প্রেমাঙ্গন পর্ব-০৯

0
21

#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
পর্ব:৯

সকালের আলো ফুটেছে।চারদিকে কেমম সতেজ নির্মল বাতাসে হাসছে প্রকৃতি।বর্ষা প্রায় শেষের দিকে। এই দু’দিন থেকে আর বৃষ্টি হয় না।আজকের দিনটায় না হলেও আরো বেশি ভালো হয়।পরিবেশ দেখেও বুঝা যাচ্ছে আজ বৃষ্টি হবে না তবে আবহাওয়ার বিশ্বাস নেই। মুহূর্তে বদলে যেতে পারে,ঘনিয়ে আসতে পারে অঁধার।
আরশিয়া আজ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়লো।দেখতে দেখতে আজ সোমবার ভার্সিটির বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান এসে পড়লো।এই কয়দিন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সাথে রিহানের জ্বালাতনে সে অস্থির।
তবে এর মধ্যে ঘটেছিলো আরেক ঘটনা সেদিন রিকশা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ ওড়না ঢুকে যাচ্ছিলো রিকশায় চাকায়।আরশিয়া দেখতে পায়নি।রিহান হঠাৎ চিল্লিয়ে ডেকে উঠে। আরশিয়া শুনতে পায়নি সে তো ব্যস্ত ফোনে কথা বলতে।ওড়নার এক কোন চাকায় ঢুকে গেছে সবে। আরশিয়া গলার যখন টান পেল সে হকচকিয়ে গেলো।রিহান ততক্ষণে বাইক নিয়ে এসে ওড়না টেনে ফেলে দেয় কারণ ততক্ষণে ঢুকে গেছে ফেলে না দিলে সে নিজে পড়তো। একট দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারলো। কিছুটা ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছিলো এক মুহূর্তের জন্য। আরশিয়া সেদিন কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলো রিহান কে। তবে এর আগে লক্ষ্য করেছিলো মিহির কে তা জিজ্ঞেস করেছিলো কিন্তু বলেনি দেখে মুখ গোমড়া করে থাকতো।আরশিয়া সেসব পাত্তা দেয়নি প্রথমে।

অতিবাহিত হলো সময়।আরশিয়া গোসল সেরে চুল মেলেছে ফ্যানের নিচে।তাড়াতাড়ি শুকাতে হবে তার পর রেডি হবে। আজকে সবাই শাড়ি পরবে বিশেষ করে তাদের পরতে হবে।তাছাড়া অর্থি তাকে না পরলে ছাড়বে না। বেশ ঘন কালো লম্বা চুল হওয়াতে তাড়াতাড়ি শুকাতে চায় না। চাইলে হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করতে পারে কিন্তু সে করে না। চুলের সুন্দর অবস্থা নষ্ট করে তার ওই যন্ত্র। একটুর পর আনজুমা চৌধুরী আসলেন শাড়ি হাতে।
আরশিয়া দেখলো একখানা গোলাপি রঙের শাড়ি।আরশিয়া জিজ্ঞেস করলো,

“এটা কবে কিনলে?আমি তো দেখিনি।”

“কয়েকদিন আগে মার্কেটে গেছিলাম তখন কিনেছিলাম।তুই রেডি হয়ে নে।”

সে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। হয়তো কিনেছে সে দেখেনি। মা’কে রাখতে বললো। চুল শুকালে শাড়ি পড়বে। সময় আছে এখনো অনেকটা, দুটোর দিকে পৌঁছালেই হবে।অনুষ্ঠান শুরু হবে তিনটে থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।

প্রায় ত্রিশ মিনিট চুল শুকালো। যদিও ভেতরে চুলের গোড়ার দিকে একটু করে ভেজা আছে কিন্তু এখন সময় নেই। দায়িত্ব পালন করতে তাড়াতাড়ি যেতে হবে,সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে হবে, সামলাতে হবে সব

আরশিয়া শাড়ি পরার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবে। ব্লাউজ, পেটিকোট পরে শাড়ি জড়াতে যাচ্ছে।
অর্থি তখনই আসলো।পরনে তার মেরুন রঙের শাড়ি,হাতে ম্যাচিং কাঁচের চুড়ি,আর ঠোঁটে লিপস্টিক সব মিলিয়ে মাশাল্লাহ।আরশিয়ার চোখ গেলো তারই দিকে।সে হাসলো।

“অসম্ভব সুন্দর লাগছে তোকে।

অর্থি লজ্জা পেলো,হেসে বলল,

“মিথ্যে প্রশংসা করতে হবে না। আমি জানি আমায় ওতো ভালো লাগছে না।

“আম্মু বলো তো ওকে সুন্দর লাগছে না? আমি কি মিথ্যে বলছি?

আনজুমা চৌধুরী হাসলেন।অর্থির দিকে তাকিয়ে বলল,

”হ্যাঁ মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর লাগছে।”

অর্থি বোধহয় এবার লজ্জা পেল।মাথা নিচু করে নিলো।রনিত আসার সময় কল দিয়েছিলো তাকে দেখার অপেক্ষায় সেও নাকি অধীর আগ্রহে বসে আছে।মা দেখেও বলেছে তার হৃদয়ের রাজ্যের রাজরানি লাগবে।সে এবার ভাবা বাদ দিয়ে আরশিয়াকে শাড়ি পরতে হেল্প করলো।কুঁচি ঠিক করে দিতে দিতে বলল,

“বিয়েটা করলে আজ এই মুহূর্তটা কত রোমান্টিক হতো।ভাইয়া শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিতো তার পর…

তুই থামবি?
আরশিয়া রাগের ভান ধরে থাকা চোখ দেখে হাসলো।তখনই ফোন বেজে উঠলো। অর্থির পাশে ফোন থাকায় দেখতে পেলো।ফোনের স্কিনে ভেসে উঠেছে মিহির নামটা।সে ভ্রু কুঁচকালো।আশরিয়া তখনি ফোন তুলে নিলো।

তিরতির করে যেন রোদ বাড়ছে।এতোদিন বৃষ্টি হয়ে হয়ে মানুষ কে অতিষ্ঠ করলো আর আজ গ্রীষ্মের দুপুরের মতো কড়া রোদ উঠেছে। সময়টা তখন দুপুরের পরই।
রিকশা থেকে আরশিয়া আর অর্থি নামলো।গরমে তাদের অবস্থা শেষ তার মধ্যে শাড়ি পরায় ঘেমে একাকার অবস্থা। আরশিয়া এই রোদে বিরক্ত হলো, “এতো কড়া রোদ আজই হতে হলো?বিরক্তি নি পা বাড়ালো তারা দুজনে।

ভার্সিটির গেট পেরোতেই অন্যরকম এক আমেজ।
আজ যেনো চেনা ভার্সিটি অচেনা রূপে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে ঝলমলে সাজসজ্জা, প্রতিটি ভবনের দেয়ালে নববধূর ন্যায় সাঁজ। ভার্সিটির আঙ্গিনায় রঙিন আলপনা, গেট থেকে শুরু করে প্রতিটি কোনায় টাঙানো রঙিন বাতি আর ফেস্টুন। রাস্তার দুপাশে ঝুলছে ব্যানার আর ব্যানারে লেখা-
“বার্ষিক বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান – আমাদের স্বপ্ন, আমাদের উৎসব।”

মাঠজুড়ে সাজানো স্টেজ। লাল কার্পেটে ঢাকা পুরো মঞ্চ, পেছনে বড় বড় লাইটিং, ফুলের মালা দিয়ে সাজানো ব্যাকড্রপ। চেয়ারগুলো একটার পর একটা সুন্দরভাবে বসানো।পাশে সাজসজ্জার জন্য আলাদা সেকশন তৈরি করা হয়েছে।
কেউ ব্যস্ত সাউন্ড সিস্টেম ঠিক করতে, কেউ মাইক চেক করছে, কেউ বা ডেকোরেশনের শেষ কাজটুকু সারছে।

আরশিয়া আর অর্থি ভেতরে ঢুকতেই সবাই তাকালো। গোলাপি শাড়িতে আজ অন্যরকম লাগছিলো আরশিয়াকে। একেবারে যেনো একটা ফুলের মতো। পাশে মেরুন শাড়িতে অর্থিও কম যায় না। দুজনকে একসাথে দেখে একদম ঝলমলে লাগছিলো।

রিহান তখন বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। তার চোখ হঠাৎই গিয়ে আটলো আরশিয়ার দিকে। এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেলো, যেনো সময় থেমে গেছে। চশমার কাঁচের ভেতর দিয়েও সেই চোখের দৃষ্টি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। সানগ্লাসটা চোখ থেকে খুলে মুগ্ধ হয়ে তাকালো। কিন্তু তার মুগ্ধতা বেশি সময় টিকলো না।হুট করে তার হাসি উবে গেলো। কারণ সেই সময়েই মিহির এসে দাঁড়ালো আরশিয়ার পাশে।
ডাকলো তাকে।আরশিয়া ঘুরে তাকালো।

“আরেহ আপনি এতো তাড়াতাড়ি আসলেন?ভাবলাম আরো পরে আসবেন। আপনি ব্যস্ত মানুষ। আরো টুকটাক কথা চললো। রিহান কেবল তাকিয়ে রইলো। কথা শুনতে না পেলেও আরশিয়ার ছেলেটার হেসে কথা বলে দেখে ওর গা জ্বলে গেলো। রেগে লাথি মারলো মাটিতে পড়া থাকা স্পিড ক্যান এর উপরে। সেটি ছিটকে গেলো কিছু দূরে। সাহিল আর অভিষেক তার দৃষ্টি লক্ষ্য করে আসল কারণ বুঝতে পারলো। রনিতের সেদিকে নজর নেই। সে তো তার প্রিয়তমা কে দেখতে ব্যস্ত। অভিক কোথা থেকে এসে রিহান কে বলল,” চল ওদিকে একটা সমস্যা হয়েছে।
রিহান প্রথমে শোনেনি। রাগে আর চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। অভিক আবার বলতে সে শুনলো, কোনো কথা না বলে ওর সাথে হনহনিয়ে চলে গেলো।

“তুমি একেবারে প্রিন্সেস লাগছো আজ। সত্যি দারুণ।

মিহিরের আরশিয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কথা বলার আগেই রিহান পাশ থেকে এগিয়ে এসে হালকা ঠাণ্ডা স্বরে বললো,
“সময়টা নষ্ট কোরো না। আরশিয়া, তোমার দায়িত্বের জায়গায় গিয়ে দাঁড়াও। প্রোগ্রাম শুরু হতে যাচ্ছে।”

মিহির একটু বিরক্ত হলো, কিন্তু কিছু বললো না।
রিহানের তার দিকে কড়া দৃষ্টি লক্ষ্য করলে তবে বুঝতে পারলো না কেন?

অনুষ্ঠান শুরু হলো জাতীয় সংগীত দিয়ে। তারপর উপাচার্যের বক্তব্য, সিনিয়র শিক্ষকদের স্মৃতিচারণ, সবকিছুতেই একটা উৎসবের আবহ।
এরপর শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—
কেউ নাচছে, কেউ গান গাইছে, কেউ আবৃত্তি করছে। দর্শক সারি হাততালিতে মুখর হয়ে উঠলো।

মাঝে অর্থি আর রনিতের দেখা হলো। রনিত মুগ্ধ চোখে অর্থির দিকে তাকিয়ে ছিলো, অর্থি শুধু লাজুক হাসি দিয়ে নিচে তাকিয়ে ছিলো।

অন্যদিকে রিহান আরশিয়া দায়িত্ব সামলাতে ব্যস্ত থাকলেও, বারবার তার চোখ চলে যাচ্ছিলো মঞ্চের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দৃষ্টি আরশিয়ার দিকে।
রিহান এবার আরশিয়ার কাছে এসে কিছুটা রেগে বললো, ” ওই ছেলে কে?কি সম্পর্ক তার সাথে?

আরশিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
“কেন বলুন তো? সে যেই হোক আপনার কি?”

রিহান আবারো দেখলো মিহির ছেলেটি তাকিয়ে আছে। তার রাগ বাড়লো হাতে থাকা কেঁচিটা রাগে চেপে ধরলো।
কেঁটে গেলো আঙ্গুন রক্ত গড়িয়ে পড়তেই ব্যথা অনুভব করতেই একটু শব্দ করে উঠলো। আরশিয়া দেখে এগিয়ে গেলো। রিহান তার এগিয়ে আসা দেখে হনহনিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো,

“আমার কিছু না। তোমার ও কিছু না হোক।
আরশিয়া তার দিকে তাকিয়ে রইলো তার পর তাকালো মাটিতে পড়ে থাকে তাজা রক্ত গুলোর দিকে। পাশ থেকে কেউ একজন তাকলো। আরশিয়া ছুটলো সে
দিকেই

অবশেষে অনুষ্ঠান শেষ হলো। আরশিয়া হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তবে শাড়ি পরে প্রচুর গরম লাগছে। মনে হচ্ছে কখন শাড়ি ছাড়তে পারবে আর শান্তি পাবে।অর্থি এসে দাঁড়ালো তারই পাশে। সে জানালো রাত হয়েছে তাই রনিত বাসায় পৌঁছে দিবে। আরশিয়া একা যাবে রাত খুব একটা বেশি হয়নি আটটা বেজেছে। অর্থি চলে গেলো আরশিয়া দাঁড়িয়ে রইলো। আশে পাশে রিহান কে খুঁজলো বোধহয়। কিন্তু দেখতে পেলো না। সেই সময়ের পর রিহান কে আর খুব একটা দেখতে পায়নি।আর পেলেও অনেকটা দূরে ছিলো মুখ ভার করে। আরশিয়া হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো। তার পর কিছু একটা ভেবে আশরাফ চৌধুরী কে ফোন করল। তিনি জানালো এখনো অফিসে আছে।তাই আরশিয়া আর কিছু বললো না। গাড়ি পাঠাতে চাইলে আরশিয়া না বললো।

সে বাসার যাওয়ার জন্য গেইটের দিকে যেতে নিচ্ছিলো। তখনই কারো ফিসফিস কন্ঠে পা থেমে যায়। আশে পাশে কেউ নেই। সে একটু বাম পাশে এগিয়ে গেলো, বুঝার চেষ্টা করলো কোথা থেকে আসছে কন্ঠ?দেওয়ালের ওপাশ থেকে কন্ঠ আসছে বুঝতে পেরে কান পাতলো দেওয়ালে। শুনতে পেল শুধু, ” আজ অনুষ্ঠান ছিলো এজন্য কাজ হয়নি। কাল ভার্সিটি বন্ধ পরশু আসবো। তার পর আর কিছু শুনতে পেলো না। কার কন্ঠ ঠিক বুঝতে পারলো না।কে দেখার জন্য সে ওপাশে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে কেউ তার হাত টেনে ধরে,অন্ধকারে সে হকচকিয়ে গেলো,ভয় পেলো।এই দিকটায় মানুষ কম,লাইটিং নেই বললেও চলে।

চলবে……………….?