#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৬
[পর্বটি রোম্যান্টিক। চাইলে স্কিপ করতে পারেন]
রুম জুড়ে একদমই নীরবতায় আচ্ছন্ন এক পরিবেশ। মৃদু হলদেটে আলোয় জ্বলজ্বল করছে পৌষ’র মুখটা আর তাতেই অনির্মেশ তাকিয়ে আছে তৌসিফ। জানালার ফাঁক গলিয়ে সুর সুর করে বাতাস বইছে। বাইরে বৃষ্টি বৃষ্টি একটা ভাব অথচ বিকেল অব্দি ছিলো মিষ্টি রোদের ঝলক। পরিবেশ বাইরে ঠান্ডা হলেও ভেতরে খুবই উত্তপ্ত। তৌসিফ প্রায় মিনিট পাঁচ সময় লাগালো পৌষ’কে দেখতে। লজ্জায় ডুবে ম’রা বাকি পৌষ’র অথচ ও ঠাই বসে আছে। তার রূপের আগুনে হাত ছানি দিয়ে ডাকছে তৌসিফ’কে। ভাবা যায় তৌসিফ’কে? এক তাগড়া জোয়ান সুপুরুষ’কে সে এভাবে ডাকছে, সে কি জানে এই মুহুর্তে তৌসিফ তাকে কি করতে পারে? ঠিক কতটা সহ্য করার ক্ষমতা তার আছে? তৌসিফ ওর দিকে তাকিয়ে ভাবলো। নজর না সরিয়েই নিজের পরণে থাকা টিশার্ট এক টানে খুলে নিলো। অবহেলায় তা গিয়ে পরলো ফ্লোরে। তৌসিফ কিন্তু নজর হটালো না। এদিকে পৌষ মৌন। তৌসিফ চালাক পুরুষ। চতুরতা দিয়েই আজ এতদূর সে। হাত বাড়াতেই নিজের কম্পমান হাতটা ওর দিকে দিলো পৌষ। তৌসিফ না তাকিয়েই শক্ত করে ধরলো। তাকানোর সময় কই? তার নজর তো এই বিশ বছর বয়সী নারীর পানে যে তার পা’গল করা রুপে ঝলসাতে চাইছে তৌসিফ’কে?
আচমকাই পৌষ’কে নিজের দিকে টেনে নিলো ও। একদম নিজের কোলের উপরে তুলে দুই গাল চেপে ধরলো নিজের দুই হাতে। মুখ তুলে পৌষ আর তাকে অপলক দেখে তৌসিফ। বাঁকা হেসে মুখ এগিয়ে নিতেই পৌষ চোখ বুজে ফেলে। চুমু পরলো ঠিকই কিন্তু থুতনিতে। এই চুমুতেই যেন পৌষ পা’গল হয় বেশি। তৌসিফ সরে নি, সে সরবেও না। লাগাদার থুতনিতে একের পর এক ওষ্ঠের ছোঁয়া অতঃপর হঠাৎ ই ব্যথায় “আহ” শব্দ করে পৌষ। না চাইতেও চোখ গলিয়ে পানি বেরুলো তার। থুতনিতে কামড়ে ধরেছে তৌসিফ। তার সুক্ষ্ম দাঁতের এহেন কামড়ে পৌষ’র জান যায় যায় অবস্থা অথচ সে থামাচ্ছে না। তার মাথায় জেদ এখন একটাই। সে বিনিময়েই থাকবে এখানে। মাগনা না৷
তৌসিফ অবাক ই হচ্ছে। পৌষ থামাচ্ছে না তাকে তাই তো এবার জোড়ে কামড়ে দিলো৷ মুখে “উমম” শব্দ করে চাদর খামচে ধরে পৌষ৷ ওর মনে হচ্ছে থুতনি দিয়ে র’ক্ত বেরিয়ে আসবে। তৌসিফ নিজেই ছেড়ে দিলো। পৌষ’র পিঠে হাত দিয়ে একদম নিজের কাছে নিয়ে গালে গাল মিশিয়ে নেশালো গলায় বললো,
— হানিইইইই, ক্যান আই হ্যাব মোর?
— হুমম।
অনুমতি পত্র সাক্ষর পৌষ’র সাথে মুখেও স্বীকারোক্তি কোথায় যাবে তৌসিফ। মন তো চাইছে এখানেই নিজের সমাধি দিতে। এত বছরের যাতনা এখানেই পৌষ’র মাঝে বিলিয়ে দিতে মন চাইলো তার। না পেরে হুট করেই ওষ্ঠেই আঘাত হানলো ও। পৌষ তখন খেই হারাচ্ছে কারণ ওর পিঠ জুড়ে তখন তৌসিফে’র হাতের বিচরণ। তৌসিফে’র মতো পুরুষ’কে পৌষ’র হার মানাতে হলে আরো শিক্ষা দরকার কারণ তৌসিফ ই তাকে ছক্কা মে’রে বশে এনে ফেলেছে। ওষ্ঠ ছেড়ে গলায় কিছুক্ষণ উৎপীরণ চললো। পৌষ ও যখন দুই হাত বাড়িয়ে তৌসিফ’কে ধরলো ঠিক সেই চরম মুহুর্তে তাকে ছেড়ে দিলো তৌসিফ। পৌষ তখন বৈঠা হীন এক নৌকা। কোথায় যাবে তার জানা নেই। তৌসিফ’কে ও নিজেই আটকাতে চাইলো কিন্তু পারলো না৷ এত বড় মানুষটাকে ও বাগে আনতে পারলো না। নারী তো সব পারে। পুরুষ নারীর কাছে বাঁধা এই দিক দিয়ে তাহলে কেন পৌষ পারলো না? রাগে, দুঃখে কান্না আসে ওর। হঠাৎ ই পেটে খামচে ধরে তৌসিফ। পৌষ’র মনে হলো নখ দাবিয়ে দিয়েছে সেখানে তৌসিফ। ওর উপরে উঠে শুয়ে কাঁধে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,
— ইউ নিড মোর হানি?
কান্না আটকালো পৌষ। পেটে হাত দিতে চাইলেও পারলো না। তৌসিফ আরো এগিয়ে এসে ওর কানের কাছে মুখ নিলো। এক চুমু খেলো লতিতে অতঃপর সেখানে ও কামড়ে দিলো। নরম জায়গায় কামড় খেয়ে পৌষ না পেরে কেঁদে দিলো। ভীষণ জ্বলছে সেখানে। দম আটকে আসছে যেন। তৌসিফ একদম সরে গেলো। কান ধরে উঠে বসলো পৌষ। সত্যি ই কানে জোরে কামড়ে দিয়েছে তৌসিফ। পৌষ’র মনে হলো র’ক্ত বের হচ্ছে সেখান থেকে। তৌসিফ সরে বসা ওর থেকে। দম ফেলে তৌসিফ বলে উঠলো,
— বলেছিলে কাঁদবে না।
পৌষ নিজের মুখ চেপে ধরলো। হিচকি উঠে গিয়েছে ওর। কোনমতে বলে উঠলো,
— ভ..ভুলে ভুলে কেঁদেছি। আর হবে না। আসুন আপনি।
— উহু হানিই। এভাবে তো হচ্ছে না।
— ক..কি করব আমি?
— আমার সামনে এসো।
উঠে তৌসিফে’র সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ও। কান চেপে দাঁড়িয়ে আছে পৌষ। তৌসিফ পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললো,
— কান ছেড়ে দাঁড়াও।
পৌষ তাই করলো। অল্প হেসে তৌসিফ বললো,
— যা দেখাচ্ছো এর থেকে বেশি দুই দিন আগে দেখেছি।
পৌষ নিজের দিকে তাকালো। ওর পরণে শুধু হাতা কাটা পেট পর্যন্ত ইনার। পৌষ প্রশ্ন করলো,
— খ..খুল..ব?
তৌসিফ চোখ তুলে তাকালো। আচমকাই বলে উঠলো,
— আজ কি যা বলব সবই করবে?
— আজ না সারাজীবন শুনব।
ভ্রুঁ কুঁচকালো তৌসিফ। পৌষ’র মনে কি চলছে তা বুঝছে না ও। হঠাৎ ই বললো,
— যা কষ্ট দিলাম তার থেকে ও অনেক দিব।
— আচ্ছা।
রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তৌসিফে’র। এই মেয়ে কাকে তেঁজ দেখায়? তৌসিফ কে? ও কি জানে তৌসিফ কি করবে? হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ টাই বা কি? তৌসিফ তো বললো কেন তখন রাগ করলো তবুও এই আচরণ কেন দেখতে হচ্ছে ওকে?
আঙুলের ইশারায় ডাকতেই পৌষ কাছে এলো। ওর হাত ধরে প্রায় ছুঁড়ে মা’রলো তৌসিফ বিছানায়। মুখের উপর পরলো পৌষ। কান্না করতে গিয়ে ও করলো না। আচমকাই ওকে সুযোগ না দিয়ে তৌসিফ হামলে পরলো ওর উপর।
.
তৌসিফ পৌষ’র গালে আদরের সহিত চুমু দিয়ে বললো,
— এবার বলো কি হয়েছে?
— কিছু হয় নি।
— রাগ উঠাচ্ছো হানি।
— যা বলবেন সব করব। ঐ দিন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তাই আজ কাছে টানছি।
— ওহহো পৌষরাত। হঠাৎ কি হয়েছে? বলো আমাকে। তখনকার আচরণের কারণ তো বললাম ই।
— কিছু হয় নি সত্যি বলছি।
পৌষ’কে এবার নিজে বুকে জড়ালো তৌসিফ। এতক্ষণ ওর উপর ঝুঁকে ছিলো। তখন ওভাবে ঝাপিয়ে পরাতে মেয়েটা ভরকে গিয়েছিলো। তাই তো মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করলো। তৌসিফ শুরুতেই বুঝেছিলো পৌষ’র মতো মেয়ে মুখ ফুটে তৌসিফ’কে ডাকার নয়।
তৌসিফের বুকেই রইলো পৌষ। তৌসিফ ছাড়বার পাত্র নয় তাই তো মাথায় চুমু দিয়ে আদুরে গলায় ডাকলো,
— আমার তোতাপাখি?
— হুউ।
— এমন করছো কেন হানি?
— কেমন করছি আমি? আজ থেকে যা বলবেন তাই করব। বুয়ারা যেমন কাজের বিনিময়ে টাকা পায় তেমনই আমাকে খাওয়ানো, পড়ানোর, এত বিলাসিতা দেয়ার বিনিময়ে আপনার সজ্জা শায়ী হব আমি। যা বলবেন তাই করব। মাগনা আর কত অন্যদের ঘাড়ে বসে খাব। আপনিই তো বললেন আমি বাধ্য আপনার কথা শুনতে। কেউ কাউকে মাগনা রাখে না। আমার বাবা’র বাড়ী থাকতাম আমি অথচ দেখুন চাচারা রাখলো না। আমাকে পেলেছে এই খোঁটা দিয়ে বিদায় করলো আমাকে। বাবা-মা থাকলে হতো না এটা। আসলে আমার মতো এতিমদের এত মুখ চালানো উচিত না। এটা চাচির বোন ও বলতো কিন্তু কি করব ছোট থেকেই মুখ চলে বেশি। এতিম তো তাই শাসনের অভাবে বিগরানোই রয়ে গেলাম।
বেশ ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে গেলো পৌষ অথচ তীরের বর্শা’র গিয়ে বিধলো তৌসিফে’র বুকে। বুয়াদের সাথে পৌষ তুলনা দিলো নিজের? নিজেকে কোন পর্যায়ে দাঁড় করালো ও? বিনিময়ে নাকি নিজের দেহ দিবে ও তৌসিফ’কে। সেই হিসেবে পৌষ কোথায় দাঁড়ালো? ও কি আদৌ বুঝলো নিজেকে কোন কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়েছে ও?
তৌসিফ খেয়াল করলো ওর বুকে নরম ঠোঁটের স্পর্শ। চোখ বুজে নিলো তৌসিফ। তার এই বুকটাতে জীবনে দুটো নারীকেই অধিকার দিয়েছিলো ও। এখন যুক্ত হলো পৌষরাত। মা তাকে ছেড়ে চলে গেলো অন্যদিকে মাঝ রাস্তায় পিয়াসী। সে ও বহু বছর আগে এভাবে তৌসিফের বুকে চুমু দিতো। যখন ই নতুন কোন গোল্ডের কিছু দেখলো তখনই এই আদর পেতো তৌসিফ অথচ আজ নারী আর পরিস্থিতি ভিন্ন। পৌষ’র মাথায় হাত দিয়ে মোলায়েম গলায় বললো,
— আর কত নিজেকে নিচে নামাবে পৌষরাত? এবার থেমে যাও হানি।
পৌষ থেমে গেলো। ও এখনও বুকেই আছে। তৌসিফ ওকে বুকে রেখেই অলস গলায় বললো,
— সেদিন রাতে যখন কাঁদলে অসহায় ভাবে তখনই জানিয়েছিলাম মনের কথা তোমাকে। জানি না তোমার মনে আছে নাকি নেই। কিন্তু আজ কি বললে পৌষরাত? নিজেকে বিক্রি করতে চাইছো তুমি আমার কাছে? বিনিময়ে তোমাকে দিবে? বিনিময়ে তো দেহ পাওয়া হয় হানি মানুষ না। আমি তো মানুষ চেয়েছিলাম। নিজেকে এত ছোট কেন বানা…..
— আমি ছোটই। এতিম রা এমনই হয়। এদের উপর সবাই শুধু রোপ ঝাড়ে। ব্যাস। মায়া দেখানো ছেড়ে দিন আমাকে। চিন্তা নেই কিন্তু। লাত্থি, উস্টা খেয়েও ছেড়ে যাব না৷ এখানেই থাকব। এত সুখ ছেড়ে তো পা’গল ও যাবে না।
তৌসিফ এই দফায় ঠিক রইলো না৷ পৌষ’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অস্থির হয়ে গেলো ও,
— এই? এই পৌষরাত, তুমি এমন বলছো কেন? আর কিভাবে বুঝাব তোমাকে? মাফ চাইছি তো। সহজ হও আমার সাথে। এভাবে কথা বলো না প্লিজ। আমি সহ্য করতে পারছি না পৌষরাত। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই হানি। তুমি যদি বলো ওয়াদা করব আমি আজীবন স্বামী’র অধিকার ফলাব না। আমি নারী থাকা থাকতে পারি পৌষরাত। অনেক বছর থেকেছি। বছরের পর বছর পার করেছি এই একা বিছানায়। চাইলেই কত শয্যা শায়ী হাজির কিন্তু কখনো কাউকে চাই নি। এই প্রথম তোমাকে চেয়েছিলাম। তোমাকে ছোট করতে চাই নি আমি। প্লিইইইজ পৌষরাত, ডোন্ট ডু দিস টু মি।
পৌষ নীরব রইতেই অস্থিরতা বাড়লো তৌসিফের,
— জেদ করো, জেদ দেখাও আমাকে হানি৷ আমি সব সয়ে নিব কিন্তু এই নীরবতা না। তুমি কেন বুঝো না তোমাকে ছাড়া চলে না আমার। প্লিজ না পৌষরাত, আমাকে এতটা অসহায় করে তুলো না। নিজেকে ছোট করে আমাকে কষ্ট দিও না। আমি কাছে টানব না আর….
হু হু করে ওর বুকে কেঁদে উঠলো পৌষরাত। কাঁদতে কাঁদতেই তৌসিফে’র পিঠে কিল ঘুষি মা’রতে মা’রতে বলতে লাগলো,
— বজ্জাত লোক, খারাপ পুরুষ। কেন তখন বকেছেন? গাল চেপে ধরেছেন? আমি কষ্ট পাই নি? কি ভেবেছেন, আমার কেউ নেই? ছাড়ুন আমাকে। এখন কেন বুকে ধরেন? দেই বুকে কামড়ে একদম? তখন বুঝবেন কেমন লাগে।
উদাম বুকে এই সন্ধ্যা রাতে বউ নিয়ে অসহায় অবস্থা কাটালো তৌসিফ। মেয়েটার আয়োডিন ডিফেসিয়েন্সি। এমনিতেই দূর্বল তার মধ্যে খায় যত উলোট পালোট। তৌসিফ তো রিপোর্ট দেখেই তখন পা’গল হয়ে ছুটে এলো। ঐ বাচ্চাগুলো’কে ও নিজে স্কুলে পড়ায়। কখনো এতিম বলে ছোট চোখ করে দেখে নি অথচ আজ বউয়ের চোখে কি ইজ্জত টাই না গেলো ওর। আফসোস হয়। বড়ই আফসোস হয় ওর।
নাক টেনে টেনে পৌষ ডাকলো,
— এএই শুনছেন?
ধড়াক করে লাফিয়ে উঠলো তৌসিফে’র বুক। এত রসের ডাক! না জানি কোন মাথায় বাঁশ ফাটানো আবদার এখন করে বসে। এমন এক মুহুর্ত যে তৌসিফ’কে রাস্তায় আন্ডায় ওয়ার পরে নাচতে বললে তৌসিফ তাই করবে এখন। কি মুশকিল! কি মুশকিল! এত তো মহা ঝামেলা। পৌষ ওর বুকের লোম টেনে দিতেই “আউচ” করে উঠলো তৌসিফ। পৌষ লোম টেনে ধরেই বললো,
— একটা দাবি ছিলো।
বলেই ছাড়লো। তৌসিফ বুকে হাত ডলে বললো,
— আপাতত বাঙালি এটা ছাড়া কিছু বুঝে না৷ বলো কি দাবি আমার তোতাপাখির?
— সোহা’কে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিন।
— হানিই, এটা…
— শুনবেন না?
— হুম৷ বিয়ের কথা এগিয়ে রাখব।
— আজ আমাকে অপমান করেছে ও।
— কাল কথা বলব।
আদরে আহ্লাদী পৌষ একটু আদরেই গলে পানি পানি। তাই তো অতি হয়ে বললো,
— কথা শুনবেন একটা?
— শুনব মানে? তুমি যদি এখন আমাকে হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া ডাকতে বলো আমি তাই করব হানি।
পৌষ গদগদ কণ্ঠে ডাকলো,
— কাল বাসায় যাব।
— কিহ? না। একদমই না৷ আমি থাকাতে পারব না।
— ওওওও মামাতো ভাই, যাই না প্লিইইজ।
#চলবে…..
প্রাণ তেঁতে উঠে প্রিয়’র গাল চেপে ধরলো। হিসহিসিয়ে বললো,
— মনে হচ্ছে অনেক মজা পেয়েছিস? আমার ছোঁয়া দেখছি ভালোলাগে না তোর গতকাল থেকে। কাছে আসতেই বমি করে দিলি। কিরে নতুন লাগবে নাকি তোর? এই কথা বল! বল! আমাকে ভালো লাগে না? নতুন ছোঁয়া চাই?
ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো প্রিয়। প্রাণ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললো,
— তুমি যোগ্য ই না। কোন কিছুর যোগ্য না তুমি। নোংরা হয়ে যাচ্ছে তোমার চিন্তা ভাবনা। কিভাবে তোমাকে ভালোবাসলাম আমি? নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে আমার।
— প্রিয়ম!!
— কি? কি প্রিয়ম? কি করবে? কাপুরুষের মতো গায়ে হাতে তুলা ছাড়া কি পারো? পাগল তুমি। অসুস্থ। তোমার মতো অসুস্থর সাথে থেকে আমি ও পাগল হয়ে গিয়েছি। নাহলে কেন পরে আছি এখানে? চলে যাব আজই। পাগলের সংসার কিভাবে করে মানুষ?
প্রাণের চোখ মুখ মুহুর্তের মাঝে রং বদলালো। ফ্যাকাসে হলো মুখটা। দাঁত পিসে বললো,
— চুপচাপ ঘরে বস। মেরে ফেলব একদম।
— এটাই পারবি তুই।
বলেই প্রিয় সরতে চায় ওখান থেকে। তুই তুকারি সহ্য হয় না প্রিয়’র। যদিও তাদের বয়সের পার্থক্য মাত্র এক বছর তবুও কেন জানি প্রাণ প্রিয় থেকে তুই শব্দ টা মানতে চায় না।
হঠাৎ প্রিয়’র হাত ধরে টেনে গালে চড় বসিয়ে দিলো প্রাণ। আচমকা এমন হওয়াতে ছিটকে ফ্লোরে পরে প্রিয়। রেগে গিয়ে হঠাৎ প্রিয় বলে উঠলো,
— এজন্য ই তোঁষা মা তোমার সাথে নেই। মায়ের আদর না পাওয়া ছেলে অন্যের সন্তানের মূল্য কিভাবে জানবে? আজই পাপা’র কাছে চলে যাব। বাবা’কে ও আমাদেরই সাথে নিয়ে যাব। তুই একটা সাইকো। পাগল তুই। একা থাকবি এখন থেকে। জানোয়ার।
মা’কে তুলে কথা বলাতে আর প্রিয় চলে যাবে শুনে জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পেলো প্রাণে’র। জোরে চিৎকার করে ড্রয়িং রুমে থাকা কাঠের চেয়ারটা তুলে শক্তি দিয়ে আঘাত করে প্রিয়’কে। ভয়ে চিৎকার করে উঠে প্রিয়। দুই হাতে পেট চেপে ধরলেও আঘাতটা লাগলো পিঠে। মুহুর্তে ই মুখ ছিটকে রক্ত বেরিয়ে এলো। ছিটকে গিয়ে পরলো প্রাণে’র পায়ে। ফ্লোরে তরপাতে লাগলো প্রিয়। হাত পা ছুঁড়ে দাপড়াতে দাপড়াতে নাক দিয়ে ও রক্ত বেরিয়ে এলো।
#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৭
চারদিকে ফুড় ফুড়ে বাতাস। আকাশটাও ঘনকালো মেঘে ছেয়ে আছে আবার হুটহাট করে মেঘ সরে সেথায় জায়গা নিচ্ছে সূর্যের আলো। পর্দার ফাঁক ফোকর দিয়ে মৃদু আলোক ছটা এসে হানা দিলো পৌষ’র চোখে মুখে। ঘুমের মাঝেই বিরক্ত হয়ে তৌসিফে’র বুকে আরেকটু লেগে নাক মুখ গুজে ঘুমালো পৌষ। একে বাইরে ঠান্ডা তার মধ্যে সারারাত রুমে চলে এসি। তৌসিফ ও ঠান্ডায় বউয়ের উষ্ণতা পেয়ে ওকে চেপে ধরলো নিজের বুকে। গভীর উষ্ণ আলিঙ্গনে আপ্লুত এক পরিবেশ সৃষ্টি হলো।
ভোর কেটেছে অল্প। তৌসিফের টাইমলি ঘুম ভাঙলো। চোখ খুললো ধীরে ধীরে তখনই খেয়াল হলো সে কাউকে নিজের মাঝে নিয়ে আছে। অধরের কোণ ঘেঁষে তখন হাসির ঝলক। তৌসিফ একটু ঝুঁকে চুমু দিলো পৌষ’র মাথায়। এত আদুরে, শান্ত অথচ একে সজাগ করে দেখো চিৎ পটাং করে রেখে দিবে। আরেকটু বুকে নিয়ে কপালে চার পাঁচটা চুমু দিলো তৌসিফ। মেয়েটা তার এক অন্যতম ভালোবাসা। তার প্রতি দিন কে দিন তৌসিফ শুধু দূর্বল হচ্ছে। এতদিন তার কোন দূর্বলতা ছিলো না। এখন যেন তৌসিফের ভয়টা ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যবসায়িক কার্যক্রমে ভালোই শত্রুর আক্রমণের শিকার সে। হায়না দৃষ্টি আকর্ষণ করা ভালোই আয়ত্তে তার। সামনে জ্বি হুজুর বলা মানুষ গুলোই পিছনে ছুঁ’ড়ি হাতে দাঁড়িয়ে। সুযোগ বুঝেই ঝোঁপে কোপ মা’রবে তারা।
উঠতে মন চায় না তৌসিফের। এত সুন্দর বউ রেখে কার ই বা ভালো লাগে উঠতে? কিন্তু সমস্যা একটাই তার এক রান দিতে হবে। জিমে না গেলে তার ফিটনেস ঠিক থাকবে না৷ সে আরেক মহা কাব্য। উঠে যত্ন করে পৌষ’কে গুছিয়ে রাখলো তৌসিফ। গলা অবদি কম্বল দিয়ে ঢেকে এসি অফ করে নিজে ফ্রেশ হয়ে জিম সুট পরে নিলো। ফোনটা পকেটে ভরে অতি বিড়াল পায়ে সে রুম ত্যাগ করলো পাছে যদি বউটা উঠে যায়?
তৌসিফ যাওয়ার ঘন্টা খানিক পরই ঘুম ভেঙে পৌষ’র। আড়মোড়া ভেঙে উঠে পাশে হাতাতেই দেখে খালি। এটাই হয়। ঘুম থেকে উঠে জামাই মিলে না কাছে। কোথায় সকাল সকাল জামাই’কে আদর সোহাগ দিয়ে তুলবে তা না ব্যাটা আগেই ভেগে যায়। কি হইবে সেই পেটানো শরীরটা দিয়ে যদি তোর বউকেই সকালে সময় না দিস? পৌষ মুখ গোমড়া করে উঠে বিছানা গোছালো। রুমের সব পর্দা খুলে গেলো ওয়াশরুমে। লাইন অন করেই আয়নায় নিজেকে হেসে ফেললো ও। এই লাইট নিয়ে ও কম তো কাহিনি হলো না। সাদা লাইট লাগিয়ে ছেড়েছে পৌষ। তৌসিফ মানুষ টা খারাপ না তবে পৌষ’র ওকে গিরগিটি মনে হয়। সে রঙ বদলায় হুটহাট। পৌষ’কে প্রচন্ড আঘাত ও দিবে আবার ভালোবাসায় ও ভরে রাখবে। ব্রাশ করতে করতে পৌষ নিজেকে আয়নায় দেখলো অতঃপর শুধু পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিলো। সামনের কাঁচের সেল্ফগুলোতে সারি সারি দামি স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট রাখা। একটা খুলে ঘ্রাণ নিলো পৌষ। মনে হলো একটু চেখে দেখতে। এত সুন্দর একটা ঘ্রাণ! লোভ বুঝি সামলানো যায়? একটু নিয়ে মুখে দিয়ে ওয়াক ওয়াক করে কুলি করে নিলো। ঘ্রাণ ভালো কিন্তু স্বাদ না। মুখ মুছে বেরিয়ে গেলো পৌষ।
নাস্তা নিজ হাতে বানাতে তার ভালোলাগে। তাই সোজা কিচেনে ঢুকলো ও। সুজি দিয়ে শুরুতে ই হালুয়া বানায় পৌষ। যদিও জানা নেই তৌসিফ আদৌ পছন্দ করে কি না৷ তবুও আজ হালুয়া বানালো ও। ব্যাস্ত হাতে রুটি বানিয়ে দিতেই বুয়া ভেজে ভেজে তুললো।
তৌসিফ ফিরেছে মিনিট দশ হলো। এখনই গোসল করে সে টেবিলে আসবে। ভিজিয়ে রাখা পেসতা,কাজু আর চিনা বাদামগুলে কেটে নিলো পৌষ। হালুয়াতে ছিটিয়ে আরেকটু নাড়া দিতেই ঘ্রাণে মৌ মৌ করে উঠলো চারপাশ। তৌসিফ রুম থেকেই ডাকলো,
— হানিই?
পৌষ ও কিচেন থেকেই উত্তর দিলো,
— কি?
তৌসিফ কথা না বলে বেরিয়ে এলো। সবেই গোসল করেছে সে। আপাতত একটা সিট মাস্ক লাগানো মুখে। পৌষ হঠাৎ পিছনে ঘুরে তৌসিফ’কে দেখেই গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে উঠলো। চোখ বড় বড় করে ওর মুখ চেপে ধরে তৌসিফ। বুয়া সহ বাকিদের দেখে অভ্যাস, পৌষ হঠাৎ দেখে চমকেছে ভালোই। কে জানে দিন দাহারে রুপের সাগর দরিয়া সেজে ঘুরে তৌসিফ? পৌষ ঝটকা মে’রে হাত সরালো ওর মুখ থেকে। হাতের খুন্তি উঁচু করে বললো,
— কি চাই?
— তোমাকে।
— কাজ করছি।
— দেখলাম।
— তো? যান এখন। মেয়েদের হার মানাবেন আপনি।
বুয়া সামনে অথচ তৌসিফের ধ্যান নেই সে পৌষ’র গালে হাতের উল্টো পিঠ ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
— তোমার জন্য ই তো।
ঝটাক মে’রে পুণরায় হাত সরালো পৌষ। মুখ ভেঙিয়ে বললো,
— জানা আছে বাবু মশাই। আপনি আজকের না পুরাতন বৈরাগী।
তৌসিফ পৌষ’র গাল দুটো টেনে দিয়ে চলে গেলো। মাস্ক তুলে ফেসটা একটু ম্যাসেজ করলো অতঃপর মুখ ধুয়ে সিরাম লাগিয়ে মশচুরাইজার দিলো। এতেও কিন্তু শেষ নয়, সানস্ক্রিন লাগিয়ে বের হলো রুম থেকে। চেহারায় তখন তার আফটার জিম গ্লো। পৌষ টেবিলে গরম গরম রুটি আর হালুয়া রাখতেই তৌসিফ’কে খেয়াল করলো। চেহারা একদম চিকচিক করছে যেন। এতটা গ্লো কোথা থেকে এলো? মন চাইলো গাল দুটো ছুঁয়ে দিতে কিন্তু সাহসে কুলালো না৷ যদি ছ্যাবলা ভাবে?
তৌসিফের সামনে বুয়া ডিম সহ এক পদের ভাজি রেখে গেলো। সোহা ও এসে বসেছে। পৌষ তৌসিফে’র দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— হালুয়া দেই?
সোহা ফোড়ন কেটে বলে উঠলো,
— এসব কি…..
কথা শেষ করার আগেই পৌষ ওকে একদম অগ্রাহ্য করে তৌসিফ’কে বললো,
— দিব? খাবেন?
তৌসিফ গাঢ় হাসলো। প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
— অনেক বছর খাই না হালুয়া। আগে মা বানাতো।
পৌষ হাসি মুখে তুলে দিলো। রুটি দিতেই একটা রুটি হালুয়া দিয়ে খেলো পৌষ। তৌসিফ ওর প্লেটে ডিম দিয়ে বললো,
— কোন বাহানা না হানি। খেয়ে নাও।
মুখ লটকালেও পৌষ ডিম খেলো। রোজ তাকে ধরে ডিম খাওয়াবে তৌসিফ। পৌষ আজ তর্ক না করে খেয়ে উঠলো। তৌসিফ রুমে যেতেই পৌষ কাজের বুয়াকে শুনিয়ে বললো,
— খালা শিঘ্রই বিয়ে খাবে।
বুয়া না বুঝে বললো,
— কার?
— কার আবার? আপনাদের মিনুর আপার।
সোহা হঠাৎ ই দাঁড়িয়ে গেলো। তার বিয়ে মানে? তৌসিফ কি ঐ ভার্সিটির লেকচারারের সাথে তার সত্যি ই বিয়ে দিবে?
.
কফি হাতে রুমে ঢুকে তৌসিফের হাতে এক কাপ দিয়ে নিজের চা নিয়ে বারান্দায় চলে যায় পৌষ৷ তার ভালো লাগে জায়গাটা। তৌসিফ ও পিছু পিছু চলে এসেছে এখানে। পৌষ তখন রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘাটের পাশেই রাস্তা। একদম কাঁচা রাস্তা। সেখানেই দুটো গরু ছেড়ে রেখেছে কেউ। তারা ঘাসে মুখ ডুবিয়ে খাচ্ছে। আচমকাই পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে তৌসিফ। পৌষ মৃদু কেঁপে উঠলো। হালকা স্বরে বললো,
— যদি চা পরে যেতো?
— যেতো না। আমি আছি তো।
পৌষ ছাড়ালো না আর তৌসিফ ও ছাড়লো না। তৌসিফ ধীরে বললো,
— কি দেখো?
— এই পুকুর ঘাটটা ভালো লাগতো আমার আগে থেকেই। রাস্তা থেকে তাকিয়ে দেখতাম অথচ এখন কত কাছে।
— এত ভালো লাগে?
— হুম। এখানে পা ডুবিয়ে বসলে মজা লাগবে। আর ঐ নৌকাটা কি চলে?
— চলে তো।
— আমি উঠলে আপনি বকবেন?
— খুউব।
— কেন?
— সন্ধ্যার সময় ওখানে যাবে না।
— কাল ওভাবে কেন আচরণ করলেন?
— একদিন বলব।
— নৌকায় উঠতে চাই।
— বুড়িগঙ্গা ঘুরবে নাকি পদ্মা?
— এই পুকুর।
— পৌষরাত…..
— প্লিজ।
— আচ্ছা।
পৌষ লাফিয়ে উঠতে নিলেই ওর কাঁধে চুমু দেয় তৌসিফ। জানায়,
— আজ রাতে তোমায় নিয়ে বের হব। ফ্রেন্ডরা থাকবে।
— কোথায়?
— এক ফ্রেন্ডের নতুন শোরুম উদ্ভোদন করছে তার পার্টি।
— ওহ। আমি যাব না।
— কেন?
পৌষ চায়ে চুমুক দিলো। জানালো,
— ঐ সব বড়লোক পার্টি আমার পছন্দ না। ফালতু লাগে।
— আমি থাকব তো হানি।
— নো।
— ইয়াহ।
— না ব লে ছ…
একদম ওকে থামিয়ে দিলো তৌসিফ। পৌষ বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওয়াক ওয়াক করে উঠলো। ঠোঁট মুছতে মুছতে বললো,
— কফি খেয়ে মুখ তিতা করে এখন আমার মুখ ও তিতা করে দিয়েছেন। খারাপ লোক।
বলেই চায়ে চুমুক দিলো। পৌষ অবাক ই হলো। কফি এতটাই তেতো করে তৌসিফ খায় যে ওর মুখ এখনও এতটা তেতো হয়ে আছে? এদিকে চাপা হাসছে তৌসিফ যা দেখে রেগে যায় পৌষ।
#চলবে….
প্রিয় প্রাণ’কে দেখা মাত্র ই চমকালো৷ প্রাণ তো আজ এত তারাতাড়ি বাসায় ফেরার কথা না। তখন সাহস করে বেরুলেও এখন অনেকটা ভয় পাচ্ছে ও৷ তবুও বুকে সাহস জুগিয়ে এগিয়ে এসে ব্যাগগুলো সাইডে রেখে বললো,
— আ..আজ এত তারাতাড়ি ফিরলে?
— ফিরে অসুবিধায় ফেলে দিলাম নাকি?
— কি যে বলো? আসলে আমি একটু বেরিয়েছিলাম।
বলেই এক কদম সামনে বাড়লো। প্রাণ চোখ না তুলেই জিজ্ঞেস করলো,
— কাকে বলে?
— আ..আসলে তোমাকে বলতে..চেয়েছিলাম ক..কিন্তু ভাবলাম তুমি ব্যাস্ত তাই।
— ওহ্।
প্রাণ আর কথা বললো না। প্রিয়’র ভয়ে হাত পা কাঁপা কাঁপা অবস্থা। মিনিট পাঁচ পর সাহস জুগিয়ে বললো,
— খা..খাবে না প্রাণ?
— হ্যাঁ খাবো তো। শপিং দেখাবি না?
প্রিয় যেন বুকে সাহস পেলো। একটু হাসার চেষ্টা করে বলতে লাগলো,
— হ্যাঁ হ্যাঁ দেখাব তো। জানো আজ কি হলো….
— শপিং দেখা আগে।
ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো প্রাণ৷ হাসি মুখেই ব্যাগগুলো আনলো প্রিয়। একে একে বের করলো কিছু জামা কাপড়। প্রাণ উল্টে পাল্টে দেখলো। প্রাণের জন্য ও একটা পাঞ্জাবি এনেছে। বেশ সুন্দর রং। প্রাণ দেখতে দেখতেই জিজ্ঞেস করলো,
— তোর টপস নেই?
— আছে তো।
— আমার পাঞ্জাবি নেই?
— হ্যাঁ আছে।
— তোকে ওরনা আর বিকিনি কিনে দেই না?
একথাটা বলেই মাথা তুলে তাকালো প্রাণ। ওর সেই চাহনি দেখেই প্রাণ আত্না কেঁপে উঠলো প্রিয়’র। প্রাণ পুণরায় জিজ্ঞেস করলো,
— দেই না?
— হ…হ্যাঁ দাও।
হাতে থাকা কাপড়গুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে প্রাণ বললো,
— তাহলে আজ কেন গেলি? কেন গেলি এসব কিনতে আমাকে না বলে? কুত্তার মতো সারাদিন খুঁজেছি তোকে অথচ তুই এই *** কিনছিলি!
প্রিয় ভয় পেয়ে গেলো। কিছু বলার আগেই প্রাণ ড্রয়ার থেকে একটা লাইটার বের করে একে একে সবগুলো কাপড়ে আগুন লাগিয়ে দিলো। প্রিয় ওর হাত ধরে আটকানোর চেষ্টা করলো। কোন ভাবেই থামানো গেলো না ওকে। মুহুর্তে ই সব ছাড়খাড় হয়ে গেলো। মুখে হাত চেপে কাঁদছে প্রিয়। প্রাণ ধীরে ধীরে হেটে ফ্রিজের কাছে এলো। বরফগুলো জমেছে। প্রিয়’র একটা সুতির ওরনাতে বরফগুলো নিয়ে শক্ত করে বাঁধলো। রুমে ঢুকে দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে সামনে আসতে আসতে বললো,
— খারাপ লাগছে প্রিয়?
#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৮
— হানিই! হানিই!
এক প্রকার চাপা স্বরে ধমকে পৌষ’কে ডাকছে তৌসিফ। পৌষ’কে ড্রপ করে তৌসিফ যাবে সাইডে। আজ মিটিং আছে তার দুটো কিন্তু পৌষ’র আসার নাম গন্ধ নেই। তৌসিফ মোজা পায়ে ড্রয়িং রুমে চপ্পল পরে বসে আছে। এরমধ্যেই মাথায় হিজাব পেঁচিয়ে মাস্ক আর ব্যগ হাতে বেরিয়ে এলো পৌষ। চোখ তুলে যেই না তৌসিফ ডাকবে ওমনিই খেয়াল করলো পৌষ’কে। লম্বা একটা গোড়ালি পর্যন্ত সুতির গাউন পরা পৌষ। তৌসিফ ই এনেছিলো। সাদা গাউনটার মাঝে কমলা রঙের বড় এক ফুল করা। হাতের কাজ করাতে সাধারণ দেখতে গাউনটার চরা দাম নিয়েছে। কমলা রং একজনের কাছে বিষাক্ত ছিলো। কেন জানি সহ্য ই হতো না। এটা পরলে নাকি মেয়ে মেয়ে লাগে কিন্তু জীবনে প্রথম তৌসিফে’র মনে হয়েছিলো এই রঙটা ওর তোতাপাখির উপর ভালো মানাবে আর হলো ও কিন্তু তাই। মাথায় সাদা রঙের একটা একদমই সাদাসিধা সুতির হিজাব পেঁচিয়ে থাকার পরও দেখতে মায়াবী দেখাচ্ছে তার তোতাপাখি’কে। সারাক্ষণ ঠোঁটের আগায় তার কথা লেগে থাকে। এই যে, এখনও বুয়ার সাথে কথা বলছে। কি যে এত কথা বলে আল্লাহ মালুম। তৌসিফ গলা ছেড়ে ডাকলো,
— হানিই প্লিজ গিফ মাই সুজ।
পৌষ একপলক পিছনে তাকিয়ে জুতার আলমারির কাছে গেলো। কালো রঙের একটা লোফার বের করে তৌসিফে’র সামনে রেখে নিচে হাটু গেড়ে বসলো। তৌসিফ নিরদ্বিধায় পা গলিয়ে দিলো লোফারে। পৌষ পরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তৌসিফে’র দিকে না তাকিয়েই ফাঁকা গলায় জানালো,
— সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে।
তৌসিফ চমকালো। এমন চমক ই খেলো যেন মনে হলো ভর রাস্তায় মুখের উপর পরে গিয়েছে ও। চোয়ালটা ফাঁক হতে নিলেও হলো না। তার হঠাৎ ই মনে হলো সারাজীবনের ঘষামাজা আজ বুঝি সার্থক। উফফ! বউটা বলে কি?
তৌসিফে’র পরণে সাদা শার্ট কালো গেবাডিং এর সাথে ইন করা। তার উপর ব্লেজার। হাতে তার ব্লাক ওয়াচ। মাথার চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করে রাখা, একটু বেড়েছে কি না। গম্ভীর্জে ভরপুর পুরুষ মুখটাতে পুরুষত্বের স্পষ্ট ছাপ।
এই মুখ আর পেটানো ফিট শরীরটাতে মানুষ তাকে বরাবরই প্রশংসা করে। বন্ধু বান্ধব সব ঠিলা হয়ে লুজবুজ অবস্থা। তৌসিফ’কে দেখলেই তাদের চোখ চক্ষুর বড় বড় হয়ে যায়। সেবার এক বন্ধুর ভাতিজির জন্য ও প্রস্তাব পেয়েছিলো। আশ্চর্য ও হয়েছিলো বটে। দিন শেষে কথা কিন্তু একটাই। তোমার টাকা তো দুনিয়া আছে। দুনিয়ার পেছনে ছুটতে ছুটতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পরে মানুষ অথচ সহায় বিপত্তি ই যেন তাদের একমাত্র অবলম্বন।
তৌসিফ উঠে দাঁড়িয়ে পৌষ’র কুনুই ধরে নিজের কাছে আনলো অতঃপর পৌষ’র হাতে থাকা মাস্কটা ওর হিজাবের ভেতর দিয়ে কানে পরিয়ে দিতে দিতে বললো,
— আমার তোতাপাখিটাকেও অনেক সুন্দর লাগছে।
— আমি তো আপনার মতো ফর্সা না।
— উমম। আমার শীতের কোকিল পাখি তুমি।
পৌষ ধুরুম করে একটা গুতা মা’রলো তৌসিফের পেটে। তৌসিফ আচমকা গুতাতে অল্প ব্যথা পেয়ে বলে উঠলো,
— কি করলাম?
কটমট তাকিয়ে পৌষ বললো,
— আমি ওমন কাইল্লা?
তৌসিফ বুঝলো তার বউ ইমোশন বুঝে নি, সে বুঝেছে রঙ। কি আর করার বউ’কে টেনে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
— আচ্ছা আমার এলব্রাটস তুমি। একদম সাদা।
পৌষ এবারেও ধাক্কা মারলো। কিচেনে যেতে যেতে বললো,
— আমি ঠ্যাং কি বগের মতো লম্বা! শা’লা…
বলেই জিভ কাটলো। তৌসিফ বোধহয় শুনে নি নাহলে লাগাতো এক ধমক। কিচেন থেকে হাতে ব্যগ নিয়ে বেরুলো পৌষ। তৌসিফ তখন পৌষ’র ভার্সিটি ব্যগ হাতে তুলেছে। দু’জন বেরিয়ে যেতেই বুয়াগুলো ফুসুরফাসুর লাগালো। তাদের মামা’কে এভাবে দেখা হয় নি কোনদিন।
গাড়িতে ও মুখখানা ফুলিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো পৌষ। তাদের মাঝে দূরত্ব ও আছে। পৌষ একদম সেটিয়ে বসে আছে। তৌসিফ চোখের সান গ্লাসটা নামিয়ে পৌষ’কে এক টান দিতেই ও হুমড়ি খেয়ে পরলো। তৌসিফ ওকে নিজের কাছে লাগিয়ে নিলো। পৌষ কথা বলে না। বলবেও না। তৌসিফ হঠাৎ ই ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
— হানি এমন গাল ফুলিয়ে রাখলে তো আমার আদর আদর পায়।
পৌষ ও ফিসফিস করে বললো,
— সমস্যা কি তাহলে? আমাকে নামিয়ে দিন এরপর ড্রাইভারকে আদর করুন।
— কিহ!
জোরে ধমক দিলো তৌসিফ। পৌষ হু হা করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে হেলে পরলো যেন। তৌসিফ তাকিয়ে রইলো ওর পানে। এই মেয়ে এত পাঁজি। আচমকা গাড়িটা ঝাঁকি দিতেই পৌষ গিয়ে গিয়ে জানালার কাঁচে বারি খেলো। তৌসিফ ধরার সুযোগ পেলো না। “মা” বলে উঠতেই তৌসিফ তারাতাড়ি টেনে ধরলো। হিজাবের উপর দিয়েই হাত ডলতে লাগলো ওর মাথায়। ড্রাইভার’কে ধমকে উঠতেই পৌষ ওর বাহু ধরে বললো,
— উফ। দোষ আমার অথচ ধমকাচ্ছেন ওনাকে।
ড্রাইভার তবুও মাফ চাইলো। পৌষ সরস গলায় বললো,
— আরে আমি সরি। আপনার দোষ নেই।
তৌসিফ ওর মাথায় হাত রেখেই বললো,
— হানি, মাথায় পানি দিই? হিজাবটা খুলে দেই? গাড়িতেই পানি আছে।
— আরে না না লাগবে না। ঠিক আছে।
তৌসিফের মন মানলো না৷ পৌষ মুখ চেপে হাসছে তখনও। আচ্ছা মেয়েটা তো অনেকটা ব্যথা পেয়েছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। এর কারণ টা কি? ওর কষ্ট দেখার তো মানুষ আছে। এই যে স্বয়ং তৌসিফ আছে। ও কেন নিজের কষ্ট লুকিয়ে বেড়ায়? সেদিন জ্বরের ঘোরে কাঁদলো আর গতদিন….।
গাড়িটা ভার্সিটির সামনে থামতেই পৌষ টাটা দিয়ে নেমে গেলো। ওকে আশ্চর্য করে দিয়ে তৌসিফ ও নামলো। পৌষ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ওর হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। পৌষ জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিলো না। তৌসিফ ওকে নিয়ে সোজা ঢুকলো মেডিক্যাল সার্ভিসে। পৌষ’র চক্ষু চড়কগাছ। এই ব্যাটা সুধরাবার নয়। পৌষ’র মনটাই বলছিলো তৌসিফ তালুকদার কেরামতি দেখাবে। এই নাও ঠ্যালা। মাথায় টোকা খাওয়ানোর পর ডক্টর দেখাও। লজ্জা ই পাচ্ছে পৌষ। বার দুই এক না ও করলো লাভ হলো না।
তৌসিফ ঢুকেই জানালো,
— মাথায় অনেক জোরে গাড়ির গ্লাসে বারি খেয়েছে। আমি রাতে এক্সে করিয়ে নিব। আপনি আপাতত ব্যথা কমান৷
মাথা চারবার চক্কর দিলো পৌষ’র। এই লোকের মাথার তার দুই একটা ছেড়া আছে। উপস্থিত ডক্টর ঠান্ডা আইসের ব্যাগটা ওর মাথায় ধরে রাখতে বললো। একটা পেইন কিলার জোর করে তৌসিফ খাওয়ালো। পৌষ না করতেই মুখ চেপে গিলালো। রাগে, দুঃখে কান্না পায় পৌষ’র। চোখ দিয়ে পানি পরেও যেন পরে না। তৌসিফ অবশ্য ওর ভেজা চোখ দেখেছে। তাতে তার যায় আসে না। বউ তার কলিজার টুকরো। তোতাপাখিটা সারাক্ষণ ত ত করে। এর ব্যথা লাগলেই তো অসুস্থ হবে তখন কে তার কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান করবে?
সব কাহিনি শেষ করে পৌষ’রা বের হতে নিলেই উপস্থিত একটা মহিলা জিজ্ঞেস করলো,
— কি হন তোমার?
পৌষ মুখটা ভেঙিয়ে বললো,
— মামাতো ভাই।
তৌসিফ চোখ এমন ভাবে রাঙালো যে পৌষ’র ভেতরের ছোট্ট কলিজাটা ধরফর করতে লাগলো। বদলের মতো হেসে পৌষ বলে উঠলো,
— হে হে জামাই লাগে।
মহিলাটি অল্প হেসে বললেন,
— অনেক ভালোবাসে তাই না? সামান্যতেই যা করলো।
পৌষ শূন্য গলায় বললো,
— উনি একটু আলগা পিরিত সবসময় ই আমাকে দেখায়।
তৌসিফ এবার দাঁড়ালো না টানতে টানতে বাইরে আনলো ওকে। পৌষ খিলখিল করে হাসছে তখন। পেছনে মহিলাটাও হাসলেন। মেয়েটা চঞ্চল!
তৌসিফ গাড়িতে উঠতেই পৌষ জানালার ফাঁক দিয়ে ডাকলো,
— ওওও জামাই?
চকিত দৃষ্টি ফেলে তাকালো তৌসিফ। এই মেয়ে একটা বদর! পৌষ জানালা দিয়ে মাথা ভেতরে ঢুকিয়ে বললো,
— কি?
— সোজা ক্লাসে যাবে। নিতে আসব।
— যাব না।
— কি করবে তাহলে.?
— বটতলায় প্রেম করব।
— এক চটকানা লাগাবো গালে। মাথা ঠিক হয়ে যাবে।
— মাথার নাট বল্টু খুলে গিয়েছে আগেই।
তৌসিফ কপালে হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
— হানিই? কি চাই বলো।
— সামনের সিটে লাঞ্চ দিয়েছি। ঐ ব্যগে আছে। খেয়ে নিবেন। ঠিক আছে?
অবাক হয়ে তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,
— কেন?
— আসলে আমার পাতানো জামাই দুপুরে বাইরে খায় তাই তার জন্য রান্না করেছি। তাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব আপনার। কি পারবেন না?
তৌসিফ হেসে মাথা নাড়ালো। পৌষ মাথা বের করে ড্রাইভারের সামনে সিটি বাজাতেই ড্রাইভার তাকালো। পৌষ ভেটকি দিয়ে বললো,
— আমার জামাই’কে ভালোমতো পৌছে দিবেন।
— জ্বি জ্বি।
ড্রাইভার বিব্রত। তৌসিফে’র গাল থেকে হাসি সরছে না। ও হাত নেড়ে বিদায় দিলো পৌষ’কে। পৌষ ঢুকতেই তৌসিফের গাড়িও চলতে লাগলো।
অনুভূতি গুলো এলোমেলো। তা গোছাতে বসলো তৌসিফ। সত্যি ই এলোমেলো এক অনুভূতি। এই মেয়ে ওকে জাদু করেছে।
এভাবে বাসা থেকে ছোট থাকাকালীন মা টিফিন দিতো। মা নেই যত্ন ও নেই। পিয়াসী কখনো এতটা ভাবতো না। কত দিন গেলো তৌসিফ না খেয়েই অফিস করলো। না সময় ছিলো না ছিলো বাইরের খাবার খাওয়ার ইচ্ছে।
_______________________
দুপুর তিনটা নাগাদ মিটিং শেষ হলো। তৌসিফে’র আজ ক্ষুধা লেগেছে সাথে তাড়া ও আছে। বউ টিফিন দিয়েছে। রুমে ঢুকে গায়ের ব্লেজার খুলেই ইমু’কে বললো,
— আমার বাসা থেকে লাঞ্চ দিয়েছে। সার্ভ করতে বলো।
ইমু অবাক হলো বটে। এই প্রথম বলে কথা। এখানে কাজ করে বছর হলো ভালোই। তৌসিফ এক ধমক দিতেই ইমু দৌড়ে বের হলো। মুখ, হাত ধুঁয়ে সেন্টার টেবিলে বসলো তৌসিফ। বাটিগুলো সাজিয়ে রাখা। ভাত, করলা ভাজি, চিংড়ির দোপিজি সাথে ডাল। পাশে ছোট্ট একটা বক্স। ঢাকনা খুলতেই সালাদ দেখা গেলো। তৌসিফে’র ঠোঁট জুড়ে তখন প্রাপ্তির ছাপ। এমনিতে কম খেলেও আজ পুরোটা সাবার করলো। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে পানি পান করতেই ইমু নক করলো। তৌসিফ তাকে আসতে বলতেই ইমু ঢুকলো। হাতে তার ছোট্ট একটা চিরকুট। তৌসিফ’কে দিয়ে বললো,
— স্যার খাবারের ব্যাগে ছিলো।
তৌসিফ ভ্রুঁ কুঁচকে হাতে নিলো রঙিন চিরকুটটা তাতে গোটাগোটা অক্ষরে লিখা,
” ও মামাতো ভাই, আমার একমাত্র জামাই, আপনার জন্য লাঞ্চ দিলাম। খাবেন কিন্তু পুরোটা। একটা ভাতের দানা ও বাকি থাকে তাহলে আপনার মাথার চুল বাকি থাকবে না। ইটস লাউড এন্ড ক্লিয়ার।”
#চলবে…..