#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_১৭
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
রাতের খাবারের পর তুলি যখন ঘরে এল তখনই দেখা গেল আয়শান বসে কোন কাজ করছে। তুলি একবার তার দিকে চেয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করতেই আয়শান ল্যাপটপ রাখল। বিছানায় টানটান হয়ে হাত পা মেলে শুঁয়ে পড়ে। শুধাল,
“ আম্মুর সাথে সব রাগ অভিমান মিটে গেছে তুলি? ”
তুলি নিশ্চুপ তাকাল। হ্যাঁ, মিটে গেছে। মামনির সাথে তার কোন রাগ ছিলই না। যা ছিল তা চাপা অভিমান। কিন্তু কখনো প্রকাশ করতেই পারেনি মেয়েটা। মামনি সেবার রেগেই বলেছিল তুলিকে যাতে তার সামনে না পড়ে। তুলিও সে আদেশ মাথা পেতে নিয়ে কখনো নিজ থেকে যোগাযোগ করে নি, সামনে যায় নি!অথচ আজ কতগুলো দিন পর মামনি তাকে আদর করল, আগের মতো স্নেহ করল, ভালোবাসল! তুলির এসব ভেবেই কান্না পেল কেবল। মায়ের পর যাকে সে নিজের মায়ের মতো ভেবেছে, সর্বোচ্চ ভালোবেসেছে তার আদর পেয়ে টলমল হয়ে উঠে চোখজোড়া। কতগুলো দিন সে চাপা কষ্ট বয়ে গিয়েছে। মামনির সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করেছে। আজ এতগুলো দিন সে আগের মামনিকে পেয়েই সে আনন্দে উদ্গ্রীব হলো। কান্না পেল তার কেবল। আর সে কান্না বোধহয় আয়শানের জিজ্ঞেস করা প্রশ্নে আরো উৎলে উঠল। চোখ টলমল হয়ে আসে মুহুর্তেই। কোনভাবে কান্না আটকে রেখে শুধাল,
“ আমি মামনির উপর কখনো রাগ করিনি,কখনোই না। তবে একটা চাপা কষ্ট ছিল এই ভেবে যে মামনি আমার জন্য কষ্ট পেয়েছে।আমি অপরাধী ছিলাম তার চোখে এই ভেবে কষ্ট পেতাম। আজ, আজ আমি মামনিকে জড়িয়ে ধরতে পেরেছি। আগের মতো ঝাপটে জড়িয়ে ধরতে পেরেছি আয়শান ভাই। ”
আয়শান খেয়াল করল কেবল তুলিকে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়েছে ততক্ষনে। তুলি অত্যাধিক নরম মনের মেয়ে। খুব ছোট থেকেই। শুধু মাঝখানে কেমন অনুভূতিহীন, নিষ্প্রাণ হয়ে গেল তার তুলিটা! তুলির আগের মতো হচ্ছে, লজ্জা পাচ্ছে, কাঁদছে এসব দেখে আয়শান খুশিই হলো। মৃদু হাসল এবারে। উঠে বসে তুলির হাতটা ধরে গম্ভীর স্বরে শুধাল,
“ আম্মু অনেক আগেই ভুল বুঝতে পেরেছিল তুলি। কিন্তু তোর সাথে যোগাযোগ করার সাহস করেনি। আমার থেকে খোঁজ করত তোর। ”
তুলি নিশ্চুপই থাকল। শুধু কান্নাই দেখা গেল। আয়শান ফের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ আম্মু তোকে আপন ভাবে, আমরা তোকে আপন ভাবি। বিশ্বাস করিস তো এখন হুহ? ”
তুলি তাকায়। উত্তর করে,
“ আমি আপনাদের কখনোই অবিশ্বাস করিনি আয়শান। ”
“ তবুও আমি জানি, তুই ভাবতি এই বাড়ির কেউ তোকে আপন ভাবে না। তাই না?”
তুলির কান্না আরো বাড়ে যেন। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালায় মেয়েটা। অথচ পারে না। বলে,
“ হঠাৎ এসব নিয়ে প্রশ্ন কেন করছেন?
“ এমনিই!”
আয়শান হেসে কথাটা বলতেই দরজায় আওয়াজ হলো। এখন প্রায় রাত বারোটা। দেরি হলো কারণ তুলি আয়জানের সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছিল। অতঃপর এতোটা সময় থেকেও যখন আয়জান বাড়ি ফিরল না তখন রুমে এল। কিন্তু এত রাতে কে দরজায় আওয়াজ করবে? নিশ্চয় কোন দরকার? তুলি তাকাল। যেতে নিবে ঐ সময় আয়শান উঠে গিয়ে দরজা খুলল। সঙ্গে সঙ্গেই দেখা মিলল আয়জানের। ভাইকে দ্রুত এড়িয়ে গিয়ে চলে গেল তুলির কাছে।অতঃপর তুলির মাথায় দ্রুত আলতো হাতে চড় মেরে বলে উঠল,
“ তুলি তুই আমার সঙ্গে দেখা না করে ঘুমোতে চলে এলি? কি আশ্চর্য কি আশ্চর্য! আমরা তুলির এ কি রূপ দেখছি হুহ? তুলিটা কিনা এত নিষ্ঠুর হয়ে গেল? আয়জান ভাইকে ভুলে গেল? ”
তুলির হেসে ফেলল এবারে।আয়জান এই বাড়ির ছোট ছেলে হওয়াতে ছোট থেকেই দুষ্টু প্রকৃতির কিছুটা। চঞ্চল! আর এই বাড়িতে এই চঞ্চল দুষ্টু প্রকৃতির ছেলেটার সাথেই তুলির খুব বেশি বন্ধুত্ব ছিল। তুলি হাসে। মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“ তো তুমি তো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে চলে গিয়েছিলে। আমি অনেকটা সময় অপেক্ষা করলাম। শেষে মামনিই আমায় পাঠিয়ে দিল। ”
আয়জান ফুঁসে উঠে তাকাল। তুলি কাঁদছিল নাকি? চোখে পানি কেন? মুহুর্তেই ভাই এর দিকে তাকাল সে। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
“ বড় ভাইয়া? তুমি তুলিকে কিছু বলেছো নিশ্চয়? ও কাঁদছে কেন? তুমি ওকে কষ্ট তাও কেন বারবার?আমি কিন্তু ওর বড়ভাই, ভুলে যেও না। মেনে নিব না এসব। বেশি কষ্ট দিলে আমাদের মেয়ে আমরা নিয়ে চলে যাব। তুমি থেকো একা। ”
আয়জান যেন রেগেই বলল। আয়শান চোখ ছোট ছোট করেই তাকাল। কোথাকার কোন অভিভাবক এল! বলল,
“ তোর বোন আগেও অল্পতেই কেঁদে ফেলত। মাঝখানে পাথরের মতো হাবভাব করে থাকত। এখন আবার আগের ফর্মে ফিরে এসেছে। আমি কিছু বলি নি। ”
আয়জান তবুও ভাইএর দিকেই তাকাল। বলল,
“ না বললেই ভালো। ”
ফের তুলির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ শোন তুলি, তোর কিন্তু ডাবল অপরাধ! একেই আমরা যখন বাড়ি ফিরলাম তখন তুই ছিলি না, দ্বিতীয়ত তুই আমার সাথে দেখার করার জন্য অপেক্ষা করলি না। তো এই জন্য তুই কালকে সকাল আমায় কফি করে খাওয়াবি। নাহলে কিন্তু কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখব। ”
তুলি মাত্রই মাথা নাড়িয়ে বলতে নিচ্ছিল, ঠিকাছে। কিন্তু তার আগেই আয়শান এল। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
“ তাই নাকি? বড় ভাই এর বউকে তুই কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবি? পারবি নাকি? ”
আয়জান চোখ সরু করে চাইল। বলল,
“ অবশ্যই পারব। ও তোমার বউ হওয়ার আগে আমার বোন ছিল। নিজে তো আমার অবলা সহজ সরল বোনটাকে জোর করে বিয়ে করে ফেলেছো হুহ। জানি না আমরা? ”
“ যেভাবেই হোক, এখন তোর বোন আমার বউ। কি করবি কর পারলে। ”
তুলি ফ্যালফ্যাল করে তাকাল কেবল। আয়জান দ্রুতই ওর দিকে ফিরে বলল,
“ তুলি? তুই কার পক্ষে? ”
তুলি মুহুর্তেই বলল,
” তোমার, তোমার পক্ষে আয়জান ভাই। ”
আয়জান দাঁত কেলিয়ে হাসল। তারপর ভাই এর দিকে একটা চাহনি দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল হেসে।
.
আযরান আর রোজের বিয়েটা নিয়ে দুই পরিবারই রাজি হলো অবশেষে। রোজ আপাতত ওর বাবার বাড়িতেই থাকল। বিয়ের দিন একেবারে শ্বশুড়বাড়ি যাবে। যদিও আয়শান আর তুলির বিয়ের অনুষ্ঠানটাও একইসাথে করার প্রস্তাব করা হলো কিন্তু ওরা দুইজনই নাকোচ করল। প্রথমত ওখানে ডেইজি থাকবে। দুইজনের বিয়ের অনুষ্ঠানে নিশ্চয় ডেইজির খারাপই লাগবে। উল্টো নিজের বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানটাও উপভোগ করতে পারবে না। আযরান আর রোজের বিয়ে নিয়ে রাজি হওয়ার পর কয়েকটা দিন কাঁটল এভাবেই। অবশেষে আজ তাদের কেনাকাঁটার জন্য বের হওয়া লাগল। রোজকে নিতে এল আযরান আর আয়জান। আয়জান অবশ্য ডেইজির প্রতি সে পাগলামোটা এখন নরমালভাবেই নেওয়ার চেষ্টা করছে।এই বাড়িতে এসেও সে খুব নর্মালই আগের মতো। রোজের মা সম্ভবত কোথাও গেছে। বাড়িতে আছে তার বাবা, ডেইজি আর রোজ। রোজ উপরে তৈরি হচ্ছে। আযরানও সম্ভবত ওখানে। মাঝখানে আয়জান রোজের সাথে কথা বলে এসে সোফায় বসে গেইমই খেলছে। কি আশ্চর্য। বাড়িটা নিরব নিরব। আচ্ছা, ডেইজি এখানেই থাকে কি?ভালো আছে? আয়জান ছোটশ্বাস ফেলতেই দেখা গেল ডেইজিকে। সে তাকিয়ে দেখলই কেবল। একটা ছোটশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে ডেইজির দিকে চেয়ে দ্রুত বলল
“ মিস ডেইজি? আপনাদের বাড়িতে কি অতিথিদের খাবার দাবার দেওয়া হয় না? কতক্ষন যাবৎ বসে আছি। নাস্তা ফাস্তা কিছু এলই না। ”
ডেইজি ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। আয়জান ভাইয়া? আগের মতোই চঞ্চল শোনাচ্ছে কন্ঠটা। আগের মতোই বোধ হচ্ছেে।অথচ মাঝখানে কত পাগলামো হলো। কতকিছু হলো! ডেইজি তাকিয়ে থাকতেই আয়জান আবারও বলল,
“ ওভাবে হা করে আছিস কেন ডেইজি, তোর মুখে মশা ডুকে গেল তো। ”
ডেইজি এগিয়ে এল। কপাল টানটান করে স্পষ্ট স্বরে বলল,
“ এই বাড়িতে মশা নেই। ”
আয়জান মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ তুই নিজেই তো মশা। ছাগলের মতো তাকিয়ে আছিস। ”
ডেইজি রেগে তাকাল। বলল,
“ রাগাচ্ছেন কেন আমায়? ”
“ কারণ তোর বরাবরই রাগ বেশি। ”
ডেইজি উত্তর না করে চলে যেতে নিতেই আয়জান আবারও বলল,
“ কি বেয়াদব! তোরা কি সত্যিই বাড়িতে অতিথিকে নাস্তা ফাস্তা করাস না ডেইজি? আন্টি কোথায়? আমার পেটের ভেতর গুড়গুড় করছে। কিছু খেতে দে। ”
ডেইজি রেগে বলল,
“ আপনাদের বাড়িতে খাবার রান্না করেনি? ”
“ করলেও বা কি, যা খেয়েছি তা এতদূর আসতে আসতে হজম হয়ে গেছে না? তার উপর তোর বোন তো তৈরি হচ্ছেই হচ্ছে। ”
ডেইজি ছোটশ্বাস ফেলে বলল,
” দেখছি আমি,বসুন। ’
ডেইজি কিচেনে গেল ঠিক। পেছন পেছন গেল আয়জানও। ডেইজিকে চুলা জ্বালিয়ে পাতিলে পানি দিতে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
” কি করছিস ডেইজি? ”
ডেইজি রান্না পারে না। বাবা মায়ের আদুরে মেয়ে সে বরাবরই। তাই কখনো কিচেন পর্যন্ত আসতেই হয়নি। তবুও চেষ্টা চালাল। বলল,
“ চা বানানোর চেষ্টা করছি। ”
অতঃপর কি বানাল সেই জানে৷ একটা কাপ নিয়ে তাতে চা ঢালল। আয়জান অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই কাপটা হাতে নিল। ফু দিয়ে মুখে নিতে গিয়েই সে মুখ কুঁচকে বলল,
” ছিহ! কি বিচ্ছিরি চা বানিয়েছিস ডেইজি। এইটা চা হলো? কি তেতো! ওয়েট আমি নাস্তা বানাই বরং।কি আছে দেখি তোদের কিচেনে? ”
দুইজনই কখনো রান্না করেনি। বলতে গেলে কিচ্ছু পারে না। অথচ দুইজনই রান্না করবে! ডেইজি ভাবল আয়জান বোধহয় এই দুইবছরে রান্না শিখেছে। জিজ্ঞেস করল,
“ কি বানাবেন? ”
“ দেখি আগে কি আছে।”
তারপর উপরে রাখা বয়ামটায় সাদা কিছু দেখে হাত উুচিয়ে বলল,
“এটা ময়দা? আমি ময়দা দিয়ে তেলে বেজে কিছু বানাতে পারি রাইট?
তেলে বেজে কি বানাতে হয় তাও জানে না৷ তবে কিছু বানাতে পারবে এটা আন্দাজ করল কেবল। অতঃপর হাত বাড়িয়ে বয়ামটা নিতে গিয়েই ঘটল অনর্থ। বয়ামের ঢাকনাটা বোধহয় ভালো ভাবে লাগানো ছিল না। তাই তো দ্রুতই সব ময়দা ছিটকে পড়ল তার গায়ে। প্রায় ছট ফুট উচ্চতার একটা ছেলের সর্বাঙ্গে সাদা ময়দা!ডেইজি প্রথমে আয়জানকে খেয়ালই করল না। তবে বয়ামটা ফ্লোরে পরতে দেখে দ্রুত রেগে বলল,
“ কি করলেন এটা আয়জান ভাইয়া? আপনাকে না সত্যিই ইচ্ছে করছে গলা টিপে মেরে দিই! ”
পরমুহুর্তেই যখন আয়জানকে খেয়াল করল তখনই সে অট্টহাসিতে হেসে উঠল৷ সাদা ভূতের মতো লাগছে আয়জানকে। একদম সাদা ভূত৷ হাসতে হাসতে ডেইজির পেট ব্যাথার যোগাড় যেন। আয়জান তা দেখে দ্রুত বলল,
“ কি হলো এইটা? তুই হাসছিস ডেইজি? হাসছিস তুই? তোর হাসি জঘন্য! খুবই বিশ্রী!”
কবির সাহেব একটু আগেই এসেছিলেন জলের জন্য। ওদের কান্ডকারখানা দেখছিলেন। অবশেষে মেয়েকে হাসতে দেখে তার চোখ চকচক করে উঠে। তাকায় শান্ত দৃষ্টিতে। কতদিন পর তার মেয়েটা হাসল। তাও আবার আয়জানের জন্য। উনি ছোটশ্বাস ফেলেন। নিশ্চুপে গিয়ে সোফায় বসেন। আয়জান নিজের গায়ের ময়দা ঝেড়ে আবার গিয়ে সোফায় বসে। কবির সাহেবকে দেখে দ্রুত দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
“ আঙ্কেল? আপনি এমন মুখটা বেলুনের মতো ফুলিয়ে রেখেছেন কেন? ”
আয়জান বরাবরই এমন। ছোট থেকেই। কথাবার্তার ঠিক নেই। চঞ্চল। কবির সাহেব অবশ্য এই ছেলেটার উপর কোনকালেই রাগ করেননি। বরং বরাবরই ওর চঞ্চলতা উনার মন কেড়েছে, হাসাত মনকে। এখনও বোধহয় কবির সাহেব আয়জানের উপর রেগে নেই। কোথাও গিয়ে ও বাড়ির মধ্যে এই সহজ সরল ছেলেটাকেই উনার ভালো লাগে। আর একদমই ভালো লাগে, দু চোখে বিষ যে সে হলো আয়শান। কবির সাহেব এখনও আয়শানকে ভালো হিসেবে নিতে পারেন না। রাগ হয়! কবির সাহেব উত্তর করলেন,
“আয়জান। তোমরা সবকটা ভাই-ই বেয়াদব। বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলে জানো না। অবশ্য তুমি ছোট থেকেই এমন ছাগল। তবে আগে তোমার ছাগল প্রজাতির কথাবার্তা শুনে হাসলেও এখন আমার হাসতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ”
“ কি করে হবে? আপনারা সবাই তো দেখছি কেমন রোবট রোবট বিহেইভ করছেন। কিন্তু বিয়েটা প্লিজ সুন্দরভাবে হতে দিয়েন, আমি আপনাকে দুশো রসমালাই খাওয়াব আঙ্কেল। ”
কবির সাহেব কেমন করে তাকাতেই আয়জান হাসল। অতঃপর বলল,
“আচ্ছা আঙ্কেল?এ বেলায় রাজি হতে পারলে আমার বেলায় কেন রাজি হলেন না? আমি সত্যিই তাকে চেয়েছিলাম, সত্যিই তাকে ভালো রাখতাম আমি। ”
কবির সাহেব ছোটছোট চোখ করে তাকাল। বলল,
“ এ বেলায় আমার মেয়ে রাজি, তোমার বেলায় আমার মেয়ে রাজি ছিল না। ”
” ওহ। ”
.
আযরান ঘড়িতে সময় দেখল। রোজ মাত্রই তৈরি হয়ে বের হলো। পরনে একটা শুভ্র রং এর জামা। চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। আযরান তাকিয়ে দেখে। সুন্দর দেখাচ্ছে রোজকে। একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে। তাকিয়ে হাসল সে। অতঃপর এগিয়ে গিয়ে একহাতে রোজের কোমড় খিঁচে ধরে নিজের দিকে টানল। অন্যহাতের তর্জনী আঙ্গলু দিয়ে রোজের মুখে বুলিয়ে বলল,
“ এতক্ষনের অপেক্ষা স্বার্থক! মাই হোয়াইট রোজ? আমি আপনার জন্য হাজারবার প্রেমে পড়তেও রাজি। ”
রোজ তাকাল। আযরান হেসে আচমকা মুখ নামাল। রোজের থুতনিটা আঙ্গুল দিয়ে তুলে ধরল। তারপর দুই চোখে তাকিয়ে বলল,
” আমার সমস্ত প্রেম তোর হোক জান। আমার সমস্ত স্পর্শ তোর হোক। ”
এইটুকু বলেই সর্বপ্রথম ঠোঁট এগিয়ে চুমু দিল রোজের থুতনির সে তিলটায়। অতঃপর মুখ উঠিয়ে দখল নিল রোজের ঠোঁটজোড়ায়। উম্মাদের মতো ঠোঁটজোড়ায় নিজের রাজত্বের প্রকাশ ঘটাতেই রোজ হাঁপিয়ে উঠে যেন। আযরান বুঝে দূরে দাঁড়াল। যেতে যেতে হেসে বলে গেল,
“ আমার দোষ নেই জান, তোরই দোষ। এত সুন্দরভাবে আমার সামনে সামনে আসার প্রয়োজন কি বল? আমার তো ইচ্ছে হবেই তাই না? ”
.
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে কবির সাহেব নিজের স্ত্রীকে হুট করেই বললেন,
“নূরজাহান? আমার মনে হয় আয়জান সত্যিই আমার ডেইজিটাকে ভালো রাখতে পারত। দুইবছর আগে আমি বোধহয় সত্যিই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যদি আয়জানের সাথে ডেইজির বিয়েটা হতো তাহলে বোধহয় আমার ডেইজি এতদিনে অনেকটা হাসিখুশি থাকত বলো? ”
নূরজাহান শান্ত ভঙ্গিতে তাকালেন। বললেন,
“ আয়জান ছোট থেকেই সবাইকে হাসাতে পারে, সহজ সরল একটা ছেলে। সবার উপরে রাগলেও ওর উপর রাগ করা যায় না। ডেইজি অবশ্যই এই ছেলেটাকে কোন না কোন একদিন ভালোবেসে ফেলত। কিন্তু আপনিই… ”
কবির সাহেব সিলিং এর দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
“ আমি ভুল ছিলাম তাই না? আমার মেয়েটাকে আজ অনেকদিন পর হাসতে দেখেছি নূরজাহান। অনেকদিন পর সে রাগ করে অন্য কারোর সাথে কথা বলছিল, হাসছিল। প্রাণ খুলে হাসছিল।”
নূরজাহান ছোটশ্বাস ফেলে জানালেন,
“ এখন আর কিচ্ছু করার নেই। ভুলে যান। ”
কবির সাহেব কেমন নিস্পৃহ হয়ে তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টিতে। অতঃপর বললেন,
“ আমার মনে হলো ছেলেটা এখনও ডেইজিকে ভালোবাসে…”
.
তুলির পরনে আজ লাল টকটকে শাড়ি। মামনি তাকে এই শাড়িটা পরিয়ে দিয়েছে আজ বিকালেই। তুলি শুধু মামানিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল তখন। আগেও মামনি এমন করত। এমনই ভাবে তাকে ভালোবাসত। তুলি এসব ভেবে হাসে। শাড়ি সামলাতে না পারলেও এই শাড়িটা সে ইচ্ছে করেই খুলল না আজ। তার মামানি পরিয়ে দিয়েছে! তুলি আয়নায় দেখে। দেখে হাসে কেবল।তুলির নিজের আলমারি থেকেও একটা শাড়ি বের করল। এটা দুয়েকদিন আগে কিনেছিল। মামনির জন্য। সে ওটা নিয়েই মামনির ঘরে গেল। হেসে বলল,
“ মামনি? তোমার শাড়ি পরানো সত্যিই সুন্দর বলো? আমিও তোমায় শাড়ি পরিয়ে দিই? দুইজনই আজ শাড়ি হলে কেমন হবে? ”
তুলির মামনি হাসল। মেয়ের হাত পেছনে দেখেই তাকিয়ে বলল,
”অবশ্যই ভালো হবে। মা মেয়ে আজ শাড়িতে। কিন্তু পেছনে কি শুনি? ”
তুলি হাত এগিয়ে দেখাল। বলল,
“ এটার দাম অতো বেশি নয়, কিন্তু আমার মনে হলো তোমায় ভালো মানাবে মামনি। ”
“ আমি তোকে কি বলেছি তুলি? উপহার দাম দিয়ে বিচার করে না বলেছি না? তবুও দামের কথা কেন বলতে হলো? ”
তুলি হাসল। বলল,
“ আর বলব। পড়িয়ে দেই এটা? ”
“ অবশ্যই। ”
তুলি হাসল। পড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা অর্ধেক পথে যখন কুঁচি ভাজ করা ঠিক হলো না তখন বাচ্চাদের মতো করে বলল,
” এটা তো হচ্ছে না বোধহয় মামনি। ”
উনি হাসলেন। মেয়ের এমন নিরাশ হওয়া দেখে নিজেই শিখিয়ে দিলেন। অতঃপর দুই দুইজনই শাড়ি পরে আয়নায় দাঁড়াল। তাকাল। সুন্দর! সত্যিই সুন্দর। তুলি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল,
“ তুমি একটু দাঁড়াবে মামনি? আমি মোবাইলটা আনছি। আয়নায় দুইজনের এই ছবিটা তুলে রাখব। ”
অতঃপর এটা বলে তাড়াহুড়ো করেই নিজের ঘরে যেতে লাগল৷ বিছানায় ফোনটা দেখে নিয়েই দৌড়ে যেতে লেগে শাড়িতে পা আটকে পড়ে গেল তুলি। বরাবরই সে ছোট থেকে এমন পড়ে, ব্যাথা পায়। নতুন কিছু নয়। আয়শান তখন মাত্রই বাসায় ফিরেছিল। রুমে ডুকতেই তুলিকে পড়ে যেতে দেখে এগিয়ে আসলেও প্রথমেই নজরে পড়ল তুলি শাড়ি পরেছে। কি স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটাকে লাল শাড়িতে। আয়শান যেন মুগ্ধ হয়েই চাইল। অতঃপর নজর সরিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
“ তোর হাঁটাচলা কবে ঠিক হবে তুলি? ”
তুলি কেমন করে তাকায়। উঠে দাঁড়ায় হাত ধরে। যেতে নিতেই আয়শান বলল,
“ তোকে শাড়িতে সুন্দর লাগছে তুলি। কিন্তু এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাওয়া হচ্ছিল? ”
তুলির প্রথম প্রশংসাটায় বোধহয় ভালো লাগল। আজকাল আয়শানের সবকিছুই তার ভালো লাগছে । রাগ হচ্ছে না, জেদ হচ্ছে না। শুধু পুরুষটিকে ভালো লাগছেে।সম্ভবত ঐ ডায়েরীর লেখাগুলো পড়ে পড়েই,অনুভূতিগুলোর জন্যই তার মাথায় এসব হচ্ছে। সে বলল,
“ মামনির কাছে। ”
“ আস্তে যা। ”
তুলি চলে যেতেই নিচ্ছিল। আবার দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনিও যাবেন? আমার আর মামনির কিছু ছবি তুলে দিন। স্মৃতি হিসেবে রাখতে চাই। ”
আয়শান হাসল। অতঃপর গেল। গিয়ে নিজের মাকেও শাড়িতে দেখে হাসল। দুইজনকে শাড়িতে দেখে মাথা চুলকে বলল,
“ বাহ! দুই দুইজন রমণীই আজ শাড়ি পরিহিত। সুন্দর দেখাচ্ছে। ”
.
তুলির সাথে রাতে যখন ঘুমানোর আগে দেখা হলে তখনও তুলি শাড়ি পরিহিত। কিন্তু সমস্যা হলো তুলি শাড়ি পরেই ঘুমাবে কিভাবে এই নিয়ে। তুলি এই নিয়ে অনেকটা সময় ভাবল। আয়শানের সাথে এই কয়েকদিনে সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হলেও এতোটাও স্বাভাবিক হয়নি যে সে শাড়ি পরে ঘুমোতে পারবে। যদি শাড়ি উঠে যায় কোনভাবে? ভেবেচিন্তে তুলি হাতে জামা নিল। ওয়াশরুমের দিকে এগোতে নিতেই আয়শান শুধাল,
“ থাকনা শাড়িতে। চোখে শান্তি শান্তি লাগছে আমার। পাল্টাতে হবে না। ”
তুলি মেনে নিল। চুপচাপ আলো নিভিয়ে বিছানায় ঘুমোতে আসতেই আয়শান জড়িয়ে নিল। নিজের বুকের নিজের প্রেয়সীকে এভাবে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় বউ বউ রূপে আগলে নিয়ে সে হাসল। একটা আলতো অধরস্পর্শ রাখল তুলির গালে। শুধাল,
“ আমার সত্যিই মনে হচ্ছে আমার সুন্দর একটা সংসার হয়েছে তুলি। বুকে শাড়ি পরিহিতা বউ। সুন্দর নয়? ”
তুলি চোখ বুঝে নিল সঙ্গে সঙ্গেই। আজকাল একটু বেশিই লজ্জা হচ্ছে তার এই পুরুষটার সান্নিধ্যে। অথচ দীর্ঘ দুইবছরে আয়শান চুমু খেলেও লজ্জা হতো না, জড়িয়ে ধরলেও লজ্জা হতো। কেমন নির্জীব থাকত। তুলি চোখ বুঝতেই আয়শান ফের হেসে বলল,
“ আমি তোকে বউরূপে পেতে অপেক্ষায় তুলি। তোকে নিজের করে নিতে অপেক্ষায়…”
তুলি এবারও চোখ বুঝে থাকল। গাল উষ্ণ হয়ে আসছে বোধহয়। তবুও বলল,
“ আমার একবার ডেইজির থেকে ক্ষমা চাইতে হবে। ডেইজির সাথে কথা বলতে হবে। তারপর আপনার সব অপেক্ষায় মাথা পেতে সম্মতি দিব। ”
#চলবে…