#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
পর্ব:১১
মধ্যরাত।
নিস্তব্ধ শহর ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। আকাশের কোণে আধো আলো-আধো আঁধার চাঁদ, চারপাশে গুমোট নীরবতা। জানালার বাইরে কেবল মাঝে মাঝে ভেসে আসছে কুকুরের ডাকে ফাঁকা পথের প্রতিধ্বনি।
রিহান বিছানায় শুয়ে আছে, কিন্তু চোখে ঘুম নেই। এপাশ-ওপাশ করছে বারবার। বুকের ভেতর জমে থাকা হাহাকার, নদীর পাড়ের সেই অস্বীকৃত মুহূর্ত বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
আরশিয়ার নির্লিপ্ত “বাসায় যাবো” এই কথাটা যেন তার কানে কাঁটার মতো বিঁধে আছে।
মোবাইল ফোন টেবিলের উপর পড়ে আছে, কিন্তু তার হাত এগোয় না। স্ক্রিনের আলো জ্বলছে, নিভছে বন্ধুদের কল, মেসেজ, সবকিছু উপেক্ষা করছে। বুকের বামপাশে যেন একটা ভারী পাথর চেপে বসেছে।
চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে নদীর ধারে চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা আরশিয়ার অবয়ব। মনে হয় কাছে গিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে বলতে, “আমাকে ফিরিয়ে দিও না।” কিন্তু বাস্তবতা নির্মম। সে জানে, আরশিয়া তার জন্য নয়।
ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে থাকে। রাত পেরিয়ে ভোর হয়। তবুও রিহানের চোখে একফোঁটা ঘুম নেই।নিশাচর পাখির মতো জেগে রইলো। ছটফট করে রাত্রি কাঁটলো। চোখ গুলো জ্বলছে। হুট করে কারো জন্য হৃদয়ে অনুভূতির জায়গা হলে, অপর ব্যক্তি না চাইলে তখন মানুষ ভেঙে পড়ে। সাময়িকভাবে মনে হতে থাকে সে ছাড়া জীবন অচল। যদিও কাউকে ছাড়া জীবন থেমে থাকে না কিন্তু সেই সময়টাতে তেমনই মনে হয়।
সকাল।
ডাইনিং টেবিলে সবাই বসেছে নাশতা খেতে। রিহান চুপচাপ এসে বসে পড়ে। কারো দিকে তাকাচ্ছে না, কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছে না। শুধু যান্ত্রিকভাবে খাবার মুখে নিচ্ছে।
ইভা, নীহারিকা, নাবিল সবাই মজা করার মতো কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু তার নির্লিপ্ততা দেখে আর এগোয়নি।
খাওয়া শেষ করেই উঠে পড়লো। সবার চোখে তার অবসন্নতা ধরা দিলেও, কেউ কিছু বললো না।
বন্ধুরা ফোন করছে একের পর এক। স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠছে রিহান কেবল তাকাচ্ছে, ধরছে না। ফোনটা সাইলেন্টে দিয়ে বালিশের নিচে ফেলে দিয়েছে।
রুমে দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো। দুপুর গড়িয়ে গেলো, সময় যেন থমকে গেছে। কিছু ভালো লাগছে না। বিছানা থেকে উঠে ফোনের স্কিনে কালকের তোলা আরশিয়ার শাড়ি পরিহিত ছবিখানার দিকে চেয়ে রইলো। কালকে যখন আরশিয়া অর্থির সাথে কথা বলছিলো তখনই দূর থেকে তুলেছিলো। সেই ছবিটা দেখার সময়ই চোখে পড়লো ছবির এক কোনে দূরে আরেকজনের ছবি দেখা যাচ্ছে। রিহান ফোনটা ছুড়ে মারলো। সবখানে অসহ্যের মধ্যে আরো অসহ্যকর মনে হলো। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশ রুমে গেলো।
বিকেল গড়াতে তারেক মির্জা এসে দরজায় নক করলেন। সাথে সায়মা মির্জা বাহির থেকে বলল,
“রিহান, তৈরি হয়ে নাও। আজ সন্ধ্যায় একটা জায়গায় যেতে হবে। মেয়ে দেখতে।”
সায়মা মির্জাও মৃদু হাসি দিয়ে যোগ করলেন,
“এখন আর দেরি করলে চলবে না। সময় হয়েছে।”
রিহান কিছুক্ষণ নীরব রইলো। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে দৃঢ় গলায় বললো,
“আমি কোথাও যাবো না।পারলে আরশিয়া কে এনে দাও।
তারেক মির্জা ছেলের কথায় অপ্রস্তুত হলো। এমন কথা আগে কখনো বলেনি তার সামনে। সায়মা মির্জা কেবল মুখ টিপে হাসলো।ছেলে তার পাগল হয়েছে।
দরজায় শত নক করেও খুললো না।
শেষে সায়মা মির্জা না পেরে কাউকে কে কল করে কিছু বলে।
রিহানের ফোনে কল আসে।
বন্ধুরা কেউ হয়তো তাই আর চাইলো না।
পর পর কল দিতেই আছে দেখে বিরক্ত হয়ে নাম্বার না দেখেই ধরলো
“হ্যালো?”
“কতক্ষণ থেকে কল দিচ্ছি কি করছিলেন?প্রেমিকাকে চিঠি লিখছিলেন নাকি?বিরহে পুড়ে দেবদাস হয়ে পড়ে আছেন?
রিহান চমকে উঠলো। অপরিচিত কন্ঠ শুনে অবাক হলো।সে কি ভুল শুনছে? নাম্বার চেক করতে কান থেকে নামিয়ে দেখলো না ঠিকই দেখছে।
অবাক হয়ে তার প্রশ্নের উত্তর দিলো,
“দেবদাস তো হতে চাইনি,কিন্তু এখন বাপ্পারাজ হয়ে গেছি।”
আরশিয়া ওপাশ থেকে হাসলো তার পর রাগের ভান ধরে কড়া গলায় বলল,
“তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আসেন, নয়তো সত্যি বাপ্পারাজের মতো বলতে হবে‘ আংকেল বাড়ি এতো সাজানো কেন?আরশিয়া কোথাই?
আব্বু তখন বলবে,” আরশিয়ার তো বিয়ে হয়েছে গেছে বাবা।
আপনি তখন বলবেন,“না আমি বিশ্বাস করিনাাাাা।
রিহান ভ্রু কুঁচকালো।এপাশ থেকেও আরশিয়া হেয়ালি হাসির শব্দ শুনতে পেলো। আরশিয়া আবার বলল,
“বাপ্পারাজের মতো হতে না চাইলে এখুনি রেডি হয়ে চলে আসুন।
রিহান হিসাব মেলানোর চেষ্টা করলো। বুঝতে পেরে বলল,“ তার মানে কি?”
“জ্বী হ্যাঁ যা বুঝেছেন তাই।তাড়াতাড়ি আসুন নয়তো হেনার মতো চলে যাবো।”
“এ্যাই না,না আসছি পাঁচ মিনিট।ডানা থাকলে তো এখুনি উড়ে যেতাম।
আরশিয়ার হাসি থামছে না। ফোন রাখতেই অর্থি বলে উঠলো,
“অবশেষে প্রিয়তমা বুঝলো প্রিয়তমের ভালোবাসা। ঝগড়া থেকে শুরু করে আজ তাদের শুভ পরিনয় হতে যাচ্ছে।
আরশিয়া কেবল হাসলো। মনে করলো সেই দিনের কথা।
আসলেই সময় কত দ্রুত যায়,না চাইতেও হুট করে অনুভূতি জন্মায়।
হয়তো অপর পাশের মানুষটার পাগলামিতে, নয়তো যত্ন আর ভালোবাসার খেয়ায়।
সে কি ভালোবাসে? হয়তো না তবে কিছু একটা অনুভূতি তো আছে, যা কারণে তার এই সিদ্ধান্ত।
ভালোবাসা না হয় ধীরে ধীরে হবে,এক সাথে চলতে গিয়ে আবারো প্রেমে পড়বে।
“আপনি কোথায়?আসবেন তো?আমি কিন্তু সব বুঝিয়ে বলেছি। জীবনে তাকেই বেছে নিবেন যে আপনাকে ভালোবাসে। আপনি হয়তো আমাকে পছন্দ করেন তেমন অনুভূতিও আছে কিন্তু আমার তো নেই। কখনো ভাবিনিও কিছু অথচ তার সাথে ঝগড়া ঝামেলা করেও কিছু অনুভব বুঝতে পারি উনার আমার প্রতি ভালোবাসার মেহনতী। আপনি নীলা কে হ্যাঁ বলুন সে আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। আপনাকে বলতে পারেনি কারঙ আপনি তার কাছে আমার কথা বলেছিলেন বলে।
সে আপনার ভালো বন্ধু এবং বন্ধু থেকে ভালো স্ত্রী হতে পারবে। বন্ধু, বউ এক সাথে দুটো পাওয়া কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার। সে আপনাকে বন্ধু হয়ে বুঝবে, অর্ধাঙ্গিনী হয়ে আগলে রাখবে,ভালোবাসবে। জানেন না সামান্য কয়দিনের একপক্ষিক ভালোবাসা কিংবা ভালোলাগা না পাওয়ার ব্যথা।তবে নীলা তো আপনাকে ভালোবাসে দুই বছর হতে তবে আপনি বুঝতে পারেননি। তার কষ্ট আপনার থেকেও বেশি। বন্ধু হিসাবে বলি তাকে ভালোবাসিন,আঁকড়ে ধরুন এবং তাকে আজকে জানাবেন,আর অবশ্যই তাকে নিয়ে আসবেন এখানে।
আরশিয়া কল রাখলো। হেসে উঠলো আেন মনে। মনে পড়লো সেদিন নীলা মেয়েটা এসেছিলো।কিভাবে যেন ঠিকানা যোগাড় করেছিলো জানা নেই। এসে বলেছিলো তাকে এইসব কথা। মেয়েটা ভীষণ ভালো তার সুখের জন্য আমাকে রাজি হতে বলেছিলো। এজন্য হয়তো বলে, ভালোবাসা মানুষ কে উদার হতে শেখায়,দুঃখ পেলেও ভালোবাসার মানুষের সুখের কথা ভাবে। মিহির কে কালকে ভার্সিটিতে সব বলেছিলো তার পর শুনে সে চুপচাপ বেরিয়ে এসেছিলো শেষে।
মিহির কান থেকে ফোন নামিয়ে হাঁটা ধরলো। পা হঠাৎ থেমে গেলো, কানে এলো হাসির শব্দ। তাকালো সোজাসুজি হসপিটালের এক কেবিনের দিকে। নীলা একটি বাচ্চা রোগীর সাথে হেঁসে কথা বলছে। মেয়েটা হাসির মতো স্নিগ্ধ আর সুন্দর, হসপিটালে জয়েন হওয়ার পর তার সাথে পরিচয়। কথা বলতে,বলতে বন্ধু হয়ে গেছিলো,একে অপরের সাথে অনেক ক্লোজ। তাই তো সে আরশিয়ার কথা বলেছিলো। তবে সে জানতো না নীলার মনের মধ্যে তার জন্য অনুভূতি আছে। দাঁড়িয়ে আনমনে ভাবছিলো তখনই,
“এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন?”
নীলার কথায় হকচকিয়ে গেলো। ওর দিকে তাকালো ওষ্ঠপুটে এখনো স্নিগ্ধ হাসি রয়েছে। মিহির ইশারায় ওর সাথে আসতে বললো।দুজনে পাশাপাশি পা চলছে। নিরবতা ভেঙে সামনের দিকে তাকিয়ে মিহির বলল,
“সন্ধ্যার পর ডিউটি আছে?
‘হ্যাঁ আছে আবার নেই এমনই।
“ কোনোভাবে মেনেজ করে সন্ধ্যার পর আমার সাথে একটু বেরোতে পারবে?”
নীলা ব্যাগ থেকে ফোন বাহির করছিলো। হঠাৎ এমন কথা শুনে তাকালো। জানতে চাইলো, “কেন?কোনো দরকার? ”
“হুম।
“কি দরকার?
“এতো প্রশ্নের উত্তর এখানে দেওয়ার হলে তো দিতামই।
নীলা বুঝতে পারলো সে বিরক্ত হচ্ছে। তার তো ভীষণ ইচ্ছে রাতের শহর ঘুরবে মিহিরের সাথে কিন্তু তা কি সম্ভব?তার মনে অন্য কেউ আর আমার মনে সে।
কি অদ্ভুত না? আমরা তাকেই ভালোবাসি যারা আমাদের ভালোবাসে না। মিহিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,”ঠিক আছে যাবো।
নীলা ডাক আসলো। বাম পাশ থেকে কেউ ডাকলো।
“আসছি”
“নীল শাড়ি পরে এসো নীলা।
নীলা পা থেমে যায়। সে কি ভুল শুনলো?তাকে শাড়ী পরতে বলছে? কিন্তু এমন পরিবর্তন কিভাবে?
“কি বললেন?
মিহির শান্ত চোখে তাকালো। বলল,
“নীল শাড়ি পরতে বলেছি। আজ একজনের ওয়েডিংয়ে যাবো।
মিহির তাকে সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছে কারো ওয়েডিংয়ে?কিন্তু কার?প্রশ্ন চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
“কার ওয়েডিং?”
“আরশিয়ার।
নীলা অবাক হলো।খানিকটা থম মেরে রইলো যেন।
আরশিয়া ওয়েডিং কার সাথে? তাই সে এতো নিশ্চুপ? যাকে ভালোবাসতে চাইলো তার অন্য কারো হয়ে যাওয়া দেখতে যাবে? প্রশ্ন গুলো আর করা হলো না। মিহির ততক্ষণে চলে গেছে। নীলার মনে প্রশ্ন খেলা করলেও মনের কোনো কোথাও একটা ভালোলাগা বাতাস বইলো।
মানুষ হারানোর ভার টা একটু কমে এলো বলে মনে হলো।
ঠোঁটের কোনে আরেকটু গাঢ় হাসির দেখা মিললো।
সন্ধ্যা নামতেই রিহান সাদা পাঞ্জাবি পরে তার বন্ধু নিয়ে হাজির হলো আরশিয়াদের বাসার সামনে। পরিবারের লোকজন আগেই এসেছে। কি একটা অবস্থা যে জামাই তাকে রেখে এসেছে তারা কি সাংঘাতিক তাই না?
রনিতের কথায় অভিষেক ফোঁড়ন কাঁটলো, বলল,” তোর মতো নিলজ্জ নয় রিহান, তার ধৈর্য আছে।
রণিত হা হয়ে গেলো।বলল,
“ও ধৈর্যশীল?র্নিলজ্জ নয়?আল্লাহ আমারে তুলে নেও।
ওর আমার চেয়েও বেশি র্নিলজ্জা। বিশ্বাস না হলে আন্টিকে জিজ্ঞেস কর। রিহান ওর দিকে তাকাতেই ভয়ে সামনে হাঁটা দিলো। তা দেখে রিহান হেসে উঠলো। কথা বলতে,বলতে ভেতরে আসলো।
পরিবেশটা খুব বেশি সাজসজ্জা করা নয়, একেবারে পারিবারিক আর সাদামাটা। তেমন কেউ নেই। এমনিতে আরশিয়ার চাচা খালা কেউ নেই এজন্য তেমন আত্নীয় নেই, শুধু অর্থি ওর মা বাবা আর দুজন মানুষ।
আরশিয়া মেরুন রঙের একটা শাড়ি পরে বসে আছে।
রিহান আসতেই আরশিয়াকে আলতো ধ্বাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“সাদা পাঞ্জাবিতে রিহান ভাইয়া কে হেব্বি লাগছে দেখ।
আরশিয়া চোখ পাকালো, দাঁত খিঁচে বলল,
“চুপ থাকবি?তোর দেখার হলে রনিত ভাইয়া কে দেখ।
“দেখছিই তো। আমার মহারাজাকেও হেব্বি লাগছে।
“ওরে ঢং রে।
ওদের কথার মাঝে রিহান ওর মায়ের পাশে আরশিয়ার সামনাসামনি সোফায় বসলো। দৃষ্টি তার আরশিয়ার দিকেই। আরশিয়া একবারো তাকায়নি সে মাথা নিচু করে আছে।
এই সময় দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। দরজা খোলা থাকার কারণে কেউ গেলো না শুধু তাকালো সকলে। নীলাকে পাশে নিয়ে ভেতরে ঢোকে মিহির। তাদের একসাথে দেখে আরশিয়া হালকা মুচকি হাসে। রিহানের চোখও এক ঝলক যাবে ওদের দিকে, কিন্তু কোনো কথা না বলে আবার আপন মনে বসে থাকে।
সবাই আসলে খুশির আবহে ঠিক করা হয় আংটি পরানোর মুহূর্তটা। প্রথমে আরশিয়ার হাতে রিহান আংটি পরায়, প্রথম হাতের ছোঁয়ার অদ্ভুত অনুভূতি হয়।
তারপর রিহানের আঙুলে আরশিয়া আংটি পরিয়ে দেয়। চারপাশে করতালি আর হালকা উচ্ছ্বাস। মিহির শুষ্ক ঠোঁটে রিহান এবং আরশিয়া দুজনের উদ্দেশ্য বলে উঠলো,
“ কংগ্রাচুলেশনস।”
রিহান ধন্যবাদ জানালো। আরশিয়া নীলার দিকে তাকিয়ে বলল,“ টু ইউ।
নীলা আরশিয়ার দিকে তাকালো। তার টু ইউ বলার কারণ খোঁজার চেষ্টা করলো কিন্তু পেলো না।
সবাই আনন্দে মিষ্টি খাচ্ছে, হাসছে, কেউবা প্রিয় মানুষ কে পাওয়ার আনন্দে শুকরিয়া করছে। নীলা কেবল তাকিয়ে আছে মিহিরের দিকে। মানুষটা নিজেকল শক্ত রেখেও হাসছে কিন্তু ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে সে টের পাচ্ছে। নীলা আরশিয়ার কাছে গেলো কানে কানে কিছু বললো। এবার মিহিরের কাছে আসলো। ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“চলেন।
“কোথাই?”
“ না হওয়ার প্রেমিকার এনগেজমেন্ট হয়ে যাওয়ায় দুঃখ বিলাশ করতে। যাবেন?
মিহির ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কিছু একটা ভেবে বলে উঠলো,
“চলো তবে দুঃখ বিলাশে সঙ্গী হয়ে পাশে পাশে হেঁটো।”
চলবে………….?
#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা: #শ্যামলী_রহমান
পর্ব:১২
রাতের রাজশাহী শহরের রাস্তাগুলো দিনের কোলাহল শেষে যেন এক অন্যরকম শান্ত সৌন্দর্যে ভরে ওঠে। চারদিক জুড়ে হালকা অন্ধকার, কোথাও কোথাও ফিকে হলুদ লাইটপোস্ট গলির মাথায় আলো ফেলে রেখেছে। সেই আলোয় রাস্তাগুলো মনে হয় নরম কুয়াশার পর্দায় ঢাকা। মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে ছোট দোকানগুলোর ঝলমলে সাইনবোর্ড এখনো জ্বলে আছে কেউ চা খাচ্ছে, কেউ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে অলস ভঙ্গিতে।
রাজশাহীর বাতাসে আছে গোধূলির পরের ঠাণ্ডা আমেজ, বিশেষ করে পদ্মার ঘেঁষা হাওয়ায় একটা শীতল স্পর্শ। কোথাও কোথাও ছাত্র-ছাত্রীরা আড্ডা দিচ্ছে, আবার কোনো রাস্তা পুরোপুরি নির্জন শুধু দূরে কুকুরের ডাকে ভাঙছে নিস্তব্ধতা।
এই নীরব শহরের বুক চিরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে একখানা রিকশা। ঘণ্টির টুংটাং শব্দ যেন রাতের নিরবতা ভেঙে নরম সঙ্গীত গায়। দু’জন বসে আছে পাশাপাশি। রিকশার নরম দুলুনিতে এক ধরনের অচেনা স্বস্তি এসে জড়ায়।
পথের দুই ধারে পুরনো গাছের সারি, তাদের ছায়া পড়ে রাস্তায়, বাতাসে পাতা দুলে মৃদু শব্দ তোলে। শহরের হৃদয় শাহ মখদুম মাজারের পাশ দিয়ে গেলে সেখানকার আলো মোমবাতির মতো টিমটিম করে ঝলকায়।
রিকশার হাওয়ায় মেয়েটার ওড়না উড়ে এসে ছেলেটার হাতে ছুঁয়ে যায়, দু’জনেই চুপচাপ, অথচ মনে হয় হাজার কথা ভাসছে নীরবতায়। মিহির নিরবতা ভেঙে বলে উঠলো,
“ খানিকের প্রেমে ভাঙা হৃদয়ে নতুন করে ভালোবাসা বীজ বুনতে পারবে? ভালোবাসতে পারবে সব জেনেও?”
নীলা অনেকটা অবাক হলো। মুগ্ধ চোখে শহর দেখা বাদ দিয়ে তাকালো পাশের সুপুরুষটির দিকে। সবকিছুর উর্ধে তাকে দেখার মতো সুন্দরতম জিনিস আর কিছু নেই।
নীলা জানতে চাইলো,
“ভালোবাসার বীজ বুনতে দিবেন আপনার হৃদয়ে?অনুমতি পেলে বুনতে চাই। সেই কবে থেকে ভালোবাসার ফুল স্ফুটিত হয়ে বীজ হয়ে আছে।
মিহির সযত্নে নীলার শাড়ির আঁচলটা ধরলো। হাতের মুঠোয় নিয়ে বাম হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আঁচলে বেঁধে ফেলো হাত, হৃদয়ে বেঁধো আমারো হৃদয়।
অপেক্ষা করিও একটু সময়, অপেক্ষার প্রহর শেষে পূর্ন ভালোবাসা নিয়ে সামনে দাঁড়াবো, দুহাত মেলে চিৎকার করে বললো সেদিন, ভীষন ভালোবাসি নীলা।”
নীলা হাসলো। চোখে সুখের জল চিকচিক করলো।
অবশেষে না বলা ভালোবাসা প্রকাশ্যে আসলো, স্বপ্ন কে সত্যি করে তাকে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেলো। নীলা শাড়ির আঁচলে হাত না বেঁধে বামহাতটা রাখলো মিহিরের আঙ্গুলের ফাঁকে, শক্ত করে আঁকড়ে ধরে চোখে জল নিয়ে হেঁসে বলল,
“হাতে আঁকড়ে ধরবো হাত, হৃদয়ে হৃদয়, আপনি পাশে থাকলে অপেক্ষা কঠিন কিছু নয়।”
আনন্দে, হইহোল্লড় শেষে খাওয়ার টেবিলে সবাই বসে গেলো। গরম গরম বিরিয়ানি, কাবাব, স্যালাডে ভরে উঠলো টেবিল। হাসাহাসি, খুনসুটি চললো খাওয়ার সময়ও।
রিহান নির্লিপ্তভাবে খাবার নিচ্ছিলো, তবে চোখ মাঝে মাঝে চলে যাচ্ছিলো আরশিয়ার দিকে। আরশিয়া ও চোখ নামিয়ে নীরবে খাচ্ছিলো, যেন চারপাশের কোলাহলে সে নেই।তার নিজের থেকেও সকলের উচ্ছাস বেশি।
খাওয়া শেষ হলে বড়রা বসলো গল্পে পুরোনো স্মৃতি, নতুন পরিকল্পনা, আত্মীয়তার টানাপোড়েন নিয়ে চলতে থাকলো আলাপচারিতা।
এই সুযোগে ছোটরা, মানে রনিত, অভিষেক,সাহিল অভিক, ইভা, অর্থি,সবাই মিলে হৈচৈ করে ছাঁদে উঠে গেলো।
ছাঁদে গিয়ে শুরু হলো হাসাহাসি। রাতের আকাশে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে, হালকা বাতাস বইছে, ঠিক যেন উৎসবের আবহ।
রনিত মজা করে বলল,
“আরে ভাই, আজকের রাতটা ইতিহাসে লেখা থাকবে। রিহান অবশেষে কুপোকাত।সাদা পাঞ্জাবিতে হিরো, পাশে মেরুন শাড়ির নায়িকা। আহা, কি ম্যাচিং!”
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। অর্থি তো হাততালি দিয়ে বলল,
“ঠিক বলছো,আজকে ভাইয়াকে তো একদম সিনেমার হিরো লাগছে।তবে হিরোইনও কম যায় না।”
অভিক হেসে ফেলে যোগ করলো,
“হিরো-হিরোইন হলে তো আমাদের দুঃখ কম হতো। ওরা দুইজন একসাথে থাকলেই পরিবেশ জমে ওঠে। কখন ঝগড়া, কখন প্রেম আমাদের বোঝা দায়।”
ইভা তাড়াতাড়ি বলল,
“এই জন্যেই তো বলে যাদের বেশি ঝগড়া হয়, তাদের প্রেমও গভীর হয়।”
অভিষেক গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো,
“ভুল! আমি প্রমাণসহ বলতে পারি ঝগড়া প্রেমের মূল শত্রু।”
রনিত সাথে সাথে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“চুপ কর বুড়ো দার্শনিক! প্রেম বুঝিস নাকি তুই? আজ অব্দি প্রেম করেছিস?”
অভিষেক লাজুকভাবে হেসে মাথা চুলকাতে লাগলো। লজ্জা পেলো সবার সামনে। তা দেখে সবাই আবার হো হো করে হেসে উঠলো।
ঠিক তখনই রনিত দুষ্টুমি করে বলে উঠলো,
“বন্ধু এখন বউ পেয়েছে এখন আর কথা বলছে না। দেখ কিভাবে তাকিয়ে আছে।
রিহান চোখ ফেরালো আরশিয়া হাসলো তাদের সাথে।
অভিষেক কিছু বলতে নিলে রনিত থামিয়ে দেয়,“থাক ভাই তোর জ্ঞানী বানী আমাকে শোনাস না। আমি এমনি বকবক করতে পারি কিন্তু মানুষের প্রেমে ব্যগড়া দেইনা। শুধু আমার প্রেম করা হয় না তোদের জ্বালায়। চল সবাই নতুন জুটিকে প্রেম করতে দে।অনেক তো ঝগড়া করেছে এবার প্রেম করুক।
আরশিয়া লজ্জা পেলো।
হবু স্বামীর বন্ধু হলেও তারা ওর সিনিয়র সেটাই আগে আসে। তাদের এনন কথায় লজ্জা লাগছে।
ছাঁদে হইচই শেষে একে একে সবাই নেমে গেলো। হাসি-আড্ডার শব্দ মিলিয়ে গেলো, চারপাশে নেমে এলো নিস্তব্ধতা।
ছাঁদে রয়ে গেলো শুধু দু’জন রিহান আর আরশিয়া।
আকাশে পূর্ণিমার আলো ঝরে পড়ছে। হালকা বাতাস বইছে, কপালের চুলগুলো খেলা করছে।
আরশিয়া হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি তার আকাশের দিকে।
মনে হচ্ছিলো, চাঁদের সাথে কিছু বলতে চাইছে।
অচেনা এক শিহরণে বুক কেঁপে উঠলো যখন হঠাৎ পেছন থেকে কারো উপস্থিতি অনুভব করলো। ধীরে ধীরে ঘুরে তাকাতেই দেখলো
রিহান নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। চোখদুটো মুগ্ধতায় ভরে উঠেছে, যেন সারা দুনিয়ার আলো এসে জমেছে সেই দৃষ্টিতে।
আরশিয়া চোখ সরাতে পারলো না।রিহান তাকিয়ে রইলো। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“এসব কি করে হলো? রাজি ছিলে তাহলে কাল কেন বললে না?”
আরশিয়া হালকা হাসি দিয়ে তাকিয়ে রইলো। সে হাসি আড়াল করার জন্য মুখের উপর হাত রেখেছিলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো তার আরো কাছে।
গলায় নীচু স্বরে বলল,
“কষ্ট দিতে মজা লাগে। না, মজা নয় পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। জানতে চাইছিলাম, কতটা ভালোবাসেন আমাকে।”
রিহান ভ্রু কুঁচকালো, ঠোঁটে ক্ষীণ অভিমান জমলো।
“পরীক্ষা? ভালোবাসারও আবার পরীক্ষা হয় নাকি?”
আরশিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকালো। তারপর তার দিকে ফিরে এসে বলল,
“সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হলো ধৈর্য আর কষ্ট সয়ে পাশে থাকা।আপনি যদি আমাকে ফেলে যেতে পারতেন,তবে জানতাম ভালোবাসাটা ভঙ্গুর। কিন্তু আপনি থেকে গেলেন,আপনার চোখে আমি ভরসা দেখলাম।”
“তাহলে পরীক্ষায় পাশ করেছি তাই রাজি হলে?”
“না। প্রেমে পড়েছিলেন তাই সেঁকা দিয়ে বাপ্পারাজ বানালাম না। দয়া করে ছাড় দিলাম যতই হোক সিনিয়র ভাইয়া।
কথাটুকু বলে আরশিয়া মুখ চেপে হাসলো।রিহান খেয়াল করলো, বুঝতে পারলো মজা করে বলছে।
“প্রেমে পড়েছিলাম আগে বুঝেছিলে?”
“হ্যাঁ কবেই বুঝেছিলাম।
রিহানের চোখে মুখে জানার আগ্রহ। জানতে চাইলো,
“কিভাবে জেনেছিলে?
“হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন মেয়েদের একধরনের তৃতীয় নয়ন থাকে,যার মাধ্যমে তারা মুহূর্তের মধ্যে বুঝে যায় কেউ তার প্রেমে পড়েছে।
রিহান শুনলো। ভাবুক হয়ে জানতে চাইলো,
“তুমি হুমায়ুন আহমেদের বই পড়ো?”
“জ্বী পড়ি। হুমায়ুন আহমেদের লেখা হিমু চরিত্র সবার মতো আমারও পছন্দের।
রিহান ঝট করে বলে বসলো,“ইসস হলুদ পাঞ্জাবি পরলেই হিমু হয়ে যেতাম।
আরশিয়া ঝঙ্কার তুলে হাসলো।কোনো মতো হাসি থামিয়ে বলল,
“হিমু হতে হবে না। কল্পনার চরিত্র কল্পনায় সুন্দর,আপনি তো আমার বাস্তব।”
চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো দু’জনেই। চারপাশে হালকা বাতাস, আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ, রাতের নিস্তব্ধতা যেন তাদের জন্যই সাজানো।
রিহান এক পা এগিয়ে এলো। আরশিয়ার শাড়ির আঁচল টেনে নিলো। আরশিয়া একটু ঘাবড়ালো। তা দেখে হেসে উঠলো। আঁচলটা মেলে ধরে আরশিয়ার মাথায় রাখলো। তার পর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল,
“স্নিগ্ধ রাত, আকাশে সুন্দর চাঁদ,
পাশে আমার প্রিয়তমা, এর চেয়ে অপূর্ব মুহূর্ত কি আর হয়?
ছাঁদে থাকা নয়নতারা ফুলের দিকে তাকিয়ে আবারো বলে উঠলো,
“আমার হৃদয় বাগানে একমাত্র ফুল তুমি,
সকাল,সন্ধ্যের বাতাসে পাওয়া যায়,একমাত্র তুমি নামক ফুলের ঘ্রাণ।
আরশিয়ার কেবল মুগ্ধ হয়ে শুনলো,বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দ করে উঠলো। চাঁদের আলোয় মনে হলো দু’চোখে মনি নয়, যেন আকাশের নক্ষত্রেরা এসে আশ্রয় নিয়েছে।
রিকশা এসে থামলো ছয়তলা বিশিষ্ট বাড়িটির সামনে।
মিহির আগে নেমে পড়লো। তার পর নামলো নীলা।
একটু আগে ফুরফুরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মাত্র বৃষ্টির রেশ যেন বেশি হলো। মিহির রিকশা ওয়ালা কে ভাড়া দিতে দিতে নীলা কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভেতরে যাও ভিজে যাবে।
নীলা গেলো না ওইরকম দাঁড়িয়ে রইলো। মিহিরি ভাড়া মিটিয়ে তাকিয়ে দেখে নীলা দাঁড়িয়ে আছে তারই দিকে তাকিয়ে। অথচ ঝুম বৃষ্টি নামলো মুহূর্তেই অনেকটা ভিজে গেলো। মিহির তাড়া দিয়ে নীলার হাত টেনে আনলো বিল্ডিংয়ের নিচে। বলল,
“কথা শোনোনা কেন?”
নীলা চুপচাপ ভেতরে গেলো। যাওয়ার আগে বললো শুধু, “দুই মিনিট দাঁড়ান আসছি।
মিহির দেখলো সে লিফটের ভেতরে প্রবেশ করলো।
তখন তাকালো রাস্তার পানে।বৃষ্টির পড়ছে টিপটাপ ধ্বনিতে। তখনই নজরে আসলো একটি ছেলে ও মেয়ে রিকশা করে যাচ্ছে। ছেলেটি সাদা পাঞ্জাবি আর মেয়েটি পরেছে কালো শাড়ি। বেশে মানিয়েছে। বৃষ্টিরতে দুজনে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। মেয়েটির হাতে থাকা ফুলটি ছেলেটিকে দিয়ে হাত দুটো মেলে ধরলো।
রিকশা একটু দুলতেই মেয়েটি দুলে উঠলো।ছেলেটি ভয় পেয়ে জাপটে ধরলো যদি পড়ে যায়। সেই ভয় মিশ্রিত চোখ দেখে যেন মেয়েটি ঝঙ্কার তুলে হাসলো। হয়তো তার ভালোবাসার বিশালতা দেখে হাসলো।
“অন্যের ভালোবাসা না দেখে নিজেও তো এমন মুহূর্তে তৈরি করতে পারেন।
মিহির চমকে তাকালো। তার মাথার একজোড়া হাত তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল মুছে দিচ্ছে।নীলা মুখ তুলো চাইলো।বলল,
“কি দেখছেন?ভুল শুনেছেন মনে হচ্ছে?
মিহির মাথা নাড়ালো। যার অর্থ না।
নীলা মাথা মুছে দিয়ে মিহিরের হাতে একটি ছাতা ধরিয়ে দিলো। বলল,
“এখন বাসায় যান।”
বৃষ্টির গতি কিছুটা কমলো। মিহির পা বাড়ালো ছাতা মেলে। কিছুটা যেতেই আবার পিছনে তাকালো। বলল,
“অপেক্ষা করো খুব শিগগিরই আমাদের ও এমন মুহূর্ত হবে।”
চলবে………………?