#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
সূচনা পর্ব
আই নিড ইউ।আমি তোমাকে চাই,চাই মানে চাই।হোক সেটা বিয়ে করে কিংবা না করেই।ইউ নো?আই এ্যাম ভেরি রোমান্টিক।তুমি যদি বউ হতে চাও,তাহলে সম্মানের সাথে যাবে,আর যদি বিয়ে না করেই…….
পুরো লেখাটা পড়ার আগেই আরশিয়ার রাগ উঠে গেলো।
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো,মতিষ্কে রাগের হানা দিলো।রাগে তার পুরো শরীর কাঁপছে,চোখে মুখে হিংস্রতা প্রকাশ পাচ্ছে।লেখা কাগজটা এক হাতে চেপে ধরলো। চোখ বুলিয়ে ভার্সিটির মাঠের একপাশে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলো।হনহনিয়ে ছুটলো সেখানেই।
ক্লাস শেষ করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো রিহান।সাথে আরো আছে অভিক,রনিত আর সাহিল। বন্ধু মহলের আরেকজন আছে সে আজ আসেনি।
আড্ডার মাঝে রনিত বলে উঠলো,
“দোস্ত তোর আর আরশিয়ার জুটিটা সেই লাগে।দুজনে কেউ কাউকে দেখতে পারিস না,একজন আরেকজন কে দেখলে এমন ভাবে ভাব করিস যেন জাত শত্রু।তোদের ঝগড়া দেখতে বেশ মজা পাই।
সাহিল মত মিলিয়ে বলল,
“দোস্ত এমন ঝগড়া কিন্তু ভবিষ্যৎতে অন্য কিছুর লক্ষ্যণ।ওই যে নাটক সিনেমায় দেখিস না নায়ক নায়িকা প্রথমে কেউ কাউকে পছন্দ করে না,এক সময় আবার দুজনে প্রেমে পড়ে।
রনিতের কথায় বাকি দুজন হেসে উঠলো।বিরক্তিতে নাক কুঁচকালো কেবল রিহান।তার মতে অসভ্য মেয়েটার নাম নিতেই তার মন মেজাজ খারাপ হলো।দাঁত কিড়মিড় করে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই তার গালে কষে থাপ্পড় পড়লো।সেই থাপ্পড়ের কলতানে ভার্সিটির সকলে তাদের দিকে তাকালো।শুরু হলো নানা আলোচনা।রিহান সহ সকলে আশ্চর্য হলো।সবকিছু এতো দ্রুত হলো যার কারণে রিহান ওর কথার কিছু বুঝতে পারছে না। হ্যাঁ থাপ্পড় টা আরশিয়া মেরেছে।শুধু থাপ্পড় মেরেও থামেনি।আহানের শার্টের কলার চেপে রেগে বলল,
“আমি কোনো রাস্তার মেয়ে নয়,যে টাকার লোভে চরিত্রহীনদের সাথে সম্পর্কে যাবো।আমাকে এমন কু প্রস্তাব দেওয়ার সাহস কি হয় আপনার?মেয়ে দরকার হলে সেসব জায়গায় যাবেন।আপনি এই ভার্সিটিতে আসেন কেন?যেখানে আপনার মধ্যে সামান্য পারিবারিক,নৈতিক শিক্ষা নেই,সেখানে ভার্সিটি এসে ডিগ্রি অর্জন করে কি হবে?আগে মানুষ কে সম্মান করতে শিখবেন তার পর আসবেন,বিশেষ করে মেয়েদের সম্মান করতে শিখবেন।
রিহান বিস্মিত সাথে ওর বন্ধুরাও।অভিক এগিয়ে আসে।আরশিয়াকে বলতে চাইলো,
“তুমি কাকে কি বলছো আরশিয়া?রিহান কি করেছে?
আরশিয়া ওর শার্টের কলার ছেড়ে দিলো।অভিকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সেটা আপনার অভদ্র,বেয়াদব বন্ধুকে জিজ্ঞেস করবেন।কথাটা বলেই আরশিয়া রেগেমেগে ভার্সিটি প্রাঙ্গন থেকে চলে গেলো, হয়তো বাসার উদ্দেশ্য।
যাওয়ার আগে লেখা চিরকুটটা তার হাতে দিয়ে গেছে।
রিহান গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রাগে তার শরীর মন দুটোই জ্বলছে।এখনো বুঝতে পারছে না তার পকি হলো এটা?যেখানে সে কিছু করেওনি।
অভিক,রনিত,সাহিল এসে রিহানের হাতের কাগজা দেখতে চাইলো।
সাহিল কাগজটা খুলছে।রিহান রেগে জোরে বললো,
“ওই মেয়ের সাথে এবার যা হবে খুব খারাপ হবে।
সাহিল কাগজের লেখাটা পড়ে অবাক হলো।রিহান কে বলল,
“মেয়েটার দোষ নেই। দেখ এটা, বলে কাগজা মেলে ওর সামনে ধরলো।রিহান পড়লো,রাগ তার দ্বিগুণ হলো।বলল,
“যে লিখেছে তাকে খুঁজে বাহির কর।আর ওই মেয়েকে তো আমি শাস্তি দিয়েই ছাড়বো।এতোদিন সামান্য বিষয় নিয়ে হলেও তেমন কিছু বলিনি কিন্তু আজকে অনেক বড় ভুল করেছে, এর মাশুল দিতেই হবে।
অভিক বলল,
“কিন্তু মেয়েটার তো দোষ নেই। সে তো মনে করেছে তুই লিখেছিস।তোর সাথে যেহেতু ঝামেলা চলে তাই..
রিহান কথা শেষ করতে দিলো না অভিকের উপর ক্ষেপে বলল,
“আমি লিখেছি মানে?আমার মাইন্ড এতো খারাপ?ও আমার পারিবারিক শিক্ষার উপর আঙ্গুল তুলেছে সেটা হোক জেনে,কিংবা না জেনে।আমার সম্মানে আঘাত লেগেছে আমি প্রতিশোধ নিবোই।এখন আপাতত খোঁজ লাগা কার এতো বড় সাহস হলো?কে করলো এই কাজ?
আমি আসছি।
বলেই রিহান ও চলে গেলো।রহিত বলল,
”হয়ে গেলো।এই মেয়ের নিশ্চিত এবার খবর খারাপ আছে।
সাহিল কাগজটা দেখে বলল,
“কেউ কম নাকি?দুজনে সেম।টক্কর বেশ জমবে,তবে এই কাজ করলো কে?
”সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না।
হঠাৎ অভিকের চোখে কিছু পড়লো।বলল,
“এমন কেউ করেছে,যে আরশিয়া এবং রিহানের ঝামেলা বাড়াতে চায়।
ভার্সিটির সেই প্রথম দিন শুরু হয়েছিলো তাদের প্রথম ঝামেলা।রিহান অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আরশিয় তখন অনার্স প্রথম বর্ষে নতুন ভর্তি হয়েছে। ভার্সিটির ক্লাস এক মাস আগে শুরু হলেও সে আসতে পারেনি অসুস্থতার জন্য।একমাস পর প্রথম পা দেয় স্বপ্নের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের।মনে ছিলো প্রথম ভার্সিটিতে আসার আনন্দ,মুখে ছিলো হাসি আর পাশে ছিলো তারই প্রিয় বেস্টি অর্থি।ভাগ্যের জোরে কিভাবে যেন দুজনে এক ভার্সিটিতে চান্স পায় যদিও তাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা।আরশিয়ার সাবজেক্ট পলিটিক্যাল সাইন্স আর অর্থির ইকোনোমিকস।সেদিন আনন্দের সহিত ভার্সিটিতে পা দিলেও সেই আনন্দ বেশিক্ষণ থাকে না।
ভার্সিটির গেইট পেরিয়ে যেতেই হুট করে একদল ছেলে সামনে এসে দাঁড়ায়।আরশিয়া আর অর্থি থমকে দাঁড়ায়।অর্থি ভয় পেলেও আরশিয়া স্বাভাবিক,সে সহজে ভয় পায় না।নিজেকে খুবই স্ট্রং মনে করে এবং রাখে ও।
আরশিয়া তাদের বলল,
“কি চাই?
দলের একটি ছেলে জানতে চাইলো,
“জুনিয়র তাই তো?
“হ্যাঁ তো?
“তো মানে?সম্মান দিবে না?এমন ভাবে বলছো যেন কোন মিনিস্টারের মেয়ে।
“সিনিয়রা সম্মান নিতে কি রাস্তায় আসে?সম্মান রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া যায়?সম্মান নিতে হলে সম্মান দিতে হয়।আপনারা সম্মান দিয়েছেন?অসভ্যের মতো পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছেন।
ঠিক শেষের এতটুকু কথাই রিহানের কানে গেলো।কারণ এই কথাটা আরশিয়া একটু জোরে বলেছে।রিহান পাশেই ছিলো।যারা র্যাগ দেওয়ার ধান্দায় ছিলো তার ওর প্রিয় বন্ধু না হলেও ক্লাসমেট ছিলো।মাঝে মধ্যে ছেলেটা একটু র্যাগ দিতেই পারে বাড়াবাড়ি করলে সে নিজেও প্রতিবাদ করে। তবে প্রথম এসে এমন কথা রিহানের সহ্য হলো না।উঠে গেলো তাদের সামনে।রিহান যেতেই ছেলেগুলা বলল,
“রিহান দেখ না!জুনিয়র হয়ে সিনিয়রদের সাথে কিরকম অসভ্যের মতো আচরণ করছে।আরশিয়া এবার ছেলেটার দিকে তাকালো,সেও তার দিকে তাকিয়ে আছে।
আরশিয়া বলল,
“ভয় দেখাতে ভার্সিটির গুন্ডা,মাস্তান ডেকে আনছেন নাকি?ওয়াও!আমি তো ভয়ে সিটিয়ে গেলাম। বলে হেসে উঠলো।অর্থি ভয়ে বারবার ওকে থামতে বলছে কিন্তু ও থামছে না।
আরশিয়ার বলা কথাটা ওর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।রেগে হাতের মুঠ বাঁধে।পাশের জনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ওকে স্পেশাল র্যাগ দে।সিনিয়রদের সাথে বেয়াদবি করার জন্য ভার্সিটির মাঠে কান ধরে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।সবাই দেখবে সিনিয়রদের সাথে বেয়াদবি করার ফল।
রিহানের কথা শেষ হতেই আরশিয়া আবারো হেসে উঠলো।কোনো মতো হাসি আটকিয়ে বলল,
“ এক্সকিউজ মি?ভার্সিটি কি আপনার বাবার?যে আপনার কথা শুনতে হবে? সিনিয়রা সম্মান পাওয়ার মতো কাজ করলে অবশ্যই করতাম।বাট সরি,আমাদের লেট হয়ে যাচ্ছে চল অর্থি।সবাই কে অগ্রাহ্য করে আরশিয়া চলে গেলো।সকলে অবাক হলো!রিহান রেগে গেলো প্রচন্ড।এখন পর্যন্ত এই ভার্সিটিতে তাদের উপরে কথা বলার সাহস দেখায়নি। সেখানে এই মেয়ে প্রথমদিনে এভাবে অসম্মান করলো।এটা তার আত্মসম্মানে লেগেছিলো।তার পর চলে গেছে দুই মাস।তার পর থেকে এই পর্যন্ত দুজনের মধ্যে এইরকম রেসারেসি চলতে থাকে।ভার্সিটির প্রায় অর্ধেক মানুষ জানে তাদের এইসব কাহিনির কথা।অনেকে অবাক হয় যে রিহানের উপর সব মেয়েরা ফিদা,যার উপরে ভয়ে কেউ কথা বলে না।ভার্সিটির সব স্যারদের প্রিয় ছাত্র, কারণ সে পড়ালেখায় ক্লাস টপার এন্ড তার চাচ্চু এই ভার্সিটির ভিসি।বাবার একমাত্র ছেলে সে,টাকা পয়সার অভাব নেই।এটিটিউট আর আভিজাত্য নিয়ে চলে তবে অন্যকে অসম্মান করে না।আরশিয়ার সাথে যা ঘটে তা দুজনের ছাড় না দেওয়া এবং ভুল বুঝা বুঝির কারনে,আজও তাই হলো।না জানি আজকের পর আরো কি হবে একমাত্র আল্লাহ জানে।রিহান যে রেগে আছে কিছু তো করবেই।পরিবার নিয়ে কথা বললে ওর মাথা পাগল হয়ে যায়, পরিবারের জন্য ও সব করতে পারে।
আনিকের কথায় রহিতও সাধ দিলো।সাহিল বলল,
“ব্যাপ্যারটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করতে হবে।কাল যা হবে দেখা যাবে আজ বাসায় চল।এই রিহান না থাকলে আড্ডাও কেমন ফিকে লাগে।
আরশিয়া ভার্সিটিতে থেকে বেরিয়ে সোজা বাসা গেছে।আজ অর্থি সাথে ছিলো না।বাসায় গিয়ে সোফায় বসে পড়লো।রাগ তার এখনো কমেনি।সম্মান মেয়েদের কাছে অনেক দামি সেখানে এমন প্রস্তাব দিলে যে কেউ রেগে যাবে।কিছু মেয়ে আছে রাজি হতেও পারে,তাদের অবশ্য মেয়েদের কাতারে ধরা যায় না। যারা নিজের সম্মান বির্সজন দেওয়াকে আনন্দ, ফুর্তি মনে করে তারা হচ্ছে…
না আর ভাবতে পারছে না।রাগ লাগছে ভীষণ।
আরশিয়ার মা সানজানা চৌধুরী উপর থেকে নামলেন।মেয়েকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে?গরম লাগছে?শরবত করে দেব?এই রহিমা এক গ্লাস শরবত করে দে তো। রহিমা হলো তাদের বাসার কাজের মহিলা।আরশিয়া বসা থেকে উঠে পড়লো। বলল,
”গরম আমার শরীরে নয় মেজাজে লাগছে।
সানজানা চৌধুরী চিন্তিত হলেন।আবারো জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে তোর বলবি তো?
আরশিয়া এবার মায়ের দিকে তাকালো।মা’কে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তেমন কিছু না। তোমার না শুনলেও চলবে।আব্বু কে কল করে বলে দিও অফিস থেকে যেন তাড়াতাড়ি আসে।
সানজানা চৌধুরী মাথা নাড়িয়ে ঠিক আছে বললো।আরশিয়া ততক্ষণে নিজের রুমে চলে গেছে।সুবিশাল এই বাড়িতে থাকে তারা মাত্র তিনটে মানুষ।আরশিয়ার বাবার আর কোনো ভাই না থাকার কারণে তার দাদুর সবকিছু তারাই পেয়েছে।বড়লোক বাবার মেয়ে হলেও চলাফেরা সাধারন ভাবে করে।দেখলে বুঝা মুসকিল সে কেমন পরিবারের মেয়ে।
বন্ধ দরজায় অনবরত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছেন সায়মা বেগম।কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই। এবার তিনি থামলেন,ছেলেকে শোনার জন্য জোরে বললেন,
“কি হয়েছে বলবি তো?দরজা বন্ধ করে থাকলে কি বুঝবো?তোর আব্বু অফিস থেকে এসে অপেক্ষা করছে।জানিস তো বাড়ির সবাই এক সাথে খেতে বসে।
দীর্ঘক্ষণের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রিহান দরজা খুলে দিলো।বলল,
“আমার কিছু হয়নি আম্মু।ভালো লাগছে না তাই দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম।আব্বুকে বলো আমি খাবো না।
সায়মা বেগম ছেলের কথা এমনিতে বিশ্বাস করলেও আজ বিশ্বাস হলো না।জিজ্ঞেস করলো,
“এতোক্ষণ কেউ ঘুমোয়?সেই বিকেল থেকে এসে দরজা বন্ধ করেছিস।এখন কয়টা বাজে?রাত এগারো বাজছে।
“ওহ আম্মু সত্যি ভালো লাগছে না যাও তো।
বলেই রিহান দরজা লাগিয়ে দিলো।রাজিয়া বেগম ছেলের কি হলো ভাবছে আর ফিরে আসছে।
রাগে,ক্ষোভে,অপমানে সারারাত ঘুম হলো না রিহানের।মূলত এই কারণে সে নিচে যায়নি, খায়নি।ওই মেয়ে কে শাস্তি দিবে তার পর ক্ষ্যান্ত হবে।সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়লেই রিহানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। কারো দীর্ঘ রাত র্নিঘুম কাঁটলো।কেউবা কিছুই না জেনে আরামের ঘুম দিলো।
ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই শহর যেন নিদ্রাভঙ্গ করে হঠাৎই দৌড়াতে শুরু করে। রাস্তায় গাড়ির হর্ন, বাসের গর্জন আর রিকশার ঘণ্টা মিলেমিশে এক অদ্ভুত কোলাহল তৈরি করে। ফুটপাথে হেঁটে যাচ্ছে তাড়াহুড়া করা অফিসগামী মানুষ, কারও হাতে লাঞ্চবক্স, কারও হাতে কফির কাপ। স্কুলবাসের হলুদ রঙ কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে যায়, ছোট্ট বাচ্চারা জানালা দিয়ে কৌতূহলী চোখে চারপাশ দেখে। ট্রাফিক সিগন্যালের লাল আলোয় থেমে থাকা গাড়ির সারি আর হকারদের ডাকে ভরে ওঠে মোড়গুলো। কোথাও ঠেলাগাড়ি থেকে ভাপ ওঠা সিঙ্গারা-পেঁয়াজু বিক্রি হচ্ছে, আবার কোথাও মুচি তার দিনের কাজ শুরু করেছে। কুয়াশা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলে দেখা যায়, উঁচু দালানগুলোর কাঁচের জানালায় সূর্যের প্রথম রশ্মি চকচক করছে। এই শহরের সকাল শান্ত নয় এখানে প্রতিটি মুহূর্তে গতি, শব্দ আর তাড়াহুড়া মিশে আছে, তবু এই ব্যস্ততার মাঝেই লুকিয়ে আছে জীবনের ছন্দ।
তবে চৌধুরী বাড়ি মানে আরশিয়াদের বাড়িটা একটু অন্য রকম। একদম কোলাহল মুক্ত। শহরে বাড়ি হলেও এমন জায়গায়, যেখানে আশে পাশে গাড়ির হর্ন কম শোনা যায়,সকাল হলে শান্ত পরিবেশ,শীতল হাওয়া অনুভব করা যায়।শুধু পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে পায় না। তবে বাসার মধ্যে দুটো পাখি আছে আরশিয়ার ভীষণ প্রিয়। বাড়িটার আশ পাশ ভীষণ সুন্দর একপাশে বাহারি রঙের ফুল,ফলের বাগান,ছাদেও আছে কিছু।
আরশিয়া ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে।সাধারণ তো সে ভোর বেলা উঠে পড়াশোনা করে।তবে আজকে অলসতা একটু বেশি ছিলো বলে উঠা হয়নি।আরশিয়ার ক্লাস আছে আটটা বিশ এ এখন বাজে সাতটা পঞ্চান্ন। যেতে তার পনেরো মিনিট লাগবে খেতে লাগবে পাঁচ মিনিট।সিড়ি বেয়ে নামছে আর বলছে,
“আম্মু তাড়াতাড়ি খেতে দেও। একদম সময় নেই পাঁচ মিনিটে খেতে হবে।
সানজানা চৌধুরী মেয়ের তাড়াহুড়ো দেখে বললেন,
“আগে নেমে এসো বস দিচ্ছি। এতো তাড়াহুড়ো করলে চলে?
আরশিয়া ততক্ষণে ডাইনিং টেবিলে এসে বসে পড়েছে। তার পাশে চেয়ারে বসা আশরাফ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“গুড মর্নিং আব্বু।
আশরাফ চৌধুরী ও বলল,
“গুড মর্নিং মামনি।এতো তাড়াহুড়ো করছো কেন?ক্লাস আছে তাহলে আরেকটু আগে রেডি হতে।আসো আমি তোমায় খাইছে দেই।
আরশিয়া বাড়তি ঝামেলা থেকে বাঁচলো।সানজানা চৌধুরীর আনা খাবার টুকু স্বামীর পাতে তুলে দিলেন।তিনি মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছেন। কয়েকবার নিতেই ঘড়িতে দেখে আটটা বেজে গেছে। আরশিয়া চেয়ার থেকে উঠে পড়লো,মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে কোনোমতে বলল,
“আর খাবো না আব্বু।সময় শেষ আমার যেতে হবে।
কথাটুকু শেষ না করতেই ততক্ষণ দরজা পরিয়ে গেছে। আশরাফ চৌধুরী পিছন থেকে বললো,
“পড়ে যাবে তো,ধীরে যাও।
সে কথা আরশিয়ার কান অবধি পৌঁছালো না।ডাইভার গাড়ি নিয়ে রেডি ছিলো ও শুধু উঠে পড়লো।এমনি দিন রিকশায় যায় কিন্তু আজ লেট হয়ে গেছে রিকশায় উঠানামা করতে,যেতে আরো লেট হয়ে যাবে। ভার্সিটির খানিকটা দূরে গাড়ি থামাতে বলে।আরশিয়া নেমে পড়ে।এক মিনিট রাস্তাটা হেঁটে যাবে।
রাস্তা পেরিয়ে ভার্সিটিতে পা রাখতেই অর্থি দৌঁড়ে আসে।আরশিয়া জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে দৌঁড়াচ্ছিস কেন?”
অর্থি হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,
“দোস্ত তুই যে কালকে বললি রিহান ভাইয়া তোকে কু প্রস্তাব দিয়ে চিরকুট লিখেছে।এজন্য তুই থাপ্পড় মেরেছিস সেসব নিয়ে সমালোচনা চলছে পুরো ভার্সিটি।
আরশিয়া রাগ বাড়লো, পুরো কথা না শুনে বলল,
“ভাগ্য ভালো প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করিনি।
“আগে পুরো কথাটা শোন।
আরশিয়া চুপ করলো।অর্থি বলল,
“তুই বিরাট বড় ভুল করেছিস।কালকের চিরকুটে রিহান ভাইয়ার নাম লেখা থাকলেও তিনি লিখেননি।লেখাটা রিহান ভাইয়ার নাম করে তোকে ফারিয়া দিয়েছে।
জানিস তো মেয়েটা কেমন?একদম অসভ্য,অশ্লীল ভঙ্গি, চেলাফেরা।সে তোর আর রিহান ভাইয়ার মধ্যে আরো সাপে নেউলে করার জন্য এরকম করেছে।একটু আগে সবার সামনে ফারিয়া শিকার করেছে।রিহান ভাইয়া প্রচন্ড রেগে আছে তোর উপর।
আরশিয়া অবাক হলো। সে ভুল করেছে?আসলেই?
না জেনে কত কথা বলে ফেলেছে। তার আগে যাচাই করা উচিত ছিলো কিন্তু ওই মুহূর্তে ওমন প্রস্তাব দেখে রেগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কত কি বলেছি।
এর মধ্যে অর্থি আবার বলল,
“দোস্ত রিহান ভাইয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিস।যদিও রেগে আছে অনেক।তুই তাকে বললি বল,তার পরিবার কে বলতে গেলি কেন?শুনেছি উনার বাবা ভীষণ ভালো মানুষ।
আরশিয়ার অনুশোচনা হলো।জানতে চাইলো,
“উনি কোথাই?
“একটু আগে ভার্সিটির গেইট দিয়ে বেরিয়ে গেছে দেখলাম। শুধু উনার বন্ধুরা আছে।
ক্লাস শেষে আরশিয়া আশে পাশে রিহান কে খুঁজলো কিন্তু কোথাও দেখতে পেলো না।
ভার্সিটির মাঠের এক কোনো তার বন্ধুদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলো।আরশিয়া আর অর্থি সেখানে গেলো।অভিক,রনিত,সাহিল আর ইশতিয়াক কথা বলছিলো।অভিকের নজর যেতেই সবাই কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পিছনে দেখ আরশিয়া আসছে।
সবাই তাকালো তার মধ্যে ওরা দুজনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আরশিয়া সবাই কে উদ্দেশ্য করে জানতে চাইলো,
“আপনাদের বন্ধু কোথাই?”
রনিত উত্তর দিলো,
“তাকে তোমার কি দরকার?
অর্থি বলল,
“দরকার আছে বলুন না।
“রনিত তাকালো মেয়েটার দিকে।মেয়েটাকে দেখলে আজকাল ভালো লাগে তবে প্রকাশ করে না আহানের ভয়ে।শত্রুর বন্ধবী কে পছন্দ শুনলে রাগ করবে নিশ্চিত।
“রিহান কোথাই গেছে আমরা জানিনা।আমাদের বলে যায়নি,তবে তোমার উপর ক্ষেপে আছে।তুমি কালকে না জেনে অতিরিক্ত বলে ফেলেছো।একজন ছেলে হোক কিংবা মেয়ে তার কাছে তার পরিবার অনেক বড়।তার সামনে পরিবার, বাবা মা তুলে কথা বললে কারোর সহ্য হবে না স্বাভাবিক।
আরশিয়া চুপচাপ শুনলো।পিছন ফিরে অর্থির হাত ধরে চললো গেইটের দিকে।আজ নাগাল পায়নি কাল এসে বলবে।এইসব ভেবে আরশিয়া আনমনে আটো ওয়ালাকে বলল,
“যাবেন মামা?
তিনি হ্যাঁ বলতেই উঠে পড়লো।অর্থির বাসার রাস্তা উল্টো সে চলে গেছে অন্য পথে।আরশিয়া বসে আছে আশে পাশে কে আছে খেয়াল করেনি।হঠাৎ মুখ চেপে ধরতেই আরশিয়া চমকে উঠলো,মুখ থেকে হাত সরানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো না ক্লোরোফিলের গন্ধে অজ্ঞান হয়ে শরীর নিতেজ হয়ে পড়ছে।চোখ বন্ধ হওয়ার আগে অস্পষ্ট ভাবে পরিচিত মুখটা দেখতে পেলো।পুরোপুরি জ্ঞান হারাতেই লুটিয়ে পড়লো কারো প্রসস্থ বুকে।
চলবে……………….?