#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
পর্ব:১৫
শা,শা করে বাতাসের শব্দ আসছে। শরৎকাল তো আজই পড়েছে। এজন্যই হয়তো আজকের আকাশ ঝকঝকে লাগছে। সাদা তুলোর মতো মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে নীল আকাশে। মাঝে মধ্যে নীলে সাদায় মিশে যাচ্ছে।
শরৎকালের মতো স্নিগ্ধ আকাশ আর কখনো দেখা যায় না। এই নতুন ঋতুতে শেষ হতে চলছে কিছু গোপনীয়তা।
সব প্ল্যান মতো হয়েছে সবকিছু। এখন বাকি প্ল্যান সাকসেসফুল হওয়া।দেখা যাক কতটুকু কি হয় শেষ পর্যন্ত।রিহান আজ আরশিয়া কে নিতে আসবে।বাসার নিচে বাইক নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আরশিকাকে ফোন করে জানাতেই সে তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি বেয়ে নামলো। আনজুমা চৌধুরী নিচে নেই তাই একবার চিল্লিয়ে দরজা খুলে বেরোলো। তার হাতে একটা শপিং ব্যাগ আর পরনে থ্রি পিছ। বরাবরের মতো রিহান মুগ্ধ হলো।তাকিয়ে রইলো।আরশিয়া এক প্রকার দৌঁড়ে বেরোলো।থামলো গিয়ে রিহানের ঠিক সামনে। হাফ ছেড়ে সামনে তাকালো।দেখলো রিহান তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো,
“কি?
“দেখছিলাম।”
“কি দেখছিলেন?”
রিহান বাইকে উঠলো এবং তাকেও ইশারায় উঠতে বললো। তার পর স্টাট দিতে দিতে উত্তর দিলো,
“রিহান মির্জার বউ কে দেখছিলাম।”
আরশিয়া হাসলো।লাজুক রাঙা মুখটা বাইকের আয়নায় দেখে রিহান ও হেসে উঠলো। বাইক চলতে শুরু করতেই রিহানের কাঁধ জাপটে ধরলো।সকালের স্নিগ্ধ বাতাস হৃদয় ছুঁয়ে দিচ্ছে,গুনগুন করে গাইছে প্রকৃতির গান। ব্রেক কষলো আরশিয়া কিছুটা ঝুকে পড়লো। অন্য সময়ে রোমান্টিক মনে হলেও এই জ্যামো তা ভাবনায় ও আসলো না।ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ির ভীড় জমলো। এই জ্যামে পড়ার মতো বিরক্তি আর কোথাও নেই।
রিহান বেশি বিরক্ত হচ্ছে। প্রায় দশ মিনিট পর জ্যাম কাঁটলো চলতে শুরু করলো বাইক।
ভার্সিটিতে গিয়ে রিহান রনিত আর অভিষেক কে ডাকলো। জিজ্ঞেস করলো, “সব ঠিকঠাক?
“হ্যাঁ সব ঠিকঠাক। অভিক আর সাহিল ওখানে আছে নজরদারি করছে।
“গুড।
রিহান চলে গেলো আরশিয়ার থেকে দূরে।অন্য দিনের মতো স্বাভাবিক থাকতে হবে। আরশিয়ার আজ ক্লাস নেই অর্থি এসেছে ও ক্লাসে গেছে। হঠাৎ ফারিয়া কে দেখতে পেলো।সর্ট ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে হেঁসে হেসে কথা বলছে একটা ছেলের সাথে।বাম হাত তারই হাতের ভাঁজে।আরশিয়া চোরা চোখে দেখছিলো যাতে বুঝতে না পারে।ছেলেটা ফারিয়াকে তাকে দেখিয়ে কি যেন বলছে।
আরশিয়া চোখ সরালো।তাকে ইঙ্গিত করে কি বলছিলো?কাল আবার কেউ দেখে ফেলেনি তো? শত ভাবনার মাঝে ছেলেটি আর ফারিয়া কখন ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল করেনি।
“কি রে এখানে কি করছিস? রিহানের সাথে আজ চিপকে নেই কেন?পাত্তা দিচ্ছে না?না দিলে বল রাহেল তোকে সঙ্গ দিব। কি রে দিবি না?
ফারিয়ার ঠাড্ডার কথায় ছেলেটিও সঙ্গ দিলো। হাসতে হাসতে বলল,“ সুন্দরী মেয়েরা চাইলে সঙ্গ কেন সবকিছু করতে পারি।
আরশিয়ার রাগ উঠলো। ইচ্ছে করলো ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে।কিন্তু আজ নিবর থাকতে হবে। ফারিয়াকে ওর মতো থাকতে দিতে হবে।তাই আর কিছু বললো না। কেবল উঠে গেলো সেই স্থান থেকে।
“কি ব্যাপার বলতো? আজকে এতো চুপচাপ কেন?এমনিতে তো কিছু বললে কাঁটার মতো জবাব দেয়।
“এতো ভাবার সময় নেই। চল দেখি ওরা এসেছে কিনা।
ফারিয়া ভাবনায় মসগুল হয়ে তার সাথে চললো।
অপেক্ষা ফুরলো। দুপুর গড়াতেই ফারিয়া আবার বেরেলো। আজকেও সাথে তিনটে মেয়ে। একটি বাড়তি হয়েছে। সবগুলো কেমন হাসফাস করছে, তাদের দেখে মনে হচ্ছে কিছুর তীব্র তাড়া আছে। রিহান আর আরশিয়া ওদের পিছু নিলো। রনিত কে বললো তোরা একটু পরে আয়। আমি যখন শুধু কল দিবো তোরা ঢুকে পড়বি আর সাহিল কে বল ওরা যাচ্ছে। আভিক যেন ফোন করে সব ঠিকঠাক রাখে। রিহান আর অভিষেক মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। আরশিয়া আর রিহান ওদের পিছু নিতে গিয়ে একটু পিছু হাঁটলো, যেহেতু চিনে সমস্যা নেই। তার আগে তাদের কাজ করতে হবে। আরশিয়া হাতে থাকা ব্যাগ থেকে কালো বোরখা বাহির করলো সাথে নিকাব ও।সেগুলো পরে নিলো। রিহান কে বললো,“ঠিক আছে সব?চেনা যাচ্ছে কি?
“না। একদম চেনা যাচ্ছে না।
আরশিয়ার কিছু মনে হতেই পায়ের নতুন জুতো জোড়া খুলে ব্যাগ থেকে পুরনো স্যান্ডেল বাহির করে পরে নিলো।কোনোভাবে যেন সন্দেহ না করে।
পিছু নিয়ে আসলো সেই দুইতলা বাড়ির সামনে।আজকে গেটের সামনের দোকানটা বন্ধ। গেটের একটু সামনে গিয়ে দুজনে দাঁড়ালো।প্ল্যান মতো আরশিয়া এগিয়ে আসলো। গেইটে যেতেই দারোয়ান আঁটকে দিলো।
“কে আপনি কোথাই যাচ্ছেন?”
আরশিয়া ঘাবড়ালো না, বলল,
“রেনু খালা আজ কাজে আসবে না। তিনি অসুস্থ এজন্য আমারে পাঠালো। আমি তার ভাইজি। বিশ্বাস না হলে উপর থেকে শুনে আসুন।ফুফু বলেছে সে আজ আসবে না আমি আসবো। দারোয়ান ফোন করলো কাউকে।
কথা বলা শেষে বলল,“ঠিক আছে যান।
আরশিয়া একটু ভয় নিয়ে ঢুকলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠলো দুইতলায়। কলিং বেল টিপ দিলো। একটু পর একটি মহিলা দরজা খুলে দিলো।
“তুমি রেনুর ভাইজি?
আরশিয়া মাথা ঝাঁকালো।
ওর দিকে তাকিয়ে মহিলা আবারো বলল,
“এমন চোখ মুখ ঢেকে রেখেছো কেন?”
আরশিয়া একটু ভয় পেলো। চোখ কেমন সন্দেহ মতো করে তাকিয়ে আছে।কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখলে আরো সন্দেহ করবে।
“আন্টি আসলে আমি স্বামী চায় না অন্য কেউ আমার মুখ দেখুক তাই বোরখা নিকাব পরি। আপনি তো জানেন স্বামির কথা না শুনলে গুনাহ হয়। আমি কি এতো বড় পাপ করতে পারি?
“ঠিকাচ্ছে। এতো নাটক শোনার সময় নেই। যাও কাজ করো গিয়ে।
আরশিয়া কোনদিকে যাবে বুঝতে পারলো না। বাম দিকে যেতে নিলেই কেউ একজন দাঁড়িয়ে পড়ে।আরশিয়া চমকে উঠে পিছিয়ে যায়।
একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। দৃষ্টি কেমন যেন। তার বোরখার আবৃত শরীরের দিকেও কেমন করে তাকিয়ে আছে। মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলো,
“কে এটা?নতুন মাল নাকি?
“ওদিকে চল। ও কাজ করতে এসেছে।
আর মেয়ে ওদিকে কই যাচ্ছিলে? ডান পাশে ইশারা করে বললো ওদিটায় যাও।
আরশিয়া আশে পাশে চোখ বুলিয়ে চললো ডানপাশে। কিন্তু কোথাও ফারিয়া কিংবা মেয়ে গুলোকে দেখতে পেলো না।
বিশ মিনিট হয়ে গেলো।আরশিয়া ঘর ঝাড়ু দেওয়া শেষ। শুধু একটি মাত্র ঘর আছে। ও সেদিকে নজর পড়লো যেতে নিলে কেউ কাঁদে হাত রাখলো। আরশিয়া চমকে উঠলো। পিছনে তাকিয়ে দেখলো আরেকটি মেয়ে।
তার দিকে তুখোড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
“এখানে উঁকি মেরে কি দেখছিলে?
আরশিয়া আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে সব ঘর তো ঝাড়ু দিলাম কিন্তু ওই ঘর দেওয়া হলো না।
“ওটায় দিতে হবে। তুমি তোমার কাজ করো এদিকে আসবে না। যাও এখান থেকে।
আরশিয়া চলে আসলো। কি করবে ভাবছে।আপাতত কিছু একটা কাজ করতে হবে।
একটু পর আবার কলিং বেল বাজলো।আরশিয়া তখন ওয়্যারড্রপ মুছছিলো। ও ঘর থেকে বেরিয়ে মাথা বাড়িয়ে দেখলো। দরজা খুলছে ওই ছেলেটা। রিহানের পরনে কমদামি শার্ট প্যান্ট আর মুখে মার্ক্স। লোকটি কি যেন জিজ্ঞেস করলো তার পর আসতে দিলো।
সে মূলত কারেন্টের কাজের জন্য এসেছে। একটি লোককে আসতে বলেছিলো রিহান তাকে সরিয়ে নিজে এসেছে। ভাগ্য ভালো তাদের লোক দরকার পড়েছে বলে আসতে পারলো।
রিহান কে একটা ঘরে নিয়ে গেলো।যাওয়ার আগে আশে পাশে তাকালো। আরশিয়াকে দেখে হাতের ইশারায় কিছু বললো।
আরশিয়া একটু পর বেরেলো। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। একটি রুমে ওই মহিলা শুয়ে আছে। এই সুযোগ সে পা টিপে সেই রুমের কাছে গেলো।
দরজা তো বন্ধ তাই গেলো রান্না ঘরে। রান্না ঘরের এক সাইডে একটু ফাঁকা আছে সেখানে দিয়ে সেই রুমে বেলকনিতে যাওয়া যায় এবং বেলকুনিতে থাই গ্লাস লাগানো আছে পর্দা টানা আছে এজন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। আরশিয়া রান্না ঘরের সাইড দিয়ে মাথা এগিয়ে দিলো,সামান্য পর্দা উঠাতেই যা দেখলো তাতে ওর শীরর কেঁপে উঠলো, আশ্চর্য হলো,মুহূর্তে থমকে গেলো মতিষ্ক শূন্য লাগছে। তখনই রিহান আসলো। আরশিয়ার অবস্থা দেখে ইশারায় জানতে চাইলো কি হয়েছে?
আরশিয়া আবার পর্দা সরিয়ে দেখালো। রিহান ও স্তব্ধ হয়ে গেলো,রাগে শরীর কাঁপতে লাগলো। ফোন করলো রনিত কে। তার পর উঠে দাঁড়ালো দরজার দিকে গেলো।
দরজা ধাক্কা দিচ্ছে এমন সময় ওই মহিলা আসলো।তাদের দেখে বললো কি হচ্ছে এখানে?
রিহান দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“এই রুমের মধ্যে কি হচ্ছে আগে সেটা বলেন।
মহিলা আশ্চর্য হলো,মুখশ্রীতে কিছুটাভয় ও দেখা দিলো।
বলল,
“কারা তোমরা? এখানে কি করতো এসেছো?
মহিলার চেঁচামেচি আর দরজা ধাক্কানোর কিছুজন বেরিয়ে আসলো। তাদের দেখে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
চোখ গুলো কেমন লাল লাল হয়ে আছে।পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মহিলা কিছু ইশারা করলো। আরশিয়া বুঝার আগেই লোকগুলোর মধ্যে একজন আরশিয়া গলার ছুরি ধরলো। রিহান এগুলে আরেক তার কাঁধে ছুরি বসিয়ে দেয়। আরশিয়া চিৎকার করে উঠে। রিহান চোখ খিঁচে লোকদিকে উল্টো ছুরি দিয়ে হাতে বসিয়ে দেয়।এর মধ্যে ওই মহিলা আর দুজন পালাতে দরজার দিকে যায়। রিহান আরশিয়াকে ধরে থাকা লোকটার দৃষ্টি লক্ষ্য করে। হুট করে ছুরি কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে মেঝেতে। তার ঘাঁড়ের উপর পা দিয়ে ডলা দিতে থাকে।আরশিয়া সেই রুমের দরজা খুলে ঢুকে পড়লো। প্রত্যেকটি মেয়ে নেশায় ঢলে পড়ে আছে। একজনের দিকে তাকিয়ে তার খারাপ লাগলো। না জেনে এরা কত খারাপের দিকে পা বাড়িয়েছে। বাবা মা জানেও না তাদের মেয়ে নেশায় আসক্ত হয়ে গেছে। আর এই জানোয়ার গুলো সেই সুযোগ নিয়ে নেশা করাতো আর ছি। বলতে গিয়েও থেমে গেলো। সবচেয়ে ঘৃণা লাগলো ফারিয়া কে দেখে। সে তাদের নিয়ে আসে।জীবন ধ্বংস করে দেয়।
মেয়ে দুটো নিজেদের মধ্যে নেই। চোখ বন্ধ করে ঢলে পড়ে আছে। আরশিয়া ঘরের আশে পাশে চোখ বুলিয়ে পানির বোতল পেলো। তিনজনের চোখে পানির ছিঁটা দিলো। একজন চোখ মেলে দেখলো আবার বন্ধ করলো।
কিছুক্ষণ পর আরশিয়া ঘর থেকে বেরেলো। দেখলো রনিত, অভিক,সাহিল,অভিষেক এসে গেছে সাথে পুলিশ ও আছে। রিহান কাঁধ ধরে আছে, রক্ত বাহির হচ্ছে সেখান থেকে। আরশিয়া নিকাব খুলে ফেললো।রিহানের কাঁধে সুতি নিকাবটা দিয়ে বেঁধে দিলো। পুলিশ সবাই কে ধরেছে। মহিলা পুলিশদের মেয়ে গুলোকে স্বাভাবিক করে তাদের পরিবার কে ফোন দিতে বললো।
এরা মূলত ফারিয়ার মাধ্যমে ভার্সিটির কিছু মেয়েকে আনতো। প্রথমে জোর করে নেশা করাতো তার পর অভ্যাসে পরিনত হলে তারা নিজে আসতে ব্যস্ত হতো। নেশা না পেলে পাগলামি বাড়লো।বাসা থেকে টাকা লুকিয়ে নেশা করতে আসতো ভার্সিটির নাম করে।এভাবে তাদের ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দিচ্ছিলো এদের মতো নিকৃষ্ট মানুষরা। সবচেয়ে ঘৃণিত ওই মহিলা।মায়ের বয়সী হয়ে কিভাবে এসব করতে পারে? এসব খোঁজ তারা কালকে নিয়েছিলে আরেকটি মেয়ের থেকে। আজ সে আসেনি। কালকে তাকে ধরেছিলো আরশিয়া এবং রিহান। সে প্রথমে ভয়ে বলতে চায়নি পরে কেঁদে ফেলেছিলো,বলেছিলো সব সত্যি। তাদের বলা ছিলো কাউকে বললে তাদের করা গোপন ভিডিও ফাঁস করে দিবে। সেই ভয়ে কাউকে বলতো না এবং নেশা ছাড়তে পারতো না বিধায় যাইতে হতো।
আরশিয়া রিহান কে নিয়ে আগে বেরিয়ে গেলো।রনিত আসলো সাথে। ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে গেলো ফার্মেসিতে। রক্ত পড়ছে বন্ধ করতে হবে। রিহান ব্যস্ত হতে না করলো। সামান্য কিছু হবে না কিন্তু সে শুনলো না।
চলবে………………?
#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
পর্ব:১৬
আজ শুক্রবার। অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশি গরম।গাছের পাতা একটুও পড়ছে না, মাথায় উপরে সূর্যি মামার কড়া তাপে ফেঁটে যাচ্ছে মাঠ ঘাট নিশ্চিত। রাস্তায় চলতে থাকা কর্মজীবী মানুষদের ভোগান্তি বেশি।
আরশিয়া বাড়ির গাড়ি নিয়ে বেরেলো আজ যাবে শপিং করতে। রিহানের একটা কাজ থাকায় সে যেতে পারছে না। রিহান এখন নতুন অফিসে জয়েন করেছে,বাবার সাথে অফিস সামলাচ্ছে। বেশ কাজের মধ্যে থাকে আজকাল।বিয়ের শপিং করতে যাচ্ছে সে। তবে বিয়ে তার নয় অন্যজনের।
বিশ মিনিট পর লোকেশন অনুযায়ী গাড়ি দাঁড় করালো।আরশিয়া নেমে চারপাশে তাকালো কিন্তু পরিচিত মুখ দেখতে পেলো না। ফোন বাহির করে ডায়াল করলো, “কোথাই?”
অপরপ্রান্ত হতে উত্তর আসলো দাঁড়াও আসছি। আরশিয়া ফোন রাখতে রিহানের কল আসলো। রিসিভ করলো,
“কোথাই আছো?শপিং মলে গেছো?
“হ্যাঁ মাত্র আসলাম। এখন ভেতরে যাইনি।
রিহান ব্যস্ত হাতে ফাইল চেক করছে আর কথা বলছে তা বুঝতে পারছে আরশিয়া। কারণ তার সাথে কথা বলার মাঝেও অন্য কাউকে কিজানি বলছে। যেহেতু দুপুর পেরিয়ে গেছে তাই জিজ্ঞেস করলো,
“খেয়েছেন?”
“না।
“কেন?”
“বউ খাবার আনেনি তাই।
বলেই নিঃশব্দে হাসলো। আরশিয়া মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দিলো,
“আপনার বউ ভালো না। অন্যত্র বিয়ে করেন।
রিহান এবার জোরে হেসে উঠলো, বলল,
“ম্যাম একটা লক্ষী মেয়ে খুঁজে দেন তো।যে অপেক্ষার অনলে না পুড়িয়ে পারমানেন্ট চলে আসবে।
আরশিয়া দাঁত চেপে রাগ হওয়ার ভান করে বলল,
“ওকে দেখবো। এখন আমার কাজ আছে রাখি।অন্যের জামাইয়ের সাথে কথা বলা পাপ।
এতটুকু বলে আরশিয়া ফোন রাখলো। রিহান জোরে হাসতে লাগলো। তারেক মির্জা তার ডেস্কে এসে পড়েছে সে খেয়াল করেনি।তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে অভিব্যক্তি বুঝার চেষ্টা করলেন।
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“এভাবে হাঁসলো কেন?জ্বিনে ধরেছে?”
“না!আপনার বউমা ধরেছে।
তারেক মির্জা ছেলের দিকে তাকিয়ে ভাবছে এ এতো নিলজ্জ হলো কবে থেকে?
বাবার দৃষ্টি লক্ষ্য করলো।তার ভাবনার উত্তর হিসাবে আবারো বলল,
“মানে আপনার বউমা ফোন ধরেছে তাই হাঁসছিলাম।
তারেক মির্জা সেসব বাদ দিয়ে বলল,
“আজকের মিটিং তিনটায় হওয়ার কথা থাকলেও হবে পাঁচটায়।
“ওকে। এখন এই ফাইলগুলো দেখো আরেকবার ঠিক আছে কিনা।তারেক মির্জা ফাইলগুলো দেখতে বসে পড়লো।
দেখা শেষ হতেই বলল,
“সব ঠিক আছে। তুমি খেতে এসো। একসাথে খেয়ে আসি।
তারেক মির্জা বেরিয়ে যেতেই রিহান ও বেরোলো।কাউকে ফোন করলো যেতে যেতে।
মিহির নীলা আর আরশিয়া এসেছে শপিং করতে।
মিহিরের বাবা থাকলেও মা নেই।
নীলার বাবা মা দুজনেই আছে তবে ভাউ বোন নেই।তাদের গ্রামের বাড়ি অন্য জায়গায় হওয়ার কারণে এখানে কোনো আত্নীয় ও নেই। তাই তারা একা এজন্য আরশিয়াকে ডেকে নিয়েছে নীলা।
বিয়ের শপিং একা করা ঝামেলা একটা মেয়ে সাথে হলে সুবিধা আছে।
ওরা তিনজনে একটা শাড়ি হাউজে ঢুকলো।মিহির লেহেঙ্গা হাউজে যেতে বললেও নীলা নাকু বিয়েতে শাড়ি পড়বে।
বাঙালি মেয়েদের শাড়িতে সুন্দর লাগে। ওসব লেহেঙ্গা তার পছন্দ নয়।
শাড়ি কিনতে গিয়ে পড়লো মুসকিলে। শাড়ি পছন্দ হয় না। শেষে একটা দোকানে গিয়ে পছন্দ হলো খয়েরি রঙের একটা শাড়ি।সাথে আরো দুটো শাড়ি নিলো বিয়ের পরার জন্য।
শাড়ি প্যাক করে নিয়ে বেরেলো। এবার জামাইয়ের পোশাক কেনার পালা।মিহিরের একটা দোকানে গিয়ে পছন্দ হলো এবং কিনে ফেললো।বেরিয়ে আসতে আসতে বলল,
“এই হলো নারী আর পুরুষের মধ্যে পার্থক্য! আমি একটা দোকানে গিয়ে কিনে ফেললাম আর তোমাদের দশটা দোকান ঘুরতে হলো।
নীলা ঠোঁট বাঁকিয়ে উত্তরে বলল,
“ পছন্দ করে কিনবো না?জীবনে একবারই বিয়ে, বারবার তো আর আসবে না।
মিহির থেমে গেলো। তার ভ্রু কুঁচকে আসলো।
“আমার কি তাহলে বিয়ে বারবার আসবে? অবশ্য আসলে মন্দ নয়।
নীলা চোখ পাকিয়ে তাকালো। পায়ের উপর পারা দিয়ে বলল,
“একবার বিয়ে করে দেখেন তার পর আর বিয়ে করার শখ জাগবে না।
মিহির আহহ বলে পা তুলে আবার দাঁড়ালো।
ওদের দুজনের খুনসুটির ঝগড়া শুনে আরশিয়া মুখ টিপে হাসছে।সে অনেকটা এগিয়ে দিয়ে দাঁড়ালো। বিকেল গড়িয়ে আাছে। মিহির এসে বলল,
“চলো পাশের রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাসসয় চলে যাই।
আরশিয়া প্রথমে দ্বিমত পোষণ করলো।কিন্তু নীলা আর মিহিরের জোরাজুরিতে যেতে বাঁধ্য হলো।
রেস্টুরেন্টের ভেতরটা স্নিগ্ধ পরিবেশ। আশে পাশে ফুলের গাছ লাগানো আছে।দূরে কোথাও মিউজিক বাজছে, টেবিলগুলো পরিপাটি করে সাজানো, প্রতিটা টেবিলে জ্বলছে ছোট্ট ক্যান্ডেল স্ট্যান্ড। বাইরে গরম থাকলেও ভেতরে এসি’র ঠান্ডা হাওয়া আরাম দিচ্ছে। চারপাশে নানারকম মানুষের হাসি-ঠাট্টা ভেসে আসছে।
মিহির আর নীলা নিজেদের মধ্যে গল্পে মেতে উঠেছে।
খাবার দিয়ে গেছে। নিজেদের পছন্দ মতো অর্ডার করেছিলো। নীলা মাঝে মধ্যে মিহির কে খাইয়ে দিচ্ছে। ওদের হাসাহাসি, খুনসুটি দেখে আরশিয়া মনে মনে হাসলেও, খানিকটা একাকিত্বও অনুভব করছে। রিহান কে মিস করলো। ভাবলো তার তখনের কথা।খাওয়া শেষ হওয়ার পর ও হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো।
“তোমরা গল্প করো। আমি একটু হাঁটতে যাচ্ছি।”
নীলা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মিহির হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো।
“যাক, ও একটু ঘুরে আসুক।”
আরশিয়া ধীর পায়ে রেস্টুরেন্টের একপাশে চলে এলো। সাইড কর্নারে কাঁচের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাতে লাগলো। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় হেডলাইটের আলো ঝলমল করছে।এখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।সূর্য ডুবেছে একটু আগেই। আরশিয়ার নিরিবিলি পরিবেশটা ভীষণ ভালো লাগছে।
ঠিক তখনই পিছন থেকে অপরিচিত এক কণ্ঠ কানে আসলো।
“এক্সকিউজ মি, মিস।”
চমকে ঘুরে তাকালো আরশিয়া। দেখলো, একটা ছেলে হালকা নীল শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। বয়সে হয়তো তাদের কাছাকাছি, ঠোঁটের কোনে লেগে আছে হাসি।
আরশিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
“জি, কিছু বলবেন?
ছেলেটা নিঃসংকোচ ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো।
“আপনাকে দেখলাম আপনার বন্ধুদের সময় দিয়ে একা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মানে আপনি একা তাই সঙ্গ দিতে আসলাম। আপনি চাইলে আমরা ওদিকটায় বসতে পারি।
আরশিয়ার মুখ কঠিন হয়ে গেলো। চোখে স্পষ্ট অস্বস্তি।
ওর মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরতে লাগলো।এমন সময়ে যদি রিহান এখানে থাকতো তবে কি এই ছেলেটা এমন সাহস দেখাতে পারতো?
আরশিয়া দু’পা পেছনে সরে এলো। কণ্ঠ গম্ভীর করে বললো,
“সরি, আমি একা থাকতে এসেছি। সঙ্গের দরকার নেই।”
ছেলেটা আবারও ভাঙা ভাঙা ইংরেজি মিশিয়ে বলল,
“ও কম’ন, ডোন্ট মাইন্ড। আমি তো শুধু ফ্রেন্ডলি অফার করলাম। ইউ আর সো বিউটিফুল!একা দাঁড়িয়ে থাকাটা আপনাকে মানায় না।”
আরশিয়ার ভেতরটা রাগে কাঁপতে লাগলো। চারপাশে তাকালো, কেউ খেয়াল করছে না। সে ঠাণ্ডা গলায় বললো,
“শোনেন, এভাবে অচেনা মেয়েদের কাছে আসা ভদ্রলোকের কাজ নয়। আমি চাইলে এখনই ম্যানেজমেন্টে অভিযোগ করতে পারি।”
ছেলেটা হাসলো, যেন ভয় পাওয়ার মানুষ নয়। এক পা এগিয়ে বলল,
“অভিযোগ করবেন? এত রাগ দেখাচ্ছেন কেন? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি। একটু হাসি-ঠাট্টা… বাস।”
“তাই?আপনি তাকে সঙ্গ দিতে এসেছেন?
ছেলেটি চমকে পিছনে তাকালো।একটি ছেলে তার ঘাঁড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরশিয়া কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখতে পেয়ে হেসে উঠলো। রিহান ওর ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল,
“মেয়েদের বিরক্ত করে সঙ্গ দিতে জনসেবা করতে এসেছিস?সরি মেয়ে সঙ্গসেবা করতে এসেছিস?
ছেলেটি রেগে গেলো। ঘাড় থেকে হাত ফেলে দিয়ে বলল,
“কে ভাই আপনি?আমি কাকে সঙ্গ দিবো -না কি করবো সেটা আমার ব্যাপার।আপনার কি?
রিহান হাসলো। হাসিমুখে ওর সামনে গিয়ে একহাতে কলার চেপে ধরলো। হাসিমাখা মুখ মুহূর্তে রাগত্ব হলো।বলল,
“যাকে সঙ্গ দিতে এসেছিস তার রিয়েল সঙ্গী আমি।
ওকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমি আছি।
ছেলেটা একটু ভয় পেলো। আশে পাশে তাকালো কেউ নেই এদিকে। রিহান কলার ছেড়ে দিলো। ওয়ার্নিং দিয়ে বলল,
“নেক্সট কখনো এমন দেখলে তোরে উচিত শিক্ষা দিবো।
ছেলেটি সাথে সাথে উধাও হয়ে গেলো।
আরশিয়া রিহানের সামনে এসে দাঁড়ালো।
“আপনি এখানে?
“ আপনার সঙ্গী কে দেখতে এসেছিলাম।
দাঁত চেপে বলা কথায় আরশিয়া একটু বিস্মিত হলো।
“এখানে আমার কি দোষ?
“সঙ্গী নিয়ে না ঘুরলে সুন্দরী মেয়ে দেখলে ছেলেরা তো সিঙ্গেল ভাববেই।
“আপনি তো সঙ্গে আসেননি আমার কি দোষ?
রিহান ঘুরে ওর চোখে চোখ রাখলো। শীতল কন্ঠে বললো,
“একবারে সঙ্গী করে নাও। অপেক্ষার প্রহর শেষ করো।তখন সবসময় সঙ্গে ঘুরবো।
শীতল পরিবেশে শীতল কন্ঠ আরশিয়ার হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি করলো। তার কথার মানে বুঝতে পারলো। তখনই মিহির আর নীলা ডাকলো। রিহান আগে থেকে প্ল্যান করে রেখেছিস মিটিং শেষ করে আসবে।মিহিরের সাথে তার কথা হয়েছিলো আরশিয়াকে না বলতে।
রিহান আর আরশিয়া যাচ্ছে। আরশিয়া একটু পিছনে রিহান সামনে। আরশিয়া হুট করে বলে উঠলো,
“আপনার বাবা কে গিয়ে বলবেন অপেক্ষা প্রহর শেষ করার ব্যবস্থা করতে।
রিহানের পা থেমে গেলো। ঘুরে তাকালো তখনি।
চোখে মুখে উচ্ছাস নিয়ে জানতে চাইলো,
“সত্যি?
আরশিয়া মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে ছুটলো নীলার কাছে।
রিহান দাঁড়িয়ে রইলো। হাত মুঠো করে বলে উঠলো,
“ভালোবাসা পূর্নতার অন্তিম মুহূর্ত তাড়াতাড়ি আসুক,
সহস্র আনন্দের মধ্যেও পূর্ণতার আনন্দে হৃদয় ভাঁসুক।
চলবে……………..?