প্রেমাঙ্গন পর্ব-০৬

0
22

#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
পর্ব: ৬

সকালের সূর্যের আলোর কিরণ আস্তে আস্তে ঘরের জানালা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আরশিয়া চোখ খুলে বাইরের দৃশ্য দেখলো। পাখিরা আনন্দে গান গাচ্ছে, আর গাছের পাতাগুলো দোলা খাচ্ছে। প্রকৃতি যেন নতুন দিনের অন্তর্দৃষ্টি দিচ্ছে। এই সুন্দর সকাল তার মনের বিষাদ কাটাতে সাহায্য করবে।
আরশিয়া বিছানা থেকে উঠে বসে আছে। গত পাঁচদিনের অসুস্থতার পরিবর্তে আজ তার মনে কিছুটা শক্তি ফিরে এসেছে। কিন্তু মাথাটা এখনও ভারি মনে হচ্ছে।এক কাপ চা খাওয়া দরকার।ঘড়ির দিকে তাকালো তখন বাজে সকাল নয়টা পয়তাল্লিশ। অসুস্থ থাকার কারণে ডাকেনি।ও ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে গেলো। ফ্রেশ হয়ে একবারে গোসল সেরে আসবে বলে আবার বেরিয়ে কাপড় আর টাওয়াল নিলো।তখনই আনজুমা চৌধুরী আসলেন।

“গোসল করবি?”

“হ্যাঁ আম্মু গোসল করলে নিজেকে অনেকটা ফ্রেশ লাগবে।

“ঠিক আছে গোসল সেরে একটু নিচে আায়।
আরশিয়া এতকিছু না ভেবে ঠিক আছে বললো।আনজুমা চৌধুরী বেরিয়ে যেতেই ও গোসলে গেলো।প্রায় পনেরো মিনিট পর মাথায় টাওয়াল পেচিয়ে সুন্দর নীল একখানা থ্রি-পিস পরে বাহির হলো।নিজেকে কেমন রিফ্রেশ লাগছে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু দেখলো।কতদিন নিজেকে দেখা হয় না আয়নার সামনে রোজই দাঁড়ানো হয় তবে সেভাবে খেয়াল করা হয় না। আজকে অজান্তে আরশিয়ার মন ভালো আছে,অসুস্থতা কাঁটিয়ে ফ্রেশ লাগছে। বেলকনিতে গিয়ে চুল ঝেরে টাওয়াল মেলে দিলো।হঠাৎ মনে হলো আনজুমা চৌধুরী তাকে নিচে যেতে বলেছিলেন।বেলকনি থেকে বেরিয়ে এলো।
রুম থেকে বেরোতেই কারো কন্ঠ শুনতে পেলো।অচেনা কন্ঠ শুনে আরশিয়া ভাবছে কে এলো এবার?
সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে চেনা অচেনা মানুষের মুখ দেখতে পেলো। সে আকস্মিক ভাবে থেমে গেল। তার বাবা-মা কিছু অচেনা মুখের মাঝে বসে আছেন এবং তাদের হাসি আর কথোপকথন তার মনে অস্বস্তি সৃষ্টি করল।

আরশিয়া ততক্ষণে নিচে নেমে এসেছে। আনজুমা চৌধুরী তাকে দেখে ডাকলো।
“আয় এদিকে আয়।
বলে ওর হাত টেনে নিয়ে গিয়ে বসালো।সামনে বসা ভদ্রলোক কে সে চিনে।সেদিন যে লোককে সে হসপিটালে নিয়ে গেছিলো তিনিই সে মেয়ে। ভদ্রলোক হেসে আরশিয়ার উদ্দেশ্য বললো,

“কেমন আছো মা?”
শুনলাম অসুস্থ এখন শরীর ভালো আছে? আর চিনতে পারছো তো?

আরশিয়া আকস্মিকতা কাটিয়ে হেসে উত্তর দিলো,
“আলহামদুল্লিলা এখন ভালো আছি আংকেল।আপনি কেমন আছেন? মাথা আর পায়ের ব্যথা সেরেছে?

“হ্যাঁ সেরেছে কয়দিনেই। এখন চাঙ্গা হয়ে গেছি দেখছো না। ভদ্রলোকের কথায় আরশিয়া ও হাসলো।পাশে ভদ্রমহিলা বসে আছে। জানতে পারলো তিনি উনার স্ত্রী।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবাক হলো তখন যখন জানতে পারলো উনারা উনাদের ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। আরশিয়া পাত্র কে তা শুনেই না করে দিলো।
“আমি এখনো বিয়ের বিষয়ে ভাবছি না আংকেল।আমি পড়াশোনা করতে চাই।

তিনি অনুরোধ করলেন।
“পড়াশোনা তুমি করবে কেউ বাঁধা দিবে না।
দরকার পড়লে বিয়ে ঠিক করা থাকবে তুমি না হয় বছর পরে উঠিও যখন ইচ্ছে হবে।
আরশিয়া তার বাবার দিকে তাকালো।
তিনি মেয়ের অবস্থা বুঝে উত্তর দিলো,
“জোর করবো না তোর ইচ্ছে, তবে তারেক মির্জার সাথে আমার এককালে ভালো সম্পর্ক ছিলো। এক সাথে ছোট ব্যবসা শুরু করেছিলাম তার পর দুজনে বড় হয়ে গেলাম। সময়ের সাথে আর যোগাযোগ ছিলো না।আমি আগে ঢাকায় ছিলাম তার পর আবার আসলাম রাজশাহীতে এভাবে আর মনে ছিলো না। সেদিন যখন রিহান আসলো ওর থেকে তারেক মির্জা নাম শুনে চেনা লাগছিলো, ভালো করে শুনে বুঝতে পারলাম সেই তারই ছেলে।

আরশিয়া আকস্মিকতার চরম পর্যায়ে চলে গেলো। সব ঠিক আছে কিন্তু রিহান উনার ছেলে?নো ওয়ে কিছুতেই বিয়ে পসিবল নয়।ওমন ছেলেকে বিয়ে করলে নিজের পস্তাতে হবে।কিন্তু তাদের মুখের উপর কিছু বলতে পারলো না। কেবল বললো আমার সময় চাই,আগে ভাবি তার পর জানাবো।
তারেক মির্জা রাজি হলো, বলল,
“ঠিক আছে মা। তুমি ভেবে জানিও তবে উত্তর পজিটিভ আসলে খুশি হতাম।তোমার মতো মেয়ে আমার ছেলের বউ হলে আরো বেশি খুশি হবো।
সায়মা মির্জা আরশিয়ার হাতে হাজার টাকার কয়টা নোট ধরিয়ে দিলেন।আরশিয়া কিছুতে নিবে না কিন্তু তারেক মির্জা বলল,
“রেখে দে মা। মেয়ে দেখলে দিতে হয় এমন নিয়ম আছে কিছু জায়গায়, সেটা হোক কিংবা আমার ভালোবাসা হিসাবে রেখে দে।
আরশিয়া মানুষটার কথা ফেলতে পারলো না। উনাকে বাবার মতো শ্রদ্ধা করে, সেই প্রথম দিন মা সম্বোধন তার হৃদয়ে ভালোলাগা সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু একটা বিষয় ভাবলেই রাগ লাগছে ওই বাঁদর উনার ছেলে। যদিও ভুল করে ক্ষমা চেয়েছে। রাগের মাথায় ওমন কাজ করেছে মিথ্যে নাটক সাজিয়েছিলো।কিছু না হলেও ভয় তো মনের মধ্যে ছিলো।আবার ভাবলো সেও তো ভুল বুঝে এই মানুষ গুলোকে কত বাজে বলেছেন, অথচ মানুষ গুলো কি নিদারুণ। কিন্তু তার পর ও যার সাথে দুদণ্ড মিলে না তার সাথে বিয়ে ইম্পসিবল।

আরশিয়া অর্থি কে ফোন দিলো।কিন্তু ওর নাম্বার ব্যস্ত দেখাচ্ছে তার মানে কারো সাথে কথা বলছে।প্রায় বিশ মিনিট পর আবার দিলো,আবারো ব্যস্ত দেখাচ্ছে। বিরক্ত হলো আরশিয়া।যেকোনো কিছু ঘটলে অর্থিকে না বলা পর্যন্ত তার শান্তি লাগে না কিন্তু এই অর্থির বাচ্চা এতক্ষণ
ধরে কার সাথে কথা বলছে?
তার কপালে ভাজ পড়লো।তার পর হঠাৎ কালকে রাতে আননোন নাম্বার থেকে আসা মেসেজ টা চোখে পড়লো।
দুইয়ে দুইয়ে চার হলো। আরশিয়ার চোখে মুখে বিস্ময়। তার মানে ওই মেসেজ কি ওই বাঁদর পাঠিয়েছিলো,?উত্তরে সে তো তার পরিবার পাঠাতে বলেছিলো। হয়তো সে কিন্তু তার থেকে এমন মেসেজ আশা করেনা।তার সাথে ঝগড়া আর রেশারেশির সম্পর্ক তবে?
আকাশকুসুম ভাবনার মাঝে অর্থির ব্যাক কল এলো।
আরশিয়া রাগ করে প্রথমে ধরলো না। পরপর দুবার কেটে গেলো।আবার কল আসলে আরশিয়া ধরে।সে কিছু বলার আগেই অর্থি বলতে থাকে,

“সরি,সরি দোস্ত।আসলে কথা বলছিলাম তোর কল খেয়াল করিনি।
আরশিয়া রাগী ভাব রেখে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“এতোক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলি?যার কারণে আমি কল দিচ্ছি তার হুস নেই। ব্যাপার কি বলতো?”

অর্থি সব বললো।আরশিয়া শুনে কপালের ভাজ ফেলে ভাবছে কিছু। বলল,
“এদের সমস্যা কি দুই বন্ধু একসাথে পিছে লেগেছে মতলব কি?যদিও রনিত ভাইয়া ভালো ছেলে।
অর্থি ঠিক বুঝতে পারলো না তাই জিজ্ঞেস করলো,
“দুজনে মানে?আর কে?

“কে আবার ওই রিহান মির্জা।

অর্থি পুরোটা জানতে চাইলো।আরশিয়া পুরো ঘটনা খুলে বলতেই অর্থি থ মেরে গেলো।বলল,
“দোস্ত একদম সিনেমার কাহিনির মতো হয়ে গেলো।নায়ক নায়িকার মিলে না, সব সময় ঝগড়া ঝামেলা করে তার পর একদিন অজান্তে প্রেমে পড়ে যায়।তেমনই হয়েছে মনে হচ্ছে।
ফিল্মি কথা শুনে আরশিয়া বিরক্ত প্রকাশ করলো।বলল,
“জীবন কোনো সিনেমা নয়,যার সাথে মিল নেই তার সাথে সংসার হয়তো করা যাবে কিন্তু ভালোবেসে ভালো থাকা হবে না।
অর্থি চুপ করে গেলো।মশকরা মুড থেকে এবার সিরিয়াস হলো। বলল,
“রিহান ভাইয়া কিন্তু ওতোটাও খারাপ না।হ্যাঁ সে তোকে তুলে নিয়ে গেছিলো রাগের মাথায় কিন্তু খারাপ কিছু তো হয়নি।আর ভুল তোর ও ছিলো।

“হ্যাঁ ছিলো শাস্তি অন্য দিতো।যাই হোক সেসব কথা বাদ দে।সময় আসলে না বলে দেবো। যেখানে ভালোবাসা নেই বা হবে না সেখানে আমি সংসার করতে যাবো না। সংসার বড় কঠিন জিনিস।একটা মানুষের সাথে সারাজীবন থাকতে হবে। তার সাথে মনের মিল,মতের মিল না হলে সে সংসার সুখের হবে না।

অর্থি সে টপিক চেঞ্জ করলো।বললো তার বিষয়ে তার পর হঠাৎ বলল,
“তুই তো এখন অনেকটা সুস্থ তো চল আজকে ঘুরতে যাই পার্কে। মাইন্ড ফ্রেশ হবে, নিজেরও ভালো লাগবে।
আরশিয়াও রাজি হলো।ভাবলো ঘুরতে গেলে মানুষের মনোভাব পরিবর্তন হয়,মন খারাপ থাকলে ভালো লাগে,অসুস্থতা কমে যায়। এজন্য হয়তো অনেকে বলে শুধু ঔষুধ না খেয়ে মাঝে মধ্যে ঘুরতে যাও।

রিহানের বাবা মা বাসায় যেতেই রিহান সামনে এসে দাঁড়ালো।ও যেন তাদের অপেক্ষাতেই ছিলো।তারা দরজা পেরিয়ে আসতে না আসতেই জিজ্ঞেস করলো,
“কি হলে আব্বু? রাজি হয়নি?

তারেক মির্জা স্বাভাবিক ভাবে বললো,

“না। সময় নিয়েছে সে বিয়ে এখনি করতে চায় না। যদিও ওর বাবা মায়ের আপত্তি নেই ও যা বলবে তাই।

রিহানের মুখ কালো হয়ে গেলো।ও জানতো এমন কিছু হবপ আর হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তাদের মধ্যে নেই কেনো বনিবনা তার উপর কত কাহিনি। কিভাবে যে ভালোবেসে ফেললো মন তা জানিনা নিজেও।
ঝগড়া হোক কিংবা ভালোবাসা দুটোতেই মিস করতে করতে আরো ভালোবাসা জন্মায়, হয়তো তার প্রতি ভাবনা থেকে সৃষ্টি হয়েছে ভালোলাগা সেটার নামই দিচ্ছি আমি ভালোবাসা।
ভালোলাগা, ভালোবাসা যাই হোক, আমার তাকেই চাই,
প্রেম না হোক,ঝগড়া করতে কাটিয়ে দিতে চাই।

আরশিয়া আর অর্থি এই বৃষ্টি ভেজা বিকেলে ঘুরতে বেরিয়েছে।যদিও বৃষ্টি এখন নেই, তবে চারদিকে বৃষ্টির পানির ছড়াছড়ি,বৃষ্টির পরের শীতল পরিবেশ মনকে আরো সতেজ করে তুললে।আরশিয়া রিকশায় বসে অর্থির হাত জড়িয়ে বলল,
“এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কি হতে পারে বল।

অর্থি দুষ্টু হেসে দাঁত বাহির করে বলল,

“এর চেয়ে সুন্দর অনুভূতি তখন হবে,যখন পাশে আমার বদলে ভাইয়া থাকবে।

আরশিয়া ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকালো। কপালে ভাজ ফেলে বলল,

“কোন ভাইয়া?কে ভাইয়া?”

“তোর ভবিষ্যৎ জামাই রিহান ভাইয়াও হতে প…..
বলতে গিয়েও আরশিয়ার চোখ পাকানো দেখে থেমে যায়।ভয়ে কথা পাল্টাতে বলে,

“যেকেউ হতে পারে হে হে।
আরশিয়া ওর মুখ দেখে হেসে উঠলো। অর্থিও হাসলো সাথে। এমন শীতল পরিবেশে মিশে গেলো হৃদয়ের কুর্ণিসে।
এভাবে কেটে গেলো সময়। বৃষ্টি ভেজা শহর ঘুরলো,খেলো পছন্দের ফুঁচকা,আইসক্রিম। সবশেষে এবার বাসায় ফেরার পালা। সন্ধ্যে নেমে এসেছে ধরণীতে।
আবারো রিকশায় করে ফিরছে দুজনে।হঠাৎ আরশিয়ার চোখ আঁটকে যায় কিছুতে। অর্থির হাত ঝাকিয়ে বলে,

“এটা রিহান না?”

অর্থি রাস্তার ডানপাশে তাকালে।হ্যাঁ রিহান ভাইয়াই তো।
রাস্তার পাশে কাঁদা পানিতে লেপ্টে আছে রিহানের গাঁ।
সে ছোট একটা বাচ্চাকে ধরে আছে। আর একটা বাইক ওয়ালাকে রেগে কি যেমন বলছে।রিকশা ছুটে চলেছে শেষ পর্যন্ত আরশিয়া পিছনে তাকিয়ে দেখলো।শেষে দেখতে পেলো রিহান বসে ছেলেটার গা থেকে কাঁদা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে আর কিছু বলছে। পরে ছেলেটির হাত ধরে নিয়ে গেলো কেথাও।
কিছু শুনতে না পেলেও ঘটনা দেখে বুঝতে ঠিকই পারলো কি হতে পারে। অর্থি কিছু বলছে কিন্তু আরশিয়ার তাতে মন নেই।
তাদের ভার্সিটি পেরিয়ে অনেকটা দূরের একটি গলি থেকে হলো তিনটে মেয়ে আর একটা ছেলে।
অর্থি দেখতে পেয়ে আরশিয়াকে দেখালো।
এটা তো ফারিয়া আর একটা তাদের ভার্সিটির সম্ভবত চেনা চেনা লাগছে, আরেক জনকে চিনেনা। তারা ওদের এমন গলিতে ভার্সিটির ব্যাগ কাঁধে দেখে অবাক হলো। তার চেয়ে বেশি অবাক হলো যখন দেখলো তাদের পাশের ছেলেটা সেই বাজে ছেলে যে আরশিয়ার সাথে ধাক্কা লেগে বাজে কথা বলেছিলে।

“এরা ওই লোকটার সাথে এখন এখানে কি করছে? ভার্সিটি সেই কবে শেষ হয়েছে। তাদের ভাবভঙ্গি কেমন, লোকটা বারবার দূর থেকে মেয়েগুলোকে কিছু একটা বলছে।কিছু একটা জটিলতা তো আছে।”

চলবে………..?