#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫৯
বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় আসতেই পৌষ তৌসিফে’র বাহু খাঁমচে ধরলো। তৌসিফ নিজের গলার মাফলারটা খুলে পৌষ’র নাক সহ মুখে পেঁচিয়ে দিলো। ফোন হাতে নিয়ে শক্ত কণ্ঠে ড্রাইভারকে ধমকে গাড়ি নিয়ে আসতে বলা মাত্রই পৌষ মুখের থেকে মাফলার সরায়। নাসারন্ধ্রে ধাক্কা খেলো তৌসিফ তৌসিফ গন্ধ। পৌষ নাকটা পুণরায় মাফলারে ঠেকায়। শুকে নেয় যতটুকু পারা যায়। যদিও তৌসিফ’কে সে বিনাকারণে কাঠগোড়ায় দাঁড় করায়৷ বলে গন্ধ গন্ধ কিন্তু সত্যি তো এটাই যে তৌসিফ এক ঘ্রাণময় পুরুষ। তার পুরুষনালী ঘ্রাণে পৌষ মাতাল বনে যায়। মানুষের শরীরের গন্ধ হয় ভিন্নতর। তৌসিফে’র পারফিউমটার ঘ্রাণও ভিন্ন। পৌষ’র ভালো লাগে। চোখ বুজে তা অনুভব করে ও।
তৌসিফে’র হাতটা ধরতেই তৌসিফ তাকালো ওর দিকে। পৌষ’র নাক খোলা দেখেই চোখে রাগ দেখিয়ে যেই না নাক ঢাকবে ওমনি পৌষ বলে উঠলো,
— এখন হোটেলে না যাই? একটু হাঁটি? আপনি আর আমি? হাঁটব। ঘুরব। প্রেম করব।
তৌসিফ ফোনটা কেটে দিলো। ফটাফট আঙুল চালিয়ে কিছু টাইপ করে ফেললো। ফোনটা জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে পৌষ’কে টেনে নিলো নিজের কাছে। চোখের দিকে তাকাতেই পৌষ দৃষ্টি নামায়। আলগোছে তৌসিফ কাছে টানে। পৌষ তৌসিফ’কে জড়িয়ে ধরে। খোলা রাস্তায় তখন মানুষ জন খুবই কম। চারপাশে ঝলমলে আলো। পুরো অস্ট্রেলিয়া তখন সেজেছে নতুন রঙে। বছর বিদায় হওয়ার আর বেশিদিন বাকি নেই। পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে বরণ’কে করতে মুখিয়ে আছে সকলে। পুরাতনকে মনে রাখতে নেই আর যদি সেই পুরাতন হয় জ্বালাময়, জঘন্য এবং কষ্টদায়ক তাহলে সেই পুরাতন মনে পুষে নিজে জ্বলার প্রশ্নই উঠে না। পুরাতন মানেই তাকে বিদায় করো। নতুন’কে আঁকড়ে ধরো। এখানে অবশ্য ভিন্নমত আছে। থাকাটাই যথার্থ। মানুষ ভিন্ন এরমানে যুক্তি ভিন্ন হবেই।
পৌষ পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হলো। তৌসিফ ওর নিয়ত বুঝলো না তবুও কোমড় জড়িয়ে একটু উঁচুতে তুলে দিলো। পৌষ দুই হাতে তৌসিফে’র গলা জড়িয়ে দাঁড়ি ভর্তি গালে নিজের গাল ঘঁষে দিলো। তৌসিফ চোখ বুজে নিলো। পৌষ তখন আদর করতে ব্যস্ত। তৌসিফ এক ঢোক গিলে। পৌষ ওর প্রসস্থ কপালে চুমু দিয়ে এক হাতে হাত দিয়ে আরেক গালে ঠোঁটে’র ছোঁয়া দিলো। অতি ঠান্ডায় উষ্ণ আলিঙ্গন। তৌসিফ পৌষ’র দেহটা নিজের সাথে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে হালকা স্বরে বলে উঠলো,
— এখানে রুমের ব্যবস্থা করব?
— উহুঁ।
— তাহলে?
— এভাবেই থাকব।
— রাস্তা এটা হানিইইই….ট্রাই টু….
তৌসিফ এত অল্পে বেসামাল হবে কে জানতো। পৌষ আদর থামালো। গালে ছোটখাটো এক কামড় দিয়ে গলা ছেড়ে দিয়ে বললো,
— নামান।
তৌসিফ চোখের পলক ঝাপ্টা দিলো কয়েকবার। অসন্তোষ গলায় বললো,
— এটা কি ছিলো?
— আদর ছিলো।
— ব্যাস এতটুকুই?
— হুঁ। এতটুকুই।
— আর পাব না?
— এখন না।
— তাহলে? কখন?
তৌসিফ বড়ই উতলা হচ্ছে। হওয়ারই কথা। বউ মাত্রই তাকে আদর করছে একটু। এখন তার মনটা আদর আদর করছে। এই করাটাও স্বাভাবিক। পৌষ উত্তর করলো,
— রাতে।
তৌসিফ ফট করে পৌষ’কে নামালো। এদিক ওদিক তিনশত ষাট ডিগ্রী এঙ্গেলে ঘুরিয়ে বললো,
— দেখো চারপাশে অন্ধকার। রাত বারোটা বাজে।
— আরো রাত হোক।
— এখন?
— ঘুরব।
— নো ওয়ে হানি….
পৌষ ঝট করে হাত সরালো। দারাজ গলায় বলে উঠলো,
— একশত ওয়ে হানির জামাই। বুড়ো জামাই বলে কি আমি প্রেম করব না? এতক্ষণ আমাকে বুইড়া বেটিদের মাঝে বসিয়ে রেখেছিলেন। এখন ঘুরবেন আমাকে নিয়ে। আর হ্যাঁ, খবরদার যদি কু*ত্তামার্কা বেটিদের কাছে আমাকে আরেকবার এনেছেন তো! ফালতু সব! আমার সংসারে নজর দেয়। ওদের চোখ দিয়ে গুট্টি বানিয়ে খেলব আমি। একদম কাঁটাচামচ দিয়ে তুলে নিবে। চিনে না আমাকে!
তৌসিফ অসহায় ভাবে তাকালো। কি হলো? হঠাৎ রোম্যান্টিক মুডে থাকা বউটা ক্ষেপলো কেন? এতক্ষণ তো ভালোই ছিলো। পৌষ’র হাতটা ধরে তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,
— কেউ কিছু বলেছে?
— বলেছে।
— কি বলেছে?
— রাতে বলব।
ফোঁস করে শ্বাস ফেলে তৌসিফ। পৌষ’র হাত ধরে টেনে নেয় নিজের কাছে। দুজন হাঁটা ধরে। গন্তব্যহীন। সিডনি শহরটা তখন আলোকিত। বুঝা দায় এখন রাত। তারমধ্য এক অসমবয়সী দম্পতি হাঁটছে। মেয়েরা রাগ করে সামনে যেতেই পুরুষটা পিছু দৌড়ালো। এগিয়ে এসে হাত ধরে টান দিতেই মেয়েটার রাগ পরে গেলো। তাদের ছুটাছুটি চললো অনেকক্ষণ। হাসির শব্দে আশেপাশের দুই একজন তাকালো অবশ্য অথচ বেখবর দু’জন মেতে আছে প্রেমে। তারা সিডনি’র ঠান্ডার মাঝে উৎসব খুঁজে নিয়েছে। একদম নিজের মতো।
ক্লান্ত পৌষ দেখলো মোটামুটি জোয়ান একজন মহিলা বেলুন বিক্রি করছেন। তার থেকে এক জোড়া করে কিনে বেঁধে আকাশে ছেড়ে দিচ্ছে কেউ কেউ। তাদের মতে এই দুটো হলো এক জোড়া প্রেমের জুটি। বেলুন গুলো ঝলমল করছে। পৌষ সেই বরাবর দৃষ্টি দিয়ে দেখতেই পেছন থেকে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে তৌসিফ। নিজের কাছে নিয়ে উঁচু করে হাঁটা দিতেই পৌষ হাসলো। আজ সারাদিন তৌসিফ তাকে হাঁটতে দেয় নি ততটা। তার আড়ালে করা এসব যত্নে পৌষ’র ভালোবাসা বাড়ে৷ হাজার গুন বাড়ে। শতশত তারা যেমন আকাশে রাজত্ব করে ঠিক সেভাবেই তৌসিফে’র বুকে রাজত্ব করে পৌষ। সবটা তার। এই তৌসিফ তালুকদার তার। নিজ রাজত্বে যখন রাজাই আমার তখন ফাঁকা তীরে কেউ ম’রে না। পৌষ অতটাও বোকা না৷ সে হাজার বোকা হলেও তৌসিফে’র ভালোবাসা চিনতে তার ভুল হয় নি। এই ভালোবাসা কে না বুঝে? পা’গলও বুঝে।
পৌষ হাসলো। তৌসিফ লোকটার কাছে যতটুকু ছিলো সবগুলো বেলুন নিয়ে পৌষ’র হাতে দিলো। পৌষ হাসতে হাসতে বললো,
— এত কেন?
— দুটো তুমি-আমি।
— বাকিগুলো?
— আমাদের বাবুরা।
— এত্তোগুলো?
— হ্যাঁ তো।
— এতোগুলো না৷ ব্যাটা বলে কি? ম’রে যাব আমি।
পৌষ বেলুন হাতে ব্রীজে ছুটলো। তৌসিফ এক পলক তাকিয়ে হাসতে হাসতে টাকা দিলো মহিলাটাকে। মহিলাটা হাসিমুখে তাকে সুন্দরতম রাতের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। তৌসিফ বুকে হাত গুজে তাকালো। ব্রীজটা ছোট। অপর পাশ থেকে দৌড়ে এলো তৌসিফ। তার মতো একটা পুরুষ’কে হয়তো এসব মানায় না কিন্তু একজন প্রেমিক পুরুষকে সবটা মানায়। সবটা।
হঠাৎ সামনে থেকে তৌসিফ’কে আসতে দেখে পৌষ থামলো না। তার পা চলমান। দু’জন দ্রুতই নাগাল পেলো দু’জনকে। হাঁপাতে হাঁপাতে তৌসিফ জড়িয়ে ধরলো পৌষ’কে। দু’জনের মুখ থেকে আভ বেরুচ্ছে। অতি শিঘ্রই পৌষ’র দেহ আঁকড়ে ধরে দুটি ওষ্ঠাধর একত্রিত হলো। মাঝ ব্রীজ থেকে তখন উঁড়ে গেলো চৌদ্দটি বেলুন। পৌষ দুই হাতে তৌসিফে’র পিঠ জড়িয়ে ধরলো। ওর চোখ দিয়ে পানি পরলো সমানতালে। জানা নেই কেন কিন্তু এই চোখ শুধু কাঁদে। হোক অতি খুশিতে বা অতি দুঃখে।
__________________
বাড়ীতে আসার পর থেকে সোহা’র ব্যবহার বদলে গেলো। মেহেদী পাথর হয়ে আছে। তার জীবনে এমন পরিস্থিতি কখনো আসে নি। রাস্তায় সোহা গাড়ি থামিয়ে মিষ্টি কিনেছে। গাড়ি করেই তারা বাড়ী ফিরেছে। মিষ্টি গুলো মেহেদী ভেতরে এনে টেবিলে রাখতেই ওর মা বেরিয়ে এলেন। সকাল সকাল কোথায় বেরিয়েছিলো জিজ্ঞেস করতেই সোহা হাসিমুখে বললো,
— হাসপাতালে।
চিন্তিত হয়ে শাশুড়ী জিজ্ঞেস করলো,
— হায় হায়, হাসপাতালে কেন গিয়েছিলে? ঠিক আছো দু’জন? মেহেদী বাবা কি হয়েছে?
সোহা শাশুড়ী’কে জড়িয়ে ধরলো। কানে কানে বললো,
— দাদী হচ্ছেন আপনি।
সোহা ছেড়ে সরে আসতে চাইছিলো কিন্তু পারলো না। ওর শাশুড়ী জড়িয়ে রাখলো৷ মধ্যবয়স্ক নারীটি কোঁদেও ফেললো। তার একমাত্র সন্তান মেহেদী। কষ্টের সংসারের একমাত্র পুত্র সে। তার সন্তান আসবে ভাবতেই আবেগী হলেন তিনি। সোহা’র কপালে চুমু খেয়ে শুকরিয়া আদায় করে মেহেদী’র পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরতেই খেয়াল করলেন মেহেদী কাঁপছে। ওর মা হেসে ফেললেন। বললেন,
— দেখলে বউ মা আমার ছেলে বাবা হওয়ার খুশিতে কিভাবে কাঁপছে। এই মেহেদী, আব্বা আমার, কেন কাঁদছিস? পা’গল। খুশির কথায় কাঁদতে নেই।
মেহেদী মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ওর ফুঁপানো কানে এলো সোহা’র। সোহা মেহেদী’র অপর পাশে বসে কাঁধে হাত রাখলো। মেহেদী’র মা কপাল কুঁচকে নিলেন। অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,
— এভাবে কাঁদে কেউ? মেহেদী বাবা হচ্ছিস না এখন?
সোহা ঢোক গিলে সামলে নিলো। বললো,
— আম্মা আসলে ডাক্তার প্রথমে একটু ভুল-ভাল বলেছিলো তো তাই হয়তো এখনও ভয় পাচ্ছেন উনি।
— সে কি! এই ডাক্তার দেখিও না আর তাহলে। মেহেদী ছাড়। তোর বাবা’কে বলি। আত্মীয় স্বজনদের ফোন দিতে হবে তো। আর বোঁকা, তুই পাঁচ কেজি মিষ্টি কেন এনেছিস? হবে এতে? আমি পুরো মহল্লায় দিব। দাঁড়া টাকা নিয়ে আসি।
বলতে বলতে উঠে গিয়ে কয়েকটা ভাজ করা কিছু নোট নিয়ে এলেন উনি। দেখেই বুঝা যাচ্ছে বিভিন্ন সময়ের জমানো টাকা। সোহা পুণরায় ঢোক গিললো। সে কি বেশি কঠোর হয়েছিলো? মেহেদী’র শরীর তখনও কাঁপছে। ওর মা এবার বিরক্ত হয়ে স্বামী’কে ফোন দিলেন। বাসার পাশে থাকায় শশুর তারাতাড়ি বাড়ী ফিরলো। তাকে খুশির খবর দিয়ে টাকাগুলো হাতে গুজে দিয়ে শাশুড়ী পাঠালেন মিষ্টি আনতে। সোহা কঠিন কথা বলবে ভেবেছিলো তাই তো দামী মিষ্টি এনেছিলো। সোহা ধরলো না সেগুলো। ও খেলো শশুরের আনা কমদামি সাদা মিষ্টি। শাশুড়ী মিষ্টি বাট করছেন। আশেপাশের কয়েকজন চাচি এসেছেন। তারা নানান কথা বলছেন সোহা’কে। সোহা দেখলো মেহেদী একই ভাবে বসে আছে। শাশুড়ী আনাড়ের রস এনে সোহা’র হাতে দিয়ে বললেন,
— এক ঢোকে গিলে নাও তো বউমা। আর এই মেহেদী ঘরে যা ওকে নিয়ে। একটু শুয়ে থাকুক।
মেহেদী উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পায় না৷ শক্তি হয় না। সোহা ওর হাত ধরে শক্ত করে। মেহেদী উঠে দাঁড়ায়। সোহা’র সাথে রুমে যায়। সোহা দরজা আটকে এলো৷ নিজের করা আচরণটা তার কাছে তখন ঠিক লাগলেও এখন ভুল লাগছে। সে ভালোবাসে মেহেদী’কে। একই ভাবে মিনুটাকে ও নিজ হাতে পেলেছে। এই কলিজার একটা টুকরো মিনু। হয়তো ভালো শিক্ষা দিতে পারে নি ততটা কিন্তু সোহা ভালোবাসে ওকে। নিজ সন্তানের মতো৷ মেহেদী’র পাশে বসে সোহা। ওর হাতটা ধরতেই মেহেদী চোখ তুলে তাকালো৷ লাল একজোড়া চোখ। সোহা ভরকালো। কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই মেহেদী ফ্যাচফ্যাচে গলায় বললো,
— কত টাকা লাগবে সোহা?
সোহা ঢোক গিলার আর সুযোগ পেলো না৷ ওর বুক কাঁপছে। কিসের টাকার কথা বলছে মেহেদী? ওকে ছেড়ে দিবে নাকি? তালাকের টাকা’র কথা বলছে? সেটা তো পরিশোধ করা তাহলে? অযাচিত সব ভাবছে সোহা। মেহেদী পুণরায় জিজ্ঞেস করলো। সোহা ভীতু স্বরে বলে,
— কিসের টাকা?
— বাচ্চা পালতে কত টাকা লাগে?
— মেহেদী… আমি শুধু আপনাকে বুঝাতে চেয়েছিলাম…
— আমি বুঝেছি তো সোহা।
— শুনু…
— শুনা লাগবে না আর। আমি বুঝেছি। আচ্ছা, শুনো এখানে তো দুই রুম৷ একমাস সময় দাও নাহয়। আচ্ছা দুই মাস দেয়া যাবে? একটু সময় লাগবে মনে হয়। তিন রুমের বাসা নিতে হবে। মিনু থাকবে কোথায়? ওর জন্য এক রুম। সোহা আমি টাকা কামিয়ে নিব। তুমি চিন্তা করো না৷ তুমি নিশ্চিত থেকো। সামনের মাসেই বড় ফ্ল্যাট নিব৷ তোমাকে সব দিব৷ কি কি লাগবে আমাকে বলবে….
ওদের কথা শেষ হলো না। দরজায় খটখট শব্দ হয়। সোহা কান্না চেপে ধরে। ও শুধু ভয় দেখাতে চেয়েছিলো। ভালোবাসার লোভে মেহেদী’কে আঁকড়ে ধরেছে ও। চায়নি পূর্বের মতো মন ভাঙতে কিন্তু মেহেদী যে এতটা কষ্ট পাবে তা সোহা বুঝতে পারে নি। সোহার কান্না পাচ্ছে। ভীষণ কান্না। সোহা কাঁদতে পারলো না। মানুষজন দিয়ে ভরা বাড়ী। শুধু ফাঁকে গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে মাফলারে মুখ পেঁচিয়ে বেরিয়ে গেলো মেহেদী।
সোহা ভয় পেলো তখন যখন রাতেও বাড়ী ফিরলো না মেহেদী।
_____________________
রাত তিনটা নাগাদ হোটেল রুমে ঢুকে তৌসিফ। পৌষ’কে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে নিজে টুকটাক খাবার অর্ডার দিলো। পৌষ’র যে ক্ষুধা লেগেছে এটা ও জানে। পৌষ কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলো। তারাতাড়ি তৌসিফ ওকে বিছানায় তুললো। দাঁত চেপে তৌসিফ এক ধমকও দিলো। পৌষ কেঁপে যায়। মাথা ঢুকায় কম্ফোর্টারের ভেতর। তৌসিফ রাগী কণ্ঠে বলে,
— এই বরফের মতো ঠান্ডা পানি দিয়ে কেন মুখ হাত ধুয়েছো? গরম পানি নেই? কথা শুনো না তুমি! এত ঘাড়ত্যাড়ামি করলে দেখবে কি করি!
বলতে বলতে হিটারটা পৌষ’র কাছাকাছি এনে রাখলো। নিজেও ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখলো পৌষ এখনও ওভাবে শুয়ে আছে। তৌসিফ এত টানলো ও উঠবে না। না পেরে কম্ফোর্টার সহ ওকে জড়িয়ে ধরে তৌসিফ। হাসতে হাসতে বলে,
— এই বউ সরি তো। উঠো।
— না।
— কেন?
— বকেছেন।
— মাফ চাইছি। খাবে না?
— না। ছাড়ুন আমাকে।
তৌসিফ ছাড়ে না। পৌষ’কে বের করে নেয়। মুখের সামনে খাবার নিলেও যখন ত্যড়ামি শুরু করলো তখন তৌসিফ আচমকা ওর কানে কানে কিছু বললো। পৌষ মাথা নামিয়ে নিলো। তৌসিফ মুখে খাবার দিতে খেয়েও নিলো। তৌসিফ হাসছে। হাসি থামিয়ে একসময় জিজ্ঞেস করে,
— এত ভাবো আমার কথা?
— ভালোবাসি তো।
তৌসিফ গাঢ় দৃষ্টি ফেলে তাকালো। সময় গড়ালো। তাদের হানিমুনের দ্বিতীয় রাত স্বার্থক করলো তৌসিফ যাতে যথাযথ অবদান রাখলো পৌষ।
রাত যখন শেষ দিকে তখন নিভু নিভু চোখে তৌসিফে’র বুকে থাকা পৌষ বলে উঠলো,
— এত এত দেশ থাকতে অস্ট্রেলিয়াই কেন এলেন হানিমুনে?
ওর চুলে হাত বুলিয়ে তৌসিফ বললো,
— বিশেষ কারণে?
— কাউকে দেখাতে?
— কাকে?
— আমি কি জানি……
পৌষ ঘুমিয়ে গেলো। তৌসিফ কপাল কুঁচকে নিলো। পৌষ’কে আরেকটু বুকে তুলে নিলো। মেয়েটা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
#চলবে…..
#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৬০
বাইরে তখন মৃদু মৃদু বাতাস। ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম। তৌসিফ কফি নিতে একটা ফুড জোনে ঢুকা মাত্রই পৌষ’র সামনে আগমন ঘটে এক নারীর। পৌষ তার চেহারা খেয়াল করে নি। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াতেই পৌষ চোখ তুলে তাকালো। বরাবর দাঁড়িয়ে সুন্দরী এক রমণী। কপাল কুঁচকে পৌষ সরে যেতে নিলেই নারীটি বাংলায়ই বললো,
— কেমন আছো পৌষ?
পৌষ অবাক হলো। এই ভিন দেশের মাটিতে তাকে “পৌষ” বলে কে ডাকবে? ওর অবাকতা দেখে নারীটি সামান্য হাসলো। বললো,
— অবাক হচ্ছো? হওয়ারই কথা। আমি কিন্তু তোমার সম্পর্কে আরো জানি। তুমি তৌসিফে’র ওয়াইফ আর সে তোমাকে খুবই আদর-যত্নে রাখে। তোমার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। এই আদর যত্ন কিন্তু সে আরো অনেককেই করেছে। সেসব গুরুত্বপূর্ণ না। তবে তোমার বুঝতে হবে সে কিন্তু কাজের মেয়েদেরও একই ভাবে আদর করে….ইমম। তুমি কি বুঝতে পারছো না? পৌষ আমি কিন্তু তাকে খুব করে চিনি। তার পুরুষ শরীরের ঘ্রাণ খুব কাছ থেকেই নিয়েছি আমি। হয়তো আরো কিছু নারীও নিয়েছে।
–“পিয়ু”
তৌসিফে’র কণ্ঠে আচমকা এই ডাকে দু’জন নারী একসাথে চমকালো। পিয়াসী ভাবে নি তৌসিফ এত তারাতাড়ি ফিরত আসবে কারণ কফির কাউন্টারে অনেক ভীর। তৌসিফ চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে আসা মাত্র ই পৌষ ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলো,
— আপনি বাদে আর কোন নারীর সাথে তার সম্পর্ক আছে?
পিয়াসী ঘাবড়ানো বাদ দিয়ে তৌসিফে’র দিকে তাকাতেই দেখলো তৌসিফ তাকে খেয়ে ফেলবে ঠিক ওমন ভাবেই দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে। পিয়াসী হরবড়িয়ে বলে উঠলো,
— পুরো এলাকা জানে…
— আর তুই? তুই কি জানিস?
আচমকা পৌষ’র গলার স্বর আর সম্মোধন বদলে গেলো। আপনি থেকে সোজা তুইতে আগমন তার। পিয়াসী রাগী দৃষ্টি ফেলে বললো,
— বেয়াদব মেয়ে তোমার কত বড় আমি জানো?
— জেনে কি কাজ আমার? ভাগ এখান থেকে নাহয় চুল টেনে দুটো পটকানি দিব এখানেই ভ্যাটকি লেগে যাবি!
তৌসিফ এগিয়ে আসতে আসতেই পিয়াসী বলে উঠলো,
— কত নারী নিয়ে তৌসিফে’র বদনাম জানো? সোহা’কে নিশ্চিত চেনো….
বাকিটা শুনার অপেক্ষা পৌষ করলো না। ও হামলে পড়েছে পিয়াসীর উপর। পিয়াসীর রঙ করা চুল গুলো টেনে ধরে গালে মুখে আঁচড় কাটতে কাটতে বলতে লাগলো,
— কু’ত্তী! ** তুই চিনিস আমাকে? আমার সংসারে আগুন লাগাস! তোর চুল ছিড়ে শাক খাব আমি! শা’লী, আমার সংসারে আগুন লাগাতে চায়! তোর মুখ ভেঙে দিব আমি।
মানুষ জন জর হতে সময় লাগল না। তৌসিফ তারাতাড়ি পৌষ’কে ধরলো। পিছন থেকে ধরেও সরাতে পারছে না৷ পৌষ’র যেন শক্তি বৃদ্ধি পেলো হঠাৎ। পিয়াসী’র চুল ও ছাড়ছে না৷ তৌসিফ বহু কষ্টে ছাড়ালো। পিয়াসী’র যেন দম আটকে আসছে৷ গার্ড চলে আসা মাত্রই পিয়াসী’কে সুযোগ না দিয়ে তৌসিফ গার্ডদের বললো পিয়াসী’কে সরাতে অতঃপর পৌষ’কে নামালো। পৌষ সমান তালে বাংলা ভাষায় উচ্চতর গালি দিয়ে যাচ্ছে। তৌসিফ না পেরে ওকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। পৌষ ঝটকা মা’রে। সরে দাঁড়ায় তৌসিফ থেকে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে হাঁটা ধরে অচেনা রাস্তায়। রাগে মাথাটা দপদপ করছে। তৌসিফ’কে কিছু বলারও সুযোগ দিচ্ছে না ও। তৌসিফ শক্ত হাতে ধরলো এবার। নিজেও রাগ দেখিয়ে বললো,
— হয়েছে?
— কেন কষ্ট লাগলো বুঝি?
— পৌষরাত।
— এক্ষণ বাসায় যাব।
— ওকে ফাইন। হোটেলে ব্যাক করছি।
— হোটেল ফোটেল না৷ সোজা বাসায় যাব এখন। এখনই দেশে ফিরব। এই ** কেন এনেছেন? পুরাতন বউকে জ্বালাতে?
তৌসিফ ওকে টেনে গাড়িতে তুললো। রাস্তায় মানুষ দাঁড়িয়ে ওদের নাটক দেখছে। পৌষ গাড়িতে দূরত্ব রাখলো। হোটেল রুমে পৌঁছেই ও নিজের লাগেজ গোছাচ্ছে। তৌসিফ হাজার বুঝালেও বুঝ মানতে নারাজ। তৌফিক ওর বাহু ধরে নিজের কাছে টানলো। দুই বাহু চেপে ধরে বললো,
— এখানে এনেছি কারণ আমার পুরাতন বেশ কিছু বন্ধু আছে এখানে।
— ** আছে এখানে!
— পৌষরাত, মাথা ঠান্ডা করো।
— মাথা আমার ঠান্ডাই আছে। ঐ *** আমার সংসারে আগুন লাগায়। ওর কি দোষ? ইচ্ছে করে ওকে দেখাতে এখানে এসেছেন আপনি? এ্যাই ও আপনাকে ছাড়লো কেন? সোহা’র জন্য? এত এত প্রেম তাকে বলেন নি সোহা’র সাথে বোনের সম্পর্ক! ওওও সরি, বোন তো না সোহা। এরমানে কি? পুরো এলাকা কেন বলে এটা? পিয়ু কেন ডাকলেন তাকে? কেন অস্ট্রেলিয়াই আসতে হলো? কেন পরিষ্কার করেন নি সোহা কে হয় আপনার? আর পিয়াসী কেন বললো বিভিন্ন নারী? কয় বউ আপনার? নাকি বিয়ে ছাড়াই..
আর কিছু বলার আগেই পৌষ’র ডান গালে দানবীয় এক চড় পরলো। ছিটকে বিছানায় গিয়ে পরলো পৌষ। তৌসিফে’র চোখ দুটো তখন টকটকে লাল দেখাচ্ছে। রাগ তার সহজে উঠে না। উঠলে নিয়ন্ত্রণে থাকে না তৌসিফ। তার শিরা উপশিরা তখন দপদপ করে জ্বলছে। পৌষ দমে যায় নি বরং তেজি গলায় বলে,
— সত্যি গায়ে লাগলো নাকি? কি কথা বলুন। উত্তর আজ দিতেই হবে আপনাকে। তৌসিফ তালুকদারের কত নারী সঙ্গ আছে? আমার তো জানা দরকার।
তৌসিফ ওর গাল দুটো চেপে ধরে হিসহিসিয়ে শুধু বললো,
— কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না।
অতঃপর সে উঠে গিয়ে রুমের দরজার সবগুলো লক একটিভ করে দিলো। পৌষ ঝাঁঝালো গলায় বললো,
— এখনই দেশে যাব আমি! থাকব না এখানে।
— ব্যবস্থা করছি।
অতি ঠান্ডা অথচ হিংস্র সেই কণ্ঠস্বর।
_______________________
— আপনি কোথায় ছিলেন?
সোহা’র প্রশ্নের উত্তর করে না মেহেদী। সোহা আবারও বলে উঠলো,
— কথা বলুন মেহেদী। আজ সপ্তাহ খানিক ধরে রাত কোথায় কাটান আপনি? এত টাকা কোথা থেকে আনছেন? মেহেদী আপনি কি খারাপ কোন কাজে জড়াচ্ছেন?
মেহেদী ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। গোসল করে এসেছে মাত্র। চুল গুলো মুছে খাটে বসে বললো,
— সামনের মাসেই তিন রুমের ফ্ল্যাট নিব আমরা সোহা। মিনু’কে এনে রাখব। আচ্ছা, এক কাজ করি, রাতে তো আমি বাসায় থাকি না। মিনু’কে এনে রাখো। তোমার সাথে এখানে থাকলো। সকালে বাসায় ফিরে আমি মায়ের রুমে থাকব নে।
সোহা আর সহ্য করতে পারলো না। মেহেদী’র হাতটা ধরে আতঙ্কিত গলায় বললো,
— কি বলছেন? মেহেদী! আপনি এমন ছিলেন না। আমি তো বারবার বলছি আমি শুধু আপনাকে বুঝাতে চাইছিলাম এত হিসেবি হতে নেই। খরচ তো হয়ই৷ আমার টাকা আছে। আমার সম্পদ যা আমাকে দেয়া হয়েছে তা আপনি নিন।
— কেন নিব?
— কি আজব কথা মেহেদী। বউ হই আপনার।
— আচ্ছা, তুমি সব বাবুকে দিও। আমার লাগবে না।
— বলুন রাতে কোথায় থাকেন?
— সত্যি বলছি, আরেকটা বিয়ে করি নি।
মেহেদী হাসলো। সোহা বিরক্ত হয়ে ওর হাত চেপে ধরতেই কপাল কুঁচকায় মেহেদী। সোহা তাকালো মেহেদী’র হাতের দিকে। ও তাকিয়ে রইলো। শুধু হা করে তাকিয়েই রইলো। সুন্দর একজন শিক্ষকের কলম ধরা হাতটা কাটাছিড়া হয়ে আছে। চামড়া ছিলে আছে কিছু জায়গায়। সোহা’র চোখের গরম পানির ফোঁটা পরলো মেহেদী’র ক্ষতবিক্ষত হাতে। জ্বলে উঠলো সেই হাত। সোহা তখনও দেখছে। এ কোন শিক্ষকের হাত না। এটা একটা দিনমজুরের হাত। না জানি কত কত ইট আর বস্তা টেনেছে এই হাত। সোহা কি মনে করে হঠাৎ মেহেদী’র শার্টের বোতাম গুলো খুললো। গা থেকে শার্ট সরাতেই দেখা গেলো তার সুন্দর অপরিপক্ক কাঁধ দুটো সন্তান তুলার বদলে তুলেছে ভারী কিছু বস্তু। সোহা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো হঠাৎ। ধপ করে বসে পরলো মেহেদী’র পায়ে। মেহেদী ওকে বুকে নিতে চাইলেও পারলো না৷ সোহা আহাজারি করে উঠলো। দরজায় শাশুড়ী ধাক্কাছে কি হয়েছে জানতে। কেউ খুলে না৷ সোহা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে শুধু বললো,
— আমি কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। আমাকে ত্যাগ করুন মেহেদী। আপনার সুখ সব নষ্ট করে দিব আমি।
#চলবে….
#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৬১
হঠাৎ ই বৈরী হাওয়া বইতে লাগলো অস্ট্রেলিয়ায়। বাইরে ঝড়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। নিউজ মিডিয়া সরাসরি সম্প্রচার করে যাচ্ছে আবহাওয়া। ঝড়ো হাওয়ার মাঝে উত্তাল পানি। মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডায় মানুষ জমে যাওয়ার উপক্রম। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। রাস্তা-ঘাট ততক্ষণে বন্ধ। যাতায়াত ব্যবস্থার বন্ধ করার অন্যতম কারণ হলো দূর্ঘটনা প্রতিরোধ। টিভির সাউন্ডটা আরেকটু কমিয়ে দিলো পৌষ। রিমোটটা পাশে রেখে এদিক ওদিক ফোন খুঁজলো। তার ফোনটা পাওয়া যাচ্ছে না। নাক আর মাথা জ্যাম হয়ে আছে। মুখ খুলে শ্বাস নিলো কিছুক্ষণ বড় বড় দম ফেলে। বুকের ভেতর অস্থির লাগছে তার। তৌসিফ এখানে নেই। বাইরে অবস্থা ভয়ংকর। শরীর ঠেলে বহু কষ্টে উঠে বসলো পৌষ। কোমড়ের দিকটা ব্যাথার দরুন চোখ মুখে খিঁচে নিলো। নিজেই হাত দিয়ে চেপে ধরলো। চোখ দিয়ে টুপটাপ পানি পরলো কতক্ষণ। চাপা স্বরে কেঁদে বিরবির করলো,
— কোথায় গেলেন আপনি?
তৌসিফ বেরিয়েছে ঘন্টা তিন পার হলো। পৌষ এবার উঠে দাঁড়ালো। এক দুই পা করে এগিয়ে আলমারির কাছে এসে নিজের কাপড় নিলো। পরণে থাকা তৌসিফে’র বড় মোটা হুডিটা খুলে নিজের জামাটা গায়ে জড়ালো। তৌসিফ কোথায় সে জানে না৷ আবছা আলোয় ও ফোন পাচ্ছে না। এদিক ওদিক খুঁজেও যখন পেলো না তখন আস্তে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে এলো কাউন্টারে। ম্যানেজার ওকে দেখা মাত্র এগিয়ে এলো। পৌষ জানালো তৌসিফ এখনো ফিরে নি। ম্যানেজার আসস্ত করে জানালো তৌসিফ ফিরছে। চিন্তার কিছু নেই।
পৌষ ভরসা পায় না৷ এক বিন্দুও ভরসা সে পায় না। বাইরে বাতাস তান্ডব চালালো। পৌষ সেদিকে তাকিয়ে এক দুই পা বাড়ালো বাইরের দিকে। ম্যানেজার ঘাবড়ে গিয়ে তার পিছু নিয়ে বারংবার নিষেধ করলো সেদিকে না যেতে কিন্তু পৌষ শুনলো না। এই শীতের দেশে তার উত্তপ্ততর হৃদয় কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এটা দেখা যায় না। ছোঁয়া যায়। শুধু অনুভব করা যায়।
হোটেলে’র বাইর দিকে মেইন ফটকের ভেতর বসার জন্য সুন্দর বেঞ্চ করা। পৌষ এগিয়ে এসে সেখানে বসলো। তার পা দুটো চলছে না। এখান থেকে কোথায় যেতে হয় তাও পৌষ জানে না। গাড়ি কোথায় পাওয়া যায় তাও জানে না৷ সারি সারি গাড়ি লন সাইডে রাখা। রাস্তা-ঘাট তো বন্ধ। পৌষ কোথায় যাবে? কোথায় গেলে পাওয়া যাবে তৌসিফ তালুকদার’কে?
শুকনো মুখে পৌষ রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো। ঝড়ের বেগে আসা বাতাস গুলো তার মুখে ঝাপ্টা দিচ্ছে। নাকে ঠান্ডা বাতাস লাগাতে ব্যথা হচ্ছে। ঠোঁট গুলো খুব শিঘ্রই ফেঁটে ফেঁটে এলো। ফ্যাকাসে মুখে পৌষ পথ চেয়ে রইলো।
ম্যানেজার সহ এবার একজন মেয়ে স্টাফও এলো। তারা চেষ্টা করেও পৌষ’কে সরাতে পারলো না। অগত্যা মেয়ে স্টাফ একটা চাদর এনে ওর গায়ে দিয়ে সরে এলো। পৌষ তখনও ঠাই বসা। বিরবির করে বলতে লাগলো,
“কোথায় আপনি? কোথায় গেলেন? আমার কথা কি ভুলে গেলেন? আপনার এত এত ভুল সত্ত্বেও আমি কেন আপনাকে ভুলতে পারি না? এই ঠান্ডার প্রকোপে’র মাঝেও কেন আমার আমার ভেতর জ্বলছে? আপনি আমায় কোন প্রেমে মত্ত করে গেলেন? কেন একা ফেলে গেলেন? আমি কি ভুল ছিলাম? শাস্তি কেন আমার বেলায় এত কঠিন হয়? আপনি কি বুঝেন না? নাকি বুঝেন বলেই আমার শাস্তির সময় বৃদ্ধি করেন? ফিরে আসুন। ফিরে আসুন।”
চোখ দুটো সহসা লাল হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে রাত কাটিয়ে সকাল হলো। ঝড় কমেছে কিছুটা। মানুষ জন চলা ফেরা শুরু করলো। কেউ কেউ পৌষ’কে দেখলো। ম্যানেজার তার নাস্তা পাঠালেও পৌষ ঘুরে তাকালো না৷ তার দৃষ্টি নড়ে নি। সে দেখতে চায় কতক্ষণ তৌসিফ তাকে অপেক্ষা করায়। সময় গড়িয়ে তখন দুপুর। খুবই অল্প সূর্য উঁকি দিলো। এক ফালি রোদ সেকেন্ডের জন্য পৌষ’র উপর পরে পরক্ষণেই হারিয়ে গেলো। দুপুর হতেই লোক যাতায়ত বাড়ে। এত মানুষ আসে অথচ তৌসিফ আসে না।
কালো রঙের একটা গাড়ি লনে আসলো। পৌষ তখনও সোজা দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে। মোটা জ্যাকেট গায়ে গাড়ি থেকে নামলো তৌসিফ। সোজা হেঁটে ভেতরে ঢুকবে সে। খুবই তাড়ায় আছে যেন৷ সে তার হৃদয়ের এক টুকরো এখানে রেখে গিয়েছে। তারাহুরোয় সে আশেপাশে খেয়াল করে না। মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো সে। হঠাৎ ই কপালে ভাজ পরলো। ছাই রঙা চদর গায়ে মুড়িয়ে কেউ একজন বসে আছে বেঞ্চে। তৌফিক তড়িৎ বেগে পিছু ফিরলো। তার হৃদপিণ্ড দাপিয়ে উঠলো ততক্ষণাৎ। সমস্ত শরীর যেন সেকেন্ডের জন্য প্রতিক্রিয়া জানাতে নারাজ হলো। শক্ত-পোক্ত মুখ চোখ হঠাৎই অসহায় হয়ে এলো। অতিরিক্ত চাপ অনুভব হলো তার। দুই একবার এদিক ওদিক তাকালো। সবই তো ঠিক আছে তাহলে কেন তৌসিফ নিজে ঠিক নেই? এই মেয়েটা। এই মেয়েটা পুতুলের মতো এখানে বসে আছে। কিন্তু কেন? এটা কি তার বসার জায়গা? তৌসিফ কি তাকে এখানে রাখতে বলেছে? কেউ কেন তার কলিজার যত্ন নেয় না? কেন তৌসিফ কারো ভরসায় রেখে গেলে বারবার হতাশ হয়? টাকা দিয়েও কেন কাজ হয় না? কেন হয় না? তৌসিফ কি বলে যায় নি ওর জানটার খেয়াল রাখতে? তৌসিফ কি টাকা দিয়ে যায় নি? তাহলে কেন পৌষ এখানে থাকবে? তৌসিফ বাদে কেন কেউ ওর তোতাপাখি’র খেয়াল রাখে না? তৌসিফে’র কান্না পেলো আজ। ভীষণ কান্না পেলো। তার মনে পরলো তার মায়ের কথা। মা বাদে কেউ তার খেয়াল রাখতে পারে নি৷ কখনোই পারে নি। তায়েফা আপা সংসার সামলে তৌসিফ’কে ততটা খেয়াল করতে পারে নি। সে ভালোবেসে গিয়েছে শুধু।
এতিম হওয়া বড় এক জ্বালার বিষয়৷ এদের অতি আপন বলতেও কেউ থাকে না৷ এই এক পৌষ এলো জীবনে অতঃপর খুব কম সময়ই তৌফিক নিজের খেয়াল রেখেছে। তার পায়ের নখটা সহ এই পৌষ কেটে দেয়। এত ভালোবাসা কেন ফিঁকে পরে যায় বারবার। উত্তর তৌসিফ জানে না।
দুই এক পা বাড়িয়ে এগিয়ে এলো বেঞ্চে’র কাছে। আস্তে ধীরে বসলো। একদম গা ঘেঁষে। পৌষ মাথা নিচু করে নিলো। তার দৃষ্টি গোটা এক রাত, এক সকাল পর সরলো এখন৷ তৌসিফ দুই হাতে ওকে টেনে নিজের বুকে নিলো। পৌষ উষ্ণতা পেলো। মুখটা বুকে রাখলো। তৌসিফ ওর মাথাটা চেপে ধরলো সেখানে। কেউ কোন কথা বললো না। খুব যত্নে ওকে কোলে তুললো তৌসিফ। ওরা এগিয়ে গেলো রুমের দিকে। বিছানায় পৌষ’কে রেখে তৌসিফ দরজা আটকালো। রুমে হিটার আছে তবে অফ করা। তৌসিফ তারাতাড়ি তা অন করলো। গতরাত থেকে তাপমাত্রা শুধু কমছে। এগিয়ে এসে গায়ের জ্যাকেট খুলে বিছানায় উঠে গেলো। এক টানে বুকে নিলো পৌষ’কে। আজব, আজ পৌষ কাঁদছে না৷ তৌসিফ ওকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো। বুকে নিয়ে মোটা কম্বলে ঢাকলো। পৌষ’র পুরো শরীর জমে আছে। তৌসিফ দেখলো ওর নামটা ঠান্ডা হয়ে আছে। ও জানে একটু ঠান্ডায়ই নাক ব্যথা করে পৌষ’র। তারাতাড়ি মাথা সহ ঢেকে নিলো৷ তৌসিফে’র শ্বাস-প্রশ্বাসে শিঘ্রই উষ্ণ হলো হাওয়া। পৌষ আরাম পেলো। তৌসিফ ওর কপালে সময় নিয়ে চুমু দিলো। ফাঁটা ঠোঁটজোড়ায় আঙুল বুলালো বেশ কিছুক্ষণ। পৌষ ফ্যাচফ্যাচ করে বললো,
— বাড়ী যাব না?
— যাব।
— ওওহ।
তৌসিফ ওদের মাথা বের করে। পৌষ’কে ধরে বসিয়ে ড্রয়ার থেকে ফোন বের করে কল লাগায় খাবার দিয়ে যেতে। মিনিট পাঁচের মাঝেই হাজির হলো খাবার। পৌষ চুপচাপ খেলো। ওর ক্ষুধা লেগেছে। তৌসিফ নিজেও গোসল সেরে এসে পাশে বসে খেলো। নিজ হাতে পৌষ’র মুখটা মুছে দিয়ে বললো,
— এখন শুনবে?
— শুনব।
গতরাতে তৌসিফ ঠান্ডা মাথায় পৌষ’কে বলেছিলো সে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিবে পৌষ’কে। পিয়াসী এবং ওর গল্প যা আজও অজানা তা জানাবে তৌসিফ। তার জন্য একটু ধৈর্য ধরতে হবে। পৌষ মেনে নিয়েছে। সে ধৈর্য ধরেছে। গতরাতের আদরটুকুও স্বাচ্ছন্দ্যে নিয়েছে। পৌষ’র মত মেয়েরা মানুষ চিনে। পৌষ এতটুকু তো জানে তৌসিফ তাকে অবহেলা করবে না। সে ভালোবাসা চিনে। ভালোবাসার ধরণও চিনে। যেই পৌষ’র জন্য আজ পর্যন্ত তেমন কেউ ব্যস্ত হয় নি সেই পৌষ’র জন্য তৌসিফ সবসময় দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছে। একদিনের আসা প্রশ্নের মুখে পৌষ এতদিনের ভালোবাসা ভুলবে না। তার দ্বারা সম্ভব না।
তৌসিফ পৌষ’র অল্প লাল হওয়া গালে হাত বুলালো। জিজ্ঞেস করলো,
— ব্যথা আছে?
— না।
— আচ্ছা, আমি বলছি তবে তার আগে ওয়াদা করো আমাকে আর ভুল বুঝবে না পৌষরাত। এই প্রথম কৈফিয়ত দিচ্ছি কাউকে আমি। এমন কাজের কৈফিয়ত যার প্রয়োজন আমার জীবনে নেই৷ না আছে গুরুত্ব।
— কৈফিয়ত দিয়ে যদি সবটা সুন্দর হয় তাহলে দিতে মন্দ কি?
— এত ভালোবাসা আজ পর্যন্ত কাউকে বসি নি নাহয় কৈফিয়তে’র প্রশ্নই উঠতো না।
তৌসিফ একটু থামলো৷ পৌষ’র হাত দুটো ধরে বলা শুরু করলো,
— আমার পিঠে কালো দাগ দেখে একদিন তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে ওটা কিসের দাগ। পায়েও দাগ দেখেছো।
— হ্যাঁ।
— পিয়ু’র সাথে ডিভোর্সে’র পর একরাতে ড্রিংক করে গাড়ি চালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। ব্লাড রেয়ার হওয়ায় পাওয়া যায় নি। সেদিন আমাকে র’ক্ত দিয়েছিলো সোহা। ওর সাথে র’ক্তের কোন সম্পর্ক আমার নেই তবুও ও আমাকে সেদিন যেই উপকার করেছিলো তার বৈদলতে আজ আমি এখানে বসে আছি। পাঁচ মাস হাঁটতে পারি নি। বাসায় ছিলাম। সোহা আমাকে সাহায্য করেছে বিভিন্নভাবে…
কথা শেষ হওয়ার মাঝে পৌষ প্রশ্ন করে,
— কেমন সাহায্য?
— এই তো বউ বলে কথা।
— বলুন ঠিকঠাক।
— বিজনেসের কাজে সাহায্য করেছে। সেই সুবাদে দুই এক ঘন্টা রুমে থাকা হতো ওর। কাজের লোকরা ভাবীদের কানে এসব কথা দিলো। তারা তিলকে তাল বানিয়ে ছাড়ালো সোহা’র সাথে আমার অবৈধ সম্পর্ক। কেউ কেউ বলতো আমি ওকে বিয়ে করে নিয়েছি। কেউ বলতো, “কাজের মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক”। ওপর ওয়ালার কসম কেটে বলছি, আমার সামনে আজ পর্যন্ত কেউ এই কথা বলে নি। যদি বলতো হয়তো উত্তর আমি দিতাম ভিন্ন ভাবে। ঘরের শক্র বিভীষক। আমার দুই ভাবি ছড়িয়েছে এই কথা।
সোহা’র ঐ উপকারের বিনিময়ে আমি কখনোই ওকে তেমন কিছু বলতাম না৷ উল্টো আমার জন্য একটা মেয়ের চরিত্র খারাপ হয়েছে সকলের দৃষ্টিতে। শেষ সময়ে হয়তো ও খারাপ করতে চেয়েছে তাই সেই নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরে ওকে পাঠিয়েছি আমি। সেখানে ও বুঝবে জীবন কোথায় ছিলো ওর। তবে হ্যাঁ, মেহেদী ভালো ছেলে তার নিশ্চয়তা আমি দিচ্ছি। আমি ওর খারাপ করি নি। যেই লোভ ও করেছে সেই কিছু সম্পত্তি ও ওকে দিয়েছি।
দম আটকে পৌষ প্রশ্ন করে,
— পিয়াসী কেন বললো সোহা’র কথা?
— আমি কি জানি?
— মানে?
— এটা পিয়ু জানে। পিয়ু থাকাকালীন সোহা খুব কম আমাদের সাথে ছিলো। বেশির ভাগ গ্রামে ছিলো। আর ওর সাথে পিয়ু’র সম্পর্ক ভালো ছিলো। আমি আন্দাজে বলতে পারি, হয়তো তোমাকে নাড়া দিতেই ও সোহা’কে টেনেছে?
— কিভাবে জানলো?
তৌসিফ বিরক্ত হলো। বললো,
— হাউ ক্যান আই নো?
পরক্ষণেই বললো,
— বড় ভাবী বলতে পারে।
— উনি কেন বলবে?
— বড় ভাবীর সৎ বোন পিয়ু।
” কিহ”!
এক প্রকার চিৎকার করে উঠলো পৌষ। তৌসিফ হাসলো। বললো,
— জীবন রহস্যে ঘেরা পৌষরাত। যত গভীরে ঢুকবে তত অতলে হারাবে।
— ও কেন বললো ভিন্ন নারী সঙ্গী?
— ডিভোর্সের পর চিল ছিলাম৷ পিয়ু এক বিদেশি ছেলের সঙ্গে ভেগেছিলো। আমার মুখে কালি দিয়ে ও পালিয়েছিলো। ক্লবে যাতায়াত বেড়েছিলো। তবে আমার বুকে হাত রেখে বলছি পৌষরাত, দ্বিতীয় নারী আমার জীবনে তুমি। পিয়ু’র পর তুমি বাদে কাউকে গভীর ভাবে স্পর্শ করিনি।
— হালকা ভাবে করেছেন?
— হুঁ।
— কিভাবে?
— ঐ হাত ধরা পর্যন্ত।
— লুইচ্চামি তো ছাড়লেন না।
— ওহহো পৌষরাত। একবার ধরেছিলাম ভুলে। বন্ধুদের পাল্লায় পরে। তবে ঐ হাতই ধরেছিলাম। কিসিমিসি হয়নি।
পৌষ চুপ রইলো। ভেতরে খুব সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। ও জানে তবুও কেন জানি তৌসিফ আগে কারো ছিলো তা আজ মানতে কষ্ট হচ্ছে। তৌসিফ পৌষ’র গালে চুমু দিয়ে বললো,
— এটার জন্য আমি খুব করে মাফ চাইছি।
— আচ্ছা, যেদিন আমরা এখানে আসব সেদিন হেডলাইনে দেখলাম আপনার উপর থেকে সকল মামলা তুলে নেয়া হয়েছে তাহলে কাল রাতে আপনি মামলার কথা বললেন ফোনে। কেন?
তৌসিফ মৃদু হাসলো। বললো,
— ঐ যে বলেছিলাম না, “কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না”। আমি ভেবেছিলাম রাজনৈতিক কোন কারণে আমার জাহাজে মাদকাদ্রব্য চালান করা হয়েছে কিন্তু না সেই কাজ করেছিলো পিয়ু’র বর্তমান জামাই। পিয়ু’র নামে আমি কিছু সম্পদ লিখে দিয়েছিলাম। যা ও ভেগে যেতেই সরিয়ে ফেলেছি। তার মধ্যে জাহাজেরও কিছু ছিলো। ও সেটা হাতিয়ে নিতেই ঐ চাল চেলেছিলো। দেশে এর বিচার সম্ভব না। তাই একই সাথে হানিমুন আর কোর্টের কাজ সামাল দিতে এখানে আসা। কাল থেকে আজ পর্যন্ত পিয়ু’র স্বামী’কে কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করে এলাম। এত দেড়ী হলো কারণ আবহাওয়ার কারণে রাস্তা বন্ধ ছিলো।
ও জানতো আমি এজন্যই এসেছি তাই শেষ সুযোগে সংসার ভাঙতে তোমাকে টার্গেট করেছিলো আর ও সফল হয়েছে পৌষরাত। দুই মিনিটে তুমি বিশ্বাস ভেঙে ফেললে।
পৌষ অবাক হয়ে বললো,
— গতরাত থেকে ভাবছিলাম আপনি আমাকে কুকুর বলেছেন।
তৌসিফ কপাল কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— মাথা গেছে তোমার? এইখানে শুধু আমি ছাড় দিয়েছিলাম বলে পিয়ু এত বাড় বাড়তে পেরেছে নাহয় এতদিন থালা হাতে ভিক্ষা করত। এখন কোর্টের চক্কর কাটবে কয়েকবছর। তোমার মাথা এতদিকে চলে এই দিকে চললো না?
পৌষ নিজের ভুল সরাসরি ঢাকতে চাইলো। হুরমুর করে বলে উঠলো,
— সব বুঝলাম কিন্তু এখনও ঐ ** কে পিয়ু পিয়ু করছেন কেন? লজ্জা করে না?
তৌসিফ বিরক্ত হলো। বললো,
— ও আমার ক্লাসমেট ছিল পৌষরাত। ওকে আমরা কেউই কখনো পিয়াসী ডাকি নি। সবাই পিয়া অথবা পিয়ু ডেকেছি।
পৌষ সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে চুপ হয়ে গেলো। তৌসিফ ওকে কাছে টানলো। নিজের কোলে বসিয়ে কাঁধে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করলো,
— গতরাতে বেশি কষ্ট পেয়েছিলে?
— হুঁ।
— এখন কমলো?
— হুঁ।
— আদরে ব্যথা বেশি ছিলো?
— একটু একটু।
— এখন ঠিক আছো?
— একটু একটু।
— আমি কাছে না থাকলে এমন দেবদাসী হয়ে যাও কেন পৌষরাত? আমাকে জ্বালাও কেন? তখন এভাবে কেন বসে ছিলো? তোমাকে দেখে আমার কেমন লেগেছে বলো তো?
— আমার তো ভেতর জ্বলে যাচ্ছিলো। খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আমার তো আপনি ছাড়া কেউ নেই।
— যদি কেউ হয়?
— কেন আপনি ছেড়ে দিবেন আমাকে?
— জানে মে’রে দিব তবুও ছাড়ব না।
— তাহলে?
— তাহলে বুঝাচ্ছি তোমাকে।
— একটুও না৷ দামড়া ব্যাটা। আমি ম’রে যাব। ছাড়ুন।
পৌষ’র কথায় তৌসিফ হেসে ফেললো। আলগোছে ওকে বুকে আগলে নিলো। ও জানে পৌষ ওকে ছাড়বে না। সেই রাস্তা তৌসিফ রাখে নি। তাদের বিবাহ নামায় এটা লিখা ছিলো। পৌষ স্বেচ্ছায় কোনদিনই তৌসিফ’কে তালাক দিতে পারবে না। হয়তো পৌষ জানে না কিন্তু তৌসিফ সহ বাকিরা জানে। তবুও কেন জানি তৌসিফ একটু উনিশ, বিশ হলেই হয় পায়। পৌষ’কে হারানোর ভয়।
পৌষ আস্তে করে বললো,
— দেশে কবে যাব?
— আর কিছুদিন থাকি?
— একদিনও থাকতে চাই না।
— কারণ?
— আমি ভয় পাই।
— কিসে?
— আপনাকে হারানোর ভয় হয় আমার। যদি এখানে হারিয়ে ফেলি?
তৌসিফ পৌষ’র গালটায় আদর দিলো। চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বললো,
— খুব সরি আমি।
— আমিও।
— তোমার আর প্রশ্ন আছে?
— আপাতত নেই।
বলেই পৌষ হাসলো। সে ভালোবাসে এই পুরুষটাকে। বয়সে বড় মানুষটাকে দেখলেই এখন প্রেম প্রেম লাগে। তৌসিফ নামটাই তার কাছে এখন আস্ত এক ভালোবাসা।
#চলবে….