#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৬৯
পৌষ’র টনটনা কণ্ঠে মেয়েটা সরে দাঁড়ালো। তৌসিফ শান্ত দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে। হাবভাব এমন যে সে কিছুই বলবে না। শুধু মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে ছোট্ট করে বললো,
— ইউ মে গো নাও।
মেয়েটা তখনও অবাক হয়ে আছে। তার পোশাক-আশাক পৌষ’র পছন্দ হলো না। মেয়েটা চলে যেতেই তৌসিফ ইশারায় কাউন্টারের মেয়েটাকেও চলে যেতে বললো। দরজা আটকে মেয়েটা চলে গেলো৷ পৌষ হাতের ব্যাগ সাইডে রেখে বড় বড় পা ফেলে তৌসিফে’র কাছাকাছি চলে এলো। দূরত্ব কমা মাত্রই সে তৌসিফে’র কোলে বসে নিজের স্থান বুঝে নিলো। মুখটা খুলতেই তৌসিফ দেখলো অল্প ঘর্মাক্ত এক মুখ। আশ্চর্যের বিষয় পৌষ’কে আজ একটু অন্যরকম লাগছে। তৌসিফ কারণ বুঝলো না অবশ্য। মুহুর্তের মাঝে পৌষ ওর গলা জড়িয়ে ধরলো। তখনই কেউ গলা খেঁকানি দিয়ে দুটো কাশি দিলো। পৌষ ছিটকে দাঁড়িয়ে গেলো। দেয়ালের একদম সাইডে ইমু দাঁড়িয়ে। ছেলেটাকে পৌষ একবার হয়তো দেখেছিলো। মনে পরছে না৷ লজ্জায় ওর হাতের তালু ঘামছে। নাকে পানি জমে কান্না পাচ্ছে। ইমু ক্যাবলা কান্তের মতো হেসে মাথা চুলকে তৌসিফ’কে বললো,
— স্যার আমি যাব?
তৌসিফ চোখ গরম তাকালো যেন চোখের ইশারায় প্রশ্ন করলো, “যাবে না তো কি করবে? আমার বউ আমাকে কিভাবে আদর করে তা দেখবে?”
ইমু বুঝলো। ভয় পেয়ে যথারীতি স্থান ত্যাগ করলো। একদিক দিয়ে ইমু ভাগলো আরেকদিক দিয়ে পৌষ পুণরায় তৌসিফে’র কোলে বসলো। দুই হাতে তৌসিফে’র গাল ধরে আস্তে করে তৌসিফে’র কপালে চুমু খেলো। পরপরই দুই গাল সহ দাঁড়ি যুক্ত চোয়ালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। খাঁড়া নাকটায় ঠোঁট ছোঁয়াতেই তৌসিফ থুতনি এগিয়ে দিলো। পৌষ ঝটপট করে সেখানেও চুমু দিলো। আস্তে করে তৌসিফে’র টাই ঠিলা করে গলার দিকের দুটো বোতাম খুলে গলায় মুখ গুজে দিলো। ওর ব্যালেন্স ঠিক রাখতে তৌসিফ ওর পিঠে হাত দিলো।
পৌষ ওভাবে থেকেই অভিযোগ করলো,
— সকালে এভাবে রেগে চলে এলেন যে? আমার পরীক্ষা আপনি জানেন না? না জানলেও কেন রাগ করবেন? বউ এর সাথে রাগ করে কেউ লাঞ্চ না দিয়ে আসে? পেট ঠান্ডা তো দুনিয়া ঠান্ডা। আপনি কতটা চালাক পুরুষ! আপনি জানতেন আপনার চিন্তায় চিন্তায় আমি পা’গল হব তাই এই পায়তারা। আমি কি বোকা? বুঝি না? আমাকে কষ্ট দিয়ে শান্তি লেগেছে?দুষ্ট জামাই।
তৌসিফ একদম চুপ করে আছে। ওর চোয়াল শক্ত। পৌষ পিঠে চাপ পড়ায় অল্প ব্যথা পেলো। গলায় মুখ রেখেই আস্তে করে বললো,
— ব্যথা পাই।
তৌসিফ শুনলো না। আরেকটু চাপ দিলো বরং। পৌষ’র মনে হচ্ছে জায়গাটায় বুঝি নখ ডাবিয়ে দিচ্ছে তৌসিফ। পৌষ মুচড়ে উঠে। ব্যথাকাতুর শব্দ তুলে অথচ মেয়েটা নড়ে না। অবস্থান তার ঠিক আগের মতোই। এই পর্যায় না পেরে তৌসিফে’র বুকের দিকের শার্টটা খামচে ধরে। তৌসিফ আস্তে করে ছেড়ে দিলো ওকে। পৌষ টের পেলো তৌসিফ জোরে জোরে শ্বাস টানছে। ভয়ে পৌষ এবার মুখ তুলছে না৷ এতটা রাগ উঠলো কেন তার? পৌষ আসাতে? বরাবরই পৌষ’র মাথায় সঠিক ধারণা এলো না।
তৌসিফ ওকে নিজের থেকে ছাড়ালো। পা দুটো নিজের উপর থেকে সরাতে নিলেই পৌষ বুঝলো তাকে নামাতে বলা হচ্ছে। ভয়ে তারাতাড়ি নেমে গেলো পৌষ। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। তৌসিফ ওর তারাহুরো ভাব দেখলো। এটাও বুঝলো ভয়ে এই দশা ওর। গম্ভীর থেকেও গম্ভীর কণ্ঠে তৌসিফ প্রশ্ন করে,
— এটা কোন জায়গা আমার?
পৌষ’র ঠোঁট কাঁপতে লাগলো। কোনমতে মতে বললো,
— কাজের জায়গা। আর আসব না।
তৌসিফ বিরক্ত হয়ে বললো,
— বেশি বুঝতে বলি নি। এখন বলো, কাজের জায়গায় আমাকে কিভাবে আশা করো তুমি?
— কাজ করা অবস্থায়।
— কি দেখলে কি করছিলাম আমি?
— জানি না৷
— ফাইল সাইন করছিলাম। দেখেছো?
— জ্বি।
— ঐ মেয়েটা এখানে কাজ করে। সে ফাইল সাইন করাচ্ছিলো। আগামী পরশু শিপিং যাবে তাই।
— আচ্ছা।
— সে কাজ করছিলো।
— বেশি ঝুঁকে ছিলো।
— আমি তাকিয়েছিলাম?
— না।
— কাউন্টারের মেয়েটার দায়িত্ব আমার কেবিনে অনুমতি ছাড়া কাউকে ঢুকতে না দেয়া। এর জন্য মাস শেষে মোটা অংকের টাকা দেই তাকে। এখন বলো সে কি ভুল করেছে তোমাকে আটকে?
— না।
— ভুল কার?
— আমার।
— ভুল কারীর কি করা উচিত?
— মাফ চাওয়া উচিত।
— ওদের ডাকছি।
পৌষ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পা দুটো হঠাৎ ঝিমঝিম করছে। ওর বসতে মন চাইলো। ভেতরে কেমন ধকধক করছে। আসলেই তো ও কেন এমন করলো? মেয়েগুলোর দোষ ছিলো না কিন্তু ঐ মেয়েটাকে তৌসিফে’র কাছাকাছি দেখেও ভালো লাগে নি ওর। সাধারণ স্ত্রী সুলভ আচরন তার মাঝে আছে। একটু অতিরিক্তই আছে। তৌসিফ ইমু’কে ফোন দিয়ে মেয়ে দু’জনকে ডাকালো। তারা নিজেরাই ভয় পেয়ে আছে। ঢুকে ভেতরে দাঁড়াতেই দেখলো পৌষ দাঁড়িয়ে আছে। তৌসিফ বসা। দু’জনই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। নীরবতা ভেঙে পৌষ বিনয়ী কণ্ঠে বললো,
— আমি খুবই দুঃখীত আপু। আমার ভুল হয়েছে। নিজের আচরণের জন্য মাফ চাইছি।
বলে পৌষ তাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। দু’জন অপ্রস্তুত হলো। মেয়ে দুটো যথাসম্ভব আধুনিক পোশাকে আছে। বেশ অবাকই হলো।
তারা ভদ্রতার সহিত মাথা নাড়লো। বললো,
— ইটস ওকে ম্যাম।
এতক্ষণে তৌসিফ মুখ খুললো। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
— মাই ওয়াইফ।
মেয়ে দুটো ততটা অবাক হলো না। ইতিমধ্যে তারা জেনেছে ইমু থেকে। তৌসিফ তাদের যেতে বলতেই তারা চলে গেলো। পৌষ পা বাড়িয়ে যেতে নিলেই তৌসিফ পেছন থেকে হাত ধরে ফেললো। কণ্ঠ তার এখনও গম্ভীর। বললো,
— যেই কাজে এসেছো তা করো।
পৌষ ঘুরে দাঁড়ালো। অল্প হেসে বললো,
— হাত ধুয়ে আসি।
তৌসিফ হাত ছাড়লো। জানালো,
— রাইট সাইডের পাশে ওয়াশরুম।
পৌষ মাথা নেড়ে সেখানে গিয়ে হাত ধুঁয়ে এলো। আসতেই দেখলো টেবিলে প্লেট আর গ্লাস রাখা। ইমু’কে দেখে পৌষ হালকা স্বরে বললো,
— ভাইয়া, খেয়েছেন?
ইমু ভড়কালো। মাথা তিনবার নেড়ে বললো,
— না ম্যাম খাব।
— গরুর ভুনা রেঁধেছি। বেশি এনেছি। আপনিও বসুন।
ইমু যেন ভয় পেয়ে গেলো। স্যারের সাথে লাঞ্চ করা হয় কোথাও গেলে কিন্তু এখন তার বউয়ের সাথে বসলে তাকে চোখ দিয়ে গিলে নিবে। ইমু ভ্যাবলার মতো হেসে বললো,
— ইয়ে ম্যাম আরেকদিন…
পৌষ মাথা নাড়লো। ইমু চলে গেলো। পৌষ টেবিলের কাছে এসে বক্স থেকে খাবার বের করে প্লেটে সার্ভ করছে। তৌসিফ এই পর্যন্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে নি। ঠাই বসে আছে সে। পৌষ ওর সামনে প্লেট এগিয়ে দিতেই তৌসিফ বলে উঠলো,
— নিয়ে এসেছো তো খায়িয়ে দাও।
কোনরূপ দুষ্টামি না করে পৌষ প্লেট হাতে নিলো। ভাত মাখিয়ে তৌসিফে’র মুখের সামনে দিলো। তৌসিফ চুপ করে খাচ্ছে। এক প্লেট খাওয়া হতেই পৌষ আবার নিলো। তৌসিফ সবটুকু খেয়ে পানি খেয়ে উঠে নিজে হাত ধুঁয়ে এলো। পৌষ বাটি গোছাতে নিলেই তৌসিফ এসে ওকে বসালো নিজের চেয়ারে। বিশাল বড় জায়গাটায় পৌষ বসেও যেন দুইজন বসার জায়গা অবশিষ্ট। তৌসিফ এবার ঐ প্লেটে করে ওকে খাওয়ালো। আধ প্লেট খেয়ে পৌষ বললো,
— আর খাব না।
তবুও দুই লোকমা অতিরিক্ত তৌসিফ খাওয়ালো। পৌষ নিজে সবটা গুছিয়ে ব্যাগে ভরলো। হাত ধুয়ে এসে বললো,
— এখন যাচ্ছি তাহলে।
— কোথায়?
— বাসায়।
তৌসিফ কথা বললো না। এগিয়ে এসে সোজা পাজা কোলে তুললো পৌষ’কে। এগিয়ে এলো বাম দিকের কোণার দরজার কাছে। পৌষ অবাক হয়ে দেখলো এখানে একটা রুম। পরিপাটি গোছানো একজনের থাকার মতো সবকিছুই আছে। তৌসিফে এখানেই হয়তো আরাম করে। ওকে বিছানায় বসিয়ে পরণে থাকা বোরকা খুলে দিলো তৌসিফ। সাইডে রেখে আস্তে করে নিজের কাছে টেনে নিলো। দু’জনের মাঝে কোনরূপ ঘটনার ব্যখা কেউ চাইলো না। তারা নিশ্চুপ। আশেপাশের খবরও তারা নিলো না। শুধু তৌসিফে’র বুকে চেপে রইলো পৌষ। প্রায় আধ ঘন্টা পর তৌসিফ কিছু বলতে চাইলো। পৌষ’র মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলো,
— পৌষরাত, শুনছো?
সাড়া এলো না৷ তৌসিফ দেখলো পৌষ পুরোপুরি ঘুমে। ঘুমন্ত মুখটায় আদর দিয়ে আস্তে করে উঠলো তৌসিফ। পৌষ’র পরণের জামা খুলে পিঠ দেখলো। লাল হয়ে দাগ পরে আছে। আস্তে করে সেথায় চুমু দিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা মলম নিয়ে লাগালো সেখানে। পায়ের কাছ থেকে কম্বল নিয়ে দু’জনকে ঢেকে নিলো। ইমু’কে ফোন দিয়ে শুধু বললো,
— মিটিংটা শেষ করো তুমি। রাতে ফাইল মেইল করে দিও।
পৌষ’কে বুকে নিয়ে তৌসিফ চোখ বুজলো। সংসার জীবন এক তরফায় চলে না। এখানে সম্মান যতটা জরুরি ঠিক ততটাই জরুরি শাসন। প্রেম যতটা জরুরি ততটা জরুরি বোঝাপড়া। ভালোবাসা যতটা ভালো সংসারে অবদান রাখে, ঠিক ততটা অবদান রাখে সমঝোতা।
__________________
চোখ খুলে নিজেকে আবদ্ধ অবস্থায় পেলো পৌষ। তৌসিফ কাছে নেই। ভালো একটা ঘুম হওয়ার ওর ভালো লাগছে। চোখ খুলা মাত্র কিছুটা আতঙ্কিত হলো। আতঙ্ক বাড়লো যখন দেখলো কম্বলের নীচে ওর গায়ে পোশাক নেই। ততক্ষণাৎ মনে পরলো এটা তৌসিফে’র অফিস। মাথাটা উঁচু করে এদিক ওদিক নিজের পোশাক খুঁজেও যখন পেলো না তখন তৌসিফ’কে হালকা স্বরে ডাকলো,
— শুনছেন? কোথায় আপনি?
অফিস বলে বেশি জোরে ডাকলো না পৌষ। দেখা গেলো মিনিট পাঁচ পরই কফির মগ হাতে ভেতরে এসে লাইট জ্বালালো তৌসিফ। চোখ বুজে কপাল কুঁচকায় রোদ। মাথা নেড়ে বলে,
— আমার জামা কোথায়?
— আমার কাছে।
আস্তে ধীরে চোখ খুললো পৌষ। তৌসিফ কফির মগ সাইডে রেখে বললো,
— মুখ ধুয়ে এসো।
— জামা দিন।
বাকা চোখে তাকিয়ে তৌসিফ বললো,
— সমস্যা কোথায়?
পৌষ তেজ দেখিয়ে বললো,
— ভালোয় ভালোয় দিন৷ ঘুমের সুযোগ নিয়েছেন আপনি? খারাপ লোক।
— সুযোগ দিবে তুমি। এদিকে সুযোগ নিলে আমার দোষ?
— দেখুন ভাই, দয়া করে দিন।
তৌসিফ আহত চোখে তাকালো। পৌষ বুঝলো। এবার প্রাকৃতিক ভাবেই ভাই ডেকেছে সে। পৌষ পুণরায় বলে উঠলো,
— ভালোয় ভালোয় দিন নাহয় অফিসের মধ্যে ঝামোল পাকিয়ে দিব।
— তুমি ভালো হলে না।
— জামাই হতে দিলো না।
তৌসিফ সাইড থেকে জামাটা দিতেই পৌষ কম্বলের নীচে ঢুকে পরতে নিলো। তখনই এক টান দিয়ে কম্বল সরায় তৌসিফ। পৌষ কথা বাড়ালো না। উঠে বাথরুমে চলে গেল। তৌসিফ খেয়াল করলো পৌষ শান্ত হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা হতে চললো। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তাই পৌষ’কে রেখে দিয়েছে ও। এখান থেকেই সোজা হসপিটাল যাবে তারা।
পৌষ ফিরা মাত্রই তৌসিফ বললো,
— হানি, কফিটা শেষ করো। ব্রেড আছে সাথে।
— অন্য কিছু খাব।
— কি খাবে?
— ঝাল।
— বাইরে খাব। এখন এটা খাও।
পৌষ’কে খেতে দিয়ে তৌসিফ বের হলো। তার টুকটাক কাজ আছে। পৌষ এদিক ওদিক হেঁটে হেঁটে ঘরটা দেখলো। সুন্দর এবং গোছানো। ঠিক যেমন হওয়া উচিত তৌসিফ তালুকদারের।
পৌষ বিছানায় বসে বিভিন্ন ভাবনায় হারালো। তার জীবনের হিসেব কষতে বসলেই পৌষ এলোমেলো হয়ে যায়। থমকে যায়। অতীত হাতড়ে ভালো কিছু পায় না। ভাই-বোন বাদে তেমন ভালো স্মৃতি তার নেই। মাঝেমধ্যে কেমন আফসোস হয়। এখন আবার বিষন্ন লাগছে নিজেকে। মনে হচ্ছে ও ক্লান্ত।
কফিটা শেষ পথে। পৌষ’র হঠাৎ কান্না পেলো। বাম হাতে চোখ মুছতে নিলেই তৌসিফ ফিরে এলো। দরজায় দাঁড়িয়ে পৌষ’র চোখ মুছাটাও দৃষ্টির আড়াল হয়নি ওর।
আসতে আসতে বললো,
— পৌষরাত, রেডি হও।
— বাসায় যাচ্ছি?
— হসপিটালে।
— আমি যেতে চাই না।
— ইউ হ্যাব নো চয়েজ হানি।
পৌষ মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তৌসিফ ওকে বোরকা পরতে সাহায্য করলো। দুই গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো পৌষ’র চোখে। এত ব্যথা কেন ওর চোখ জুড়ে? কিসের এত কষ্ট? তৌসিফ প্রশ্ন করলো,
— বেশি বকেছি?
— একটু।
— মানুষ আমাকে হাজার দেখুক আমি তো শুধু তোমাকে দেখি। কি দেখি না?
— হ্যাঁ।
— ভালোবাসি না?
— হ্যাঁ।
— তাহলে….
— বাইরে চলি। এখানে দমবন্ধ লাগছে।
বলতে বলতে ওর যেন সত্যিই দমবন্ধ হয়ে আসছে। তৌসিফের চিন্তা হলো। পৌষ’কে নিয়ে বের হলো।
ইমু’কে বিদায় জানিয়ে পৌষ আগে আগে বের হতে নিলেই তৌসিফ পেছন থেকে ধরে ফেলে। নিজে ওর কাঁধ জড়িয়ে ধরে যেন সে সবাইকে মুখে না বলে চালচলনে বুঝাচ্ছে তার অর্ধাঙ্গিনী তার সাথে। তার ভালোবাসা তার সাথে।
.
ডাক্তারের কেবিনে ঢুকা মাত্রই তিনি হাসিমুখে ওদের বসতে বলেন। তৌসিফ পৌষ’র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই ডাক্তার মুচকি হাসলেন। তৌসিফ চুপ করে গেলো। ওর বুকের ভেতর শীতল এক স্রোত চলে গেল যেন। পিঠের শিরদাঁড়া দিয়ে বেয়ে নামলো ঠান্ডা এক রেশ। তৌসিফ জানতো। ওর মন বলছিলো। তার থেকে গভীর ভাবে কে দেখে তার পৌষরাত’কে? কেউ না। তার থেকে কে অধিক মনোযোগী তার পৌষ’র ক্ষেত্রে? এটার উত্তরও কেউ না। তৌসিফে’র শুধু চিন্তা হচ্ছে। অজানা এক চিন্তা।
পৌষ এদের হাবভাবে কিছুই বুঝলো না। হঠাৎ ওর মাথা ব্যথা করছে। ডাক্তার ওকে বললো,
— আমার সাথে এসো পৌষ।
পৌষ তাকালো তৌসিফে’র দিকে। তৌসিফ যেতে বললো। পৌষ যেতেই তৌসিফে’র কানে ব্যথা-ক্রন্দন শব্দ এলো। কপাল কুঁচকে ও উঠে দাঁড়িয়ে সোজা ভেতরে চলে এলো। ডাক্তার চমকালো। পৌষ পিঠের দিকে হাত দিয়ে বসে আছে। তৌসিফে’র কেমন লাগলো? ভেতরটা না ঝাঁঝড়া হয়ে গেলো। কে দিলো এই ব্যথা? তৌসিফ নিজে। নিজের উপর রাগ হলো ওর। ভীষণ রাগ। পৌষ ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
— আমার কাছে আসুন। ভয় লাগছে।
তৌসিফ দেড়ী করলো না। এসেই ওর হাত ধরলো। ডাক্তার কিছু বললো না। পৌষ’র পেট চেপে চেকআপ করতেই মুখ কুঁচকে নিলো পৌষ। পেটে চাপ লাগলেই ব্যথা লাগছে। তৌসিফ স্পষ্ট দেখলো তা। ডাক্তার মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— আল্ট্রা করি? দেখবে?
তৌসিফ কি বলবে তার আগেই পৌষ জিজ্ঞেস করলো,
— কি দেখবে? পেটে মানুষের কি থাকে? নাড়িভুড়ি দেখব না আমি।
ডাক্তার হেসে ফেললেন। তৌসিফ পৌষ’র হাতটা শক্ত করে ধরলো। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো,
— করুন।
পৌষ’র বুকটা টিপটিপ করছে। কিছুটা আন্দাজ তো সেও করছে। তৌসিফ দেখলো পৌষ ঘামছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ওর মুখটা মুছে দিতেই পৌষ তৌসিফে’র হাতটা বুকে চেপে ধরে। তৌসিফ সহ ডাক্তার টের পেলো পৌষ কাঁপছে। মেয়েটা এত ভয় কেন পাচ্ছে। প্রথম অনুভবের তীব্রতা সে কাকে বুঝাবে? কে বুঝবে?
ডাক্তার ওদের দু’জনকে অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— হার্টবিট চলে এসেছে? শুনবে?
তৌসিফ মাথা নাড়ে। সবার আগে তৌসিফ শুনলো বাবুর হার্টবিট। তৌসিফ চুপ করে শুনে গেলো। পৌষ বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ফাঁকা ঢোক গিলে বললো,
— আমাকে দিন।
তৌসিফ পৌষ’র কানে দিয়েই দু’জনের কপাল এক করে দিলো। পৌষ স্তব্ধ হয়ে আছে। ডাক্তার জানালো পৌষ তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পৌষ’র লক্ষণ দেখা দিলেও ওরা বুঝতে পারে নি। তৌসিফ সন্দেহ করেছিলো। অস্ট্রেলিয়ার হানিমুনের সময়ই তার যথাযথ সন্দেহ হয়েছিলো। এলোমেলো ভাবে থাকায় এই রহমত বর্ষণ হয়েছে। দুজন যেন একদমই থমকে গেলো।
পৌষ’কে রেখে ডাক্তারের সাথে কথা বললো তৌসিফ। জানালো,
— ওর মুড সুইং তীব্র মাত্রায় হচ্ছে। এত রাগ দেখাচ্ছে যা বলার বাইরে। আজ আবার একদম চুপ করে গিয়েছে।
ডাক্তার অল্প হেসে বললেন,
— কিছুদিন আগে একটা কেস এলো। বাইশ বছরের অন্তঃসত্ত্বা এক মেয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিলো। ভাবো কতটা মুড সুইং হচ্ছিলো। হরমোন জনিত কারণে এটা মানুষ টু মানুষ ভ্যারী করে। ওর খেয়াল রাখো। মুড সুইং একদমই স্বাভাবিক। আপাতত কোন ঝামেলা দেখছি না। সি ইজ ফাইন। বমি হবেই। মাথা ঘুরবেই। এগুলো তো খুবই সাধারণ তৌসিফ। আর হ্যাঁ খাওয়া দাওয়া একটু খেয়াল রাখো। ওর তো আয়রনের একটা সমস্যা আছে জানোই।
তৌসিফ মাথা নাড়লো। ডাক্তার চার্টে টুকটাক অনেক কিছু লিখে দিলো। তখনই ওদের রিপোর্ট দিয়ে গেলো নার্স। ডাক্তার রিপোর্ট খুলতে খুলতে পৌষ চলে এলো। দুজন’কে অবাক করে দিয়ে ডাক্তার হেসে ফেললেন। বলে উঠলেন,
— অভিনন্দন, একসাথে দু’জন আসতে চলেছে। ফিটাস দুটো।
তৌসিফ হা হয়ে গেলো। কোথায় আল্ট্রায় তো দেখলো না। ডাক্তার জানালো এমন হয়। তারা রিপোর্ট দেখেই নিশ্চিত জানালেন।
পৌষ চুপ করে একদম মিহিয়ে গেলো। তৌসিফে’র অনুভূতি এলোমেলো। পৌষ’কে নিয়ে ও বাড়ী ফিরতে ফিরতে রাত নয়টার বেশি। ওদের মাঝে কোন কথা সারা রাস্তায় হয় নি। পৌষ চুপ করে তৌসিফে’র বুকে লেগে ছিলো।
বাসায় এসেই পৌষ’কে ফ্রেশ করালো তৌসিফ। নিজেও ফ্রেশ হয়ে এসো বসলো পৌষ’র কাছে। আস্তে করে হাত বাড়াতেই পৌষ কাছে আসে। একসময় বুকে যায়। এত ঘন্টা পর পৌষ’র যেন মাতৃত্ব জেগে উঠলো। হু হু করে কেঁদে উঠলো ও। তৌসিফ কাঁদে না। তার হাত একটা পৌষ’র পেটে। এখানে তার অস্তিত্ব। দুই দুটো জান। তৌসিফ অনুভব করার চেষ্টা করে। সে ব্যার্থ হয়। ব্যার্থ হয় অনুভূতি গোছাতে। পৌষ’র মাথাটা আরেকটু চেপে ধরে বুকে।
#চলবে….
#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৭০
আকাশে আজ গোল চাঁদ উঠেছে। আশেপাশে কোন তারা নেই। পুকুরের পানিতে জ্বলজ্বল করছে চাঁদের প্রতিচ্ছবি। তাকাতেই যেন চোখে বিঁধে তীক্ষ্ণ সূচের ন্যায়। এই মাঝরাতে বারান্দার থাই খুলে বসে আছে তৌসিফ। বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না তেমন৷ ঘাটে পানি দেয়া হয়েছিলো এই দুই মাস। পৌষ’র খুব পছন্দ। তৌসিফ ভেবেছে বসার জায়গার চারপাশ ঢেকে দিবে। কৃষ্ণচূড়ার জন্য সামনের রাস্তা থেকে সরাসরি কেউ দেখতে পায় না। তবুও তৌসিফ চাইছে না এই সময় কেউ দেখুক পৌষ’কে। যদি নজর লেগে যায়? তৌসিফে’র মনের ভেতর এখন আতঙ্ক ঢুকেছে। তার মস্তিষ্ক তাকে বারংবার খুঁচিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে ডাক্তারের বলা কথাটা, “বাইশ বছরের গর্ভবতী মেয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিলো”। তৌসিফে’র বুক কেমন চিলিক দিয়ে উঠে কথাটা ভাবলেই। মুড সুইং কি সত্যি এত তীব্র হয়? পৌষ তো এমনিতেই এলেমেলো ধরণের ছুটন্ত এক মেয়ে। ওর এলোমেলো ভাব শায়েস্তা হয় শুধু মাত্র যখন তৌসিফ কঠিন হয়। এখন তৌসিফ নিজের কলিজা কেটে ফেললেও কঠিন হতে পারবে না৷ সে পারছে না। মনটা আজ সন্ধ্যা থেকে নরম হয়ে আছে। চাইলেও যদি পুরোপুরি ভাবে পিতৃত্ব ভাব বা অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে না যা হচ্ছে তা পৌষ’র আর আগত সন্তানদের জন্য মাথা কিলবিল করা চিন্তা। বলা হয় পুরুষের কোলে যেই পর্যন্ত সন্তানের অস্তিত্ব না আসে সেই পর্যন্ত তাদের পিতৃতান্ত্রিক সত্তা নাকি জাগ্রত হয় না৷ তৌসিফ অবশ্য অনুভূতি গোছাতে পারছে না। মনে হচ্ছে দুই হাতে সবটা আগলাচ্ছে আর এদিক ওদিক দিয়ে জোছনার আলোর মতো তা বেরিয়ে যাচ্ছে। আজ পর্যন্ত এই দশা কখনো হয়েছে তৌসিফে’র? উহু, একদমই না। সে যথেষ্ট শক্তপোক্ত এক পুরুষ। তার ধাঁচে নেই নরম স্বভাব। মা বাদে কখনো নরম হয় নি কারো সামনে। পিয়াসী’কে অতিরিক্ত ভালোবেসে তার কদমে কদমে ফুলের গালিচা বিছাতে রাজি ছিলো তৌসিফ। সে নিজের ভালোবাসা দিয়েছে, ছুটেছে টাকার পিছনে কিন্তু সেই সাথে ছুটেছিলো তার অগাধ আস্হা, নিজের ভালোবাসা প্রতিই তার বিশ্বাস ছিলো না। পিয়াসী থেকে সে বারকয়েক মিনতি করেছিলো সন্তানের। জানা নেই কিন্তু ছোট্ট জান তার খুব ভালো লাগে। এই যে হেমন্তের ছেলেটা দেখলেই বুক জুড়িয়ে যায়। ইনি-মিনি’কে কখনো শালী লাগে না বরং বাচ্চা মনে হয়। কেমন আদর আদর মুখ।
তারও খুব শখ কেউ আসবে তার জন্য হাত ভর্তি করা নরম আদর নিয়ে। মুখ ভরা লালা নিয়ে কেউ ছোট্ট শব্দে ডাকবে। একদম অস্পষ্ট, জড়তায় ভরপুর। মুখের ভাষায় হাজার দূরত্ব থাকলেও তৌসিফ কথা বলবে মনের ভাষায়। বড় বড় চোখে যখন তাকিয়ে থাকবে তৌসিফ তখন নিজেকে দেখবে সেই চোখের মাঝে। ভাবা যায়, নিজের অংশের মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা! কত বড় আশ্চর্যের ব্যাপার। তৌসিফে’র তো ভাবতেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
পৌষটাকে সে পৌষ মাসের মতোই ভালোবাসে। কোনদিন অবশ্য ভাবে নি নিজের থেকে এত ছোট মেয়ের প্রেমে সে পড়বে। বেয়াদব ধাঁচের, বাঁচাল এক মেয়ে। উড়নচণ্ডী অথচ কাঁদুনে। শক্ত অথচ দূর্বল। এ যেন কোন অদ্ভুত মানবী। এমন না সে খুব সুন্দর। না তেমন কোন বিশেষত্ব আছে। যা আছে তার সবটা হলো কাঁচের ন্যায় ফকফকা এক মন। সেই মন দিয়ে সবাইকে সে কাছে টানে। সেভাবেই টেনেছিলো তৌসিফ’কে। তৌসিফ বরাবরই সংসার চেয়েছে। সংসারী বউ সে পেয়েছে। শুরুতে তার মনে ভালোবাসা তো দূর পৌষ’র জন্য ভিন্ন কোন জায়গাও ছিলো না। ফুপির রেখে যাওয়া ছোট্ট একটা আমানত আর বাবা’র মুখের কথা। সবটা রাখতেই যেন হাত বাড়ালো পৌষ’তে। হাতের মুঠোয় আসতেও সময় অবশ্য লাগে নি কিন্তু মন বিনিময়, সে এক জন্ম-জন্মান্তরের কাহিনি। কিভাবে যে তৌসিফে’র মতো মানুষটা প্রেমে পড়লো তা যেন আজও রহস্য।
মাঝেমধ্যে তৌসিফ শক্ত হয়ে যায় নাহয় এই পৌষ বিগড়াবে। তৌসিফ তা হতে দিবে না৷ প্রশ্নই উঠে না৷ চোখে চোখে রাখে সে তার পৌষরাত’কে। বুকের ভেতর খোলা খাঁচায় বন্দী সে পাখি। মন চাইলে উড়াল দেয় আবার সন্ধ্যা হতেই ফেরত আসে। এখন থেকে ডানার নিচে দুটো ছানা নিয়ে সে ফেরত আসবে এই হৃদকুঠুড়িতে। তৌসিফ তখন আগলে নিবে। সামলে নিবে।
— হয়েছে।
পৌষ’র বলা শব্দে তৌসিফ পেছনে ঘুরলো। ক্ষুধা লাগায় পৌষ একাই উঠেছিলো। তৌসিফ উঠেছে নিজ থেকে। খেতে খেতেই পৌষ বললো তার অস্থির লাগছে তাই বারান্দার থাই খুলতে এসেছিলো তৌসিফ অথচ কিভাবে যেন গভীর ধ্যানে আটকা পরলো।
পা বাড়িয়ে ভেতরে এসেই জিজ্ঞেস করলো,
— খেলে না যে?
— বাসি হয়ে গিয়েছে।
তৌসিফ কপাল কুঁচকালো। নাকের সামনে নিয়ে শুঁকে দেখলো। নাহ! ভালোই তো। তৌসিফ জানালো,
— ইটস টোটালি ফ্রেশ হানি। বুয়া রাতেই রেঁধেছে।
— টক টক লাগে কেন তাহলে?
তৌসিফ এক চামচ মুখে দিলো। বললো,
— কোথায়? ঠিকই আছে।
— ওহ আচ্ছা।
তৌসিফ এবার যেন বেশ অবাক হলো। এত সহজে মেনে নিলো? এত সহজ তো তার পৌষরাত না। তবে কি ওর মুড সুইং হচ্ছে? তৌসিফ ওর গা ঘেঁষে বসলো। গালে হাত রেখে বললো,
— অন্য কিছু খাবে?
— কি খাব?
— যা মন চায় বলো।
পৌষ কিছুক্ষণ ভাবলো। ভাবতে ভাবতেই ঝুমতে লাগলো। তৌসিফে’র কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে চুপ করে রইতেই তৌসিফ ওর মাথায় হাত রাখে। মেয়েটা এত শান্ত হলো কেন? তৌসিফ কখনোই চায় নি পৌষ শান্ত হোক। তার ঘরময় ছড়িয়ে থাকা এক শান্তি এই পৌষ। সে চুপ করে গেলে কিভাবে হবে?
________________
তৌসিফ সাইডে এসেছে কাজে। ঘড়িতে এখন ঠিক তিনটা বেজে দুই মিনিট। বারবার হাত ঘড়ি দেখছে তৌসিফ। ইমু বিষয়টা লক্ষ করলো। ফাইল গুছিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— স্যার কোন সমস্যা?
— হ্যাঁ।
ইমু হকচকালো। বললো,
— কোন ফাইলে? আমি দুইবার চেক করেছিলাম। বাফারিং টাইম তো আছে। আবার দেখব একবার?
তৌসিফ কপাল কুঁচকে তাকালো। ইমু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। বুঝলো না সে ভুল কি হলো। তৌসিফ পানির বোতলটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি গলায় ঢাললো। ফোনটা হাতে নিয়ে বললো,
— সময় দেখেছো? তিনটা তিন বাজে। বাসায় থাকা দরকার ছিলো আমার এখন। তোমার ম্যাডাম একা আছে। এমনিতেই আজকাল চুপচাপ থাকছে। না জানি কপালে কি আছে আমার।
বলেই তৌসিফ ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। ইমু কোন কথা ব্যাক্ত করার অবস্থায় নেই। স্যার কখনোই এভাবে কথা বলে না। বউ নিয়ে কথা তো দূরের বিষয় সেখানে বউ নিয়ে চিন্তা করছে ইমু’র কাছে। ইমু’র কষ্ট লাগলো। সে তৌসিফ’কে দেখেছে বিভিন্ন ধাপে। ভাঙলেও মচকায় না তৌসিফ। শক্ত ধাতুর মনে হয় তাকে কিন্তু এবার তার ভাব ভিন্ন। হয়তো সে বদলাচ্ছে। মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল সেখানে তৌসিফে’র পরিবর্তন তার চোখে পড়ছে।
তৌসিফ দুপুরেও খেলো না। আজ পৌষ’র শেষ পরীক্ষা। সেমিস্টার গ্যাপ থাকবে এখন। তৌসিফ লক্ষ করে দেখেছে এই একটা মাস মেয়েটা পড়ায় মন দিয়েছিলো। প্রথম পরীক্ষা খারাপ হওয়ায় নাকি অন্য কোন কারণ তা তৌসিফ বুঝতে পারে না। তৌসিফ বাসায় ঢুকলে তার বই হাত ছাড়া হয়েছে। এরমধ্যে অবশ্য নতুন এক বুয়া রেখেছে তৌসিফ। তার কাজ শুধু পৌষ’র খেয়াল রাখা যদিও পৌষ মতবিরোধ করেছে। তার পছন্দ হচ্ছে না কেউ সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখুক তাকে। তৌসিফ শোনে নি। পৌষ কি জানে তাকে তৌসিফ এমনিতেও চোখে চোখে রাখে?
বাসার রাস্তায় না গিয়ে তৌসিফ সোজা গেলো ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারটা ভালো অবশ্য। দুই দিন পরপরই তৌসিফ ছুটে আসে। নানান রং বেরং এর প্রশ্ন তার। পৌষ নতুন কোন আচরণ করলেই তার ছুট হয় হাসপাতালে। ডাক্তার বিরক্ত হন না বরং মুচকি হাসেন প্রতিবার এবারও তৌসিফে’র প্রশ্নে তিনি মৃদু হাসলেন। বললেন,
— তুমি কি চাইছো তোমার বউ চিৎকার চেঁচামেচি করুক?
তৌসিফ যেন চমকে উঠে। হ্যাঁ। এটাই। হয়তো ও এটাই চাইছে তৌসিফ। শুক্র-শুক্রে আট দিন পৌষ থমথমে মুখ করে থাকে। নাম মাত্র কথা তার। তৌসিফ ঐ দিকে শ্রেয়া’কে দিয়ে ফোন দেয়ালো। পৌষ হু হা বলে রেখে দিলো। সে নাকি ঘুমাবে অথচ তৌসিফ দেখলো ও মিনু’র সাথে বসে আছে। বাড়ীতে গেলেও কথা নেই। আগের মতো হৈ চৈ করে না৷ জ্বালাতন তো দূরের কথা দুষ্টামির দ ও করছে না ও। এমন কেন হবে? কে বলেছে ওকে ম্যাচিউর হতে? তৌসিফ বলেছে? তৌসিফ কি পা’গল? তার তোতাপাখি চুপ, তৌসিফে’র তো মনে হয় তার দুনিয়াই স্তব্ধ হয়ে আছে। কেন সে চুপ থাকবে। সে তো তোতাপাখি। পাখির বুলি কেন থামবে? ডাক্তারের কাছে আজ আসার কারণই হলো দিনদিন পৌষ চুপ করে যাচ্ছে। গত তিনদিন ও ঠিকমতো ত্রিশটা শব্দ বলেছে কি না সন্দেহ।
ডাক্তার তৌসিফে’র দিকে তাকালো। এত সুন্দর উচা লম্বা সিনা টানটান পুরুষটার চেহারায় চিন্তার ছাপ। সে যে সত্যিই কতটা মানুষিক ভাবে চিন্তিত তা বলার অবকাশ রাখে না। তপ্ত শ্বাস ফেলে ডাক্তার বললেন,
— তৌসিফ, কয় মাস চলছে?
— পাঁচ মাস দুই দিন।
— বাহ। ঘন্টাও গুনো নাকি?
— যদি ঐ দিন সন্ধ্যা ধরি তাহলে পাঁচ মাস দুই দিন উনিশ ঘন্টা।
ডাক্তারের এবার সত্যিই মায়া হলো। লোকরা উদগ্রীব হয়ে আছে। চোখে মুখে প্রশ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ডাক্তার বললো,
— আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি তৌসিফ। চুপচাপ হয়েছে। এটা তেমন কোন ফ্যাক্ট না।
— একদমই কথা বলছে না। ওর চালচলন দেখেই বুঝি ইচ্ছে করে করছে।
— ঝগড়া হয়েছে?
— না। ওর সাথে আমার ঝগড়া হয় না।
— বেবি প্ল্যান্ড ছিলো না?
— ছিলো। আমি খুব করে চাইতাম। আমার চাওয়া দেখে ও নিজেও চাইতো।
— তাহলে শুনো মনোযোগ দিয়ে। এখানে ও দুই কারণে হয়তো চুপ আছে। কারণ দুটো খুবই ছোট এবং স্বাভাবিক। এক হলো, নতুন মা হচ্ছে। এই প্রথম। শারীরিক, মানসিক পরিবর্তন গুলো মানাতে পারছে না৷ দুটো বাচ্চা ক্যারী করছে। ও যথেষ্ট পারফেক্ট এরজন্য। এই যে প্রথম মা হচ্ছে এটা হয়তো রিয়েলাইজ করতে ওর টাইম লাগছে। নিজের ভেতরের অস্তিত্বটাকে মেনে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। তুমি বাইরে থেকে যা ফিল করো তা ওর ভেতরে বেড়ে উঠছে। ওর মানুষিক দিকটা দেখতে হবে এখানে। অনেকটা ইমোশনাল ব্যাপারটা।
দ্বিতীয় যেটা সেটা অনেকটা সিলি বুঝলে? ও হয়তো তোমাকে জ্বালাতন করতে চাইছে না। ভাবছে তুমি ওর এলোমেলো কষ্ট বা অনুভূতি দেখে নিজে হয়তো গিল্ট ফিল করবে তাই সবটা লুকিয়ে রাখছে।
ডাক্তার দেখলো তৌসিফ মাথা নিচু করে বসে আছে। তিনি ডাকলেন,
— তৌসিফ?
— জ্বি।
— বুঝেছো?
— হ্যাঁ কিন্তু…
— কিন্তু?
— ও তো চুপ থাকার মানুষ না।
ডাক্তার এবার শব্দ করে হাসলেন। বললেন,
— বাসায় যাও বাবা। ওকে টাইম দাও। একা সময় কাটাও। বাইরে ঘুরে এসো। বেশি জার্নি না অবশ্য। মাঝেমধ্যে নিজেদের সুবিধা বুঝে এক হও । ও স্ট্রেস ফ্রী মানেই বাচ্চারা সুস্থ। আর হ্যাঁ, এখন বমি হয়?
— এই দুই মাসে একবারও হয় নি আর।
— আচ্ছা। তবে এইক্ষেত্রে শেষ দিকে বমি শুরু হতে পারে।
তৌসিফ যেন ভদ্র ছাত্রের মতো সবটা বুঝলো। বাইরে এসে গাড়িতে উঠে আবার নামলো। দুটো ভিক্ষুক দেখেই তাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে কিছু দান করলো। নোংরা জামা পরা ছোট্ট বাচ্চাটার গালে হাত দিয়ে আদর দিয়ে কচকচা একটা নোট দিলো। বাচ্চাটা হাসলো। সে টাকা চিনে। তৌসিফ গাড়িতে উঠতে উঠতে চাইলো আকাশপানে। বিরবির করে বললো,
— এর প্রতিদান আমার স্ত্রী-সন্তানদের দিও আল্লাহ।
.
বাসায় এসে তৌসিফ ঘুমন্ত অবস্থায় পেলো পৌষ’কে। মুখ হাত ধুতে গিয়ে গোসলই করে ফেললো। পৌষ’র কপালে হাত বুলিয়ে গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। এগিয়ে এসে পেটে হাত রাখলো। দুটো বাবু থাকাতে পাঁচ মাসেই পেটটা বেশ বড় হয়েছে। তৌসিফ পেটে হাত রেখে থম ধরে বসে রইলো। ওর গলা ধরে এলো। আস্তে ধীরে তৌসিফ বললো,
— তোমারা কি জানো তোমাদের পাপা চিন্তায় আছে?
অপেরপাশ নিশ্চুপ। তৌসিফ আবার বললো,
— আজকের ডিল ফাইনাল বাবারা কিন্তু পাপা কাজে মন দিতে পারি নি। তোমাদের আম্মু কেমন শক্ত আচরণ করছে আমার সাথে। সে কথাবার্তা বলছে না অথচ শান্তি প্রিয় মানুষ আমি অথচ বছর খানিক সময় ধরে তোমাদের আম্মুর কথা ছাড়া আমি চলতে পারি না। আমার বুকটা খালি খালি লাগে। মনে হয় দম আটকে যাবে আমার। তোমাদের আম্মু এটা কেন করছে? আমার দোষ কোথায়? আমি সাফার করছি।
তৌসিফ চুপ করে গেলো। তার গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কেউ চেপে ধরেছে। আচ্ছা, বাবা হওয়া এত কষ্ট কেন? পেটে না রেখেও তৌসিফ কেমন দূর্বল হয়ে গেলো। এমন কি কখনো ছিলো তৌসিফ যে কথা বলার আগে চোখে পানি জমা হবে? গলা ধরে আসবে? কেন হচ্ছে? ভালোবাসা নামক মন্ত্রে কি এমন জাদু আছে যা বশবর্তী করে ফেললো শক্ত পুরুষটাকে। তৌসিফ ওখানেই মাথা রাখলো। চোখ বুজলো।
চোখটা তখন হয়তো মাত্র লেগে আসবে তৌসিফ মাথায় কারো হাত টের পায়। ধীরে ধীরে শব্দ আসে কানে,
— উঠুন। এখানে কেন ঘুমিয়েছেন?
তৌসিফ চোখ খুলে মাথা তুললো। পৌষ আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
— খেয়েছেন?
তৌসিফ মাথা নাড়ে। পৌষ উঠতে চাইলেই তৌসিফ আস্তে করে পেছন থেকে সাপোর্ট দিলো। পৌষ নিজে নিজে মুখে পানি দিয়ে এলো। বললো,
— চলুন। আমারও ক্ষুধা লেগেছে।
— তুমি খাও নি?
পৌষ মাথা নেড়ে বলে,
— নামাজ পড়তেই এত ঘুম এলো।
বলেই বেরিয়ে গেলো। তৌসিফে’র রাগ গিয়ে পড়লো নতুন বুয়ার উপর। তার দায়িত্ব ছিলো পৌষ’কে ঠিক সময়ে খাওয়ানো।
#চলবে…