হতো। মেয়েটাকে একটু সময় দেয়া উচিত ছিলো। তৌসিফ চেয়েছিলোও তাই কিন্তু পৌষ’র জন্য তা হলো না। ধৈর্য্যর পরিক্ষায় বরাবরই শূন্য’র কোঠায় তৌসিফ তালুকদার। তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী’কে মুগ্ধ নয়নে দেখলো সে। গলার স্বর খাদে নামিয়ে ডাকলো বহু আদরের স্বরে,

— পৌষরাত।

ঝঙ্কার তুললো এই ডাক পৌষ’র দেহে। এতটা খন, এতটা ঘন্টা পর এই লোক কথা বললো। পৌষ’র কান ভেদ করে ডাকটা কলিজায় লাগলো একদম৷ ফালাফালা করে দিলো তার খয়েরী রঙের হৃদযন্ত্রটাকে। আহত চোখদুটো দিয়ে পানি গড়ালো। পৌষ মাথা তুললো না। একটা বার চেয়েও দেখলো না অনুতপ্ত তৌসিফ’কে। রা করলো না মুখে।
উত্তরের আশায় থেকে হাল ছাড়লো তৌসিফ। পৌষ’র এলোমেলো চুলে এক হাত রেখে বললো,

— চলো গোসল করবে।

এবারেও পৌষ নড়লো না৷ তৌসিফ পুণরায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই হুট করে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে পরলো পৌষ। পায়ের সামনে থাকা কাঁথাটা দিয়ে ঢেকে নিলো নিজেকে আপাত মস্তক।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তৌসিফ দেখলো। চাইলো একবার ডেকে বলতে খাবারের কথা। পাশেই টেবিলে পরে আছে। ঐ বাড়ীতেও তো খেলো না৷ এখনও খেলো না। তৌসিফ নিজে একাই খেতে বসলো। ভাতে হাত দিলেও ভক্তিতে টানলো না। উঠে হাত ধুয়ে সরে গেলো সেখান থেকে। পৌষ ঘুমিয়েছে কি না বুঝা গেলো না। তৌসিফ বারান্দায় চলে গেলো ধীর পায়ে। দূর আকাশে আজ চাঁদের আনাগোনা নেই। একদম খালি সেটা তৌসিফেরই মতো। সিগারেট জ্বালিয়ে তাতে টান দিলো সাথে সাথেই নাক, মুখ ভর্তি ধোঁয়ায় বিষাক্ত হয়ে উঠলো চারপাশ।

খুক খুক কাশির শব্দে তৌসিফের কান সজাগ হলো কিছুটা। নিশ্চিত সিগারেটের গন্ধটা হয়তো পৌষ সহ্য করতে পারে না তাই কাশছে। অ্যাশ ট্রে’তে পিষে বড় বড় শ্বাস ফেলে মুখে একটা চুইংগাম চিবুলো তৌসিফ। যতটুকু পারলো নিজেকে ফ্রেশ করে রুমে ঢুকলো। নাক, মুখ ঢেকে এভাবে ঘুমাতে দেখে তৌসিফের ই যেন দম বন্ধ দম বন্ধ অবস্থা। এভাবে কিভাবে ঘুমায় মানুষ। পৌষ’র দিকে ঝুঁকে কাঁথাটা মুখ থেকে সরাতে চাইলো। লাভের লাভ ছাই কিছুই হলো না। পৌষ আরো মুড়িয়ে শুয়ে রইলো। দেখে মনে হলো একদম প্যাকেট করা। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তৌসিফ ও পাশে শুয়ে পরলো। সোজা দৃষ্টিটা তার বদ্ধ রুমের দেয়ালে। এই রুমটাতে তার হাজার খানিক স্মৃতি। কতশত আদুরে আদুরে মুহূর্ত। সবটা ঘিরে থাকা এক সুন্দরী রমণী। না চাইতেও তৌসিফের মস্তিষ্ক একবার তুলনা দিয়ে ফেললো। পৌষ সেই তুলনায় ততটা সুন্দর না। তার পিয়াসা ছিলো একদম লাল পেয়ারার মতো মিষ্টি। তার চাল চলন, বাচন ভঙ্গি, হাটা চলা সব কিছু মুগ্ধতা ছড়াতো। কেউ না চাইলেও দ্বিতীয় বার ঘুরে তাকে দেখতো। সবচাইতে সুন্দর রমণীকে নিজের ঘরণী করেছিলো তৌসিফ তালুকদার। সমস্যা রয়ে গেলো ঘাটে। যেই ঘাটের পানি স্বচ্ছ দেখে তৌসিফ মুখ ডুবালো। চাইলো প্রাণ ভরে পান করে তৃষ্ণা মেটাতে সেই পানিই ছিলো দূষিত। পানি জিনিস টা কিন্তু অদ্ভুত। এটা নষ্ট হোক। দূষিত হোক। এটা দেখে বুঝা যায় না। যতক্ষণ না পানি মুখে নেয়া হবে, এর স্বাদ গ্রহণ করা হবে ততক্ষণ বুঝা দায় আসল সমস্যা টা কি ঐ পানিতে। যেই পানিকে তৌসিফ অমৃত, বিশুদ্ধ সুধা ভেবে পান করেছিলো, মজে ছিলো যার রসে ভরা প্রেমে সেই প্রেমের সুধা তাকে ঘোল খায়িয়ে ছাড়লো। ছাড়লো তো ছাড়লো একদম ভরা মাঠে একা ছেড়ে চলে গেল। তৌসিফ তখন সাতার না জানা এক সাঁতারু। সে ডুবলো। শুধু কি ডুবলো সে অতলে হারিয়ে গেলো। সকলের সম্মুখে ডাট, ফাটে চলা তৌফিক তালুকদারের মুখে চুনকালি মেখে চলে গেলো পিয়াশা। সে পিছু তাকায় নি। এত এত প্রেমের সুধা রেখে সে তার সুখ খুঁজেছিলো ভিন্ন কিছুতে।
যাকে তৌসিফ নিজের গন্তব্য ভেবে থমকে ছিলো তার সেই গন্তব্য নিজেই আরেক গন্তব্য খুঁজছিলো। দোষটা তাহলে কাকে দেয়া যায়? প্রশ্ন টা তো রয়েই যায়।

________________

ভোর কেটে গিয়ে সকাল হতে শুরু করলো। চারপাশে পাখির এমন কান ধাঁধানো শব্দ যা শুনে আর টিকতে পারলো না পৌষ। ক্ষুধায় পেটটা যখন মুচড়ে উঠলো তখনই অলস পৌষ মুখ থেকে কাঁথা সরালো। দিন দুনিয়ার হুশ হারিয়ে পৌষ তখন সব ভুলে গিয়েছে। তবে সাময়িক সুখ তার কপালে সইলো না। বিশাল চওড়া চওড়া দুটো পেশি বহুল বাহুতে নজর পরতেই চমকে তাকালো পৌষ। ফর্সা বাহুতে ফাটা চোখে তাকিয়ে যতটুকু পারলো নজর লাগালো ও। বলা তো যায় না এই সুযোগ আবার আসবে না কি?
গতরাতের কিছু কথা মনে পরতেই পৌষ’র ধ্যান ভাঙলো। উদাম গায়ে থাকা তৌসিফ তালুকদারকে আরেকবার দেখেই সে ওয়াশরুম ছুটলো। রাত ভর সে চেপে রেখেছিলো। এখন ওয়াশরুম যাওয়াটা মাস্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই দুই বার ইউরিন ইনফেকশন হয়েও শিক্ষা হলো না তার। পৌষ জানে আগামী দুই বারেও তার শিক্ষা হবে না৷
ওয়াশরুম ঢুকা মাত্র বাঁধলো বড় বিপত্তি। এত বড়সড় সাদা বাথরুম পৌষদের না৷ উচ্চ মাধ্যবিত্ত পরিবারের যা থাকে তা তাদের আছে। ইয়া বিশাল বড় এক জমিদার বাড়ী ও বলা চলে তবে এই রাজপ্রাসাদের ন্যায় না৷ মুখ ভেঙালো পৌষ। ফকিন্নিদের আবার এত ঢং। হলুদ বাত্তি জ্বালায় রাতে অথচ এখন দিন দাহারে ও এসব হলুদ বাতি দেখতে হবে? বাথরুম মানেই তো রেস্ট রুম। এই রেস্ট রুমে হলুদ বাতি কে লাগায়? আজব!

#চলবে….

[ ফাইনাল পরিক্ষা চলে….পরিক্ষার পর থেকে রেগুলার আসবে ইনশা আল্লাহ।]

ঢাকা’র রমনা পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছে রোদ, দিশা। তখনই ওদের সামনে এসে দাঁড়ায় এক চ্যাংড়া ছেলে। হাসিমুখে বলে উঠে,

“দিশু?”

দিশা হতভম্ব। বাকরুদ্ধ। এই চ্যাংরাটা কে? রোদ তো মুখ ফুটে জিজ্ঞেস ই করে ফেললো,

“আপনি ইমু?”

ইমু নামের ছেলেটা লাজুক হাসতেই গা, পিত্তি জ্বলে উঠে দিশার। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আঙুল তুলে শাসিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“ মিথ্যা কথা বললে থাপড়ে গাল লাল করে দিব বেয়াদপ ছেলে। ইমু’কে দেখি নি আমি?”

ইমু মাথাটা নিচু করে বললো,

“ ওটা তো টার্কিস একটা ছেলের ছবি ছিলো দিশু। তুমি আমাকে ধমকাচ্ছো কেন?”

দিশার মাথায় হাত। বলে কি এটা? যেই ছবি দেখে ওর মনে মাদুলী বাজলো। সিতারা’র সুর বাজলো সব কি না মিথ্যা? এটা হতে পারে? রাগে, কষ্টে দিশা ধমকে বলে উঠলো,

“ দূর হ চোখের সামনে থেকে আমার। শালা চ্যাংড়া কোথাকার।”

ইমু যাবে না কিছুতেই। ছলছল চোখে তাকাতেই এবার দিশা পাশ থেকে একটা ইটের টুকরো তুলে নিলো ওমনি উল্টো পথে দৌড় ইমু। রাগে গজগজ করতে কেঁদে ফেললো দিশা৷ এটা কি হলো? এই নিয়ে পরপর তিনবার ছ্যাঁকা খেলো ও। কাঁদো কাঁদো মুখে রোদের দিকে তাকাতেই স্ব শব্দে হেসে উঠে রোদ। এই কাঠফাটা রোদে রোদের হাসি যেন বিগড়ে দিলো দিশার মস্তিষ্ক খুব বাজে ভাবে।

চলবে।