#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৩
ভোর কেটেছে সেই কখন। বাইরে পাখির কিচিরমিচির শুনা যাচ্ছে। তালুকদার বাড়ী আধুনিক ভাবে তৈরী করা হলেও এর চারপাশে প্রকৃতির সমারোহ। চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য এটা ঘিরে। সম্মুখে থাকা ঘাটটা যেন গ্রামীণ এক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলে। এই ঘাট’কে ঘিরে রয়েছে বিরাট ইতিহাস। তৌসিফের এক ফুপি’কে নাকি খারাপ কিছু এখানে মে-রে ফেলে রেখেছিলো। তার তখন ছোট্ট ছয় মাসের বাচ্চা। সেই বাচ্চার কাঁথা ধুতে এসেছিলো সে ঘাটে সন্ধ্যার সময়। ফিরে আর আসা হয়নি তার। তার দেহে কোন ক্ষয় দেখা যায় নি শুধু গালে পাঁচ আঙুলের থাপ্পড়ের দাগ ছিলো। এটা যে অশুভ কিছু ছিলো তা বুঝতে কারো সমস্যা হয় নি। এই ঘটনা অবশ্য অনেক পুরাতন তবে সেই থেকে এই ঘাটকে ঘিরে এলাকার মানুষের নানান জল্পনা কল্পনা। এখন যদিও একটা পন্ডের মতো এটা। পরিষ্কার স্বচ্ছ পানি। সাইডে একটা নৌকা ও বাঁধা। তৌসিফ এখানে মাছের পোনা ছাড়িয়েছে। প্রায় সময় মাছ তুলে ও। শখের তার কমতি নেই।
ঘাটের উপর বিরাট কৃষ্ণচূড়া গাছটা উঁকি দিয়ে আছে। সেখানেই বসা ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। নিজেদের স্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে তারা। চারদিকে মৃদু বাতাস যেন আজ প্রকৃতিকে আরো চাঙ্গা করে তুলছে।
তৌসিফের বুকে ভেজা পৌষ। জ্বর ছাড়তেই ঘেমে অস্থির ও। তৌসিফের বুকে থাকাতে তৌসিফ ও ভিজে উঠেছে। মৃদু শব্দে গুঙিয়ে উঠলো পৌষ,
— উমমম। ব্যথা।
তৌসিফ প্রথমে বুঝলো না। পরক্ষণেই খেয়াল হলো ওর বুকে কেউ। চোখ মেলতেই দেখলো পৌষ। সবার আগে ই ওর হাত পৌঁছালো পৌষ’র কপালে। দেখলো ভেজা কপাল। জ্বর ছেড়েছে। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট বের হলো,
— আলহামদুলিল্লাহ।
ঘুমের রেশ তার এখনও কাটে নি। টেনে চোখ খুলে বললো,
— কেমন লাগছে হানি?
পৌষ চোখ বুজে আছে। এখনও নেতিয়ে আছে তৌসিফের বুকে। ঘড়ির দিকে তাকালো তৌসিফ। সকাল নয়টা। উঠা উচিত। পৌষ’কে খাওয়াতে হবে। মেডিসিন দিতে হবে। আজ মর্নিং ওয়াক টা মিস গেলো। জিমটাও মিস গেলো। তৌসিফ ভেবে নিলো যেকোনো ভাবেই হোক না কেন এক ঘন্টা জিম করতেই হবে। একদিন না করলেই মনে হয় মাসল গুলো হয়তো চুপসে গেলো। চিন্তায় ঘুম হয় না। বডি ফিটনেস নিয়ে সে খুবই সচেতন। বিগত ছয় বছর ধরে একই ওজন ধরে রাখাটা মুখের কথা না। এক কেজি ও এদিক ওদিক হতে দেয় না ও। এই যে বিয়ের পর থেকে ওর রুটিনে উলোট পালোট করেছে পৌষ তাতে ও তৌসিফের সমস্যা হয় নি। ট্রেইনারকে দিয়ে এক্সট্রা জিম করে নিয়েছে ও। দুই দিন হলো ইয়োগা ধরেছে। এতে শরীর বুড়িয়ে যায় না। হাহ্ কতই না তোরজোর এই শরীর ফিট রাখার জন্য।
ফোঁস করে শ্বাস ফেললো তৌসিফ। আস্তে ধীরে পৌষ’কে নিয়ে ই উঠে বসলো। পৌষ’র চুলগুলো একত্রে করে সাইড থেকে একটা বড় ক্লিপ দিয়ে আটকে গালে হাত দিয়ে নরম স্বরে বললো,
— হানি,একটু উঠতে হবে।
— পরে উঠি?
ভালো লাগে না। একদম ই ভালো লাগে না তৌসিফের। তার বউ তো এমন না। এত অসহায় কণ্ঠ তো তার বউয়ের না। তাও কি না পরে উঠার অনুরোধ করে? সে তো বসে বসে তৌসিফকে নাচানোর মেয়ে। এমন নাচ নাচায় মাঝেমধ্যে তো তৌসিফের মনে হয় ও একটা বান্দর যাকে ডুগডুগি বাজিয়ে নাচায় পৌষ। এতে অবশ্য মন খারাপ হয় না ওর। এমন একটা চঞ্চলা প্রাণের ই অভাব তার জীবনে।
পৌষ’কে কোলে তুলে নিলে তৌসিফ। একেবারে ওয়াশরুম নামিয়ে দিতেই হয়তো হঠাৎ মাথা ঘুরালো পৌষ’র। সাপোর্ট হিসেবে পেছন থেকে ধরলো তৌসিফ। মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— বেশি খারাপ লাগছে?
— উহু।
— এভাবেই থাকো। আমি ফ্রেশ করাচ্ছি।
ব্রাশ থেকে নিয়ে মুখ ধোঁয়ানো পুরোটাই করলো তৌসিফ। ঘেমে ভিজে যাওয়াতে ভেজা টাওয়াল দিয়ে পৌষ’র ঘাড়,গলা মুছিয়ে ফ্রকটা পাল্টে দিলো। এবারেও লং কোন প্যান্ট তৌসিফ দেয় নি। শুধু ধীরে বললো,
— পি করবে?
— হু।
তৌসিফ বেরিয়ে এলো। দরজা লক করতে নিলেই গমগমে স্বরে তৌসিফ বললো,
— আমি দাঁড়িয়েছি। লক করতে হবে না। তোমার পাহারাদার আছে না।
বেশি না হয়তো দুই মিনিট গেলো এরমধ্যে ই পাঁচবার ডাক দিলো তৌসিফ,
— হানি? হানি খুলব? হানি আসব?
এমনি সময় চাঙ্গা থাকতে ওর চৌদ্দ গুষ্টির নাম ভুলিয়ে দিতো পৌষ তবে শরীরে শক্তি না থাকায় আপাতত চুপ রইলো। এই দফায় তৌসিফ ঢুকেই পরলো। পৌষ তখন হাত ধুচ্ছিলো। ওকে নিয়ে ই বের হলো তৌসিফ। সোফায় বসিয়ে জোরে বুয়াকে ডাকলো। বুয়া আসতেই তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— বেড শিট চেঞ্জ করো। আর হ্যাঁ লাইট কালারের চাদর বিছাবে।
মাথা নেড়ে বুয়া চলে যেতেই তৌসিফ পৌষ’র কাছে বসলো। থুতনিতে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে বললো,
— কি খাবে আমার তোতাপাখি?
— কিছু না।
— খেতে তো হবে হানি। তোমার তো পাসতা পছন্দ।
— ভালো লাগছে না।
কাঁদো কাঁদো গলায় বললো পৌষ। তৌসিফ বুঝলো। বললো,
— খেলেই তোমাকে চেক আপে নিব হানি। হুট করে কেন জ্বর এলো?
কথায় আছে রশি জ্বলে গেলেও বল নিভে না। পৌষ’র তাই হলো। কাঁপা কাঁপা চোয়ালে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
— আপনার শয়তান ভাই উল্লুকের মতো হাত দিয়ে থাপ্পড় মে’রেছে আমাকে তাই জ্বর এসেছে।
তৌসিফ তারাতাড়ি বউকে শান্ত করতে চাইলো। মাথায় হাত বুলালো। বুয়া ততক্ষণে এসে চাদর পাল্টে নাস্তা ও দিয়ে গেলো। তৌসিফ পৌষ’র মুখে তুলে খাওয়ালো। তিন চার চামচ খেয়ে পৌষ আর খাবে না। না মানে না ই। এই না কে আর হ্যাঁ তে পরিবর্তন করা গেলো না। সেই এঁটো থেকেই তৌসিফ খেয়ে নিলো। পৌষ’কে ঔষধ খায়িয়ে চুলগুলো কাটা ছাড়িয়ে আঁচড়ে দিলো সুন্দর করে। এত সুন্দর বড় বড় লম্বা চুল। অনেকদিন হলো ঘ্রাণ নেয়া হয় না। নাক মুখ ডুবালো তৌসিফ। বড্ড নেশালো লাগে তার এই ঘ্রাণ। আচমকা পেছন থেকে পৌষ’র কোমড় জড়িয়ে ধরলো তৌসিফ। কাঁধে মুখ ডুবিয়ে অনায়াসে তা ঘঁষে বললো,
— কবে যে মেনে নিবে আমাকে তুমি?
— কোন দিন ও না।
— অপেক্ষা করতে জানি আমি।
— উমম।
— হামমম।
মুখ তুলে চুলগুলো সুন্দর করে বাঁধলো তৌসিফ। একবার বউকে দেখলো হেড টু টোস। এই প্রথম হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ফ্রক পরা দেখেছে ওকে তৌসিফ। বাচ্চা ই লাগে।
আচমকা বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে তৌসিফ বিরক্ত হলো। তৌফিকের গলা শুনা যাচ্ছে। তৌসিফ পৌষ’কে বসিয়ে নিজে গেলো বাইরে। তৌসিফ’কে দেখেই যেন ফুঁসে উঠলো তৌফিক। চেঁচিয়ে উঠে বললো,
— কোন সাহসে তুই আমার এত ক্ষতি করলি?
না বুঝার মতো মুখ করে তৌসিফ বললো,
— কি হয়েছে?
বলেই মিনুকে বললো,
— বুয়াকে কফি দিতে বল।
ভাইয়ের এমন গা ছাড়া ভাব মেনে নিতে পারলো না তৌফিক। দাঁত পিষে বললো,
— ডিল ক্যান্সেল করলি কেন? কাল আমার একটা জাহাজ ও বন্দরে ঢুকে নি। কেন?
— আমি কি জানি? আজব কথা বলেন ভাই। প্রজেক্ট লাভবান মনে হলো না তাই ক্যান্সেল আর জাহাজ যা আমার নামে আছে তা ই বন্দরে ঢুকেছে। লিগ্যাল ব্যাপার স্যাপার ইউ নো।
তৌসিফ একটু থেমে বললো,
— সকাল সকাল এসেছেন। নাস্তা করে যান। ঘরে গেলেই ভাবী আবার মাথা খাবে আপনার তার থেকে এখান থেকে ই খেয়ে যান।
তৌফিক যা বুঝার বুঝলো। বউয়ের কথায় কান দিয়ে গতকাল পৌষ’কে চড় মা’রার ফলাফল ই যে এটা তা বুঝা হয়ে গেলো ওর। কোনমতে দাঁত চেপে চলে গেল নিজের ফ্লাটে। তৌসিফ স্পষ্ট শুনলো ভাবীকে ঝাড়ছে বড় ভাই। তৌসিফ ব্যাঙ্গ করে বললো,
— গুড।
______________________
গাড়িতে করে পৌষ’কে নিয়ে বের হলো তৌসিফ। হসপিটালে নিয়ে জোর করে টেস্ট করাবে এখন ও। মাথা থেকে পা সব। পৌষ রাগে, দুঃখে কেঁদেই ফেললো এবার। কোন পা’গলের পাল্লায় পরলো এটা ও। এত না করলেও শুনলো না। ইউরিন টেস্টের টেস্ট টিউব দেখেই বিচক্ষণ ভঙ্গিতে তৌসিফ বলে উঠলো,
— তোমার মনে হচ্ছে বিলিরুবিন কম।
লজ্জায় ম’রে যেতে মন চাইলো পৌষ’র। নার্স গুলো হেসে উঠলো। তৌসিফের তাতে আসে ও না যায় ও না। মনে মনে গালি দিলো পৌষ,
— শা’লা ধান্দাবাজ। শরীরটা ভালো হোক তোকে যে কি করব তা আমিও জানি না।
আল্ট্রা করাতে গিয়ে ঝামেলা বাঝলো। পাকনামি করে আগে ইউরিন টেস্ট করিয়ে এখন বোতলের পর বোতল পানি গিলালো ওকে তৌসিফ। হায় কি কপাল! তৌসিফের সাথে আজ পেরে উঠলো না পৌষ। ফুল বডি চেকআপ করিয়ে যেই না ব্লাড নিবে ওমনিই তিড়িংবিড়িং শুরু করলো পৌষ। সে কি কান্ড! তৌসিফ আহত হলো। তার গলায়, গালে খামচি লাগলো দুটো। নার্স দু’জন মিলে ধরলো কোনমতে। পৌষ চিৎকার করে উঠলো,
— ছাড় আমাকে। ছাড় বলছি। দিব না র*ক্ত। আমার শরীরে র*ক্ত নেই। ওরে কুত্তা ছাড় আমাকে। হেমু ভাইইই, বাঁচাও। ছাড় আমাকে, ঐ ব্যাটার শরীর ভরা র’ক্ত। ওনার থেকে নে।
ডক্টর বড়ই বেকায়দায় পরলো। তৌসিফ দমে নি। ওর বউকে একদম সুস্থ চাই। যে কোন মূল্যে চাই। মৃত্যুকে বড়ই ভয় পায় সে। মা’কে এক অবহেলার কারণে ই হারিয়েছে ওরা। পৌষ’কে হারানো যাবে না। কিছুতেই না।
#চলবে….
সময় গড়ায়। দিন যায়। মাস কাটে। সবটার বদল ঘটে। তোঁষা’র মাথায় তেল দিতে বসেছে আরহাম। মাথায় চুরুনী চালনা করতেই হঠাৎ এক গোছা চুল চলে এলো আরহামে’র হাতে। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো আরহাম। ধীর গলায় তোঁষা জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে প্রাণ? বেণী করে দাও।
— হ..হু? ওহ্ হ্যাঁ দিচ্ছি।
বলেই কোনমতে চুলগুলো বেণী করলো। লুকিয়ে ফেললো এক গোছা চুল। তোঁষার কেমো চলছে। মেয়েটা কিভাবে যেন মেনে নিলো সব। আরহাম সেদিন যখন জ্ঞান হারালো তখন তুষা’র হসপিটালে এসেই জানতে পেরেছিলো ওর পুতুলের সত্যি। ওর পুতুল আর থাকবে না। কথাটা ভেবেই যখন পাগল প্রায় তুষার তখন আরহামে’র পরিবর্তন সকলের নজর কাটলো। ছেলেটা চুপ করে গেলো। শুধু অনুরোধ করেছিলো,
— আমাকে তুঁষ’কে কিছু বলো না। ও ভয় পাবে শুনলে।
ওর তুঁষকে কারো বলতে হয় নি। দিন দুই পরই তোঁষা’র অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। বাড়ীতে রাখা গেলো না কোন ভাবেই। হসপিটালে ভর্তি হওয়ার পর ই তোঁষা জানতে পারে সত্যি টা। থম মেরে তোঁষা সেদিন বসেই রইলো। মা,চাচি সহ কারো কান্না ই যেন কানে ঢুকলো না৷ মেয়েটা শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। দেখলো সকলকে। পৃথিবীর বুকে কিছু দিনের মেহমান কথাটা জানার পর একটা মানুষের অনুভূতি কেমন হওয়া উচিত তোঁষা’র জানা নেই। জানা নেই ওর আরহাম ভাই কিভাবে থাকবে? জানা নেই কিভাবে বাঁচবে ওর প্রাণ? ছোট্ট প্রাণ এত তারাতাড়ি মা ছাড়া হয়ে কিভাবে টিকে থাকবে দুনিয়ার বুকে? ওর অশিক্ষিত মা নিয়ে কেউ মজা করবে না। আরহাম ভাই’কে আর কোনদিন তোঁষা জড়িয়ে ধরে অভিযোগ করতে পারবে না। তোঁষা কোথায় থাকবে? বৃদ্ধ বয়সে প্রাণের হাত ধরে হাঁটা হবে না।
তোঁষা আর ভাবে না। তার ভাবনা গুলো ফুরিয়ে আসে।
প্রাণ হাতে একটা বল নিয়ে ছুঁটে এলো মায়ের কাছে। তোঁষা’র মাথা ঘুরছে তবুও ছেলেকে ধরে বললো,
— খাবে না বাবা?
— মাম চলো না বল খেলি।
তোঁষা ভাবলো আর তো কিছুদিন। ঘুরাক মাথাটা। ছেলের আবদার রাখতে বল হাতে নিলো তোঁষা। পাঁচ মিনিট হয়তো টিকতে পারলো অতঃপর ধাম করে বসে পরলো। প্রাণ দৌড়ে এসে মা’কে ধরে৷ কেঁদে ফেলে শব্দ করে। আরহাম আজকাল যেন কিছু করার শক্তিটুকু ও পায় না৷ এসে তোঁষাকে ধরে উঠিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দেয়। প্রাণের মা’কে জড়িয়ে ধরে। সে ভয় পেয়েছে।
এরপরের সময় বা ঘটনা কোনটাই সুখের নয়। তোঁষা একদিন গা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
— প্রাণ দেখো না এসব কি হচ্ছে?
আরহাম তারাতাড়ি ওর বাহু দেখলো। একে একে কাপড় সরিয়ে দেখতেই দেখলো সারা শরীরে ছোপ ছোপ দাগ। তোঁষা থম ধরে গেলো। সেদিন সকালেই ঘুম থেকে উঠে সে টের পায় তার চুলগুলো অবশিষ্ট নেই। মা’কে দেখেই গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠে প্রাণ। তার কাছে ভয়ংকর লাগে মায়ের রুগ্ন, দাগযুক্ত মুখটা।
ছেলের কান্নার শব্দকে ছাড়িয়ে গলা ফাটিয়ে কাঁদে সেদিন তোঁষা। প্রতিটা রুহ যেন কেঁপে উঠে সেই কান্নায়৷ আরহাম প্রতিবারের ন্যায় স্থির রইতে পারে না। তোঁষা’কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে সে। একটা পুরো পরিবার কাঁদছে। মা, বাবা,ছেলে। তাদের কান্না প্রকৃতিতে গুঞ্জন তুললো। অকৃত্রিম শোকের ছায়ায় ঢেকে গেলো আরহাম তোঁষা’র ঘরটা।
#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৪
সুস্থ একটা মানুষ’কে অসুস্থ করে হসপিটালে ভর্তি করানো হলো। সামান্য জ্বর’কে কেন্দ্র করে টেস্ট করাতে এসে হসপিটালে এডমিট হওয়ার ঘটনা বিরল। একদম ই বিরল। সেই বিরল কাজ টা ই করে দেখালো তৌসিফ। ওর সামনেই বেডে শুয়ে আছে পৌষ অথচ ওর মধ্যে ছিটাফোঁটা ও অনুতাপ নেই। শোক নেই। এখনও দুটো টেস্ট বাকি। এই যে পৌষ এত করে বলছে ও করাবে না কিন্তু তৌসিফে’র সাথে পেরে উঠছে না। না মানে না ই। তৌসিফের অনেক রুপ, ছদ্মবেশ দেখা শেষ পৌষ’র কিন্তু এই রুপ ত্যাড়া যে তৌসিফ যা জানা ছিলো না। ওর কথা থেকে টলানো গেলেই না। পৌষ এবার নেতিয়ে পরলো। জেদ, রাগ, কান্না সবই করলো ও তবে লাভের লাভ কিছুই হলো না। ফলাফল শূন্য’র কোঠায়। যাই বলুক ফলাফল ঋণাত্মক। নিজেকে এবার ইলেকট্রন মনে হলো পৌষ’র। এত কিছু করলো ধনাত্মক জীবনে হলো না৷ মাথার উপর ঋণাত্মক চিহ্ন নিয়ে ই আজীবন ঘুরতে হবে ওর৷ এই তৌসিফ ওকে ছাড়বে না আর না ই পৌষ ছাড়তে দিবে। তবে এই মুহুর্তে বড়ই অসহ্য লাগছে তৌসিফ’কে। মুখটা কেমন ব্যথা ব্যথা করে রেখেছে। কেন রে শালা? তোর কিসের ব্যথা? ব্যথা তো পৌষ’র। অবস্থা খান এমন যে, সর্বাঙ্গে ব্যথা ঔষধ লাগাবো কোথায়?
তৌসিফ’কে দেখেই পৌষ’র বলতে মন চাইলো,
“তোমার কোন কোন জায়গায় ব্যথা গো বান্ধবী লোলিতা?”
শরীরটা দূর্বল হওয়াতে এই প্রশ্নটা করা হলো না। রাগে, দুঃখে কোন কথাই বললো না পৌষ। এতেও শান্ত নেই তৌসিফ। সোফা ছেড়ে উঠে এলো পৌষ’র কাছে। বেডে অসুস্থ হয়ে চিৎ হয়ে স্যালাইন খাচ্ছে পৌষ। একদম চুপ করে থাকায় তৌসিফ এসেই ঝুঁকে পরলো ওর দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে জিজ্ঞেস করলো,
— কথা বলো।
মুখ ঘুরালো পৌষ। শা’লা! বলে কি না কথা বলো। কেন রে পৌষ কেন কথা বলবে? তোর দাদা’র কেনা জমি পৌষ’র মুখ যে বললেই কথা বলবে? টু শব্দ ও করবে না পৌষ। তুই যদি এখানে ডিগবাজি জায়েদ খান সেজে দুটো পল্টি ও মা’রস তবুও পৌষ কথা বলবে না। তৌসিফ আরেকটু ঝুঁকে গেলো পৌষ’র কাছে। ওর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো পৌষ। একদম পৌষ’র মুখে এসে পরছে তপ্ত নিঃশ্বাস। তৌসিফ ওভাবে থেকেই বললো,
— কথা বলবে না?
পৌষ বুঝি উত্তর দেয়? তৌসিফ বুঝলো তাই তো কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
— টেস্ট বাকিগুলো ও করানো হবে। যতই ভঙ দেখাও না কেন।
সাথে সাথে মাথা ঘুরে তাকালো পৌষ। টলমলে চোখ জোরা নিয়ে ই ভাঙা গলায় ঝগরা শুরু করলো,
— আপনি একটা জঘন্য লোক। খারাপ লোক। নিশ্চিত কোথা থেকে কালো টাকা কামিয়েছে তাই আমার মতো ভোলাভালা বাচ্চা দেখে সেই টাকা দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছে। কি ভেবেছেন এতে টাকা শুদ্ধ হয়ে যাবে? জঘন্য লোক আমার চোখের সামনে থেকে দূর হন। যান এখান থেকে। পৌষ কখনো কথা বলবে না আপনার সাথে। আপনি আমার ব্যথা কখনো বুঝবেন না।
আর বলতে পারলো না পৌষ। বরাবরের মতো থুতনিতে বরাদ্দকৃত চুমুটা পরলো সেখানে। তৌসিফ অতি নরম স্বরে বললো,
— আমার চিন্তা বুঝলে শেষের কথাটা বলতে না হানি।
— আপনার হানি,রস, চিনি, দই সব আপনি খান। আমাকে মাফ করুন। আপনার মতো মামাতো ভাই আল্লাহ কাউকে না দিক। আমিন।
তৌসিফ কথা হারালো। কাকে বুঝাবে? কি বুঝাবে? বুঝার মেয়ে এটা? তৌসিফ শক্ত রইলো। এখন নরম হয়ে কথা বললেই তৌসিফে’র ঘাড়ে উঠে ওর ঘাড়ই মটকাবে। এই পৌষ হচ্ছে এক বাদর যাকে আদর দিলেই গাছে উঠে। উঠে তো উঠে, হাত পা ধরে টেনে ও নামানো যায় না। নার্স আসতেই তৌসিফ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নার্সটির মিটমিট করে হাসা দেখেই গা পিত্তি জ্বলে উঠলো পৌষ’র। নিজের ভালোর জন্য চুপ রইলো। অল্প হেসে নার্স বললো,
— স্যার ম্যামকে নিতে হবে।
তৌসিফ কপাল কুঁচকালো। বললো,
— এখানেই করাতে বলেছি আমি।
— একটা এখানেই করবে স্যার। বাকি দু’টোর জন্য একটু কষ্ট করতে হবে ম্যাম’কে।
পৌষ নিজে নিজেই উঠে বসলো। তৌসিফ প্রথমে খেয়াল না করলেও হঠাৎ দেখলো নিজে নিজে স্যালাইন খুলছে। তৌসিফ ধমকে উঠলো তখনই,
— এই মেয়ে! কি করছো? এক চড় মা’রব।
তারাতাড়ি ওটা ছেড়ে দিলো পৌষ। নার্স এসে খুলে দিতেই পৌষ বললো,
— আপু আমাকে একটু ধরে তুলবেন?
— শিওর ম্যাম।
তৌসিফ ও এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে ধরার জন্য কিন্তু পৌষ ধরলো না ওকে। নার্স’কে ধরে ই বেরিয়ে এলো। তৌসিফ অল্প আহত হলো।
টেস্ট করানো শেষ হতেই পৌষ হাপ ছেড়ে বাঁচলো। নার্সটা তখন তৌসিফ’কে কিছু বলছে তা দেখেই তেঁতে উঠলো পৌষ’র ভেতরে থাকা বউ আত্মা। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ডেকে উঠলো,
— এই মেয়ে এখানে আসো।
নার্স সহ তৌসিফ তাকালো। পৌষ যেন এতে আরো চেঁতে গেলো। শরীরে নেই শক্তি। যা আছে তা নিয়ে ই ঠেলেঠুলে উঠলো ও। পাশে থাকা চেয়ারে ভর দিয়ে এগিয়ে এসেই দাঁড়ালো দু’জনের মাঝখানে। ঝাঁঝালে গলায় বলে উঠলো,
— এত কি কথা?
নার্স থতমত খেতেই পৌষ বলে উঠলো,
— জুয়ান পুরুষ দেখলেই ছুঁকছুঁক করতে মন চায় না? এত যেহেতু ভালো লাগছে তাহলে রেখে যাই এখানে। কি বলো? এক মিনিট তুমি কি জানো এই দামড়া ব্যাটা দুই বিবাহ করেছে। তার বাপ করেছে দুই বিবাহ। দাদা করেছে চৌদ্দ বিবাহ। পর দাদা করেছে……
পেছন থেকে মুখ চেপে ধরলো তৌসিফ। ছাড়া পেতে ছটফট করলো পৌষ। নার্স হতবাক। হতবিহ্বল। পৌষ’কে টেনে কোলে তুলে নিলো তৌসিফ অতঃপর সোজা হাঁটা দিলো বাইরে। বউয়ের এই পা’গলামি মানতে ও বাধ্য। এতক্ষণ হাজার বউ’কে ধমকে ধামকে রাখুক তাকে নিয়ে বউ এর সেনসিটিভি সে মাথা পেতে নিবে। শুধু এটা কেন বউ সুস্থ থাকার জন্য সে একটু কঠোর নাহলে তো সারাক্ষণ ই এই পা’গলের ইশারায় নাচতে রাজি তৌসিফ।
সোজা গাড়িতে বসালো ওকে তৌসিফ। ড্রাইভার’কে আদেশ করলো,
— চলুন।
পৌষ’র জন্য ঔষধ গুলো আর নেয়া হলো না। রিপোর্ট দিবে কাল পরশু। পেছনের সিটে বসে পৌষ’র মাথাটা নিজের বুকে নিলো ও। শক্তি পৌষ’র আজ কম তাই তো ততটা নড়াচড়া করলো না। পরে রইলো বুকে। বুকের কাছটা থেকে ঘ্রাণ এলো পৌষ’র নাকে। চোরের মতো ঘ্রাণ নিলো পৌষ। রইলো সেভাবেই।
______________________
বাসায় ঢুকতেই বুয়ারা একে একে দেখে গেলো পৌষ’কে। দরজা ধরে দাঁড়ানো মিনু। ভেতরে ঢুকার সাহস পেলো না। পৌষ দেখে ডাকলো,
— মিনু? কি চাই?
ডাক শুনেই মিনু ঢুকলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— শরীর ভালা আপনের ছোট ভাবী?
— হু।
মিনু আর কথা খুঁজে পেলো না তাই মাথা নিচু করে চলে গেল। পৌষ ও ঘাটলো না। চুপ করে রইলো। তৌসিফ বের হয়েছে আধ ঘন্টা হবে। ব্যাটা আজ ভালোই ভঙ দেখাচ্ছে। কোলে তুলে ভেতরে এনেছে ওকে। পৌষ তখন বাঁকা বাঁকা দুটো কথা শুনিয়েছি।লাভ অবশ্য হয় নি তাতে। পৌষ’কে রুমে রেখে চেঞ্জ করিয়ে ভেগেছে হুরতার করে।
চোখ বুজে নিলো পৌষ। একটু ঘুমানো দরকার।
আচমকা কথার শব্দে কানে এলো। ধীরে ধীরে মনে হচ্ছে কেউ শরীরে বেয়ে বেয়ে উঠছে। একটা না দুটো মানুষ। হঠাৎ ই মনে হলো কেউ বা কারা পৌষ’র গলা চেপে ধরেছে। ঝট করে চোখ মেললো পৌষ। ওর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। চোখ খুলা মাত্র ই একদম লাল হয়ে উঠলো চোখ দুটো। কাঁচা ঘুমটা ভেঙেছে তাই তো ঝট করে মাথা ধরে গেলো। ইনি,মিনি’কে দেখেই পৌষ চমকালো। খুব করে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
— কোথা থেকে টপকালি দুটো?
ইনি,মিনি ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
— আম্মুর পেত থেতে আপা।
পৌষ দুই বোনকে জড়িয়ে ধরলো। দু’জনের কপালে চুমু দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কার সাথে এলি?
— হেমু বাই আনলো আপা।
— হু। ঘুমা এখন।
এতদিন পরে বোনের আদেশ অমান্য করলো না ওরা। বোনের গলা ধরেই ঘুমিয়ে গেলো। তৌসিফ এসে অবাক ই হলো বটে। এসব বোনগুলো কি একই পদের? একটাকে জাগাতে এসে বাকি দুটো ও ঘুমিয়ে গেলো। বাইরে হেমন্ত বসা। তৌসিফ ডাকলো না পৌষ’কে। ঘুমাক একটু। হেমন্ত তৌসিফ’কে ফেরত আসতে দেখেই জিজ্ঞেস করলো,
— পৌষ এলো না?
— ঘুমাচ্ছে।
— ইনি,মিনি?
— ওরা ও ঘুম।
হেমন্ত নিরাশ হলো। তৌসিফের সাথে কথা হলো গতকাল। বলেছিলো পৌষ’কে বাসায় নিতে চায় তৌসিফ সুন্দর ভাবে কথা কাটালো। বউ বুঝি হাত ছাড়া করার মানুষ তৌসিফ? যেই বউ তার, পুরাই ঝাকানাকা। না জানি কোথায় চলে যায় তাই তো তৌসিফ ছাড়ে না। কফিতে চুমুক দিলো তৌসিফ। বললো,
— শরীর অসুস্থ এখন যেতে দিব না আমি।
একদম মুখের উপর না করে দিলো তৌসিফ। হেমন্ত আহত হলো। ছোট্ট পৌষ’টাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করে এখন কি না শুনতে হচ্ছে তাকে নেয়া যাবে না। তবুও অনুরোধ করে উঠলো হেমন্ত,
— আমার ই বোন সে। খেয়াল রাখবে সবাই। মা-বাবা থেকে চাচা-চাচি সবাই দেখতে চাইছে। পিহা,জৈষ্ঠ্য, চৈত্র সবাই অপেক্ষায় আছে। শ্রেয়া প্রেগন্যান্ট, ও আসতে পারছে না৷ পৌষ’র সাথে ওর এটাচমেন্ট বেশি। একটা সপ্তাহের জন্য অনুমতি দিন।
তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— ও যাবে না হেমন্ত।
তীব্র ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও হেমন্ত চুপ রইলো। উঠে দাঁড়ালো সে। শুধু বললো,
— দেখা যাবে? জাগাব না৷ শুধু দেখব যদি অনুমতি দিতেন।
— এভাবে অনুমতি নেয়ার কি আছে হেমন্ত। তোমার ই বোন।
আকাশ থেকে পরলো হেমন্ত। এই তৌসিফ কোন ক্ষেতের মুলা? কথার মার প্যাঁচে ফেলা কেউ এর থেকে শিখুক। বোন দেয় না এখন বলে তোমার ই বোন। অসহায় চোখে তাকিয়ে হেমন্ত ভেতরে গেলো। তৌসিফ সেসব গায়ে মাখে না৷ বউ ছাড়া সে বাঁচবে না। একদম দেবদাস হয়ে নেশায় বুদ হয়ে ম’রবে।
হেমন্ত ঘুমন্ত ইনি,মিনিকে নিজের কোলে নিয়ে বের হলো। দুটো দুই কাঁধে। প্রচুর বায়না ধরে কেঁদে কেটে এসেছে। তৌসিফ ই বলেছিলো আসতে। এখন ঘুম দেখে সে ডাকতে পর্যন্ত দিলো না। হেমন্ত খুশি ও হলো আবার বিরক্ত ও হলো। ওকে দেখেই দাঁড়ালো তৌসিফ। বললো,
— ওদের রেখে যাও। থাকুক। পৌষ’র ভালো লাগবে।
— বাড়ী গেলেও ওর ভালো লাগতো।
তৌসিফ হেমন্ত’র সাথে নিচ পর্যন্ত নামলো। গাড়িতে উঠার পর তৌসিফ হাসি মুখে শুধু বললো,
— নিয়ে যাব আমি। চিন্তা করো না। ভালো রাখব আমি।
— ভরসা না থাকলে বোন দিতাম না।
হেমন্তের গাড়ি চলে গেলো। ততটাও দূরের পথ না। ভেবেছিলো পৌষ’কে নিয়ে যাবে তাই তো গাড়ি নিয়ে এলো। এখন বাড়ী গিয়ে কি জবাব দিবে সবাই’কে?
.
পৌষ’র ঘুম ভাঙতেই ও এদিক ওদিক তাকালো। তা দেখেই তৌসিফ বললো,
— কি খুঁজো হানি?
— আমার মাথা।
বলেই বাইরে গেলো। ফেরত এসেই বললো,
— ইনি, মিনি না এসেছিলো?
— চলে গিয়েছে।
মাথায় বাজ পরার মতো চমকালো পৌষ। বললো,
— থাকতে বলবেন না? কার সাথে এলো? কখন এলো? কখন গেলো?
তৌসিফ ভাবশালীন ভাবেই বললো,
— বললাম তো ওদের রেখে যেতে।
রাগে গা পিত্তি জ্বলে উঠলো পৌষ’র। নাক, মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলো,
— কেন রেখে যাবে? ওদের মা-বাপ নেই? আমার যাওয়ার কথা ছিলো ওখানে। আপনার দোষ সব। এখনই যাব আমি৷ সরুন। সামনে আসবেন না একদম।
ভয়ে আত্মা গলায় চলে এলো তৌসিফের। বউ যাবে? কেন যাবে? তৌসিফ থাকবে কিভাবে? পৌষ ততক্ষণে উঠে এলোমেলো ভাবেই রাগে কাঁপতে কাঁপতে রুম থেকে বের হচ্ছে। টেনেটুনে বউকে নিজের কাছে নিলো তৌসিফ। পৌষ বুঝি মানে? সে সমান তালে লাত্থি, উস্টা দিয়েই যাচ্ছে।
#চলবে….
প্রিয় শুধু মাথা নাড়লো। প্রাণ অসহায়ের মতো কাঁদলো কিছুক্ষণ। কাটা ঠোঁট টা নেড়ে নেড়ে বলতে লাগলো,
— দেখ না আমাকে মেরেছে ওরা। সবাই মারে আমাকে। শুধু মারে। সবখানে মারে ওরা প্রি। আমার পেটে আজ অনেক মেরেছে। পা দিয়ে দাঁড়াতে পারি না প্রি। বা হাত ও ভাঙা। দেখ। এই প্রি দেখ না।
খোলা শরীর হওয়াতে প্রিয় সবটা ই দেখলো। আচমকা প্রাণের পেটে তাকাতেই আঁতকে উঠলো ও। নাভী দিয়ে সমান তালে রক্ত ঝরছে। ফ্লোরটা সহ চিটচিটে হয়ে আছে। প্রিয় চিৎকার করে উঠলো। আদনান সহ ভয় পেয়ে গেলো এটা দেখে। প্রাণ’কে তুলতে চাইলেও প্রাণ উঠবে না। ও প্রিয়’র হাতটা ধরে বললো,
— আমাকে মাফ করে দে না প্রি। মাফ করে দে। বাবুটা ও বল ওর বাবা’কে মাফ করে দিতে। তোদের কাছে মাফ চাওয়ার জন্য ই বেঁচে আছি। আমার বাবা’কে একটু দেখে রাখিস। বাবা নিশ্চিত খায় না তাই না?
প্রিয় দুই হাতে প্রাণ’কে বুকে তুলে নিলো। পাগলের মতো চিৎকার বলে উঠলো,
— কিচ্ছু হবে না। তোমার প্রিয় আছে না? চাচ্চু ওকে হসপিটালে নিতে হবে। ওকে তুলো চাচ্চু।
#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৫
তৌসিফ বাসায় নেই। দিন দুই রুম বন্দি থেকে নিজেকে আসামি মনে হচ্ছে পৌষ’র। এরজন্য সে দিন রাত খেয়ে না খেয়ে দায়ী করছে তৌসিফ’কে। কথা বার্তা ও কম ই বলার চেষ্টা করছে। পৌষ অবাক ও হয়। মানুষটা তার কথা শুনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। পৌষ ও কথা পেটে রাখতে পারে না। তার কষ্ট হয়। পেট ব্যথা করে। মনে হয় হাত কাটা ফকির সে তাই তো পটর পটর করা শুরু করে ও। তৌসিফ তখন শুনে। সে মুখ বুজে শুনে। বগর বগর করতে করতে পৌষ যে কখন ঘুমিয়ে যায় তা ও নিজেও জানে না। বিছানা ছাড়লো পৌষ। গা টান দিলো একদিন বিড়ালের মতো। পরণে থাকা জামাটা কুঁচকে আছে। যথাসম্ভব টেনেটুনে সোজা করলো ও। তৌসিফ মিয়া তাকে পাকিস্তানি সুট এনে দিয়েছে। কাপড় নিজের বাসার গুলো না থাকায় এগুলোই পরে দিন কাটাচ্ছে ও। সুতির এহেন আরামদায়ক পোশাক পৌষ ততটা পরতো না। পায়ের চপ্পল রাখা সামনেই। পৌষ দেখলো অতঃপর এক শট মে’রে একটা পাঠালো কাউচের নীচে আরেকটা তৌসিফের জিমের ডাম্বলের দিকে। ঢং দেখে সে ম’রে ম’রে। এত সুন্দর ঝকঝকা ফকফকা ফ্লোর এটাতে কেন চপ্পল পরে হাটবে ও? এমন ফ্লোরে তো আরামসে ভাত ঢেলে ও খাওয়া যাবে।
গায়ে ওরনা তুলেই পৌষ বেরিয়ে এলো। হাতে থাকা বাটারফ্লাই ব্যান্ড দিয়ে ঝুঁটি করতে করতে বের হচ্ছিলো ও। খেয়াল না করাতে ধাক্কা খেলো সোহা’র সাথে। পৌষ মুখে সরি সরি বলে উঠতেই খ্যাঁট খ্যাঁট করে উঠলো সোহা। মেজাজ তুঙ্গে তুলে ধমকে উঠলো,
— দেখে হাটতে পারো না মেয়ে? চোখ কোথায় থাকে তোমার? অসহ্য একদম। কোথা থেকে ধরে এনেছে এটাকে কে জানে? চলন্ত রেলগাড়ী নিয়ে এসেছে বাড়ীতে।
পৌষ বুকে হাত গুজে পরখ করলো সোহা’কে। বাড়ীতেই এক প্রকার নাইটি পরে ঘুরছে সে। মুখে আবার দেখে মনে হচ্ছে গোবর লেপ্টে দিয়েছে। পৌষ’র সন্দেহ যেন নিমিষেই ফুরালো। ও ভেবেই নিলো তৌসিফে’র বাপের অবৈধ বা বৈধ সন্তান ই এই সোহা নাহলে এত রুপ চর্চা কিভাবে করে এই মেয়ে? দেখতে তো ফর্সা ই এখন সে কি চায় চেহারার চামড়াটাও উঠে যাক? সোহা তখনই ধমকে উঠলো পুণরায়,
— এই মেয়ে কি বিরবির করছো? অসভ্য মেয়ে।
পৌষ চোখ দুটো ছোট করে তাকাতেই সোহা বিব্রত হলো। পৌষ কড়ায় গন্ডায় সোহা’র কথাগুলোর উত্তর দিলো,
— দেখেই তো হাটি খালা। চোখ এই দেখুন চোখেই আছে।
বলেই বড় বড় করে তাকিয়ে চোখ দেখালো অতঃপর আফসোস করা কণ্ঠে বললো,
— আমাকে আমার বাড়ী থেকে ধরে না বিয়ে করে এনেছে আপনার ভাআআআই। ঐ যে আপনার তৌসিফ ভাই, আপনার কলিজার ভাই, গুরদার ভাই। তো বুঝলেন তো, রেলগাড়ী না বউ এনেছে আপনার তৌসিফ ভাই।
দাঁত বের করে কেলিয়ে ক্যাবলা মার্কা এক হাসি দিলো পৌষ। সেভাবেই প্রস্থান করলো সেখান থেকে। সোহা রাগে, আপমানে ফুঁসতে লাগতেই পৌষ দরজা অবদি গিয়েই বলে উঠলো,
— খালাম্মা?
আচমকা ডাকে সোহা তাকাতেই পৌষ এক পাটি দাঁত বের করে বললো,
— হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকেই বলছি, মুখে ঐ গোবর লাগিয়ে লাভ নেই। দেখতে একই লাগে মাঝখান থেকে আপনার কলিজার ভাই তৌসিফ আর আমার জানের জান, প্রাণের প্রাণ, যার উপর আমার জান কুরবান সেই জামাই এর টাকা বরবাদ হয়। বুঝেন ই তো স্বামীর টাকার প্রতি টান আছে একটা।
পৌষ চলে গেল। সোহা হা করে তাকিয়ে রইলো সেখানে। কি বললো এই মেয়ে? টাকার খোঁটা দিলো সোহা’কে? এত সাহস! কোথায় পেলো এত সাহস? মিনু এসে আপা’কে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই বললো,
— আপা কি হয়েছে?
সোহা’র ধ্যান ভাঙলো। আশ্চর্য গলায় বললো,
— আমার চেহারায় কি বল তো?
মিনু বুঝলো না তাই বলে উঠলো,
— জানি না তো আপা। ফেস প্যাক না এটা?
— এটা কি গো-বর?
মিনু ফিক করে হেসে দিলো। কুটকুট করে হেসে বললো,
— একদম ঠিক বলেছো আপা। দেখে গোবরই মনে হয়। একদম ঐ রঙের এটা। গন্ধটা ও কেমন মনে হয় রাস্তা থেকে গোবর প্যাকেট করে ঐ দোকানে বিক্রি করে।
মিনু’র কথা শুনে সোহা কথার খেই হারালো। রাগে, কষ্টে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। ওয়াশরুমে ঢুকেই আগে মুখটা ধুঁয়ে নিলো। এই আপমান মানার নয়। এত দামী অর্গানিক ফেস প্যাক। মূর্খ গুলো জানে এটার মূল্য কত? পৌষ’কে “ফকিন্নি” বলে ডাকতেও ভুললো না সোহা। তার গা জ্বালা করছে।
.
পৌষ এসেছে সোজা নিচে। তালুকদার বাড়ীটার মেইন গেট দুটো। গাড়ি ঢুকলে বড়টা খোলা হয় অন্যথা পকেট গেইট দিয়ে ই সকলের যাতায়াত। এদিকে মানুষ আসলেও অনুমতি ছাড়া ভেতরে ঢুকা নিষিদ্ধ। পৌষ একা একা হাটলো এদিক ওদিক। পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলো একটা নৌকা বাঁধা। শেষের সিঁড়ি গুলো শ্যাওলার জন্য পিচ্ছিল বটে তাই তো পৌষ নেমেও নামলো না। পানিতে পরলে রক্ষা নেই। একদম জয় বাংলা হয়ে যাবে ও। উপরে এসে কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকালো কিছুক্ষণ। বিশাল বড় গাছটা। সাইডেই সারি সারি নারিকেল গাছ। পৌষ’র মাথায় দুষ্টামি চাপলো। নারিকেল গাছ থেকে টাটকা নারকেল খেতে মন চাইলো ওর। দারোয়ান’কে বলতেই সে নগলে বলে উঠলো,
— এখনই দিচ্ছি ছোট মামি। আপনি ভেতরে যান৷ মামা দেখলে রাগ করবে।
— ধুর মিয়া, আপনার মামা’র গুষ্টি কিলাই আমি। আসুন আপনি। ভয় কিসের? মনে রাখবেন ভয় পেলেন তো হেরে গেলেন। ভয়’কে জয় করতে খেতে হয় মাউন্টেন ডিউ৷ খাবেন?
দারোয়ান হতবাক। মানুষ এত বাঁচাল কিভাবে হয়? এ ও কি সম্ভব? মনে হচ্ছে কান পেঁচিয়ে ফেলবে। দারোয়ান নারিকেল পেরে দিলো। কেটেও দিলো। পৌষ একটা’র অর্ধেক খেতে খেতে বললো,
— ঐ পিচ্চিগুলো ওখানে কি করে?
গেটের বাইরে এক দল পিচ্চি খেলা করছে। দারোয়ান জানালো,
— পাশের বস্তিতে থাকে এরা৷ ওদের মা-বাবা’রা এখানে কাজ করে। ঐ যে ছোট্ট টা আমার ভাগ্নে।
পৌষ যেন হাতে চাঁদ পেলো। ঝট করে বললো,
— এদের ডাকুন ভেতরে।
দারোয়ান সাথে সাথেই না করলো। জানালো,
— বড় মামা রেগে যাবেন।
— আরে ধুর মিয়া। সরুন দেখি আমি আনছি।
বলে পৌষ নিজেই ওদের ডাকলো,
— এই পিচ্চিরা। এখানে আয়।
ডাক শুনতেই হৈ হৈ করে সবগুলো ভেতরে এলো। মিনিট পাঁচ যেতেই এরা হাউকাউ শুরু করে দিলো। ওদের খেলাধুলা শুরু হয়ে গেলো ততক্ষণে। পৌষ যেন বিয়ের পর এতদিনে মন খুলে খেলায় মনোযোগ দিলো। কখন যে বিকেল কাটলো টের ই পেলো না।
.
এক প্রকার তারাহুরো করে গাড়ি থেকে নামলো তৌসিফ। পৌষ’র রিপোর্টগুলো ওর হাতে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তৌফিকের কল এলো কিন্তু ধরলো না তৌসিফ। আগে বউটাকে দরকার তার।নিজের ফ্লাটে ঢুকেই দেখলো শুনশান নীরবতা। রুমে যেতেই ভ্রুঁ যুগল কুঁচকালো ওর। এদিক ওদিক তাকিয়ে ডাকলো,
— পৌষরাত?
না উত্তর এলো না। পকেট থেকে মানিব্যাগ, ফোন বের করে বেডে ছুঁড়ে দিলো তৌসিফ। হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে ওয়াশরুমের দরজায় নক দিলো। নাহ নেই। বের হয়েও ডাকলো,
— হানি? কোথায় তুমি?
উত্তর না আসাতে তৌসিফ এবার চিন্তায় পরলো। জোরে বুয়াকে ডাকতেই তারা দৌড়ে এলো। তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো পৌষ’র কথা। বুয়ারা জানালো বিকেলে পৌষ রুমেই ছিলো। তৌসিফ ভয়ঙ্কর ভাবে রেগে ধমক দিলো,
— রুমে থাকলে নেই কেন? কোথায় ও?
ভয়ে কাঁপছে সকলে। তখনই ফোন এলো রুমে। দৌড়ে গিয়ে দেখলো তৌফিক কল করেছে। না চাইতেও ধরলো ও। ওপাশ থেকে তৌফিক কড়া গলায় বলে উঠলো,
— বাড়ীটাকে কি এতিম খানা বানিয়েছো তুমি? একেতো এতিম, নাজায়েজ মেয়ে বিয়ে করে আনলে সেই মেয়ে নিয়ে যত কাহিনি। ঐ মেয়ে এখন রাস্তা ঘাট থেকে মানুষ তুলে বাড়ীতে ঢোকাচ্ছে। তামশা করছে ঐ মেয়ে। একে সামলাও নাহলে…….
কল কেটে দিলো তৌসিফ। দৌড়ে নামলো বাসা থেকে। বাড়ীর পেছনে যেতে নিলেই দেখলো ঘাট পাড়ে এত এত বাচ্চা নিয়ে খেলছে পৌষ। দৃশ্যটা কিন্তু সুন্দর অথচ ঐ মুহুর্তে তা তৌসিফে’র কাছে তা সুন্দর লাগলো না। গটগট পা ফেলে সকলের সামনে দিয়ে গিয়ে পৌষ’র হাত টেনে ধরলো ও। চোখ তুলে তাকালো পৌষ। তৌসিফ’কে দেখেই হাসি মুখে বলে উঠলো,
— আপনি?
তৌসিফ তখন ভিন্ন ধ্যানে। পৌষ’র হাত টেনে ধরে বললো,
— ভেতরে চলো।
— আরে খেলছি তো। দেখুন ওরা মালা গেঁথে দিলো আমা…..
— চলো বলছি!
বেশ রেগেমেগে বললো তৌসিফ। পৌষ পাত্তা দিলো না। ও ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতেই তৌসিফ এবার সজোরে ধমকে উঠলো,
— সোজা ভেতরে চলো পৌষরাত। তোমার পা বেড়ে গিয়েছে!
বাচ্চাগুলো ভয়ে সিটিয়ে গেলো তা দেখেই পৌষ নাক ফুলালো। মান ইজ্জত রইলো না। দারোয়ান তাকিয়ে আছে ভয়ে ভয়ে। পৌষ মুখ খুলে কিছু বলতে নিলেই তৌসিফ বাচ্চাগুলোকে ধমকে উঠলো। সবগুলো ছুটে পালালো। সবচেয়ে ছোট্টটা উস্টা খেয়ে পরতেই পৌষ নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো জোর করে। বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো মাটি থেকে। তৌসিফ চিৎকার করে দারোয়ান’কে ডাকতেই সে দৌড়ে এলো। তৌসিফ পৌষ’র কোল থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে দারোয়ানকে দিয়ে বললো,
— ওর বাসায় দিয়ে এসো।
একপল অপেক্ষা না করে পৌষ’কে টেনেটুনে নিলো তৌসিফ। টলমল চোখে পৌষ। রা করলো না। রুমে এনে একদম দরজা আটকে দিলো তৌসিফ। পৌষ মুখ খুলতে নিলেই ধমকালো তৌসিফ,
— ঘাটে কি তোমার? কথা বলো, কি ওখানে? সময় দেখেছো? এই মেয়ে, সময় দেখেছো? তোমার না শরীর খারাপ? আর যদি দেখেছি….
কথা কেড়ে রেগে পৌষ বলে উঠলো,
— কি করবেন? কি করবেন আপনি?
মুখ চেপে ধরলো আচমকা তৌসিফ। চোয়ালে চাপ দিতেই পৌষ থমকে গেলো। টলমল চোখে পানি পরলো। দাঁত চেপে তৌসিফ বলে উঠলো,
— না মানে না। কি বলেছি বুঝেছো? আমার রাগ দেখতে যেয়ো না পৌষরাত। ভয়ংকর খারাপ হবে। কথা শুনবে। বাধ্য তুমি আমাকে শুনতে। আর বাইরে যাবে না। বেশি বার বাড়লে একদম ঘরের বাইরে পা রাখা নিষিদ্ধ করে দিব এন্ড ইউ নো আই ক্যান ডু দিস।
কথাগুলো বলে তৌসিফ ছাড়লো ওকে। দুই পা পেছালো পৌষ। ঢোক গিললো দুটো তিনটা। তৌসিফ তখন ওয়াশরুমে ঢুকলো। পৌষ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ভাবলো কিছু। ছোট্ট বাচ্চাটা মাটিতে পরে গেলো দৌড় দিতে গিয়ে। একদম ইনি-মিনির সমান বাবুটা। কত সুন্দর খেললো। সবগুলো মিলে পৌষ’কে কি সুন্দর মালা গেঁথে দিলো তৌসিফ কি না ওদের ই ধমক দিলো। মায়া ও হলো না। বড়লোকরা কি এমন ই হয়? গরীব পছন্দ না এদের? এদের কথা ই শুনতে হয়? পৌষ’কে সে আজ বলেই দিয়েছে পৌষ তার কথা শুনতে বাধ্য। কেন হবে না? মাগনা খাওয়া থেকে শুরু করে পড়াশোনা, পায়ের উপর পা তুলে থাকা, কোন কাজ নেই, সারাক্ষণ চাপা নাড়ানো, এত দামি দামি পোশাক সবই তো তার দেয়া। বিনিময়ে তো তারই গোলামী করতে হবে পৌষ’র। এটাতে ভুল নেই। নিজের কষ্ট ভুলাতে আর কত তর্ক করবে ও? আর কত অস্বীকার করবে সে এতিম। তার বাবা নেই। মা নেই। মা-বাবা ছাড়া একজন মানুষ ঠিক কতটা অসহায় তা পৌষ বাদে কে ই বা জানে? বাঁচাল তো পৌষ ছোট থেকেই। মনে কথা চেপে রাখে না। যা মুখে আসে তাই বলে দেয়। এই সাদা মনটাতে কাঁদা নেই তার। আচমকাই পৌষ ভাবলো তৌসিফ ভুল না। তার কি দায় সে পৌষ’কে পালছে? পৌষ ই বা কেন মাগনা থাকছে? বুয়ারা যেমন টাকার বিনিময়ে কাজ করছে সেভাবে পৌষ ও বাধ্য শুধু কাজগুলো ভিন্ন।
চোখ মুছে বিছানায় গিয়ে কাত হয়ে শুয়ে পরলো পৌষ। খট করে দরজা খুলে ওয়াশরুম থেকে বের হলো তৌসিফ। পৌষ তখনই ঠাই শুয়ে আছে। তার চিন্তা জুড়ে হঠাৎ ই ভিন্ন কিছু। তৌসিফ ঠান্ডা মাথায় বউ’কে দেখলো। তার আচরণে ভুল নেই। কেন সে তৌসিফে’র কথা শুনে না? কেন বুঝে না তৌসিফের ভয়? কত করে বলেছে সন্ধ্যার সময় ঘাটে না যেতে। তার ফুপির মৃত্যু সেখানেই হয়েছিলো। লোকমুখে শোনা কথা হোক বা ভিন্ন কিছু তৌসিফ পৌষ’কে নিয়ে সচেতন।
পা টিপে বউয়ের কাছে এলো ও। পিঠে হাত রাখতেই পৌষ ঘুরে তাকালো। গাল দুটো লাল হয়ে আছে। আলতো হাত বুলালো তৌসিফ। ছোট্ট করে বললো,
— সরি। এতটা লেগে যাবে বুঝি নি হানি।
পৌষ চুপ রইলো। তৌসিফ ওর মুখটা ধরে বরাবরের মতো থুতনিতে চুমু দিয়ে বললো,
— সরি তো আমার তোতাপাখি।
গালে দুটো চুমু দিয়ে বললো,
— পুকুরে যেতে না করেছিলাম না হানি?
— বাচ্চাটার কি দোষ?
— কখন বলেছি ওদের দোষ?
— ধমকে দিলেন যে? বাচ্চাটা পরে গেলো।
— বেশি ভাবছো…
–আমার মতো এতিম সে। এতিমরা বেশিই ভাবে।
— ওহহো পৌষরাত, কি বুঝাব তোমাকে আমি?
বলেই জড়িয়ে ধরলো ওকে। পৌষ চুপ রইলো। তৌসিফ জানালো,
— তোমার রিপোর্ট দেখে চিন্তায় ছিলাম হানি৷ স্বাস্থ্য ঠিক নেই তোমার। চিন্তায় ম’রে যাচ্ছিলাম। বাসায় এসে দেখি তুমি নেই। কেমন লাগে বলো? বড় ভাই ফোন দিয়ে উলোট পালোট কথা বললো তারমধ্যে বুয়ারা সঠিক খবর দিতে পারলো না। রাগ হওয়া কি স্বাভাবিক না?
— জ্বি।
পৌষ’র এহেন ঠান্ডা শব্দ হজম করা কষ্টসাধ্য। বুকটা যেন ছটফট করে উঠে। তৌসিফ অস্থির হয়ে বলে উঠলো,
— প্লিজ হানি, ডোন্ট ডু দিস টু মি। বি নরমাল টু মি।
— সোহা’কে বের করে দিন।
— দিব।
— আচ্ছা।
পৌষ’কে তখনও বুকে চাপা তৌসিফ অথচ মেয়েটা শক্ত হয়ে আছে। তার চোখের পানিতে পৌষ’র বুক ভিজছে। তৌসিফ ওকে ছাড়লো। ঠোঁটে চুমু দিয়ে ই বললো,
— কথা বলো না হানি।
তৌসিফ’কে অবাক করে দিয়ে নিজের পরনে থাকা কামিজটা খুলে নিলো ও। তৌসিফ অবাক হঠাৎ কান্ডে। পৌষ মাথা নিচু করে সহজ সরল গলায় বলে উঠলো,
— ইউ ক্যান। আমি বাঁধা দিব না৷ কাঁদব না৷ সত্যি বলছি।
লাস্যময় নারী দেহ যাকে খুব করে চায় তৌসিফ। বছরের পর বছর পুড়ে পুড়ে আঙ্গার ওর যৌবন। এহেন সময় পৌষ’র করা এহেন কান্ডে ঠিক কোথায় গড়াবে জল? স্রোতে ভেসে কোথায় যাবে তৌসিফ নাকি এখানেই ডুবে ম’রবে? পৌষের মাঝে।
#চলবে……
বদ্ধ রুমের মধ্যে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে প্রাণ। আচমকা প্রিয়র গালে শক্ত এক চড় বসাতেই আট মাসের পেটটা নিয়ে ছিটকে ফ্লোরে পরে ও। অনবরত আঘাত পরে প্রিয়’র গায়ে। প্রাণ ঝুঁকে প্রিয়’র মুখটা চেপে ধরে বলে,
— কথা শুনবি বল।
— শুনব।
— তাহলে তখন শুনলি না কেন?
বলেই প্রিয়’র চুলের মুঠি ধরে টেনে দাঁড় করায়। পুণরায় চার পাঁচটা চড় খেয়ে ফ্লোরে বসেই প্রাণে’র পা জড়িয়ে ধরে ও। হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
— আ…আর মেরো না প্রাণ।
পা দিয়ে ছিটকে ফেলে প্রাণ। মুখ থুবড়ে পরতেই চিৎকার করে প্রিয় বলে,
— পেটে না। প..পেটে মেরো না প্রাণ। এখানে বাবু আছে। প্লিজ না প্রাণ৷ পেটে মেরো না।
প্রাণ শুনলো না। সজোড়ে লাথি মারলো প্রিয়’র আট মাসের ভরা পেটটাতে……
চলবে।