#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৭৫
দীর্ঘ তিন ঘন্টা সবার কাটলো তীব্র প্রতিক্ষায়। পৌষ’কে এক বুক কষ্ট দিয়ে আর তৌসিফ’কে ভীষণ করে কাঁদিয়ে পৃথিবীতে আগমন ঘটলো একটি কন্যার। লাল টুকটুকে দেখতে ছোট্ট একটা জান। নার্স তাকে ওয়াশ করতে সাইডে নিতেই তৌসিফ পৌষ’র হাতটা শক্ত করে ধরলো। তখনও ব্যথায় শব্দ করে কাঁদছে পৌষ। ডাক্তার তাকে পুণরায় তাগাদা দিলো,
— পৌষ, পুশ করার চেষ্টা করো।
— আর পা..র…চ্ছি না।
তৌসিফে’র শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। পৌষ’র চিৎকার করা কান্নায় তাকে আসতেই হয়েছে এখানে। গত একটা ঘন্টা ধরে ও পৌষ’র হাত ধরে বসা। রীতিমতো থরথর করে কাঁপছিলো তৌসিফ। দুই চোখ শুধু টিশার্টের হাতায় মুছে যাচ্ছে বারংবার অথচ পানি যেন ফুরায় না। তার স্বামী হৃদয় শুধু কাঁদে। কেন যেন আফসোস হয়। কি হতো বাবা না হলে? কেন তার বাবা হতে হবে? কেন এতটুকু জানটা এতটা কষ্ট পাবে? মা ডাক তো সে একা শুনবে না, তৌসিফও বাবা ডাক শুনবে তাহলে কষ্টটা কেন পৌষ একা করবে?
ঠিক এক মিনিট পেরিয়ে তিন সেকেন্ড তৌসিফ বাম হাতটা পৌষ’র কপালে রাখলো। পৌষ ওর চোখের দিকে তাকালো। ডাক্তার তাড়া দিলো পুশ করতে। তৌসিফে’র চোখে কাতরতাসূচক দৃষ্টি দেখে পৌষ। মানুষটা খুব করে কাঁদছে। কত বড় লোকটা অথচ মুখটা এখন ছোট্ট হয়ে আছে। পৌষ ভাবলো, তার সামনে বড় একটা জীবন পরে আছে। তার সন্তানদের সাথে তৌসিফ সহ তাকে বাঁচতে হবে। সংসার করা বাকি। কতশত দুষ্টামি করা বাকি।
একবার চোখ বুজে পুণরায় তা খুলে পৌষ। জোরে আল্লাহু আকবর বলে একবার পুশ করতেই ছেলে বাবুর কান্না শব্দ এলো। পৌষ শুধু শুনলো এক ছেলে এক মেয়ে। সে জ্ঞানহারা। তৌসিফ বাচ্চা দেখে না৷ ও দেখে পৌষ’র কাত হওয়া মাথা। তৌসিফে’র বুক চিনচিন করে। পৌষ’র গালে হাত দিয়ে ডাকে ফিসফিস করে,
— পৌষরাত। আমার পৌষরাত, উঠো। তোতাপাখি? তাকাও। এই পৌষরাত?
পৌষ তাকায় না। তৌসিফ ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে আস্তে করে বলে,
— ও কখন তাকাবে? ওকে এখন তুলা যাবে না?
ডাক্তার বিগত পাঁচ মাস ধরে তৌসিফে’র মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে জ্ঞাত। মৃদু হেসে উত্তর দিলেন,
— ও ঠিক আছে তৌসিফ। ব্যথায় জ্ঞান হারিয়েছে। এত শক্ত তোমার স্ত্রী। ও শক্ত থাকায় দুটো বাচ্চা নরমালে হলো নাহয় সি সেকশন করতেই হতো। সময় হোক ও চোখ খুলবে। তোমার সাথে কথাও বলবে। জানো আমাকে কি বলেছিলো?
তৌসিফ আগ্রহ নিয়ে তাকালো। ডাক্তার বললেন,
— আমাকে বলেছিলো, “ডাক্তার আন্টি, আমার জামাই আমাকে খুব করে ভালোবাসে। সে আমাকে কষ্টে দেখতে পারে না। আমার যাতে বেশি কষ্ট না হয় একটু খেয়াল রাখবেন হ্যাঁ”।
আমার মনে হয় ও তোমাকে বেশি ভালোবাসে। এতটুকু বুকে তোমার জন্য গভীর ভালোবাসার জল জমানো। ডুবে যেতে পারো। এখন দু’জন যোগ হলো। মিষ্টি খাব না কিন্তু তৌসিফ। অনেক জ্বালিয়েছিলে। দই পাঠাবে মনে করে।
ডাক্তার হাসলেন। তৌসিফ মৃদু হাসলো। সে জানে তার পৌষ কেমন। নার্স পৌষ’কে পরিষ্কার করতে এগিয়ে এলো। তৌসিফ’কে বললো,
— স্যার, ম্যামকে ক্লিন করতে হবে।
— করুন।
— আপনি বাইরে যাবেন কি?
— না।
নার্স কথা বাড়ালো না। ডাক্তার বললো,
— বাবু দুটো ছোট তো। আধ দিন এনআইসিউতে থাকবে।
তৌসিফ আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
— ঠিক আছে?
— আহা বাবা, ঠিক আছে। তুমি না দেখলে?
— আমি মুখ দেখি নি।
— আচ্ছা দেখবে। সকালেই দেখতে পারবে।
— পুরোপুরি সুস্থ আছে তো। তাই না?
এত কথা তৌসিফ বলছে বিষয়টা মোটেও সহজ না। তৌসিফ তালুকদার এত প্রশ্ন করার মানুষ না। তার কঠিন আবরু ভেঙে ফেলেছে পৌষ। সেই গম্ভীর তৌসিফে’র মৃত্যু তো কবেই হলো।
ডাক্তার ওকে ভরসা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে দুনিয়ার মানুষ। পৌষ’কে কেবিনে দেয়া হবে। এখান থেকে পরিষ্কার করেই বের করবে। নার্স’কে খুব একটা ধরতে দিলো না তৌসিফ। নার্স’কে বললো,
— আমাকে দেখান। আমি করছি।
— স্যার…
তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— দেখিয়ে দিন।
নার্সের সাহায্যে পরিষ্কার করতেই পৌষ’কে বের করা হলো। কেবিনে দিতেই একে একে সবাই দেখে গেলো। তায়েফার কাঁধে মাথা দিয়ে অদ্ভুত চোখে পৌষ’কে দেখছে তৌসিফ। পেটটা আবার ছোট হয়ে গিয়েছে। বাবুরা পেটে নেই। তারা এখন দুনিয়ায় কিন্তু তৌসিফ ছুঁয়ে দেখে নি। পৌষ দেখে নি। তৌসিফ শান্তি পায় আবার অস্থির লাগে। এখনও দেখা হচ্ছে না ঠিকঠাক।
হসপিটালে এত মানুষ রাখা যাবে না। তায়েফা’কে এলাউ করা হচ্ছে না অগত্যা তৌসিফ ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে তায়েফা’কে সাথে রাখলো। হেমন্ত কয়েকবার বলেছে শ্রেয়া থাকবে কিন্তু তৌসিফ না করেছে। শ্রেয়ার নিজের ছোট্ট একটা বাচ্চা আছে। চাচিরাও থাকতে চেয়েছিলো। তৌসিফ রাজি হয় নি। তার বউ। তার দায়িত্ব। সে একা হাতে সামলে নিবে শুধু ভয় হয় দেখে তায়েফা’কে রাখা নাহয় বউ, বাচ্চার জন্য তৌসিফ একাই একশ।
রাত প্রায় শেষ দিকে। তৌসিফ ঘুমায় নি। পৌষ’র চোখ দুটো মৃদু মৃদু নড়ছে। তৌসিফ ব্যস্ত হলো। ডাকলো,
— হানি? তোতাপাখি আমার, চোখ খুলো।
পৌষ আস্তে করে চোখ মেলে চায়। তৌসিফ’কে দেখেই হাসে। ঠোঁট নেড়ে কিছু বলতে চায়। তৌসিফ খেয়াল করে পৌষ’র ঠোঁট কাঁপছে। প্রাকৃতিক ভাবে এমন হওয়ার কারণ বুঝলো না ও। তায়েফা নার্স ডাকতেই তৌসিফ ডাক্তার ডাকালো। ডিউটিতে তখন অন্য ডক্টর। জানালেন,
— ব্যথার সাথে শরীর খাপ খাওয়াতে না পারলে এমন কম্পন হয়।
— থামান তাহলে।
ডাক্তার বিরক্ত হলেন। বললেন,
— আপনাআপনি এডজাস্ট হতেই থেমে যাবে।
— এখন থামিয়ে দিন।
ডাক্তার মহা বিরক্ত হলেন৷ বিরক্ত নিয়েই বললেন,
— এখন ওনাকে কোন ড্রাগ বা ইনজেকশন দেয়া যাবে না। অপেক্ষা করুন।
তৌসিফ’কে এই প্রথম কেউ পাত্তা দিলো না। ডাক্তারটা ইয়ং। তৌসিফ মেয়েটার তেজ দেখে তাকিয়ে রইলো। তাকে তেজ দেখানো মানুষ সংখ্যা খুবই কম। তার মধ্যে এই মেয়ের আগমন। তৌসিফে’র মনে হঠাৎ ভিন্ন এক অনুভূতি কাজ করলো। এলোমেলো একটা ভাবমূর্তির আবির্ভাব ঘটলো। কিছুটা ঘোলাটে। কিছুটা আবছা। মাঝে ঘোর অন্ধকার।
_________________
রাত কাটার সময় পাওয়া গেলো না। তৌসিফে’র মেয়ে ক্ষুধার্ত। সে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। নার্স এসে জানালো বাচ্চা খাওয়াতে হবে। পৌষ তখন ঘুম। তৌসিফ কি বলবে বুঝার আগেই তায়েফা বললো,
— বাচ্চা নিয়ে আসুন৷ বাচ্চার মা’কে তুলছি।
তৌসিফ এরমধ্যে বলে উঠলো,
— আপা, তুমি যাও।
— পারবি তুই?
— পারব।
— বুঝিস?
— বুঝলাম আপা।
তায়েফা নড়লো না। ভাজিতি বা ভাতিজা কাউকেই সে দেখেনি। দেখা গেলো নার্স মেয়ে আনতেই তৌসিফ হাত বাড়িয়েছে। নার্স মুচকি হাসলো। বললো,
— স্যার, খাবে আপনার মেয়ে।
তায়েফা বুদ্ধিমান। সে পৌষ’কে ডাকলো গায়ে হাত দিয়ে। গভীর ঘুমে মগ্ন পৌষ’র এখন থেকে নিদ্রাহীন রাতের পালা। একটু চোখ খুলতেই তায়েফা বললো,
— তোর মেয়ের ক্ষুধা লেগেছে পৌষ। খাওয়াবি।
পৌষ অদ্ভুত চোখে তাকালো। হ্যাঁ। তাইতো। তার বাবুদের খাওয়া হয় নি এখনও। ও উঠে বসতে চাইতেই তৌসিফ বাঁধা দিলো। নার্স এগিয়ে আসতেই তৌসিফ সাহায্য করলো। তায়েফা তখন বাইরে। এই প্রথম ছোট্ট মুখখানা দেখলো তৌসিফ। তার চোখ চিকচিক করছে। বুকের কাপড় সরিয়ে খাওয়াতে দিতেই মহা মুশকিল বাঁধলো। পৌষ খাওয়াতে পারছে না। নার্স জানালো দুধ নেই। শোনা মাত্রই পৌষ কেঁদে ফেললো। তার বাচ্চা কাঁদছে ক্ষুধায়। তৌসিফে’র ভেতর কেমন যে করে উঠলো ও বুঝলো না। এত টাকা পয়সা দিয়ে তার কি হবে যদি সন্তানই না খেয়ে থাকে?
তৌসিফ কৃত্রিম দুধের কথা জিজ্ঞেস করতেই নার্স বললো,
— সামান্য কারণে এটা দেয়া যাবে না স্যার। আমরা চেষ্টা করছি।
পৌষ’র ব্যথায় চোখে পানি চলে এলো। যখন বারবার চেষ্টা করা হচ্ছিলো তখন তৌসিফে’র হাতটা চেপে ধরে ও। তৌসিফ দেখলো ব্যথায় পৌষ দাঁত খিঁচে আছে। কাজ হলো বটে। সামান্য একটু দুধ এসেছে। তৌসিফে’র মেয়ে চুকচুক শব্দ করে খাচ্ছে তখন। পৌষ’র ব্যথার মাঝে সুখানুভূতি হয়। তার ঠোঁট হাসি হাসি অথচ চোখ ভর্তি পানি। বুকে ব্যথা হচ্ছে তার।
তৌসিফ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে ছোট্ট জানটাকে। ফুটফুটে একটা বাচ্চা। এত সুন্দর। বাবা’র রুপ তার। ঠিক যেন ছোট্ট তৌসিফ।
এরইমাঝেই আরেকজন নার্স ছেলে হাতে হাজির। ছেলের ও ক্ষুধা অথচ সে মিহি স্বরে কাঁদছে। শান্ত স্বরে। মেয়েটা একটু পাঁজি বুঝা গেলো। সে পৌষ’র মতোই হবে, তৌসিফ ভাবলো মনে মনে।
মেয়েটাকে সরিয়ে ছেলেকে ফিড দিতেই মেয়ে গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলো। তৌসিফ তাকে এই প্রথম দুই হাত মেলে কোলে তুলে ভাঙা গলায় ডাকলো,
— মা, মা?
বহু বছর পর এই ডাক এসেছে তৌসিফে’র কণ্ঠে। মা হারা সে বহু বছর ধরে। ছেলেটাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরেছে পৌষ। তৌসিফ মেয়ের সাথে কথা ধরলো। নানান ভাবে বলার চেষ্টা করলো তার ছোট্ট ভাই আছে। তারও ক্ষুধা লেগেছে। মেয়ে শুনতে নারাজ। তার ক্ষুধা আগে।
এমনিতেই নেই দুধ তারমধ্য দুই ভাই-বোন কেউ কাউকে ছাড় দিবে না। পৌষ কেঁদে যাচ্ছে। তার কষ্ট লাগছে। তৌসিফ ওর মাথায় হাত রাখে। পৌষ চোখ তুলে তাকাতেই তৌসিফ বলে,
— কেমন লাগছে পৌষরাত?
এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া হলো না। দু’জন ফিক করে হেসে ফেললো। কোলের মেয়ে বাবুটা তখন কান্না থামিয়ে বাবা’কে দেখছে। তার বাবা’র মুখ ভর্তি সুন্দর হাসি। তার গোলাপি ঠোঁটটায়ও হাসি ফুটলো। পৌষ ডাকলো,
— অ্যাই মামাতো ভাই? ওকে দিন।
তৌসিফ কপাল কুঁচকে তাকালো। অসন্তোষ গলায় বললো,
— বাবুর আব্বু ডাকবে।
— এ্যাহ! বললেই হলো?
— একশত বার হবে।
— আমার শক্তি আজকাল বেশি। ভয় পাই না।
— তাই? পাখা গজালো নাকি?
— আবার জিগায়? দুটো পাখা। দেখেন না?
তৌসিফ ঠোঁট কামড়ে হাসে। তার ভেতর পা’গল পা’গল লাগছে। দুটো সন্তান তার। এত সুখ। কোথায় রাখবে সে? তার বাবা সত্তা কেমন ফুপিয়ে উঠতে চায়। তৌসিফ তাদের দমিয়ে রাখে। তার ভেতর ফেটে কান্না পায়, তৌসিফ দমিয়ে রাখে। তার পৌষ তাকে সুধা পান করিয়েছে। ম’রণসুধায় তৌসিফ ম’রতেও রাজি।
#চলবে…..