#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৯
সাত সকালে তালুকদার ভিলাতে হৈ চৈ পরলো। বাড়ীর ছেলে আজ অনেকদিন পর ফিরে এসেছে। প্রকৃতিতে ঘেরা সম্পূর্ণ চারপাশ। এর মাঝখানে সুন্দর তিন তলা বিশিষ্ট বড় এই তালুকদার বাড়ী। বাড়ীটার একদম মুখ বরাবর সামনে বাঁধাই করা পুকুর। পুকুরটার কিণারায় গাট বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছটা। পুরো এলাকাতে এমন বাড়ীর দেখা মিলবে না। মেইন সড়কের পাশে এহেন বিলাসবহুল বাড়ী শুধু তালুকদারের। এদের বাপ দাদারা ই নাকি কোন এক কালে এই এলাকায় জমিদারি করতো। মুক্তিযোদ্ধার খেতাব ও আছে তাদের বাবা’দের। তালুকদার বংশটা বেশ বড়। বর্তমানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও নিজেদের বাড়ীঘর ঠিকই আছে এলাকাতে। মাঝেমধ্যে এসে ঘুরে যান। পুরো এলাকা হেটে বেড়ান। তবে তৌসিফ তালুকদারের বাবা এখানেই ছিলেন। যদিও তাদের বিদেশে সহ ঢাকার সুনাম ধন্য এলাকাতে ও বাড়ি আছে তবে ঐ যে বাবা-চাচাদের কবর এখানে। মায়ের কবর এখানে। চাইলেও ছেড়ে দূরে যেতে পারে নি ওরা। এলাকায় এই সাইডে সহ আশেপাশে জায়গা জমি কিনে ক্ষমতা তাদের এখন শিখড়ে।
কালো বড় গাড়িটা মেইন সড়কে সাই সাই চললেও বাড়ীর সড়কে আসতেই গতি কমালো। পুকুরের পাশের রোডটা দিয়ে ঢুকতেই দারোয়ান বড় গেইটটা খুললো। গাড়ি ঢুকা বের হওয়ার জন্য ই এই গেইটটা খুলা হয় অন্যথায় ওরা পকেট গেইট ই ব্যবহার করে। এছাড়াও দেখা যায় রোজার ঈদে শাড়ী,লুঙ্গি বিলানোর সময় অথবা কুরবানির ঈদে গোশত বিলানোর সময় বড় গেটটা খোলা হয়।
কালো গাড়িটা বাড়ীর নিচে ঢুকতেই ডোর খুলে বেরিয়ে এলো আদিত্য তালুকদার। তৌফিক তালুকদার ছেলেকে দেখেই প্রসস্থ হাসলেন। আদিত্য বাবা’কে দেখেই জড়িয়ে ধরলো। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তৌসিফ। সবে ঘুম থেকে উঠে আসায় পরণে এখনও পাতলা একটা টিশার্ট আর ছাই রঙা টাউজার। বাবা’কে ছেড়েই চাচা’কে জড়িয়ে ধরে ও। তৌফিক ওর পিঠ চাপড়ে বললো,
— কেমন আছিস?
— একদম ঠিক।
— হাউ ওয়াজ দ্যা ট্যুর?
— বেস্ট এভার চাচ্চু। মেঝো চাচ্চু কোথায়?
তৌফিক তালুকদার পাশ থেকে বললেন,
— মেঝো বাসায় নেই। জরুরি কাজে ফিনল্যান্ড গেলো গতরাত।
মুখে ছোট্ট করে “ওহ” বলে তৌসিফ’কে ছেড়ে দাঁড়ালো আদিত্য। হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো,
— চাচি কোথায় চাচ্চু?
তৌসিফ মৃদু হেসে বললো,
— ঘুমাচ্ছে।
তৌফিক তালুকদার মাঝ থেকে বললেন,
— আগে উপরে চলো তোমার আম্মু অপেক্ষা করছে।
— আগে নতুন চাচি দেখব আব্বু।
বলেই তৌসিফের সাথে তিন চলায় গেলো আদিত্য। তৌফিক তালুকদার থামান নি। সত্যি এক না একদিন আদিত্য জানবেই। ভালো হবে যদি আগেই জেনে যায়। ভয়টা শুধু তৌসিফ’কে নিয়ে।
আপাতত তৌসিফের ওখানে না গিয়ে ফোনটা হাতে তুলে কাউকে কল দিতে দিতে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকলেন তিনি।
.
পরপর দুইবার নক করার পর ও যখন পৌষ দরজা খুললো না তখন ব্যাপার টা সম্মানে লাগলো তৌসিফের। ভাতিজার সামনে সে বউয়ের রুমে দরজা নক করছে। আদিত্য কি ভাবছে কে জানে। বাইশ বছরের আদিত্য নিশ্চিত বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে দেখছে না। নতুন বউ তার বরের রুমে ছেড়ে পাশের রুমে দরজা আটকে ঘুমাচ্ছে। এবার কিছুটা জোরে নক করাতে ঢুলতে ঢুলতে দরজা খুলে দিলো পৌষ। খুলেই ঢুলুমুলু পায়ে আবার গেলো বিছানায়। তৌসিফ অবাক না হয়ে পারলো না। এই মেয়ে কতটা আরামেই না ঘুমাচ্ছে। একদম ঘোড়া বেঁচে ঘুম যাকে বলে।
এগিয়ে এসে ডাকলো তৌসিফ,
— পৌষরাত?
পৌষ স্বভাবসুলভ উত্তর দিলো না। তৌসিফের রাগ লাগলো। পৌষ’র হাত ধরে টান তুলে বললো,
— গো ফাস্ট পৌষরাত। ফ্রেশ হয়ে এসো। বাবু তোমাকে দেখেই রেস্ট নিতে যাবে। এতদূর জার্নি করে তোমাকে দেখতে সোজা এখানে এসেছে।
মুখে “চ্যাহ” শব্দ করে চোখ ডলতে ডলতে বাইরে যেতে নেয় পৌষ। তৌফিক তারাতাড়ি ওকে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
— কি আশ্চর্য কোথায় যাচ্ছো তুমি? মুখে অন্তত পানি দিয়ে যাও।
— কেন? মুখ দেখতে এসছে, দেখবে এরপর ফুটে যাবে। এত কাহিনি কেন করতে হবে?
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিছানায় পরা ওরনাটা ওর মাথায় দিয়ে বললো,
— চলো।
গটগট পায়ে বেরিয়ে এলো পৌষ। সোফাতে বসে আপেল চিবুতে চিবুতে ফোন স্ক্রল করছিলো আদিত্য। কেউ কাউকে এখনো দেখে নি যদিও। হঠাৎ চিরপরিচিত এক নারী কণ্ঠ কানে আসতেই মুখের আপেলটুকু আর চিবুতে পারলো না আদিত্য।
পৌষ আদিত্য’র দিকে না তাকিয়েই পেছন থেকে বললো,
— আসসালামু আলাইকুম।
তারাতাড়ি ঘুরে দাঁড়ায় আদিত্য। দুইজন দুইজনকে দেখে অবাকের চরম মুহূর্তে পৌঁছে গেলো। ফাঁকা ঢোক গিললো আদিত্য। পৌষে’র বাকি ঘুমটুকু হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। যদিও ও জানতো এই মুহুর্ত টা আসবে কিন্তু ঘুমে থাকায় এতক্ষণ কিছুই মাথায় ছিলো না। নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রাখতে চাইলো পৌষ। নিজের ভালোবাসার মানুষটা এতদিন পর চোখের সামনে অথচ মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না কারো। দুজন থম মে’রে গেলো একদম। আদিত্য এক প্রকার ছুঁটে এসে পৌষ’র সামনে দাঁড়িয়ে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— পুষি? এই পুষি? তুমি এখানে? এখানে কি করছো? কোন কাজে এসেছো? কিন্তু এখানে তোমার কি কাজ? এই এই তুমি বেডরুম থেকে বের হলে কেন? কথা বলো পুষি। প্লিজ সে সামথিং।
পৌষ’র চোয়াল কাঁপে। এডামস এপলটা নড়বড়ে হয়। চোখ দুটো তাদের তৃষ্ণা মেটাতে শুধু দেখেই যাচ্ছে। আদিত্য কোনকিছু না ভেবে পৌষ’র গালে হাতে রাখলো। এই প্রথম আদিত্যে’র স্পর্শ পেলো পৌষ। কোনদিন কারো হাতটা ছুঁয়ে দেখা হয় নি। আদিত্য যেন পাগল হয়ে উঠলো। বারবার জিজ্ঞেস করতে করতে আচমকা জড়িয়ে ধরলো পৌষ’কে। এইবার আর নিজেকে থামাতে পারলো না পৌষ। প্রিয় মানুষটার স্পর্শে এসে কেঁদে উঠলো হু হু করে।
তৌসিফ কাজের মেয়েটাকে রান্না ঘরে কফির কথা বলে ড্রয়িং রুমে এসে এহেন দৃশ্য দেখে থমকে গেলো। শরীরে থাকা রক্তগুলো পা থেকে মাথায় উঠতেও সময় নিলো না। তীব্র শব্দে গর্জে উঠে ও,
— আদিত্য!
এই প্রথম তৌসিফ ওকে আদিত্য বলে ডাকলো। মুহুর্তে ছিটকে পৌষ’কে ছেড়ে দিলো আদিত্য কিন্তু পৌষ মানলো না। ও গিয়ে পুণরায় আদিত্য’র হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
— আমাকে মাফ করে দাও আদি। মাফ করে দাও। আই ওয়াজ হেল্পলেস। আমি সরি আদি….
তৌসিফ এসে এবার হেচকা টানে নিজের বুকে নিয়ে নিলো পৌষ’কে। আদিত্য’র দিকে তাকিয়ে কঠোর গলায় বললো,
— বাসায় যা।
ছুঁটে চলে গেল আদিত্য তবে পৌষ? ও তো ছটফট করতে লাগলো। নিজেকে শক্ত রাখা তেজী মেয়েটা আদিত্য’র কাছে যেতে চাইলো। বলতে চাইলো তাকে সবকিছু। সে মাফ চাইতে চাইলো আদিত্য থেকে। অথচ তৌসিফ ভাবলো ভিন্ন। ওর বউ কি না ওরই ভাতিজার সাথে? মাথাটা খারাপ হতে সময় লাগলো না ওর। হাত পা ছুঁড়ে আদিত্য’র কাছে যেতে চায় পৌষ। তৌসিফ ওর হাত টেনে রুমে নিয়ে দরজাটা ধাম করে বন্ধ করে দিলো। বিকট দুটো ধমকে ভয়ে ছিটকে গেলো পৌষ। তৌসিফ পৌষ’র গালটাতে আঙুল ডাবিয়ে চেপে ধরে দাঁত খামটি মে-রে প্রশ্ন করলো,
— তোর আশিক আদিত্য ছিলো?
ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে পৌষ। কোনমতে বলে,
— ব..ব্যাথা… ব্যাথা পাচ্ছি।
— এই চুপ! বল তোর ঐ লাফাঙ্গা প্রেমিক আদিত্য? বল!
বিকট ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করে গালের চাপটা দীর্ঘ করে তৌসিফ। ওর মাথায় খু*ন চেপেছে এই মুহুর্তে। পৌষ কান্না করতে করতে মাথা নেড়ে সায় জানাতেই তৌসিফ হঠাৎ ওর গলায় চেপে ধরে বলে,
— মুখে বল!
গলায় চেপে ধরায় কিছুই বলতে পারলো না পৌষ। তৌসিফ চাপটা আরেকটু জোরে দিয়ে দেয়ালে ঘেঁষিয়ে বললো,
— বল!
— হ…হুউ।
গলায় চাপ দেয়া হাতটা ছেড়ে দিলো তৌসিফ। দুই হাতে গলা ধরে ফ্লোরে বসে কাশতে লাগে পৌষ। দানবীয় লাগছে তার তৌসিফ’কে। এই লোক এতটা কেন ক্ষেপে গেলো? সে কি সত্যি ই জানতো না আদিত্য পৌষ’কে ভালোবাসে?
রাগে হিতাহিত জ্ঞান মুহুর্তে ই হারিয়ে ফেলে তৌসিফ। আজও ভিন্ন হলো না। তাকে ধোঁকা দেয়ার সাহস কে করলো? এতটা জঘন্য অনুভূতি থেকে পালাতে চাইলো ও। আপন ভাতিজার প্রেমিকাকে কি না ও বউ করে নিয়ে এসেছে? রাগে গা কাঁপছে ওর। সাইড টেবিল থেকে সিগারেট নিয়ে জ্বালিয়ে ঠোঁটের ভাজে গুজলো। ভয়ে ভয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে পৌষ। একটু দূরেই পানি রাখা। এই মুহুর্তে পানির দরকার। কাশতে কাশতে গলা ব্যাথা করছে। কোনমতে উঠে যেই না পানির গ্লাসটা তুলবে ওমনিই হঠাৎ তৌসিফের থাবার স্বীকার হলো। জলন্ত সিগারেটটা পেছন থেকে ওর পেটে চেপে ধরতেই আঁতকে উঠে চিৎকার করে পৌষ। তৌসিফ থামলো না। জলন্ত সিগারেটটা এবার ঠিক পৌষ’র বুকে চেপে ধরলো। ছুটতে চায় পৌষ। পালাতে চায় তবে পারে না। ওর একেকটা আত্ন চিৎকারে দরজার বাইরে উপস্থিত প্রতিটি কাজের লোক কেঁপে উঠে। তৌসিফের রাগ সম্পর্কে তারা অবগত কিন্তু ছোট্ট মেয়ে টা তো অবগত না।
.
অতীত~
আদিত্য আর পৌষ দুইজনকে একই শিক্ষক পড়াতো। যদিও আদিত্য ওর থেকে দুই তিন বছরের বড় তবে ইংরেজিটা পড়ানোর সুবাদে গ্রামার পার্টটা মাঝে মধ্যে মিলে যেতো। পৌষ’র একটা বই ই স্যার একবার দিতে বলে আদিত্য’কে। ফোন করে হেমন্ত’কে বলে যাতে পৌষ’কে বলে গ্রামার বইটা আদিত্য’দের বাসায় পৌঁছে দিতে। আদিত্যের পরিক্ষা। হেমন্ত তখন কাজে যাচ্ছিলো বিধায় নিজে দিতে পারে নি চৈত্র বা জৈষ্ঠ্য ও বাসায় নেই। অবশেষে পৌষ পাশের বাড়ীর চাচাতো বোনকে নিয়ে যায় তালুকদার বাড়ীতে। এই বাড়ী এলাকায় সবাই চিনে। এই পথ ধরে কলেজ যেতো পৌষ।
সেদিন ই প্রথম এই বাড়ীতে পা রাখে ও। দারোয়ান জানায় দুই তলায় থাকেন আদিত্য’রা। পৌষ ভদ্র ভাবে বইটা আদিত্য’কে দিতেই আদিত্য’র মা জোর করে ওকে টেনে বসায় ভেতরে। অসস্তিতে হাশফাশ করা পৌষ’কে দেখেই আদিত্য হেসে বলে,
— কি হয়েছে পুষি? আরেন্ট ইউ ফিল কমফোর্ট?
— হুউউ। না আসলে ভাইয়া। আমার নাম পৌষরাত।
— কিন্তু তোমার এই ছোট্ট খাট্ট মুখটা দেখে একদম বিড়াল বিড়াল লাগে। আদুরে বাচ্চা একটা। তাই তোমাকে পুষি ডাকলাম।
পৌষ’র বুকটা এমনিতেই ধুকপুক করছিলো। আদিত্য এত কথা বলাতে তা বেড়েছিলো কয়েকগুণ। এরপর কতদিন গেলো। কিভাবে যেন ফেসবুকেও একদিন কথা বলা শুরু হলো। বাহানাটা ছিলো আজব। কোন এক অ্যাপ পৌষ’কে ইনস্টল করে কোড চাইছিলো আদিত্য। এসব কিছু করে ও ইনকাম করে। পৌষ ঐদিন অনেক চেষ্টা করেও কোড দিতে পারি নি। কেন যেন হলোই না।
হেমন্ত তখন নতুন ওকে ফোন কিনে দিয়েছে। এতসব ও বুঝতো না।
ধীরে ধীরে কথা বাড়লো। কলেজের বাইরে আদিত্য দাঁড়িয়ে থাকতো মাঝেমধ্যে। কেউ যাতে না চিনে তাই মুখে মাস্ক পড়ে সানগ্লাস চোখে দিয়ে রাখতো।
সাহস জুগিয়ে একদিন আদিত্য কথা বলতে এগিয়ে এসেছিলো পৌষ’র কাছে। সেদিন ছিলো পৌষ’র কলেজে শেষ দিন। সামনে তার ফাইনাল পরিক্ষা। বিদায় অনুষ্ঠানে শাড়ী পরে আসাতে ওকে দেখে লোভ সামাল দিতে পারে নি আদিত্য তাই তো ছুটে এসে কথা বলতে চায়। ভাগ্যে’র নির্মম পরিহাসে বড় চাচা সেদিন নিতে যায় পৌষ’কে। এসেই দেখে নাক,মুখ ঢেকে রাখা এক ছেলে একটা গোলাপ দিচ্ছে পৌষ’কে। ব্যাস! কান্ড সেদিন ই ঘটে গেলো।
বাসায় এসেই তুলকালাম লেগে যায়। পৌষ’কে কিছুতেই আর পড়াবেন না তিনি। তবে পৌষ’র চড়া গলা আর হেমন্তের জন্য পরিক্ষাটা দিয়েছিলো ও। ভার্সিটিতে ভর্তি ও হয়েছে এ বছর এক প্রকার যুদ্ধ করে। ভাগ্য ক্রমে একই ভার্সিটির ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে আদিত্য আর পৌষ।
ওর উনিশতম জন্মদিনের রাতে আদিত্য হঠাৎ ই কল করে। সে জানায় ম্যারিন ট্যুরে যাচ্ছে সে। হয়তো মাস তিন চার লাগবে। এসেই বাসায় জানাবে পৌষ’র কথা। যদিও ওর বাবা জানে তবে এখন পর্যন্ত কিছু বলেন নি তবে।
পৌষ’র মনে মনে পছন্দ ছিলোই বটে তাই তো সেদিন ওয়াদা করে শক্ত মনের মেয়েটা, সে অপেক্ষা করবে।
___________________
বর্তমানে~
আদিত্যদের ফ্ল্যাট থেকে চিল্লা চিল্লির শব্দ আসছে। তৌসিফ ওদিকে যেতে গিয়েও গেলো না। মাথা ঠান্ডা করা প্রয়োজন ওর। নিজেকে সামলে ওয়াশরুম ঢুকে শাওয়ার অন করে ও। সময় নিয়ে ভাবে কিছু জিনিস। মাথা ঠান্ডা করে বের হতেই দেখে ভয়ে এখনও লুকিয়ে বসে আছে পৌষ। মায়া হয়েও হলো না তৌসিফে’র। কিভাবে আদিত্য’র বুকে গেলো ও?
চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করে পৌষ’র কাছে গিয়ে ওকে টেনে তুলে। শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
— ফ্রেশ হয়ে এসো।
এই প্রথম তৌসিফের এক কথায় পৌষ ওয়াশরুমে গেলো। তৌসিফ বাকা হাসলো। ডোজ কাজে দিয়েছে। যদিও রাগটা ছিলো বড় ভাই আর পৌষ’র চাচার উপর বেশি তবে তা উঠিয়েছে পৌষ’র উপর। প্লেটে করে খাবার নিয়ে এসে দেখলো পৌষ হাত পা গুটিয়ে বিছানায় বসা। তৌসিফ ওর সামনে খাবার রেখে বললো,
— খেয়ে নাও।
মাথা নিচু করেই মুখে খাবার দেয় পৌষ কিন্তু গিলতে পারে না। গলা ব্যাথায় চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এলো ওর। কোনমতে বললো,
— গিলতে পারছি না।
— খেতে বলেছি খাবে।
বলেই চলে যায় তৌসিফ। মুখে খাবার নিয়ে ই কেঁদে ফেলে পৌষ।
তৌসিফ হাতে করে একটা স্যুপের বাটি নিয়ে ফেরত আসে। পৌষ’র সামনে দিয়ে বলে,
— ধীরে ধীরে খাও।
কোনমতে অর্ধেক খায় পৌষ। তৌসিফ হঠাৎ ওর পেটে হাত রাখে। চমকায় পৌষ তবে লাভ হয় না। কিছু বলার আগেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে “উফ” শব্দ। পেটে বরফ ধরেছে তৌসিফ। দাঁত চেপে বিছানার চাদরটা খামচে ধরে ও। তৌসিফ তাকালো ওর মুখপানে। চোখ মুখ খিচে আছে মেয়েটা। আস্তে ধীরে যখনই ওর বুকের দিকে উঠতে চাইলো তখনই অসহায় চোখে তাকিয়ে নিচু স্বরে পৌষ বলে,
— প্লিজ না।
— আমি না তো কে?
চোখ বুজে নেয় পৌষ। ওর জামাটা বুকের দিক থেকে সরিয়ে তাতে বরফ খন্ড ধরে তৌসিফ। হাত পা অবশ হয়ে আসে পৌষ’র। কি হচ্ছে তার সাথে এসব?
#চলবে…..
— আমি আদ্রিয়ান’কে ভালোবাসি আব্বু।
ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো উপস্থিত সকলের কান। ফাটা চোখে তাকিয়ে রইলো আদ্রিয়ান। পুঁচকে চিনিটার এতটা সাহস কোথা থেকে এলো? মুহুর্তেই থাপ্পড়ের গুঞ্জন ছড়ালো। গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোদ তবে তার মুখ থেমে রইলো না,
— মারো আব্বু কিন্তু তবুও আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব না। আই লাভ আদ্রিয়ান। বাবুরা আমাকে মাম্মা ডাকে। তাদের ছাড়া আমার চলে না। চলবে না।
দ্বিতীয় বারও থাপ্পড় ই পরলো। আদ্রিয়ানের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এগিয়ে এসে মি.রহমানের হাতটা ধরে অনুনয় করল,
— প্লিজ আঙ্কেল ওকে মারবেন না৷ দয়াকরে কথাটা শুনুন……
— বেরিয়ে যাও।
— আমার কথাটা শুনুন…..
— দোষটা আমার মেয়ের তাই বেরিয়ে যেতে বলছি নাহয় আজ….
আপমানে জর্জরিত আদ্রিয়ানের পরিবার ছেলের খুশির দিকে তাকিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলেন তবে আদ্রিয়ান দাঁড়ালো না। মিনতি করে বললো,
— আমি যাচ্ছি। ওকে মারবেন না প্লিজ।
— আমার মেয়ে, যা খুশি করব। বেরিয়ে যাও।
— না। আদ্রিয়ান আমিও যাব।
রোদের কথাটা মুখ দিয়ে বের হতেই এবার ওর বাবা ওর গলা চেপে ধরলো। আদ্রিয়ান সহ এবার রাদ এগিয়ে এলো রোদকে ছাড়াতে। আতঙ্কিত সকলে তাকিয়ে রইলো। রোদকে ছাড়াতেই রোদ আদ্রিয়ানের বুকে ঠাই নিলো। দুই হাতে ঝাপ্টে ধরলো। হঠাৎ ওর চুলের গোছা ধরে আদ্রিয়ান থেকে ওর মা সরালো ওকে। আদ্রিয়ান তারাহুরো করে বললো,
— আমি যাচ্ছি। ওকে ছাড়ুন। দয়াকরে ছাড়ুন।
— এখনই যাও।
আদ্রিয়ান যেতে নিলেই রোদ কেঁদে উঠলো,
— আদ্রিয়ান? আদ্রিয়ান? আমাকে নিয়ে যান। আমিও যাব। এখানে থাকব না। আদ্রিয়ান!!
অসহায় আদ্রিয়ান দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। পিছনে পরিবার। রোদের কান্নার শব্দ তখনও কানে বিঁধছে। বুকের ভেতর চলা তুফান থামানো দায়। আদ্রিয়ান বেরিয়ে গেলো গাড়ি নিয়ে। কোথায় গেলো জানলো না কেউ।
#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১০
আজ চারদিন পরলো তৌসিফের বউ হয়ে তালুকদার বাড়ীতে আছে পৌষ। ছটফট করা দূরন্ত পৌষ এই চারদিন ধরে ঘর বন্দী হয়ে কাটিয়ে দিলো। তাকে রুমের বাইরে অবদি পা রাখতে দেখা গেলো না। তৌসিফের ও তেমন কোন আতাপাতা নেই। দিনে এক কি দুই বার ওর দেখা মিলে। মন মরা ভাব নিয়ে পৌষ তাকালো বাড়ির আঙিনায়। পুকুর পাড়টা দেখা যাচ্ছে। সেখানেই উঁচু করে সিমেন্টের বাঁধাই করা জায়গা। আদিত্য বসে ফোনে কারো সাথে কথা বলছে হয়তো।
নজর সরিয়ে নিলো পৌষ। তার ফোনটা বেজে যাচ্ছে। রুমে এসেই দেখলো হেমন্ত কল করেছে। ওদের কারো সাথেই এই চারদিন কথা হয় নি। যেখানে ভাগ্য ই সাথ দিলো না সেখানে রেগে থাকার তেমন কোন কারণ দেখলো না পৌষ। ফোনটা রিসিভ করে ই সালাম জানালো অতি নম্র স্বরে। ওপাশ থেকে সালামের জবাব দিয়ে ই হেমন্ত বলতে লাগলো,
— কেমন আছিস পৌষ?
— জানি না তো হেমু ভাই।
হেমন্ত’র বুকটা ভেঙে কান্না পায়। তবুও কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
— এমন না আমি জানি না পৌষ। আমি সবটা জানি। নিজের অস্তিত্বের সত্যি টা তুই এখন অবদি জানিস না। আমার হাত-পা বাঁধা সোনা নাহলে তোকে এতটা সাফার করতে দিতো না তোর হেমু ভাই। শুধু এতটুকু মনে রাখ যেমনটা তুই জানিস বিষয়গুলো তেমন না। তোর অতীত তোকে ওখানে নিয়ে গিয়েছে পৌষ। জানি তুই রেগে আছিস। নিজের বাবা’র সাফাই গাইছি না শুধু বলব একদিন সত্যি গুলো তুই জানবি। জানি না কিভাবে সামনে এগুবি তবে সবসময় মনে রাখিস পৌষ তোর হেমু ভাই আছে তোর সাথে। তুই আমার বোন, তোকে এই বাড়ীর প্রতিটা মানুষ ভালোবাসে সোনা।
অতীত কারো পিছু ছাড়ে না, তোকে ও ছাড়ে নি। সুযোগ দে নিজেকে। তুই পারবি সবটা গুছিয়ে নিতে। জানি তোর মনে প্রশ্ন জাগছে অনেক তবে ঐ যে বললাম চাইলেও কিছু বলতে পারব না আমি এখন।
— একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে?
— হু।
— আমি কি জারজ সন্তান?
উত্তর টা শোনা হলো না। পেছন থেকে তৌসিফ ওর ফোনটা নিয়ে কেটে দিয়ে তাকালো পৌষ’র দিকে। মেয়েটার চোখের ভাষা ও বুঝে না। মাঝে মধ্যে বুঝে তবে আবার মনে হয় না বুঝে না। এতটুকু একটা মেয়ে চারদিনের ব্যাবধানে কেমন মূর্ছে গেলো। তৌসিফ সাধারণ ভাবেই বললো,
— এতদিন পর বাসার কথা মনে পরলো?
— না। হেমু ভাই কল দিয়েছিলো।
— ওহ। তোমার সাথে কিছু ছিলো পৌষরাত। এখন বাইরে যাচ্ছি। রাতে কথা হবে। তোমার কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবে রাতে।
ওর মাথায় হাত দিয়ে চলে গেল তৌসিফ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তৌসিফের গাড়িটা যেতে দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পৌষ।
রুমে এসে ওরনাটা মাথায় দিয়ে পা বাড়ায় বাইরের দিকে। দরজার কাছে যেতেই মিনু বলে উঠলো,
— কই যান ছোট ভাবী?
পৌষ তাকালো একপলক। এমনি সময় হয়তো দুটো কড়া কথা বলতো তবে এখন কিছুই বললো না। গটগট পায়ে বেরিয়ে এলো সদর দরজা থেকে। মিনু পেছন থেকে ডাকলেও শুনলো না।
তিন তলা থেকে নেমে পৌষ সোজা পুকুর পাড়ে এলো। আদিত্য’র কাছে মাফ চাইতে হবে তার। কোন বাবা ই চাইবে না তার ছেলের বিয়ে কোন জারজ সন্তানের সাথে হোক। তেমন ই ভাবে হয়তো তৌফিক তালুকদার ও চায় নি। এটাই তো স্বাভাবিক। জীবনের সবচাইতে বড় সত্যি কি না পৌষ জানে না তবে দুই দিন পূর্বে যখন তৌসিফ ওর বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলছিলো তখন পৌষ’র কানে শুধু একটা কথাই ঢুকেছিলো যা তৌফিক তালুকদার বলেছিলেন চিৎকার করে, “আমার ছেলে’র সাথে জারজ কারো সম্পর্ক গড়ুক তা কোনদিন আমি মেনে নিতাম না”।
ব্যাস পৌষ সেদিন একটা উত্তর পেয়ে গিয়েছিলো। এটাই একমাত্র কারণ যার দরুন তৌফিক তালুকদার ছেলেকে সরিয়েছিলেন পৌষ থেকে। কিন্তু কেন তৌসিফের সাথে তার বিয়ে হলো ওটা পৌষ জানে না। তবে ও ধরে নিয়েছে যেহেতু ও জারজ সন্তান আর তৌসিফের বউ ও ভেগে গিয়েছে। এছাড়াও তৌসিফের চরিত্র ঠিক নেই সেই সুবাদে হয়তো জারজ পৌষ’র সাথে চরিত্রহীন পুরুষ তৌসিফের বিয়ে হলো।
হঠাৎ কানে কিছু কথা আসতেই স্তম্ভিত ফিরে পায় পৌষ। কখন যে ভাবনায় ডুবেছিলো খেয়াল ই নেই। আদিত্য হেসে হেসে ফোনে কথা বলছে কারো সাথে,
— আরে না কি যে বলিস। এই মাস পরই চলে যাচ্ছি দেশের বাইরে। প্রেম-ট্রেম করার সময় নেই। এতদিন টাইম পাস করেছি অনেক। তোদের চক্করে পরে বেট ধরে অনেকটা সময় ও অপচয় করেছি। নাও ইটস টাইম টু রিলাক্স। দেশী মেয়ে দিয়ে আমার পোষাবে না ডুড। আই ওয়ান্ট এ উমমম ইউ নো…..
আর কিছু শুনার অপেক্ষা করলো না পৌষ। ধীরে ধীরে পা ফেলে যেভাবে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই চলে গেল। ও যেতেই কান থেকে ফোনটা সরালো আদিত্য। পুকুরের পানিতে এতক্ষণ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো পুষির অবয়ব যা ধীরে ধীরে নাই হয়ে গেলো৷ আদিত্য’র বা চোখ দিয়ে আচমকা এক ফোঁটা গরম তরল পরলো। গাল বেয়ে না পরে তা টুপ করে পরলো পুকুরের পানিতে। এত এত মিষ্টি পানির মধ্যে মিলে নিজের অস্তিত্ব হারালো সেই নোনা পানি। ঠিক যেমন ভাবে সম্পর্কের বেড়া জালে নিজেকে হারালো আদিত্য।
চলমান গাড়িতে বসে মুচকি হাসলো তৌসিফ। জীবনে এক ভুল মানুষ কয়বার করে? একবার ই তো। তাহলে তৌসিফ কেন দু’বার করবে? “ন্যাড়া বেল তলায় একবার ই যায়” প্রবাদটা মনে পরলো তৌসিফের। এর কারণ আছে অবশ্য। বেল তলায় ন্যাড়া মাথায় একবার যাওয়ার পর তো আর ন্যাড়া বেঁচে থাকে না। দ্বিতীয় বার যাওয়ার সুযোগ টা কোথায় কিন্তু তৌসিফের তো সুযোগ আছে। সে কেন কাজে লাগাবে না তাহলে সেই সুযোগ।
.
সিড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠে ভেতরে ঢুকে পৌষ। এলোমেলো মস্তিষ্ক তো কাজ করে না আজ দুই দিন ধরে। যার বাবা মায়ের ই ঠিক নেই সেসব সন্তানদের রাগ, অভিমান মানায় না তাই তো পৌষ কারো প্রতি কোন রাগ রাখলো না মনে। পুষে রাখলো না কোন অভিযোগ। ছেড়ে দিলো ভাগ্য’র উপর।
ওকে ঢুকতে দেখেই হেলেদুলে ওর সামনে এলো মিনু। বাদাম বুট চিবুতে চিবুতে রসিয়ে রসিয়ে বললো,
— কি গো ছোট ভাবী তোমার মুখটা ওমন দেখায় কেন? মামা বুঝি আজকাল আদর সোহাগ কম দিচ্ছে?
কি হলো তা বুঝা গেলো না তবে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মিনু। পৌষ ওর গালে ঠাটিয়ে এক থাপ্পড় মে’রে হিসহিসিয়ে বললো,
— কাজের মেয়ে যোগ্যতা বুঝে কথা বলবি। মুখ এত ছুটলে জিহ্বা গোড়া থেকে উপড়ে ফেলব। চিনিস নি এখনও পৌষ’কে।
বলেই ধুপ ধাপ পা ফেলে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় পৌষ। রান্না ঘরে থাকা বিজলির মা মুখ টিপে হাসছেন। পাশের মেয়েটাকে বললেন,
— এবার কোন নোংরা খেলার ইতি ঘটবে বলে মনে হচ্ছে। যোগ্য মেয়ে এসেছে বাড়িতে।
মেয়েটা সায় জানালো। মিনু’কে তার সহ্য হয় না। নিজে কাজের মেয়ে হয়েও ঢপ দেখায় এমন যেন সে নিজেই মালিক।
________________
জীবন মানুষ’কে বিভিন্ন ভাবে শিক্ষা দেয়। ঠোকরা খেতে খেতে ই তো একদিন মানুষ বড় হয়। বুঝ আসে তার মাঝে। পৌষ’র আজ কেন জানি কান্না আসছে না। সে খুব করে চাইলো হাউ মাউ করে কান্না করতে তবে হচ্ছে ই না। কান্না আসছে না। চোখে জ্বালা ধরে একদম তবুও কান্না এলো না।
এমনটা না আদিত্য’কে সে অনেক বেশি ভালোবাসত বা খুব গভীর কোন সম্পর্ক ছিলো তাদের মাঝে। কথাটা হলো ফাস্ট লাভ অব টিনএজ। কিশোরী’র প্রথম মন বিনিময় ঘটেছিলো। কোন রুপ স্পর্শ ছাড়া এক সম্পর্ক যার কোন মারপ্যাঁচ পৌষ বুঝে নি। মনের উপর জোড় চলে না। কখনোই না। যদি ততটা গভীর সম্পর্ক হতো তাহলে হয়তো পৌষ কোনদিন বিয়েতে মত দিতেই পারতো না। পছন্দ ছিলো দুজন দুজনকে। সেদিন আবেগ সামলাতে পারি নি পৌষ তাই তো আদিত্য যখন আলিঙ্গন করলো তখন বেহায়া তার হাত দুটো হঠাৎ ই আদিত্যে’র পিঠ ছুঁয়ে দেয়। কোনরুপ কামনায় পরে পৌষ হাত বাড়ায় নি। আদিত্য তার ভালো বন্ধু ছিলো প্রথম। পরেই না সম্পর্ক একটু বাড়লো যা পৌষ তৌসিফের নামে কবুল পড়ে নিজ পায়ে পিষ্ট করেছে।
আজ আদিত্য’র সত্যি জানতে পেরে কেন জানি খারাপ লাগলো না। শুধু মনে হলো যা হলো ভালোই হলো। একজন জারজ সন্তান থেকে বেঁচে গেলো আদিত্য। ওর দেয়া ধোঁকা পৌষ’র মেনে নিতে একটুও খারাপ লাগে নি। অভিমানে বুকটা ফেটে গেলেও নিজেকে বুঝ দেয় পৌষ। জারজদের অভিমান মানায় না। তারা শুধু হেলায় খেলায় মানুষের প্রয়োজন মিটায়।
কি মনে করে আলমারি খুলে পৌষ। তৌসিফ তার বউয়ের জন্য অসংখ্য দামি কাপড়ে আলমারি ভরেছে। বেছে বেছে ফিনফিনে এক পাতলা শাড়ী টেনে বের করে ও। আজ পৌষ সাজবে। নিজেকে সাজাবে। তৌসিফের জন্য। আদিত্য’র সাথে তার শেষ সম্পর্কটুকু ছিলো ক্ষমা চাওয়ার যার আর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না পৌষ। বন্ধুদের সাথে বেট ধরেই যেহেতু আদিত্য এসব করেছে তাহলে কেন পৌষ মাফ চাইবে?
লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলো পৌষ। সাদা’র মাঝে লাল রঙা শাড়ীটা অদক্ষ হাতে পরলো ও। একা অবশ্য পারলো না। ফোনের সাহায্য প্রয়োজন হলো। ঠিক মাঝ বরাবর সিঁথি কেটে ঠোঁটে গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিক লাগালো। বলা হয় পুরুষ নাকি নারীর লাল রঙা ঠোঁট দেখেই সবার আগে আকর্ষণ বোঁধ করে। আয়নায় নিজেকে দেখেই চমকালো বটে। তার এহেন রুপ নিজের কাছেই অজানা। অচেনা। কখনো এই রুপে নিজেকে আবিষ্কার করা হয় নি তার।
.
অপেক্ষার প্রহর শেষ করে তৌসিফ ফিরলো রাত বারোটা নাগাদ। মিনু ঘুমিয়ে যাওয়াতে তেমন তান্ডব ঘটলো না। নাহয় তাকে চড় মারার মশগুল সে পৌষ’কে গুনাতো।
অন্ধকার রুমে ঢুকে তৌসিফ ভাবলো পৌষ হয়তো ঘুম। তাই হাত ঘড়ি খুলে সোজা ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ফিরে এসে পৌষ’কে খেতে আসতে বলবে বলে যেই না লাইট অন করলো ওমনিই চমকালো ও। খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে এক অপসরী। তৌসিফের বুকে দুটো ধাক্কা লাগলো। পৌষ’র এহেন রুপ তার দেখা হয় নি। বিবাহের রাতে ও মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগে নি। চোখ বুজে নিজের প্রথম নারীটির চেহারা মনে করতে চাইলো তৌসিফ। পারলো না। কোন ভাবেই তার চেহারাটা কল্পনায় এলো না। তার ঐ ফর্সা মুখটা আজ পৌষ’র শ্যামারঙা মুখের সামনে হার মানলো। বড্ড অসহায় অনুভব করে তৌসিফ। ফাঁকা ঢোক গিলে পৌষ’র সামনে দাঁড়িয়ে ডাকে,
— পৌষরাত?
— জ্বি।
আজকাল মেয়েটা এক ডাকেই উত্তর দেয়। তৌসিফ দুই আঙুল পৌষ’র চিবুকে ছুঁয়ে দিয়ে ওর মুখটা তুলে চেহারাটা দেখেই বললো,
— মাশা আল্লাহ।
পৌষ জানে না কেন তবে মৃদু লজ্জা এসে ভর করেছে তার মাঝে। তৌসিফ এবার ওর মাথায় হাত রেখে বললো,
— এভাবে শাড়ী পরলে যে আজ?
— ভালো হয় নি?
প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন পাওয়া তৌসিফের পছন্দ নয় তবে আজ খারাপ লাগলো না। পৌষ’র পাশে বসে হাতটা ধরে বললো,
— অনেক ভালো হয়েছে পৌষরাত। তোমাকে সাদা এক পরী দেখাচ্ছে।
মাথাটা নামিয়ে নেয় পৌষ। তৌসিফ ওর হাতের ভাজে নিজের হাত রেখে মোহনীয় কণ্ঠে বলে,
— আই ক্যান রিড ইউর আইস পৌষরাত। এ’ম আই থিংকিং রাইট?
পৌষ মাথা ঝাকালো। তৌসিফের বুঝতে মিনিট ও লাগে নি পৌষ কি চায়৷ তার চোখের চাহনিতে সবটা স্পষ্ট। তৌসিফ ধীরে ধীরে ওর কোমড়ের দিকে হাত রাখতেই মুচড়ে উঠে পৌষ। তৌসিফ আরেক হাত ওর বুকের দিকে রেখে মুখটা একদম সামনে এনে ফিসফিস করে বললো,
— আ’ম সরি ফট দ্যাট জান দো আই ওয়াজ নট রং।
পৌষ’র দেহে কাঁপন ধরলো। তৌসিফের ঘ্রাণ ওর নাসারন্ধ্রে ধাক্কা খাচ্ছে। তৌসিফ পুণরায় ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
— জীবনে প্রথম কারো কাছে মাফ চেয়েছি পৌষরাত।
— আমাকে মাফ করে দিন।
— দিলাম।
বলেই তৌসিফ ওর মাথায় চুলে চুমু খায়। সম্মুখে বসে থেকে এক গোছা চুল সামনে এনে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ টেনে বলে,
— আজ ঘ্রাণ টা আরো সুন্দর পৌষরাত।
কথাটা বলেই ওকে কোলে তুলে তৌসিফ। সারা রুমে তখন জ্বলছে গোল্ডেন রঙের বাতিটা যা পৌষ’র কাছে চারশত চল্লিশ বোল্ডের লাইট।
#চলবে……