প্রেমাঙ্গন পর্ব-১৩+১৪

0
21

#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
পর্ব:১৩

বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তায় জমে থাকা পানিতে ছিটকে পড়ছে গাড়ির চাকা, লাইটপোস্টের আলোয় প্রতিফলিত হয়ে উঠছে শহরের অন্যরকম রূপ। মিহির ছাতা মাথায় বাড়ির দিকে হাঁটছে, অথচ মনে পড়ে যাচ্ছে নীলার ভেজা মুখ, চুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলবিন্দু। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক প্রেমময় বাতাসে হৃদয় জমে উঠলো।ভাবলো কেমন হবে সেই প্রতীক্ষিত মুহূর্ত?

অন্যদিকে, নীলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভেজা বাতাস গায়ে মেখে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। মনে হলো বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা তার বুকের ভেতর কাঁপন তুলছে। মিহিরের সেই সংলাপ “খুব শিগগিরই আমাদেরও এমন মুহূর্ত হবে”বারবার কানে বাজতে লাগলো। ঠোঁটে অচেতন এক হাসি ফুটলো, চোখের কোণে জমলো অশ্রুবিন্দু। সুখের জল। অবশেষে সবকিছু স্বপ্নের মতো হচ্ছে। জীবনে কাউকে ভালোবাসলে সাথে সাথে বলে দেওয়া উচিত, নয়তো দেখবেন সময় আসুক পরে বলবো করতে,করতে তার জীবনে অন্য কেউ এসে যাবে।

রিহান আর আরশিয়া তখনো ছাদে। চারপাশ ফাঁকা, কেবল বাতাস আর চাঁদের আলো। আরশিয়া হঠাৎ বললো,

“তুমি জানো? আমি সবসময় ভেবেছি ভালোবাসা হয়তো অনেক ঝলমলে কিছু সিনেমার মতো। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আসলে সেটা খুব নিঃশব্দ, খুব সাধারণ ঠিক এই মুহূর্তটার মতো।”

আরশিয়া মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলো। ফিসফিস করে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, প্রেম কখনো আড়ম্বর চায় না। পাশে থাকাটাই আসল।”

দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। নীরবতার ভেতর যেন হাজারটা কথা বাজতে থাকলো। হঠাৎ বাতাসে আরশিয়ার শাড়ির আঁচল উড়ে গিয়ে রিহানের কাঁধে পড়লো।তারা দুজনে পাশাপাশি ছিলো। রিহান হাত দিয়ে ধরে নরম কণ্ঠে বললো,
“ ভাগ্যও আমাদের একসাথে বাঁধতে চাইছে,বাতাসে বইছে প্রেমের গান,তুমি পাশে আছো বলে মুহূর্তটা লাগছে মৃয়মান।

লজ্জায় আরশিয়া মুখ লাল হয়ে গেলো, আঁচল টেনে নিলো নিজের কাছে। তবে চোখ নামালো না, মৃদু কন্ঠে বললো,

“নীচে চলুন সবাই নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে।কতক্ষণ ধরে আছি নিশ্চিত অন্য কিছু ভাববে।

“ভাবার হলে ভাববে না?সময় হয়েছে তাই যে যা ভাবার ভাবুক তুমি শুধু চুপ থাকো।
আরশিয়া ছাঁদ থেকে হাঁটা দিলো। রিহান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। হাত টেনে ধরলো মাঝ পথেই। আরশিয়া কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। বুঝতে সময় নিলো কি হচ্ছে।
রিহান কোমর পেঁচিয়ে ধরলো। নাকের ডগায় নাক ঘষা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

“এতো তাড়া কেন?ভালো লাগছে না? না লাগলেও কিছু করার নেই। সারাজীবন এই আমার সাথে থাকতে হবে,সংসার করতে হবে,আমার বাচ্চার মা হতে হবে।

আরশিয়ার লজ্জা বাড়লো।কোনো কথা না বলে ছাড়াতে চেষ্টা করলো।রিহান হাত আলগা করলো। আরশিয়া বাঁধন থেকে মুক্তি পেতেই উড়ন্ত পাখির ন্যায় ছুটে চললো।
রিহাম কেবল হেসে উঠলো তার কান্ড দেখে।

মিহিরের ঘরে আলো জ্বলছে। টেবিলে রাখা আছে একটা ডায়েরি। সে কলম হাতে নিয়ে লিখছে,

“নীলা,আজ তোমার চোখে আমি দেখেছি সেই আলো, যে আলো আমার অন্ধকার জীবনে চিরকাল খুঁজেছি। যদি কখনো আমার হাত ছাড়ো, আমি বেঁচে থাকতে পারবো না। তবুও তোমাকে আঁকড়ে ধরা আমার সবচেয়ে বড় সাহস।”

লিখতে লিখতে চোখ বন্ধ করলো। বুকের ভেতর একরাশ শান্তি নেমে এলো।

অন্যদিকে, নীলা নিজের ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। ভিজে চুল মুছে নিচ্ছে। আয়নায় মিহিরের চোখ ভেসে উঠলো। ফিসফিস করে বললো,
“হৃদয়ে বুনে ফেলেছি আপনাকে, মিহির। এখন আপনি ছাড়া এই মন একটুও চলবে না।”

চাঁদের আলো জানালা দিয়ে ভেতরে এসে তাদের দু’জনের কল্পনা, স্বপ্ন আর ভালোবাসার সেতু বেঁধে দিলো।

কেটে গেছে তিনটি দিন।সময়ের পরিবর্তনে পরিবর্তন হয়েছে কতকিছু,যেমন সম্পর্ক,মানুষ, প্রকৃতি, আবহাওয়া এমনকি দায়িত্বও।
আজ ভার্সিটিতে এসেছে আরশিয়া আর অর্থি।
রিহান নিয়ে আসতে চাইলেও সে একাই আসে।যখন একবারে দায়িত্ব পাবে,তখন তার দায়িত্ব নিবে এমনই ভাবনা।প্রথমদিন রিহানের সাথে এসেছিলো তার পর বলেছিলো সে একা আসবে কারণ দুজনের বাসা উল্টোপথে কি দরকার আসার?মাঝে মধ্যে সেটা ঠিকই আছে। তবে প্রেমিক পুরুষের ন্যায় সে জেদ ধরে,আবসর অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নেয়।সেসব মনে পড়তে তার হাসি পেলো।সে কেমন নিব্বিদের মতো হয়ে যাচ্ছে না? তার সাথে কি এমন যায়?প্রেমে পড়লে বোধ-হয় সবাই একটু অবুঝ, বাচ্চামো টাইপের হয়।তাই সে নিজেও তেমনই উপলব্ধি করেছে বলে মনে করলো।

আজ ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে এজন্য আগে আসা।অর্থির ক্লাস তাড়াতাড়ি না থাকলেও আরশিয়ার জন্য আসতে হয়েছে।আরশিয়া আশে পাশে দেখলো রিহান এখনো আসেনি। ক্লাস শুরু হবে দশ মিনিট বাদেই। অর্থি কারো সাথে মেসেজ করছে। আরশিয়া ফোনটা ছো মেরে কেড়ে নিলো।মেসেজ দেখলো না তবে উপরে নামটা দেখে আবার দিয়ে দিলো।বলল,

“বিয়ে করে নে। প্রেমের ভরসা নেই।
প্রেমিক পুরুষের মন মুহূর্তে গলে যেতে পারে সুন্দরী রমনী দেখলে।

অর্থি ফোনটা রেখে হেসে বলল, “ অন্য মেয়ে দেখলে গলে যাবে ওমন প্রেমিক পুরুষ কিংবা জীবনসঙ্গী কোনোটাই আমার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া তুই কেমনে বলছিস এ কথা?

আরশিয়া সময় হতেই তার এক ক্লাসমেট ডাকলো। সে যেতে যেতে বলল,“ জাস্ট মজা করলাম।বাস্তব জীবনে সুখে থাকতে প্রয়োজন একজন সৎ,ব্যক্তিত্বসম্পূর্ণ মানুষ।অনেকে বলতে পারে সৎ আর ব্যক্তিত্বসম্পূর্ণ হলে সুখি হওয়া যায় টাকা লাগে না?অবশ্যই লাগে তবে লাখ,লাখ নয় হাজার,হাজার টাকা দিয়েও সংসার চালানো যায়। কিন্তু অসৎ কিংবা অন্যের প্রতি ঝোঁক এমন মানুষের টাকা থাকলেও সুখী হওয়া যায় না। হয়তো বিলাসিতায় থাকা যায় কিন্তু অসুখে পুড়ে।

অর্থি আজকে তাড়াতাড়ি চলে গেছে।ওর মা হঠাৎ সিঁড়ি থেকে পড়ে আঘাত পেয়েছে এজন্য চলে গেলো।যাওয়ার আগে আরশিয়াকে মেসেজ দিয়ে বলেছে।সে তখন ক্লাসে ছিলো।বাহির হয়ে মেসেজ দেখলো তার পর আশে পাশে আবারো কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে খুঁজলো।
রনিত,অভিষেক,সাহিল আর অভিক কে দেখে এগিয়ে গেলো।আরশিয়া কে দেখে ওরা চারজনে সালাম দিলো,সাথে ভাবি সম্মোধন ও করলো।
আরশিয়ার লজ্জা লাগলো,বলল,

“ভাইয়া আপনারা আমায় নাম ধরে ডাকলেই খুশি হবো।আমি আপনাদের ছোট ভাবি বললে আমার সরম লাগে।

অভিক বলল,

“ঠিক আছে। এখন বলো কাকে খুঁজছো?রিহান কে?

আরশিয়া প্রথমে না বলল তার পর আবার হ্যাঁ বললো।
তার দুমনা কথা শুনে ওরা চারজনে হেসে দিলো।রান ত কোনো মতো হাসি আটকিয়ে বলল,
“জামাই হবে খুঁজতেই পারো, এতে লজ্জার কি আছে?
তোমার জামাই এখনো আসেনি। কল দিলাম ধরলো না মনে হয় আসবে না। তোমার সাথে কথা হয়নি?

আরশিয়া শুনলো। বলল,
“সকালে বলেছিলো তো আসবে তার পর আর কথা হয়নি।

“ওহ আচ্ছা। ওয়েট আমি কল দিই।
অভিষেক কল দিলো কিন্তু ধরলো না। তিনবার না দিয়ে ধরাতে সে আর দিলো না। আরশিয়া বলল,

“থাক আর দিতে হবে না। হয়তো কেনো কাজে ব্যস্ত আছে।আমি পরে কথা বলে নেবো।
বলেই আরশিয়া চলে গেলো। অপেক্ষা করতে লাগলে নেক্সট ক্লাসের জন্য। কিন্তু সেই সময় তার এক ক্লাসমেট বলল একটু পরের ক্লাসটা নাকি হবে না। স্যার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই কাল হবে।
আরশিয়া বিরক্তিকর শ্বাস ফেললো।
এই কড়া দুপুরে এখন বাড়ি ফিরতে হবে। রিহান ও আসেনি। এখন মনে হয় একটু বেশি চোখে হারায় দুদিনেই। বসে থাকতেই চোখ পড়লো ফারিয়ার উপর। আজকেও দুটো মেয়ে কে নিয়ে কিজানি বলছে আর বেরোচ্ছে। আরশিয়া দেখলো মনে মনে ভাবলো, আজকে ওদের পিছু নিবে এন্ড কোথায় যায়,কি করে দেখবে।এই বলে উড়ে পড়লো।ভার্সিটির পিছিন দিক দিয়ে চললো ওদের পিছু পিছু।মাঝে মধ্যে ওরা থামলে আরশিয়া লুকিয়ে পড়ছে। আজকে যেন হারিয়ে না যায় সেভাবে নজর রাখতে হবে।

রিহান ভার্সিটিতে এসে আরশিয়াকে খুঁজছে। তার ক্লাস নেই একজনের থেকে জানলো। লাইব্রেরিতে গেলো সেখানে আছে কিনা দেখতে। কিন্তু না সেখানেও নেই।
লাইব্রেরি থেকে বেরোতে অভিষেকের সাথে দেখা। সে কেবলই ক্লাস শেষ করে বেরোলো। রিহান কে দেখে বলল,

“কাকে খুঁজছিস?আরশিয়া কে?সে তো তোকে একটু আগে খুঁজছিলো।

রিহান বলল,

“হ্যাঁ কিন্তু কোথাও দেখলাম না। বাসায় চলে গেছে নাকি?

“কিজানি। তবে দেখলাম গেইট দিয়ে বেরিয়ে গেলো।

“তোর ফোনটা দে তো। আজকে একটা কাজে আব্বুর সাথে গেছিলাম ভুলে ফোন বাসায় ফেলে এসেছি।

অভিষেক ফোন বাহির করে দিলো।রিহান আরশিয়ার নাম্বারে কল দিলো। রিং হচ্ছে কিন্তু ধরছে না। কয়েকবার দেওয়ার পর আর দিলো না। ভাবলো বাসায় গেছে হয়তো।পরে কল ব্যাক করবে।

আরশিয়া ওদের পিছু নিতে নিতে পৌঁছালো একটির বাড়ির সামনে।ফারিয়া সহ দুটো মেয়ে গেইট দিয়ে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো।আরশিয়া দূর থেকে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসলো।চারদিকে নজর বুলালো।
কেমন জানি ছমছমে জায়গা।আশে পাশে মানুষ তেমন নেই। তবে বাড়িটির সামনে ছোট একটি দোকান।সেখানে এক বৃদ্ধ লোক বসে আছে।আরশিয়া একটু করে এগিয়ে গেলো।দেখলো ছোট দোকানটায় তেমন কিছু নেই। আছে কিছু ব্যাকারি জিনিসপত্র,চা আর পান পাওয়া যায়। আরশিয়া গিয়ে ছোট বেঞ্চটায় বসলো।বৃদ্ধ তার দিকে সন্ধিহান চোখে তাকালো।আরশিয়া তার মতিগতি বুঝার চেষ্টা করে বলল,

“দাদু আপনার দোকানে তেমন কোনো জিনিস নেই কেন?

বৃদ্ধ উদাস হয়ে উত্তর দিলো,

“যেমন চলন,তেমন জিনিস আর কি।

আরশিয়া এবার জিজ্ঞেস করলো,
“দাদু একটু আগে তিনটি মেয়ে এই বাড়িটিতে ঢুকলো তারা কি প্রায় আসে?

বৃদ্ধ কেমন করে তাকালো আবার।
“কেন বলো তো?

“এমনি জিজ্ঞেস করছি। মাঝে মধ্যে দেখি এখানে এসে ঢুকে।কিন্তু করে কি তারা?
বৃদ্ধ প্রথমে বললো না। আরশিয়া বুঝতে পারলো অন্য কিছু ট্রাই করতে হবে। ব্যাগ থেকে একটা হাজার টাকার নোট রাখলো বৃদ্ধর সামনে। বৃদ্ধর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো লোভে। আরশিয়া বলল,

“এবার তো বলবেন?”

বৃদ্ধ টাকাটা নিলো। আশে পাশে তাকালো তার আরশিয়াকে বললো, “বলছি কিন্তু কাউকে বলিও না।বলে লাভ কি?এসবে নাক গলালে নিজেরই ক্ষতি।
এর পর বৃদ্ধর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। শুনেই আরশিয়া চমকে উঠলো।সে যেন যা সন্দেহ করেছিলো তার থেকেও বেশি কিছু এখন সন্দেহ হচ্ছে। যদিও বৃদ্ধ পুরোপুরি বলতে পারছে না। তবে তার কথার ইঙ্গিত অন্য কিছু বলছে। আরশিয়ার ভাবনার মাঝে বৃদ্ধ বলে উঠলো শুধু,

“আমার আর কি?আমারে মাঝে মধ্যে কিছু টাকা হাতে গুঁজে দেয়। কি বা করতে পারি?সবই পারিবারিক অসাবধনতা আর সঙ্গীর দোষী।
আরশিয়া উঠে পড়লো। দুইতলা বিশিষ্ট বাড়িটির দিকে তাকিয়ে রইলো,ভাবলো কিছু তার পর হাঁটা দিলো নিজ পথে।”

চলবে…………?

#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
পর্ব:১৪

দুপুরের রোদ যেন কড়া শাসকের মতো শহরটাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। রাস্তায় লোকজন কম, গাড়ির শব্দও দূরে কোথাও মিলিয়ে যাচ্ছে। আরশিয়া ধীরে ধীরে হাঁটছিলো, কিন্তু বুকের ভেতর অদ্ভুত অশান্তি। বৃদ্ধ লোকটার কথা বারবার কানে বাজছে।

এই কথার মানেটা কি?
ফারিয়া বারবার ওই বাড়িতে আসে কেন? দু’জন মেয়েকে নিয়ে ঢুকে যায় আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভেতরে কাটায়। কি এমন আছে ভেতরে? তার সন্দেহ কি ঠিক?

মনে হলো কিছু একটা ভয়ঙ্কর রহস্য লুকিয়ে আছে।
কিন্তু এখনই যদি কাউকে বলে ফেলে, সবাই হয়তো বিশ্বাস করবে না। তাই চুপচাপ ব্যাগ শক্ত করে কাঁধে ঝুলিয়ে পথ ধরলো।

অন্যদিকে, রিহান ঠিক তখনই ভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে। সূর্যের তাপে কপালে ঘাম জমেছে। তারেক মির্জা একটা কাজ দিয়েছে সেটা করতে আবার যেতে হবে। আরশিয়া বাসায় গেছে ভেবে স্বাভাবিক মনে সে ছুটলো।

বিকেলের দিকে আরশিয়া ঘরে ফিরলো। মুখ ক্লান্ত, চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে মনে হলো, যেন কোথাও অপরাধ করে এসেছে। বুকের ভেতর ভয়, আবার সত্য জানার অদম্য আকাঙ্ক্ষা।

ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠলো।
স্ক্রিনে ভেসে উঠলো রিহান কল করেছে। ভয় পেরিয়ে
হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ড দ্বিধায় থাকলো। তারপর কল রিসিভ করলো।
ওপাশ থেকে রিহানের কণ্ঠ কঠিন হয়ে এলো,
“তুমি কোথায় ছিলে? ফোন ধরছিলে না কেন? আমি পুরো ভার্সিটিতে খুঁজলাম কোথাও পেলাম না।”

আরশিয়া গিলে ফেললো ভেতরের ভয়ের ঢেউ।
“আমি… আমি তো ক্লাস শেষে চলে এসেছি। ফোনটা ব্যাগে ছিলো, শুনিনি।”

রিহান কিছুক্ষণ চুপ রইলো। তারপর নরম গলায় বললো,
“তুমি নাকি আমাকে খুঁজছিলে?আজকাল চোখে হারাও নাকি?
রিহানের মুখে নিঃশব্দ হাসি তবুও আরশিয়া বুঝতে পারলো তাকে লজ্জায় ফেলতে বলছে। সে বলল,“ হ্যাঁ খুঁজছিলাম তো ফারিয়া বলল আপনি কোথাই তাই।

ফারিয়ার নাম শুনতেই রিহানের মেজাজ খারাপ হলো।কিছুটা রেগে বলল,“প্রেমময় মূহুর্তে জল ঢেলে দিলে?নিরামিষ মহিলা।

আরশিয়া মুখ টিপে হাসলো।বলল,“আমর নিরামিষ তরকারি ভীষণ পছন্দ কিনা,এজন্যই আমিও নিরামিষ।

“আমিষ বানানোর দায়িত্ব বিয়ের পর আমি নিবো না হয়।

আরশিয়া লজ্জায় পড়লো। কথা ঘুরাতে বলল,“আম্মু ডাকছে আসি।বলেই ফট করে কল কাটলো। রিহান ফোন রেখে হেঁসে উঠলো। মনে মনে আওড়ালো, “ শীতের পরে বসন্ত আসবে,তুমি আমার একান্ত হবে,সন্ধ্যার বাতাসে প্রেমের বাতাস বইলে তুমি আমি সিক্ত হবো সে বাতাসের অনুভূতিতে।

সন্ধ্যার শহরটা আজ অন্যরকম সাজে সেজেছে। লাইটপোস্টের আলো জ্বলে উঠেছে, রাস্তার পাশে ব্যস্ত মানুষের ভিড়। গাড়ির হর্ন, দোকানের কোলাহল সব মিলিয়ে এক অচেনা সুর বাজছে।

রিহানের ফোনে মেসেজ এলো,
“আজ সন্ধ্যায় একটু সময় পাবেন? দেখা করতে চাই। জায়গার লোকেশন আমি পাঠিয়ে দিবো।”

রিহান মেসেজ দেখলো এক ঘন্টা পর।তখন অলরেডি সন্ধ্যা নেমেছে। আরশিয়াকে কল ব্যাক করলো। বলল লোকেশন পাঠাতে সে এখনি আসছে।

তারপরই লোকেশন পাঠিয়ে দিলো। শহরের মাঝামাঝি এক ছোট্ট, নিরিবিলি রেস্টুরেন্ট।

রিহান প্রথমে একটু অবাক হলো। সাধারণত আরশিয়া খুব একটা বাইরে ডাকেনা, অথচ আজকে নিজেই ডাকলো। মনের ভেতর কৌতূহল আর অদ্ভুত টান একসাথে কাজ করলো।

বিশ মিনিটের মধ্যে রিহান উপস্থিত হলো। আরশিয়াকে দেখতে পেলো সুন্দর একটা মেরুন রঙা থ্রি পিছ পরে বসে আছে। কি স্নিগ্ধ লাগছে। ফর্সা চোহারার ঠোঁট দুটোতে মেরুন রঙা লিপস্টিক ও মিলিয়ে দিয়েছে।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে চারদিকে তাকালো। নরম আলোয় সাজানো ছোট্ট জায়গা। কোণের টেবিলে বসে আছে আরশিয়া।

রিহান এগিয়ে গেলো, চেয়ারে বসতেই নরম গলায় বললো,
“কি হলো? এত হঠাৎ করে ডাকলি কেন? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।”

আরশিয়া একটু চুপ রইলো। পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে আবার নামিয়ে রাখলো। তার চোখ যেন ভেসে যাচ্ছে অজানা শূন্যতায়।
বললো,
“আপনাকে একটা বিষয় জানাতে চাই। তবে আগে প্রতিশ্রুতি দিন, রাগ করবেন না।”

রিহান ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
“রাগ করার মতো কিছু করলে তুমি? বলো শুনি।”

আরশিয়া ঠোঁট কামড়ে নিলো। কণ্ঠ আরও নিচু হয়ে এলো,
“আমি আজ একটা জায়গায় গিয়েছিলাম… সেখানে গিয়ে যা দেখেছি, সেটা বলার মতো সহজ নয়। শুধু এটুকু বুঝেছি, সবকিছু বাইরে থেকে যেমন মনে হয়, ভেতরে আসলে তেমন নয়।”

রিহান এবার একটু এগিয়ে এলো।
“কি বলছো পরিষ্কার করে বলো? কোন জায়গায় গিয়েছিলে?”

আরশিয়া হেসে ফেললো চাপা হাসি।
“সব বলবো কিন্তু একসাথে নয়। ধীরে ধীরে। শুধু বিশ্বাস রাখবেন, আমি যা বলবো সেটা সত্যি।”

রিহান কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠলো। হাত বাড়িয়ে আরশিয়ার হাত ধরলো।
“আমি সব সময় তোমার পাশে আছি থাকবো?ক্লিয়ার করে বলো কি হয়েছে?”

কিন্তু তখনই ওয়েটার এসে খাবার টেবিলে রাখলো। মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো।

আরশিয়া নিঃশব্দে প্লেটে হাত রাখলো। তবে চোখ তখনো ভিজে, মনে হলো এক পাহাড়সম রহস্য তার বুকের ভেতর চাপা পড়ে আছে।

“আজকে আমি ভার্সিটি শেষে এক জায়গায় গিয়েছিলাম। হঠাৎ ফারিয়া আর দু’জন মেয়েকে অনুসরণ করলাম। ওরা একটা দুইতলা বাড়ির ভেতরে ঢুকলো।”

রিহান সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে উঠলো।
“কোনো কারণ ছাড়া কাউকে অনুসরণ করছিলে কেন?”

আরশিয়া ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়লো।
“কারণ… আমার সন্দেহ হচ্ছিলো। ওরা বারবার সেই দিকেই যায়। আমি ভেবেছিলাম হয়তো এমনি, কিন্তু আজ গিয়ে যা দেখলাম আর শুনলাম…”

রিহান তার হাত চেপে ধরলো।
“শান্ত হয়ে বলো। কি শুনলে?”

আরশিয়া চারপাশে তাকালো, তারপর খুব ধীর গলায় বললো,
“সামনের দোকানের এক বৃদ্ধ আছে। আমি ওনার সাথে কথা বলেছি। প্রথমে কিছু বলতে চাইছিলো না। তারপর টাকা দিলো উনি এমন কিছু ইঙ্গিত দিলেন, যেটা শোনার পর আমার শরীর কেঁপে উঠলো।

রিহান ভ্রু কুঁচকে গেলো।
“মানে কি?”

আরশিয়া চোখ নামিয়ে বললো,
“পুরোটা স্পষ্ট করেনি। তবে ইঙ্গিত বুঝতে বাকি নেই। ফারিয়া যাদের সাথে মেশে সেটা ঠিক না। আর ও বাড়িটা ভেতরে কী হয় জানি না, কিন্তু ভালো কিছু নয় নিশ্চয়ই।”

কথাগুলো বলার পর যেন চারপাশ ভারী হয়ে গেলো। রিহানের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো।

“তুমি একা গিয়েছিলে?”

“হ্যাঁ।”

“ জানো এটা কতটা বিপজ্জনক কাজ ছিলো? যদি কিছু হয়ে যেতো? যদি কেউ দেখে ফেলতো?”

আরশিয়া ফিসফিস করে বলল,
“জানি!কিন্তু মনে হচ্ছিলো সত্যি না খুঁজে পেলে আমি শান্তি পাবো না।”

রিহান আর কোনো কথা বললো না। শুধু কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আরশিয়ার পানে।তারপর ধীরে ধীরে বললো,
“এখন থেকে কোথাও একা যাবে না। যা কিছু দেখেছো যেটুকু বুঝেছো সব আমার ওপর ছেড়ে দেও। আমি খুঁজে বের করবো আসল সত্য।”

আরশিয়া মুখ তুললো।
“আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করছেন আমাকে?”

রিহান হাত আরও শক্ত করে ধরলো।
“বিশ্বাস না করলে কি আজও এতটা তাড়াহুড়ো করে আসতাম?”
আরশিয়া আরো অনেক প্ল্যান করলো।রাতে খোঁজ শুরু করে দিবে এবং কালকে কিছু একটা করবে বলে ঠিক করলো। এর মধ্যে রিহান তার বন্ধুদের কল দিলো। সবকিছু বুঝিয়ে বললো। রিহান ওকে ভরসা দিলো। কাল সকাল থেকে ফারিয়ার উপর নজর রাখবে এন্ড তারা ভার্সিটির বাহিরে অপেক্ষা করবে।

কথাগুলো শুনে বুকের ভেতর জমে থাকা ভারি বোঝাটা একটু হালকা হলো আরশিয়ার। বাইরে তখন রাত নেমে এসেছে। শহরের আলোয় দু’জনের মুখশ্রী জ্বলজ্বল করছে। একে অপরের দিকে অন্য রকম অনুভূতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

ঠিক সেই মুহূর্তেই দূর থেকে এক জোড়া চোখ তাদের উপর পড়লো। দূর থেকে ওদের দেখে হাসলো। সে হাসি আসলে কি বুঝালো তা সে ছাড়া কেউ জানেনা।
মিহির ওদের সামনে যেতে চাইলে নীলা আটকালো, বলল,“আরেহ কি করছেন?নিজে প্রেম বুঝেন না বলে অন্যকে প্রেম করতে দিবেন না নাকি?ওদের সুন্দর মুহূর্তে গিয়ে কাবাবের হাড্ডি হবেন?”

মিহির যাওয়া বাদ দিয়ে নীলার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তার কথার পেক্ষিতে বলল,“ তুমি কি আমাকে অপমান করছো?আমি প্রেমিক পুরুষ হতে পারবো না?”

নীলা মিহির কে সে রেস্টুরেন্ট হতে টেনে নিয়ে গেলো। মিহির ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “কোথায় যাচ্ছো?আর কি বললে?”

নীলা থামলো না। ব্যস্ত রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলো। মিহিরের হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে রাখলো।
মিহির একটু রাগ করার চেষ্টা করে বলল,“ এই কে আপনি? হাত ধরছেন কেন?আমি কারো প্রেমিক পুরুষ নয় হাত ধরবেন না।

নীলা হাতটা আরো চেপে ধরলো। কুটিকুটি হেসে বলল,
“প্রেমিক পুরুষ হতে হবে না,আপনি বরং ব্যক্তিত্ববান স্বামি হইয়েন,ধরনীতে রাত্রি নামলে এক মুঠো বেলি ফুলের তোড়া দিয়ে ভালোবাসি বইলেন, ক্লান্ত বিকেলে আরামের বিছানা হিসাবে কাঁধ এগিয়ে দিয়েন।”

মিহির মাথা কাত করে শুনলো,দেখলো নীলাকে।
পারবেন তো?

মিহির মুগ্ধ চোখে হেসে উঠলো, বলল“ যর্থাঙ্গা ম্যাম।

নীলাও হেসে ফেললো।ব্যস্ত রাস্তায় একসাথে পা ফেলে চললো দূর অজানায় নির্জন রাস্তায়।

চলবে………….?