#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫৬
অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া শীতল সাথে বইছে হাওয়া। সেই হাওয়া বড়ই ঠান্ডা। গায়ে কাঁটা দেয়ার মতো ঠান্ডা। সূর্য এখানে সচরাচর দেখা দেয় না। সিডনি শহরটা তখন সূর্যের অনুপস্থিতিতে বড়ই ফ্যাকাসে অথচ তার রুপ বড়ই চমৎকার। মানুষ জন সকাল হতেই বাইরে বিচরণ করছে। সূর্য কৃপণতা দেখিয়ে ঠমক ধরেই আড়ালে রইলো।
আলসতা দেখিয়ে উঠে বসে পৌষ। গায়ে ব্যথা নিয়ে আড়মোড়া ভাঙে ও। যদিও তার সয়ে সয়ে গিয়েছে এখন তবুও মাঝেমধ্যেই মাথা চারা দিয়ে উঠে। চোখ ডলতে ডলতে ওর খেয়াল হলো এটা কিছু মাস পূর্ব পৌষ যেই জামাই বাড়ী পেয়েছে সেটা না। এটা অপরিচিত এটা জায়গা। টনক নড়লো ওর। এক ধ্যানে কিছুক্ষণ রুমটার সিলিং দেখে পৌষ। হঠাৎ ই মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়। হাঁটু ভাজ করে মাথা ঠেকায় পৌষ। এই সব কিছুই তার নিকট স্বপ্ন। অল্পসল্প পেটে ব্যথা হতেই পৌষ পেট চেপে ধরে। মুখে ব্যাথাকাতুর শব্দ উচ্চারণ করে পুণরায় বালিশে মাথা রাখে। শ্বাস-প্রশ্বাস আচমকাই বেগতিক হয়। পৌষ আশেপাশে তৌসিফ’কে খুঁজে। না নেই সে। একবার অল্প স্বরে ডাকও দিলো,
— আপনি এখানে আছেন? শুনছেন…
উত্তর আসে না মানে তৌসিফ এখানে নেই। পৌষ চোখ বুজে নিলো। কার্ণিশ উপচে কয়েক ফোঁটা মুক্তোর দানা ঝড়লো তখন। তৌসিফ থাকলে নিশ্চিত এখানে কান্ড ঘটিয়ে ফেলতো। বউ নিয়ে বড়ই চিন্তিত থাকে।
সময় গড়ালো মিনিট পাঁচ সাথে কুড়ি সেকেন্ড। সফেদ দেয়ালে সোনালী রঙের ঘড়িটায় তখন টুং করে শব্দ হয়। সচকিত দৃষ্টি ফেলে সেদিকে দৃষ্টিপাত করে পৌষ। পুণরায় উঠে বসে। আস্তেধীরে হেটে যায় বাথরুমের দিকে। এদিকে একটা বিষয় অবশ্য নিন্দনীয় লাগে পৌষ’র কাছে। সাওয়ার নেয়ার জায়গাটাতে স্বচ্ছ কাচ। ভেতর বাহির সবটা দেখা যায়। এমন কুরুচিপূর্ণ ডেকোর ওর ভালো লাগে না। এদিকে তৌসিফ স্পেশাল ভাবে এই হানিমুন সুইট বুক করেছে। এসেছে থেকে একের পর এক চমক। বাথরুমের বাথ টাবে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সবটা সাজানো ছিলো সাথে ছিলো অজস্র ছোট ছোট রং-বেরঙের মোমবাতি। কিছু আলোকসজ্জা আবার রুমে জুড়ে চারপাশে।
পৌষ অনেক চেঁচামেচি করে পর্দা লাগিয়েছে। তৌসিফ অবশ্য এতে নারাজ ছিলো।
কাঁচের দরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই পৌষ সাড়া দেয়,
— আছি আমি।
— কি করছো?
— ব্রাশ করছি।
— খুলো তাহলে।
— অপেক্ষা করুন।
ব্রাশ হাতে থাইটা খুলে পৌষ। তৌসিফ ঘর্মাক্ত শরীরে বড়ই উদ্বীগ্ন হয়ে চায়। চিন্তার ছাপ কণ্ঠে ফেলে শুধায়,
— ঠিক আছো? আমি বাইরে একটু জিমে গিয়েছিলাম। ভাবলাম তুমি ঘুমাচ্ছো।
পৌষ কুলি করতে করতে বলে,
— এখানেও জিম করা লাগে? আলগা ঢং।
বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলতেই তৌসিফ ওর দিকে এগিয়ে আসে। বেসিনের সামনে এসে গরম পানির ট্যাব চালু করে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বলে,
— হোটেলেই ছিলো তো।
–ফ্রী?
— হ্যাঁ।
পৌষ ফটাফট বলে উঠলো,
— হায় হায়, আগে বলবেন না? রোজ দুই বেলা করে যাবেন৷ মাগনা নাকি? অ্যাই শুনুন আমিও যাব।
তৌসিফ বক্র হাসে। মুখে ক্লিনজার লাগাতে লাগাতে বলে,
— আমাকেই সামাল দিতে ত্যাড়া ব্যাকা হয়ে যাও সেখানে যাবে নাকি জিম?
সরাসরি ঠেস। পৌষ’র রাগ হলো। দাঁত চেপে বললো,
— আপনি একটা বুইড়া খাটাস।
তৌসিফ কপালে মৃদু ভাজ ফেলে ডান হাত দিয়ে পৌষ’র চোয়ালে চাপ দেয়। ফলাফল সরুপ চেপে রাখা দাঁতের পাটি আলগা হয়। তৌসিফ ছেড়ে দেয়ার আগে তাতে আলতো চুমু দিয়ে বলে,
— দাঁত চাপতে নেই।
— কথা বলবেন না?
— আপাতত বলছি না। জলদি গিয়ে গায়ে ভারী কিছু দাও৷
— পারব না।
— হানি, ইটস ঠু কোল্ড।
— হোক।
— কথা শুনবে না?
— আমাকে যে ছোট করে কথা বলে তার কথা আমি শুনব না। খারাপ লোক।
বিরবির করে বলতে বলতে পৌষ চলে গেল। তৌসিফ অবশ্য শুনলো তবে ঘাটলো না। ছোট্ট ব্যাপারটা যে পৌষ’র মাইন্ডে লাগবে তা বুঝতে পারে নি তৌসিফ।
রুমে এসে দেখা গেলো পৌষ বিছানা গোছাচ্ছে। তৌসিফ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি ঠেকাতেই পৌষ’র নাক টানার শব্দ এলো। তৌসিফ পুরোপুরি ভাবে থতমত খেলো। কথাটা কি খুবই বলেছে সে? তেমন কিছু মিন করে তো বলে নি তাহলে পৌষ কেন এতটা কষ্ট পেলো। ব্যস্ত হাতে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তৌসিফ গালে হাত রাখে। অধিকার বোধ নিয়ে বলে,
— তাকাও।
পৌষ’র নজর ফ্লোরে। কাঠের ফিনিশিং দেয়া তাতে। পৌষ ভাবছে কতই না দামী হবে এই কাঠ নাহলে কেন গুনে খাচ্ছে না। হঠাৎ ই আবার মনে হয় ছোট্ট বেলায় একবার দশটা দশ টাকা দামের মুরগীর বাচ্চা কিনেছিলো পৌষ। চাচাকে অনেক বলে কয়ে কিনতে হলো। তো একদিন ওদের খাবার শেষ হয়ে গেলো। চাচা বাড়ীতে নেই। চাচির কাছে চাইতেই চাচি বললো চাল দিতে। পৌষ তাই দিলো। আফসোস অত ছোট বাচ্চা চাল খেতে পারে না। পৌষ তখন ঝাড়ু দিয়ে কয়টা মাছি মে’রে খাওয়ালো। হেমন্ত তখন স্কুল থেকে ফিরেছে। পৌষ দৌড়ে যেয়ে বলতেই হেমন্ত দেখে তার পকেট শূন্য। বন্ধুদের সাথে লুকিয়ে বেনসন সিগারেট খেয়ে উল্টো দোকানে দুই টাকা পরে দিবে বলে একটা সেন্টার ফ্রুট চিবুতে চিবুতে বাড়ী ফিরলো।
পৌষ আবার তার খুবই আদরের। হেমন্তের কাঁধের ব্যাগটা পৌষ’কে দিয়ে বললো,
— ভেতরে রেখে আয়।
এক দৌড়ে পৌষ তাই করে। হেমন্ত তখন পঁচা একটা কাঠের টুকরো বের করে। গ্যাসের ভয়ংকর সমস্যা। বড় চাচি প্রায়ই লাকড়ি সংগ্রহ রাখেন। হেমন্ত কাঠটা টুকরো করা মাত্রই ছোট ছোট কাঠের রঙের পোকা বেরিয়ে আসে। মুরগীর বাচ্চাগুলো ঠুকরে ঠুকরে খায়। পৌষ উচ্ছাসিত হয়ে আগামী দুই দিন তার মুরগীর বাচ্চাদের ঐ পোঁকা খাওয়ালো সাথে যতটুকু পারা যায় মাছি।
তৌসিফ বেখেয়াল পৌষ’কে দেখে নিজেই মুখটা তুলে। বলে,
— কি ভাবছো?
— মুরগীর বাচ্চা।
— মুরগীর বাচ্চা? চিকেন খাবে আমার তোতাপাখি?
— ধুরু মিয়া। আপনার আলগা পিরিত রাখুন। আচ্ছা, বলুন কখনো মুরগী পেলেছেন? দশ টাকা দামের? ঐ যে বাসায় এসে বিক্রি করতো।
তৌসিফ জানপ্রাণ অবাক হয়। ও কি না মুরগীর বাচ্চা পালবে? তাও আবার দশ টাকা! আশ্চর্য! যদিও এত মাসে তৌসিফ বউয়ের পা’গলামিতে অভ্যস্ত। মুখটায় পানির ঝাপ্টা দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,
— কুকুর পেলেছিলাম।
— কুত্তা পালা ভালো না জানেন না?
— উপফ পৌষরাত। কুকুর বলা যায় না?
— না ফিলিং পাই না। কুত্তা বললে মনে শান্তি লাগে। এখন ধরুন কাউকে আমি গালি দিব তখন যদি বলি, “এই শোনো তুমি একটা কুকুর” তখন কি মনের ভাব প্রকাশ হতো? একটুও হতো না। কিন্তু যদি বলি “শা’লা তুই একটা কুত্তা” তাহলে মনের খায়েশ মিটে যাবে।
তৌসিফে’র মাথা ঘুরতে চায় কিন্তু তৌসিফ সামলে নেয় নিজেকে। পৌষ’কে পাজা তুলে হঠাৎ। পৌষ গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ করে। কাঁধে মাথা রেখে বলে,
— এভাবে বাইরে যাবেন?
— আমার তো সমস্যা নেই।
— তাহলে চলুন।
— এই ড্রেসেই যাবে?
পৌষ একটু ফেঁসে গেলো৷ মুখটা গোমড়া হয়ে গেলো সহসা। বললো,
— না নেয়ার ধান্দা। নামান আমাকে।
— একটা ট্যুর তো দেয়াই যায়।
দরজা খুলে বিশাল বড় করিডোরে চলে এলো তৌসিফ। পৌষ অবাক হয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে নিলো। চাপা স্বরে বললো,
— কই যান?
— জানি না তো।
— আজব কি করছেন? আমি তো ফাইজলামি করছিলাম…..
“গুড মনিং স্যার”
আচমকা শক্ত হাতে তৌসিফে’র পিঠ আঁকড়ে ধরে কাঁধে মুখ গুজে পৌষ। সাদা ধবধবে বিড়ালের মতো লোকটা’কে তার ম্যানেজার মনে হলো। লজ্জায় মরি মরি পৌষ। তৌসিফ মুচকি হাসলো। পৌষ আকুতি করে উঠলো,
— প্লিজ ফিরে চলুন। আর দুষ্টামি করব না।
— দুষ্টামি না করলে যাব না।
— আচ্ছা, দুষ্টামি করব।
— এখন করো।
— ভাই, দয়া করে ফিরে চলুন। আমার সত্যিই লজ্জা লাগছে।
তৌসিফে’র কাঁধেই মুখটা গুজে রইলো। আচমকা কাঁধে দাঁত বসতেই তৌসিফ হেসে ফেললো। ফিচেল স্বরে বললো,
— এই দুষ্টামি আমিই করতে পারি।
__________________
হিজাবের উপর দিয়ে পৌষ’কে টুপি পরালো তৌসিফ। পৌষ খুলতে চাইলো৷ বললো,
— কান ঢাকা তো।
— বাইরে অনেক ঠান্ডা হানি।
পৌষ’কে লং জ্যাকেট পরিয়ে পরিপাটি হয়ে নিজেকে গুছালো তৌসিফ। গালে হাত দিয়ে তা দেখে পৌষ। পা ঝুলাতে ঝুলাতে গুনগুনিয়ে গান গায়। তৌসিফ আড় চোখে বউকে দেখে। শরীর কিছুটা দূর্বল হলেও এই মেয়ে তা বুঝতে দেয় না। তৌসিফ টুপি পরে পৌষ’র দিকে হাত বাড়ালো। দু’জন হাতের ভাজে হাত নিয়ে বেরিয়ে এলো বিশাল বড় হোটেল থেকে।
গাড়িতে উঠতে নিতেই পৌষ বাগড়া দিলো,
— হাটি? কত সুন্দর রাস্তা।
— হাটব। আপাতত এক জায়গায় যাচ্ছি।
পৌষ মাথা নাড়ে। বাইরে ফুরফুরে বাতাস। স্নোরী মাউন্টেনে ওদের পৌঁছাতে ভালোই সময় লাগলো। তৌসিফ জানালা আটকে রাখলো। পৌষ খুলতে চাইলেই বললো,
— অনেক ঠান্ডা। অসুস্থ হয়ে যাবে।
— গাড়িতেই যদি থাকি তাহলে কেন এলাম?
— দেখাচ্ছি কেন এলে।
পর্বতে পৌছাতেই পৌষ অবাক হয়ে গেলো৷ তৌসিফ ওর হাত মুজা পরিয়ে দিতে দিতে বললো,
— কেমন?
অবাক পৌষ তখন স্নো দেখছে। পুরোটা চূড়া বরফে আচ্ছাদিত। কিছু মানুষ আছে যারা বিভিন্ন খেলাধুলায় মত্ত যার পুরোটা বরফ ভিত্তিক। পৌষ অবাক হয়ে বললো,
— আমি এমন কিছু কখনো স্বপ্নেও দেখি নি।
— বাস্তবে দেখো তাহলে।
— শুনছেন?
— হুঁ।
— আমি কিন্তু অনেক অবাক।
— আমি অনেক খুশি।
হঠাৎ একটা বরফের খন্ড উঁড়ে আসে। পৌষ চমকায়। তৌসিফ কপাল কুঁচকে তাকাতেই ছোট্ট একটা বাচ্চা দৌড়ে এসে বললো,
— স্যরি ম্যাম। আই ডিডেন্ট শিই।
পৌষ চমৎকার হেসে ছেলেটার বাদামি চুল নেড়ে বললো,
— ক্যান আই প্লে উইথ ইউ?
বাচ্চাটা খুশি হয়ে হাতে থাকা গোল বরফ ছুঁড়ে মা’রে। পৌষ নিজেও তুলে মা’রে। সাথে আরো কিছু বাচ্চা যোগ দিলো। তৌসিফ বুকে হাত গুজে তাকিয়ে আছে। তার এক জীবনের প্রেম নিহিত এখানে। এই পৌষ’র মাঝে। হঠাৎ ওর শরীরেও একটা এলো। পৌষ খিলখিল করে হাসছে। আরেকটা মে-রে বললো,
— আসুন না।
তৌসিফ ঠোঁট কামড়ে নিজেও সামিল হলো৷ তৌসিফ ইচ্ছে মতো যতটা পারলো বরফ একত্রিত করে ছুঁড়তে লাগলো। এত বড় মানুষটা বাচ্চা হয়ে গেলো যেন। পৌষ বরফের মাঝেই মুখ থুবড়ে একবার পরলো। তৌসিফ টেনে তুলতেই দেখলো নাক, মুখ লাল হয়ে আছে ওর ঠান্ডায়। পৌষ হাসিমুখে বললো,
— স্কি করব।
— কাম।
দু’জন একসাথে হাত ধরে করতে গিয়ে পরে গেলো। পৌষ দাঁড়াতে পারে না। তৌসিফ এবার ওকেও নিজের কাছে নিলো। পৌষ’র টকটকে ঠোঁট জোড়া ওকে আকর্ষণ করলো। মুখ দিয়ে তখন দু’জনে আভ বের হচ্ছে।
আচমকা ঠোঁটে ঠোঁট মিলায় তৌসিফ। পৌষ ওকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে। স্কি’র বোর্ডে পা রাখে তৌসিফ। একটু পথ যেতেই পরে গেলো ওরা। ছুটলো না অবশ্য কেউ। তাদের শীতলতা তখন ওষ্ঠের উষ্ণ মাদকতায় ভরপুর। বরফের মাঝে যেন বিলীন হয় তারা। পান হয় প্রেমসুধা।
দূরের ক্যাফেতে তখন পরিপূর্ণ নারীটির চোখে বাঝে তা। সে গরম কফির কাপে চুমুক বসায়। জীবন সুন্দর। শুকনো গাছের পাতাটার মতোই সুন্দর যার প্রয়োজন ফুরালেও সে দূর থেকে সুন্দর। চোখ জুড়ানো সুন্দর।
#চলবে….
#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫৭
বরফের মাঝে পৌষ’র চঞ্চলতা বাড়লো বৈ কমলো না। এখনও ল্যাটকা মে’রে বরফে বসে আছে৷ তৌসিফ গা ঝাড়ে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডাকে,
— হানি, উঠে এসো।
পৌষ হাত ধরে। আচমকা হেচকা টান মা’রতেই হুমড়ি খেয়ে পরে তৌসিফ বরফের উপর। খিলখিল করা হাসি শোনা যায় তখন৷ তৌসিফ রাগে না। একটুও না। তার ভেতরে আচমকা এক অনুভূতি হয়। প্রেমের অনুভূতি। যেন সে সদ্য এডাল্ট হওয়া এক পুরুষ। যার হয়তো প্রথম প্রেম এই নারী। ঐ যে উপন্যাসের নাইকা যেমন হাসে ঠিক ওমন হাসি। তৌসিফে’র বুকটা ঝরঝর করে ভাঙে। সদ্য প্রেমে ডুবন্ত এক প্রেমিক তৌসিফ। তার চোখ দুটো যেন খুবই পিপাসিত। সেই চোখ তার তৃষ্ণা মিটাতে অবিরাম চেয়ে থাকে। তৌসিফে’র ভেতর ছটফট করে তখন। পৌষ একমুঠ বরফ হাতে তুলে তৌসিফে’র গালে লাগিয়ে দিলো। হাসতে হাসতে বললো,
— আপনাকে বরফের দেশের বিদেশিদের মতো দেখাচ্ছে।
— তাই? আর কি দেখায় আমায়?
— উমম। আমার জামাই জামাই লাগে।
— আর?
— আর কি মামাতো ভাই লাগে।
তৌসিফ যেন বিরক্ত হলো এই উত্তরে। কপাল কুঁচকে তাকাতেই ওর লাল হওয়া গালে ঠেসে একটা চুমু দিলো পৌষ। বললো,
— আপনার গাল দুটো স্ট্রবেরির মতো লাল হয়ে আছে। মন চায় টুকুস করে গিলে নেই।
তৌসিফ হাসলো। পৌষ’কে টেনে ধরে দাঁড় করিয়ে গা ঝেড়ে দিলো। বরফের ভিতর এই মেয়ে বসে আছে কখন থেকে। মন তার ভরছেই না। তৌসিফ সন্দিহান হলো৷ ঠান্ডা না লেগে যায়। হানিমুনে এসে বউয়ের ঠান্ডা কিছুতেই তৌসিফ সহ্য করবে না৷ একদমই না।
পৌষ হাত মুচরাতে মুচরাতে বলে,
— ছাড়ুন৷ এখানে থাকি।
— একদমই না। ঠান্ডা লাগবে?
— লাগবে না৷
— লাগবে। কাম ফাস্ট হানি।
পৌষ’র গাল দুটো ফুলার সুযোগ পায় না৷ পাজা কোলে তুলে তৌসিফ। পৌষ ওর গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী হয়ে বলে,
— অ্যাই তুসু ভাই, কই যান?
— একদম হাত ছেড়ে দিব৷ ধ্রিম করে পরবে এখানে। শিক্ষা দরকার তোমার।
— আমি তো শিক্ষিত।
— জালিম বলে এটাকে। জামাই’কে ভাই ডাকে কেউ?
— আগে তো ভাই আপনি৷ পরে জামাই।
— তুমি আগে কোনরূপে পেলে?
— শয়তান, বুইড়া খাটাস মার্কা এক জামাই রুপে।
তৌসিফ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। তার কিছুই বলার নেই। সে অবশ্য স্বীকার করে বিয়ের পরপর পৌষ’কে খুব একটা ভালো ট্রিট করা হয় না। তখন কোন আবেগ বা প্রেম কিছুই ছিলো না। অথচ একরাশ ভালোবাসা ছাড়া তৌসিফে’র বুকে কিছুই নেই। রিক্ত আজ সে এই পৌষরাত ছাড়া।
হাঁটতে হাঁটতে এক কটেজে ঢুকে তৌসিফ। বাইরে মানুষ জন বসা। তৌসিফ যদিও বললো রুমে গিয়ে কফি খাবে কিন্তু পৌষ মানে না৷ ও এখানেই খাবে। এর অবশ্য কারণ আছে। এখানে ঝুলছে ত্রিশ শতাংশ ছাড়ের এক অফার। তৌসিফ মোটেও বিরক্ত হলো না। তার মন আজ-কাল এসবে অভ্যস্ত। তৌসিফ ওকে আস্তে করে সাইডে রাখা নরম গদিতে বসিয়ে বললো,
— কমফোর্ট পাচ্ছো?
পৌষ মাথা নাড়ে। তৌসিফ ঘড়িতে সময় দেখে। বলে,
— শুধু কফি খেলে তো হবে না। সাথে কি খাবে?
— কফিই খাব।
ছোট চোখ করে তাকায় তৌসিফ। বলে,
— দিনের বেলায় কি তোমার পাকস্থলী সংকুচিত হয়ে যায়?
পৌষ তাগড়া চোখে তাকিয়ে যেন সে খুবই অবাক এহেন কথায়। মুখটা সাক্ষাৎ পেঁচার মতো করে বললো,
— আমাকে বেলুনের মতো বোটকা বললেন আপনি? যে সংকুচিত হই আর বাতাস দিলে রাতে প্রসারিত হই?
তৌসিফ ঝুঁকলো একটু কাছে। পৌষ’র থুতনিটা ধরে বললো,
— তোতাপাখি আমার।
বলামাত্রই ছোটখাটো এক আদরের প্রদান ঘটলো। পৌষ ঝটকা দিয়ে বলে উঠলো হতভম্ব ভাব নিয়ে,
— আশেপাশে মানুষ কত….
— ইটস অস্ট্রেলিয়া হানি।
— তো?
— ইটস ঠু নরমাল।
— মানে কি নরমাল? এরমানে বাংলাদেশে এসব অ্যাবনরমাল?
— উপস সরি। ভুলেই গিয়েছিলাম কার সাথে কথা বলছি।
তৌসিফ কেটে পরলো। পৌষ পিছু ডাকতেই জ্যাকেটের পকেটে হাত গুজে বললো,
— একটু অপেক্ষা করো। এখনই আসছি।
পৌষ ফোনটা হাতে নিলো৷ নরম গদিতে পা তুলে আরাম করে বসেছে সে। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। পৌষ অবাক চোখে দেখে তা। তার পাশেই আগুন জ্বালানো হয়েছে। সেই আগুনের শিখায় অপলক তাকিয়ে আছে এক উন্নত বয়সের নারী। পরণে এখানকার পোশাক। মুখে স্থানীয় ভাষা। সে হাসিমুখে দেখছে পৌষ’কে। তার পাশে ব্রাউন চুলের একটা ছেলে আসতেই সে কিছু কথা বললো তার সাথে। ছেলেটা পরক্ষণেই তাকে বি’য়ার সার্ভ করলো মগ ভর্তি। মহিলা মগে অবলীলায় ঠোঁট রাখে। এমন ঠান্ডা আবহাওয়ায় বিয়ার শরীর গরম রাখতে ভালো কাজ করে। তার মন চাইলো হ্যাংলা পাতলা মেয়েটাকেও সাধতে। তার উচিত বিয়ার খাওয়া। কিভাবে কাঁপছে।
সেটার অবশ্য প্রয়োজন পরলো না। মেয়েটার আশ্রয় হয়েছে এক লম্বা-চওড়া পুরুষের বুকে।
এবারেও নারীটি হাসলো। মিনমিন করে বললো,
— ইউস টু ওই জায়গা, মেয়ে। যদি তুমি জানতে এ-র থেকেও গভীর আদর ভাবে সে আমার মাঝে নিজেকে জড়াতো তাহলে এত খুশি হয়ে তৃপ্ত হয়ে তুমি জড়াতে না তার সাথে।
পেছনে ডাক পরতেই নারীটি হাসলো। ইশারায় দেখালো পাশের অসমবয়সী দম্পতিকে।
_____________________
— কথার উত্তর কেন দেন না মেহেদী? কখন থেকে কথা বলছি?
মেহেদী খাতা দেখছে। ডিসেম্বর মাস। পরিক্ষা শেষ। সপ্তাহের মাঝে এসব খাতা জমা দিতে হবে। হাত ভর্তি কাজ। এখন কথা বলার সময় হচ্ছে না তবুও বললো,
— রাতে কথা বলছি।
— আর কত রাতে মেহেদী?
— আর একটু।
সোহা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে চলে গেলো৷ ওর প্রস্থান এক পলক দেখে মেহেদী। বিশেষ পাত্তা দেয় না।
রান্না ঘরে খাবার গরম করছে সোহা। শশুর তখন চায়ের আবদার করলেন। আদা চা। সোহা দেখলো ঘরে আদা নেই। শশুড়কে তো আর বলা যাচ্ছে না আদা আনতে। বাজার সামনেই৷ মুদির দোকানেই আদা পাওয়া যায়। সোহা বিব্রত বোধ করে শিশুর’কে বলতে তাই পুণরায় রুমে ঢুকে দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,
— মেহেদী আদা লাগতো। বাবা চা খাবেন।
— হুঁ। এক মিনিট।
ড্রয়ার থেকে ভাঙতি টাকা নিয়ে মেহেদী বের হলো। একদম সোহা’র সামনে দিয়ে। সোহা’র কণ্ঠনালী কাঁপলো। ভীষণ ভাবে কাঁপলো। একটা কথার উত্তর দেয়ার সময় হচ্ছে না অথচ বাড়ীর বাইরে নিজ বাবা’র জন্য ঠিকই যাচ্ছে আদা আনতে। সোহা নিজের অবস্থান বুঝে। এটাও বুঝে ঠিক কতটা খারাপ লাগে অবহেলায়।
মাঝেমধ্যে মনে হয় নিজ থেকে কপালে দুঃখ এনেছে সোহা। দরজাটা ধরেই দাঁড়িয়ে থাকে ও। হঠাৎ যখন হাতের মুঠোয় একটা পলিথিন এলো তখন টের পেলো মিনিট পাঁচ এখানেই পার হলো। মেহেদী ফিরে এসেছে। সোহা রান্না ঘরে ঢুকে চা বানায়। তিন কাপ চা করে শশুর সহ শাশুড়ী’কে দিয়ে আরেক কাপ নিয়ে ঢুকে রুমে। মেহেদী’কে চা দিতেই চমৎকার হাসে মেহেদী যেন সে খুবই কৃতজ্ঞ। সোহা চোখে হাসে। মানুষ স্বার্থপর। কিছু পেলে তারা কিছু দিতে রাজি। এই যেমন সোহা নিজেও এখন স্বার্থপর। ভালোবাসা পেতে, ভালো থাকতে ও মেহেদী’কে এতটা ভালোবাসাছে। সেই প্রথম রাত থেকে।
যতক্ষণ মেহেদী খাতা দেখলো সোহা ঠাই বসে রইলো। এক গভীর ভাবনার মাঝেই ওরা রাতের খাওয়াও শেষ করলো। সোহা রুমে ঢুকেই এবার সরাসরি বললো,
— এখন উত্তর দিন মেহেদী…
হেলামি দেখায় মেহেদী। বিছানায় উঠতে নিলেই এবার সোহা একটু জোরেই বলে উঠলো,
— কি সমস্যা কি মেহেদী? সেই কবে থেকে বলছি একই কথা। হ্যাঁ বা না বলুন….
মেহেদী নিজেও রেগে বলে উঠলো,
— আমার মুখের হ্যাঁ-না কেন লাগবে? তুমি বোঝো না? দেখো না? সংসার চালিয়ে কত খরচ তার উপর তুমি চাইছো মিনু’কে এখানে আনতে? জীবন্ত একটা মানুষ সে সোহা। পালতে টাকা লাগবে। রাখব কোথায়? রুম ই তো দুটো। খাওয়াব কি? অতিরিক্ত খাবার অপচয় বৈ কিছুই না আমার কাছে। ওর পোশাক-আশাক সব কিছুর দায়িত্ব নিতে হবে। সবচাইতে বড় কথা, ও তোমার নিজের আপন বোনও না। ওখানে খাচ্ছে দাচ্ছে ভালোই আছে। এখানে এনে কি করব আমরা? অতিরিক্ত খরচ না একটা? দরকার আছে কোন?
— না।
খুবই শান্ত গলায় উত্তর করে সোহা। মেহেদী ফোঁস করে শ্বাস ফেলে এগিয়ে আসে। সোহা’র হাত ধরে বসায় খাঁটে। এক হাত গালে রেখে বলে,
— বুঝার চেষ্টা করো সোহা।
— বুঝেছি তো।
— সত্যি তো?
— হুঁ।
— এসো৷ ঘুমাবে।
সোহা চুপচাপ শুয়ে পরলো। মেহেদী তাকে বুকে টেনে নিলো। বুঝ দিলো অনেক কিছু। সোহা চুপচাপ বুঝ নিলো।
সকাল হতেই মেহেদী টেবিলে দেখলো এক জোড়া কানের দুল, দুই মুঠো চুড়ি সাথে একটা থ্রি পিস রাখা। মেহেদী’র বুকে মোচড় দিলো হঠাৎ। কাল কি খুব বেশি খারাপ আচরণ করা হলো সোহা’র সাথে? এসব তো এই কয় মাসে বিয়ের পর মিনু’কে দেয়া হচ্ছিলো। সোহা সব ফিরত আনিয়েছে। সে কি তবে খুব কষ্ট পেলো? মেহেদী কাল রাতে এত কাজের পর হয়তো বেশিই রুক্ষ ভাবে কথাগুলো বলে ফেলেছে। সোহা’কে নরম ভাবে বলা উচিত ছিলো।
মেহেদী’র ফোনে আচমকা এক ম্যাসেজ আসে যা দেখা মাত্র ওর কপাল বেয়ে ঘাম ছুটতে থাকে। এই শীতের সকালে ওর শরীর নিয়ে এক দফা ঘাম ছুটে গেলো। হাত-পা অবস হয়ে এলো। চিৎকার করে ও ডাকতে লাগলো,
“সোহা? এই সোহা? এখানে এসো! সোহা?”
#চলবে…..
#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫৮
নরম স্বভাব বজায় রেখে পৌষ’কে নিয়ে ঠান্ডার দেশে গরম গরম কফিতে ভালোবাসার আদান-প্রদান করছে তৌসিফ। তার আচার আচরণ ঠিক এক সদ্য প্রেমে পুরুষের মতো। পৌষ’র চঞ্চলতা এখনও বিদ্যমান। তারা দু’জন বিন্দুর দূরত্বও রাখতে যেন অপারগ। গায়ে গা ঘেঁষে দু’জন বসে আছে। তৌসিফ নিজের জ্যাকেটের চেইন খুলে তাতে টেনে নিলো পৌষ’কে। আদুরে বিড়াল বনে গেলো পৌষ। সে ওম খুঁজতে ব্যস্ত। কান টুপিটা টেনে ঠিক করে তৌসিফ। হালকা স্বরে বলে,
— ঠান্ডা লাগবে।
পৌষ বুকে আরেকটু সেটে যায়। তৌসিফ বাহু বন্ধনে আটকে নেয়। না চাইতেও চোখ ভিজে যায় পৌষ’র। তৌসিফ তখন আদর আদর কথা বলছে তাকে। দৃষ্টি তার বাইরে তুষারপাতে। তৌসিফ হ্যান্ড গ্লাভসগুলো পরাতে চাইলো পৌষ’কে কিন্তু ও পরবে না। হাত দুটো তৌসিফে’র কোমড় পেঁচিয়ে ধরে চাপা স্বরে পৌষ বলে,
— এই যে, গরম হয়ে যাবে।
— পৌষরাত?
পৌষ চমকালো। এখানে আসার পর থেকে পৌষরাত নামে ততটা ডাকছে না তৌসিফ। সে ভালোবাসার মধুর ডাকই ডাকছে। হঠাৎ নিশ্চিত পৌষ’র ভারী কণ্ঠ
শুনেই সে বুঝেছে। পৌষ ঝটপট গলা খেঁকিয়ে নিলো। বুকে আরেকটু ঢুকার চেষ্টা করে বললো,
— এখানে কত সুন্দর সবকিছু….
— ডাকছি আমি।
— হুঁ। বলুন।
— মন খারাপ? তোমার কণ্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন?
— কিছু ভাবছি।
— কি?
— এত সুখ কোথায় রাখব আমি?
— এই যে তোমার ছোট্ট বুকটায় ভেতর ছোট্ট একটা হৃদয়। ওখানে শুধু আমাকে রেখে দাও। আর কিছু রাখতে হবে না।
— আমার কাছে সব কল্পনা মনে হয় জানেন। মনে হয় সেদিনও আমি কক্সবাজার যেতে কত বায়না ধরলাম। কেউ নিলো না। বান্ধবীরা সবাই যাচ্ছিলো। তাদের সাথেও যেতে দিলো না। পাঁচ হাজার টাকা জমিয়েছিলাম তবুও দিলো না। সেবার আমার কত্ত মন খারাপ হলো। এত রাগ লাগলো কিন্তু আমি রাগ করি নি। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে হাবিজাবি অনেক কিছু কিনে রাতে ছাদে পার্টি করেছিলাম। জানেন, শ্রেয়া ভাবীও বলেছিলো কিন্তু তবুও যেতে দেয় নি৷ আমি আসলে কখনো ঢাকার বাইরে যাই নি। এবার একদম দেশ ছাড়া হয়ে গেলাম।
তৌসিফে’র ভেতরে বেহুদা সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হয়। নামহীনা যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার কোন কারণ নেই। মাঝেমধ্যে আমাদের খারাপ লাগে। সেই খারাপ লাগার তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ কারণ থাকে না। তৌসিফে’র এবার তাই হলো। এমন মন খারাপ অবশ্য তার সহসা হয় না। আবার মনে হচ্ছে এই প্রথমই বুঝি এমন মন খারাপ হচ্ছে।
তৌসিফ পৌষ’কে তুললো বুক থেকে। প্রেমিকের মতো কপালে চুমু দিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ংকাল। পৌষ চোখ নামিয়ে নিলো। তৌসিফে’র গভীর চোখে বেশিক্ষণ তাকাতে সে অক্ষম।
তৌসিফ পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে বললো,
— উঠবে?
পৌষ শান্ত ভাবে মাথা নাড়ে যদিও এখানে বসে থাকতে তার ভালো লাগছিলো৷ তৌসিফ পৌষ’র হাত টেনে গ্লাভস পরিয়ে দিলো। উঠতে নিবে তখনই ফোনটা বেজে উঠে। তৌসিফ দেখলো দেশ থেকে কল তাই পৌষ’কে বসিয়ে বললো,
— একটু বসো। এখানে নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না৷
পৌষ বসে। এদিক ওদিক এলোমেলো দৃষ্টি দিতেই দেখা মিলে অপ্রীতিকর দৃশ্য। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরায় পৌষ। ঠিক সেই মুহুর্তে ওর টেবিলে দুটো টোকা দিয়ে এক নারীকণ্ঠ বলে উঠে,
— হেই ডিয়ার, ক্যান আই নো ইউর নেইম?
পৌষ চোখ তুলে তাকায়। নারীটির চোখ মুখ দেশীয় লাগলেও তার মুখের ভাষা এবং চুলের রং এখানকার মতো। ঘাড় পর্যন্ত চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে পুণরায় বললো,
— হোয়ার আর ইউ লস্ট?
— নাথিং। আই ডোন্ট নো ইউ।
— ওকে ফাইন। আমি বলছি..
পৌষ বুঝলো সে ঠিক। এই মহিলা দেশী কিন্তু এখানে এসে বেশ ধরেছে। এসব পৌষ’র খুবই বিরক্ত লাগে। তবুও ঠোঁটে হাসি ফুটাতে চাইলো ও। বললো,
— আমার হাসবেন্ড আছেন সাথে। ওখানে আছেন।
আঙুল দিয়ে দেখাতেই নারীটি হাসলেন। বললেন,
— আই আস্কড এবাউট ইউ ডারলিং।
পৌষ’র হাসি বিস্তর হলো। বললো,
— আপনার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে ওনাকেই জিজ্ঞেস করুন আন্টি।
বলেই পৌষ উঠে দাঁড়ালো। হেঁটে হেঁটে গেলো তৌসিফে’র কাছে। তারা হাত ধরে প্রস্থান করলো এখান থেকে। এদিকে নারীটি আন্টি ডাকে হতভম্ব হয়ে গেলো। তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মুহুর্তেই।
_________________
মেহেদী অস্থির হয়ে উপস্থিত হলো ঢাকার সনামধন্য এক হাসপাতালে। তখন সে চিৎকার করে ডাকলেও সোহা উত্তর করে নি৷ সে ছিলোই না বাড়ীতে। থাকার কথাও অবশ্য না কারণ মেহেদী’র ফোনে তখন সোহা’রই এক বার্তা উপস্থিত ছিলো। হয়তো খুবই বা খুশির বা অতি মর্মান্তিক। মেহেদী’র ডাকে ওর মা-বাবা উপস্থিত হয়। মেহেদী তখন অবিন্যস্ত দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে থাকে। তার বুকের অস্থির ভাব তার চোখেমুখে তখন ফুটে উঠে তখন কোনমতে শুধু মানিব্যাগটা পকেটে ভরে সে দৌড়ে বেরিয়ে আসে।
এখন এই মুহুর্তে তার লজ্জা এবং সংশয় হয়। এমন ভাবে এই বেশে এত বড় হাসপাতালে ঢুকবে কিভাবে? যদি অপমান করে? মেহেদী সহ্য করতে পারে না। তার ভেতর তখন জ্বলছে। ভয়ে বুকটা কুঁকড়ে যাচ্ছে বারংবার। সোহা ফোন ও ধরছে না। মেহেদী ভেতরে ঢুকে। তার দিকে ওয়াচম্যানও কেমন ভাবে তাকায়। মেহেদী পাত্তা দেয় না। ও লিফট ধরে চার তলায় যায়। কাঁপা কাঁপা পা ফেলে কাউন্টারে জিজ্ঞেস করতেই তারা কম্পিউটারে সোহা নামটা টাইপ করে শুধু জানায় তার অবস্থান। মেহেদী’র শরীর হীম হয়ে আসে৷ ও দেয়াল ধরে সেদিকে পা বাড়ায়।
রুম নাম্বারটা আরেকবার দেখে নব ঘুরাতেই দরজা খুলে গেলো৷ মেহেদী দেখলো বেডে শুয়ে আছে সোহা। ধরাস করে উঠে ওর বুকটা। অজানা আশঙ্কায় ভেতর কাঁপে।
আস্তে করে দরজা লাগিয়ে ভেতরে ঢুকে হাত রাখে সোহা’র পেটে। বুঝার চেষ্টা করে কিছু। সোহা চোখ থেকে হাত সরায়। মেহেদী’র অবস্থান সে টের পেয়েছে। মেহেদী বুঝে না কিছু। সোহা তাকাতেই আচমকা ঝরঝরে কেঁদে ফেলে মেহেদী। হাঁটু গেড়ে বসে নিচে। সোহা তাকিয়ে রয়। মেহেদী’র কান্না সে দেখেনি কখনো। সোহা’র শান্তি লাগলো। তার ভেতরের রাগ হালকা হচ্ছে যেন মেহেদী’র চোখের পানি ছিটানো হচ্ছে ওর বুকে যা উপশম করছে তার দাবানো রাগ।
মেহেদী কাঁদতে কাঁদতে শুধু প্রশ্ন করে,
— আছে?
সোহা উঠে বসে। পা দুটো ভাজ করে আসাম করে বসে বলে,
— না থাকাটা আপনার জন্য সস্তির মেহেদী। খরচ হতো অনেক। কাঁদার কারণ?
মেহেদী তাজ্জব বনে উঠে এলো। সোহা’র বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বললো,
— কি বলছো? কি বলছো সোহা? আমার সন্তান বোঝা কেন হবে? এই তুমি কি করেছো? ওকে কি মে-রে ফেলেছো? কথা বলো দয়া করে…
— আমি কাল জানলাম। ভাবলাম আপনাকে জানাব। কিন্তু দেখলাম আপনার টাকা নেই। অতিরিক্ত এক পিঁপড়েও যদি আপনার চিনির দানা নিয়ে যায় তবে আপনার সংসারে চায়ে মিষ্টতা কমে যাবে। ছোট বাচ্চা, বুঝেন কত খরচ। এদের দুধ থেকে নিয়ে সবই খরচ। জামা-কাপড় অতিরিক্ত খরচ। ডায়াপার নাহয় কাঁথা দিয়ে সারিয়ে নিতাম। ছয় মাস যেতেই বাড়তি খরচ। তা বাদ দিন এই যে পেটে থাকতেই খরচ শুরু হতো। ভালো-মন্দ, ডাক্তার, খাওয়া কত খরচ! আবার বড় হলে একে স্কুল, সে আরেক খরচ। চিপস, চকলেট সহ কত আবদার থাকবে তার মেহেদী। সংসার চলে টানটান করে। বাচ্চার খরচ কোথা থেকে আসবে? কত টাকা খরচের থেকে এবর্শন এর টাকা খরচ বুদ্ধিমানের কাজ। কি ঠিক বলি নি?
আর ভাবলাম যেহেতু এবর্শন করাবই বড় হাসপাতালেই করাই। ওও আচ্ছা, আপনি কি টাকা নিয়ে ভয় পাচ্ছেন? কোন সমস্যা নেই। বিল পে করা সব। আমি দিয়ে দিয়েছি। আর হ্যাঁ, এটা আপনার খরচ না। পেটের সন্তান আপনার হলেও তাকে মা’রার খরচ তার মা ই দিবে…..
মেহেদী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার ভাষা নেই। শব্দ ভান্ডার শূন্য। মেহেদী অবাক স্বরে শুধু বলে,
— আমি কি এত বড় শাস্তির যোগ্য সোহা?
সোহা ভাব শালীন। সে গুনগুন করে গান ধরেছে।
_____________________
— হানিবানি, কি খাবে?
— মজা খাব।
তৌসিফ বউ’কে আজ হাঁটাচলা করতে দিচ্ছে না৷ সে জানে বউ অসুস্থ। ক্লান্ত তার বদন। তৌসিফ ওকে নিয়ে এলো সিডনির এক লোকাল রেস্টুরেন্টে। ওরা ঢুকা মাত্রই কয়েকজন লোক এগিয়ে এলো। এগুলো বিদেশি। অবাক করা বিষয় তৌসিফ সবাই’কে চিনে এবং তারা বন্ধু। তৌসিফ এসেছে শোনামাত্রই দাওয়াত দিয়েছে। তৌসিফ বউ সহ ভেতরে ঢুকে। সবার স্ত্রী ভেতর দিকেই। পৌষ’কে তারা নিজেদের কাছে টেনে নিলো। তৌসিফ চোখে ভরসা দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ডোন্ট বোদার হার মাচ।
উত্তরে মুচকি হাসি। ব্যাস।
পৌষ’কে ঘিরে তাদের বিস্তৃত আলোচনা। তারা পৌষ থেকে জানছে কিভাবে বিয়ে হলো। কিভাবে হলো প্রেম? পৌষ’র বলতে মন চাইলো অনেককিছু। তার মুখ নিশপিশ করছে কিন্তু আফসোস বলতে পারছে না। মনে মনে গান গাইলো পৌষ,
“পিরিত করছে যে জন জানে সেজন পিরিতের কি বেদনা”
তৌসিফ’কে বিয়ে করে প্রথম প্রথম এই বেদনাই পেয়েছে পৌষ। আহা! পৌষ শিহরিত হয়। পৌষ তাদের সাথে ভালোই আলোচনা চালায়। মিষ্টি মিষ্টি স্বভাবজাত কথা বলে। ওদের মাঝখান থেকে একজন বলে উঠলো,
— পিয়া’র সাথে দেখা হলো এখানে? ও তো সিডনিতেই থাকে।
পৌষ আসলে বুঝে না৷ “পিয়া” নামের কাউকে ও চিনে না। পৌষ’র মুখ দেখে মেয়েটা পুণরায় বললো,
— কি হলো পৌষ? বললে না?
— চিনি না তো।
আরেকজন ওকে থামিয়ে বললো,
— কেউ না। বাদ দাও।
প্রথম মেয়েটি থামলো না৷ সে জানতে উৎসুক। এই তৌসিফ’কে সে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো। তৌসিফ বাজেভাবে তাকে প্রত্যাখান করেছে। তাহলে এই হ্যাংলা-পাতলা মেয়ের মাঝে সে পেলোটা কি?
সে তাই বলে উঠলো,
— আরে, কেউ না কেন? পিয়াসী’কে তো পৌষই চিনেই৷ ও জানে যে তৌসিফ বিবাহিত ছিলো।
এতটুকু বলেই থামলো ওরা। পৌষ’র টনক নড়লো অল্প। তৌসিফে’র আগের বউয়ের নাম পিয়াসী এটা আদৌ পৌষ জানতো কি না এটা নিজেই বুঝতে পারছে না। তারা বলাতে শুধু বুঝলো কার কথা বলছে। পৌষ জানে তৌসিফে’র দ্বিতীয় বউ সে কিন্তু এই মুহুর্তে তার ভালো লাগে না কথাটা। একদমই না। সোজা উঠে যেতে নিলেই তার হাত ধরে বসিয়ে দিলো মেয়েটা। হাসতে হাসতে বিষয়টা হালকা করে চালিয়ে গেলো ভিন্ন আলাপ কিন্তু আশ্চর্য পৌষ’র ভালো লাগছে না। রাগে তার গা দপদপ করছে।
#চলবে….