#প্রেমহিল্লোল||৩৪/অন্তিমপাতা||
#তাসনীম_তামান্না
রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে রিমা আর রাজ। রাজ অন্যবারের মতো এবার আর আগে এসে বসে থাকে নি। যে সময় বলেছিল তার থেকে আধাঘন্টা পরে এসেছে রিমা আজ অস্থির চিত্তে বসে রাজের অপেক্ষায় ছিলো বার বার ফোন দিচ্ছিল কিন্তু রাজ ফোন ধরে নি। এসে রাজ কোনো কিছু বলল না বসে ওয়েটারকে পানি দিতে বলল তারপর নিজের ফোন বের করে দেখতে লাগলো। রিমা যে তার সামনে বসে আছে সে দিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই যেনো তার সামনে কেউ নেই। রিমার রাগ জিদ লাগলো সেটা কন্ট্রোল করতে পারলো না চিৎকার দিয়ে বলল “আমি যে একটা মানুষ বসে আছি তোমার চোখে পড়ছে না? এতোক্ষণ দেরি করলে কেনো আসতে? ফোন ধরছিলে না কেনো? কতবার ফোন দিয়েছি তোমাকে?”
রাজ ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আশপাশে তাকালো সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। রিমা নিজেও তাকিয়ে বুঝলো এভাবে পাবলিক প্লেসে চিৎকার চেচামেচি করা উচিৎ হয় নি। ম্যানেজার এসে জিজ্ঞাসা করলো “এ্যানি প্রবলেম, ম্যাম?”
ও গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো “নো” বলে বসে পড়লো। সকলে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রিমা দাঁতে দাঁত পিশে বলল “কী হলো এখনো উত্তর দিচ্ছো না কেনো?”
রাজ এতোক্ষন পরে উত্তর দিলো –একটু ব্যস্ত ছিলাম।
–কী এতো ব্যস্ত ছিলে যে ফোন ধরার টাইন পাও না।
–দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস।
রিমা অপমানিতবোধ করলো। রাজ ছবিগুলো ওর সামনে দিয়ে বলল “এই যে ছবিগুলো, তবে কী জানো এগুলো তুষার বিশ্বাস করবে না। ও আমাদের মতো এতো বোকা নয়। আমার মনে হয় আমাদেরকে থেমে যাওয়া উচিৎ। ওদের বিয়ে হয়ে গেছে সুখে সংসার করছে আমরা সেখানে জাস্ট থার্ড পার্সন। আমরা পলিসি করে ওদের হাসিল করে ফেললাম কিন্তু তাদের মন থেকে ভালোবাসা পেলাম না তখন আমরা কেউই শান্তি পাব না। শুধু শুধু ঝামেলা করে লাভ নাই।”
–কীহ? আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল তোমার দ্বারা কিছু হবে না অকর্মার ঢেকি একটা।
–আমার কথাগুলো বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবো তারপর তোমার যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নাও। তবে সেসবে আমি থাকব না নিজের মতো কাজ করবে তুমি। বাই দ্যা ওয়ে, আমার কাজ আছে যেতে হবে বাই।
রাজ তাড়াহুড়া করে চলে গেলো। রিমা হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। রাজ কী তাকে এড়িয়ে গেলো বা পালিয়ে গেলো। রিমা রাগে একা একা ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। ওয়েটারকে কফি দিতে বলল। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কফি আসলে সেটা খেতে খেতে মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে লাগলো। ভাবনার শেষে ফলাফল আসলো রাজই সঠিক। আর সে ভুল।
———————
আমরা সময়কে আঁটকে রাখতে পারি না। সেটা প্রকৃতির নিয়মে চলতে থাকে। কিন্তু কিছু সুখের সময় বোধহয় দ্রুত চলে যায়। আজ রিমা, তুষার এবং কুয়াশার ফ্লাইট সকলে তাদের বিদায় দিতে এয়ারপোর্টে এসেছে। সকলে কষ্ট বুকে চেপে মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে। এটা-ওটা পরামর্শ ও সাহস দিচ্ছে। কিন্তু কুয়াশা কেঁদে কুটে শেষ সে নিজের রাগ-কষ্টগুলো আড়াল করতে পারে না।
তুষারের হাত শক্ত করে ধরে এয়ারপোর্টের সকল কাজকর্ম শেষ করে প্লেনে উঠলো। এটাই প্রথম ফ্লাই করছে সাদা সাদা তুলার মতো মেঘগুলো এতো সৌন্দর্য ওর মনকে ছুঁতে পারছে না দুঃখ ওদেরকে ছুঁতে দিচ্ছে না। তুষার ওকে কোনো সান্ত্বনা দিলো না মাথায় ভরসার হাত বুলিয়ে দিলো। পুরোটা সময় তুষার দুয়েকটা কথা বললেও কুয়াশার ‘হ্যাঁ-না’ এই দুটোতে উত্তর আঁটকে ছিলো। তুষার ও আর ঘাটে নি ওকে। ওকে সামলে উঠার জন্য সময় দিয়েছে।
ওরা যখন সুইজারল্যান্ডে পৌছালো তখন রাত হয়ে গেছে। রিমা ওদেরকে বলে বিদায় নিয়ে টেক্সিবুক করে ওর বাসার দিকে রওনা দিলো। তুষার ও একটা বুক করলো। কুয়াশা কিছু বলছে না এদিকে ওদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। তা দেখে তুষার বলল “কী খাবে বলো? বাইরে থেকে খেয়ে যায় বাসায় গিয়ে খাবার বানানোর এনার্জি পাবো না।”
–আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। পেট ভরা
–ওকে শুকনা খাবার কিনছি চলো।
–আপনি খাবেন না?
–আমারও পেট ভরা।
কুয়াশা আর কিছু বলল না। ওরা কেনা কাটা করে বাসায় ফিরলো। কুয়াশা গিয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে নিলো শরীরটা আর পারছে না আগে কখনো এমন লঙ জার্নি করে নি। এসেই বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়লো। তুষার অন্য ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যে।
তুসার এসে দেখল কুয়াশা এলমেল হয়ে শুয়ে আছে। সাও্যারের পরে চুল্গুলাও মুছে নাই ভিজে অবস্থাই ঘুমিয়ে পরেছে ও যত্ন করে চুল্গুল মুছে নিজেও শুয়ে পড়লো। এতোটা জার্নির পরে আর পারছে না। তার পরে কয়েকদিন কেটে গেলো কুয়াশা ধীরে ধীরে মন খারাপ কাটিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। তুষার ও ওকে সময় দেয় ঘুরতে নিয়ে যাই। কুয়াশার মানসিক সমস্যাও কাটিয়ে উঠেছে আগের মতো আর পাগলামি করে না। দুজনের সম্পর্কের দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসাগুলো বেড়েই চলেছে। সারাদিন ঘুরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছিল। তুষারের ঘুম ভেঙে গেলো কারোর কথা বলার আওয়াজে চোখ খুলে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল কুয়াশা ঘুমের মধ্য বিড়বিড় করে কি সব বলছে। ওর ঘুম কেটে গিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে কুয়াসাকে ডাকল কিন্তু ও রেস্পন্স করলো না ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখল গরম হয়ে আছে। ও উঠে গিয়ে থার্মোমিটার এনে জ্বর মাপল জ্বর পট্টি দিলো কিছুক্ষণ। কুয়াশা জ্বরের ঘোরে বলতে লাগলো “তুষার আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?”
–হুম আমি তো শুধু তোমাকেই শুনি
–আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না তো? আমি হারাতে হারাতে আজ নিঃস্ব আপনাকে হারালে আমি মরে যাব
–কেউ কারোর জন্য মরে যাবে কথাটা ভুল । এবং কারোরই কারোর জন্য মরে যাওয়া উচিত নয়।
–তার মানে কি আপনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?
–আমি চলে গেলে কি? তুমি তো আমাকে ভালোবাস না
কুয়াশার চোখ দিয়ে অবিলম্বে পানি ঝরতে লাগল। সেটা দেখে তুষার হেসে বলল
–কাঁদছ কেন আমি তো ভুল কিছু বলি নি
ও ফুঁফিয়ে কেঁদে বলল “আমি আপনাকে ভালবাসি খুব ভালবাসি। আপনি আমাকে একটুও ভালবাসেন না একটুও আদর করেন না। জানেন মেঘার জামাই ওকে কত ভালোবাসে আদর করে।”
তুষার মুখ টিপে হেসে বলল
–তুমি অন্যর বেড রুমের খবর নিয়ে বেড়াও?
–হ্যাঁ, নি তো? আমার জামাই তো আর আমাকে ভালো বাসে না।
তুষার হেসে ওর দিকে ঝুঁকে মুখোমুখি হয়ে বলল “ভালোবাসা লাগবে? আদর লাগবে?”
কুয়াশা তুষারের মাথা টেনে ওষ্ঠে অধর মিলিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে মেতে উঠলো ভালোবাসার খেলায়। ভেসে গেলো প্রেমহিল্লোল নামক ভালোবাসার জেয়ারে।
পরিশিষ্ঠঃ
তারপর সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, বেলা, দিন, সপ্তাহ, মাস গড়িয়ে কয়েক বছরে গিয়ে ঠেকলো। এর মধ্যে সকলের জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। মেঘা-রিদের ছেলে হয়েছে। তুতুল-মেঘের ছেলে হয়েছে। আর তুষার-কুয়াশার এখনো পেন্ডিংয়ে আছে।
ওদের বাবা-মায়ের খুনিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ব্যপারটা ওরা ছেলেরাই শুধু জানে কে খুনি, কে কে জড়িত কোটকাচারি সব ওরাই সামলেছে অযথা আর বাড়ির গিন্নীদের প্রেশার বাড়াতে চাই নি। তারা শুধু জানেন ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। সব চেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় খুনির ছেলেই খুনিকে ধরিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা আচমকাই বদলে গেছে আচমকা? নাকি সত্যিকারের ভালোবাসার সান্নিধ্যে পেয়ে।
বাংলাদেশের এক কমিউনিটি সেন্টারে ধুমধামে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে আত্মীয় স্বজনে ভরপুর। আজ রাজ রিমির বিয়ে। সকলে আমন্ত্রিত। কুয়াশা উঁচু পেটে নড়তে চড়তে কষ্ট হচ্ছে। সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদেরকে দেখছে আর ওর হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদতে মন চাইছে। তুষার একে ওকে ধমকালো বলল “কী সমস্যা? তোমাকে এক জায়গায় চুপ করে বসতে বলেছি। এভাবে তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে বেড়াচ্ছো কেনো?”
কুয়াশাও মেজাজ দেখিয়ে বলল “কারণ আমি ক্যাঙ্গারু তাই।”
–আচ্ছা আসো বসবে। এভাবে বারবার এদিকে ওদিকে চলে যেও না। এতো লোকজন বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করছে ব্যাথা পাবে তো একটু বোঝার চেষ্টা করো। আসো আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোমাকে।
কুয়াশা মুখটা ভাড় করে বলল “আমাকে দেখতে বাজে লাগছে। সবাইকে কী সুন্দর লাগছে। আমি কত মোটা হয়ে গেছি।”
তুষার ওকে আশ্বাস দিয়ে বলল “মাতৃত্বকালীন মেয়েদের চেহারায় এক অন্যরকমের মাধুর্য থাকে। তুমি আমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছো এসব বলতে হয় না। আমাদের বেবি আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
–আমার খুব ভয় করে।
–আরে কিছু হবে না ইন শা আল্লাহ
–তোমাকে নিয়ে ভয় করে
–কেনো?
–যদি অন্য মেয়েকে ভালোবেসে ফেলো
–পাগল নাকি? একটা বউ সমলাতে গিয়ে আমি শেষ আরো? ওহ নো…
কুয়াশা খিলখিল করে হেসে উঠলো। তার হাসিতে তার একান্ত প্রেমিক প্রেমহিল্লোলে ভেসে গেলো বহু দূর… বহু দূর!
~সমাপ্ত~