#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_০৯
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
তুলি সায়ানকে দেখেই শান্ত দৃষ্টিতে চাইল। পরমুহুর্তেই সায়ানের শান্ত অসহায় দৃষ্টি দেখে সে অস্বস্তিতে পড়ল যেন। সে জানে সায়ানের চোখের ভাষায় কি আছে বা কি ছিল আগে! একজন মেয়ে হিসেবে সে এটুকু খুব ভালোভাবেই বুঝে উঠতে পারে। কিন্তু একটা বিবাহিত মেয়ের দিকেও এভাবে তাকানো মানানসই কি? তুলি ছোটশ্বাস ফেলে। সায়ানের জন্য তার অনুভূতি কোনকালেই ছিল না। আগেও ছিল না, এখনও নেই। তবুও এভাবে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালে তাকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়৷ মনে হয় যেন সায়ানের এই অসহায় দৃষ্টির জন্যও সে দায়ী ! সবকিছুর জন্যই তো সে দায়ী! তুলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোট করে উত্তর করল,
“ ভালো আছি সায়ান ভাই। ”
সায়ান ভদ্রভাবে হাসি উপহার দিল। তুলি বিনিময়ে ভদ্রতা নিয়েও একবার জিজ্ঞেস করল না সে কেমন আছে? জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল না? হেসে বলল,
“ তোমায় দেখে ক্লান্ত লাগছে তুলি, ফ্রেশ হয়ে এসো বরং। ”
তুলি যেন স্বস্তিই পেল এবারে। যাক, একটা না একটা কারণে সরে পড়া গেল এখান থেকে। তুলি দ্রুত মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমে গেল। মুখচোখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হলো। অতঃপর তীব্র ক্লান্তি নিয়ে যখন বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুঁয়ে পড়ল ঠিক তখনই বাইরে থেকে কুহু ডাক দিল। অস্ফুট স্বরেই বলল,
“ তুলি আপু?এই তুলি আপু? শুনছো তুমি? ”
তুলি ক্লান্ত ভঙ্গিতে চোখ বুঝে নিলেও এবারে উত্তর করল,
“ শুনছি কুহু, আয়। দরজা খোলাই আছে। ”
কুহু এল দ্রুতই। তুলিকে উচ্ছাস নিয়ে বলল,
“ একটু শপিং এ যাব, নিয়ে যাবে তুলি আপু? তুমি সাথে গেলে কেউ কিছু বলবে না। ”
তুলি চোখ মেলে চাইল এবার। সারাদিনের ক্লান্তি কেমন চোখে ভাসছে যেন। বলল,
” কিন্তু এখন কিসের শপিং করবি কুহু? ”
“ রোজ আপুর জন্য। আমার ভাবি হয়েছে বলে কথা। কিছু গিফ্ট করব না বলো? ”
তুলি মাথা নাড়াল। উঠে বসে হেসে বলল,
“ ওহ, তা ঠিক। আমারও কিচ্ছু দেওয়া হয়নি রোজকে। দেওয়া উচিত। ”
“তুমিও কি কিছু কিনবে রোজ আপুর জন্য?”
তুলি ছোটশ্বাস ফেলে বলল,
“ হয়তো। গিয়ে তৈরি হয়ে আয় কুহু৷ ”
অতঃপর উঠে বসে তুলি ব্যাগ হাতড়াল। মাসের শেষ দিক এখন। তুলি মোটামুটি এই বাড়িতে থাকা খাওয়া ব্যাতীত বাকিসব নিজের খরচ নিজেই বহন করা শিখেছে এই দুটো বছর। আগে তার মামনি থাকতে তাকে খরচ করতে দেওয়া হতো না। এখন মামনি নেই, তার সঙ্গে তেমন কথাও বলে না৷ তুলির প্রথম দিকে তখন এইচএসসি শেষ করে কষ্টই হলো মামনি ব্যাতীত অন্য কারোর টাকা খরচ করতে, আয়শানের টাকা খরচ করতে। বিয়ে, এতসব ঝামেলা সব ওর এইচএসসির পরই হলো হুট করে। অতঃপর ভার্সিটির এডমিশন, প্রস্তুতি, ভার্সিটিতে ভর্তি এই নিয়ে প্রায় অনেক টাকাই আয়শান খরচ করেছে।তুলির এই এতকাল টাকাপয়সা খরচ, নিজের খরচ এসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা না হলেও আয়শানের সাথে বিয়েটা হওয়ার পরই সে আবিষ্কার করল তার নিজে খরচটা নিজের বয়ে নেওয়া উচিত। সবাই আদর স্নেহ করলেও দিনশেষেই কেউই নিজের সম্পূর্ণটা দিয়ে তো তাকে ভালোবাসেনি। তার প্রমাণ সে পেয়েছে আয়শানের সাথে বিয়ের পরপরই। তুলি প্রথম প্রথম আয়শানের খরচ করা নিয়ে কিছু বলতে না পারলেও একটা সময়ে গিয়ে সে একটা টিউশন জোগাড় করল। অতঃপর তারপর থেকে আয়শানের দেওয়া টাকা সে তেমন খরচ করেনি। আয়শান মাসে মাসে তাকে টাকা দিলেও তুলি টাকা দিতে না বলেছিল দুয়েকবার, আয়শান শোনেনি। তুলিও আর কথা বলেনি। টাকাগুলো একাউন্টে আসে, ওভাবেই থাকে৷ তুলি বরং চেষ্টা করে প্রথম দিকের খরচ করা টাকাটাও ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু অভদ্রতা হিসেবে দেখাবে বলে আর ফেরত দেওয়া হয়নি। আর যায় হোক, সে তো এই বাড়ির ঋণ কখনোই শোধ করতে পারবে না। এই বাড়ি তাকে অনেক দিয়েছে। এখন এসে টাকা ফেরত দিলে তা নিমকহারামির মতো দেখাবে। তুলি ছোটশ্বাস ফেলে। টিউশনি টাকা থেকে বৃদ্ধ দাদী এবং একটা এতিমখানায় মাসে দুয়েকদিন সময় কাঁটাতে গিয়ে কিছুটা খরচ সে করে। এরপরও কিছু জমানো থাকে। ঐ জমানো টাকা দিয়েই আগের মাসে সে দাদীর চিকিৎসার জন্য খুব বেশিই টাকা পাঠিয়েছিল। যার দরুন হাতে এখন কেবল হাজার দুয়েক টাকাই তার আছে কেবল। তুলি ঐ টাকা দিয়েই উপহার কিনবে বলে চুল আঁছড়ে তৈরি হলো। ততক্ষনে কুহু তৈরি হয়ে চলে এল।প্রথমেই জিজ্ঞেস করল,
“ তুলি আপু? জানো? আমি আম্মুর থেকে হাজার পনেরো টাকা এনেছি উপহার কেনার জন্য।আচ্ছা, তোমার বাজেট কত আপুকি কিনবে? ”
তুলি হাসল। বলল,
“ বাজেট? উপহার তো বাজেট দিয়ে বিচার করে না কুহু। তাই না? ”
কুহু দ্রুতই মাথা নাড়াল। বলল,
“ হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই। তবুও জানতে চাইলাম আরকি। ”
.
রোজ রুমেই ছিল। সায়ানের সাথে খুব একটা কথাবার্তা তার হয়নি। তবে আযরানের সাথে খুব করে কথা হলো সায়নের। হয়তো এখনো সায়ানের সাথেই কথা বলছে আযরান। রোজ ছোটশ্বাস ফেলে। সায়ানের কাছে শুনেছে ডেইজি পাগলামো করছে আবারও। রোজের মা মেয়ের জন্য এখনও চিন্তিত। আর বাবার কথা কিই বা বলবে। রোজ এরপর থেকেই সিদ্ধান্ত নিল বাবার বাড়ি যাবে সে। সেদিন যায়নি মানে এই না যে সে পুরোপুরি আযরানকে মেনে নিয়েছে। এমন নয় তো আযরানের সাথে সংসার করার জন্য সে সব মেনে নিয়েছে। সে সেদিন মেনে নিয়েছিল কেবল আযরানকে যাতে জেলে যেতে নাহয় এই কারণে। আর এখন বাবার মাথা গরম নিশ্চয়। সেদিন সে যেভাবে বাবাকে যাবে না বলল এরপর নিশ্চয় ও বাড়ি ফিরলে বাবা তাকে বাড়ি তুলবে না আদর করে?রোজ ভাবে। ভাবতে ভাবতেই সে বুঝে না আযরানও কি তাকে যেতে দিবে এত সহজে? রোজকে পালাতে হবে? কিন্তু এতগুলো মানুষের চোখে ফাঁকি দিয়ে পালাবে কি করে সে?এই জন্য সায়ানকে বলেও রেখেছে যদি পালাতে নাই পারে সে তবে যেন ডেইজিকে নিয়ে একদিন কোন রেস্টুরেন্টে আসে। সে দেখা করতে যাবে। কিন্তু এসব বিষয়ে আযরান জানলে কি হবে সেটাই ভাবে সে। রোজ যখন এসবই ভেবে যাচ্ছিল ঠিক তখনই কেউ তার কাঁধে থুতনি ঠেকাল। রোজ কিছুটা চমকালেও পরমুহুর্তে বুঝে উঠে তা আযরান। ভ্রু কুঁচকে পিছু ফিরে দ্রুত বলল,
“ কি?”
আযরান ও একইভাবেই বুকে হাত দিয়ে দাঁড়াল। বলল,
“ কি জান? বারবার প্রমাণ দিচ্ছিস তুই বিশ্বাসঘাতক? কেন বল? এত সুন্দর করে ক্ষমা করছি, ভালোবাসা দিচ্ছি, পছন্দ হচ্ছে না?”
রোজ বিভ্রান্ত চাহনিতে তাকায় যেন। আযরান হাসল। একটা গা জ্বালানো হাসি উপহার দিয়ে বলল,
“ সায়ানকে টেনে এককোণায় নিয়ে গিয়েই কেন কথা বললি জান? তুই চাইলে আমি তোদের স্পেস দিতাম তো তাই না? ”
রোজ ভ্রু কুঁচকে নিল। সায়ানকে সে টেনে এককোণায় নিয়ে যায়নি মোটেই। শুধু একপাশে গিয়ে কথা বলেছে।পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করেছে। এটা বিশ্বাসঘাতকতা কিভাবে হলো? রোজ বিরকাত হলো যেন। কপাল কুঁচকে বলল,
“ আপনি আসলেই অতিরিক্ত করছেন আযরান।সবকিছুতে অতিরিক্ত ভাবছেন। ”
আযরান হাসে। আচমকায় এক হাতে রোজকে টেনে এনে নিজের সামনে আনল। ধারালো এক চাহনি উপহার দিয়ে শাসিয়ে বলল,
“ আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করিস না রোজ। তোকে ছুঁয়ে বলছি জান, এবার যদি তুই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করিস তবে তোর চোখের ঐটুকু অনুভূতির দিকেও আমি চাইব না। ”
রোজ ফুঁসে উঠে যেন। বলল,
” বারবার বিশ্বাসঘাতক শব্দটা আমার ক্ষেত্রে ইউজ করছেন কেন? বলুন? ”
আযরান হাসল। বলল,
“ কারণ তোরাই বিশ্বাসঘাতক। তোর বাপও বিশ্বাসঘাতক, তুইও! বছর দুয়েক আগে তোর বাপ বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাদের পুরো কোম্পানি শেষ করতে চাইল আর এখন তুই বিশ্বাসঘাতকতা করে আমায় শেষ করতে চাইছিস। ”
রোজ রেগেই তাকাল। বলল,
“ আমার আব্বু বিশ্বাসঘাতকতা করেছে রাগে,প্রতিশোধ নিতে, কারণ এর আগে আপনারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন আযরান। আব্বু শুধু প্রতিশোধ নিয়েছিল৷ কেবল। ”
আযরান হেসে বলল,
“প্রতিশোধ? খুব ভালোই পারে নিতে তোর বাপ। কিন্তু আমাদেরটা বিশ্বাসঘাতকতা নয়, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ। যা বড় আব্বু ভুলবশত আয়শান ভাই এর মত না নিয়েই দিয়ে ফেলেছিল। ”
রোজ দৃঢ় চাহনিতে চেয়ে বলল,
“ আমার আব্বা সে প্রতিশ্রুতি পেয়ে আজহার আঙ্কেলকে চোখ বন্ধ রেখে বিশ্বাস করেই ভেবেছেন যে বিয়েটা হবে। কিন্তু হলো না তো, বিশ্বাস তো ভঙ্গ হলোই তাই না? ”
আযরান চুপ থাকল। অতঃপর কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে কেমন করে যেন হাসল। বলল,
“ তৈরি হয়ে নে রোজ, একটু শ্বশুড়বাড়ি ঘুরে আসব চল। ”
” মানে? ”
” তোর বাবার বাড়ি আরকি। যাবি না? ”
রোজ ভ্রু কুঁচকায়। বলে,
“ কেন যাবেন? ”
” সে কি!শ্বশুড়বাড়ি যেতে পারব না আমি? তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে আমার? ”
“ এই দুইবছরে তো কখনো যাননি। হঠাৎ কেন যেতে হবে? ”
আযরান উত্তর করল,
“ এই দুইবছর তো আমি ও বাড়ির জামাই ছিলাম না, ও বাড়ি আমার শ্বশুড়বাড়ি ছিল না। তাই না? এখন ও বাড়ির মেয়ে আমার বউ। যেতে হবে না? ”
রোজ শান্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকায়। অতঃপর বলে,
” ঝামেলা হবে জানেন আপনি। ”
আযরান বিনিময়ে বলল,
“ এত ঝামেলা করে লাভ আছে বল? একটাই তো বউ! ”
রোজ আগের মতোই স্থির শান্ত ভঙ্গিতে চেয়ে থাকল। অতঃপর বলল,
“ আমি বাবার সাথে তখন যাইনি মানে এই না যে আমি আপনাকে ভালোবেসে মেনে নিয়েছি আযরান। জানেন আপনি? ”
আযরান হুট করেই ভ্রু বাঁকাল। চাহনি কঠিন করল। জিজ্ঞেস করল,
“ জানি, তো কবে পালাচ্ছিস জান? ”
রোজও ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। উত্তর করল,
“ সময় বুঝে।এভাবে তো আর আটকে রাখতে পারবেন না আযরান।আর না তো আমি থাকব। ”
আযরান ও মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ তা ঠিক, আমি ভেবেছিলাম তুই আজ সায়ানের সাথে পালিয়ে যাবি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় গেলি না? তার চেয়েও আশ্চর্যের বিষয় সায়ানের চোখ তোর প্রতি অতোটা পরতে তো দেখলাম না। কেমন যেন একটা উদাসীনতা। কাউকে যেন খুঁজছিল এ বাড়িতে। তোকে পাত্তা না দিয়ে এমন করছিল কেন তোর সায়ান? আশ্চর্যের বিষয়। কোথায় আমি ভেবেছিলাম আমার বউ এর দিকর তাকানোর অপরাধের ওর একটা যাচ্ছেতাই শাস্তি দিব।”
“আপনি কি সবসময় পর্যবেক্ষণ করছিলেন?”
” বউ এর হবু বর ছিল বলে কথা। নজর রাখব না? ”
.
কুহু আর তুলি বের হলো সন্ধ্যের একটু আগেই। কুহু গাড়ি নিতে চাইলেও তুলিই বলেকয়ে রিক্সায় যাবে বলল। কুহু রাজি হতো না যদি না সাথে ফুসকারও প্ল্যান টানা হলো। অতঃপর রিক্সায় উঠল দুইজনে। এখনও বের হওয়া সময় আযরানের মা বারবার বলেছে যাতে কুহুকে দেখে রাখে। তুলি কুহুকে দেখেই রাখল। রিক্সায় উঠতে পর্যন্ত সাবধানে উঠতে বলল। অথচ কয়েক মিনিটের পথ অতিক্রম করতেই তাদের রিক্সাটা একটা সি এনজির সাথে ধাক্কা লেগে আচমকা উল্টে পড়ল। তুলির দিকেই একপাশ হয়ে পড়ল রিক্সাটা। মুহুর্তেই তুলি কুহু দুইজনেই যেন কিছু বুঝে উঠল। ধপাস করে পড়ে রাস্তা খসখসে জমিনে দুইজনেই ব্যাথা পেয়েছে। কুহুর হাতে ব্যাথা পেয়েছে, কপালের দিকটা কেঁটে গিয়েছে, সাথে বামহাতটাও কাঁটল। আর সে রক্তটা দেখেই কুহুর যাচ্ছেতা অবস্থা। কাঁদতে কাঁদতে প্রায় আধমরা সে। তুলি ছোটছোট চোখ করেই তাকায়।অতঃপর নিজে যা ব্যাথা পেয়েছে তা হজম করে নিয়ে আরো একটা রিক্সা ডাকল। কুহুকে কোনভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রিক্সায় উঠতে বলতেই ও দ্বিগুণ কান্না ঝুড়ল। বলল,
“ আম্মুকে কল দাও আপু, আম্মুকে দাও। আমি আম্মুর কাছে যাব আপু। বলো আমার এক্সিডেন্ট হয়েছে, বলো আপু। কত কেঁটে গিয়েছে, আমি কত ব্যাথা পেয়েছি আপু….”
বেচারা তুলি উপায় না পেয়ে কল করল। জানে সে, এই দোষটাও তার উপরই উঠানো হবে। ছোটশ্বাস ফেলে জানাল সে সবটা। কুহুর মা সমস্ত শুনেই আহাজারি জুড়লেন। জানালেন আয়শানের হসপিটালেই যাতে নেয় কুহুকে। আয়শানের হসপিটালের দূরত্বও কম। আয়শানও আছে, চিকিৎসা ভালো হবে। অথচ তুলি চাইছিল ওই হসপিটালে যাতে না যেতে হয়, সে অন্য হসপিটালে যাওয়ার জন্য বলেও দিয়েছিল রিক্সাওয়ালাকে কিন্তু বড়দের আদেশ যখন তখন তো তা তাকে পালন করতেই হবে। নিজের মতো কথা বলার অধিকার তার এখনো জম্মেছে কি? তুলি রাজি হলো। কুহুর সাথে কথা বলিয়ে দ্রুত রিক্সা নিয়ে ছুটল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। অতঃপর পৌঁছাল ও। কোথাও আয়শানকে না দেখতে পেয়ে সে স্বস্তিই পেল। দ্রুত ওখানকার নার্স আর ডক্টরকে বলিয়ে কুহুর চিকিৎসা করাল৷তেমন বেশি আঘাত পায়নি, খুব অল্পই!তবুও প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষুধ, ব্যান্ডেজ সব করাল তুলি। বিল পে করল। অতঃপর কুহুকে নিয়ে চলে যাবে ভাবতেই ছুটে এল কুহুর মা, ফুফু,আযরান। কুহুকে দেখেই কেঁদে উঠলেন কেমন। তুলিকে শুধালেন,
“ তুলি? তোকেই তো বারবার করে বললাম আমার মেয়েটাকে দেখে রাখতে। বলিনি? কি দেখাশোনা করলি বল? আমার মেয়েটার এখন এই অবস্থা। তোর তো কিছু হলো না, আমার মেয়েরই হাত পায়ে কপালে ব্যান্ডেজ।”
তুলি হাসল। তাকিয়ে থাকল কেবল কেমন করে৷ অতঃপর পায়ে কোনরকমে ভর দিয়ে দিয়ে একপাশে গিয়ে বসল সে।এতক্ষন ও সে কোনরকমে বাম পায়ে ভর দিয়ে দিয়েই চলছিল, কুহুকে এই পথটা এনেছেও এভাবে। বোধহয় ভালোই ব্যাথা লেগেছে। ডান পাটা ছোঁয়ানোও যাচ্ছে না মাটিতে। হাতের কনুই গুলো ও জ্বলছে খুব। তুলি অবশ্য খুব একটা খেয়াল করেনি নিজের ব্যাথা নিয়ে। গুরুত্বও দেয়নি। তবে এখন হাসি পাচ্ছে তার। যে ব্যাথাকে যত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় লোকের কাছে সে ব্যাথায় ততবেশি গুরুতর! এই যেমন, তুলি তার ব্যাথাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে তা অতটুকু গুরুতর নয়৷
#চলবে….
#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_১০
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
আয়শান এতোটা সময় ও.টি. তে ছিল। আযরানের মা হসপিটালে এসে পৌঁছানোর আগে তাকে ত্রিশের উপরে কল দিয়েছে যা তার চোখে পড়ল এই মাত্রই ও.টি. থেকে বের হওয়ার পর। আয়শান ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিজের কেবিনে বসে কল ব্যাক করল। অতঃপর জানতে পারল কুহুর এক্সিডেন্ট হয়েছে। তুলির সাথে পাঠানো হয়েছিল কোন প্রয়োজনে, তুলির কিছু না হলেও কুহু খুব আঘাত পেয়েছে। এটুকুই জানল ছোট্ট আম্মুকে কল করে সে।এটাও জানল যে তারা এখনও হসপিটাল থেকে যায়নি। আয়শান তা শুনে দ্রুতই পা চালাল। তুলির কিছু হয়নি এটা শুনে স্বস্তি পেলেও কুহু আঘাত পেয়েছে এটাই চিন্তার কারণ হলো। বেশি আঘাত পেল কিনা। তাইতো দ্রুতই গেল। অতঃপর গিয়েই দেখা গেল কুহুকে ঘিরে আছে তার ছোটআম্মু, ফুফি। সে ছোটশ্বাস ফেলে এগোল। কিছুটা দূরে একপাশে দেখা গেল তুলি একদম শান্ত বাচ্চার মতো বসে আছে। আয়শান এগিয়ে ছোটশ্বাস ফেলে প্রথমে কুহুকেই জিজ্ঞেস করল,
“ কুহু? এখন কেমন লাগছে? বেশি কষ্ট হচ্ছে? কোথায় কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস হুহ?”
তুলি তাকিয়ে দেখল এবারে। কুহু কেঁদে ফেলেছে প্রায়।মেয়েটা তার আম্মুকে দেখে একবার কেঁদেছে বাচ্চাদের মতো, এখন আয়শানের আদুরে স্বর শুনে আবারও কেঁদে উঠল বাচ্চাদের মতো। ঐ যে, যেখানে বেশি ভালোবাসা পাওয়া হয় ওখানেই আমরা অল্পতেই কেঁদে ফেলতে পারি। অল্পতেই ফ্যালফ্যাল করে টলমল চাহনি ফেলতে পারি।কুহুও বোধহয় তার ব্যাতিক্রম করল না। কেঁদে উঠে জানাল সে খুব ব্যাথা পেয়েছে। আয়শান এবারে ছোটশ্বাস ফেলে কুহুর মাথায় হাত বুলাল। তারপর ব্যান্ডেজ গুলো দেখল। যেটুকু আঘাত পেয়েছে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। তাছাড়া এক্সিডেন্টের বর্ণনা শুনে বা ব্যাথা পাওয়ার বর্ণনা শুনে তার মনে হলো না খুব সাংঘাতিক এক্সিডেন্ট। ছোটশ্বাস ফেলে কুহুকে বুঝিয়ে জিজ্ঞেস করল এবারে,
“ আর কোথাও ব্যাথা পেয়েছিস কুহু? এই ব্যান্ডেজ গুলো ছাড়া আর কোথাও ব্যাথা পেয়েছিস? পেলে তা ডক্টরকে জানাতে হবে তো। ”
কুহু বাচ্চাদের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল,
“ তুমিও তো ডক্টর বড়ভাইয়া। ”
আয়শান হেসে ফেলল। বলল,
“ হ্যাঁ, কিন্তু আমি তো নিউরোলজিস্ট কুহু।তুই বল, আর কোথাও ব্যাথা পেয়েছিস?আর কোথাও ব্যাথা হচ্ছে বল? ইন্টার্নাল কোন সমস্যা হলে তো ক্ষতি হবে।”
কুহু টলমল চোখে তাকিয়েই উত্তর করল এবারে,
“ না বড়ভাইয়া।আর কোথাও ব্যাথা পাইনি। ”
আয়শান কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ ঠিক আছে, ঠিক হয়ে যাবে। ডক্টর ঔষুধ দিয়েছে না? বাসায় গিয়ে রেস্ট করবি, দুষ্টুমি করবি না, দেখবি ঠিক হয়ে যাবে অল্পদিনে।”
এটুকু বলেই কুহুর মায়ের দিকে চাইল সে। বলল,
“ চলে যাচ্ছেন এখন ছোটআম্মু? আযরান কোথায়? ”
কুহুর মা মুহুর্তেই উত্তর করল,
“ হ্যাঁ, কুহুরও সুবিধা হয় বাসায় গেলে। রেস্ট নিতে পারবে। আযরান গাড়িতেই, মাত্রই গেল। ”
আয়শান মাথা নাড়াল। জানাল,
“ আচ্ছা, তাহলে রেস্ট নিক বাড়িতে গিয়ে। আশা করি সুস্থ হয়ে যাবে দ্রুত। ”
কুহুর মা যেন নিশ্চিত হতে পারল না তবুও যে মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে। দ্রুত জানালেন,
“ আমি আর তুলির সাথে কোথাও পাঠাব না আমার মেয়েকে দেখো। তুলি এতোটা বেখেয়ালি জানলে আমি পাঠাতামই না ওর সাথে।”
আয়শান ভ্রু কুঁচকে নিল এবারে। একবার তুলির দিকে তাকাল। তুলি ততক্ষনে চলে যাবে শুনে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। আয়শান ওর দিকে একবার তাকিয়েই ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ তুলি কি করেছে ছোটআম্মু? ”
কুহুর মা দুঃখ করে শুধালেন,
” ওকে বলেছিলাম আমার মেয়েকে দেখেশুনে রাখতে। ও আমার মেয়েটাকে দেখে রাখল না।দেখে রাখলে কি এমন হতো বলো? ”
আয়শান এবারে শান্তি ভঙ্গিতেই উত্তর করল,
“ কুহু তো ছোট বাচ্চা নয় ছোট আম্মু। আর তুলিও কি করবে এখানে? এটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। কুহুর মতো আঘাত তুলিও পেতে পারত। ”
“ পায়নি তো আয়শান। ”
আয়শান হুট করেই শান্ত শীতল চাহনিতে তাকাল। ভ্রু উঁচু করে বলল,
“ পেলে খুশি হতে? ”
কুহুর মা যেন এবার কিছু রেগে গেল। শুধাল,
“কি বুঝাতে চাইছো?”
আয়শান এবারে শুধু বলল,
” কিছু না। ”
পরমুহুর্তেই আয়শান ছোটশ্বাস ফেলে তুলির দিকে চাইল ফের। আসলেই কি ব্যাথা পায়নি তুলি? নাকি ব্যাথা পেয়েও হজম করে বসে আছে ওভাবে? ব্যাথা পেলেও তো বলার মেয়ে নয় এই তুলি। নির্ঘাত চুপচাপ বসে থাকবে এভাবে। আয়শান এগোল ওর দিকেই। অতঃপর সম্মুখে দাঁড়িয়ে শুধাল,
“ দুইজন একই রিক্সায় ছিলি, ও ব্যাথা পেল অথচ তুই ব্যাথা পেলি না তুলি? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এটা। ”
তুলি এবারে সরাসরিই দৃষ্টি রাখল।বিশ্বাস হচ্ছে না মানে? কি বুঝাতে চাইছে আয়শান? সে ব্যাথা পায়নি মানে সে কুহুকে ইচ্ছে করে ব্যাথা দিয়েছে?একটু আগেই তো ছোট মামনির কথাতে স্পষ্ট বুঝা গেল ব্যাথা পায়নি এটাতে উনি খুশি নন। হয়তো সন্দেহ করছে সে ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত দিয়েছে? তুলি মনে মনে ভেবে নিল বাকি সবার মতো আয়শানও তাকে দোষরোপ করছে। আর দোষারোপ করার ভঙ্গিটা এই প্রশ্নের মাধ্যমেই শুধাল বোধহয়। তুলি মৃদু হাসল কেবল।নিজের মায়ামায়া দৃষ্টিতে আয়শানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উত্তর দিল,
“ কুহু আমার বোনের মতো আয়শান ভাই, ওকে আমি নিজে থেকে ব্যাথা দিই নি। বিশ্বাস করুন, ওর সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই।”
আয়শান শান্ত স্থির একটা দৃষ্টিই নিক্ষেপ করল এবারে। তুলি এমন কেন? কেন ভাবে যে সবাই সবকিছুর জন্য তাকেই দায়ী করবে? আয়শান তো স্বাভাবিক ভাবে ব্যাথা পেয়েছে কিনা এই উত্তরটা জানার জন্যই প্রশ্নটা করল। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেও কি উত্তর দিত এই মেয়ে? দিত না। তাই তো এভাবে জিজ্ঞেস করেছে। অথচ তুলি অন্যভাবে নিল। আয়শান গম্ভীর স্বরে শোনাল,
“ কুহুকে তুই ব্যাথা দিয়েছিস এমনটা আমি বলেছি তুলি? নাকি তুই ওকে ব্যাথা দিয়েছিস কিনা, শত্রুতা আছে কিনা এইটা জানতে চেয়েছি? ”
আয়শানের স্বরটা ঠান্ডা হলেও একটা দৃঢ়তা এসে বাঁধল যেন কোথাও। তুলি সেই দৃঢ়তায় চুপ হয়ে গেল। উত্তর করল না আর। শান্ত স্থির কোন স্রোতস্বিনীর ন্যায় সে বরাবরই শান্ত। এখন ও শান্তি স্থিরভাবেই সে দাঁড়িয়ে রইল।আয়শান ফের বলল,
“ তুই কি ভাবিস? আমরা মানুষ না তুলি? তোকে সবসময় আমরা খারাপ ভাবি এটা কেন ভাবিস? বল। ”
তুলি এবারেও উত্তর করল না। দেখল কুহুকে নিয়ে এগোচ্ছে ফুফু আর ছোট মামনি। সেও পা বাড়াতে নিয়ে বলল,
“ কুহুকে তো বাসায় গিয়ে রেস্ট করতে হবে, যেতে হবে। যাচ্ছি, ভালো থাকবেন।”
আয়শান শান্তভাবেই তাকাল এবারও। তুলি এক পা ফেলেছে মাত্র।অতঃপর তুলিকে পা ফেলতে দেখে এবারে ভ্রু বাঁকাল সে৷ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তুলি পা ফেলতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে। অথচ এই মেয়ে নাকি ব্যাথা পায়নি? আয়শান মনে মনে নিজেকেই গা’লি দিল এতক্ষন এই কথা বিশ্বাস করার জন্য যে তুলি ব্যাথা পায়নি।মুহুর্তের মধ্যেই তুলি অন্য পা ফেলার আগে সে তুলির এক হাতে টেনে ধরল বাম হাতের কনুই ধরে। কুহুকে কিছু না বলে ফুফু আর ছোট আম্মুকে গম্ভীর বলল,
“ তোমারা একটু গাড়িতে গিয়ে বসো ফুফু, তুলি একটু পরে আসছে। ”
তুলি ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। বাকিরা তেমন উত্তর না করলে ও সে ভ্রু কুঁচকাল। কেন সে পরে যাবে? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরিয়ে শান্তস্বরে বলল সে,
“ একটু পর? ”
আয়শান ও মাথা নাড়িয়ে জানাল,
“ হ্যাঁ, একটু পর। ”
তুলি এবারে আর উত্তর করল না। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকল। আয়শানের এই চুপচাপ মেয়েটাকে চুপচাপ দেখে উল্টো রাগ লাগল। বলল,
“ তারপর বল, কতটুকু ব্যাথা পেয়েছিস? কি ভাবিস নিজেকে? তুইই সব জানিস? তুইই চালাক। আমরা সবাই বোকা? ”
তুলি চুপই আছে। কেমন মায়ামায়া নজর যেন চোখজোড়ায়। আয়শান ফের বলল
” কি হলো বল? ”
তুলি এবারে উত্তর দিল,
“ তেমন একটা ব্যাথা পাইনি। ”
আয়শানের রাগ লাগল আরও।ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
“ তাহলে হাঁটতে পারছিস না কেন? ”
তুলি সঙ্গে সঙ্গেই পায়ে তাকাল। বুঝা যাচ্ছে সে ব্যাথা পেয়েছে? নাকি ফোলা দেখাচ্ছে? কিভাবে বুঝল? তুলি হতাশ হয়ে উত্তরে বলল,
“ পায়েই একটু লেগেছে কেবল। ”
আয়শান জানে ব্যাথাটা কেবল একটু নয়। তাই তো ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“ কেবল একটু? ”
এটুকু বলেই তুলির কনুই ছেড়ে দিতেই তার অনুভব হলো তার হাতে তরল কিছু লেগে আছে যেন। আয়শান হাত মেলে দেখল, অতঃপর সঙ্গে সঙ্গেই দেখল তুলির হাত ধরার সেই কনুই এর অংশটায়। মুহুর্তেই বুঝতে পারল তুলির হাতএ কেঁটেছে। কনুই এর দিকটা জামা কিছুটা ছেঁড়াও। আয়শান ছোটশ্বাস টেনে কেবল বলল,
“ অথচ তোর হাতের কনুইও ভেজা লাগছে। ওখানেও… ”
তুলি শুনল না। দুটো কনুই এবং হাতের কিছু অংশ জ্বালা করছিল এতক্ষন। সে জানে কেঁটেছে। তবে এটা আয়শান জেনে যাওয়াতে তার নিজেকেই কেমন যেন লাগল। দ্রুত শান্তগলায় বলল,
“বাড়ি যাব আমি। উনারা অপেক্ষা করছে তো। ”
আয়শান কেমন করে যেন তাকাল। তুলি বরাবরই এমন। ছোটবেলা থেকেই। নিজের ব্যাপারে খুবই অসচেতন এই মেয়েটা। নিজে ব্যাথা পেলে তা কাউকে জানাতও অব্দি। চলাফেরাতেও যে সে কত যে ব্যাথা পায় তা সৃষ্টিকর্তা জানে।ঐ ছোট আম্মু একটু আগে বলল? তুলি বেখেয়ালি? হ্যাঁ বেখেয়ালিই। তবে তা শুধু নিজের বেলাতেই। অন্যদের বেলাতে সে অক্ষর বাই অক্ষর কথা শোনা, যত্ন করা মেয়ে। শুধু নিজের বেলাতেই অনীহা। আয়শান ওভাবে তাকিয়েই পকেট থেকে ফোন বের করল। তুলিকে কিছু না বলেই আযরানকে কল করে শুধাল,
“আযরান,তুলিকে নিয়ে আমি ফিরব। তোরা চলে যা এখন। ”
#চলবে..