প্রেমসুধা পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0
369

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪১

গটগট পা ফেলে সোহা’র রুমে সোজা ঢুকলো তৌসিফ। এখনও রেডি হওয়ার সময় সে পায়নি। সোহা’র পরণে নিজের কিনে আনা দামী লেহেঙ্গা। তৌসিফ শুরুতেই ধমকে উঠলো,

— বলেছিলাম না শাড়ী পরতে? মিনু বলেছে না? মেহেদীরা চলে আসবে যেকোনো সময়। দশ মিনিট দিলাম শাড়ী পরো যেটা মেহেদী পাঠিয়েছে।

তৌসিফে’র ধমক গুলো যেন গায়ে কাঁটার বর্ম ফুঁটালো। সোহা’র বুকটা কেঁপে উঠলো মুহুর্তের মাঝে। ঘর কাঁপানো যেন প্রতিটা শব্দ তার। শিউরে উঠে সোহা। টলমল হয় চোখ জোড়া। তৌসিফ পাত্তা দিলো না। সোহা বুকে সাহস জমা করলো। শেষবারের মতো চেষ্টা করলো বিয়েটা আটকাবার।

— আমি বিয়েটা করতে চাই না।

নিচু শব্দে বললো সোহা। তৌসিফ যেন কথাটা কানেই তুললো না। কেমন একটা চাহনি দিলো অতঃপর গমগমে গলায় বললো,

— তৈরী হও শিঘ্রই।

— আমি বলেছি মেহেদী’কে বিয়ে করব না। দেখো কি পাঠিয়েছে আমাকে। এই শাড়ীর মতো তিনটা শাড়ী আমার ড্রেস বিক্রি করলে পাওয়া যাবে।

— তাহলে নিজের ড্রেস বিক্রি করে দাও।

— মানে?

— মানে সেটাই যেটা বললাম। আমি তৌসিফের মুখের কথার উপর দিয়ে টপকে কোন কাজ করলে ছুঁয়ে ফেলে দিতে সেকেন্ড সময় ও নিব না। হয় আজ মেহেদী’কে ভদ্রমতো বিয়ে নয়তো আমার বাড়ী থেকে আউট। আর হ্যাঁ, যেই ড্রেসের বড়াই করছো সেটার উপযুক্ত কি না ভেবে দেখো। আমি ঠাই না দিলে আজ কোথায় থাকতে ভেবেছো? সদর ঘাটে গার্মেন্টসে চাকরি করে খেতে হতো। তখন এত তুলুতুলু ভাব থাকতো না। নীল দুনিয়া থেকে বের হও। কার টাকায় পা মাটিতে রাখো না ভেবে দেখো।

কাটখোট্টা গলায় কথাগুলো বলেই বেরিয়ে গেলো তৌসিফ। মেজাজটাই যেন খারাপ হয়ে গেলো ওর। মনে মনে বিশ্রী এক গালি দিতেও যেন ভুললো না। প্যান্টের পকেট হাত দিতেই দেখলো সিগারেটের প্যাকেটটা নেই। এবার বেজায় বিরক্ত তৌসিফ। মুখটা যেন বিতৃষ্ণা লাগছে তার। একটা সুখ টান এখন দিতে হবেই। ধুপধাপ পা ফেলে রুমে ঢুকেই ড্রয়ার হাতরে প্যাকেট নিলো। লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে মুখে গুজেই লম্বা এক টান দিলো। মুহুর্তেই নাক, মুখ দিয়ে গলগলিয়ে ধোঁয়া বের হলো। সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। কাজিও শিঘ্রই চলে আসবে। মেহেদীরা আসলেই তৌসিফ আগে বিয়েটা পড়াবে। খাওয়া দাওয়া, হাল হকিকত জিজ্ঞেস করার বহুত সময় আছে।
মাথাটা এলিয়ে দিলো তৌসিফ। সাইড থেকে চিনচিন করছে তবে খুবই অল্প। হঠাৎ কারো কাশির শব্দ পেয়ে হাতে থাকা সিগারেটটা’র দিকে তাকালো তৌসিফ। খেয়াল করলো কাশতে কাশতে ওর দিকে তেড়ে আসছে পৌষ। পরণে পাকিস্তানি এক গাড়াড়া। উল্টে পরবে নাকি উস্টা খাবে সেই খেয়াল নেই। তৌসিফ মাথাটা তুলেই কোনমতে শুধু বলেছে,

— উস্টা খাবে তো হানি….

কথাটা বলেই যেন আরো ক্ষেপালো সে তার হানি’কে। এক ঝটকায় তৌসিফে’র কিছুটা উপরে উঠে এলো পৌষ। ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো,

— আমি উস্টা খেয়ে বুস্টা হয়ে যাই। এরপর বুস্টা হয়েই চাঁন্দের দেশে চলে যাই। সেখানে গিয়ে কাঁথা বানাই। সেই কাঁথা ফিক্কে ফিক্কে পৃথিবী বাসীকে পাঠাই। তাতে আপনার কি হ্যাঁ?

তৌসিফ যে না চাইতেই সুনামি ডেকেছে তা ও খুব সহজেই বুঝে গেলো। এলোমেলো চুলে বউটাকে ঠাকুমার ঝুড়ির ডাইনীর মতো লাগছে। এই কথা অবশ্য বলা যাবে না। বললেই জাঁহাপনার হুকুম তামিল করে গর্দান যাবে। তৌসিফ আবার কঁচিতে কঁচিতে বউকে সালাম দিয়ে চলে। এই যেমন এই মুহুর্তে বউ ক্ষ্যাপাটে হয়ে আছে। যেই কোন মুহুর্তে সে হামলা দিতে পারে। তৌসিফ এই অবস্থায় শান্ত। সংসার সুন্দর করার এক মোক্ষম হাতিয়ার হলো চুপ থাকা। একজন আগুন তো অন্যজন পানি। আগুন কখনো আগুন নেভায় না আবার পানিও পানিতে কোন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে না, তারা একদমই নিটোল। তাই তো হতে হবে বিপরীতমুখী। তৌসিফ আপাতত পানির ভূমিকায় আছে কারণ বউ আছে আগুনের ভুমিকায়। এর কারণ অবশ্য যথাযথ। সিগারেট খাওয়া পছন্দ করে না পৌষ। মেয়েটার কাশি উঠে যায়। তৌসিফও ততটা খাচ্ছে না। তবে মুখের তৃষ্ণা অথবা বহু পুরাতন অভ্যাস যাই হোক না কেন সেটার নিবারক হিসেবে খুব মাঝেমধ্যে সুখ টান দেয়া হয়। পৌষ যে এত তারাতাড়ি বেরিয়ে আসবে তা কে জানতো? জানলে বুঝি নিজের বউকে চাঁদে গিয়ে কাঁথা বানানোর মতো কাজে লিপ্ত হওয়ার মতো দুঃখ তৌসিফ দেয়? উহু। মোটেও দিতো না।

হঠাৎ ই হাতে টান পরলো। তৌসিফ দেখলো পৌষ ওর হাত ধরে টানছে সিগারেট নিতে। মুখ খুলে তৌসিফ শুধু জিজ্ঞেস করলো,

— আহা! এটা টানছো কেন? ফেলছি তো।

— ফেলবেন ক্যান? আমি খাব। দিন আমাকে। এখনই দিন। আমিও খাই। দেখি কি এমন আছে যা আপনাকে টানে। কোন সুখ আছে এটাতে যা আপানকে এটা ছাড়তে দেয় না। কি এমন মধু আছে এটাতে? বলুন আমাকে? দিন আমিও খাব। দেখব আজ।

মুখে বলতে বলতে সমান তালে টানছে পৌষ। তৌসিফ জানে বউ তার কিছুটা তারছিঁড়া তাই তো ঝট করে আগে সিগারেট নিভালো। এক হাতে পৌষ’কে আটকে রেখে অন্য হাতে থাকা সিগারেট ফেলে দিয়ে আস্তে করে বললো,

— আচ্ছা রে বাবা আর খাব না।

— আমি কেন আপনার বাবা হব? বউ লাগি বউ। ব যোগ উ। বুঝেছেন?

— বুঝেছি।

— সিগারেট খাব।

— দেয়া যাবে না।

— কেন?

— হৃদপিণ্ডে হামলা দিবে।

— ওওওওও তাই নাকি? আহা! ইহা কিতা বলিলেন আপনি? ওমা! এতো আজ প্রথমবার শুনলাম। কি আশ্চর্য, আমি তো বিস্মিত হয়ে গেলাম। এই এই ধরুন আমাকে। এই কথা শুনার আগে আমি ম’রে গেলাম না ক্যান? সিগারেট হৃদপিণ্ডে হামলা দেয়? কি অবাক করা কথা! হায় তওবা! তিনবার তওবা।

এমন বিশ্রী ভাবে যে পৌষ ভেঙ্গাবে তা কাশ্মির কালেও ভাবে নি তৌসিফ। মুখটাকে চার ট্যামরা করে ব্যাঙ্গ করে যাচ্ছে পৌষ। কটুক্তি গুলো খুব সহজে হজম করে চুপ করে তৌসিফ হাত বাড়ালো। পৌষ’র চুলে হাত দিলে নিলেই তড়াক করে সরে দাঁড়ালো পৌষ। একদম সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পাংশুটে মুখ করে বললো,

— আজ আমার ধারেকাছে আসবেন না আপনি। যেদিন এই সিগারেট ছাড়তে পারবেন সেদিন আসবেন।

তৌসিফ উঠে দাঁড়ালো। বেশ ঠান্ডা স্বরেই বললো,

— আর খাব না।

— এই কথা আপনি আগেও বলেছেন। কথা রেখেছিলেন?

কণ্ঠে কাঁপন বুঝা গেলো। বেইমান চোখ দুটো ভরে উঠলো। ঠোঁট দুটো সমান তালে কেঁপে যাচ্ছে। তারা ভেঙে পরে কাঁদতে চাইছে। হয় রাগ নাহয় অভিমান। কোন এক কারণে এই দশা পৌষরাতে’র। সঠিক কারণ তার জানা নেই। তৌসিফ মনোযোগ দিয়ে দেখলো ওকে অতঃপর এক হাত ধরে নিলো। পৌষ ঝটকা দিয়ে সরাতে চাইলেও সরালো না। ও এতটুকু তো বুঝেছে পুরুষ মানুষ প্রত্যাখ্যান জিনিসটা ততটা পছন্দ করে না আর সেই পুরুষ যদি হয় তৌসিফ তালুকদার তাহলে তো কিচ্ছাই খতম।
তৌসিফ পৌষ’র হাতটা নিয়ে স্থান দিলো নিজের বুকে। সময় নিয়ে অনুভব করালো তার সিস্টোল ডায়াস্টল। কিছুপল যেতেই নম্রস্বভাব নিয়ে বললো,

— কথা দিচ্ছি আর খাব না।

— যেই কথা রাখতে পারবেন না সেই কথা দিয়ে কি লাভ?

— আচ্ছা। মাঝেমধ্যে খাব।

— না।

— সপ্তাহে একটা।

— না।

— মাসে?

— না।

— ওহ প্লিজ পৌষরাত! বছরে একটা খাওয়া না খাওয়া একই কথা।

পৌষ খিটমিট করে বলে উঠলো,

— কখন বলেছি বছরে একটার অনুমতি দিব? ছাড়ুন হাত।

তৌসিফ ছাড়লো না। পৌষ’র কোমড় জড়িয়ে নিয়ে কিছু বলতে নিলেই পৌষ “ওয়াক ওয়াক” করে উঠলো। তৌসিফ কিছু বলা বা করার আগেই পৌষ ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

— আপনার মুখে গন্ধ।

তৌসিফ এই পর্যায়ে খুবই অসহায় বোধ করলো। কি এক বউ তার। পুরাই পৌষ মাসের মতো। এই বৃষ্টি তো এই গরম।

______________________

মেহেদী’রা পৌঁছাল ঘন্টা খানিক দেড়ী করে। আসার পথে গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। কেউ যদিও আহত হয়নি তবে মুরুব্বি ধাঁচের দুইজন বলাবলি করেছে পথে বাঁধা যেহেতু এসেছে এই বিয়েতে তাহলে না আগানোই ভালো। মেহেদী অবশ্য পাত্তা দেয় নি তবে ওর মা-বাবার চোখে মুখেও আতঙ্কের ছাপ দেখা গিয়েছে। মেহেদী যেন দেখেও দেখে না। তৌসিফ ভাই তার জন্য অনেক করেছে। আজ যখন তার জন্য কিছু করার পালা তখন মেহেদী পিছিয়ে থাকবে না। তার নিজের তো কোন পছন্দ নেই। বিয়ে তো করবেই তাহলে তাকেই করুক যাকে তৌসিফ ভাই পছন্দ করে দিলো। নিশ্চিত এর মধ্যে ভালো কিছু আছে।
ওরা সবাই ড্রয়িং রুম জুড়ে বসেছে। তখনই দেখা মিললো তৌসিফে’র। রুম থেকে বের হচ্ছে। পরণে তার সাদা একটা সিম্পল পাঞ্জাবী তবে হাতের কাজ করা বুকের দিকে আর হাতে। মুখ ভরা তার দাড়ী। দেখতে চমৎকার দেখালো। অতি সুন্দর একজন পুরুষ সে। তার কাছে যেন বর বেশে থাকা মেহেদীও ফিঁকে। মেহেদী যদিও ততটা সাজসজ্জা করে নি। সাধারণ এক পাঞ্জাবীই পরেছে। তৌসিফ বের হতেই পিছন পিছন পৌষ বের হলো। কাজ ছাড়া এক গাড়াড়া পরে মাথায় হিজাব পরেছে সে। সাজ বলতে শুধু ঠোঁটে একটু লিপস্টিক। তৌসিফ না করেছে সাজতে। পৌষও মেনে নিয়েছে।
তৌসিফ কাজিকে শুরুতেই বললো,

— বিয়েটা আগে হোক।

কাজি মাথা নাড়লেন। একজন মুরুব্বি বললেন,

— এত তাড়া কিসের বাবা? আগে তো….

তৌসিফ গমগমে স্বরে বললো,

— কি মেহেদী? বিয়ে করবে না?

— জ্বি জ্বি ভাই।

তারাহুরো করে বলে উঠলো মেহেদী। তৌসিফ বাঁকা হেসে মিনুকে বললো,

— সোহাকে আন।

মিনিট দুই যেতেই সোহা’র আগমন ঘটলো। সেই কমদামী শাড়ীটিই তার পরণে। তৌসিফ ফিরেও তাকালো না। মেহেদী’র পাশে ফাঁকা জায়গায় তাকে বসানো হলো। সোহা শক্ত হয়ে রইলো যেন। কাজি কবুল বলতে বললেও সোহা যখন চুপ করে রইলো তখন পৌষ এগিয়ে এলো। সোহা’র পাশে বসে হাতটা ধরলো। ও জানে এই সময় কেমন লাগে। পৌষ’রও এমন দিন গিয়েছে। তার পাশে কেউ ছিলো না। কেউ না। যারা এতিম তাদের আল্লাহ বাদে কেউ নেই। এই যে সোহা। ওরও কেউ নেই। পৌষ সব খারাপ কিছু ভুলেই সোহা’র হাত শক্ত করে ধরে আস্তে করে বললো,

— কবুল বলে দিন আপু। উনি আপনার জন্য নিশ্চিত খারাপ কাউকে পছন্দ করবেন না। নিজের দায়িত্ব উনি যথাযথ ভাবেই পালন করবেন।

সরলমনা পৌষ কথাটা বলতেই সোহা মুখ ফুটে কবুল বললো। ও জানে ওর আগেপিছে কেউ নেই। এই বিয়ে ওকে করতেই হবে। সোহা কবুল বলা মাত্রই মেহেদীও কবুল বললো। সকলে আলহামদুলিল্লাহ বলতেই তৌসিফ নিজ হাতে সবার আগে জামাই বউ অতঃপর একে একে সবার মিষ্টি মুখ করালো। তার মুখটা হাসি হাসি। পৌষ চমকালো। খুব অবাক হলো। লোকটা গিরগিটি। কিভাবে রং বদলালো। এতক্ষণ মুখটা কেমন ভারী ভারী করে রেখেছিলো অথচ এখন যেই না বিয়েটা হলো ওমনিই সে রং বদলাচ্ছে।
বাকিরাও অবশ্য চমকেছে। বিশেষ করে মেহেদীর মা-বাবা। তারা যেন শো এসেছে। বলার বা করার কিছুই নেই। তাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে কেন নিজের সৎ বোন বিয়ে দিচ্ছে তৌসিফ এর উত্তর তাদের জানা নেই। না জিজ্ঞেস করার সাহস আছে।
.
খাওয়া দাওয়া হতেই সোহা’কে বিদায় দেয়া হলো। গলা ছেড়ে মিনু কাঁদলো। সোহা পাথর বনে আছে। ওর সামনে অতি কমদামী একটা গাড়ি তাও ভাড়া করা। জীবন তার কোথায় মোড় নিলো সে জানে না। মিনু’কে শুধু বললো,

— কাঁদিস না। তোকে নিয়ে যাব।

— আজ চলি আপা?

— না।

সোহা যেতে নিলেই আচমকা পৌষ এসে জড়িয়ে ধরলো। সোহা চমকালো তবে কথা বললো না। পৌষ শুধু বললো,

— মন দিয়ে সংসার করুন আপা।

পৌষ যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই সরে গেলো। তৌসিফ আগ বাড়িয়ে কথা বলে নি। ওদের বিদায় কালটা সাদামাটা ভাবেই হলো। তৌসিফ বিরবির করে শুধু বললো,

— বালা টললো।

পৌষ পাশ থেকে বলে উঠলো,

— কি বললেন?

— কি আর বলব?

— তাও ঠিক। মামাতো ভাই না আপনি আমার? আপনার কি ই বা বলার থাকতে পারে?

#চলবে…

[ রিভিশন দেয়ার সময় হয় নি। ভুল পেলে জানানোর অনুরোধ রইলো]

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪২

আকাশে আজ অর্ধচন্দ্র’র দেখা মিললো। অর্ধ বলাটা অবশ্য ভুল। একদমই ঠিক নয় কারণ চাঁদটা অর্ধেক থেকেও যেন কম। মোটা একখানা দাগের মতো দেখতে। মেঘের আড়াল হওয়া থেকে নিজেকে কোনমতে বাঁচিয়ে স্ব গর্বে সে তাতিয়ে বেড়াচ্ছে। দ্যুতি ছাড়াচ্ছে চারপাশ জুড়ে যেন তার রুপের ঝলকে ফিঁকে পরে যাচ্ছে সকলে। বড়ই দাপট দেখাচ্ছে আজ চাঁদটা। তৌসিফ দূর আকাশে চাঁদের পানে তাকিয়ে হাসলো বাঁকা ভাবে। তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠলো,

— তোর থেকে আমার শ্যামাঙ্গিনী অধিক সুন্দরী।

চাঁদটা যেন ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে তৌসিফ’কে বলে উঠলো অনেকিছু যার শ্রোতা একমাত্রই তৌসিফ নিজে তাই তো একা একাই বলতে লাগলো,

— তোকে সকলে দেখে। নিজেদের বাসনা নিবারন করে কিন্তু আমার চাঁদ শুধু আমার আকাশে উঠে। সে বিলুপ্তও আমার আকাশেই হয়।

শরৎ বাতাস চারদিকে। এই সময়টাতে ঠান্ডাও লাগছে বেশ। পাতলা এক সাদা শার্ট তৌসিফে’র পরণে সাথে সাদা ঢোলা এক প্যান্ট। বুকের কাছের বোতাম দুটো খোলা থাকায় তাকে বেশ দেখাচ্ছে। তৌসিফ আপাতত বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তার ভেতরের প্রেমিক সত্তার আজ ঘুম ভেঙেছে বহু বছর পর। পৌষ’কে নিয়ে আজ সে সদ্য জাগ্রত প্রেমটাকে নিয়ে এই চন্দ্র বিলাস করবে।

শব্দ হতেই তৌসিফ বুঝলো পৌষ বেরিয়েছে। হাত, মুখ ধুয়ে একদম ফ্রেশ হয়ে এসেছে ও। চুলগুলো একত্রিত করে ঢোলা এক ঝুঁটি করে পিঠে দিয়ে রাখলো। বিছানায় রাখা সাদা ওরনাটা মাথায় দিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। তৌসিফ বাইরে থেকেই তা অবলোকন করে হাসলো মৃদু। কাকে খুঁজে তার তোতাপাখি? নিশ্চিত তৌসিফ’কে। উত্তরটা যেন তৌসিফে’র মস্তিষ্ক খুব ঝটপট করে দিলো। পৌষ ডাক দিলো,

— আপনি কি বারান্দায়?

জবাব এলো না। পৌষ’র রাগ হলো। এই ব্যাটা হয়েছে এক খাটাস। এই যে পৌষ তখন একটু ফোনটা হাতে তুলেছিলো কাউকে কল দিতে। তৌসিফ কল লাগাতে দিলো না। ফোন কেড়ে নিয়ে সে ঠেলেঠুলে পৌষ’কে ঢুকালো ওয়াশরুমে। সোজাসাপটা বলেও দিলো গম্ভীর কণ্ঠে যাতে পৌষ কাপড় বদলে গোলাপি রঙের কুর্তিটা পরে। পৌষ ভাবলো হায় কপাল ওর জামাইটার কি হলো? মানুষটার মুখটা কেন হুতুম প্যাঁচার মতো দেখায়? কেলেঙ্কারি বুঝি কিছু হলো? কিন্তু কই? এই লোকের বিনা কারণে করা হুমরি তুমড়ি সব। এখন পাত্তা নেই।
পৌষ এবার বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলো। বিনা কারণেই এক দুই গুনলো দশ পর্যন্ত অতঃপর জোরে গলা ফাটিয়ে ডাকলো,

— অ্যাই মামাতো ভাই! কই আপনি? আমার জামাই কই? দেখেছেন তাকে?

এই ডাক না হলেও এক কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছে। তৌসিফ যেন তড়িঘড়ি করে রুমে ঢুকলো। পৌষ’র ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। ও যেন চাইছিলোই তৌসিফ এভাবে আসুক। মেয়েটা চালাক হয়েছে বটে। তার চালাকি ধরে ফেললো তৌসিফ অতি সহজে।
বিড়াল পায়ে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো পৌষ’র পানে। পৌষ বাড়িয়ে দেয়া হাতটার মাঝে নিজের হাতটা অনতিবিলম্বে দিয়ে দিলো। মুহূর্তেই ছোট খাটো হাতটার কবজি আটকা পরলো খসখসা বড় পাঞ্জার মাঝে। অল্প টান লাগতেই পৌষ উঠে দাঁড়ালো। তৌসিফ হাটছে, পৌষ ওর পিছু পিছু পা বাড়াচ্ছে। দরজা পর্যন্ত যেতেই পৌষ জিজ্ঞেস করলো,

— কোথায় যাচ্ছি?

— বাইরে।

— হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো জানি কিন্তু এত রাতে!

— তাতে কি? জামাই এর সাথে যাচ্ছো।

— তো?

— তো মানে?

— জামাই হলো দ্যা মোস্ট এভার রিস্ক জোন। যখন তখন এর মতলব খারাপ হয়ে যেতে পারে। ভরসা নেই।

— তাই নাকি?

— আবার জিগায়।

তৌসিফ ফিরে তাকালো একপল অতঃপর মৃদু হেসে উঠলো। পৌষ যেন মড়মড় করে ভেঙে গেলো। একদম গুড়িয়ে গেলো। তার শরীর যেন চলা বন্ধ করলো। লোকটার হাসি। হায়! পৌষ না ম’রেই যায় এই হাসি দেখে। এক পুরুষের প্রেমে রোজ নিয়ম করে তিন বেলা হাবুডুবু খায় পৌষ। আজও বাদ গেলো না।

ভাবনায় ডুবে থাকা পৌষ কখন যে নিচে পৌঁছালো তা যেন খেয়াল ই করে নি। বাড়ীর সামনে থাকা ঘাট পাড়ে ওদের বর্তমান অবস্থান। পৌষ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো যখন তৌসিফের শাহাদাত আঙুল তাক করা স্থানে তাকালো।

এই ঘাটটা টাইলস করা। একদম ই নিজস্ব তবে পুরাতন কিন্তু এখন দেখলেই মনে হয় হয়তো সৌন্দর্যের জন্য করা কিন্তু পৌষ শুনেছিলো এটা তৌসিফে’র বাপ-দাদার আমলে করা ঘাট। বহু ঘটনা এই ঘাট ঘিরে। এই ঘাট পাড়ে আসার দরুন তৌসিফ ও কতটাই না বাজে ব্যবহার করলো ওর সাথে। ঘাটের সিঁড়ি গুলোর সাইডে মরিচা বাতি জ্বালানো। বেশ দেখাচ্ছে এটা। সাউডের ফাউন্টেনও কদাচিৎ ছাড়তে দেখেছে পৌষ আজ তাও দেখলো। ঠিক পাড়ে একটা নৌকা রাখা।
এতদিন কচুরি দিয়ে ভরে থাকলেও আজ কচুরিপানা নেই। তৌসিফ পরিষ্কার করিয়েছে। হাত ধরে ধরে পৌষ’কে সিঁড়ি দিয়ে নামালো তৌসিফ। নিজের হাত দিয়ে ওকে শক্ত করে ধরে বললো,

— সোজা নৌকায় পা রাখো। মাথার দিকে পা রেখো না নৌকা তাহলে সরে যাবে।

পৌষ’র হাসি পেলো। ওকে কি না শিখায় কিভাবে নৌকায় উঠতে হয়? পা ঝট করে নৌকায় উঠে উল্টো হাত বাড়ালো তৌসিফে’র জন্য। তৌসিফ হেসে ফেললো তবে হাতটাও ধরলো। বৈঠা হাতে তুলে নৌকাটা আনলো অন্য কিনারায়। বড় কড়ই গাছটার সাথে নৌকা বেঁধে তৌসিফ আবার নৌকায় উঠলো। পৌষ তখন জামাই ভুলে সুন্দর প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত। তৌসিফ এগিয়ে এসে পাশ ঘেঁষে বসলো। ঠান্ডা এক বাতাস বইছে তখন। নৌকাটা এদিক ওদিক হেলেদুলে যাওয়াতে পানিতে অল্প অল্প শব্দ হচ্ছে। পৌষ উচ্ছাস প্রকাশ করলো,

— এসব…. এসব অন্নেক সুন্দর। আমি কখনো ভাবি নি এভাবে দেখব। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

তৌসিফ পৌষ’র দিকেই ফিরে ছিলো। পেছন দিক থেকে পৌষ’র পিঠ ঠেকলো তৌসিফে’র বুকে। শক্ত বুকটার উষ্ণতা টের পেয়ে লোভী মনটা আন্দোলিত হলো। মাথা এলিয়ে দিয়ে শরীর ছেড়ে দিলো পৌষ। দুই হাতে তাকে আগলে নিলো তৌসিফ। পা মেলে দিয়ে নিজের জায়গা মজবুদ করলো পৌষ।
চোখ উল্টে তৌসিফ’কে দেখে নিলো একপল অতঃপর ক্ষীণ শব্দ করে জিজ্ঞেস করে,

— কথা বলুন।

— কি বলব?

— কিছু একটা।

— তোতাপাখির বুলির কাছে হারা মানা এক প্রেমিক পুরুষ আমি। শুনতেই ভালো লাগছে। কথা থামিও না পৌষরাত। বলে যাও। আজ শুনি।

পৌষ’র চোখ দুটো ভরে উঠলো। এত মায়া মায়া কেন লোকটা? কেন তার পৌষ’কে এতটা প্রাধান্য দিতে হবে? আজ পর্যন্ত কেউ তো দেয় নি। কেউ ওকে কোনদিন পরামর্শ করতে ডাকে নি অথচ এই মানুষটা এত পরিপাটি হওয়া সত্ত্বেও পৌষ’কে জিজ্ঞেস করে হাত ঘড়িটা সহ পরবে। এত ভালোবাসার যোগ্য তো পৌষ?

পৌষ ঝট করে উঠলো। ঝাপিয়ে পরলো তৌসিফে’র বুকে। কেঁদে ফেললো মেয়েটা। তৌসিফ ওর মাথায় হাত রাখলো। ভরসার জায়গা সরুপ সে আছে তা বুঝালো। পৌষ আরেকটু শক্ত করে বুকে ঠাই নিলো। নৌকাটা কাত হলো একটু। পৌষ নাক টেনে টেনে বললো,

— এত কেন ভালোবাসেন?

— তাহলে কি কম বাসব?

— মে’রে না ফেলব?

— আর কত? ম’রেই তো আছি। তোমার মাঝে।

চাঁদের প্রতিবিম্ব তখন স্পষ্ট পানির মাঝে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে আবারও উপহাস করে তৌসিফ। চাঁদ নিজেই লজ্জা পেলো যেন এবার। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে নিলো নিজ অস্তিত্ব।

এহেন গহীন মুহূর্তে তৌসিফ গলায় এক ঢল প্রেম নিয়ে ডাকলো,

— পৌষরাত।

— হুউ।

ছোট একটা ঢোক গিললো তৌসিফ। এই প্রথম সে চাইবে কিছু। সঙ্কোচই লাগছে যেন। তৌসিফ দেনামোনা না করে সরস গলায় আবেদন করলো,

— আমাদের মাঝে একটুকরো চাঁদ এলে কি খুব খারাপ হয়ে যাবে পৌষরাত?

অবুঝ পৌষ জিজ্ঞেস করলো,

— মানে?

— আমি নিজের পরিবার বড় করতে চাই পৌষরাত। এই যেমন তুমি, আমি আর আমাদের অস্তিত্ব।

পৌষ পাথর বনে গেলো। চোখ তুলে এক পলক তাকিয়ে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। দু’জন ই চুপচাপ। রা নেই কারো মুখে। মাঝেমধ্যে শুধু ভারী নিশ্বাস শুনা গেলো। হয়তো মান্যতার অথবা অমান্যতার।

#চলবে….

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৩

অতি সাধারণ এক শয্যায় বসা সোহা। ওর কাছে মনে হচ্ছে দুনিয়াটা হয়তো বড্ড কঠিন হয়ে গেলো। এই রুমে এসি নেই। মাথার উপর জিএফসির একটা ফ্যান ঘুরছে। ঘুরছে বললেও ভুল হবে। এই ফ্যান শুধু পাখা গুলো গোল গোল ঘুরাচ্ছে। বাতাস আসছে না বললেই চলে। বাইরে খুবই অল্পস্বল্প কথার শব্দ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ বিয়েতে মানুষ থাকবে না এটাই তো স্বাভাবিক। সোহা অবশ্য বোকা বনে এখনও বসে আছে। মেহেদী নামক পুরুষকে এখনও চিনে না সে। মিনু’র জন্য মনটা খারাপ হচ্ছে। রাগ হচ্ছে তৌসিফে’র উপর। এ এক এলোমেলো অনুভূতি যার কোন কিণারা নেই। সাতার না জানা সোহা যেন মাঝ সমুদ্রে এসে পরলো। পরলো না তাকে ফেলা হলো। তৌসিফ তালুকদার ফেললো তাকে শুধু মাত্র তার স্বার্থে আঘাত লেগেছে বলে। সোহা জানে চাইলেই ভালো ঘরে ওকে তৌসিফ বিয়ে দিতে পারতো কিন্তু সে সেটা করে নি। সে ইচ্ছে করে কোন এক ফকিরের গলায় ঝুলালো তাকে। যেই ফকির মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা কাবিন করেছে। তাও কি না আরো কম করতে চেয়েছিলো।

কারো পায়ের শব্দ কানে আসতেই সোহা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সাদা একটা টিশার্ট আর কালো টাউজার পরা মেহেদী ঢুকলো রুমে। বেশ চিন্তিত তার মুখখানা। এসেই ভদ্র ভাবে সালাম জানালো সোহা’কে। উত্তর সোহা দিলো না বা দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। মেহেদী সংকোচ বোধ করলো তবুও জিজ্ঞেস করলো,

— আপনি খেয়েছেন সোহা? খাবার নিয়ে আসি?

সোহা উত্তর করলো না। হতাশ মেহেদী বেরিয়ে গেলো। ফিরে এলো মিনিট দশ পর। হাতে একটা প্লেট। ডিম ভাজার ঘ্রাণ আসছে। সোহারও ক্ষুধা লেগেছে কিন্তু খাবে না ও। মেহেদী’কে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে নিজেই ডিমটা ভেজে এনেছে। সোহা’র একদম সামনে প্লেট রেখে মেহেদী বললো,

— খেয়ে নিন সোহা। আপনার ক্ষুধা লেগেছে আমি জানি। সারাদিন খান নি।

এতক্ষণে মুখ খুললো সোহা,

— গরম লাগছে আমার মেহেদী। আপনাদের বাসায় এসি নেই।

মেহেদী যেন লজ্জা পেলো। তারাতাড়ি উঠে আগে ফ্যানের পাওয়ার বাড়ালো অতঃপর সোহা’কে দেখে নিয়ে বললো,

— আগে ফ্রেশ হলে ভালো লাগতো আপনার।

— আপনাদের ওয়াশরুম তো দেখছি না।

মেহেদী সঙ্কোচ বোধ করলো। বললো,

— আসলে ওয়াশরুম দুটো। মা-বাবা বৃদ্ধ মানুষ তাদের রুমে একটা, আরেকটা কমন ওয়াশরুম। ওটাই আমি ব্যবহার করি।

সোহা যেন আকাশ থেকে ছিঁটকে পৃথিবীর বুকে পরলো। কমন ওয়াশরুম! সেটা কি না তার ব্যবহার করতে হবে? রাগে মুখটা যেন লাল হয়ে এলো ওর। ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,

— বউ যদি ঠিকঠাক পালতেই না পারেন তাহলে বিয়ে কেন করলেন?

মেহেদী অবাক চোখে তাকালো। এত সুন্দর মেয়ে অথচ কণ্ঠ কতটা তীক্ষ্ণ। মেহেদী বেশ স্বাভাবিক গলায় বললো,

— ভাই তো জানতেন সোহা। আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন?

সোহা দমে গেলো। সামনের জনের দোষ নেই কোন তা তার জানা। মানুষটার দিকে তাকিয়ে বেশি উচ্চবাক্যও করা সম্ভব হচ্ছে না তার। কোনমতে সোহা বললো,

— ড্রেস চেঞ্জ করব।

— ইয়াহ শিওর।

বলে মেহেদী উঠে দাঁড়ালো। নিজেই সোহার এক সেট ড্রেস বের করে দিলো। সোহা’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— চলুন আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

মেহেদী’র পিছু পিছু পা বাড়ালো সোহা। অনাকাঙ্ক্ষিত এক জীবনে জড়িয়ে গেলো ও মেহেদী’র সাথে। ছোটখাটো এক ওয়াশরুম। হাই কমোডও নেই। অসহায় সোহা কোনমতে শরীরে পানি ঢেলে গোসল সারলো। চোখ দিয়ে পানি গড়ালো তার। এর কারণ অবশ্য তার জানা নেই। কুর্তি সেটটা পরে বের হতেই দেখলো দরজায় মেহেদী দাঁড়িয়ে। অবাক হলো সোহা। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার ছিলো না। সোহা’কে রুমে খেতে দিয়ে বাইরে দিয়ে দরজা আটকে মেহেদী বেরুলো। ফিরে এলো আধ ঘন্টা পর। হাতে এক বালতি। টাউজারটা হাটু পর্যন্ত গুটানো। টিশার্ট ভিজেছে কিছুটা। সোহা’কে অবাক করে দিয়ে বারান্দায় সোহা’র কাপড়গুলো মেলে দিলো মেহেদী।
সোহা হা করে তাকিয়ে রইলো। কাপড় তো সারাজীবন এভাবেই ফেলে আসে। বুয়া আছে তারা ধুঁয়ে দেয় তবে আজ কি হলো? মেহেদীদের কি বুয়া নেই? মেহেদী কেন সব ধুঁয়ে দিলো? শত হলেও সোহা একজন মেয়ে তার লজ্জা লাগলো। জানলে হয়তো নিজেই ধুঁয়ে দিতো তবুও অন্তত বাসর রাতে স্বামী’কে দিয়ে এসব করাতো না। অহংকারী সোহা হঠাৎ ই যেন নরম হলো। মেহেদী হাসি মুখে এগিয়ে এলো। ওয়ারড্রব থেকে একটা টিশার্ট বের করে পরণেরটা খুলে ওটা পরে নিলো। ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো সোহা। কি যেন হলো ওর। নিজেই খাটে রাখা সাদা ভেজা টিশার্টটা বারান্দায় মেলে দিয়ে এলো।
আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো মেহেদী। এত বড় লোক বাড়ীর মেয়ে তার টিশার্ট মেলে দিয়ে এলো?

সোহা ফিরতেই মেহেদী নরম স্বরে বললো,

— বসো।

সোহা পা তুলে বিছানায় বসতেই মেহেদী ওর সম্মুখে বসলো। বেশ সরল গলায় বললো,

— আমি খুব ছোট এবং স্বাভাবিক একজন মানুষ সোহা। জানোই তো শিক্ষকতা করি। স্যালারি হাই না আবার লো ও না। মা-বাবা আর আমি এই তো সংসার। তাদের খরচপাতি আর বাকিটা সংসারে দিয়ে সুন্দর চলে যায় আমার। আমরা এক কথায় নিম্ন মধ্যবিত্ত অথবা উচ্চমধ্যবিত্ত। মাঝেমধ্যে সংসারে টান পরে যখন বাড়তি খরচটা বেশি হয়। এই যে দেখো মাসের শেষ দিকে বিয়ে করলাম। বিরাট এক খরচ গেলো। কিছু না করতেও এই পর্যন্ত লাখ টাকার কাছাকাছি ভাঙা হলো।

সোহা অবাক। কি চাপা মারছে? লাখ টাকা কোথায় খরচ করলো? সোহা’কে অবাক করে দিয়ে মেহেদী পঞ্চাশ হাজার টাকা ওর হাতে দিয়ে বললো,

— তোমার মোহরানা এটা। শোধ করে দিলাম। এই যে আমাকে দেখছো, আমার কাছে আর মাত্র পাঁচশত টাকা আছে। ঝাঁকি দিলেও আর পরবে না। এটা দিয়ে আগামী চারদিন চলতে হবে। স্যালারি পেতে চারদিন বাকি আছে।

সোহা অবাক হলো। মেহেদীর দিকে তাকিয়ে হঠাৎই বলে উঠলো,

— টাকাটা লাগবে না।

— গরীব হতে পারি তাই বলে কি বউয়ের হক মা’রব?

— লাগবে না আমার।

— আমারও লাগবে না।

— এই না বললেন টাকা নেই?

— আছে তো টাকা। পাঁচশত টাকা আছে।

— ওটা টাকা?

মেহেদী হাসলো। বললো,

— এই পাঁচশত টাকা তোমার স্বামী কোন এককালে টানা মাসের পর মাস সকালে নাস্তা না খেয়ে জমাতো।

সোহা’র আচমকা খেয়াল হলো ওর শিকর কোথায়? মেহেদী’র থেকেও নীচু তার পরিবার। সোহা কতকাল না খেয়ে থেকেছে সকালে কই তাকে তো কেউ পাঁচশত টাকা দিতো না। মায়ের কাছে কত ভাত চাইতো। মাও দিতো না। বাবা তো ফিরেও তাকাতো না। কত ছলেবলেই না মা তৌসিফে’র বাবা’র গলায় ঝুলিয়ে দিলো ওকে। অল্প পানির মাছের মতো সোহাও বেশি পানতে এসে লাফাতে লাগলো। তৌসিফে’র সম্পত্তি ভোগ করতে লাগলো।
আচমকাই সোহা’র হাতে স্পর্শ হওয়াতে ওর ধ্যান ভাঙলো। মেহেদী তাকিয়ে ওর পানে। সোহা তাকালো ওর চোখের দিকে। চোখের যে ব্যাখা করার ক্ষমতা তা বোধহয় মুখের নেই। মেহেদী’র চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
সর্বদা লোভে মুড়ে থাকা সোহা আজ যেন নিজের খোলস ত্যাগ করলো। হঠাৎই ওর মন চাইলো শুধু মাত্র কারো বউ হতে। এই যে সম্মুখে বসা মেহেদী যাকে সোহা ঠিকঠাক ভাবে চিনেও না তাকে হঠাৎ করেই আপন মনে হলো। মেহেদী’র ধরা হাতটার উপর নিজের হাত রাখলো সোহা। চোখের দিকে গাঢ় চাহনি দিলো। বিপরীতে মেহেদী হাসলো। আশ্চর্য! এই ছেলে এভাবে কেন হাসে? তার হাসি দেখে হঠাৎ করেই সোহা’র মনে হলো তার জীবনে হয়তো কোন পূর্ণ্য ছিলো তাই এই হাসি দেখার তৌফিক হলো তার।

______________________

রাত পেরিয়ে সকাল হওয়ার ভাবখানা। আকাশের বুক চিরে সূর্য উঁকি দিবে দিবে। চারদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দিনে ঠান্ডা নেই অথচ ভোরের দিকে প্রকৃতি এমন ভাব দেখায় যেন ডিসেম্বরের শীত এসেছে। ঘোলা ঘোলা পরিবেশে পাখির দল কিচিরমিচির করে যাচ্ছে একটানা।
তালুকদার বাড়ী এখন নীরবতায় ঘেরা।
তৌসিফে’র বুকে গুটিশুটি দিয়ে ঘুমাচ্ছে পৌষ। রাতে আড়াইটার দিকে আজ ক্ষুধা লেগেছিলো ওর। খেলো একটু অতঃপর হঠাৎ পেট ব্যথায় কুঁকড়ে শুয়ে পরলো। তৌসিফ এত উঠাতে চাইলো লাভ হলো না। মেয়েটা কথা শুনলোই না। অগত্যা তৌসিফ ওকে বুকে নিয়ে ঘুমালো। মান্থলি ডেটও তো না তাহলে কেন পেট ব্যথা হলো তৌসিফ বুঝলো না। ডক্টর দেখাতে হবে এটা ভেবেই চোখ বুজেছিলো।

সূর্যটা যখন উদয় হলো তখন সকাল আটটা বাইশ। আজ একটু দেড়ী করেই উঠেছে সে। আলসেমি ঝাড়তে ঝাড়তে দুপুর হতেই খা খা রোদ উঠে যাবে। এটাই হচ্ছে এখন। তৌসিফে’র ঘুম হালকা হলো। চোখ খুলে আগে বুকে থাকা বউ’কে চুমু দিলো। সে এখনও ঘুমে কাঁদা। ওকে বিছানায় রেখেই নিজে উঠে গেলো। ফ্রেশ হয়ে একেবারে জিম সুট পরে আরেকবার পৌষ’কে দেখে নিলো। কাঁথার নিচে পৌষ’র পেটে হাত দিয়ে একটু হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে এসিটা অফ করে ফ্যান ছেড়ে রাখলো শুধু। ঠান্ডায় একদম গুটিয়ে আছে। নিজের প্রোটিন শেইক নিয়ে দরজা আটকে তৌসিফ বেরিয়ে গেলো।

তৌসিফ বাড়ী ফিরলো ঠিক দুই ঘন্টা পর। ভেবেছিলো বউকে ঘুমন্তই পাবে কিন্তু তা হয় নি। পৌষ রান্না ঘরে নাস্তা বানাচ্ছে। একপাশে মিনু দাঁড়িয়ে। তার মনটা খারাপ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তৌসিফ সোজা রুমে ঢুকে গোসল সেরে আসলো। রান্নাঘরে ঢুকে হঠাৎ পেছন থেকে পৌষ’কে জড়িয়ে ধরা মাত্রই পৌষ একদিকে যেমন চমকালো ঠিক তেমন ভাবেই চমকালো উপস্থিত বুয়ারা৷ মুখ চেপে তারা বেরিয়ে গেলো এদিকে পৌষ খেঁকিয়ে উঠলো,

— জানটা গলায় চলে এসেছিলো। লজ্জা লাগলো না আপনার? ছাড়ুন।

তৌসিফ নিজের ভেজা গুলো ঝেড়ে দিলো পৌষ’র মুখে। লহু স্বরে বললো,

— গুড মর্নিং হানি।

— আপনার হানি রুটি দিয়ে খান আপনি। কেমন লাগে? তারা সবাই হাসছিলো।

— হাসুক।

— লজ্জা লাগে তো।

— লাগুক।

— উমম। খাবেন। চলুন।

পৌষ’কে অবাক করে দিয়ে এই প্রথম তৌসিফ হাতে হাতে পৌষ’কে সাহায্য করলো। টেবিলে খেতে বসেই মিনু’কে ডাকলো পৌষ। ওদের সাথেই বসালো। মিনু মাথা নিচু করে খেতে খেতেই ডাকলো,

— মামা?

তৌসিফ তাকাতেই মিনু বললো,

— আমি কি আপার কাছে যাব না?

তৌসিফ খাওয়ায় মন দিলো। বললো,

— পরে দেখা যাবে।

পৌষ বুঝলো না তৌসিফ কি ভাবছে বা কি চাইছে। খেতে খেতে শুধু বললো,

— আজ আমাকে কি আপনি ড্রপ করবেন?

— না৷ আজ কাজ আছে। আর তুমি আজ বাসায় থাকো। তোমায় নিয়ে বেরুব আমি।

#চলবে……