প্রেমস্পৃহা পর্ব-৫+৬

0
23

#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_০৫
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

আয়শানের ঐ রাত্রিটায় আর ঘুম হলো না। নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়ে সে সকাল সকাল বের হলো মর্নিং ওয়াকে। তুলি তখনও ঘুমে। আয়শান একবার তাকায়। পরমুহুর্তেই টুপ করে ঠোঁট ছোঁয়ায় তুলির কপালে। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিড়বিড় করে বলে,

“ তুলি? আমার মাঝেমাঝেই মনে হয় আমার বিবাহিত লাইফটা এবার আমার উপভোগ করা উচিত। তোর সাথে জমিয়ে একটা প্রেম হওয়া উচিত। অথচ দেখ, আমরা বিবাহিত হয়েও আমাদের মাঝে কিচ্ছু নেই। শুধু আমার একপাক্ষিক জড়িয়ে ধরা আর চুমু দেওয়া ছাড়া। এটা কোন বিবাহিত লাইফ বল? আমার তো মাঝে মাঝে বড্ড বেসামাল লাগে নিজেকে।মাঝেমাঝেই দুঃখ হয়। তবুও আমায় থাকতে তোর থেকে দূরে দূরে। এটা কোন জীবন? তুই কি আদৌ আমায় কখনো স্বাভাবিক ভাবে নিবি তুলি? আমি অপেক্ষায় আছি… খুব করে অপেক্ষায় আছি!”

অতঃপর তা বলতে বলতেই বের হলো রুম ছেড়ে। মর্নিং ওয়াকে বের হবে। ঠিক তখনই চোখে পড়ল আযরানকে। আযরান একটা শার্ট পরেই বের হলো সকাল সকাল। মাঝে আয়শানকে দেখে চোখ ছোটছোট করে বলল,

“ কোথায় যাচ্ছো আয়শান ভাই?”

আয়শান হাসে। উত্তর দেয়,

“মর্নিং ওয়াকে, নতুন বর যদি যেতে চাস তো যেতে পারিস আমার সাথে। ”

আযরান হাসে। পা এগোতে নিলেই আয়শানের চোখে পড়ল শার্টের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা সাদা অংশটায়। আয়শান ভ্রু কুঁচকায়। বলে,

” কি হয়েছে ওখানে? আঘাত পেয়েছিস নাকি? ”

আযরান বুঝে উঠে। কেমন করে যেন তাকিয়ে কপালে হাত রাখে সে। অতঃপর তার ব্যাপক দুঃখ বুঝিয়ে বলে,

“ কপাল কপাল! একরাতেই বউ এর কি সাংঘাতিক ভালোবাসা। সাংঘাতিক মেয়ে একটা আমার কপালে জুটেছে! ”

আয়শান এবারে আর প্রশ্ন করল না। ছোট ভাইয়ের বিয়ের রাতে বউ কি ভালোবাসা দিয়ে বুকে আঘাত করে ফেলেছে তা নিশ্চয় সে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে না? শুধু যেতে যেতে হাসল। আর বলল,

“ ভেরি গুড! ফিউচারের জন্য শুভকামনা। ”

আযরানও পেছন থেকে বলল,

” আজই চলে যাবে নাকি আয়শান ভাই? ”

আয়শান হাঁটতে হাঁটতে উত্তর করল,

“ হয়তো। তোর বিয়ের ঝামেলা তো শেষ! আর থাকার প্রয়োজন তো নেই। ”

আযরান হাসে। বলে,

“ বিবাহিত পুরুষ তুমি, বউ রেখে বাইরে কি করে থাকো বুঝি না। থাকতে পারো তো মাঝেমাঝে বাড়িতে।তোমাকে তেমন প্রয়োজন ছাড়া পাই না বহুদিন। ”

আয়শান শুনল। শুনলেও এবারে উত্তর করল। সদর দরজা পেরিয়ে এল প্রায়। ভাবল, সে আসলেই বিবাহিত পুরুষ। অথচ বউ এর সাথে একসাথে থাকে না।আয়শান এই বাড়িতে থাকে না বছর দুয়েক হলো। মূলত ডেইজিকে বিয়ে না করে তুলিকে বিয়ে করেছে এই নিয়েই বাবার সাথে সমস্যা বেঁধে সে বাড়ি ছেড়েছিল বছর দুয়েক আগে। পরবর্তীতে আয়জানের পাগলামো দেখে সেটার কারণ সবাই বুঝেছেনও, বাবার সাথে সম্পর্কও ঠিক হয়েছে। তবুও আয়শান বাড়ি ফেরেনি। তার পেছনে অবশ্য যুক্তিযুক্ত কারণটা তুলি। তুলিকে সে বিয়ে করেছে ঠিক, তবে আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মতো স্বাভাবিক নয় তাদের সম্পর্ক। আয়শান ইন্ট্রোভার্ট ধরনের কিছুটা।আযরান, আয়জানের মতো নয়। মুখে ভালোবাসি প্রকাশ করাটা বিশ্বাস করেনি কখনোই সে।অন্যদিকে তুলিও বিয়ের দিন থেকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছে কেবল এটাই যে, আয়শান তুলিকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে, আর কিচ্ছু নয়।সে আয়শানের যোগ্য নয়, আয়শান তাকে বিয়ে করে সবার কাছে কেবল তাকে খারাপ বানিয়েছে এইটুকুই! আয়শানও আর ব্যাপারটা চওড়া করেনি। এখন যদি সে মুখে ভালোবাসি বলেও তাও তুলির কাছে হয়তো বিশ্বাসযোগ্য হবে না। ভাববে আয়শান মিথ্যে বলছে। তুলিকে সে ছোট থেকে স্নেহ করেছে, স্নেহ থেকেই ভালোবাসা জম্মেছিল। ছোট থেকে শাসন করেছে। বাড়ির সবার সাথে সাথে তুলির চোখেও নিজেকে এক আদর্শ চরিত্র হিসেবে ধরে রেখেছিল আয়শান। অসম্ভব সমীহ করে চলত আয়শানকে সে ৷আর সে তুলির চোখেই আজকাল যখন এক বিষন্ন নিরবতা আয়শান খেয়াল করে উঠে তখন তার দুঃখ হয়। নিজেকেই দায়ী লাগে। । আয়শান তুলিকে এই সম্পর্কে যেমন স্ত্রী হিসেবে কখনো জোর করেনি, তেমনই এই মেয়েটি সে ব্যাতীত অন্য কারোর না হওয়ার ও এক নিরব হুমকি যেন তার চোখেমুখেই থাকে।আয়শান হাসে। সে জানে না তুলি আদৌ স্বাভাবিক ভাবে সম্পর্কটা নিবে কিনা কখনো, কখনো সে সত্যিই তুলির চোখে আর দশজন স্বামীর মতো প্রেমিক হয়ে উঠতে পারবে কিনা, তবে দিনশেষে তুলি তার হয়েই তো আছে! এটুকুই যথেষ্ট!

আয়শান এগোয়। অতঃপর পুরো সকালটা সে বেশ সময় ব্যয় করে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় নিজের বাসার কাছেই চলে এল। এই মিনিট বিশের দূরত্ব বলতে গেলে তাদের বাড়ি থেকে। আয়শান একবার বাসায় উঠবে ভেবেই ফের মনে হলো তুলিকে বলে আসা হয়নি। আয়শান আবার ফিরতে হলো বাড়িতে। অথচ যার জন্য ফিরল তাকে সে রুমে পেল না। এতটুকু পথ হেঁটে এল। ভাবাল তুলি তাকে গরম গরস ধোঁয়া উঠা এক কাপ কফি এগিয়ে দিবে অথচ তা হলো না। তুলিকে দেখা গেল না।ত আয়শান বেলকনিতে গেল তুলিকে পাবে বলে। অথচ ওখানেও ও তুলিকে পেল না সে। আয়শান ভ্রু কুঁচকায়। পরমুহুর্তেই কিচেনের দিকে পা এগোল সে। তুলি নিশ্চয় ওখানেই থাকবে? অথচ ওখানেও পেল না। আয়শান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ছোটআম্মু অর্থ্যাৎ আযরানের আম্মুকে কিচেনে দেখে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল,

“ ছোট আম্মু?তুলি কোথায়? দেখছি না তো।”

আয়শানে ফুফি কেমন করে যেন চাইল। আয়শান ফুফির দিকে তাকিয়েই থমকাল। হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলে,

“ ফুফি তোমার সাথে কথা ছিল। তুমি কি আবারও তুলিকে কিছু বলেছো? ও আমার বউ হওয়ার অযোগ্য এটা বলে কিছু বলেছো আবার ও? ”

অতীতে আয়শানের ফুফিই এমন করেছিল। তুলি আয়শানকে না বললেও কোনভাবে তা আয়শানের কানে গিয়েছিল। অতঃপর সে এক তুলকালাম কান্ড হয়ে গেল আয়শান খানের বউকে কথা শোনানোর জন্য। আয়শানের ফুকি নাক মুখ কুঁচকে বলল,

“ আমি? আমি কেন ও কে কিছু বলতে যাব?

“ এর আগে তুমিই তো ওকে কথা শোনাতে ফুফি। আমি তোমার ব্যাপারে নিশ্চিত নই তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”

আয়শানের ফুফি মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল,

“ একটা ঢং করিস আয়শান, এই বাড়িতে বোধহয় আর কেউ বিয়ে করেনি!তোর বউ -ই কেবল আদুরে যে ওকে কথা শুনাতে পারব না? আর ও তোর বউ হওয়ার আগে থেকেই আমাদের পরিচিত। যেদিন এইটুকু থাকতে এই বাড়িতে এসেছে ঐদিন থেকেই দেখছি ওকে। ওকে আমি আগেও কথা শুনিয়েছি, হয়েছে কি তাতে? ওকে কথা শোনাতে পারব না আমরা? কথা শোনালেই তা বরের কানে ফিসফিস করতে হবে? ও ভাবে কি? তোকে বিয়ে করে ও রাজরানী হয়ে গিয়েছে? ”

আয়শান শান্ত অথচ দৃঢ় চোখে তাকায়। গম্ভীর গলায় বলে,

“ ও মোটেই আমার কানে ফিসফিস করেনি ফুফু! ”

“ ফিসফিস না করলে কথা গুলো তুই অব্দি যেত নাকি? বুঝি না আমরা? নাকি সংসার আমরা করি না? ”

“ তুমি বোধহয় ওকে সহ্যই করতে পারো না ফুফি। তাই না বলো? ”

এটুকু বলেই আয়শান বের হয়ে এল। এভাবে জিজ্ঞেস করর খোঁজ করতে হয় না তার। খবর এমনিই পায় সে। তবুও ফুফিকে দেখে মনে হলো জিজ্ঞেস করা উচিত, তাই তো করল। আয়শান ছোটশ্বাস ফেলে। অতঃপর বাড়ির ছোট সদস্যদের একটু জিজ্ঞেস করতেই ফটফট করে সব জানতে পারল সে। আয়শান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিয়েটা সে করেছে। অথচ এতে বারবার কষ্ট পাচ্ছে তুলিটা। আয়শানেন আম্মু, যে তাকে মেয়ের মতো বড় করল সে অব্দি এখন তুলির সাথে কথা বলে না। তুলির জীবনটা তো সে সত্যিই কষ্টকর করেছে। আয়শানের অসহায় লাগে। তুলিকে একবার বলেছিলও তার সাথে আলাদক থাকবে কিনা, তুলি মুহুর্তেই নাকোচ করেছে। আয়শান গম্ভীর হয়েই ভাবে। বহুক্ষন ভাবার পর টের পায় যে তুলি এসেছে। পা চালিয়ে রুমের দিকে যাচ্ছে। আয়শান হঠাৎ ডাক দিল,

“তুলি? ”

তুলি শুনতে পেল না বোধহয়। ওভাবেই পা বাড়াতে নিতেই আয়শান ফের বলে,

“ আমি ডাকছি তুলি। ”

তুলি তাকায় আচমকা গম্ভীর স্বর শুনে। হকচকিয়ে বলে,

“ হু, কিছু বলবেন আয়শান ভাই? ”

আয়শান প্রশ্ন ছুড়ল,

“ কোথায় গিয়েছিলি?”

তুলি চুপ থাকে কিছুক্ষন। আয়শান আবারও বলল,

“ উত্তর কর… ”

তুলি এবারে নরম গলায় বলল,

“ একটু মায়ের কবরে গিয়েছিলাম। দেরি হলো একটু। ”

“ কোথাও গেলে বাসায় বলে যাবি। কয়বার বলেছি তোকে কথাটা? এভাবে হুটহাট না পেলে মানুষজন চিন্তা করবে না? ”

তুলি হেসে বলল,

‘ না বলে কোথায় বা যাব? যাওয়ার জায়গা আছে আমার যে আপনাদের না বলে কোথাও পালিয়ে যাব আমি?তাছাড়া আমি কখনোই পালিয়ে যাব না আয়শান ভাই। আপনারা আমার দায়িত্ব নিয়েছেন, বড় করেছেন। কোন দিকে অপূর্ণতা রাখেননি। এত সুযোগ সুবিধা ছেড়ে চলে যাব? এসবই তো জুটত না আমার কপালে কখনো। ভাগ্যিস আপনারা আমার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ”

তুলি কি নিজের প্রতি একরাশ অবহেলা নিয়ে কথাগুলো বলল? আয়শান ফের বলল,

“ কে বলল জুটত না? ”

তুলি হেসে বলে,

“ এতিমদের ভাগ্য অতো ভালো হয় না আয়শান ভাই। এতিমরা আপনার মতো ভালো বরও পায় না। আমি ভাগ্যবশত কিভাবে যেন পেয়ে গেলাম একটা স্বপ্নের মতো বাড়ি, আম্মু, আব্বু, এতগুলো আপন মানুষ। ”

আয়শান হাসল এবারে। বলল,

“ আমাকে পেলি না? এই যে দুইবছর আগে নিজেকে তোর নামে লিখে দিলাম? ”

“ লিখে দিলেই যদি পাওয়া হয়ে যেত তবে ভালোবাসা ছাড়াও , স্বামীর মন না পেয়েও অহরহ এত সংসার টিকে থাকত না আয়শান ভাই। মেয়েরা বরের মন না পেলেও আজীবন ঐ সংসার আঁকড়ে থেকে যেতে পারি। ”

এটুকু বলেই তুলি পা বাড়াল। আয়শান কেমন নিরব দৃষ্টিতে যেন চেয়ে থাকল ওর যাওয়ার পানে। ও আয়শানে মন পায়নি? ও বরের মন পায়নি?এটা কেন মনে করে তুলি?

.

রোজ সকাল সকাল গোসল সারল। সারা রাত ঘুমায়নি, মাথা ব্যাথা করছিল। মনে হয়েছিল একটা লম্বা গোসল তার প্রয়োজন! রোজ মূলত সে কারণেই গোসল করল। পরনে আযরানের আনা সেসব জামাকাপড় থেকে একটা থ্রিপিচ। অতঃপর ভেজা চুল গুলো মেলে দিয়ে কিয়ৎক্ষন নিরব বসে থাকল। আযরান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কি ভাবছে এই মেয়ে তা বুঝার চেষ্টা চালায় হয়তো। পরমুহুর্তেই বলে,

“ খবর পেলাম তোর বাপ পুলিশ নিয়ে বাড়ি আসছে। হয়তো এক্ষুনিই এসে পৌঁছাবে। আমার অবশ্য হাসিই পাচ্ছে। তোর বাপের মুখোমুখি হই না বহুদিন বল? ”

রোজ তাকায়। মুহুর্তেই বলে,

“ পালাচ্ছেন না কেন? ধরে নিয়ে গেলে ভালো হবে? ”

আযরান মজা পেল। হেসে বলে,

” আমাকে ধরে নিবে? অতটুকু সাহস হবে না। তোর বাপ সম্ভবত তোকে নিতেই আসছে। তুই নিশ্চয় সুযোগ পেয়ে সুরসুর করে চলে যাবি রোজ? ”

“ হু? ”

“ আমি নিশ্চিত তুই চলে যাবি৷ ”

রোজ ভাবে। আসলেই চলে যাবে? আযরানকে ফেলে চলে যাবে? এর মানে এটাই প্রমাণ হবে যে সে, সে সত্যিই আযরানকে কখনো ভালোবাসেনি। রোজের ভাবনার মাঝেই আযরান আবার বলল,

“ রোজ? ”

“ হু। ”

আযরান বলল,

“ তুই চলে গেলে আমি আটকাব না তোকে। নিষেধ করব না। তবে চলে যাওয়ার পরও জানবি যে তুই শুধু আমার। তুই আমার ওয়াইফ৷ মনে থাকবে?

রোজ হেসে শুধাল,

“ কাল অব্দি জোর করে বিয়ে করলেন, আজ চলে যাওয়াতে আটকাবেন না? আশ্চর্যকর বিষয়! ”

আযরান শুধাল,

“ যে থাকতে চায় না তাকে কি করে আটকে রাখব বল জান? সাধ্য থাকে তার? তবে চলে যাওয়ার পর কিন্তু তুই সায়ানের সাথে মিশতে পারবি না।

#চলবে…

#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_০৬
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

সামনাসামনিই বসে আছেন আয়শান, আজহার খান, কবির সাহেব এবং পুলিশ ইন্সপেক্টর। আয়শান অবশ্য বিষয়টাকে খুব কঠিন হিসেবে দেখল ও না। কবির সাহেব কম্প্লেইন লিখিয়েছেন ঠিক, তবে আয়শান চোখ বুঝেই বলতে পারে খান বাড়ির ছেলেদের জেলে নেওয়ার সাধ্য উনার নেই।এটা ঠিক, তাদের পরিবারের মতো কবির সাহেবের সম্পদ প্রতিপত্তি,ক্ষমতাও কোন অংশে কম নয়।তবুও যে আজহার খান বেঁচে থাকতে এটা সম্ভব নয় সে জানে। আয়শান হাসল যেন।কবির সাহেবের দিকে চেয়ে হেসে বলল,

“ আঙ্কেল। আপনার কাছে কি প্রমাণ আছে যে আযরান রোজকে তুলে এনেছে? প্রমাণ যদি থেকেও থাকে তবে আমি বলব আপনার মেয়েও আমার ভাইকে ভালোবাসে৷ সে জেনেবুঝেই বিয়ে করেছে। আমরা তাকে মোটেই জোর করিনি আঙ্কেল। ”

কবির সাহেব তেঁতে উঠলেন। আয়শানকে উনি মোটেই সহ্য করতে পারেন না। বড় মেয়ে ডেইজিকে উনি একটু বেশিই ভালোবাসেন। যার দরুণ আয়শানের প্রতি জম্মেছে তার এক অদৃশ্য ক্ষোভ, রাগ! কবির সাহেব রেগে ফেটে পড়ে শোনালেন,

“ তুমি চুপ করো আয়শান। আমি তোমার সাথে কথা বলছি না বেয়াদব ছেলে। আমার বড় মেয়ের জীবনটা তুমি শেষ করেছো ঐ কোথাকার কোন তুলে আনা এতিম মেয়েটাকে বিয়ে করে! আমার ডেইজির কোনদিক দিয়েই পৌঁছাবে না ঐ মে…..”

আয়শান এবারে রেগে চোয়াল শক্ত করেই চাইল। শক্ত কন্ঠে বলল,

“ কালও বলেছেন, আমি ছিলাম না বলে কিছু বলিনি। কিন্তু আজ আমার সামনে আমার বউকে ছোট করে কথা বলবেন তা তো আমি মেনে নেব না। ও কোথাকার কোন তুলে আনা মেয়ে নয়, আয়শানের স্ত্রী। মনে রাখবেন এটা। পরবর্তীতে ওকে ছোট করে কথা বলার আগে এটা মনে রাখবেন অবশ্যই। এখন ছোটভাই এর শ্বশুড় বলে সম্মান দেখাচ্ছি, রোজ আর ডেইজির বাবা বলে সম্মান দেখাচ্ছি।আমার বাবার বন্ধু বলে সম্মান দেখাচ্ছি। পরবর্তীতে দেখাব না।”

কবির সাহেব ফের তেঁতে উঠলেন। আজহার খানকে বলে উঠলেন,

“ আজহার, তোর ছেলেকে এমন বেয়াদব বানিয়েছিস?বউ এর হয়ে সাফাই গাইছে ও!”

আয়শান উঠে দাঁড়াল। বলল,

“ মনে হচ্ছে আপনার আসলেই সম্মান পেতে ভাল্লাগছে না আঙ্কেল৷ অসম্মান করতে বাধ্য করবেন না আমায়। ”

কবির সাহেব দাঁতে দাঁত চাপলেন। বললেন,

“ বেয়াদব ছেলে। আমার বড় মেয়ের জীবন শেষ করে এখন আমার ছোট মেয়ের জীবন শেষ করতে উঠে পড়ে লেগেছো? ”

আয়শান ছোটশ্বাস ফেলল। কন্ঠ শান্ত রেখে বলার চেষ্টা করল,

“ ছোট মেয়ের জীবন নষ্ট করতে আপনি উঠে পড়ে লেগেছিলেন আঙ্কেল। খুব তো রাগ পুষেন বড় মেয়ে ভালোবেসেও আমায় পেল না বলে। তো ছোট মেয়ে যে আযরানকে ভালোবাসত তা জানতেন না? জেনেবুঝে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন কেন? সুখে থাকত তখন আপনার ছোট মেয়ে?”

কবির সাহেব রাগে ক্ষোভে বললেন,
“ আজহার! তোমার ছেলেকে সাবধান করো। ওর ভাগ্য ভালো যে ওকে আমি জেলের ভাত খাওয়াইনি দুই বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কারণে। ”

আজহার খান বিষয়টা মেটাতেই চাইলেন। মিটিয়ে নেওয়াই তো ভালো। যেভাবেই হোক ছেলে মেয়ে দুটো বিয়ে তো করে ফেলেছেে।এখন দুই পরিবারের সম্পর্কটা ঠিক করে ফেলাই তো ভালো। তাছাড়া দুই পরিবারের সম্পর্ক ভালো হলে দুই পরিবারেরই ভালো বাদে ক্ষতি হবে। সেটা সামাজিক হোক, আর্থিক হোক, বা ব্যবসায়িক! আজহার খান ছোটশ্বাস ফেললেন। সমস্তটা ভেবেচিন্তে শান্তস্বরে বললেন,

“ কবির, বিষয়টা মিটিয়ে ফেললে ভালো নয়? আগের বারও আমরা আলোচনায় বসতে চেয়েছিলাম। ডেইজির সাথে আয়জানের বিয়েটা হোক চেয়েছিলাম। অথচ তুই তো তা করলি না। সম্পর্ক শেষ করলি। ডেইজিকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিলি। আমরা তো কিছু বলিনি এতে কবির।তোকে দোষারোপ করিনি।ডেইজি যেমন আয়শানকে পায়নি, তেমন আয়জানও কিন্তু ডেইজিকে ভালোবেসে পায়নি। ভালোবাসলেই যে পেতে হয় এমন তো কোথাও লেখা নেই কবির। বুঝ বিষয়টা।”

কবির সাহেব বুঝলেন না। বরং অবুঝের মতো রেগে বললেন,

“ কি বুঝব আজহার? আমার মেয়ে আমায় ফেরত দে৷ আমি তোদের মতো জা’নো’য়ারদের সাথে কেন আত্মীয়তায় যেতে চাই না। আমার মেয়ে ফেরত দে, নয়তো আমি সত্যিই কঠোর হবো আযরানের বিষয়ে। ”

আজহার খান এবার কঠিন অথচ শীতল চাহনিতে তাকাল। বললেন,

” আযরানকে জেলে নিবি তুই? খান বাড়ির ছেলেকে? ”

“ আমার মেয়েকে অপহরণের দায়ে অবশ্যই নিব। ”

“ পারবি না। ”

আযরান ততক্ষনে সিঁড়ি বেয়ে নামে।নিচের চিৎকার চেঁচামিচি এমনিতেই এতক্ষন কানে আসছিল। শুধু রোজকে নিচে নামতে বলে নামতে দেরি হচ্ছিল তার।আযরান কবির সাহেবকে দেখেই প্রথমে হাসল।সোফায় বসে একদম কবির সাহেবের মুখোমুখিই বসল সে৷ পরমুহুর্তেই আজহার সাহেবের দিকে চেয়ে হেসে বলল,

“বড়আব্বু? আমি একটু জেল ঘুরে আসতে চাই।তুমি নাকোচ করো না। শত হোক শ্বশুড় আব্বুর চাওয়া। ”

আজহার সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। দ্রুত বললেন,

” মানে? ”

“ তোমার বন্ধু যে চালটা দিল তাতে উনাকে সফলই হতে দিন। একটু তো খুশি হতে দেওয়া উচিত উনাকে। ”

“ এই বাড়ির ছেলে জেলে যাবে? ”

” গেলাম নাহয়। ”

আজহার সাহেব বললেন,

“ আযরান।”

আযরান হাসে। বলে,

“ বড়আব্বু, বউ অপহরণের দায়ে জেলে গেলে কষ্ট হয় না। ভালোবাসা বাড়ে। ”

কথাটা বলেই সে ফিরল কবির সাহেবের দিকে। হেসে বলল,

“যায় হোক, আমিই আপনার মেয়েকে অপকরন করেছি, বিয়ে করেছি। এখন গ্রেফতার করুন আমায়, সমস্যা নেই। ”

কবির সাহেবের চোয়াল শক্ত। আয়শানের মতো আযরানকেও উনি সহ্য করতে পারছেন না। রাগ ক্ষোভ জমে একাকার। বললেন,

“আমার মেয়ে কোথায়?

আযরান হেসে বলল,

“ আছে সে। আপনি তো আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।আপনার অভিযোগ অনুযায়ী আমার কাছেই তো থাকবে বলুন? ”

“সোজাসুজি বলো, আমার মেয়ে কোথায়?

ঠিক তখনই রোজ এসে নামল। বাবাকে দেখে চোখ টলমল করে তার যেন। অস্ফুট স্বরে ডাকল,

“ আব্বু! ”

কবির সাহেব দ্রুতই তাকালেন। মেয়েকে দেখে দ্রুত এগিয়ে এলেন উনি। অতঃপর মেয়ের সামনে গিয়ে দ্রুত বললেন,

“ রোজ? এক্ষুনি আমার সাথে বাড়ি ফিরবি আম্মু। এক্ষুনি। এই জা’নোয়ার গুলো তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে বল? কি করেছে? জোর করে তোকে বিয়ে করেছে না বল? আমি এদের সবাইকে শাস্তি দিব। দেখে নিস। ”

রোজ কেঁদে ফেলল কেমন করে যেন। আবারও ফ্যালফ্যার করে চেয়ে বলল,

“আব্বু।”

কবির সাহেব এই কান্নাটার অর্থ বুঝলেন যে সত্যি সত্যিই তার মেয়ের উপর অত্যাচার করা হয়েছে। বললেন,

” কাঁদবি না, একদম কাঁদবি না। দেখলেন তো ইন্সপেক্টর সাহেব? আমার মেয়েটাকে আটকে রেখেছিল এরা। কত অত্যাচার করেছে সত্যিই জানি না। আমার মেয়েটা কিভাবে কাঁদছে একবার দেখুন। এরেস্ট করছেন না কেন ঐ ছেলেকে? ”

ফের মেয়েকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,

“ তুই যা বলবি, যেভাবে বলবি এই ছেলেকে আমি সেভাবেই শাস্তি দিব। দেখে নিস রোজ। তুই শুধু বল ওরা কি করেছে? ”

রোজ একবার আযরানের দিকে তাকায়। তার কান্নার মানে এভাবে ভেবে নিবে তার বাবা সে বুঝে উঠেনি। তবে তার কান্না পাচ্ছে, সত্যিই কান্না পাচ্ছে বাবাকে দেখে। কান্না দমাতে পারছে না সে। আযরান ভ্রু বাঁকায়।একমুহুর্তের জন্য মনে হলো রোজ বোধহয় তাদের পরিবারকে ফাঁসাতে এভাবে একটা নাটক সাঁজালেও সাজাতে পারে। সাজাক।রোজ যে বদলে গিয়েছে তা আজই নাহয় প্রমাণিত হোক। অথচ আযরানের ধারণা মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে রোজ শান্ত গলায় ওভাবেই বলল,

” কিছু করেনি আব্বু। ”

কবির সাহেব মানলেন। বললেন,

“ ওরা তোকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল তো। জোর করে বিয়ে করেছে না ও তোকে মা? বল, আমি আছি। বল সবট।”

আযরান উঠে এল। পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,

” একদম ঠিক। জোর করেই বিয়ে করেছি ওকে আমি। এখন কি করবেন শ্বশুড়সাহেব?”

কবির সাহেব রেগে শুধালেন,

“ তোমার বেয়াদবি দেখে আমি অবাক হচ্ছি।”

আযরান হাসে। ইন্সপেক্টরের সামনে এসে হাত বাড়িয়ে বলে,

“ এরেস্ট করছেন না কেন? যায় হোক, চলুন আমরা গাড়িতে গিয়ে বসি। উনারা ততক্ষন এসব করুক।আচ্ছা, জেলের রুমগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে না? আমার আবার অপরিষ্কার পরিবেশে সমস্যা হয়। ”

ইন্সপেক্টল সাহেব পড়লেন বেকায়দায়। দুই পরিবারই সম্ভ্রান্ত পরিবার। কি করবে বুঝে উঠে না। তবুও উনি আযরানের কথা অনুযায়ী এরেস্ট করলেন। পা বাড়ালেন। রোজ বিস্ময় নিয়ে তাকায়। এই পরিবারটা অলরেডি ভেঙ্গে গেছে। পরিবারের তিন ছেলের মধ্যে আয়জান বাইরে, আয়শানও এ বাড়িতে থাকে না। এখন আযরানকেও যদি তার জন্য জেলে যেতে হয় বিষয়টা খারাপ হচ্ছে না? রোজ বাবার দিকে তাকাল। বলল,

” আব্বু? ওদের দাঁড়াতে বলো। ”

“হু? ”

“ আযরান ভাই আমায় জোর করে বিয়ে করেননি। আমি নিজে বিয়েতে মত দিয়েছিলাম। দাঁড়াতে বলো তাদের। ”

কবির সাহেব বিস্ময় নিয়ে বললেন,

“ তুমি নিজে বিয়ে করেছো? কিসব বলছিস রোজ? তোকে ধমক দিয়েছে ওরা? হুমকি দিয়েছে? ”

রোজ উত্তর করল,

“ না আব্বু। ”

“ তাহলে? ”

” আমি নিজে থেকে বিয়েটা করেছি৷ ”

“ সত্যিটা বল রোজ, আমি আছি তোর সামনে। কিচ্ছু হবে না তোর। বল আম্মু.. ”

রোজ ছোটশ্বাস ফেলে। কান্না মুঁছে নিয়ে বলে,

“ এটাই সত্যি আব্বু। ”

কবির সাহেব এবারে নিজের সমস্ত রাগ দেখালেন নিজের মেয়ের উপর। সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা চড় বসালেন নিজের মেয়ের গালে। রোজ পিছিয়ে গেলে চড়ের আঘাতে৷ কেঁদে ফেলল ফের। গালে হাত রেখে ভয়ে তাকায় সে। কবির সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে ধমকে বলল,

“ সত্যিটা বলো রোজ। বলো ও তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছে, বলো। ’

আযরান চলে যেতে নিয়েও থামল। আচমকা হয়ে যাওয়া কান্ডটা বুঝে উঠে তার রক্ত টগবগ করে উঠে। এগিয়ে এসে বলল,

“ আপনি ওর গায়ে হাত তুললেন কেন? মারলেন কেন ওকে? বলুন, মারলেন কেন?”

রোজ তাকাল।শক্ত স্বরে আযরানকে শুধাল,

” আযরান,আমার আর আব্বুর মাঝে কথা বলার অধিকার আপনার নেই। ”

কবির সাহেব মেয়ের এই শক্ত স্বরটা শুনে যেন প্রসন্ন হলেন। তবুও ফের শক্ত স্বরে মেযেকে জানালেন,

“ তুমি আমার সাথে ফিরবে এখন রোজ। আর কথা বলবে না। কোন কথা বলবে না। ”

রোজ এবারে শান্ত চাহনিতে তাকায় বাবার দিকে। তার গাল ভেজা। চোখ লালাভ। এক গালে স্পষ্ট পাঁচ আঙ্গুলের চাপ৷ কিছুটা লালচে হয়ে উঠেছে তা। এমনকি চড়ের দরুন বোধহয় ঠোঁটের কোণাও একটু কেঁটেছে। রোজ ছোটশ্বাস ফেলে। বাবাকে বলে,

“ ফেরার মানে তো এই যে আমাকে আযরান জোর করে বিয়ে করেছে। তাই না আব্বু? ”

তার বাবা বললেন,

” হ্যাঁ। এবং তুমি আমার সাথেই ফিরবে। ”

রোজ আচমকাই বলল,

“ আমি ফিরব না আব্বু। উনি আমায় জোর করেননি। আমি নিজেই বিয়ে করেছি। ”

“ কি বলছিস তুই? তুই এই জা’নো’য়ারদের হয়ে কথা বলছিস রোজ? তোর আপুর কি অবস্থা তুই চোখে দেখে আসিসনি?কি করে পারছিস ওদের পক্ষ নিতে? ”

রোজ মিথ্যে বলতে পারল না। বলল,

“ উনারা সত্যিই আমার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করেনি আব্বু। বরং স্নেহ দিয়েছেন।আমি উনাদের বিপক্ষে কি করে যাব বলো?”

.

কবির সাহেবকে ফিরতে এল খালি হাতেই। মেয়েকে নিতে পারলেন না, আর না তো মেয়ের স্বীকারোক্তির কারণে আযরানকে জেলে নিতে পারল। আযরান এই নিয়ে মজাই পেল। তবে বউ এর এমন কাঁটকাট হয়ে বসে থাকা দেখে সে ছোটশ্বাস ফেলে। গালের লাল হয়ে উঠা পাঁচ আঙ্গুলের ছাপে হাত বুলায় সে৷ পরমুহুর্তে ঠোঁটের কোণায় অল্প একটু জমাট রক্ততে। আযরান ছোটশ্বাস ফেলে। দুই হাতে রোজের মুখটা আগলে ধরে আচমকা চুমু দিল কপালে। রোজ নিশ্চুপ। আযরান ফের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,

” আমার জান কত বড় হয়ে গিয়েছে রোজ। আমায় সেইভ করতে শিখেছে? আজ অন্তত বলবি না যে তুই আমায় এখনও ভালোবাসিস না জান। আমি জানি, বাসিস, বাসিস। রোজ কেবল আযরানেরই। ”

রোজ শুনল। তবে উত্তর দিল না। ভেবে গেল কেবল বাবার কথা। সে কি বাবাকে কষ্ট দিল?বাবা কষ্ট পেল? হ্যাঁ পেল তো। বাবার দাম্ভিক মুখটা সবার সামনে চুপসে হয়ে গিয়েছিল চলে যাওয়ার সময়৷ আচ্ছা, আজ এই সিদ্ধান্তটা নেওয়ার কারণে ভবিষ্যৎ এ তাকে কিসের কিসের সম্মুখীন হতে হবে? বাবা মাকে সে আর আগের মতো পাবে কখনো? ও বাড়িতে বাবা তাকে ডুকতে দিবে কখনো? বাবার ভালোবাসা পাবে সে আর কখনো? রোজ বুঝে না। তার শূণ্য লাগে। আযরান ততক্ষনে তার ঠোঁটের ঔষুধ লাগিয়েছে। গালে চড়ের জায়গাটায় হাত বুলিয়ে বলল,

“ কি বেয়াদব বাপ তোর। নিজের মেয়েকে বিশ্বাস করে না। শুধু তোর বাপ বলে ছাড় পেল রোজ, নয়তো অন্য কেউ আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুললে হাত উপড়ে ফেলতাম।”

রোজ শক্ত চাহনিতে তাকায় এবারে। জ্বলে উঠে বলে,

“আমি আপনার স্ত্রী হওয়ার আগে তার মেয়ে। তার আমাকে মারার অধিকার আছে,এবং থাকবে। এই নিয়ে আপনি কথা বলার কেউ নন। ”

আযরান ফোঁস করে বলে,

“ কেউ না হলে থেকে গেলি কেন? চলে যাওয়ার জন্য বলেছিলাম তো তোকে। যাসনি কেন?”

রোজ ছোটস্বরে বলে,

“আমি চলে গেলে এটাই প্রমাণ হতো যে আপনি আমায় জোর করে তুলে এনেছেন।”

আযরান ভ্রু বাঁকায়,

“তো? কি হতো তাতে? ”

“এটাই বুঝা যেত যে আপনি অপরাধী।”

ফের ভ্রু বাঁকিয়ে বলে আযরান,

“ আমি নিজের মুখেই তো বললাম আমি অপরাধী।শুনিসনি?”

“ আপনাকে তুলে নিত জেলে আযরান। আব্বু খুব রেগে ছিল, আপনাকে সত্যিই জেলে নিত। ”

“ তাতে কি? তুই চাসনি আমায় জেলে নেওয়া হোক? শাস্তি তো আমার প্রাপ্য তাই না রোজ? তোকে তুলে এনেছি বলে কথা। ”

রোজ নির্বাক তাকিয়ে রইল। আযরান হেসে বলল,

“ তুই আমায় ভালোবাসিস এখনো জান, না চাইতেও প্রমাণ দিয়ে ফেলেছিস। ”

রোজ এবারে অস্বীকার করল। বলল,

“ না।”

ভ্রু বাঁকাল আযরান। বলে,

“ তবে? ”

” আমি চাইছিলাম না আপনাদের পরিবারটা ভাঙ্গুক। আমার জন্য এই পরিবারের একটা ছেলের জেল হোক চাইছিলাম না। এই কারণেই যাইনি। ”

আযরানের হাসিটা মিইয়ে গেল। হুট করে শান্ত ভঙ্গিতে চেয়ে বলে,

“ এইজন্যই আমার পক্ষ নিলি? ভেরি গুড! তবুও এই পরিবারের প্রতি তো তোর ভালোবাসা আছে বল জান? এইটুকুই যথেষ্ট!”

রোজ তাকায়। শুধুরএ পরিবারের প্রতি না, আযরানের প্রতিও তার ভালোবাসা আছে। সে এটা অস্বীকার করতে পারে না৷ তবে কিছু রাগও আছে। রোজ ছোট শ্বাস ফেলে বলল,

” আযরান? ”

” হু।”

” আয়জান ভাই তো এখন স্বাভাবিক তাই না? শুনেছি ওখানে একটা মেয়ে উনাকে অনেক ভালোবাসেন৷ মেয়েটাকে মেনেছেন কি? উনারা বাড়ি ফিরে না কেন? আয়জান ভাইয়ের আম্মু ও ফিরে না। আবার আয়শান ভাইও এই বাড়িতে থাকে না। সবটা আমাদের পরিবারের সাথে শত্রুতার জন্য? ”

রোজের কন্ঠটা উদাস। আযরান তাকায়। ছোটশ্বাস ফেলে বলে,

“ হঠাৎ এসব ভাবনা? ”

“ এমনিই! ”

আযরান একটু হাসল। পরমুহুর্তেই চলে গেল নিরবে।

.

আয়শান তৈরি হয়ে নাস্তা করল। পেশায় সে ডক্টর। তবে মাঝেমধ্যে বাবার সাথে বিজন্যাসের প্রসঙ্গে পারিবারিক বিজন্যাস দেখতে হয় তাকে। আয়শান খাবার টেবিলে বসেই দেখতে পেল তুলিকে। বাইরে যাচ্ছে। আয়শান পেছন থেকেই ডাক দিল,

“ কোথায় যাস? ”

তুলি তাকায়। একটু আগের কবির সাহেবের কথাগুলো সে রুম থেকেই শুনেছিল। এমন অহরহ এই বাড়ির মানুষের থেকেও কথাগুলো শুনতে হয় তাকে। অথচ তুলি কিন্তু ডেইজির সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে চায়নি। ডেইজি ভালো না ও এটা জানতে চায়নি। তুলি তো এসবে জড়াতে চায়নি। তাকে জড়ানো হলো। অতঃপর দিনরাত সে অযোগ্য এই কথাটা তার মাথায় যে যার মতো ডুকিয়ে যাচ্ছে। তুলির ক্লান্ত লাগে। কখনো কখনো মনে হয় এই বাড়ি ছেড়ে সে কোথাও পালিয়ে যাক। অথচ যাওয়ার মতো জায়গা তো তেমন তার নেই। তুলি ছোট করেই বলল,

“ ভার্সিটিতে। ”

আয়শান উঠে দাঁড়াল। তুলির দিকে এগিয়ে এসে বলল,

“ আমি ও হসপিটালে যাব, একসাথেই যাওয়া যাক? ”

তুলি এবারেও শান্ত গলায় উত্তর করল,

“ হু। ”

অতঃপর পা এগোয়। বাইরে দাঁড়ায়। আয়শান আসতেই আয়শানে সাথে সাথে গাড়িতে উঠল। তুলি বরাবরই চুপচাপ হলেও আগে তবুও আয়শানকে সমীহ করে কথাবার্তা বলত। অথচ এখন তুলি নিজ থেকে কথা বললেও বলে অভিযোগ শুনাতে। আর বাকি সময় আয়শান যেভাবে যা বলে চুপচাপ তাই শুনে। শুধু আয়শান না, এই পরিবারের যে যেটাই বলুক তাই তুলি চুপচাপ শোনে। আয়শান এই পরিবর্তনের জন্য নিজেকেই দায়ী করে। সে মনেপ্রাণে চায় তুলি আগের মতো হয়ে যাক। আগের মতো। আয়শান গাড়ি চালাতে চালাতেই আচমকা এই বিষয়ে বলল,

“তুলি? তুই কি স্বাভাবিক হবি না আর?”

তুলি তাকায়। উত্তর করল,

“ স্বাভাবিক তো আয়শান ভাই। ”

আয়শান ছোটশ্বাস ফেলে। স্বাভাবিক না। আয়শানের এই তুলিকে কোনভাবেই স্বাভাবিক লাগে না। তুলি আগে অন্তত পরিবারের মানুষগুলোর সঙ্গে তো মিশত, এখন তো ওদের সাথেও তেমন মিশে না। মনে হয় ও এই পরিবারে কর্মরত। যে যাই বলছে তাই করা, সবার প্রয়োজন বুঝা যেন ওর দায়িত্ব। আয়শান বহুবার বলেছে এই নিয়ে। তুলি হেসেছে বিনিময়ে প্রতিবারই। আয়শান এসব ভেবে ফের বলল,

“ কিন্তু কোথাও একটা আমার কাছে তোকে নিষ্প্রাণ লাগে। মনে হয় কেমন যেন এই বাড়িতে পড়ে থাকতে হচ্ছে বলেই পড়ে আছিস তুই। যেন এই বাড়িতে তোর আপন কেউ নেই।কেমন যেন আমাদের সকলের কথায় উঠবস করছিস। অথচ তুইও এই বাড়ির একজন৷ যেকোন কিছুতে তোর নিজের মতো কথা বলার অধিকার আছে তুলি। কারোর সাথে খুব একটা কথাও বলিস না। ”

তুলি চুপই থাকল এসব শুনে। অতঃপর কিছুটা সময় পর বলল,

“ বুঝলাম। ”

আয়শান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এতগুলো কথা বলার বিনিময়ে শুধু বুঝলাম কথাটা সে ডিজার্ব করে? একটা সূক্ষ্ম রাগও হয় যেন। তবুও শান্তস্বরে বলল,

” তোর এই নিঁখুত পরিবর্তনের পেছনে দায়ী আমিই তাই না?এখন বল, কি করলে সবটা স্বাভাবিক হবে?আমি চাই তুই আগের মতো হয়ে যা, একটা সুন্দর লাইফ লিড কর। ”

তুলি হাসল এবারে। বলল,

“ আমি আগের মতোই আছি আয়শান ভাই। আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন আমি ছোট থেকেই এমন।”

আয়শান এর পর আর কিছুই বলল না। তার নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। আয়শান শান্ত, গম্ভীর মানুষ। খুব একটা রাগ প্রকাশ করে না। আজও রাগ প্রকাশ করতে পারল না সে। নিশ্চুপে গাড়ি চালায়। অতঃপর অনেকটা সময় পর তুলির ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামাল। ঠিক এই মুহুর্তে এসে তার মনে হলে তুলিটাকে আবার কবে দেখবে জানে। আবার কবে বাড়ি যাবে কে জানে। সে বাড়ি যায় না তুলির অসুবিধা হবে বলেই।কোথাও গিয়ে আজকাল তুলিকে দেখলেই তার অসহায় লাগে নিজেকে, নিজের প্রতিই রাগ হয়। তবুও দিনশেষে তার এই মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে হয়। টিনেজদের মতো ভার্সিটির গেইটে এসে দাঁড়িয়ে হলেও একবার এই মেয়েটার মুখ দেখতে ইচ্ছে হয়। অথচ তা হয়ে উঠে না নিজের ব্যাক্তিত্বের কাছে হার মেনর। আয়শান তুলির দিকে তাকাল। নেমে যাচ্ছে ততক্ষনে তুলি। বলল,

“ আস্তে নাম। ”

তুলি নামল। আয়শান ফের বলল,

“ আজ রাতে আর বাড়ি ফিরব না।যাচ্ছি। ”

তুলি জানে। আয়শান বাড়ি এলেও তিন চার মাস পর কোন প্রয়োজনে বাড়ি আসে৷ তারপর প্রয়োজন মিটলেই এক -দুইদিন থেকে আবার বাসায় ফিরে যায়। তুলি হেসে বলল,

“ জানি।”

আয়শানের ইচ্ছে হলো আরেকটু কথা বলুক। আরেকটু কথা বাড়ুক। কিন্তু কথা খুঁজে পেল। কেবল বলল,

“ নিজের যত্ন নিস তুলি। ”

তুলি বলল,

“ আপনিও।”

আয়শান হাসল এবারে। তুলি ততক্ষনে সামনের দিকে ফিরেছে। হাঁটা শুরু করেছে। আয়শান তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। অতঃপর একবার চোখ বুঝে শ্বাস নিল। পরমুহুর্তেই গাড়ি এগোল।

#চলবে…